ব্রাহ্মণবাড়িয়া: চ্যাপা-শুঁটকি

লালপুরের চ্যাপার সাথে চিন-পরিচয়

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার আশুগঞ্জ উপজেলায় মেঘনা নদীর পূর্ব পাশে অবসি’ত লালপুর গ্রাম; নদী লাগোয়া এলাকা চর-লালপুর গ্রাম নামেও পরিচিত বটে। ছয় বর্গকিলোমিটার এলাকা আয়তনের লালপুর গ্রামের বাজারটি অবস্থিত মেঘনা নদীর কূল ঘেঁষে। লালপুর বাজার ও তার আশপাশের বিশাল এলাকা জুড়ে গড়ে উঠেছে চ্যাপা-শুঁটকি প্রক্রিয়াজাতকরণ এলাকা। গত প্রায় ১০০ বছর ধরে এলাকায় চলছে এ ব্যবসা।

চ্যাপা-শুঁটকি (যাকে সিধলও বলা হয়) নামটা এসেছে এটা প্রক্রিয়াজাতকরণের বিশেষ পদ্ধতি থেকে। মাছ রোদে শুকানোর পরে মাটির মটকায় ভরে, পা দিয়ে থেঁৎলে, চেপে চ্যাপটা করে দীর্ঘদিন জারানোর পরে তবেই তৈরি হয় এই শুঁটকির-অধিক-শুঁটকি। অনেকটা বর্মী ঙাঁপির মতো এই শুঁটকি; দেশে-বিদেশে এর সমঝদার অনেক আর তাইতেই বেশ কয়েকটা জনপদের মানুষের জীবিকা চলে যাচ্ছে বহু বছর ধরেই। প্রসঙ্গত, উত্তরবঙ্গে সিধল বলতে আবার শুঁটকির আরেক রকম বোঝায়, যেখানে শুঁটকিটা কচুশাক আর আরো কিছু মশলার সাথে পিষে শুকিয়ে রাখা হয়।

আসলে চ্যাপা-শুঁটকিও দুই ধরনের আছে। একটি পুঁটি-সিধল অপরটি ফাইস্যা-সিধল, যে মাছটা চ্যাপা হচ্ছে তার নামে নাম। ফাইস্যা-সিধলটি হয় বৃহত্তর চট্রগ্রাম ও নোয়াখালীর সমুদ্র উপকূলবর্তী বিভিন্ন স্থানে। পুঁটি-সিধলটি হয় মিঠাপানির এলাকায়। পুঁটি-সিধলের একটি মূল ঘাঁটি লালপুর গ্রাম। ব্রাক্ষণবাড়িয়া সদর উপজেলার কিছু কিছু এলাকাসহ পুঁটি-সিধল আরো হয় হাওর-জেলা কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরে, আর মেঘনা ও তিতাসের তীরবর্তী জেলে-অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। অন্যদিকে চ্যাপার বড় ব্যবসা আছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম ও সৈয়দপুরে। উত্তরবঙ্গে বিশেষত বৃহত্তর রংপুর ও দিনাজপুরে চ্যাপার চাহিদা রয়েছে যা মেটাতে লালপুর থেকে চ্যাপা নিয়ে উত্তরবঙ্গে সরবরাহ করেন সৈয়দপুরের একদল ব্যবসায়ী।

লালপুরের চ্যাপা-শিল্পীদের দাবি তাঁদের গ্রামেরই যুগেন্দ্র চন্দ্র দাস ও শতিকা দাস পুঁটি-সিধলের ব্যবসার প্রচলন ও প্রসার ঘটিয়েছিলেন, এই পদ্ধতি লালপুরেরই জেলেদের দীর্ঘদিনের পরীক্ষানিরীক্ষার ফসল। এলাকার প্রায় ছয় হাজার লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে চ্যাপা-শুঁটকির প্রক্রিয়াজাতকরণ ও এর ব্যবসার সাথে জড়িত। প্রক্রিয়াজাত যাঁরা করেন তাঁদের প্রায় সবাই হিন্দু ধর্মাবলন্বী, জেলে সমপ্রদায়ের। লালপুর গ্রামে চ্যাপা-শুঁটকির সাথে জড়িতরা মূলত মাঝারি ও দরিদ্র অবস্থার, যথেষ্ট ধনী নন। এ কাজ করে দরিদ্ররা খেয়ে পরে চলতে পারেন আর মাঝারি শ্রেণীর জেলেরা বছরে ২০/২৫ হাজার টাকা সঞ্চয় করতে পারেন। একসময় এখানে শিক্ষার হার কম ছিল, এখন অবশ্য আয় বাড়ার সাথে সাথে শিক্ষার হারও বাড়ছে।

যে ভাবে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে

চ্যাপা-শুঁটকির কাজের সাথে জড়িত মানুষদের অভিজ্ঞতার কথা, তাঁদের সাফল্য আর সমস্যার ইতিহাস পর্যালোচনা করার জন্য যখন লালপুর গ্রামের জেলেপাড়ার মানুষদের অনুরোধ করলাম, প্রথমটায় তাঁরা খুব একটা আগ্রহ দেখাননি। পরবর্তীতে তাঁদেরকে একত্রে বসিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য যখন গেছি সময় নিয়েও অনেক সমস্যা হয়েছে। পরে তাঁদের সাথে বার বার কথা বলে তাঁদের সুবিধামতো সময় অনুযায়ী বসার চেষ্টা করেছি। শেষের দিকে অবশ্য তাঁরা উৎসাহী হয়ে নিজেরাই তথ্য সংগ্রহের কাজ করেছেন। এই কাজের বিভিন্ন ধাপের সাথে সংশ্লিষ্ট মানুষদের নিয়ে পৃথক পৃথক দলীয় আলোচনা করে প্রতিবেদনটি প্রস’ত করা হয়েছে। প্রথমেই পুরো কাজের প্রক্রিয়াটি বোঝার চেষ্টা করেছি, জানতে চেয়েছি এর উৎপত্তির কথা।

চ্যাপা-শুঁটকির ইতিবৃত্ত

লালপুরে মানুষের মুখে-মুখে ফেরে চ্যাপার জন্ম-ইতিহাস। এক সময় মেঘনা নদীতে জাল ফেললেই উঠে আসত ঝাঁকে ঝাঁকে পুঁটি। কিন’ যে পরিমাণ পুঁটি মাছ জালে ধরা পড়তো, সে পরিমাণ ক্রেতা পাওয়া যেত না। একশ বছর পূর্বে লোকসংখ্যা কম ছিল বলে জেলেরা মাছ বিক্রি করতে হিমশিম খেতেন। সেই থেকেই উদ্যোগ নেয়া হয় মাছ শুকিয়ে চ্যাপা করে শুঁটকি করার। এখন অবশ্য মেঘনায় পুঁটির অনটন। কিন’ চ্যাপা এখন যতটা না ঐতিহ্যের অঙ্গ তার চেয়ে বেশি মানুষের রুটি-রুজির প্রশ্ন। চ্যাপা করার পুঁটিমাছ যোগাতে তাই জেলেরা ছোটেন ভৈরব ফেরিঘাটের কাঁচা মাছের আড়তে।

মাছ আনার পর মাছগুলোর পেট কাটতে হয়। আর এ কাজটি করেন স্থানীয় জেলে পরিবারের মেয়ে-বৌরা। লালপুর গ্রামের পাঁচ শতাধিক জেলে-নারী এ পেশার সাথে জড়িত। মাছের পেট কাটার মজুরি হিসেবে তাঁরা পান মাছের তেলটুকু (চর্বি)। সেই তেল আবার চ্যাপা-ব্যবসায়ীরাই কিনে নেন। মাছের পেট কাটা হয়ে গেলে পুরুষ শ্রমিকেরা মাছগুলো নদীতে ধুয়ে ফেলেন। ধোয়ার পর মাছগুলোকে শুকানোর জন্য তোলা হয় ডাঙ্গিতে। বাঁশ দিয়ে মাটি থেকে প্রায় ৮-১০ ফুট উচুঁতে তৈরি করা মাচাকেই স’ানীয় ভাষায় ডাঙ্গি বলা হয়। আবার কেউ কেউ একে চাঙ্গারী বা খলা বলেন। বলা যায় পুঁটি-সিধল তৈরির প্রাথমিক কারখানা এই ডাঙ্গি। পাখিদের উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্যে ডাঙ্গি জাল দিয়ে ঢেকে রাখা হয়। বৃষ্টি থেকে শুঁটকি রক্ষার জন্য তৈরি রাখা হয় বিশাল পলিথিনের সামিয়ানা। প্রায় এক সপ্তাহ ডাঙ্গিতে রোদে-শুকানো মাছকে এঁরা বলেন আওলা মাছ।

পুঁটি কিনে আনা থেকে মটকাজাত করা পর্যন- এই জেলেপাড়ার মানুষরাই নানান ধাপে ব্যবসা করেন। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক মানুষের ব্যবসা মাছ কিনে এনে আওলা করে চ্যাপা-ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দেয়াতেই শেষ। অল্প দিনেই টাকা ফিরে আসে, আবার ডাঙ্গিতে মাছ তোলা যায়। কোনো ব্যবসায়ী হয়তো আবার শুধুই ডাঙ্গি বানিয়ে ভাড়া দেন। আবার কেউ কেউ আওলা মাছটা কিনে চ্যাপা করার কাজটা শুধু করেন। যে ব্যবসায়ীরা মাছ কিনে শুকানো থেকে শুরু করে মটকাজাত করা পর্যন- পুরো ব্যবসাটাই করেন তাঁদের সংখ্যা খুব বেশি না। সমস- প্রক্রিয়াটা চালাতে পুঁজি লাগে অনেক। প্রতি ধাপেই একেক রকম কাজের জন্য শ্রমিকও লাগে অনেক।

ডাঙ্গিতে শুকানোর পরে শুঁটকির রঙ ধরানোর জন্য ২০/২৫ মণ করে করে আওলা মাছ সতূপ করে রাখা হয় আরো কয়েকদিন। সেই সতূপ থেকে মূলত মাছ বিক্রি শুরু হয়ে যায়। আওলা মাছ চ্যাপা করতে এবার ডাক পড়ে সিধল-কারিগরদের। লালপুরের প্রায় ৪০০ কারিগর সিধল করায় দক্ষ। আওলা মাছগুলোকে ভিজিয়ে, ধুয়ে, পানি ঝরিয়ে এই কারিগরেরা সেগুলো বড়-মুখের মাটির মটকায় ভরে দুই পায়ে তা চেপে থ্যাঁতলা করেন, তারপর মুখ বন্ধ করে তা জারানোর জন্য রেখে দেওয়া হয়। যে ব্যবসায়ীরা চ্যাপা করে বিক্রি করেন, চ্যাপা কেনা থেকে শুরু করে সব মিলে মটকাপ্রতি তাঁদের মোট খরচ পড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা।

একেক মটকায় ৪০ থেকে ৪৫ কেজি চ্যাপা ধরে। এখানেই পুঁটি হয়ে ওঠে সিধল। আওলা মাছ ভরার আগে মটকার ভেতরে বেশ করে পুঁটি মাছেরই তেল মাখিয়ে রাখা হয়; মটকাপ্রতি প্রায় এক থেকে দেড় কেজি তেল প্রয়োজন হয়। তার স্থানীয় বাজার দর হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা। এই মটকাই হলো চ্যাপার দ্বিতীয় ধাপের কারখানা, যেটা বেশ সচল বা মোবাইল বলা চলে! ওই মটকা ঢাকার কারওয়ান বাজার, ময়মনসিংহ, বৃহত্তর চট্রগ্রাম, বৃহত্তর সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন স’ানে পাইকারি বিক্রি হয়। এমন কি এলসি-এর মাধ্যমে (লেটার অব ক্রেডিট, আমদানি-রপ্তানির বিশেষ সুবিধা) বিপুল পরিমাণ শুঁটকি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য ও যুক্তরাজ্যর লন্ডনে যায় প্রবাসী বাঙালি-রসনার মন-কেমন-করা তৃপ্ত করতে!

প্রতি বছরের আশ্বিন থেকে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত চলে মাছ ধরা থেকে মাছ শুকানোর কাজ। অগ্রহায়ণ মাস থেকে মাছ শুকানোর পাশাপাশি শুরু হয়ে যায় মটকাজাত করা, চলে ফাল্গুন মাস পর্যন্ত। কখনো কখনো এ কাজ চৈত্র মাস পর্যন্ত হয়ে থাকে। সাধারণত চৈত্র মাস থেকে ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয় বলে ফাল্গুন মাস পর্যন্তই এই কাজ হয়ে থাকে। বৈশাখ থেকে শুরু হয় চ্যাপা-শুঁটকি বিক্রি, চলে ভাদ্র মাস পর্যন্ত। আশ্বিন পড়তে পড়তে আবার নতুন করে চ্যাপা-শুঁটকির চক্র শুরু হয়ে যায়।

ধাপে ধাপে চ্যাপা

মাছ-কুটুনেদের কথা

কাজের প্রথম ধাপ অর্থাৎ মাছ কোটার কাজ যে মেয়েরা করেন, স্থানীয় ভাষায় তাঁদেরকে মাছ-কুটুনে কারিগর বলে। জেলে পরিবারের নানা-বয়সী নারীরাই মাছের তেলটুকু পারিশ্রমিকের বদলে এ কাজটা করেন। পাঁচ জন মাছ-কুটুনে নারীর সাথে দলভিত্তিক আলোচনায় বসেছিলাম: চরলালপুর গ্রামের বিনোদ চন্দ্র দাসের স্ত্রী প্রতিভা রাণী দাস (৪০), সত্যরঞ্জন দাসের স্ত্রী সাধনা রানী দাস (৩৫), সুকুমার দাসের স্ত্রী কানন বালা দাস (৩৬), বিকাশ দাসের স্ত্রী মীরা রাণী দাস (২৮), এবং গৌরাঙ্গ চন্দ্র দাসের স্ত্রী প্রতিভা দাস (৩২)।

প্রতিভা রাণী দাস কাজ শিখেছেন এ গ্রামে বিয়ে হয়ে এসে, “এ বাড়িতে যখন নতুন বৌ হয়ে আসি তখন দেখতাম বাড়ির অনেক মেয়েই এই মাছ কাটার কাজ করছেন। নতুন বৌ হওয়ার কারণে প্রথমে কাজ করিনি। কারণ মাছ কাটার কাজটি করতে হয় নদীর পাড়ে গিয়ে ডাঙ্গির পাশে বসে। তবে এখন গত পাঁচ বছর ধরে মাছ কাটছি। এক ঝুড়ি মাছ কাটলে এক কেজি তেল পাওয়া যায়। আর এক কেজি তেল বিক্রি করা যায় ৪০ থেকে ৫০ টাকায়।” তেলটা কিনে নেন চ্যাপা-ব্যবসায়ীরাই, সিধলের মটকায় মাখাতে। এলাকায় দুশর বেশি মহিলা মাছ কাটার সাথে জড়িত আছেন। সবাই ভোরবেলা নদীর পাড়ে গিয়ে মাছ কাটা শুরু করেন। দুই থেকে তিন ঘন্টা মাছ কাটলেই চলে। ঐ সময়ে এক ঝুড়ি মাছ কাটা যায়। প্রতিভা রাণী দাস জানান তাঁর উপার্জিত টাকা দিয়ে সংসারের বিভিন্ন কাজে সহায়তা করেন। মাঝে মাঝে তিনি এ টাকা জমিয়ে স্বর্ণালঙ্কারও ক্রয় করেন।

সাধনা রাণী দাস বলেন, “আমিও সবার দেখাদেখি মাছ কাটি। শুধু আমরা না, ১০-১২ বছরের মেয়েরাও এ কাজ করে। তবে এরা সবাই লেখাপড়াও করে। স্কুল বন্ধ করে কেউ মাছ কাটার কাজ করে না।” তিনি আরো বলেন, “এ কাজ করে এখন অনেকেই সংসার চালান। কেউ চাল-ডাল কেনেন আবার অনেকে স্বর্ণালঙ্কার কেনেন।” ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে প্রায় সব জেলে পরিবারের মেয়েরাই পুঁটি মাছ কাটতে যান । কেউ সংসার চালানোর জন্যই কাজটা করেন, কেউ বা হাতে দুটো পয়সা পাওয়ার জন্য, বাড়তি কিছু পুঁজি করার জন্য।

আলোচনায় অংশগ্রহণকারীরা আরো বললেন চ্যাপার জন্য পুঁটি কাটতে হয় বিশেষভাবে তৈরি দা দিয়ে। চ্যাপা মৌসুমের পুরো ছয় মাসই মাছ কাটার কাজ থাকে। মীরা রাণী দাস ও প্রতিভা দাস জানালেন এই ছয় মাস তাঁদের জীবন চিত্র পাল্টে যায়। ভোর ছয়টায় কাজে যেতে হয়, দুপুরে বাড়ি ফেরা। বেশির ভাগ সময়ই না খেয়ে কাজে যান, “অতো সকালে খাওন যায় না। আর খাওনডা বড় কথা না, কামডাই বড়।” অন্যরাও একই কথা বললেন। আশ্বিন থেকে ফাল্গুন – এই ছয় মাস বাদে বাকি সময়টা এই মহিলারা বেকার থাকেন।

ডাঙ্গি ব্যবসয়ীদের কথা

শুঁটকির মাচার মালিকরাই ডাঙ্গি-ব্যবসায়ী। লালপুর গ্রামের ডাঙ্গি ব্যবসায়ীদের দলভিত্তিক আলোচনায় জানা যায়, লালপুর বাজারের দক্ষিণ দিকে মেঘনার পূর্ব পাশে মৌসুমে প্রায় দুইশ ডাঙ্গি গড়ে ওঠে। ছোট-বড় আকারভেদে একটা ডাঙ্গি করতে খরচ পড়ে পাঁচ থেকে ২০ লাখ টাকা। আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন চরলালপুর গ্রামের মহেন্দ্রচন্দ্র দাসের পুত্র মণীন্দ্র চন্দ্র দাস (৬০), সুরেন্দ্র চন্দ্র দাসের পুত্র সত্যরঞ্জন দাস (৪৫), বিনোদ দাসের পুত্র পল্টু দাস (২২), সিরিষ দাসের পুত্র চিন্তাহরণ দাস এবং যাত্রামণি দাসের পুত্র হরেন্দ্র দাস (৫০)।

পূর্বপুরুষের এ ব্যবসায় মণীন্দ্র দাসের চুল পেকেছে, “হেই সিধলের ব্যবসা না থাকলি ইখানের অনেকেরই মুনিমুজুরি করতি হতো। ডাঙ্গির ব্যবসা করি বইলা অখন কইতে পারি আমি ব্যবসা করি। আর ইডাতো লাভজনক ব্যবসা। ফলে দেখাদেখি লালপুরে ব্যবসা বাইড়া গেছেগা।” তিনি জানান গত একশ বছর ধরে এখানে ডাঙ্গির ব্যবসা চলছে। প্রথমে এখানে কয়েকটিমাত্র ডাঙ্গি গড়া হতো। লোকসংখ্যা বাড়ার সাথে সাথে ডাঙ্গির সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এখন প্রতি বছর গড়ে যে শদুই ডাঙ্গি তৈরি হয় তার মধ্যে শখানেক ডাঙ্গিই ছোট, ৭০টির মতো মাঝারি এবং বাকী ৩০টি বড়। সব বছর অবশ্য একই রকম হয় না।

ডাঙ্গি স’াপনের জায়গাটি জমির মালিক থেকে ভাড়ায় নিতে হয়; জমিটি অবশ্যই নদীর একেবারে পাড়ে হতে হয়। ছয় মাসের জন্য জমি ভাড়া নেয়া হয়। ঐ জমিতে কোনো ফসল করা যায় না। জমিটি যেহেতু নদীর তীরে সেহেতু বাকি ছয় মাস পানির নিচে থাকে। ফলে ডাঙ্গি করার কারণে জমির মালিকও লাভবান হন। জমির আয়তন অনুযায়ী ভাড়া মৌসুমের জন্যও হতে পারে, মাস হিসাবেও। এক মৌসুমের ভাড়া যেমন – পাঁচ কাঠার জন্যে দশ হাজার টাকা, তিন কাঠার জন্যে ছয় হাজার টাকা। কেউ কেউ আরো ছোট ডাঙ্গিও করেন।

জমি বাদে ডাঙ্গি তৈরির প্রধান কাঁচামাল হচ্ছে বাঁশ আর জাল। এই বাঁশ দিয়ে মাটি থেকে আট-দশ ফুট উঁচু করে মাচার মতো তৈরি করে তার ওপরে মাছ শুকাতে দিয়ে তাতে জালের ঢাকা দেয়া পর্যন- মজুর খাটাতে হয়। সাতদিন পরে আউলা মাছ নামিয়ে সতূপ করতেও মজুর লাগে। বৃষ্টির জন্য তৈরি রাখতে হয় পলিথিনের বিশেষ সামিয়ানা। পুরো ছয় মাস পালা করে ডাঙ্গি রক্ষণাবেক্ষণ আর পাহারা দেওয়ার জন্যে আয়তন ভেদে দুই বা তার অধিক কর্মচারী রাখতে হয়। আছে ডাঙ্গি মেরামতের খরচ। পাঁচ কাঠার ডাঙ্গিকে বলা যায় মাঝারি, এতে একেকবারে ২০ থেকে ২৫ মণ পুঁটি মাছ শুকানো যায়। পাঁচ-কাঠার একটা ডাঙ্গিতে এক মৌসুমের অর্থাৎ ছয় মাসের খরচটা মোটামুটি এ রকম:

জমির ভাড়া – ১০,০০০/=

বাঁশ কমপক্ষে ২০০টি (প্রতিটি ১৫০/-)- ৩০,০০০/-

জাল- ১০,০০০/-

পলিথিনের সামিয়ানা- ৫,০০০/-

দুজন কর্মীর বেতন (জনপ্রতি মাসে ৩ হাজার টাকা)- ৩৬,০০০/-

ডাঙ্গি তৈরির শ্রমিক খরচ ও ডাঙ্গি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ- ২০,০০০/-

—————–

১,১১,০০০/- টাকা

যত বড় করে ডাঙ্গি তৈরি করা হয় খরচ তত বেড়ে যায়। তবে বড় ডাঙ্গি হলে এক সঙ্গে বেশি মাছ শুকানো যায়। যে ব্যবসায়ীরা শুধু ডাঙ্গি ভাড়া দেন, তাঁরা বড় ডাঙ্গি করলে লাভ বেশি পান। যাঁদের সামর্থ্য আছে তাঁরা সুতরাং বড় ডাঙ্গি দেন।

ডাঙ্গি গড়ার সময় প্রয়োজনীয় টাকা সংগ্রহ করতে ডাঙ্গি ব্যবসায়ীদের হিমশিম খেতে হয়। ব্যংক এই ব্যবসায় কোনো ঋণ দেয় না। ফলে বাধ্য হয়ে মহাজনদের কাছ থেকে দাদনে টাকা আনতে হয়। এক লাখ টাকা দাদনে আনলে মৌসুমে ২০-৩০ হাজার টাকা সুদ দিতে হয়। প্রবীণ মণীন্দ্র দাস মনে করেন সরকারি বা বেসরকারি উদ্যোগে মূলধনের ব্যবসা করে দিলে এটি শিল্পের মর্যাদা পেতে পারে।

চররামপুর গ্রামের ডাঙ্গির মালিক চিন-াহরণ দাস (৫০) জানান, ২৫-৩০ বছর যাবত ডাঙ্গির ব্যবসার সাথে তিনি জড়িত। বাপদাদার আমল থেকে পুরুষানুক্রমে এই পেশায় আছেন। ছোটবেলায় বাবার সাথে ডাঙ্গিতে যেতেন। তিনি বলেন, ডাঙ্গির ব্যবসার প্রধান সমস্যা মূলধনের। স্থানীয় মহাজনদের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা নিয়ে ডাঙ্গি গড়তে হয়। মহাজনের টাকা ফেরত দিয়ে খুব একটা মুনাফা থাকে না। তিনি বলেন, “তবু ভালো আছি। এ পেশায় না থাকলে জানে মারা যাইতাম। সারা বছর মন্দা লাইগ্যা থাকতো।”

আলোচনা-বৈঠকে মূলধনের সমস্যা ও দাদনের সমস্যার কথা আরো অনেকে উল্লেখ করেন। মূলধনের অভাবে একা একটি ডাঙ্গি দেয়া কঠিন হয়ে পড়ে। তাই একাধিক লোক মিলে ডাঙ্গি তৈরি করেন। কোনো কোনো ডাঙ্গির পাঁচ/সাত জন মালিক থাকে।

সিধল কারিগর

আওলা বা শুকানো মাছ সিধল বা চ্যাপা করতে মাছগুলোকে যাঁরা মটকায় ভর্তি করেন তাঁদেরকে স্থানীয় ভাবে সিধল-কারিগর বলা হয়। এমন পাঁচজনকে নিয়ে একটি আলোচনাচক্র করা হয়। এতে অংশগ্রহণ করেন চরলালপুর গ্রামের কৈলাশ দাসের পুত্র শচীন্দ্র দাস (৭৫), গিরীন্দ্র দাসের পুত্র লক্ষ্মীকান্ত  দাস (৪০), কামিনী দাসের পুত্র সচীন দাস, হরিচরণ দাসের পুত্র উপেন্দ্র দাস এবং চরলালপুরের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ মণীন্দ্র দাস (৯০)।

শচীন্দ্র দাস জানান, তিনি ৩০/৩২ বছর ধরে মটকা ভর্তির কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। একটি মটকা ভর্তি করলে ৫০ টাকা এবং একবেলা খাবার পাওয়া যায়। মটকা ভর্তির কাজটা করা হয় রাত তিনটা থেকে সকাল সাতটা পর্যন্ত তার আগে শুঁটকিকে পানিতে ভিজিয়ে রেখে ধুতে হয়। ভর্তির আগের দিন বিকাল চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে আওলা মাছ নদীতে ধুয়ে একটি নির্দিষ্ট স’ানে পানি ঝরতে দেয়া হয়। তারপর মাছ মালিকের গুদামে আনা হয়। গুদামে আনার পর সারারাতে মাছ বেশ শুকিয়ে যায়। এরপর রাত তিনটা থেকে শুরু হয় মটকায় মাছ ভর্তির কাজ। এই মটকাগুলো বিশেষভাবে তৈরি শুধুমাত্র শুঁটকির জন্য। এগুলোর পেট একটু বেশি মোটা এবং একটা মানুষের দু’পা ঢুকতে পারে এমনভাবে মুখ বানানো। ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়া এলাকার কুমাররা এই মটকা তৈরি করেন।

লালপুরের প্রায় চারশ লোক এই কাজে নিয়োজিত আছেন। এই কাজ চারশ পরিবারের আহার যোগায়। শচীন্দ্র দাস জানান, প্রতি রাতে একজন সহকারীসহ (স্থানীয় ভাষায় যোগালী) তিন/চারটি মটকা ভর্তি করা যায়। এক একটি মটকায় ৪০ থেকে ৪৫ কেজি মাছ ধরে। যত বেশি মাছ ধরানো যায় শুঁটকির জন্য ততোই ভালো। মটকায় ভর্তির সময়েই মাছটিকে চ্যাপা অর্থাৎ চাপে চ্যাপটা করা হয়। তিনি জানান “লালপুরের দেবেন্দ্র দাস (মৃত) আর অশ্বিনী দাস (১০০) এই কাজ প্রথম করেন। আমরা ছোট বেলায় দেখতাম ওনারা মটকার ভেতরে পা দিয়ে মাড়িয়ে শুঁটকি চ্যাপা করছেন। আর দেখতে দেখতেই আমরা হয়ে গেছি সিধল কারিগর।” মটকাগুলোর মুখ একজনের দুই পা ঢোকানোর মতো প্রশস- থাকে।

দলভিত্তিক আলোচনায় সিধল-কারিগর লক্ষ্মীকান্ত দাস জানান, তিনি ২০ বছর ধরে এই পেশায় যুক্ত আছেন। বাবার পেশা ধরেই তিনি এ পেশায় এসেছেন। প্রতিদিন চার/পাঁচটি মটকা ভরতে পারেন, সাথে একজন যোগালি নিতে হয়। একা করা সম্ভব হয় না। ধুয়ে ভরার আগে আউলা মাছ যত বেশি সময় পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয় মাছে ততো বেশি পানি ধরে । স’ানীয় ভাষায় এটিকে বলে ‘পানির তাল’। ‘পানির তাল’ বেশি হলে শুঁটকি পরে ওজনে বেশি হয় এবং ‘পানির তাল’ কম হলে শুঁটকির ওজন কম হয়। আবার ‘পানির তাল’ বেশি হলে মটকার ভেতরে শুঁটকি বেশি দিন রাখা যায় না, নষ্ট হয়ে যায় ওদিকে ‘পানির তাল’ কম হলে মটকার ভেতরের শুঁটকি বেশি দিন রাখা যায়। ফলে পানির তালের মাত্রার হিসাবটি চ্যাপা-শুঁটকির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কতদিন পরে খোলা হবে সেই আন্দাজে এঁরা পানির তাল হিসাব করেন। শুঁটকি ভর্তির পূর্বে মাছের তেল মটকাতে লাগাতে হয়। মাছের তেলের অভাবে সয়াবিন তেলেও চলে। তবে মটকায় মাছের তেল দিলে চ্যাপা শুঁটকি ভালো হয়।

মটকায় মাছ ভরার মূল মৌসুম হচ্ছে অগ্রহায়ণ থেকে ফাল্গুন মাস। এ ছাড়া সারা বছরই অল্প অল্প মটকা ভর্তি করা হয়ে থাকে। মটকা ভরার পর এগুলোকে তিন মাস/ চার মাস/ ছয় মাস/ এমনকি আট মাস পর্যন- গুদামে রাখা হয়। বিভিন্ন সময় দামের হেরফেরের কারণে যত দিন রাখা যায় তত লাভ হয়। এ গুদামগুলোও বিশেষ কায়দায় তৈরি করা। গুদাম ঘরের উপরের চালা এমনভাবে তৈরি করা হয় যাতে বৃষ্টির পানি বা কুয়াশা মটকার উপর পড়ে। এতে মটকার ভেতরের চ্যাপা শুঁটকি ভালো থাকে। তবে মটকা-ভরার কৌশল জানা না থাকলে মটকা খোলার পর মাছ অনেক সময় পচে যায়। এ জন্য মালিকের কাছে শিধল কারিগরকে দায়বদ্ধ থাকতে হয়। চ্যাপা খারাপ হলে মালিককে ক্ষতিপূরণ দেবার মতো সামর্থ্য কারিগরদের নেই। কারিগরদের ক্ষতি হচ্ছে পরবর্তীতে ওই কারিগর আর কাজ পাবেন না। তবে যে কারিগরের সামর্থ্য আছে তার কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়ের চেষ্টা করেন মালিকপক্ষ।

সিধল-কারিগর উপেন্দ্র দাস জানান ওজন বেশি করার জন্য শুঁটকিতে অনেক সময় লবণ মেশানো হয়। মটকায় ৩৫-৪০ কেজি শুঁটকি মাছ ভর্তি করা হলেও মটকা থেকে বের করার পর ওজনে ৫০ কেজি শুঁটকিও পাওয়া যায়। দলভিত্তিক আলোচনায় প্রায় একই তথ্য জানালেন শচীন্দ্র দাস ও মণীন্দ্র দাস।

চ্যাপা-ব্যবসায়ীদের কথা

চ্যাপা-শুঁটকি তৈরি হবার পর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে এর বাজারজাতকরণ। লালপুর থেকে সড়ক পথে ও নৌপথে শুঁটকি বাজারজাত হয়ে থাকে।

এই ব্যবসায়ীদের দলভিত্তিক আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন চর-লালপুর গ্রামের নরেশ দাসের পুত্র নিখিল দাস (৩৫), নগেন্দ্র দাসের পুত্র ভজন দাস (৪০), অনীল দাসের পুত্র সুনীল দাস (৪২), কৃষ্ণধন দাস (৪৫) এবং প্রাণতোষ দাস (৩৮)।

নিখিল দাস জানান, তিনি লালপুর বাজারে এ ব্যবসা শুরু করছেন পৈত্রিক সূত্রে। লালপুর বাজারে ডজনখানেক আড়ত রয়েছে। আড়তের মাধ্যমে শুঁটকি ব্যবসার সাথে যুক্ত আছেন প্রায় পাঁচশ ব্যবসায়ী। আর সরাসরি ভোক্তার হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য ছোট ছোট ব্যবসায়ী রয়েছেন প্রায় এক হাজার। নিখিল দাস বলেন, “চ্যাপা-শুঁটকির আড়তদারি প্রথম শুরু করেন সোহিম দালাল, নিত্যানন্দ বাবু, অধর বাবু, শরৎ বাবু এবং ভরত বাবু। তাঁরা মূলত কমিশন এজেন্টের কাজ করতেন অর্থাৎ তাঁরা মালটা ক্রেতার হাতে পৌঁছে দিতেন, সে বাবদ কমিশন পেতেন। কমিশন এজেন্টের ব্যবসা করে তাঁরা বিশাল অর্থবিত্তের মালিক হয়েছিলেন। তবে তাঁদের প্রত্যেকের নামের পাশে ‘দালাল’ শব্দটি যুক্ত হয়ে যায়। তাঁদের বাড়িও দালালবাড়ি নামে পরিচিত। অবশ্য তাঁদের কেউ এখন বেঁচে নেই।”

বর্তমানে অধিকাংশ বড় ব্যবসায়ী মুসলমান। তবে তাঁদের প্রায় সবারই জেলে পার্টনার বা অংশিদার রয়েছে। ছোট ব্যবসায়ীরা মূলত অ-মৌসুমে বড় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে স্বল্প পরিমাণে চ্যাপা-শুঁটকি কিনে নিয়ে খোলা বাজারে বিক্রি করেন।

চ্যাপা-শুঁটকির ব্যবসার কারণে লালপুরের যোগাযোগ ব্যবস’া খুবই ভালো। জলপথ ও স’লপথ দুই পথেরই সুবিধা রয়েছে। বৃটিশ আমলে এই মেঘনা দিয়ে জাহাজ এসে শুঁটকি বোঝাই করে কোলকাতা যেত। এখন মেঘনায় চর পড়ে যাওয়ায় আর জাহাজ আসে না, জানালেন নিখিল দাস। তবে নদী খনন করে এখনো মেঘনাকে জাহাজ চলাচলের উপযোগী করা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরো বলেন, চ্যাপা-শুঁটকিকে বিশেষভাবে রপ্তানিমুখী শিল্প হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে ব্যবসায়ী মহল ও সরকার উভয়েই লাভবান হতে পারে। এই শিল্পের জন্য কোনো নির্দিষ্ট ব্যাংক ঋণ নাই। স্থানীয় কয়েকটি বেসরকারি সংস্থা কিছু কিছু ঋণ দিলেও তা খুবই অল্প, তা দিয়ে বড় কিছু করা সম্ভব নয়। তিনি মনে করেন, সরকারের উচিত এ শিল্পের জন্য ঋণের ব্যবসা করা। এ ব্যবসার খারাপ দিক সম্পর্কে তিনি বলেন, চ্যাপা-শুঁটকি তৈরি হওয়ার সময় বৃষ্টি-বাদল থাকলে দুর্গন্ধের সৃষ্টি হয়, তখন চ্যাপায় এক ধরনের কীটের জন্ম হয়, মাছি আসে যা জনস্বাস্থ্যের জন্য সামান্য হলেও ক্ষতিকর হতে পারে। তিনি জানান বিজ্ঞানসম্মত পদ্ধতিতে শুঁটকি উৎপাদনের প্রক্রিয়া করলে এ সমস্যা থেকে উত্তরণ সম্ভব।

বিশ বছর ধরে শুঁটকির ব্যবসা করছেন ভজন দাস। আড়তের ব্যবসার সাথে সাথে চ্যাপা-শুঁটকির খুচরা ব্যবসাও করেন তিনি। গুদাম থেকে মটকা নৌকা, রিক্সা ও টেম্পু যোগে পাশ্ববর্তী বাইশ মৌজা, আশুগঞ্জ, ভৈরব, বড়াইলসহ বিভিন্ন বাজারে নিয়ে যান। বেচাবিক্রি শেষে রাতে বাড়ি ফেরার পথে অনেক ঝুঁকি নিয়ে আসতে হয়। নদীপথে চুরি, ডাকাতির সমস্যাই বেশি। ভজন দাস জানান, প্রতি কেজি চ্যাপা-শুঁটকির মূল্য একশ থেকে একশ পঁচিশ টাকা। মূলধনের অভাবে অনেক ব্যবসায়ীকেই বড় বড় আড়তদারের কাছ থেকে বাকিতে শুঁটকি কিনতে হয়। ফলে শতকরা পাঁচ থেকে দশ টাকা কম লাভ হয়।

চ্যাপা-শুঁটকি ব্যবাসায়ী সুনীল দাস বলেন, “আমি আওলা শুঁটকি কিনে লোক দিয়ে মটকা ভর্তি করি। পরে নিজের গুদামে মটকা রাখি। সুযোগ মতো পাইকারি বিক্রি করি। দেশের বিভিন্ন জেলায় আমার মটকা যায়। আমার বাবা ৫০ বছর এ ব্যবসা করেছেন। বাবার পথ ধরেই আমি এ ব্যবসায় এসেছি। বাবা অবশ্য এখন আর ব্যবসা করছেন না। আমাকে সহযোগিতা করেন।” সুনীল দাস জানান, চ্যাপা-শুঁটকির ব্যবসা খুবই লাভজনক। তবে বুঝেশুনে ব্যবসা না করতে পারলে লোকসানও হয়। যে বছর পুঁটি মাছ কম ধরা পড়ে সে বছর শুঁটকির প্রচুর চাহিদা হয়।

একই কথা বললেন ব্যবসায়ী কৃষ্ণধন দাস ও প্রাণতোষ দাস। ব্যবসায়ীরা তাঁদের ব্যবসা নিয়ে কথা বলতে চান না। অনেক কষ্টে উক্ত পাঁচ জন ব্যবসায়ীকে কথা বলতে রাজি করানো যায়। ব্যবসায়ীরা বলেন, চ্যাপা-শুঁটকি নিয়ে লেখালেখি হলে আয়কর অফিসের লোকজন এসে হয়রানি করে। তাই তাঁরা এ ব্যাপারে কথা বলতে চান না। স্থানীয় আড়তদাররা বলছেন, লালপুরে বছরে কম করে হলেও পাঁচ কোটি টাকার চ্যাপা-শুঁটকির লেনদেন হয়। তাঁদের হিসাবে প্রতি বছর প্রায় ৫০ হাজার চ্যাপা-শুঁটকির মটকা লালপুরের বিভিন্ন স্থানে গুদামজাত করা হয়। বৈশাখ থেকে আশ্বিন মাস পর্যন- এ ছয় মাসে এগুলোকে বিক্রি করা হয়।

পরিবেশ ও স্বাস্থ্যগত দিক

চ্যাপা দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করতে বা বিশেষ প্রয়োজনে পোকা-ধ্বংসকারী ডিডিটি (ডাইক্লোরো ডাইফিনাইল ট্রাইক্লোরোইথেন) ব্যবহার করা হতো। বর্তমানে ভোক্তাদের চাপের মুখে আর ডিডিটি ব্যবহৃত হয় না। তবে মাছির উপদ্রব থেকে বাঁচার জন্যে কীটনাশক ব্যবহার করা হয়।

সামাজিক সংগঠন, ঐক্য ও সঞ্চয়

চ্যাপার পুরো প্রক্রিয়াটির সাথে জড়িত মানুষরা এখন শিক্ষার দিকে ঝুঁকছেন। বর্তমান প্রজন্মের প্রায় সবাই প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে যাচ্ছে। তবে সামর্থ্যের অভাবে সবাই উচ্চশিক্ষা নিতে পারছে না। যাঁদের মূলধনের অভাব রয়েছে তাঁরা অন্য পেশায় ঝুঁকছেন। মাঘ-ফাল্গুন মাসের দিকে (প্রতিবছর) এঁরা সপ্তাহব্যাপী বা পক্ষকালব্যাপী হিন্দু ধর্মীয় উৎসব করে থাকেন। তখন উৎসব উপলক্ষ্যে যাত্রাগান,পালাগানসহ বিভিন্ন লোকজ ঐতিহ্য বিষয়ক অনুষ্ঠান হয়ে থাকে।

কি মালিক কি শ্রমিক, এঁদের কোনো রেজিষ্টার্ড সমিতি বা সংগঠন নেই। তবে নিজেরা তাঁরা ঐক্যবদ্ধ। লালপুর বাজারে অগ্রণী ব্যাংকে তাঁরা কেউ কেউ সঞ্চয় করে যাচ্ছেন। ছয় মাস মেয়াদী সমিতি করে নিজেরাও সঞ্চয় করেন। প্রতিদিন পাঁচ টাকা থেকে ৫০ টাকা পর্যন- তাঁরা নির্দিষ্ট একজনের কাছে জমা দিয়ে থাকেন। ছয় মাস পর পুরো টাকা তুলে নেয়া হয়। মধ্যবর্তী সময়ে স্বল্প সুদে আবার ঋণও নেয়া যায়।

চ্যাপা-শুঁটকি ব্যবসার সমস্যা ও সম্ভাবনা

চ্যাপা-শুঁটকি ব্যবসার প্রধান সমস্যা মূলধনের অভাব, বলছেন ব্যবসায়ীরা। মহাজনদের কাছ থেকে উচ্চ হারে সুদ দিয়ে মূলধন সংগ্রহ করতে হয়। ফলে মুনাফার একটি বড় অংশই চলে যায় মহাজনের দাদন শোধ করতে। প্রায় একই কথা জানালেন ডাঙ্গি মালিক পল্টু দাস ও সত্যরঞ্জন দাস। মহাজন হিন্দু মুসলিম দুই সমপ্রদায়ের মধ্যেই আছে। ঋণ গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রথমে তাঁরা হিন্দু ধর্মালম্বী মহাজনদের কাছে যান। ব্যর্থ হলে মুসলিম মহাজনের কাছে যান। একই সমপ্রদায়ের মহাজনদের কাছ থেকে ঋণ নিলে পরবর্তীতে টাকা ফেরত দেয়ার সময় একটু সুবিধা পান। সুবিধা বলতে অবশ্য একটু বেশি সময় পাওয়া।

লালপুর বাজারে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের শাখা রয়েছে। ব্যাংক ঋণ নিতে হলে জায়গা-জমি বন্ধক দিতে হয়। যাঁদের জায়গা-জমি নেই তাঁরা ঋণের কথা চিন্তাও করতে পারেন না। তাই চ্যাপা-শুঁটকি প্রক্রিয়ার সাথে জড়িত ব্যবসায়ী শ্রমিকসহ সকলের দাবি শিল্পঋণের মতো চ্যাপা-শুঁটকি ব্যবাসায়ীদের জন্য ঋণের ব্যবসা করা হোক। তাঁরা মনে করছেন লালপুরের চ্যাপা-শুঁটকি একটি লাভজনক রপ্তানি পণ্য হতে পারে; এতে লাভবান হবে দেশ তথা সরকার, পাশাপাশি উপকৃত হবে চ্যাপা-শুঁটকির সাথে জড়িত লালপুরের জেলে জনগোষ্ঠী।

 

 

 

এডিট- এসএস

Leave a Comment