বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, April]

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাস

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, April]

১৯৭২ সালের ২ এপ্রিল ঠাঁকুরগাঁওয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

মাননীয় সভাপতি সাহেব,

আমার ঠাঁকুরগাঁওয়ের ভাইয়েরা ও বোনেরা, আমার মনে পড়ে গণ আন্দোলনের পূর্বে আমি এখানে এসেছিলাম। কসাগাওয়া থেকে দিনাজপুর পর্যন্ত অনেক সভায় আমি বক্তৃতা করেছিলাম। আমাকে যখন পশ্চিম পাকিস্তানের জালেমরা ধরে পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমিতে নিয়ে যায়। আমি তখন জানতাম না যে, আপনাদের কাছে আবার ফিরে আসব। আমি জানতাম না আমার সোনার বাংলাকে আবার আমি দেখব। আমি জানতাম না আমার বাংলাদেশের সোনার মানুষের মুখ আমি দেখব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান | Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman : বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের এপ্রিল মাস
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান | Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman

যে বাংরার মাটিকে আমি ভালবাসি, আর যে বাংলা মাটি আমাকে ভালবাসে, যে বাংলার মানুষকে আমি ভালবাসি, যে বাংলার মানুষ আমাকে ভালবাসে, কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম, আমি জানতাম, আমার আত্মবিশ্বাস ছিল ফাঁসি কাষ্টের আসামী হিসেবেও জেলের মধ্যে কবর খোড়া সত্ত্বেও আমি জানতাম যে আমার বাংলার মানুষ স্বাধীন হবে এবং দুশমনের হাত থেকে আমার বাংলাকে রক্ষা করবে।

আমি আমার সাত কোটি লোককে যাবার বেলায় কিছুই দিয়ে যাবার পারি নাই। তাদের হাতে আমি অস্ত্র দিয়ে যাবার পারি নাই। তাদের দিয়েছিলাম নীতি, তাদের দিয়েছিলাম আদর্শ, তাদের দিয়েছিলাম নির্দেশ। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ জাতি ধর্ম নির্বিশেষে, দল মত নির্বিশেষে আমার পুলিশ বাহিনী, আমার পুরানো ইপিআর,  আমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা, আমার বাংলাদেশের ছাত্র-যুবক-কৃষকরা বিনা অস্ত্রে সেই পাঠানদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায় এবং আজ বাংলাদেশ স্বাধীন।

কিন্তু বড় রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা পাওয়া গেছে। এত রক্ত দুনিয়ায় কোন দেশে কোন জাত স্বাধীনতার জন্য দেয় নাই, যা আমার বাংলার মানুষ দিয়েছে। মানুষ যে এতো পশু হতে পারে, মানুষ যে এতো অসভ্য হতে পারে, মানুষ যে এতো অমানুষ হতে পারে যা পশ্চিমা খান সেনাদের মতো দুনিয়ার কোথাও এ রকম পয়দা হয় নাই। আমার লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে হত্যা করেছে, আমার লক্ষ লক্ষ ঘর-বাড়িকে জ্বালিয়ে দিয়েছে, আমার দুধের বাচ্চাকে হত্যা করেছে, আমার ধানের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে।

আমার পোর্ট গাড়ির রাইন ভেঙ্গে দিয়েছে, আমার টাকা আত্মসাৎ করেছে, আমার বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়ে গেছে। আমার মানুষকে ধরে ধরে নির্দয়ের মতো অত্যাচার করে হত্যা করেছে। দুনিয়ার মানুষ দেখে নাই যে কি অত্যাচার আমার দেশের উপর করেছে।

কিন্তু টিকতে পারে নাই খান সেনারা, টিকতে পারে নাই পশ্চিমা শোষকগোষ্ঠি, তেইশ বছর, চল্লিশ বছর পর্যন্ত আমার বাংলার পাটের টাকা, আমার বাংলার কৃষির টাকা, আমার বাংলাদেশের মানুষের খাজনার টাকা-আমার বাংলাদেশের মানুষের যা কিছু ছিল সব লুটপাট করে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তোলেছে। এর বিরুদ্ধে আমি প্রতিবাদ করেছিলাম বারবার। এর বিরুদ্ধে আমি রুখে দাঁড়িয়েছি। বাংলার মানুষ আমাকে সাহায্য করেছে। বেঈমানদের কাছে তবু মাথা নত করি নাই।

যাতে আমার বাংলার মানুষ দেখে তাদের নেতা মরতে পারে। সে মরলে সরাসরি মরবে, মাথা নত করে মরবে না। আমি যদি স্বাধীনতা না দেখে যাই, তারা আমার যে ত্রিশ লক্ষ ভাই বোনকে হত্যা করেছে, তারা এই স্বাধীনতা দেখে নাই। তারা জীবনে আর মায়ের কোলে ফিরে আসবে না। আপনারা জানেন আমার মনের অবস্থা কি?

আমি যখন সকাল বেলা বের হই তখন আমার ছেলেহারা মা, পুত্রহারা বাপ, স্বামীহারা মহিলারা আমার কাছে এসে বলে- ‘বাবা আমার ছেলেকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে, বাবা আমার স্বামীকে ধরে নিয়ে মেরে ফেলেছে। বাবা আমি বিধবা বিপর্যস্ত।

ত্রিশ লক্ষ লোক! একজন দুইজন নয়। এক পয়সার একবেলা খোরাকি পর্যন্ত তারা বাংলার মাটিতে রেখে যায় নাই। বৈদেশিক মুদ্রা না হলে দুনিয়ার কোথা থেকেও কোন জিনিস কেনা যায় না। বিশ্বাস করেন যেদিন থেকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ফিরা আইস্যা আমার ইচ্ছা ছিলনা যে আমি প্রধানমন্ত্রী হই। আমি প্রধানমন্ত্রী হয়ে কি হবে আমার? যে দেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষ জান দিয়া ভালবাসে একটি লোককে। তারচেয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব কি বড় হতে পারে?

আমি দেখলাম যে এক পয়সার বৈদেশিক মুদ্রা নাই, কোথা থেকে আমি খাবার আনব? কি করে আমার মানুষের মুখে খাবার দিব? কোথা থেকে আমি জিনিস পত্র কিনে আনব? কি দিয়ে আমি ঠাই দেব? কোথা থেকে আমি অর্থ পাব? যা দিয়ে আমি আমার মানুষকে সাহায্য করব, আমার কাছেতো এমন কিছু নাই। আমার কাছেতো আলাদিনের চেরাগ নাই। পশ্চিম পাকিস্তানীরা সব নিয়ে গেছে। আমি বললাম আমার কাপুরুষ হলে চলবে না।

আমাকে এদের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এদের যদি মৃত্যু হয়,তবে আমারও মৃত্যু হওয়া প্রয়োজন। ওদের দুখে আমি দুখী, ওদের সুখে আমি সুখী। ওরা আমার ভাই, আমি ওদের ভাই। দেখি কি করা যায়? চল দু’হাত তুলে চেষ্টা করে দেখি। আমার চিন্তা হয় বাংলার মানুষ সেদিন এককোটি লোক এই বাংলাদেশ ছেড়ে, ঘরবাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। একজন দুইজন নয়, এক হাজার দুই হাজার নয়, এক লক্ষ দুই লক্ষ নয় এক কোটি লোক বাংলা ছেড়ে, মাতৃভূমি ত্যাগ করে আশ্রয় নিয়েছিল ভারতে।

ভারতের জনসাধারণ তাদের সাহায্য করেছিলেন, তাদের আশ্রয় দিয়েছিলেন, তাদের খাবার দিয়েছিলেন, তাদের স্থান দিয়েছিলেন। আমরা বাঙ্গালীরা অকৃতজ্ঞ নই, নিশ্চই তাদের আমরা সাধুবাদ জানাব।

স্বাধীনতার পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ৫ লক্ষ টন খাবার দিলেন-তিনি কিছু টাকা দিলেন যা দিয়ে সরকার চালানো শুরু করা হলো। তিনি কিছু মালপত্র দিলেন, যা দিয়ে কারখানা চালানো আরম্ভ করা হলো। তিনি কিছু লোক দিলেন যা দিয়ে রেল লাইনগুলো চালু করা হলো। বলেনতো তার কাছে অকৃজ্ঞ কেমনে হই। আমি মানুষ। বাঙ্গালী নেমক হারাম নয়।

যখনি এবার আসলেন ঢাকায়। আমি তখনই তাকে বললাম-শ্রীমতি গান্ধি, তুমিতো আমাকে পাঁচ লক্ষ টন খাবার আমাকে দিচ্ছ, কিন্তু আমার যে আরো খাবার দরকার, আমি কোথা থেকে আনব? তুমি কি আমাকে আরো খাবার দিতে পার না? কাইল যখন আমি খুলনা থেকে ফিরে আসলাম, আমি তার কাছ থেকে চিঠি পেলাম যে, তোমাকে আমি আরো দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টন খাবার আমি দিব।

আমি আপনাদের পক্ষ থেকে ভারতের জনসাধারণকে এবং তাদের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীকে মোবারকবাদ জানাই। জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমি যখন দেখলাম এদেশে কিছু নাই, ওদের যদি খাজনা আদায় করতে যাই ওরাতো শেষ হয়ে যাবে। আমি বললাম যাও ওদের বকেয়া খাজনা সব মাফ করে দিলাম। মানুষ গরু ছাগল কিনতে পারে না।

কোথায় পাবো? দাও দশ কোটি টাকা? যেখান থেকে পারি, আমি ভিক্ষা করে আনব। দিয়ে দাও, সবকিছু তছনছ করে নিয়ে গেছে। খাজনা না দিলে সরকার কি দিয়ে সরকার চালাবে? কে দেবে? কোত্থেকে দেবে? সব মাফ করে দিয়েছি। পয়সা কোত্থেকে আনবে? পার্ট চালান দিব। আমার যেগুলো পোর্ট আছে চট্টগ্রাম চালনা পোর্ট। জাহাজ আসতে পারে না ভালোভাবে। জাহাজগুলো ডুবাইয়া দিয়ে গেছে নদীর মুখে, যাতে জাহাজ না আসতে পারে?

না খেয়ে মরে যাবো তবু গোলামের গোলামী করব না। ভূলে যান! তোমরা পারলে প্রায়চিত্ত্ব করো। জীবনভর প্রায়শ্চিত্ত্ব করো। কিন্তু মনে রেখো যারা আমার বাংলাকে, যারা আমার মা-বোন হত্যা করেছে। যারা আমার মা-বোনকে পাশবিক অত্যাচার করেছে। তাদের বিচার হবে বাংলার বুকে।

আমি যাবো রাশিয়া। ভিক্ষা দাও। আমি যাবো ভারতে, ভিক্ষা দাও। আর চোরের দল এদেশ থেকে বর্ডার পার করে দেয়। আপনারা আমার জন্য খুন হয়েছেন। আমার জন্য ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছেন। আমার কাছে ওয়াদা করেন যে, চোরের গোষ্ঠি নিপাত করে দিতে হবে। রাজী আছেন কিনা? আর জিনিসের দাম বাড়াবা না, তোমাদের বলে দিচ্ছি আমি, মুজিবর রহমান। ভালো মানুষ-সত্যি কথা, নরম দেল সত্যি কথা।

কিন্তু মানুষের জীবন নিয়া ছিনিমিনি খেললে মেশিনগান চালাইয়া দেবার হুকুম দেবার জন্য এক মুহুর্তে দেরী করিবো না। আপনারা মেহেরবাণী করিয়া জিনিসের দাম কমান। জিনিস যদি পাওয়া যায়, তবে দাম বাড়বে কেন? আমি তাতো বুঝিনা। আপনারা দেখছেন যে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা কিনেছি।

৩০ লক্ষ লোকের রক্ত কিনতে কত টাকা লাগে! তাই বাবু কইয়া দেরে কার কাছে যাবো। আজ আড়াই মাস হলো। আড়াই মাস। আমি একটা দিন বিশ্রাম নিতে পারি নাই। বিশ্রাম কারে কয় আমি জানি না। আমি চিন্তা করছি, চিন্তা করলে আমি শিহরিয়া উঠি। কি করে আমার দুঃখী মানুষের, মা বোনের মুখে হাসি ফুটাবো? আর চোরা কারবারী, বদমায়েশি, বাংলার বুকে বইসা বছর বছর দাম বাড়াইয়া দেয়।

আমার সংগ্রামী ভাইয়েরা, আমার বাংলার জনসাধারণ, আমার ঠাকুরগাঁয়ের জনসাধারণ তোমরা আমাকে ভালবাসো কিনা? যদি ভালোবাস তবে এই চোরাকারবারীদের শেষ করতে হবে। যেমনী আমার কথায় অস্ত্র ধরেছিলা, দরকার হলে তোমাদের আবার আমি লাঠি ধরতে বলব। চোরাকারবারীর গোষ্ঠি আমি বাংলা থেকে নিপাত করে দিব। ঠিক মনে ধরেছে, আপনারা সাহায্য না করলে পারব না।

আমার শতকরা ৬০ জন পুলিশকে মাইরা থুইয়ে গেছে। আমার শতকরা ৬০ জনের মতো, আমার বাংলাদেশ রাইফেলের জোয়ানদের মেরে ফেলে দিয়ে গেছে। আমি মিলিটারি দিয়ে দেশ শাসন করতে চাইনা। আমি পুলিশ দিয়ে দেশ শাসন করতে চাইনা। আমি চাই বাংলার জনগণের সাহায্য নিয়ে দেশ শাসন করতে। ওরা থাকবে, ওরা বাংলার সন্তান। কিন্তু আপনাদের এগিয়ে যেতে হবে আগে। আপনাদের কাজ করতে হবে। আরে, দুনিয়ায় আমি এমন এমন মানুষ দেখি নাই। আশ্চর্য হয়ে যাই!

মানুষেরতো একটু বোঝা উচিৎ যে এত রক্তের পরে স্বাধীনতা এসেছে। আজ চোরাকারবারীরা, ঠাঁকুরগাঁয়ের ভাইয়েরা, আজ একটা কথা জিজ্ঞাসা করি আপনাদের কাছে। যারা অন্যায় করেছে নিশ্চই তাদের সাজা হওয়া উচিৎ। কিন্তু যারা নিরাপরাধ তারা যেন সাজা না পায়। আপনাদের ঠাকুরগাঁয়ে একটা প্রবলেম হয়ে গেছে, কিছু লোক এখানে এসে বাসিন্ধা হয়েছিল।

আমি জানি কিছু খান সেনাদের সাথে মিশে আপনাদের অত্যাচার করেছে। তাদের বিচার করা হবে। তাদের গ্রেফতার করা হবে। কিন্তু যারা নিরাপরাধ, ঘর-বাড়ি ত্যাগ করে চলে গেছে, তাদের থাকতে দিতে হবে-রাজি? এভাবে না, হাত তুলে বলতে হবে। আমি কি করে তাদের খাওয়াব? যাইয়া হেহী চাপাই নবাবগঞ্জে ৫০ হাজার উদ্বাস্তু। একটা শহরে যদি ৫০ হাজার লোক আইসা বসে! সে দেশের লোক কি বাঁচবে?

সেখানে ৫০ হাজার লোক চইলা গেছে। তারা আমার কাছে আইসা কান্দে-আমরা কি করে খাওয়াব? আমরাইতো না খেয়ে মরছি। তাদের থাকতে দিতে হবে। আর যারা বদমাশি করছে, তাদের আমি বলে দিচ্ছি-ঐ জেল পুড়লেও আমি তাদের আরেকটা জেল করে, তাদের ভরতে হবে। কোন চিন্তা করবেন না। যারা অন্যায় করছে, তাদের ফল ভোগ করতে হবে। আপনারা নিরাপরাধ ও নিরাশ্রয় যারা তাদের, তাদের আপনার ভাই মনে করে মার্জিতভাবে আশ্রয় দিবেন।

ভাইয়েরা বোনেরা, দেশ শুধু একজনের নয়। আপনাদের কৃষির উন্নতি করতে হবে। সাত কোটি লোক, দশ কোটি টাকার বেশী টাকা দিব। ওর মধ্যে কষ্ট টষ্ট করে চালাইতে হবে। দেবার পারব না। আপনারা মুজিবর রহমানকে চিনেন, মিথ্যা কথা দেয়না। মিথ্যা ফাদ আমি চাই না। আমি মিথ্যা কথা বলে মানুষকে ধোকা দিতে পারব না।

যা অবস্থা খান সেনারা বাংলায় করে গেছে! সে জায়গা ফিরে আসতে আমার কমছে কম দশ বৎসর সময় লাগতো। কিন্তু আমি আশা করি তিন বছরে সে জায়গায় ফিরে আসতে পারব। এই তিন বৎসর আমি কাউরে কিছু দেবার পারব না। যদি পান, মনে করবেন, কিছুমতের জোড়ে পাইছেন।

যদি বলেন দিতে হবে, আমি বলব আসসালামুয়ালাইকুম। আমি দেবার পারব না। আমি খাজনা মাপ কইরা দিচ্ছি। যা আমার হাতে আছে সেটা মাপ কিন্তু যা নাই দেবার পারব না। স্বাধীনতার অর্থ বিশৃংখলা নয়। যুবক ভাইরা শৃঙ্খায় থেকো।

যুবক ভাইয়েরা গ্রামে গ্রামে যাও। লেখা-পড়া শিখ। তোমাদের ভবিষ্যতে দেশের নেতৃত্ব দিতে হবে। ভবিষ্যতে দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করতে হবে। ভবিষ্যতে তোমাদের বড় বড় চাকুরী করতে হবে। দেশ তোমার, তাকে গড়তে হবে। লেখাপড়ার দিকে একটু মনোযোগও দাও।

আপনারা জানেন যে এই যে বড় বড় ব্যাংক যা বাংলাদেশে ছিল-আজ তা বাংলার ছয় সাত কোটি লোকের সম্পত্তি। এখন আর দু একজনের সম্পত্তি না। যাকে বলে ব্যাংক জাতীয়করণ। এখন এই ব্যাংকগুলো যার মধ্যে চাবি। যা নিয়ে ভুড়িওয়ালা আরো ভুড়ি পয়দা করে আর গরীব আরো গরীব হয়। এই জায়গায় আমি প্রথম আঘাত করেছি।

তারা কিন্তু বসে থাকবে না। এটাকে বানচাল করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র করবে। আপনাদের হুশিয়ার হতে হবে। আমি আপনাদের সাথে, আপনারা আমার সাথে থাকবেন। যদি ভুড়িওয়ালারা রাত্রে, পয়সা দিয়ে অতি বিপ্লবী কথা কয়, তাদের কেমন করে দমন করতে হয়-তা বাংলার মানুষ জানে। জানেন না? একটু ভালো করে রেডি হয়ে থাইকেন। আমি হুকুম দিয়ে বসতেও পারি তা বলা যায় না। আমি লোকটা একটু সোজা মানুষ।

আমার বড় বড় কল-কারখানা। ব্যাক্তিগত সম্পত্তি যত ছিল, সেগুলোকে জাতীয়করণ করে সাতকোটি লোকের সম্পত্তি করেছিল। যতগুলো চটকল ছিল, সব এখন বাংলার সাড়ে সাতকোটি মানুষের সম্পত্তি। আমি জাতীয়করণ করে বাংলার মানুষকে দিয়েছি। ফসল উৎপাদন করেন, চেষ্টা করেন।

আমাকে বলে যে পাম্প নাই। আমি বললাম যে পাম্প নাই সত্যি নাই। গর্ত করো। পানি উঠাও। কাজ করো-ফসল উৎপাদন করতে হবে। ভিক্ষুকের জাত হয়ে আমি বাঁচতে চাইনা। আমি মাথা নত করে আরো কাছে ভিক্ষা চাইনা। আমি চাই আমার মানুষ, ভবিষ্যৎ বংশধর সুখী হউক।

ভাইয়েরা আমার, আপনাদের ধন্যবাদ জানাই, অনেক রৌদ্রের মধ্যে কষ্ট করেছেন। আসুন আমার সঙ্গে হাত মিলান। একটা মোনাজাত করেন। যে সব ভাইয়েরা শহীদ হয়েছেন, তাদের আত্মার মাগফেরাৎ কামনা করেন (বসেন আপনারা)

ভাইয়েরা আমার, অনেক রক্তের বিনীময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ওদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, সেটিই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ। সেদিনের সংগ্রাম ছিল স্বাধীনতা সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম হবে দেশ গড়ার সংগ্রাম। বাংলার মানুষ যদি পেটভরে ভাত খায়। বাংলার মানুষ যদি শান্তিতে বাস করে। কিন্তু বাংলাদেশ যদি দূর্নীতিতে ভরে যায়।

বাংলায় যদি শোষণহীন সমাজ গঠন না হয়। তাহলে আমি বিশ্বাস যারা শহীদ হয়ে মারা গেছে-ওদের আত্মা শান্তি পাবে না। তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ যে, আপনারা সকলে কাজ করেন, দেশকে গড়ে তোলেন। আমি বলে দিচ্ছি পরিস্কার কথা-কিচ্ছু আপনারা আশা করবেন না যে তিন বৎসরের মধ্যে আমি দেব।

আপনাদের নিজেদের কাজ করে খেতে হবে। আমি ভিক্ষা করে এনে যা পারি আপনাদের পৌঁছাবো। ডাকাতেরা যাতে না খেতে পারে সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আবার আপনাদের ধন্যবাদ দিয়ে ঠাকুরগাঁ ভাইদের ধন্যবাদ দিয়ে, জানি আমি ঠাকুরগাঁয় অপরাধ হয়ে গেছে। ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিচ্ছি। খোদা হাফেজ।

 

১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজের জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার,

আপনারা স্বাধীনতা পেয়েছেন। আমরা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক। বাংলাদেশ আজ সার্বভৌম স্বাধীন দেশ। কিন্তু দুনিয়ায় কোন দেশ, দুনিয়ার কোন জাতি এত রক্ত দেয় নাই, যা আমার বাঙ্গালীরা দিয়েছে। ত্রিশ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে এই বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য। এমন একটা অসভ্য দেশের সঙ্গে আমাদের বন্ধুত্ব ছিল যে পশ্চিম পাকিস্তানকে এখন পাকিস্তানবলা হয়। তাদের সামরিক বাহিনীর লোকেরা প্রচন্ড লুণ্ঠন, তারা আমার লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে হত্যা করেছে। তারা আমার ছেলে-মেয়েকে হত্যা করেছে।

তারা আমার সামরিক বাহিনীকে হত্যা করেছে। তারা আমার রক্ষী বাহিনীকে হত্যা করেছে। তারা আমার ই.পি.আরকে হত্যা করেছে। তারা আমার কৃষকদের হত্যা করেছে। তারা ছাত্রদের হত্যা করেছে। তারা আমার রাস্তাঘাট ধ্বংস করেছে। তারা আমার চাউলের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। তারা আমার সব কিছু ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। তারা আমার পোর্ট বন্ধ করে দিয়ে গেছে। তারা আমার রেল লাইনকে নষ্ট করেছে। তারা আমার পোষ্ট অফিসকে ধ্বংস করেছে। তারা আমার বৈদেশিক মুদ্রা চুরি করেছে।

তারা আমার স্বর্ণ লুট করে নিয়ে গেছে। তারা আমার টাকার নোট জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। এমন একটা দেশ, যে দেশ আমি পেলাম। আমি এসে দেখলাম, আমার উপর ক্ষমতা দিল। আমি দেখলাম, একটা ধ্বংসের স্তুপ। আমি জানি না এদের কি করে আমি বাঁচাব। আমি জানিনা এদের কি করে আমি ভাত দেব? আমি জানি না কি করে এদের আমি কাপড় দেব। আপনারা জানেন আপনাদের দেশের অবস্থায়। আপনারা জানেন কি সর্বনাশ হয়েছে এই বাংলাদেশের। স্বাধীনতা পেয়েছি সত্য কিন্তু কিছুই পাই নাই, আমি চিন্তা করে কূল পাই নাই।

কেমন করে আমি বাংলাদেশের লোককে বাঁচাব। ত্রিশ লক্ষ লোক মারা গেছে মায়ের কোল খালি হয়েছে। বোন বিধাব হয়েছে। সব সর্বশান্ত হয়েছে। আড়াই কোটি লোকের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে পশুর দল। মনে করেছে আর একদল বাঙ্গালী রাজাকার, আল বদর নামে পশ্চিমাদের সঙ্গে যোগদান করে আমার বাংলার গরীব দুঃখীদের হত্যা করেছে। রাজাকাররা মনে করেছে যে তাদের ক্ষমা হবে। নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন রাজাকার, আলবদর, যারা খুন করেছে, তাদের ক্ষমা হবে না।

তাদের বিচার হবে নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন আপনারা। আপনারা দুশ্চিন্তায় ভুগছেন বিচার হবে না, বিচার হবে, ভাল করে বিচার হবে। যে সমস্ত বিগ্রেডিয়ার কর্ণেল আমার বাংলার মা-বোনকে হত্যা করেছে, তাদের এই বাংলায় বিচার হবে।…

আমি মিথ্যা ওয়াদা করতে পারি নাই। আমি মিথ্যা ওয়াদা জীবনে কোনদিন করি নাই। আমি আপনাদের ভোট নিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে। আমি বলেছিলাম ৭ই মার্চ তারিখে-‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ আপনারা…। ২৫শে মার্চ তারিখে আমাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। আমি আপনাদের কাছে অস্ত্র দিবার পারি নাই। আমার যারা সিপাই ছিল তাদের কাছে থ্রি নট থ্রি গান ছাড়া আর কিছুই ছিলনা।

আর যারা জনসাধারণ ছিল তাদের কাছে কিছুই ছিল না। থ্রি নট থ্রি দিয়ে এই সামগ্রিক বাহিনীর বিরুদ্ধে মোকাবেলা করেছে আমার ছেলেরা, আমার বোনেরা। ফায়ারগুলি আজ দেখেছে, বাঙ্গালিরা কাপুরুষ নয়, বাঙ্গালী যুদ্ধ করতে পারে। বাঙ্গালী যুদ্ধ করতে জানে। বাঙ্গালী মরতে জানে, বাঙ্গালী মারতেও জানে। আপনাদের কাছে আমি কি বলব, আমি আড়াই মাস হলো জেল থেকে এসেছি। আড়াই মাস। আমাকে বাধ্য হয়ে প্রধানমন্ত্রীত্ব নিতে হয়েছে। কারণ আমি যে ষড়যন্ত্রকারীরা এখনো স্বাধীনতাকে নসাৎ করার চেষ্টা করছে।

ত্রিশ লক্ষ লোক যদি স্বাধীনতা পাওয়ার জন্য জান দিয়ে থাকে। যদি কেউ বলে আপনাদের এই করব, ওই করব, এই করব। যা সর্বনাশ করেছে জানেন আপনারা চট্টগ্রাম। আল্লাহর মর্জি আমি গিয়েছিলাম, সমস্ত জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে গেছে মুখের মধ্যে, জাহাজ সহসা আসতে পারে না। একটা চ্যানেল আছে যা দিয়া জাহাজে আসে। জাহাজে যদি মাল পাঠাতে না পারি, আর মাল আনতে না পারি। আপনাদের কোত্থেকে আমি দেবো, আমি কিছুই তিন বছর আপনাদের দেবার পারব না, রাজি আছেন? ও হবে না, হাত তুলে দেখাতে হবে, রাজী আছে কিনা। হ্যাঁ দেয়া হবে।

কোন মানুষ এদেশে আমার বাংলায় না খেয়ে থাকবেনা সে বন্দোবস্ত আমি করেছি। আমার বন্ধু রাষ্ট্র ভারতরাষ্ট্র শ্রীমতি গান্ধী ৫ লক্ষ টন খাবার আগে দিবেন কয়ে গিয়েছিলেন, পরে আবার আমাকে খবর দিয়েছিলেন, আরো আড়াই লক্ষ টন খাবা দিবেন। আমি বার্মার থেকে চাল কিনেছি। রাশিয়া আমাকে খাবার দেয়ার জন্য বলেছেন। জাপান থেকে কেনার বন্দোবস্ত করতাছি। জাতিসংঘ আমাকে খাবার দিবে বলে ওয়াদা করেছেন। ইনসাল্লাহ্ যদি একবার আমার সমস্ত কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়, খাবার অভাব হবে না। তবে চুরি করে যদি কেউ খায় তার নাড়ী কেটে ফেলে দিতে হবে।

একদল লোক জিনিসের দাম বাড়ায় দিয়েছে। তেলের দাম, কাপড়ের দাম, সাবান। আজকে আমি একটা ঘোষণা করতে চাই। আমি আগে করি নাই। আমি আস্তে আস্তে চাবাই। এই বাংলাদেশে যত ডিষ্ট্রিবিউটর আছেন। যত হোল সেলার আছেন। যত এজেন্ট আছেন, তেলের, নুনের, সাবানের, কাপড়ের যা কিছু হউক, যদি সাত দিনের মধ্যে দাম না কমে, সমস্ত ডিলার আমি ক্যানসেল করে দেব। সমস্ত ডিস্ট্রিবিউটর এজেন্টকে আমি ক্যানসেল করে দিব।

প্রত্যেক ইউনিয়নে ইউনিয়নে একটা করে আমি প্রপার ডিলক্টের করব। তোমাদের আমি ব্যবসা করতে দিয়েছিলাম, কিন্তু বাংলার মানুষকে আমি লুট করতে দেই নাই। তোমাদের আমি বলে দিচ্ছি যদি জিনিস পাওয়া যায় তবে কেন জিনিসের দাম বেশী হবে? ক্যানসেল হয়ে গেছে। কেরোসিন তেল আছে, অমনি বোতলে কমাইয়া দিয়া দাম বাড়াইয়া দেয়, এ এজেন্সি ক্যানসেল হয়ে যাবে। মুজিবর রহমান বলে দিচ্ছে, এ এজেন্সি ক্যান্সেল।

এই বাংলাদেশের মানুষ রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছে। বাংলার মানুষ জীবন বাজী রেখে আমাকে ফাঁসির কাষ্ট থেকে নিয়ে এসেছে। আমি প্রধানমন্ত্রী হই নাই প্রধানমন্ত্রীত্ব করার জন্য। আমি প্রধানমন্ত্রী হয়েছি এদেশের মানুষের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য। ভূলে যান। আমি ভূড়িওয়ালাদের পেট কাইটা দিছি। ব্যাংক, ইন্সুরেন্স কোম্পানী, বড় বড় পাটের কল, সব পাটের কল, সব কাপড়ের কল, সব চিনি কল, আজ প্রায়……। যত বকেয়া খাজনা ছিল সুদসহ সব মাপ কইরা দেয়া হয়েছে। ২৫ বিঘা জমির মালিক আপনারা হবেন। ২৫ বিঘা জমির খাজনা মাপ কইর দিয়াছি।

আমরা শতকরা ৬০ জন পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমার শতকরা ৬০ জন যুবকের ছিল না রাইফেল। এদের ইষ্ট পাকিস্তানরাইফেল বলা হতো। আমরা বলি বাংলাদেশ বিডিআর,তাদের শতকরা ৬২ জন লোককে হত্যা করেছে। আমার সামরিক বাহিনীর ছেলেরা যারা বাংলাদেশে ছিল। তাদের শতকরা ৬৫ জনকে হত্যা করেছে। আইন-শৃংখলা, আমি বলেছি যে তোমরা আমার কাছে অস্ত্র জমা দাও। প্রায় সোয়া লক্ষ লোক আমার কাছে অস্ত্র জমা দিয়েছে।

চোর-ডাকাত-গুন্ডা কিছু অস্ত্র রেখে দিয়েছে সামান্য সামান্য, তাদের আমি বলেছি- সময় থাকতে ভদ্র মানুষের মতো, ভাল মানুষের মতো জমা দিয়ে দাও, না হলে উপায় থাকবে না। আর যদি গ্রামে গ্রামে চুরি ডাকাতি করে বন্দুক নিয়া। আমি তাদের বলে দিয়েছি, পুলিশকেও বলে দিয়েছি যারা বন্দুক নিয়ে গুলি চালাইয়া ডাকাতি করবার চেষ্টা করবে সোজা গুলি চালায়া দিয়া হত্যা করবে আমার আপত্তি নাই। ময়মনসিংহের ভাইয়েরা, পুলিশ দিয়া হবে না। বদর ফদর বাহিনী যা পাবে এদের ধইরা এরেস্ট করবা। ওদের আমি বিচার করব।

তবে একটা কথা আছে, নিরাপরাধ মানুষ যেন নিজের সঙ্গে শত্রুতামি আছে বলে সাজা না পায়। আর যারা অন্যায় করেছে তাদের আপনাদের সাজা দিতে হবে। আমি নিরাপরাধ মানুষের সাথে তা করতে চাই না। আমি এখনও মাঝে মাঝে, আচ্ছা আপনারা কাসিম দেখছেন, কাসিম, কাসিমের মতো মাথা বার করে, ওরা আপদ বিপদ দেখলে পেটের মধ্যে মাথা নিয়ে যায়। আর যেই দেখে মানুষ নাই অমনি মাথা বাহির করে।

তাই আমি আপনাদেরকে অনুরোধ করছি যে, আপনারা গ্রামে গ্রামে আমার ভাইয়েরা পুলিশের উপর নির্ভর করে আমি সমাজ রক্ষা করতে চাই না। আমি জনগণের সাহায্য চাই। জনগণকে নিয়েই আমি স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করেছিলাম। আজ জনগণকে নিয়েই আমি সংগ্রাম করতে চাই, দেশ গড়ার সংগ্রাম। এভাবে যেন শান্তি শৃঙ্খলা বজায় থাকে। আপনারা রাজী আছেন কিনা? আপনারা রাজী আছেণ?  গ্রামে গ্রামে চোর ডাকাত ধরবেন? আরেকটা কথা রয়ে গেল……।

আমি বলে দিয়েছি আপনারা বর্ডারে বর্ডারে আপনারা গণ কমিটি গঠন কুন। আওয়ামী এবং ভলান্টিয়ার বাহিনী থাকবে, আমি বাংলাদেশ রাইফেলের লোককে পাঠিয়ে দিয়েছি তাদের সাহায্য সহযোগিতা করবেন।

মনে রাখবেন, সেদিনের সিপাই নয়। এরাও এদেশের মাতৃভুমির স্বাধীনতার জন্য বন্ধুক না নিয়েও বিপ্লবীদের সঙ্গে যুদ্ধ করে অনেক ভাই আমার শহীদ হয়েছে। আমি তাদেরও বলব যে রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা, এই স্বাধীনতা তোমরা রক্ষা কর, জনগণের সাথে তোমরা শরীক হয়ে যাও। তোমাদের কাছে এটাই আমার আবেদন ও আবদার।

ভাইয়েরা আমার, সরকারী কর্মচারী ভাইদের আমি বলব, পুরানো মদ পুরানো সঙ্গ ছেড়ে দেন। বিপ্লবের মাধ্যমে যেখানে দেশের স্বাধীনতা আসে। সেখানে অনেকে দেশে অনেকের চাকুরী করার সুযোগ থাকে না। আমি আপনাদের অনেকের চাকুরী এখানে রেখে দিয়েছি। আমি চাই, আপনারা এই মায়ের, বাংলা মায়ের সন্তান হিসেবে বাংলা মায়ের সেবা করে যান। আমরা বলব আপনারা শাসক নন। আমি আপনানের আবেদন করব। আমি আপনাদের রিকোয়েষ্ট করব, আমি আপনাদের অনুরোধ করব। এই দেশের প্রত্যেকটা মানুষ ভাই, আপনার মা, আপনার বোন, আপনার বাবা, সরল জ্ঞানে তাদের সেবা করতে হবে।

সেবার মানসিকতা নিয়ে আপনাদের কাজ করতে হবে। আমাকে আপনারা সোজা মনে করবেন না। আমি লোক অত সোজা মানুস নয়। রাগ আমার আছে, দরকার হলে আপনারা জানেন মেশিন গানের সামনে আমি প্রস্তুত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারি। এ আপনারা দেখেছেন এবং অনেকবার দেখেছেন, মৃত্যুভয় আমি করিনা, কিন্তু প্রায় সাড়ে সাত কোটি মানুষ যে ভালবাসা আমাকে দিয়েছে, যে ভালবাসা ওদের কাছ থেকে পেয়েছি। দুনিয়ার কোন কোন দেশে কোন নেতা তা পায় নাই। প্রধানমন্ত্রীত্ব আমি চাইনা, আমি চাই ভালবাসা। তাই ভালবাসা নিয়ে আমি মরতে চাই, আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ …..

…তারপর দেশকে আমাকে গড়ে তুলতে হবে। আপনাদের কাজ করতে হবে। কাজ করার টাইম নেই। ১০ টা পাঁচটা ভুলে যান। আমি ১৯ ঘন্টা কাজ করি। আমি আমার জীবনের যৌবন দিয়ে কাজ করছি। আমার ১৮ বৎসরে স্কুল ছেড়েছি। কিন্তু আমি ১৯ ঘন্টা কাজ করছি। আমার সহকারীরাও করছে। আপনাদেরও কাজ করতে হবে। আপনারা কাজ করুণ। আপনাদের যে পয়সা/বেতন দেয়, এই জনগণে দেয়। আমি যদি খবর পাই, আইন আমার হাতে আছে, আমি আইন ব্যবহার করতে চাইনা। আমার লাগবে খালি একটা খরম….।

আপনার চাকুরী আর দরকার নাই, বাড়ী যেতে হবে। মেহেরবানী করে আপনারা কাজ করেন। জনগণকে বলব আপনাদেরও সরকারী কর্মচারীদের সঙ্গে সহযোগিতার হাত মিলিয়ে আত্মনিয়োগ করতে হবে। আমি… টাকা দিয়েছি….। সোজাসুজি কথা, এই জনগণের জন্য তাই করা হবে। যদি কেহ এই টাকা আত্মসাত করার চেষ্টা করে, সে আমার দলের লোক হইক তাকে শাস্তি দেওয়া হবে এবং তা  আপনাদের সামনে। আমি চাই না, আল্লাহর ওয়াস্তে একটা কাজ করবেন, ঘুষ দূর্নীতি আল্লাহর ওয়াস্তে মাপ করেন আমারে।

মেহেরবানী করে ঘুষ খাওয়া ছেড়ে দেন। এই জমি পবিত্র জমি। এই জমির এমন কোন জায়গা নাই যেখানে আমার দেশের মা বোনের রক্ত নাই। এ জমির এমন কোন মহাকুমা নাই যেখানে আমার দেশের মা বোনের কবর নাই। এ জমির এমন কোন জমি নাই যেখানে আমার দেশের ছেলেদের আত্মা নাই।

তাদের কথা মনে করে, তাদের আত্মার কথা মনে করে। তাদের রক্তের কথা মনে করে আমি আমার জনগণকে, আমি সরকারী কর্মচারীকে, আমি ব্যবসায়ীকে, আমি শ্রমিককে, আমি কৃষকদের আবেদন জানাই-দেশ গড়তে আত্মনিয়োগ করুন। নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেন। দেশের মানুষ আজ দুঃখী, দেশের মানুষ আজ না খাওয়া। আজ দ্বারে দ্বারে ঘরে ঘরে গৃহহারা সর্বহারা আর্তনাদ। আজ গ্রামে গ্রামে দেখি মানুষের ঘরবাড়ি নাই।  মা মা করে তারা কান্দে বাংলার মানুষ কোথায় থাকবে? এদের কথা চিন্তা করে আমি ঘুমাতে পারিনা।

আমি আপনাদের কাছে চাই, যার ঘর আছে, তার পাশের বাড়িতে গৃহহারাদের ঘর বাড়ির ব্যবস্থা করবেন। যার খাবা আছে, তারা অন্যকে খাবার দিয়ে সাহায্য করেন-এটা হলো মনুষ্যত্ত্ব জাগরণের লক্ষণ, খামাকা জয় বাংলা বলে চিৎকার করলে হবে না। বাংলার মানুস যাতে সব পায়, বাংলার মানুস যাতে সুখী হয়, বাংলার মানুষ যাতে শোষনহীন সমাজ ব্যবস্থা পায়।

সমাজতন্ত্র আমি করব, সমাজতন্ত্র বাংলাদেশে হবে। শোষণহীন সমাজ বাংলাদেশের হবে। তার প্রথম পদক্ষেপ আমরা গ্রহণ করছি এবং আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি জানি বাংলার মানুষ আমাকে ভালবাসে। আমিও বাংলার মানুষকে ভালবাসি। আমি বাংলার মাটিকে ভালবাসি, বাংলার মাটিও আমাকে ভালবাসে। আমি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসতে পারতাম না। আমার মনে হয় এদেশের কোটি কোটি মানুষের দোয়া আর এই মাটির টানে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে, যেখানে আমার জন্য কবর খোড়া হয়েছিল তার কাছ থেকে আমি আসতে পারতাম না। এই মাটিকে আমি ভালবাসি।

আমি চাই, আমার বাংলার মানুস হাসুক, আমার বাংলার মানুস পেট ভরে ভাত খাক। আমার বাংলার মানুষ শান্তি পাক, আমার বাংলার মানুষ নির্যাতিত না হউক, আমার বাংলার মানুষ সুখী হউক। আমার বাংলার মানুষ সুখে স্বাচ্ছন্দে বাস করুক। লক্ষ লক্ষ বেকার রয়েছে আমার  দেশে। চাকুরীর বন্দোবস্ত আমি করতে পারছিনা। চাকুরীর বন্দোবস্ত করতে হলে কল-কারখানা করতে হবে। সরকারী চাকুরীতে চাকুরী হয় না। আমি তোমাদের বলে দিতে চাই, আমি এমন এক অর্থনীতি গড়ে তুলতে চাই- শোষণের জন্য অর্থনীতি আমি গড়ে তুলতে চাই না।

এখানে নীচের থেকে শুরু হবে উন্নয়নের অর্থনীতির ধারা এবং এটা করতে হলে সকলের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আমি আজ আপনাদের কাছে, আপনারা জানেন, যে দেশে রক্তক্ষয়ী বিপ্লব হয়েছে, যে দেশে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে। কিন্তু আমি, আমার সহযোগিতায় যারা স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়েছেন। তারা হত্যাকান্ড চালাতে দেন নাই। আমি চাই না নির্দয় অসহায় মানুষ বিপদে পড়ুক, তা আমি চাই না। তার মানে এই নয় যে আমাদের দূর্বলতা আছে। আমাদের দূর্বলতা নাই। মাপ করেন। মন প্রাণ দিয়া কাজ করেন। পয়সা খাওয়া ছেড়ে দিন। লোভ ছেড়ে দেন। ব্যবসায়ী ভাইয়েরা আবারও বলে দিচ্ছি-সাত দিন সময়।

ডিস্ট্রিবিউটর, এজেন্সি, তেলের এজেন্সি, চালের এজেন্সি, দুধের এজেন্সি বিসমিল্লাহ করে সাত দিনের পর আমি ক্যান্সেল করিয়া দিব-যদি না করেন। আপনারাতো জানেন আমি মুজিবর রহমান যা বলি তা করবার চেষ্টা করি। ইয়াহিয়া কত তেলাইছে প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য। প্রধানমন্ত্রী ফদানমন্ত্রী আমি হবার চাইনি, আপনারা জানেন। আমি মরতে গিয়েছিলাম কিন্তু বাংলার সাথে বেঈমানি করি নাই। আর এখনও বলছি, আমি মরতে পারি কিন্তু সাড়ে সাত কোটি মানুষের সঙ্গে আমি বেঈমানি করতে পারব না। তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আপনারা সংঘবদ্ধ হইয়া থাকেন।

একদল লোক রয়েছে, এটা হলনা, ওটা হলনা, ওটা হলনা, এটা হলনা। কিচ্ছু দেবার পারব না। আমি বলেছি কিচ্ছু আমার কাছে নাই। আমি দুনিয়ার কাছে ভিক্ষা করে আনতেছি, ভারতবর্ষ আমাকে সাহায্য না করলে আমি দেশ চালাতে পারতাম না। একদল লোক আপনাদের প্রভাবিত করতে চেষ্টা করছেন। আমি সাবধান করে দেবার চাই, ভারতের সঙ্গে আমার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক চুক্তি হয়েছে। আমি একটা স্বাধীন দেশ, ভারতবর্ষ একটা স্বাধীন দেশ। দুই স্বাধীন দেশের সাথে বন্ধুত্ব। এখানে কোন গোলমাল টোলমাল নাই।

আমার স্বাধীনতা কেউ হস্তক্ষেপ করবে না, আমিও তোমাদের ক্ষমতার হস্তক্ষেপ করবো না। কিন্তু যারা আমার বন্ধুত্বের হরণ করার চেষ্টা করবেন তারা মনে রাখবেন, তারা জানেন না, আমি হাত বাড়াইয়া, একবার হাত বাড়াইলে আমি কোনদিনও ফিরাইনা, এটা ইয়াহিয়া খানও জানে, আইয়ুব খানও জানে।

তাই বন্ধুরা, আপনাদের কাছে আমার আবেদন, আপনারা দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন, যাই কিছু করেন। আমি কিছু দেবার পারবনা। তিন বছর পরে, তিন বছর ধরে যদি যুদ্ধ চলত, আপনারা যুদ্ধ করতেন না? আপনারা না খেয়ে যুদ্ধ করতেন না? ধরেন আরো তিন বৎসর যুদ্ধ করতে হবে। যা ধ্বংস হয়ে গেছে, তা ঠিক করতে আমার পঞ্চাশ বৎসর সময় লাগত। কিন্তু আমি মনে করি ইনশাল্লাহ তিন বৎসরের মধ্যে পারব। কিন্তু আপনাদের সহযোগিতা করতে হবে। একলা কেউ কিছুতে চলতে পারে না। তাই আপনারা, আপনাদের আমি ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনারা দোয়া করবেন। ভালবাসা আপনারা আমাদে দিয়েছেন, আমার জীবনের ওটাই যেন পাথেয় হয়ে থাকে।

ইন্শাল্লাহ সোনার বাংলা আবার জাগবে, যদি শোষণহীন সমাজ গড়তে পারি। তবে আপনাদের সাহায্য সহযোগিতা প্রয়োজন। আপনাদের কাছে আমার আরেকটা অনুরোধ হলো যে, দূর্ণীতি ও ঘুষের বিরুদ্ধে আপনারা আন্দোলন করতে রাজী আছেন কিনা? দূর্ণীতি আর ঘুষ, রাজী আছেন? হ্যাঁ, খোদা হাফেজ-জয় বাংলা।

 

১৯৭২ সালের ৫ এপ্রিল তারিখে বাংলাদেশ বেতারে দেশ আমার মাটি আমার অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু র বক্তৃতা

আজকে কি? আজ আমাদের কি অবস্থা? আজ আমাদের পপুলেশন, আজকে উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে। আজ আমরা শ্রমিক আন্দোলন করব। কি বরব? কারখানায় কাজ হবে না। কারখানায় প্রোডাকশন না বাড়াইয়া ভীক্ষুকের জাতিতে উন্নীত হবো। দুনিয়ায় জীবনবরে ভীক্ষা-পাওয়া যায়? স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। সে জন্য কঠোর পরিশ্রমের প্রয়োজন রয়েছে। কাজ করব না ফাঁকি দিব, অফিসে যাব না, ফাঁকি দিব। ফ্রি ষ্টাইল। ফ্রি ষ্টাইল মানে গণতন্ত্র নয়।

অফিসে দশটার আগে যাওয়ার কথা বললে বারোটার আগে যাব না। রাস্তায় কাজ করব না। কারখানায় কাজ করব না। আমার কৃষক খারাপ না। আমার শ্রমিকরা কাজ করতে চায়। আমার কৃষক উৎপাদনশীলতায় এগিয়ে গেছে। আমরা বাঁধার সৃষ্টি করি, আমরা ষড়যন্ত্র করি। আমরাই যেন ধোক দেই, আমরাই যদি লুট  করে খাই। আমরাই যদি দখল করে নিয়ে যাই, আমরা যারা বড় বড় এখানে আছি, তারাই প্রশ্ন করে। তারা কারা? তারা এদেশের তথাকথিত শিক্ষিত সমাজ।

এদেশের তথাকথিত লেখাপড়া জানা মানুষ, যাদের পেটের মধ্যে দুই অক্ষর বুদ্ধি ঐ বাংলার দুঃখী মানুষের টাকায় শেখা। আমি কি পেলাম, আমি বারবার বলেছি আজকে আমার আত্মসমালোচনার প্রয়োজন। আজকে আমাদের আত্মবোধ প্রয়োজন, আজকে আমার আত্মশুদ্ধির প্রয়োজন। না হলে দেশকে ভালবাসা যায় না। দেশের জন্য কাজ করা যায় না এবং দেশের হিম্মত করা যায় না। কলে-কারখানায়, ক্ষেত-খামারে আমার প্রোডাকশন বাড়াতে হবে। তা না হলে দেশ বাঁচতে পারে না। কি করে আপনি করবেন?

যদি পারেন ২০ লক্ষ টন খাবার যদি বৎসরে প্রয়োজন হয়, কত হয়? ৪৫০ লক্ষ মন। কে দেবে? প্রত্যেক বৎসর লোনের থেকে এই তিন বৎসরে বহুরাষ্ট্র সাহায্য দিয়েছে। লোন দিয়েছে, আনতাছি। কতকাল ধরে, কতদিন ধরে, মানুষ বাঁচবে না। বৎসরে ত্রিশ লক্ষ লোক আমার নতুন নতুন বাড়ে। আজকে আমাদের পপুলেশন প্লানিং করতে হবে। পপুলেশন কন্ট্রোল করতে হবে। না হলে বিশ বৎসর ২৫ বৎসর পরে ১৫ কোটি লোক হয়ে যাবে। ষোল হাজার স্কয়ার মাইল, বাঁচতে পারবেন না।

যেই ক্ষমতায় থাকুক বাঁচার উপায় নাই। একটা পপুলেশন কন্ট্রোল আমাকে করতেই হবে। প্রোডাকশন বাড়াতে হবে, না হলে মানুষ বাঁচতে পারবে না এবং বাঁচার জন্য তাকে শৃঙ্খলাবদ্ধ হতে হবে। বিশৃঙ্খল জাতি কোনদিন বড় হতে পারে না। উশৃঙ্খল হয়ে গিয়েছিরাম আমরা। ফ্রি স্টাইল। এটা হবে না, ওটা হবে না। আর যাকে এ্যারেস্ট করবে-বলে যে, অমুক পার্টির লোক। খবরের কাগজে বিবৃতি। জিনিস এক জায়গায় একশ দশ টাকা হলে একদিন হঠাৎ এক জায়গায় কিছু দাম বাড়লে খবরের কাগজ চাপাইয়া দিল সমস্ত বাংলাদেশে বেড়ে গেল।

যেখানে সমস্ত কিছুর অভাব, যেখানে দুনিয়া থেকে সব কিছু কিনতে হয়। আমরা কলোনি ছিলাম। আমরা কোন জিনিসে সাফিসিয়েন্ট না। আমরা কাগজে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট না । আমরা তেলে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট না। আমরা খাবারে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট না। আমাদের রড সিমেন্টে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট না। কোন বিষয়ে সেল্ফ সাফিসিয়েন্ট না। আমরা কলোনি ছিলাম পাকিস্তানীদের।

আমাদের যা কিছু করতে হবে, সব কিছু আনতে হবে। কোথায় পাবেন বিদেশী মুদ্রা ছাড়া? দু হাতে কাজ করতে হবে, ইনকাম করতে হবে। স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। যে মানুষ ভিক্ষা করে, তার যেমন ইজ্জত থাকে না, যে জাতি ভিক্ষা করে তারও ইজ্জত থাকে না। ভিক্ষুকের জাতিকে প্রশ্ন করতে আমি চাইনা। আমি চাই আমার দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হউক এবং সেজন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। শৃঙ্খলা আনতে হবে।

তাই আত্মসমালোচনা করেন। আত্মশুদ্ধি করেন, তাহলেই হবে। সমাজ ঘুনে ভরে গেছে। এ সমাজকে আমি টালমাটাল করতে চাই। এমন আঘাত করতে চাই, যে আঘাত করেছিলাম পাকিস্তানীদের। সে আঘাত করতে চাই এই ঘুনে ধরা সমাজ ব্যবস্থাকে। আপনাদের সমস্যা নাই। আমি জানি আপনাদের সদস্যা আছে। কিন্তু একটা কথা, এই দেশ নতুনভাবে সাজাতে হবে। গ্রামে গ্রামে বহুমূখী কো-অপারেটিভ করা হবে। ভূল কইরেন না। আপনাদের জমি আমি নেব না।

ভয় পাইবেন না, জমি নিয়া যাব তা নয়। বাংলাদেশের ৬৫  হাজার গ্রামে একটা করে কো-অপারেটিভ হবে, প্রত্যেক গ্রামে গ্রামে। এই কো-অপারেটিভ জমির মালিকের জমি থাকবে। কিন্তু তার আওতায় থাকবে বেকার প্রত্যেকটি মানুষ। যে মানুষ কাজ করতে পারে। তাকে এই কো-অপারেটিভের সদস্য হতে হবে এবং বহুমুখী কো-অপারেটিভ হবে। আলটিমেটলি প্রত্যেকটি ভিলেজে একটা করে কো-অপারেটিভ করা যাবে। তাদের কাছে পয়সা যাবে। কাছে বেতন যাবে। আস্তে আস্তে ইউনিয়ন কাউন্সিল….।

তা না হলে দেশ এগুনো যাবে না। এজন্যই ভিলেজে কো-অপারেটিভ হবে। আমি ঘোষণা করছি আজকে, পাঁচ বৎসর মেয়াদি প্রত্যেকটি গ্রামে কয়েক হাজার লোক পাঁচশ থেকে হাজার ফ্যামিলি পর্যন্ত কম্বলসারি কমিউনিটি হবে। আপনার জমির ফসল আপনি নিবেন। অংশ যাবে কো-অপারেটিভ, ঐ অংশ গভঃর্ণমেন্টের হবে। দ্বিতীয় অংশ থানায় একটি করে কাউন্সিল হবে।

 

(অংশ বিশেষ)

 

১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল ঢাকায় আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে সভাপতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আমার প্রিয় ভাই ও বোনেরা,

সভা শুরু করার পূর্বে আওয়ামী লীগের এই কাউন্সিল সভায় আমরা প্রস্তাব করতেছি, যে সমস্ত ভাইয়েরা স্বাধীনতা সংগ্রামে এবং যুদ্ধের পরে আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীসহ বাংলাদেশের যেসব কৃষক যে সব বুদ্ধিজীবী, পুলিশ, বিডিআর, সেনা বাহিনীর লোকেরা যারা শহীদ হয়েছেন, প্রথমে আমরা তাঁদের জন্য প্রস্তাব করছি এবং শোকসংসপ্ত পরিবারের জন্য শোক প্রস্তাব করছি এবং আপনারা তাদের আত্মার মাগফেরাৎ কামনা করে আমরা মোনাজাত করছি।

(মোনাজাত)

দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, উপস্থিত অতিথিবৃন্দ আপনারা আমার আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করেন। গত কাউন্সিল সভায় আপনারা যোগদান করেছিলেন। সেবারে আমরা যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলাম এবং যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম। তা কার্যকর করতে আওয়ামী লীগ চেষ্টা করেছে। আওয়ামী লীগের আমার বড় ভাই এবং সহকর্মী যাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল, যাদের সঙ্গে আমরা দীর্ঘ ২৩/২৪ বৎসর কাজ করেছি, সে অনেক কর্মী এবং অনেক নেতা আজ আমাদের মধ্যে নাই, তারা শহীদ হয়েছেন। শহীদ হয়েছেন বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধারা, সরকারী কর্মচারীরা, সৈনিক বাহিনীর ভাইয়েরা, পুলিশ বাহিনীর ভাইয়েরা, শ্রমিক ভাইয়েরা, ছাত্র ভাইয়েরা, বিশেষ করে যাকে আমরা বিডিআর বলি, বাংলাদেশ রাইফেলসের কর্মীরা।

ওদের ফিরে পাবনা। ওরা আর পৃথিবীর বুকে ফিরে আসবে না। ওদের ডাক দিয়েছিলাম সংগ্রাম করার জন্য, দেশকে মুক্ত করার জন্য, ওরা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ইতিহাস বেশী আমি তর্জ্জমা করতে চাইনা তবে কিছুটা ইতিহাসের প্রয়োজন আছে। হঠাৎ স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হয় নাই। স্বাধীনতার শুরু হয়েছে অনেকদিন পূর্বে এবং সকল সময়ে সকল কথা বলা যায় না। আন্দোলনের মধ্যে থেকেই বুঝে নিতে হয়। এটা আপনারা জানেন এবং বুঝেন। সহকর্মীরা জানতেন এবং বুঝতেন। আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হবার পর থেকে তাদের জীবন বাজী রেখে নৌকা চালাতে হয়েছে। কোনদিন তারা ভাটিতে নৌকা চালাতে পারেন নাই- কয়েক মাস ছাড়া। আওয়ামী লীগের কর্মীদের ত্যাগ তীতিক্ষার স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

এই জন্য এখন লেকা থাকবে যে আজ বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। লেখা থাকবে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ পুলিশ বাহিনীর ইতিহাস। যারা শহীদ হয়েছে স্বাধীনতার জন্য। কর্তব্য রয়েছে দেশবাসীর, কর্তব্য রয়েছে আওয়ামী লীগ কর্মীদের। স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করা তেমনি কষ্টকর। স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা পাওয়া যেতে পারে, অর্থনৈতিক স্বাধীনতা না হলে রাজনীতি ব্যর্থ হয়ে যায়। ইতিহাস, ছয় দফার পিছনেও ইতিহাস ছিল। আওয়ামী লীগ জন্মের পর থেকে স্বায়ত্ত্বশাসনের ইতিহাস-সে ইতিহাসের পিছনেও অনেকটা ইতিহাস ছিল।

এ কথা সত্য যে শুধু শহীদ এই সংগ্রামেই হয়েছে তা নয়। বাংলার মানুষ বার বার শহীদ হয়েছে। ১৯৫২ সালে শহীদ হয়েছে বাংলার ছেলেরা, ১৯৫৪ সালে হাজার হাজার কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়েছিল এবং অনেকে মৃত্যুবরণ করেছিলেন ও শহীদ হয়েছিলেন। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল জারি হওয়ার পরেও আওয়ামী লীগের অন্যান্য দল ব্যান্ড হওয়ার পরেও সেখানে অনেকের জান দিতে হয়েছিল। ১৯৬২ সালে সোহরাওয়ার্দী সাহেব গ্রেফতার হওয়ার পরেও অনেকের জান দিতে হয়েছিল এবং অনেকে জেল খেটেছিল।

১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনের ফলে ১৭ই জুন তারিখে আমার ছেলেরা জীবন দিয়েছিল। ১৯৬৯ সালে ১১ দফার আন্দোলনে ছাত্ররা যে আন্দোলন শুরু করে, আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দেরা সেখানে গিয়ে তাদের সহযোগিতা করে আন্দোলন চালিয়ে যায়, তখন অনেকে শহীদ হয়েছিলেন। বাংলার ইতিহাস শুধু যে রক্তের ইতিহাস তা নয়, বাংলার ইতিহাস শুধু যে নির্যাতনের ইতিহাস তা নয়। বাংলার ইতিহাস শুধু যে আন্দোলনের একবারেই আমরা সংগ্রাম করেছি তা নয়, এ সংগ্রাম শুরু হয়েছে অনেক দিন আগে থেকেই।

শুধু জনগণের খালি আওয়ামী লীগের সংগ্রাম হলেই চলবে না, সঙ্গে সঙ্গে এটা জনগণেরও সরকার, সাড়ে সাত কোটি মানুষ-মানুষেরও সরকার। এটা সম্পর্কে পরিস্কার থাকা দরকার। আপনাদের কাজ করতে হবে। বিরোধী দলে থাকা এক রকমের পন্থা। আর সরকারী পক্ষে রাজনীতি করাও অন্য রকম পন্থা এবং সেখানে গঠনমূলক কাজ দিয়ে মূলত এগিয়ে যেতে হবে। অত্যাচার-অবিচার যেন না হয়। জুলুম যেন না হয়। লুটতরাজ যেন না হয়। দেশের মানুষকে ভালবেসে মন জয় করতে হবে। তোমাদের কাছে আমার নির্দেশ, তোমাদের কাছে আমার আবেদন, তোমাদের প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, আমাদের কাছে রাতের আরাম দিনের উত্তাপ হারাম, আমাদের দুঃখী মানুষের সেবায় উৎসর্গ করতে হবে।

ভাইয়েরা আমার, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে চাইলে অনেক বার যেতে পারত। ক্ষমতার জন্য আওয়ামী লীগ জন্মগ্রহণ করে নাই। বাংলাদেশে শোষণহীন সমাজ গঠন করার জন্যই আওয়ামী লীগের জন্ম হয়েছে। শোষণহীন সমাজ গড়ে তুলুন। আমাদের নীতি বিপরীত। নীতির সঙ্গে আপোষ হয় না। সেই জন্য জীবনে নীতির সঙ্গে আপোষ করতে পারি না। দরকার হলে দলের লোকজন যদি বেঈমানী করে তার সঙ্গেও আমি আপোষ করতে রাজী নই। নিয়মের উর্ধ্বে উঠতে হবে।

নিয়ম যেখানে ধ্বংস সেখানে একবার যদি কেউ নীল হয়ে যান, সে জীবন কোন দিন আর মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারবেন না। শুধু আপনার মুখে কালী দেবেন, কালী দেবেন এই দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুখে। যেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সাড়ে সাত কোটি মানুষ স্বাধীন হয়েছে। সে আওয়ামী লীগের মুখ কালি হয়ে যাবে। দেশের মানুষের মুখ কালি হয়ে যাবে। আওয়ামী লীগ কর্মীদের দায়িত্ব যথেষ্ট রয়েছে। এই দায়িত্ব থেকে তারা রেহাই পেতে পারেন না।

আমরা শৃঙ্খলা রাখতে চাই, আমরা গণতন্ত্র কায়েম করতে চাই। কিন্তু গণতন্ত্র মানে উশৃঙ্খলতা নয়। গণতন্ত্র মানে সেখানে গোপনে পোস্টার দিয়ে ষড়যন্ত্র নয় এবং আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করার ষড়যন্ত্র করছে সেটাও নয়। সেখানে সরকারের একটু শক্ত হতে হবে এবং শক্ত হবে, ভাল হইতে হবে সন্দেহ নাই এবং সেটাও আমরা করতে চাই না। জনগণই করবে সে বিশ্বাস আমার আছে। আর জনগণকে আমি চিনি, জনগণ আমাকে চিনে। জনগণ আমাদের ভালবাসে, আমরা জনগণকে ভালবাসি। আমাদের পররাষ্ট্রনীতি, আমাদের বৈদেশিক নীতি পরিস্কার।

আওয়ামী লীগের বৈদেশিক নীতি পরিস্কার এবং তা মেনে চলে। নিরপেক্ষ ইনডিপেনডেন্ট ফরেন পলিসি। আমাদের ফরেন পলিসি, বৈদেশিক নীতি পরিস্কার। আমরা কোন যুদ্ধে সংঘাতে বিভ্রান্ত হতে চাই না এবং কবর না। আমরা সকলের সঙ্গে বন্ধুত্ব করে বাস করতে চাই, আমরা সহাবস্থানে বিশ্বাস করি। আমরা সামাজ্যবাদ, আমরা সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে। আমরা দুনিয়ার দুঃখী মানুষ যেখানে সংগ্রাম করবে, তার পক্ষে বাংলাদেশ দাঁড়াবে। কারণ আমরা দুঃখী, আমরা কষ্ট সহ্য করেছি। আমরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে স্বাধীনতা নিয়েছি। আমরা যেখানে দুনিয়ার সকল মজলুম মানুষ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবে। আমরা তার পাশে গিয়ে দাড়াব।

(অসমাপ্ত)

১৯৭২ সালের ৯ এপ্রিল ছাত্র ইউনিয়নের ত্রয়োদশ কাউন্সিলে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

ভদ্র মহোদয় ও ভদ্রমহিলাগণ,

আপনারা আমার ধন্যবাদ গ্রহণ করুন। আপনারা আমাকে প্রধান অতিথি করেছেন, আমার ব্যক্তিগত পক্ষের থেকে আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। মতের যেখানে মিল আছে, মনের যেখানে মিল আছে। আপনাদের কাছে আমি দু’চারটি কথা বলতে চাই, আপনাদের কাছে ইতিহাস বলে লাভ নাই। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ইতিহাস সৃষ্টি করছে। রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন যেমন মুক্তির শর্ত, অর্থনৈতিক মুক্তি করাও তেমনী শর্ত। রাজনৈতিক স্বাধীনতা আমরা পেয়ে থাকলেও অর্থনৈতিক স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যায় যদি এদেশের দুঃখী মানুষের জন্য কিছু না করা যায়। এদেশে শোষণহীন সমাজ যদি প্রতিষ্ঠিত না হয়, এবং শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠিত করতে হলে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি একমাত্র পথ বলে আমরা বিশ্বাস করি।

স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস বাঁচে, যেদিন লেখা হবে অনেক দুঃখের ইতিহাস। স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেক দিন থেকে শুরু হয় এবং ধাপে ধাপে এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে হয় কারণ শোষণ এবং শোষক শ্রেণী হুঁশিয়ার ছিল। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ ওদের স্বাধীনতা ভোগ করেন আর আমরাও পাকিস্তানের জন্য সংগ্রাম করেছিলাম। কিন্তু সে স্বাধীনতা যে এই স্বাধীনতা হবে ১৯৪৭ সালে আমরা বুঝতে পেরেছিলাম। এ স্বাধীনতা মিথ্যা, এ স্বাধীনতা বাংলাদেশকে লুট করার ষড়যন্ত্র। বাংলাদেশের মানুষের চিরদিনের মতো গোলাম করার ষড়যন্ত্র।

কেন্দ্রে বসে নেতারা স্বাধীনতা ভোগ করেন। বাংলাদেশকে ভাগ করেন। বাংলাদেশকে ভাগ করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তারা বাংলাদেশকে শাসন করার চেষ্টা করেন। তারা শোষণ করতে চেয়েছিলেন আমার সংস্কৃতির উপর আঘাত করে। আমরা ভাষার উপর আঘাত করে। আমার শিক্ষা ব্যবস্থার উপর আঘাত করে। সামাজ্যবাদী শক্তি যেমন একটা কলোনীকে তার নিজস্ব স্বাধীকার থেকে বঞ্চিত করে। শোষণ করার ষড়যন্ত্র করে ঠিক একইভাবে আমাদের এই পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক শ্রেণীরা এই বাংলার মানুষকে শোষণ করার ষড়যন্ত্র করেছিল এবং তরা কলোনিতে পরিণত করেছিল।

আমার ছোট ছোট ভাই ও বোনেরা,

এই স্বাধীনতার আন্দোলন গোড়াপত্তন হয় ১৯৪৭ সালের জুন মাসে, যখন ঘোষণা হয় তারপর থেকে। আমাদের অনেক এদিক দিয়ে, ওদিক দিয়ে, এপাশ দিয়ে, ওপাশ দিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রের মতো মেনুয়াল করে চলতে হয়েছে এবং সেজন্য আমাদের জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে এগিয়ে আনার চেষ্টা করা হয়েছে। জাতীয়তাবাদ আন্দোলন শুরু না করতে পারলে দেশের বিপ্লব করা কষ্টকর হয়ে যায়। এজন্যই আমরা জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের দিকে বেশী এগিয়ে পড়েছিলাম।

এজন্যই সে সময় আমাদের অনেক বন্ধু-বান্ধবরা আমাদের অনেক সময় আমাদের এই প্রোগ্রামকে মানতেন না বা সমালোচনা করতেন। তারা ভুল বুঝতেন। তারা আমাদের উদ্দেশ্যের উপর কটাক্ষ করতেন কিন্তু আমরা জানতাম যে জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের সঙ্গে সঙ্গে, অনেক সময় জাতীয়তাবাদ আন্দোলন তার সঙ্গে যদি একটা পরিস্কার কর্মপন্থা না থাকে। তখন জাতীয়তাবাদের আন্দোলন শুরু করার সঙ্গে সঙ্গে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির আন্দোলন আমরা সাথে চালিয়ে দিয়েছিলাম। তখন এই যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এর পরে সমাজ থেকে অর্থনীতি করতে আমাদের কোন দিন দ্বিধা বা কষ্ট হতে পারে না। কিন্তু ষড়যন্ত্রকারীরা….।

সাম্প্রদায়িকতার উর্ধ্বে রুখে দাঁড়ানো বড় কষ্টকর ছিল। আমাদের দেশের মানুষ ছিল ধর্মভীরু মানুষ। ধর্মভীরু মানুষকে ধর্মের নামে শ্লোগান দিয়ে এগিয়ে নেয়া বড় সোজা। তাদের প্রধান অস্ত্র ছিল এই ধর্ম। নিজেরা কিন্তু কোনদিনও ধর্ম পালন করতেন না কিন্তু ধর্মকে ব্যবহার করতেন। এমনভাবে ব্যবহার করতেন, যেটা ধর্মকে ব্যবহার করে রাজনীতি, তাদের যে উদ্দেশ্য ছিল সেটাকেই ফলো করতে চেষ্টা করতেন।

আপনারা ইতিহাস জানেন, ইতিহাস বলতে চাই না, আপনারা জানেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ইতিহাস, আপনারা জানেন ৫২ সালের ইতিহাস, আপনারা জানেন ৫৮ সালের মার্শাল ল, আপনারা জানেন ৬২ সালের ইতিহাস। আপনারা জানেন ৬৪ সালের ইতিহাস, আপনারা জানেন ৬৯ সালের ইতিহাস। আপনারা জানেন এই সরকারকে।

স্বাধীনতা পেয়েছেন, আপনারা ত্রিশ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছেন। ত্রিশ লক্ষ লোক শুধু রক্ত দেয় নাই, প্রায় দুই কোটি আড়াই কোটি লোকের ঘর বাড়ি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। শুধু তাই করে নাই বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। বড় বড় সরকারী কর্মচারীকে হত্যা করা হয়েছে। পাকিস্তানের আক্রমনে বাংলাদেশের পুলিশ বাংলাদেশের ইপিআর (তখনকার ইপিআর, বর্তমানের বিডিআর, বাংলাদেশ রাইফেল্স) সামরিক বাহিনীর লোকদের হত্যা করা হয়েছে। তারা প্লান করেছিল, সে প্লান অনুযায়ী যা চলেছিল, এদেশে যারা কথা বলার মতো মাথা তুলে দাঁড়াবার মতো ছিল-তাদের সবাইকে হত্যা করে শেষ করে দাও। আমরাও জানতাম, আমরাও বুঝতাম। তারাও সময় নিচ্ছিল, আমরাও সময় নিচ্ছিলাম।

আমার অনেক বন্ধু-বান্ধব বলতেন নির্বাচন করনা, আমরা নির্বাচন বয়কট করলাম। আমি বললাম না নির্বাচন করব। দুনিয়াকে দেখাতে হবে যে আমার এই প্রোগ্রামের পক্ষে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি জনসাধারণ এবং সেটা পরিস্কারভাবে দেখা গেছে যে সেটা আমাদের যে একটা শক্তি ছিল।

যদি বেঈমানী করতাম প্রধানমন্ত্রী হওয়ার লোভে। তাহলে ইলেকশনের রেজাল্ট ফেজাল্ট নষ্ট হয়ে যেতো কিন্তু নির্বাচন শুধু ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য নয়। আমি ইলেকশনের পূর্বের ঘোষণা করেছিলাম এটা আমার গণভোট, স্বাধীকারের গণভোট, যদিও সাথে সাথে এই শ্লোগানও ছিল-এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। আমাকে বন্ধু-বান্ধবরা বলতেন ঘোষণা করে দাও। আমি বলি ঘোষণা করে আমি নিশ্চয়ই দিয়েছি কিন্তু ঘোষণা করার কায়দা আছে। দস্তকে বেকায়দায় ফেলতে হয়, দস্তকে নিয়ে বেকায়দায় পড়তে নাই। ওটা একটা যুদ্ধ।

ওটা এটা আন্দোলন, আন্দোলন না করলে আন্দোলন শিখা যায় না। বই পড়ে আন্দোলন হয় না, ও থিয়োরিশিয়ান হয়ে যায়, চৌকস হয়ে যায় নেতৃত্ব করে তারাই জানে আন্দোলন কি জিনিস। আন্দোলন কি ভাবে করতে হয়। বই পড়া থিয়োরিশিয়ানরা জীবন ভরে বই পড়েই খালি খবরের কাগজে লিখেন কিন্তু প্যাকটিকাল জিনিস কিভাবে আন্দোলন পরিচালিত করতে হয় সে শিক্ষা তাদের হয় নাই। মাঝে মাঝে সেজন্য ফাউল  প্রিন্ট করে ফেলে। আন্দোলনের একটা ধারা আছে। যেটার মাধ্যমে আস্তে আস্তে এগিয়ে নিতে হয় মানুষকে। মানুষকে এমন কিছু বলতে নাই, যেটা দেখলে মানুষ চমকে উঠে। এমন কিছুতে মানুষকে এগিয়ে নিতে হয় যেখান থেকে মানুষ ফেরত আসতে পারে না এবং শত্রুকে খেলতে দিতে হয় না।

ভাইয়েরা আমার,

স্বাধীনতা আপনারা পেয়েছেন, স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। দস্যুর দল বাংলা থেকে বিতাড়িত  হয়েছে। দস্যূর দল বিতাড়িত হয়েছে সত্য কিন্তু ২৪ বৎসর যে বন্ধু ছিল সে বন্ধুকে বিতাড়িত করতে পেরেছেন আপনারা? পারেন নাই। তাদের বন্ধত্ব রয়েছে, তাদের বন্ধু রয়েছে, তাদের সঙ্গে যাদের সম্পর্কে তারা রয়েছে, তাদের সঙ্গে যারা পয়সা লুটত তারা রয়েছে। তাদের সঙ্গে আতাত করে যারা প্রমোশন পেয়েছে তারা রয়েছে। স্বাধীনতা পেলেও এদের হাত থেকে এখনও আমরা রক্ষা পাই নাই।

তারা আমার কাছে, আমার এক ছোট ভাই সেদিন বলল, যে এত তাড়াতাড়ি না করলেও তো হতো। এত তাড়াতাড়ি ব্যাংক, ইন্সুরেন্স ন্যাশনালাইজ করলেন কেন? এখন পর্যন্ত ভসিমভূত একটা দেশ- পয়সা নাই, অর্থ নাই, টাকা নাই, ল্যান্ডিং করতে পারছেন না। তা আমাদের অর্থনীতি ভেঙ্গেচুরে চুরমার হয়ে গেছে। এই মুহুর্তে কেমন করে আপনারা এ জিনিসটা করতে যাচ্ছেন। কি হবে? সর্বনাশ হতে পারে এদেশের। আরে সর্বনাশের কিছুই বাকী নাই। সর্বনাশের উপরে আরেকটু সর্বনাশ করে ভবিষ্যৎ বংশধরদের উপর একটা পথ দেখিয়ে দিয়ে যান।

তাই যদি হয়, কারণ তারাও চেষ্টা করেছিল যে দেরী হয়ে গেলে দূর্বলতায় আসলে তারাও নড়ে উঠলে দাড়ালে এবং সমাজতন্ত্র অর্থনীতি পিছনে আঘাত করতে পারে। আমার সহকর্মীরা এবং আমি এ সম্বন্ধে খুবই হুশিয়ার। প্রায় সাড়ে সাত কোটি লোক ৭৪ হাজার বর্গমাইল। এত অল্প জায়গায় এত বেশি লোক কোথাও বাস করে না দুনিয়ায়। জমি আমাদের নাই বলতে গেলে। যা আছে তাতে কয় পার্সেন্ট লোকের জায়গা হয়। শিল্প-কারখানা যা আছে তার মধ্যে আমাদের কত লোকের বেকার সমস্যা দূর হয়। অর্থনীতি এমনভাবে ২০০ বছর ইংরেজ, চব্বিশ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের শোষক শ্রেণী বাংলার অর্থনীতিকে ভেঙ্গে চুরে চুরমার করে দিয়ে গেছে। আমিতো কোনদিন আপনাদের কাছে মিথ্যা ওয়াদা করি নাই।

আমি তো একথা বলি নাই আপনাদের যে স্বাধীনতা পেয়েছেন এখন এই পাবেন, কই পাবেন, ওটা পাবেন এটা দেয়া হবে, ওটা দেয়া হবে চাকুরী দেয়া হবে। আমিতো পরিস্কার বলি, তিন বৎসরের মধ্যে কিছু দিবার পারিবনা। যদি বলেন পারিব-আমি বিদায় নিতে রাজী আছি। যদি কেউ বলেন, এগিয়ে আসেন, আমার আপত্তি নাই। আমি ছেড়ে দিতে রাজী আছি ক্ষমতা। কিন্তু যারা সত্যিকারের প্রগতিশীল, যারা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে, যারা পড়ে পড়ে সমাজতন্ত্রের কথা বলে না, তারা নিশ্চয়ই আমাকে পূর্ণ সমর্থন দিচ্ছে-এ সম্বন্ধে বিন্দু মাত্র সন্দেহ আমার নাই।

কিন্তু যারা সমাজতন্ত্রের বই পড়ে কথা বলেন, যারা সমাজতন্ত্রের অর্থ বুঝেন না। যাদের উদ্দেশ্য অন্যদিকে। যারা অতি বিপ্লবের কথা বলে বেড়ান এবং অতি বিল্পবের সমর্থনে কথা বলেন। যারা আমার দেশের লক্ষ লক্ষ ভাই বোন যখন স্বাধীনতার সংগ্রাম করতেছিল, তখন যারা পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনীদের অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেছেন, তারা আবার প্রগতিশীল বলে দাবী করেন। তারা আবার বক্তৃতা করেন। এই আমি বক্তৃতা করতে দিচ্ছি বলে তারা যেন মনে না করেন, তাদের আমি সম্পূর্ণ ছেড়ে দিয়েছি। দরকার  হলে আবার সংগ্রাম শুরু হতে পারে।

আমি কারো বিরুদ্ধে বলতে চাই না। কোন জনগণের বিরুদ্ধে আমি নই। আমি আমেরিকার বিরুদ্ধে নই। আমি দুনিয়ার কোন মানুষের বিরুদ্ধে নই। আমি তাদের সমাজ ব্যবস্থা এবং তাদের শাসনের বিরুদ্ধে। এশিয়ার শ্রেষ্ঠ দেশ, বহু দেশ দুনিয়ার, চায়না আমাকে এখনো স্বাধীনতা স্বীকৃতি দেন নাই। তিনি বন্ধুত্ব করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর শাসকদের সাথে এবং যেখানে স্যোসালিজমের নামগন্ধ পর্যন্ত নাই। তারা স্যোসালিষ্ট কান্ট্রি নিশ্চয়ই একথা তারাও বলেন আমরাও বলি। তারাও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা পেয়েছিল।

বাংলাদেশের জনসাধারণ আশা করেছিল আমরা যেহেতু রক্তক্ষয়ী বিপ্লবের মাধ্যমে স্বাধীনতা এনেছি নিশ্চয়ই তারা আমাদের সমর্থন করবেন। সমর্থন যদি নাও করেন আমাদের বিরোধীতা করবেন না। কিন্তু দুঃখের বিষয় তারা অস্ত্র দিয়েছেন টিক্কা খান, ইয়াহিয়া খানের কাছে। যখন বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করতে ছিল, মরতে ছিল তাদের মেশিনগানের সামনে এবং আমার ছেলেরা আমার মুক্তিযোদ্ধারা যে অস্ত্র কেড়ে নিয়েছে তার মধ্যে শতকরা ৬০টি অস্ত্র চায়নার, শতকরা ৪০টি অস্ত্র আমেরিকার। বলেনতো আপনারা স্যোসালিষ্ট কান্ট্রি হয়ে আপনারা মানুষের জন্য যুদ্ধবিরোধী কথা বলে, আপনারা কেমন করে, যে দেশ সমস্ত সংগ্রাম করছে, মুক্তিকামী দেশ অধিনতার বিরুদ্ধে স্বাধীনতার জন্য কেমন করে তাদের অস্ত্র দিলেন রাতের অন্ধকারে।

আমি চায়না সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করি- আপনারা অনেক বোধ হয় সেকথা জানেন এবং জানেন না। তাই আন্দোলন যখন শুরু হয়, আমরা যখন জয়লাভ করি এই রেসকোর্স ময়দানে, আওয়ামী লীগের সদস্যরা শপথ নিলাম। তাদের ঘুম গেল। তারা মনে করেছিল আমরা আপোষ করব ক্ষমতার জন্য। নীতির সঙ্গে আপোষ হয় না, সেটা আমি বারবার তাদের বলে দিয়েছিলাম। সেই দিন যখন আমরা শপথ নিলাম এই রেসকোর্স ময়দানে এম সিদের নিয়ে যে আমরা আমাদের নীতির সঙ্গে কোন আপোষ করবনা। তারপরই এক জাহাজ অস্ত্র সোয়াত নামে চট্টগ্রামে বন্দরে চায়না থেকে আসে এবং ১লা তারিখের পূর্বেই অস্ত্র আইসা পৌঁছে এবং সে অস্ত্র নামতে দেয় নাই আমার শ্রমিক ভাইরা, কর্মীরা, ছাত্ররা।

২৪ তারিখে আমাদের উপর আক্রমণ করার দিন সামরিক বাহিনীর লোকেরা এরোপ্লেনে যেয়ে বাঙ্গালী সৈন্যদের কাছে অস্ত্র কেড়ে নিয়ে তখন তারা মাল নামানোর চেষ্টা করে। আমি জানতাম, আমি পারতাম সে জাহাজকে ধ্বংস করতে এবং সে সামর্থ আমাদের ছিল কিন্তু করি নাই, তাহলে চট্টগ্রাম পোর্ট আমার উড়ে যায় এবং চট্টগ্রাম শহর আমার জ্বলে যায়। এত বিষাক্ত অস্ত্র তারা আমাদের বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল তখন। বলেন কি করে তাদের আমি ধন্যবাদ জানাব? তবে জানাব এখন জানাতে পারলাম না। ভবিষ্যতে যদি বাংলার জনসাধারণের পাশে তারা দাড়ান তা নিশ্চয়ই তারা দাড়ান-প্রাণ খুলে জানাব, মন ভরে জানাব, দু-হাত তুলে জানাব। এখন পারলাম না, দুঃখিত।

যাই হোক আমেরিকা অস্ত্রপাতি দিয়েছেন, বিশেষ কারণে ধন্যবাদ দেই নাই। রিকোগনেশন দিয়েছেন- ভাল, সুখী হলাম, তাহলে ধন্যবাদ দিচ্ছি। মেহেরবানী করে আপনাদের প্রতি অনুরোধ রইল যে আর দামবাজির খেলা আর খেইলেন না, বাংলার মাটিতে তা হবে না। আমরা সকলে সংঘাত ছাড়া বন্ধুত্ব করতে চাই। আমরা চোট দেশ, অস্ত্র দিয়ে কারো সাথে যুদ্ধ কামনা করতে পারি না। আমরা চাই একটা শান্তিপূর্ণ একটা সহ অবস্থানে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা যুদ্ধে বিশ্বাস করিনা। আমাদের দেশে অস্ত্রপাতি নাই। আমরা আনপ্রোডাক্ট এক্সপেনডেসার করতে চাইনা। আপনাদের মতো শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করার ক্ষমতা আমাদের নাই।

মেহেরবানী করিয়া আপনারা রিকোগনেশন দিয়েছেন, আপনাদের জনগণের সঙ্গে আপনাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব আমিও কামনা করি। আমার ভিতরের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করিবেন না। তাহলে বুঝতেই পারছেন অবস্থা আবারো খারাপ হইয়া পড়িবে। যারা আমাদের রিকোগনেশন দিয়েছেন-তাদের আমরা আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই বিশেষ করে ভারত ও রাশিয়াকে আন্তরিক ধন্যবাদ। ভারতবর্ষ যদি আমার এক কোটি লোককে খাবার না দিত, ভারতের সৈন্যরা যদি আমার মুক্তিবাহিনীর সৈন্যদের পাশাপাশি যুদ্ধ না করত, ভারতের অধিবাসিরা তাদের ঘরবাড়ি চেড়ে দিয়ে আমাদের নাগরিকের না খাওয়াত। তাহলে আমাদের এ সংগ্রাম অনেকদিন চলত।

স্বাধীনতা নিশ্চয়ই আসত। কিন্তু আমাদের কি হতো বলা যায় না। এজন্য নিশ্চয়ই আমি শ্রীমতি গান্ধী, ভারতের জনসাধাণ বিশেষ করে পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা, মেঘালয়া ও আসামের জনসাধারণের ধন্যবাদ জানাই এবং তিনি আসছিলেন, আমিও ভারতে গিয়েছিলাম আপনারা জানেন আপনাদের পক্ষ থেকে কলকাতায় আমি লেখাপড়া করেছি। কেহ আপনারা জানেন কলকাতার গলি রাস্তা আমি সবই চিনি। কলকাতায় আমি রাজনীতিকর্মী ছিলাম। সাইকেল নিয়ে পথে ঘাটে ঘুরতাম।

এর আগে ১৯৩৮ সালেও আমি একবার জেলে গিয়েছিলাম। যাক সে কথা। তারপরে আমরা মৈত্রি চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি ভারতের সঙ্গে। কারণ ভিতরের ব্যাপারে কেউ হস্তক্ষেপ করিবে না। বহু রাষ্ট্রের সাথে আমরা পাশাপাশি বাস করব।

আমি সোভিয়েতে গিয়েছিলাম। সোভিয়েতের জনসাধারণ এবং সরকার, শুধু যে আমাদের সাহায্য করেছিলেন তাই নয়। যখন সংগ্রাম করতেছিল জনসাধারণ। যখন আমাকে এখান থেকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়, মেশিন গান দিয়ে। তখন প্রথম দেশ, প্রথম দেশের প্রথম নেতা হিসেবে গ্রেফতারের প্রতিবাদ করে ইয়াহিয়া খানের কাছে অনেক চিঠি পাঠান এবং মানুষ খুন বন্ধ করার আবেদনও করেন। সোভিয়েত রাশিয়াকে বিশেষ করে ধন্যবাদ দিব এবং যে বিশেষ সম্মান ও ভালবাসা আমাকে দেখিয়েছেন আমি মস্কোতে যাবার পরে। সেজন্য আমি তাদের আন্তুরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

যে সমস্ত দেশ আমাদের ফলোআপ দিচ্ছেন তাদেরও আমি আন্তুরিক ধন্যবাদ জানাই। তবে আমার আমাদের বৈদেশিক নীতি পরিস্কার আয়নার মতো। কোন কিন্তু ফিন্তু এর মধ্যে নাই। ইংরেজীতে বলি ইন্ডিপেন্ডেন্ট নিউট্রুয়াল ফরেন পলিসি পূর্ণ সহঅবস্থানে আমরা বিশ্বাস করি। আমরা যে সমস্ত দেশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্ত আন্দোলন করবে। বাংলাদেশের জনসাধারণ তাদের সমর্থন জানাবে। আমরা সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে এটা পরিস্কার যে কারো বিরুদ্ধে আমাদের শত্রুতা নাই। আমরা শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থানে বিশ্বাস করি।

আমার নতুন দেশ, আমার ভস্মিভূত অর্থনীতি, ধ্বংসস্তুপের মধ্যে আমার দেশ হয়েছে। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ না খাওয়া, গ্রামে গ্রামে হাহাকার গৃহহারার আর্তনাদ। বেকার গ্রামে গ্রামে ঘুরে বেড়াচ্ছে। পয়সা নাই, ট্যাক্স ধরতে পারিনা, সরকার চালানো কষ্টকর, মানুষকে খুশী করতে পারিনা, নানা অসুবিধার মধ্যে আমরা চলছি। এই সুযোগ নিয়ে একদল ষড়যন্ত্রকারী যারা কোনদিন আমাদের সাথে স্বাধীনতা সংগ্রামে যোগদান করে নাই। যারা আমাদের গণআন্দোলন বানচাল করার চেষ্টা করছিল, যারা ছলে বলে আমাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার চেষ্টা করছিল, তারা সুযোগ নেবার চেষ্টা করছে।

আমার ভাই ও বোনেরা, আপনাদের কাছে আমার আবেদন-ছাত্র-ছাত্রী ভাই ও বোনেরা, আমি আশা করব যে কথা আপনাদের সভাপতি বলেছেন। তার সঙ্গে আমি সম্পূর্ণ একমত। যারা আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি, তারা হাতে হাত মিলিয়ে গলায় গলা মিলিয়ে সমাজতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করে এগিয়ে যেতে হবে। এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই। আমি সকলের কোন-অপারেশন ও সহযোগিতা চাই। সকলের কাছে যদি দরকার হয় বুদ্ধি হাওলাত নেব-তাতে আমি রাজি আছি। যদি কেউ গোপনে গোপনে আমাকে এডভাইস দিতে চান, তাতেও আমি রাজি আছি।

যদি কেউ প্রকাশ্যে বন্ধ দেবার চান তাতেও আমি রাজি আছি। যারা তলে তলে গুজগুজ খুচখুচ করেন, তাদের সাথে আমি পারব না। সেটা আমার দ্বারা হবে না, আমি একগোয়া মানুষ ফট করে নেমে যাব ময়দানে, আবার রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরু হয়ে যাবে, কেউ ঠেকাতে পারবে না।

আজ সুযোগ পেয়ে গেছেন, আশ্চর্য হয়ে যাই। বিপ্লবী বিপ্লবী বিপ্লবীদের উপর ঘৃণা এসে গেছে মাঝে মাঝে। এক বিপ্লবীদের নামে রাজাকার আর আল-বদর যোগ হয়ে গেছে জায়গায় জায়গায়। বিপ্লবীদের আগে রেখে আলবদর, রাজাকার পেছনে লাইন দেছে। এটা হলনা, ওটা হলনা- তোমার বাবার মাথা হবে, আরে এখনও যে বাংলাদেশ ব্যাঁইচ্যা রইছে এও ভাগ্য ভালো। তোমাদের যে এখন পর্যন্ত আমরা যে ৭১ সালে স্বাধীনতা নিয়ে এসেছি, তারপরেও যে গুলি করে মারি নাই-এটা আমার দূর্বলতা নয়। দরকার হলে হতে পারে জনগণ করবে। আমি ঠেকাতে পারব না।

মনে করনা যে সমাজতন্ত্র করতে যাচ্ছি। সেজন্য সমাজতন্ত্র করতে যদি যে কোন পথ আমাদের অবলম্বন করতে হয়, করবই। কেউ ঠেকাতে পারবেনা। এটা আমার এবং আমার দলের বিশ্বাস এবং জনগণের বিশ্বাস।

ছাত্র ভাইদের ও বোনেরা,

এক ভাই বলেছে যে শিক্ষা তিন মাসের শিক্ষা দিয়ে কি করব? স্কুল নাই, কলেজ নাই, ল্যাবরেটরি ভেঙ্গে দিছে, টিচার মাইরা ফেলে দিছে, কিচ্ছু নাই। তিন মাসের মধ্যে যে আপনারা এখানে বসে সভা করছেন আল্লাহর কাছে ধন্যবাদ দেন। কারণ যে অস্ত্র আপনারা নিয়ে যুদ্ধ করছেন, আমার কাছে কাগজ আছে, সে কাগজ এখন বাইর করব না, ভবিষ্যতে করব। জেনারেল ফরমান আলী খানের হাতের লেখা। এ অস্ত্র আমি অমুকের কাছে দিয়ে দিচ্ছি। একটা গ্রুপ, তারা সম্মানে এখন পর্যন্ত দেশের মধ্যে আছে এবং তিনিও বলেছেন, তার হাতের লেখা পেয়েছি। সবুজ বাংলার উপর লাল রং প্রিন্ট করে দাও। তার নিজের হাতের লেখা। তাহলে বুঝতেই পারছেন ষড়যন্ত্র কিভাবে হচ্ছে।

শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে। শিক্ষা হবে গণমুখি শিক্ষা এবং সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির সঙ্গে মিল রেখেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে গড়ে তুলতে হবে। সেজন্য শীঘ্রই একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হবে এবং সেখানে আপনাদের প্রত্যেকেরই অধিকার থাকবে আপনাদের মতামত দেওয়ার। অনেকে বলেন যে শিক্ষা কমিশনের এই প্রতিনিধি নিতে হবে, এই প্রতিনিধি নিতে হবে, তথ্য প্রতিনিধি নিতে হবে। শিক্ষক প্রতিনিধি নিতে হবে। ওমুক প্রতিনিধি নিতে হবে। এগ্রিকালচার নিতে হবে, কলেজ নিতে হবে। সব নিলেতো আর কমিশন হয়না আবার এসেম্বলি হয়ে যায়। কমিশন থাকবে, যদি আপনারা যে দল, যে মত, যে ছাত্র প্রতিষ্ঠান যা আছেন, আপনাদের মতামত দিয়ে আপনারা লেখেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা করেন-কমিশনকে সময় দেয়া হবে।

আপনাদেরকে সময় দেয়া হবে। আপনাদের মত দেয়া হবে। আপনাদের সব সুবিধা দেয়া হবে। আপনারা বলেন-তারপরে কমিশন যখন রিপোর্ট সাবমিট করবে জনগণের কাছে পেশ করব। আমরাও এর মধ্যে ইন্টারফেয়ার করবনা। আমরা চাই গণমুখি শিক্ষা। আমরা আর ভবিষ্যতে আল্লাহর ওয়াস্তে কেরানী সাহেব পয়দা করার শিক্ষা আর চাই না। আমাদের শিখতে হবে গণমুখী শিক্ষা এবং আমাদের নিচের তলার লোক যারা গ্রামে গ্রামে বাস করে তারা যেন শিক্ষার সুযোগ পায়-সেদিক নজর রাখতে হবে।

আমি আশা করি আমার বন্ধুরা তা স্বীকার করবে, যে প্রস্তাব দিয়েছিলাম সম্পাদক সাহেব, আশা করি তিনি তা গ্রহণ করবেন এবং গ্রহণ করা উচিৎ হবে। তারপরে আমাদের বক্তব্যে আমরা বৈদেশিক নীতি বলেছি, অর্থনীতি বলেছি। গণতন্ত্র? হ্যাঁ গণতন্ত্রও বলেছি। গণতন্ত্র না হলে কেমন করে হয়। এমন দেখেন সহজে লিখেও ফেলে নাই। আমরা যে বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের মৈত্রী করেছি দু’একটা পত্রিকা এও গণতন্ত্র হয়ে গেছে! সার্বক্ষণিক কটাক্ষ লেখা শুরু হয়ে গেছে এবং তারা এখানে বসে ইন্টারকন্টিনেন্টালে বসে একটু কিছু গরম পানি খান আর বাইরের কাছে বাংলাদেশ সম্বন্ধে অনেক কথা বলিয়া দেন।

তার মানে গণতন্ত্র নয়। যে গণতন্ত্র হ্যাঁ…..নিশ্চয়ই…..। কিন্তু আমরা নতুন না যে যে মাত্র তিন মাস অনধিক আমরা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে স্বাধীনতা পেয়েছি। এখন বন্দুক নিয়ে ঘরবেন, বন্দুক নিয়ে গুন্ডামী করুক, নিশ্চই আপনারা তা চান না। নিশ্চয়ই চান না, কেউ চান না। কেউ চায় না। এটা গণতন্ত্র না। তাদের দমন করার জন্য নিশ্চয়ই আপনারা সাহায্য করবেন। এ

সমাজ প্রতিরোধ এবং সেটা পুলিশের চেয়েও জনগণের বিশেষ করে ছাত্র সমাজ, সুধি সমাজ এবং কৃষক সমাজের এগিয়ে আসতে হবে। যাতে শান্তি দেশের মধ্যে বজায় থাকে। শান্তি বজায় না থাকলে কোন কাজই দুনিয়ায় করা যায় না।

ভাইয়েরা বোনেরা আমার,

আমি আপনাদের আর মূল্যবান সময় নষ্ট করতে চাইনা। যে আমাকে আপনারা যে সমর্থন দিচ্ছেন এবং আন্দোলনে সমর্থন দিয়েছেন এবং ভবিষ্যতে দিবেন, এই সম্বন্ধে নিশ্চিৎ বিশ্বাস আছে। এই জন্য বিশ্বাস আছে, এটা আগেও বলেছি-আপনাদের সঙ্গে যে আদর্শ নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি, তাতে আপনারা বিশ্বাস করেন এবং নিশ্চয়ই সমর্থন করবেন; এ সম্বন্ধে আমার কোন সন্দেহ নাই। তবে আপনাদের হুশিয়ার করে দিতে চাই যে, যারা এদেশকে নষ্ট করতে চায়। বানচাল করতে চায়, দেশের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চায়, যারা এদেশে মাঝে মাঝে গোপনে পোষ্টার ছাপিয়ে, লিপলেট ছাপিয়ে এবং বিদেশী দালাল হিসেবে কাজ করে তাদের কাছে সুবিধা নেয়ার চেষ্টা করেন- আমিতো আপনাদের সাথে আছি। নিশ্চয়ই তাদের দমন করতে হবে- এ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নাই।

আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা,

যে চারটি স্তম্ভের উপর বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলন হয়েছে। এই চারটি স্তম্ভের উপর বাংলা স্বাধীনতা চলবে। আপনারা জানেন জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। এটা আমি বিশ্বাস করি, আমার দল বিশ্বাস করে, জনগণ বিশ্বাস করে, আশা করি আপনারাও বিশ্বাস করেন। আমি আপনাদের আবারো ধন্যবাদ দিচ্ছি, তবে আমার এক ভাই প্রস্তাব দিয়েছেন যে দুই ছাত্র প্রতিষ্ঠান নিয়ে একসঙ্গে এগিয়ে নিয়ে কাজ করব কেমন করে।

আমি নিশ্চয়ই আশা করব যে ছাত্র ইউনিয়ন বা ছাত্রলীগ ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান এবং আমি জানি ছাত্রলীগের সঙ্গে আগে জড়িত ছিলাম, হ্যাঁ প্রতিষ্ঠাতাও ছিলাম। আমি আশা করি নীতির সঙ্গে যেহেতু আপনাদের মিল আছে। আদর্শের যেহেতু মিল আছে-আপনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দেশে সমাজতন্ত্র গঠন করার জন্য দুস্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে এবং দেশের মানুষকে নিয়ে দেশে শোষণহীন সমাজ গঠন করার জন্য কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে, গলায় গলা মিলিয়ে, অগ্রসর হবেন-এটাই আমি আশা করি। আপনাদের মধ্যে সামান্য বিষয় নিয়ে যেন ভূল বোঝাবুঝি না হয়, সেটাই আমি আশা করি।

১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল বাংলাদেশ গণপরিষদে উদ্বোধনী অধিবেশনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কিত প্রস্তাব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ

জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে আমি আজ কয়েকটি বিষয় এখানে আলোচনা করতে চাই। আজ আমরা এখানে গণপরিষদে সদস্য হিসেবে বসবার সুযোগ পেয়েছি। আমরা আজকে বাংলাদেশকে স্বাধীন করতে পেরেছি এবং বাংলাদেশকে আজ একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। আমরা যে আজ বাংলাদেশের সার্বভৌম গণপরিষদে সদস্য হিসেবে কাজ করতে পারছি, সে সুযোগ এ দেশের জনসাধারণ তাদের রক্ত দিয়ে এনে দিয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম অনেক দিন থেকে শুরু হয়।

জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার জানা আছে যে, ৩০ লাখ ভাই বোনের রক্তের বিনিময়ে এই স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি। এই গণপরিষদের সদস্য হিসেবে নিশ্চয়ই আমাদের আত্মত্যাগের কথা আমরা স্মরণ করবো এবং মনে রাখবো। আমাদের মনে রাখতে হবে, যে রক্তের বিনিময়ে আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি, সে রক্ত যেন বৃথা না যায়। রক্ত দিয়েছে এ দেশের লক্ষ লক্ষ ভাই-বোন, নিরীহ জনসাধারণ। রক্ত দিয়েছে এদেশের কৃষক, ছাত্র, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবীরা, রক্ত দিয়েছে পুলিশ, রক্ত দিয়েছে প্রত্যেকটি বাঙ্গালী, এমনকি সরকারী কর্মচারীরাও রক্ত দিয়েছে এই স্বাধীনতা সংগ্রামে। নিষ্ঠুর বর্বর ইয়াহিয়া খানের খান সেনারা যে অত্যাচার করেছে, জুলুম করেছে তা থেকে বাংলাদেশের মা-বোনেরা পর্যন্ত নিস্তার পায়নি। লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে নির্যাতন করা হয়েছে। এই পুলিশ সেনাদের আচরণের ইতিহাস দুনিয়ার আর কোথাও নাই।

আজ তাদের কথা আমরা স্মরণ করছি, স্মরণ করতে হয় আমার সহকর্মী সভ্যবৃন্দের কথা, যারা সেই গত নির্বাচনে নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের অনেককেই বন্দী করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে-তাদের নাম ঐ প্রস্তাবে রয়েছে, যে প্রস্তাব আমি আপনার মাধ্যমে পরিষদে পেশ করেছি।

তাছাড়া এই দেশের জানা অজানা লক্ষ লক্ষ লোক, আওয়ামী লীগের লক্ষ লক্ষ কর্মী স্বাধীনতার জন্যে জীবন দিয়েছিলেন, দলমত নির্বিশেষে যারা স্বাধীনতার জন্যে রক্ত দিয়েছেন, শহীদ হয়েছেন, তাদের ত্যাগের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। জনাব স্পীকার সাহেব, আজ স্বাধীনতা আমরা পেয়েছি, এর সাথে সাথে আমি চারটি স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তম্ভকে স্মরণ করতে চাই, যে স্তম্ভকে সামনে রেখে আমাদের দেশের সংবিধান তৈরী করতে হবে। গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ। আমরা গণতন্ত্র দিতে চাই এবং গণতন্ত্র দিতেই আজ আমরা এই পরিষদে বসেছি। কারণ, আজ আমরা যে সংবিধান দেবো, তাতে মানুষের অধিকারের কথা লেখা থাকবে, যাতে ভবিষ্যতের কেউ জনগণের জানমাল নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে না পারে।

এমন সংবিধানই জনগণের জন্য পেশ করতে হবে। আজ এখানে বসে চারটি স্তম্ভের উপর ভিত্তি করে আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের জন্যে এমন সংবিধান রচনা করতে হবে, যাতে তারা দুনিয়ার সভ্য দেশের মানুষের সামনে মাথা উচু করে রয়েছে, একটা বিরাট কর্তব্য আছে, আমি আমার বক্তৃতা বড় করতে চাই না। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের জন্যে যারা সংগ্রাম করে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন, তাদের সেই ইতিহাস আজ এখানে পর্যালোচনা না করলেও চলবে।

কিন্তু বিশেষ কয়েকজন নেতার কথা স্মরণ করছি, যারা গণতন্ত্রে পূজারী ছিলেন-যেমন-হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হক, বর্বর পাকবাহিনীর হাতে নিহত ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। আর কলম দ্বারা সংগ্রাম করেছেন সেই জনাব তোফাজ্জল হোসেন, আমাদের মানিক ভাই। এদের কথা শ্রদ্ধার সাথে আমরা স্মরণ করতে চাই। স্মরণ করি ১৯৪৭ সাল থেকে আজ পর্যন্ত প্রত্যেকটি আন্দোলনের সময় যারা জীবন দিয়েছেন, যারা কারাগারে জীবন দিয়েছেন। গণতন্ত্রকে এ দেশের প্রতিষ্ঠা করার জন্যে যারা সংগ্রাম করেছেন, তাদের কথা যদি স্মরণ না করি, তাদের ইতিহাস যদি না লেখা হয়, তবে ভবিষ্যৎ বংশধরেরা জানতে পারবে না এই সংগ্রামের পিছনে কারা ছিলেন।

গত বছর নির্বাচন হলো। সেই নির্বাচনের পূর্ব থেকেই আমাদের জানা ছিল যে, বাংলাদেশ জনসংখ্যায় সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকা সত্ত্বেও তারা আমাদের কলোনি এবং বাজার করে রাখতে চায়। শুধু তাই নয়, তারা আমাদের সংস্কৃতি ও ভাষার উপর আঘাত করেছিল। আমাদের নাগরিক অধিকারের উপর আঘাত করে আমাদের কলোনি করে রাখতে চেয়েছিল। আমাদের সংগ্রাম তখন থেকেই চলছিল। আমরা জানতাম সংগ্রামকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। এভাবে এগিয়ে আজ চরম সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। ২৫ মার্চ তারিখের ইতিহাস আপনাদের জানা আছে। সেইদিন বর্বর পাক হানাদার বাহিনী কোন আইন-কানুন মানে নাই। কোন সভ্য দেশে তাদের কাজের তুলনা পাওয়া যায় না।

প্রত্যেক সভ্য দেশে যুদ্ধের একটা নিয়ম আছে। কোনরূপ ওয়ানিং না দিয়েই অতর্কিতে কাপুরুষের মতো বাড়ি-ঘরে আগুন লাগিয়ে, দুধের বাচ্চা পর্যন্ত হত্যা করে তারা জঘন্য লীলায় মেতে উঠেছিল। অর্ডার দিয়েছিল আওয়ামী লীগের লোক যাকে পাও তাকেই হত্যা করো, কোনরূপ দয়ামায়া নাই। তাদের জঘন্য কাজ-কারবারের এমন সমস্ত ইতিহাস আমাদের হাত আছে, যা দেখলে শিউরে উঠতে হয়। আমাদের হাতে একজন জেনারেলের কাছে দরখাস্ত করা কাগজ ধরা পড়েছে। তাতে আছে লুটপাট করো। এমনকি পাশবিক অত্যাচারের কথাও আছে।

বর্বর ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীকে অসহায় ও নিরস্ত্র ৭ কোটি বাঙ্গালীর উপর কুকুরের মতো লেলিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেনাবাহিনী যদি যুদ্ধ ঘোষণা করতো, তবে আমরা সে যুদ্ধের মোকাবিলা করতে পারতাম। কিন্তু তারা অতর্কিত ২৫ মার্চ তারিখে আমাদের আক্রমণ করলো। তখন বুঝতে পারলাম যে, আমাদের শেষ সংগ্রাম শুরু হয়ে গেছে।

আমি ওয়ারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র। এই খবর প্রত্যেককে পৌঁছিয়ে  দেওয়া হোক, যাতে প্রতিটি থানায়, জেলায় প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে। সেই জন্যে প্রয়োজনীয় নির্দেশও দিয়েছিলাম। এই ব্যাপারে আত্মসচেতন হতে হবে। দেশবাসী জানেন একই তারিখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরোধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এটা হওয়ার উপর থেকে হয় নাই। যদি কোন নির্দেশ না থাকতো, তবে কেমন করে একই সময়ে, একই মুহুর্তে সব জায়গায় সংগ্রাম শুরু হলো?

এখন যদি আমি ভারত সরকারের বিষয়ে না বলি, তাহলে অন্যায় করা হবে। আমাদের দেশের জনগণের যখন প্রাণভয়ে ঘরবাড়ি ছেড়ে, ছোট-ছেলে-মেয়ের নিয়ে পায়ে হেটে ভারতবর্ষে যায়, তখন ভারতের জনসাধারণ তাদেরকে বুকে টেনে নেয়। ভারতের জনসাধারণ, পশ্চিমবঙ্গের জনসাধারণ, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং আসামের জনসাধারণ বিশেষ করে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সরকারকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। কারণ, তারা আমাদের জনসাধারণকে বুকে টেনে নিয়েছেন। স্মরণ করি ভারতের সেনাবাহিনীর ঐ সমস্ত জোয়ানদের, যারা আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে সংগ্রাম করেছে। আমি স্মরণ করি রাশিয়ার জনসাধারণ ও সরকারকে, যারা নিশ্চিতভাবে আমাদের সাহায্য করেছে।

তারা প্রকাশ্যে আমাদের গ্রেফতারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছেন এবং বাংলাদেশ ধ্বংশলীলা করার বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ করেছেন। স্মরণ করি গ্রেট বৃটেনের জনসাধারণকে, পশ্চিম জার্মানির জনসাধারণকে, যারা আমাদের আন্দোলনকে সমর্থন করেছিলেন। যারা যারা সমর্থন করেছিলেন, তাদের সকলকে আমাদের এ গণপরিষদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাই। এমনকি জাতিসংঘে রাশিয়া তিনটি ভেটো দিয়েছিল, তা না হলে সেখানে যে ষড়যন্ত্র চলছিল, তাতে বাংলাদেশের অবস্থা কি হতো তা বলতে পারি না। যে সমস্ত পূর্ব ইউরোপীয় দেশ আমাদের সমর্থন দিয়েছিল, বিশেষ করে পোল্যান্ড, তাদের প্রত্যেককে এবং তাদের জনসাধারণকে আমি এই পরিষদের মাধ্যমে ধন্যবাদ জানাতে চাই এবং স্মরণ করতে চাই।

জনাব স্পীকার সাহেব, এসব কথা বলতে গেলে ভাষা আসে না, মানুষ ভাবপ্রবণ হয়ে যায়। সে জন্য এগুলো বলা আমার পক্ষেও কষ্টকর। কারণ, আমি ভাবপ্রবণ হয়ে যাই। আমরা দেখতে পাই আমাদের লক্ষ লক্ষ মা-বোনকে অত্যাচার করা হয়েছে এবং আমাদের হাজার হাজার ছেলে পঙ্গু অবস্থায় রয়েছে, তাদের জন্যে কিছুই করতে পারি নাই। আমাদের বাংলার গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে ছারখার করে দিয়েছে, আমাদের কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। এ রকম কত নির্যাতনই না আমাদের লোককে সহ্য করতে হয়েছে এবং তারা যে সহনশীলতা দেখিয়েছেন সেজন্যে তাদেরকে যদি আমরা মোবারকবাদ না জানাই তাহলে অন্যায় করা হবে। আরযে সমস্ত দল আমাকে সমর্থন করেছে তাদেরকে আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ দিতে চাই এবং শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে চাই।

জনাব স্পীকার সাহেব, আমাদের সামনে আজকে বিশেষ কর্তব্য হলো জাতিকে একা সংবিধান দেওয়া এবং যতো তাড়াতাড়ি হয়ে, সেই সংবিধান দেবার চেষ্টা করা হবে। আমার সহকর্মী ভাইয়েরা, যারা এখানে উপস্থিত আছেন, আপনার মাধ্যমে তাদের সবাইকে বলে দিতে চাই যে, আপনার গাছতলায় বসে যুদ্ধ করেছেন, না খেয়ে যুদ্ধ করেছেন, পরনের কাপড়ও ছিল না। আমার সহকর্মীদের আত্মীয়-স্বজনের উপর অত্যাচার করা হয়েছে, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেম্বারদের যে অধিকার পাওয়ার আছে, সে অধিকার পুরোপুরি দেবার ক্ষমতা আমার নেই। যদি মাইক্রোফোন বিদেশ থেকে আনবার চেষ্টা করতাম, তাহলে তিন মাস সময় লাগতো, অনেক দেরি হয়ে যেতো।

এই এসেম্বলি ভবন যে অবস্থায় ছিল, তাতে মাত্র ৩০০ মেম্বার বসার জায়গা ছিল, আজকে সেখানে ৪৫০ জন বসেছেন। যদি এই এসেম্বলি ভবনও না থাকতো, তবে গাছতলায় বসেও আমার মেম্বাররা সংবিধান রচনা করতেন-এই সুনিশ্চিত আশ্বাসটুকু দিতে পারি। আজকে আমাদের জনগণ কী অসুবিধায় আছে। তাদের থাকার মতো ঘর নেই, আমরা কিছু দিতে পারছি না, মানুষ কষ্ট করছে। হাজার হাজার লোক বেকার হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে, তাদেরকে সুযোগ-সুবিধা দিতে পারছি না। অর্থ নাই-জনসাধারণকে সুবিধা করে দিতে পারছি না। কিন্তু আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন-আপনার কাছে আবার বলছি যে, আমাদের সামনে কর্তব্য হলো সংবিধান তৈরী করা। আমরা প্রোগ্রাম অনুযায়ী আগামীকাল আবার বসবো।

শুধু যে আমাদের দলীয় সদস্য থেকে কমিটি করবো তা নয়, দলমত নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে আলোচনা করা হবে, জনগণকে যাতে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী একটা সুষ্ঠু সংবিধান দেওয়া যায়, এই উদ্দেশ্যে সকলের মতামত চাইবো। এই সংবিধান মানবিক অধিকার থাকবে, যে অধিকার মানুষ চিরজীবন ভোগ করতে পারে। আমরা গত ২৩ বছর ধরে কী দেখেছি-শাসনতন্ত্রের নামে শাসনতন্ত্র, জনগণের নিরাপত্তার নামে মার্শাল ল জনগণের দাবী আদায়ের নামে প্রতারণা। আর বাংলাদেশের কথা উঠলে, হিন্দুস্থানের দালাল এই ধরনের কথা সারা জীবন শুনে আসছি। সেসব মতে এ দেশ থেকে উঠে যায়, সে জন্যে সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে এবং এ বিষয়ে সকলের সহযোগিতা কামনা করছি।

জনাব স্পীকার সাহেব, আপনি এই পরিষদের স্পীকার হয়েছেন। আবার আপনাকে জানাতে চাই যে, আমরা একটা গণমূখী সংবিধান তৈরি করতে চাই এবং সেই সঙ্গে এই আশ্বাস দিতে চাই যে, আপনি যতক্ষণ নিরপেক্ষ থাকবেন, আমাদের কাছ থেকে পূর্ণ সহযোগিতা পাবেন। আপনার কর্তব্যটুকু আইন ও আপনার বিবেক অনুযায়ী এবং পার্লামেন্টারি কনভেনশন মেনে নিয়ে পালন করবেন এই আশা করি। আপনি কোন দল বড়, কোন দল ছোট তা দেখবেন না, কার্যপ্রণালী বিধি অনুযায়ী বিচারও ইনসাফ করবেন। আমার দলের পক্ষে থেকে আপনাকে পূর্ণ সমর্থণ ও সহযোগিতা জানাবো।

এখানে যে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল, নজরুল ইসলাম তা পড়েছিলেন, আবার সংশোধন করে তা পেশ করা হবে। আপনার মাধ্যমে আমার সদস্য ভাইদেরকে ধন্যবাদ দিচ্ছি এবং আপনাকেও ধন্যবাদ দিচ্ছি। তারপর এসেম্বলি কর্মচারীরাও রাতদিন পরিশ্রম করে এতো তাড়াতাড়ি যে এই বন্দোবস্ত করতে পেরেছেন, সেই জন্যে তাদরেকেও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

কারণ, আমি জানি তারা মাত্র কয়েক দিনের নোটিশে খুব পরিশ্রম করে এই বন্দোবস্ত করতে পেরেছেন। তারপর আমি ধন্যবাদ জানাই এই রিপোটারদেরকে, এখানে যারা কাজ করছেন। তারা যেন পরিস্কার, সুন্দর করে রির্পোট তৈরী করেন, তাতে ভুল ভ্রান্তি যেন না হয়, কারণ এটা একটা ইতিহাস হয়ে থাকবে। এই ইতিহাস যেন নষ্ট না হয়। এই কথা বলে আমার বক্তব্য শেষ করছি।

জনাব স্পীকার ঃ

এই হাউসের সামনে যে প্রস্তাব ছিল তা সংশোধনের পরে যে আকারের হয়েছে, আমি তা পড়ে শুনাচ্ছি। সংশোধিত প্রস্তাব হচ্ছে।

“বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ও আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের যে বিপ্লবী জনতা, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী, বীরঙ্গণা, প্রতিরক্ষা বিভাগের বাঙ্গালীরা, সাবেক ই পি আর পুলিশ আনসার মুজাহিদ ও রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী বীর মুক্তিযোদ্ধারা নিজেদের রক্ত দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা অর্জন করেছেন। আজকের দিনে বাংলাদেশের জনগণের ভোটে যথাযথভাবে নির্বাচিত বাংলাদেশ গণপরিষদ স্বশ্রদ্ধচিত্তে তাদের স্মরণ করছে।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার যে ঘোষণা করেছিলেন এবং যে ঘোষণা মুজিব নগর থেকে ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলে স্বীকৃতি ও সমর্থিত একই সাথে এই গণপরিষদ তাতে একাত্মতা প্রকাশ করছে।

স্বাধীনতার সনদের মাধ্যমে যে গণপরিষদ গঠিত হয়েছিল আজ সে সনদের সাথেও এ পরিষদ একাত্মতা ঘোষণা করছে।

এক্ষণে এই পরিষদ বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের আশা আকাঙ্খার সেই সব মূর্ত আদর্শ, যথা জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা, যা শহীদান ও বীরদের স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্মত্যাগে উদ্ধুদ্ধ করেছিল, তার ভিত্তিতে দেশের জন্যে একটি উপযুক্ত সংবিধান প্রণয়নের দায়িত্ব গ্রহণ করেছে।

এই প্রস্তাবের পক্ষে যারা আছেন, তারা হ্যাঁ বলবেন।

সদস্যগণঃ

(সমন্বয়ে) হ্যাঁ । না কেহই বলেন না।

জনাব স্পীকার ঃ

এই প্রস্তাব গৃহীত হলো।

 

[সূত্র ঃ বাঙ্গালির কণ্ঠ, বঙ্গবন্ধু পরিষদ থেকে প্রকাশিত, পৃষ্ঠা ঃ ২৯০]

১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

মঙ্গলবার সকাল ১০ টায় বিশেষ অধিকার প্রশ্ন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী)ঃ

জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার মাধ্যমে জানাচ্ছি যে, ভবিষ্যতে আমার এই মাইকটি একটু উঁচু করে দেবেন, আমি মানুষ একটু বেশি লম্বা।

জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য হচ্ছি। আমাদের ভুললে চলবে না এবং সদস্য ভাইদের আমি বলি যে, আমরা গণপরিষদের সদস্য, সদস্যাদের একটা বিধি প্রণালী আছে; এর বাইরে প্রশ্ন করবার অধীকার নাই; এটা পার্লামেন্টারী কনভেনশন। আমি আপনার মাধ্যমে আমার সহকর্মীদের অনুরোধ করবো, দেখবেন, শেখবার চেষ্টা করবেন। আমরা বহুদিন পার্লামেন্টারী কাজ করতে পারিনি, আমাদের অভ্যাস খারাপ হয়ে গেছে। ১৯৫৮ সালের ‘মার্শাল ল’ জারীর পরে পার্লামেন্ট হয়নি; সেই জন্য আমরা সুযোগ পাইনি পার্লামেন্টারী রাজনীতি কাকে বলে এবং গণপরিষদ কাকে বলে তা শিখবার। সেই জন্য আমাদের কিছু অসুবিধা হয়। তাই বহুদিন পর সদস্যরা এসে কথা বলতে চায়, যদিও সেটা অনেক সময় বিধি বা Rules এর বাইরে হয়।

আমি আপনার মাধ্যমে অনুরোধ করব যখন একজন কথা বলেন, তখন অন্য কারো বাঁধা দেওয়া উচিৎ নয়; এরূপ নিয়ম নাই। আমি আপনার মাধ্যমে জানতে চাই যে, গণপরিষদ একটা সুপ্রিম বডি, আমাদের ব্যবহারে বাইরে এমন কিছু প্রকাশ পাওয়া উচিৎ নয় যাতে জনসাধারণের কাছে আমাদের  ইজ্জত নষ্ট হয়। আমি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলতে চাই যে, যেসব রুলস, রেগুলেশন এবং বিধি আছে, তা আপনি অনুসরণ করেন। আমি আপনাকে এই হাউসের পক্ষ থেকে কথা দিচ্ছি, আমি আপনার সঙ্গে সম্পূর্ণ সহযোগিতা করব।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ

মেম্বারদের আর একটা বিষয় হুঁশিয়ার করতে চাই। স্পীকার যখন কথা বলেন, তখন আর কোন মেম্বরের অধিকার নাই কথা বলার। বললে আপনি মেহেরবাণী করে তাঁকে পরিষদ থেকে বের করে দিতে পারেন।

পরিষদ কমিটি গঠন প্রসঙ্গে

জনাব স্পীকার ঃ

আমি সদস্যবৃন্দকে অনুরোধ করছি যে, আপনারা এখানে একে অন্যের কথা বলবেন না এবং সকলে স্পীকারকে সম্বোধন করে কথা বলবেন। যা কিছু বলবেন তা স্পীকারকে সম্বোধন করেই বলবেন। আর কোন বক্তৃতা নয়, বর্তমানে হাউসের সামনে আর কোন প্রস্তাব নেই। যে প্রস্তাব ছিল, তা অনুমোদিত হয়েছে, গৃহীত হয়েছে। এখন আর কোন কাজ নেই, এখন পরিষদ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব সমাপ্তি বক্তৃতা করবেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঃ

জনাব স্পীকার সাহেব, আমি আপনার মাধ্যমে পরিষদ সদস্যদের আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমি আশা করি আপনারা কিছু মনে করবেন না, অনেকদিন পর আমরা এখানে বসার সুযোগ পেয়েছি। তাই অনেক সময় আমরা পরিষদ বিধি না মেনে অনেক কথা বলে ফেলেছি, কিছুদিন আপনাকে এটুকু সহ্য করতে হবে। কারণ সদস্যরা বহুদিন পর এখানে বসবার সুযোগ পেয়েছেন। সকলে এখন পর্যন্ত সব জিনিস দেবার সময় পান নাই- তাই মাঝে মাঝে দুই একটা কথা কেউ কেউ এদিক ওদিক বলে ফেলেছেন।

আমি আপনার মাধ্যমে গণপরিষদ সদস্যদের বলতে চাই যে, আপনারা কটাক্ষ করে কেউ কাউকে কিছু বলবেন না। কারও প্রতি কটাক্ষ করে কথা বলা উচিৎ নয়। কোন সদস্য অন্য কোন সদস্যকে সম্বোধন করে কথা বলতে পারেন না। সকল মেম্বারকেই জনাব স্পীকারকে সম্বোধন করতে হবে-এটা সকল সদস্যের জানা দরকার।

আমি আবার সদস্যদের অনুরোধ করছি আপনারা কারো প্রতি কটাক্ষ করে এই পরিষদে কোন কথা বলবেন না। আমার আর একটি আবেদন এই যে, আপনারা যে গণপরিষদের সদস্য, একথা যেন ভুলে না যান। আমি আপনার মাধ্যমে সদস্যদের আরও বলতে চাই যে, পরিষদে একজন বলতে উঠলে সঙ্গে সঙ্গে আর পাঁচজন দাঁড়িয়ে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবেন না। এতে পরিষদের শৃঙ্খলা নষ্ট হবে এবং এর দ্বারা প্রমাণিত হবে যে, আমরা পরিষদ সদস্য হবার যোগ্য নই। আমি আশা করি পরিষদের সকল সদস্য সেদিকে খেয়াল রাখবেন।

আপনি যেভাবে দুই দিন পরিষদের কাজ চালিয়েছেন, তার জন্য এই গণপরিষদের পক্ষ থেকে আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। পরিষদ সদস্যরা যেভাবে দুই দিন ধৈর্য্য ধারণ করে পরিষদের কাজ চালাতে সাহায্য করেছেন, তাতে তাঁদেরকেও আপনার মাধ্যমে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির আজ যে সভা হবে, সেখানে দরজা বন্ধ করে সব বিষয় আলোচনা করতে পারবেন। আজ বিকাল ৫টায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে সভা হবে। সেখানে পার্টির সব বিষয় আলোচনা করা হবে।

আপনারা জানেন আমাদের এখানে একজন মাত্র ন্যাপের সদস্য আছেন। তিনি কিছু বেশী সুযোগ পেতে পারেন। সে জন্য আপনারা কিছু মনে করবেন না, তাঁকে সুযোগ পেয়েছেন। তিনি ভবিষ্যতে নিশ্চই আরও সুযোগ পাবেন। এখানে কথা বলার অধিকার সকলেরই থাকবে। গণপরিষদে বিরোধী দল বলে কোন জিনিস নাই। এটা আফসোসের বিষয়। গণতন্ত্রের বিরোধী দল থাকা উচিৎ। নির্বাচন হয়েছে, বিরোধী দলের সদস্যরা অধিক সংখ্যক নির্বাচিত হতে পারেন নাই। সে জন্য দুঃখ করে লাভ নাই। ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই এখানে বিরোধী দল হবে। আপনারা দেখতে পাবেন। বিরোধী দল হলে আমি তাদের স্বাগত জানাব।

পরিশেষে আমি এখানকার সকল কর্মচারীকে পরিষদের পক্ষ থেকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি। গণপরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে সদস্যদের ধন্যবাদ দেওয়ার এখানে প্রয়োজন নাই। তবে সদস্যরা যেভাবে সহযোগিতা করেছেন, সে জন্য আমি সদস্যদের ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনাদের সকলকে ধন্যবাদ; খোদা হাফেজ।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment