আমার কবীর সুমন | অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ

কবীর সুমন, আমার কবীর সুমন, আমাদের কবীর সুমন।আমরা যখন বড় হচ্ছিলাম, তখন সুমনের গান এলো। আমাদের ছেয়ে ফেললো। একে, দুয়ে বা সদলবলে যখন যেখানে গান বা গানের কথা, সেখানেই কবীর সুমনের। প্রেমের অনুভবে-প্রকাশে, বিরহে, প্রতিবাদে, আন্দোলনে – সবখানেই ছিলেন কবীর সুমন আমাদের সাথে। তৎকালীন সুমন চট্টোপাধ্যায় নাম, একই গান নিয়ে।

Kabir Sumon | কবীর সুমন
Kabir Sumon | কবীর সুমন

স্বর্গীয় প্রেমের গান ছেড়ে যেন আমাদের প্রেমের কথা। আমাদের ছোট ছোট সুখ দুঃখের কথা। আমার, আমার বন্ধুর, রাস্তার দোকানদার, আমার আত্মীয়- সব যেন আমাদের কথা। গানের একটা ভিন্ন জগত খুলে দিয়েছিলেন তিনি।

বড় হতে হতে জেনেছি সে আসলে গানের এক বিরাট এন্সাইক্লোপিডিয়া। সুর, গান, গানের গল্পের অফুরন্ত ভান্ডার [ তার ভাষায় ব্লটিং পেপার ] । সাথে সময়কে এবং গানকে দেখার অনন্য অসাধারণ দৃষ্টিভঙ্গি।

গায়ক, গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক, কবি, গদ্যকার, সাংবাদিক, রাজনৈতিক কর্মী, টিভি উপস্থাপক ও নৈমিত্তিক অভিনেতা- কত পরিচয় আছে তার। আমাদের কাছে সবচেয়ে কাছের পরিচয়টি “গানওয়ালা”।

আমার কবীর সুমন [ My Kabir Suman ]:

সুমনের প্রথম অ্যালবাম  “তোমাকে চাই”।  ১৯৯২ সালের ২৩ শে এপ্রিল “তোমাকে চাই” এ্যলবামটি বেরিয়েছিলো। আমারা যখন শুনলাম তখন অলরেডি গানের জগতে হুলুস্থুল লেগে গেছে। বড় ভাই ক্যাসেটটি আমার হাতে দিয়ে বললেন “শোন”। সেই ক্যাসেটটি শুনে শুনে নষ্ট হলো, আবার কিনলাম। বহু কপি কিনে বন্ধুদের দিলাম। সেই এ্যবাম বেরোবার ইতিহাস লিখতে গিয়ে সুমন লিখেছিলেন

তোমাকে চাই এ্যলবামের প্রথম পিঠের প্রথম গান ছিলো তোমাকে চাই । এ গানটির ভুত খুব করে ধরেছিল প্রথম কদিন। কিন্তু বহুবার শোনার কারণে কিনা জানিনা। এই গানটি আমার অতটা প্রিয় থাকেনি। তার চেয়ে এই এ্যালবামের অন্য কিছু গান বেশি প্রিয় হয়ে উঠেছিল।

আরও ছিল, পেটকাটি চাঁদিয়াল,  তুই হেসে উঠলেই, কখনো সময় আসে , যতি ভাবো কিনছো আমায়, হাল ছেড়ো না। তোমাকে চাই এ্যলবামের অপর পিঠে ছিলো: তিনতালের গান, পাগল, চেনা দুঃখ চেনা সুখ, মন খারাপ করা বিকেল, দশ ফুট বাই দশ ফুট, আমাদের জন্য।

এরপর ১৯৯৩ তে এলো অ্যালবাম “বসে আঁকো”। আরও কত কত এ্যলবাম। ২০০২ সালের পর থেকে আমরা সুমনের সাথে খুব লেগে ছিলাম না। জীবিকার ব্যস্ততায় পুরনো বন্ধুর মতো মাঝে মধ্যে দেখা হতো, কি হচ্ছে জানা হতো। বা একা একা কখনও তার পুরনো গানগুলোর জাবর কাটা। তবে এর মাঝে কিছু গান চট করে সামনে এসে আটকে গিয়েছি, সেগুলো হলো :

একটা থালায়- কবীর সুমন

একটা থালায় চাটটে রুটি,

একটু আচার একটু ডাল ।
একই থালায় দুজন খাবে,
যুদ্ধ হয়ত আসছে কাল ।

একটা মাঠে দুজন সেপাই,
দেশ বিভাগের সীমান্তে ।
দুজন আছে দুই দিকে,
আর বন্ধু তারা অজান্তে ।

তারা এদেশ ভাগ করেনি,
দেয়নি কোথাও খড়ির দাগ ।
নেতারা সব ঝগড়া করেন,
জলে কুমির ডেঙায় বাঘ ।

ঝগড়া থাকে আড়াল করে,
লাভের মাটি লাভের গুড় ।
সীমান্তে দুই দেশের সেপাই,
দেশপ্রেমের দিনমজুর ।

দুই কাঁধে দুই বন্দুক,
আর বুলেট বেশি খাবার কম ।
রাজধানীতে হিসেব কষে,
এদের নেতা ওদের যম ।

যমের বাড়ি কাছেই আছে,
অনেক দূরে নিজের ঘর ।
দেশপ্রেমের নজির হল,
এই চিতা আর ওই কবর ।

ক্ষিধের কিন্তু সীমান্ত নেই,
নেই চিতা নেই কবরটাও ।
যুদ্ধটাকে চিতায় তোল,
যুদ্ধটাকে কবর দাও ।

তাই বন্দুক নিলে হাতে– কবীর সুমন

কিছুই পড়েনা পাতে,
তাই বন্দুক নিলে হাতে।
শাল বনের দস্যি ছেলে,
এত সাহস কোথায় পেলে।

শাল মহুয়ায় খুঁজি কাব্য,
ছুটি ছাটায় বেড়াতে গিয়ে।
আজ কারখানা নিয়ে ভাবব,
কোন সৃষ্টিকে সাথে নিয়ে।

তুমি বন বাদাড়ের লোক,
শালবনের দস্যি ছেলে।
বড় এক রোখা দুটো চোখ,
তাই বন্দুক খুঁজে পেলে।

সাতচল্লিশ শাল থেকে শুধু,
খিদেই দেখলে চেখে।
কাদের অন্য কাদের খাওয়া,
বোকা ছেলের কান্না পাওয়া।

অরণ্যে দিন রাত্রি,
আমি চলচ্চিত্র যাত্রী।
আমি শুটিং করতে আসি,
আমি সভ্যতা ভালবাসি।

খোঁজ সভ্যতা কোন খানে,
খোঁজ উন্নয়নের মানে।
ভাব কোন পথে তুমি চলবে,
বড় কারখানা গড়ে উঠবে।

হবে দিন গুজরান কাজ,
হবে গণতন্ত্রের সাজ।
নাকি স্বপ্ন দেখবে রাতে,
একা বন্দুক নিয়ে হাতে।

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 1 আমার কবীর সুমন | অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ

 

১৬ অক্টোবর ২০২২:

কবীর সুমন আমাদের চিন্তা জগতের অনেক দিককে প্রভাবিত করেছেন। তার মধ্যে একটি রাজনীতি। তিনি আমার চিন্তাকে অনেক বেশি রাজনৈতিক করেছেন।

তিনি বুঝিয়েছেন অন্য শহরের পপড়ী’র চিকিৎসা না পেয়ে মরে যাওয়া, সঞ্জীব চাকরির ভুল পরীক্ষায় পড়ে মরে যাওয়া, বোমায় নিষ্পাপ বাচ্চা ছেলেগুলোর মৃত্যু – এসব কোন কিছুই অন্যদের গল্প নয়, এটা আমাদের গল্প। এমনকি সবই আমার গল্প, একদম পার্সোনাল, ভেরি পার্সোনাল। আর ব্যক্তিগতর মতই জরুরী।

মগজের মধ্যে বসে বসে বলতে থেকেছেন – তোর মানুষ, তোর দেশ, তোর ভাষা, তোর পৃথিবী। এটা শুধু অচেনা অন্যদের বিষয় না, এটা তোদের বিষয়, তোর বিষয়, পার্সোনাল বিষয়। রিকশা চালানো তরুণটির স্বপ্ন তোর স্বপ্ন থেকে বিচ্ছিন্ন না। ঠেলা ভ্যানওয়ালার গল্পটাও একই রকম গুরুত্বপূর্ণ। চেনা দুঃখ চেনা সুখ – আসলে চেনা নয়, দেখা হয়নি ফিরে, তাই ভালো করে দেখা জরুরী।

মাথার মধ্যে নিষিদ্ধ ইশতেহার পড়তে থেকেছেন সারাক্ষণ।
বারবার বলেছেন – বোবা কালা হয়ে থাকিস না। কিছু প্রশ্ন তো করাই যায়, যেমন – সাঁওতাল কেন তার নিজের ভাষা নিয়ে আগাতে পারবে না? কেন বিজেপি নেতার সালমা খাতুন পুত্রবধূ হতে পারবে না? ক্ষুধার কি সীমান্ত আছে? এরকম কত শত প্রশ্ন!!!

আবার রাজনীতি থেকে সরিয়ে, আমাদের একাকীত্বে নিয়ে, দেখিয়েছেন, দুরে, অশ্রু নদীর অপর পাড়ের রবীন্দ্রনাথকে। বলেছেন – ব্রহ্ম মুহুর্তে রাগ যোগিয়ায় রেখাবের রূপটা দেখিস, পারলে ভীমসেন জোশীর কণ্ঠে। বিসমিল্লার পাগলা সানাই এর স্বাদ নিয়ে দেখিস। আমির খানের ললিতটা শুনিস। আরও কত কি সব।

কাল দেখলাম চালশের গান শোনানো সুমন বৃদ্ধ হয়েছেন।
সারা জীবন আমর মতো বহু জনকে বনস্পতির ছায়া দেয়া সুমনের শরীর খুব স্বাচ্ছন্দ্যে সঙ্গ দিচ্ছে না।

বারবার মনে হচ্ছিল – সুমন একদিন থাকবেন না। কিন্তু এই ভাবনা মোটেই ভাবতে ইচ্ছে হচ্ছিল না। গলা আটকে আসছিল।

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 2 আমার কবীর সুমন | অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ

 

১৯ অক্টোবর ২০২২:

কবীর সুমনের মুল অবদান গীতিকবি হিসেবে।

ভারতবর্ষের ভাষাজাতি গুলোর মধ্যে, একমাত্র বাঙালির স্বাতন্ত্র্য সম্পত্তি “আধুনিক বাংলা গানের”, আধুনিক গীতিকার হিসেবে। গায়ক, সুরকার হিসেবে বিচারটা পরে ।
সুমন আধুনিক বাংলা গানের রাজনৈতিক ও সমসাময়িক অঙ্গকে যতটা পুষ্ট করেছেন, তেমনটি অন্য কেউ করেননি।

পাশাপাশি বাংলা সাহিত্যের প্রথম বিশ্বভিখারি ও ত্রাতা মাইকেল মধুসূদনের উত্তরসূরি হিসেবে, সারা বিশ্বের নানা সঙ্গীতের রূপ-রস ভিক্ষে করে, আমাদের জন্য এনেছেন। তাদেরকে বাংলা শিখিয়ে, বাংলা পোশাক পরিয়ে, বসিয়ে দিয়েছেন আধুনিক বাংলা গানের সাথে।

আমাদের বোবা প্রাণের কথাকে ভাষা, ছবি বা সুর দিয়ে প্রতিষ্ঠিত করা শিল্পীর কাজ। সুমন আমাদের প্রজন্মের এমন অনেক বোবা এক্সপ্রেশনে ভাষা দিয়েছেন। আবার ফরাসি এক্সপ্রেশন “বঁজো ত্রিস্তেত” এর মতো একটি এক্সপ্রেশনকে ভিক্ষে করে, আমাদের জন্য “সুপ্রভাত বিষণ্ণতা” বানিয়েছেন।

সুমন তার গানের মধ্যে দিয়ে আমাদের অসংখ্য প্রবাদপ্রতিম শিল্পীর সাথে পরিচয় করিয়েছেন, তাদেরকে দেখার ভিন্ন দৃষ্টিকোণ দিয়েছে, যাদের এমনিতে হয়তো আমরা কোনদিন খুঁজতাম না। আমাদের এক বন্ধু বেঙ্গলের অনুষ্ঠানে চৌরাসিয়া বাঁশির দিন ভিড় দেখে সুমনকে দায় দিয়েছিলেন।

এই সবই থাকবে। আগামী শিল্পীদের উপরে প্রভাব রাখবে।

রেকর্ডিং যুগে বাংলায় নিজেরা অনেক গান লিখে, নিজে সুর দিয়ে, নিজেই গেয়েছেন, এমন লোক খুব বেশি নেই। যারা আছেন, তারা নিজেরা কেউবা ভালো গাইতেন না, কেউ গাইলেও বেশি রেকর্ডিং করেন নি। সেদিক দিয়ে পুরো প্যাকেজ হিসেবে সুমন অনন্য।

বাংলা খেয়ালের জনপ্রিয় হবার সম্ভাবনা নিয়ে আমার একটু শঙ্কা আছে। কারণ সুমন বেশিরভাগ বান্দিশ বাঁধছেন অপ্রচলিত রাগে, যেগুলো নিয়মিত গান-বাজনা প্রচার কম। আবার জনপ্রিয় রাগগুলোতে যখন খেয়াল বাঁধছেন, তখন হয়তো সচেতন ভাবে, খুব প্রচলিত চলন গুলোকে এড়িয়ে বাঁধছেন। এর আর্কাইভাল ভ্যালু থাকলেও, নিয়মিত খেয়াল গায়কদের গাওয়ার আগ্রহ কতটা থাকবে জানিনা।

সুমনের একটা বড় ক্ষমতা এখনো পুরোটা প্রকাশ হয়নি। সেই এখন ইন্ডাস্ট্রি একমাত্র জীবিত ব্যক্তি, যিনি নজরুল ইসলাম থেকে শুরু করে, আধুনিক বাংলা গানের স্বর্ণযুগ সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি খুঁটিনাটি জানেন, বিচার করার দৃষ্টিও আছে। সেটা তাকে দিয়ে ডকুমেন্টেড করানো জরুরী।

 

আমার কবীর সুমন [ My Kabir Suman ]

 

২২ অক্টোবর ২০২২:

ভাইরে,
আমি জানি না কবীর সুমন কটা বিয়ে করেছেন।
জানি না কারণ জানার প্রয়োজন বোধ করিনি।
প্রয়োজন বোধ করিনি কারণ:

১. সুমনের সাথে বা তার ছেলেমেয়ের সাথে আমার কোন আত্মীয়র এ্যরেন্জ ম্যারেজের জন্য খোঁজ খবর নিতে বলা হয়নি।

২. কটা বিয়ে বা প্রেম করতে হবে, এই শিক্ষা আমি সুমনের থেকে নেই না। নেয়ার প্রয়োজন বোধ করিনা। কারণ:
– প্রথমত তিনি রিলেশনশিপ এক্সপার্ট না।
– দ্বিতীয়ত তিনি আমাকে বিবাহ বিষয়ক কোন সম্পর্ক নিয়ে কোনদিন উপদেশ দিতে আসেন নি।
– তৃতীয়ত এই বিষয়ে তার জীবন সবার জন্য আদর্শ বলেন নি।
– চতুর্থত তার শ্রোতা হিসেবে আমার ব্যক্তিগত জীবন তার মতো হতে হবে, এমন শর্ত দেন নি।

৩. শ্রোতা বা পাঠক হিসেবে, সুমনের সাথে আমাদের যে ধরণের যোগাযোগ, তার মধ্যে বিয়ে সংখ্যা কোন প্রটোকল প্যারামিটার না। মানে তাতে কম বেশি কিছু হয় না।

সুমন আমাদের প্রিয় কবিয়াল। সুমন তার গান বা সাহিত্যে যেটা করেন, সেটা নিয়েই আমার মাথা ব্যথা।
আসুন কথা হলে তাই নিয়ে হোক।

 

কবীর সুমনের বই:

দশটির বেশি পূর্ণ বই প্রকাশনা আছে তার। সব পড়তে পারিনি। নিচের দুটো মাত্র পড়া হয়েছে।

১. হয়ে ওঠা গান
২. কোন পথে গেল গান

আমার গান খেকো সিরিজের বিভিন্ন ধরনের আর্টিকেল সূচি:

ঘোষনা:

শিল্পীদের নাম উল্লেখের ক্ষেত্রে আগে জ্যৈষ্ঠ-কনিষ্ঠ বা অন্য কোন ধরনের ক্রম অনুসরণ করা হয়নি। শিল্পীদের সেরা রেকর্ডটি নয়, বরং ইউটিউবে যেটি খুঁজে পাওয়া গেছে সেই ট্রাকটি যুক্ত করা হল। লেখায় উল্লেখিত বিভিন্ন তথ্য উপাত্ত যেসব সোর্স থেকে সংগৃহীত সেগুলোর রেফারেন্স ব্লগের বিভিন্ন যায়গায় দেয়া আছে। শোনার/পড়ার সোর্সের কারণে তথ্যের কিছু ভিন্নতা থাকতে পারে। আর টাইপ করার ভুল হয়ত কিছু আছে। পাঠক এসব বিষয়ে উল্লেখে করে সাহায্য করলে কৃতজ্ঞ থাকবো।

*** এই আর্টিকেলটির উন্নয়ন কাজ চলমান ……। আবারো আসার আমন্ত্রণ রইলো।