ইজতিহাদ / ইশতিহাদ এর রাস্তা খুলতে হবে

ইজতিহাদ / ইশতিহাদ এর রাস্তা খুলতে হবে।

প্রিয় শারুন,
গত রাতে অনেক কথা হলো। আপনি পুরানো ক্ষতটা খুঁচিয়ে দিলেন। তারপর দীর্ঘক্ষণ ঘুমাতে পারিনি। ভাবলাম আপনাকে ভাবনার সারাংশটা লিখে জানাই। লেখার এক পর্যায়ে মনে হল লেখাটা পাবলিকলি শেয়ার করি। কারণ এই ক্ষতটা শুধু আপনার আমার না। আমাদের মতো বিবেকের দংশনে কাতর বহু মুসলিমের।

ইশতিহাদ এর রাস্তা খুলতে হবে
কালো মেঘ সরাতে ইশতিহাদ এর রাস্তা খুলতে হবে

গত শতকের শেষ দিক থেকে ইসলামিক নব অভ্যুত্থান আমাদের যেদিকে নিয়ে যাচ্ছে, তাতে আমরা ক্রমশই আধুনিক জাতিরাষ্ট্রে বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছি। বর্তমানে প্রচলিত শরিয়া সিদ্ধান্তের আলোকে আমরা- আধুনিক জাতিরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, সংবিধান, গণতন্ত্র ও বিশ্ব-স্বীকৃত মানবাধিকারকে মেনে নিতে পারছি না। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছে বিভিন্ন বিশ্বাসের আস্তিক, নাস্তিক, সংশয়বাদী সহ সবারই নিরাপত্তা ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করার উপরে। যেসব বিষয়কে আমরা আমাদের ধর্মের বর্তমান ফ্রেমওয়ার্ক এর মধ্যে কোন ভাবেই বৈধতা দিতে পারছি না। আর সেমেটিক ধর্মগুলোর মধ্যে আমাদের ইনসার্জেন্স এমন একটি সময়ে হয়েছে, যখন জাতি রাষ্ট্রগুলো ও রাষ্ট্রসংঘ পৃথিবীর অতীত যেকোনো সময়ের চেয়ে শক্তিশালী। এগুলোর বিরোধিতা নিজের অস্তিত্ব ধ্বংসের নামান্তর।

SufiFaruq.com Logo 252x68 2 ইজতিহাদ / ইশতিহাদ এর রাস্তা খুলতে হবে

আজ মানসিক বা শারীরিক ভাবে আমরা অসম্ভব যুদ্ধে লিপ্ত। এটা জেনেও যে এই যুদ্ধে উভয়পক্ষের কিছু মানুষের সম্পদ এবং প্রাণনাশ ছাড়া আর কোন ফল নেই। বিজয় হবে সহবস্থানের এবং বিজয় ঐ সকল প্রতিষ্ঠানেরই। আর শুধুমাত্র আমাদের মতকে প্রতিষ্ঠার জন্য এসব প্রতিষ্ঠান তার ভিত্তি ধ্বংস করবে কেন?

তাহলে আমাদের সামনে সম্প্রীতির সাথে সহাবস্থানের রাস্তা টা কি? যেই রাস্তায় গেলে আমার ধর্মও বাঁচবে, আবার আধুনিক জাতি রাষ্ট্রের উপযোগী নাগরিকও থাকতে পারবো।

রাস্তা বের করতে হবে ভাইয়া। আমাদের বাঁচতে হলে নতুন রাস্তা বের করতে হবে।

একবার ভেবে দেখুন, একসময়ের এরোপ্লেনে হজ্জ করা হারাম থেকে হালাল হয়েছে। আজ হারাম বিশ্ব ব্যাংকিং ব্যবস্থার সাথে শরিয়া ব্যাংকিং চলছে এবং সেটাকে আমরা ইসলামিক বলে মেনে নিয়েছি। ছবি তোলা হারাম ছিল, আজ আলেম সমাজ নিয়মিত টেলিভিশনে আসছেন, পত্রিকায় নিজের ছবি সহ প্রেস রিলিজ পাঠাচ্ছেন। যেসব সংস্কারপন্থী মুসলিমদের এক সময় আলেম সমাজ হত্যা ফরজ বলে ফতোয়া দিয়েছিল, তাদের কারও কারও নামের সাথে আজ আমরা “রহমাতুল্লাহ আলাইহে” বলছি। প্রয়োজনের সাথে সাথে এরকম বহু হারাম-হালাল এর ডেফিনিশন বদলেছে, শরিয়া বদলেছে। ইসলাম তো এমনই হবার কথা ছিল। আবহমান নদীর মতো যেটা বাস্তব প্রয়োজনের সাথে গতিপথ বদলাবে।

তার মানে নিশ্চয় রাস্তা আছে। আমাদের পক্ষেও ধর্ম বাঁচিয়ে সম্প্রীতির সাথে বাঁচার উপায় আছে। হয়ত সেই রাস্তা “ইশতিহাদ” এর রাস্তা, র‍্যাশনাল চিন্তার রাস্তা। যেটা ইসলামে পূর্ণ স্বীকৃত। সেই রাস্তা, যেটা এক সময় মুসলিমদের বেশিরভাগ বিতর্কের সমাধান দিয়েছিল। সেই রাস্তা, যেটা বন্ধ হয়ে গিয়ে গিয়ে আমরা অন্ধ হয়ে গিয়েছি।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, সেই রাস্তা খুঁজবে কে আর চালু করবে কে?
যারা এই মুহূর্তে ধর্মের অথরিটি ভোগ করছেন, তারা সঙ্গত কারণে সেই রাস্তা খুলতে স্বস্তি বোধ করেন না। যারা ধর্ম বিশ্বাস করেন না, তাদের সেই রাস্তা খোলার অথরিটি নেই। তাই সেই রাস্তা খোলার মধ্যস্থতা করতে পারে একমাত্র প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি ধর্ম শিক্ষায় শিক্ষিত, বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী-ধর্মের-আচারের মানুষের সাথে মেলামেশায় অভিজ্ঞ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে জ্ঞাত সাধারণ মুসলিম। তাদের ফকিহ হবার প্রয়োজন নেই, উদ্যোক্তা হবার প্রয়োজন।

SufiFaruq.com Logo 252x68 1 ইজতিহাদ / ইশতিহাদ এর রাস্তা খুলতে হবে

ভবিষ্যতে সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্মের চেহারা কি হবে, সেটা আমি আপনি ঠিক করে দিতে পারবো না। সেটা ধর্ম বিশ্বাসী বা অবিশ্বাসীরাও নির্ধারণ করবেন না। সেটা নির্ধারণ করবে সময়। যার উপরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব থাকবে বিজ্ঞান, প্রযুক্তি ও বাণিজ্যের। কিন্তু সচেতন মানুষ হিসেবে বা রাজনীতিবিদ হিসেবে আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে এমন কিছু উদ্যোগ নেয়া যেন সেই পথ-পরিক্রমা যতটা সম্ভব শান্তিপূর্ণ হয়। আর মুসলিম হিসেবে আমার আপনার নিজের অস্তিত্বের বিষয় তো আছেই।

আমি রাতারাতি সমাজ বদলে বিশ্বাস করি না। বল প্রয়োগে ধর্ম বা সংস্কৃতি বদলেও না। রাতারাতি পরিবর্তনের বাজে উদাহরণ হিসেবে তুর্কি আমাদের সামনে রয়েছে। আর বর্তমান শরিয়া সিদ্ধান্তের বাস্তবায়ন করতে প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উদাহরণ রয়েছে আফগাসিন্তান, পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্রগুলোতে।

তাই সব মত, সব পথকে সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ভাবে একোমোডেট করার আমাদের লক্ষ্য হওয়া দরকার। মনে রাখতে হবে- বিভিন্ন বিশ্বাসের আস্তিক, নাস্তিক, সংশয়বাদীদের পরস্পরের উপরে বিভিন্ন যৌক্তিক-অযৌক্তিক ক্ষোভ আছে। সংখ্যাতেও কেউই অবহেলা করার মতো নয়। তাই একটা সমাধানের লক্ষ্য নিয়ে, সবার বিশ্বাস ও মতের উপরে শ্রদ্ধা রেখে, শান্তিপূর্ণ আলাপ-বিতর্কের মাধ্যমে সিদ্ধান্তই তার প্রশমন করতে পারে।

উদ্যোগটি কেমন হতে পারে সেটা নিয়া চলুন চিন্তা করি।

আমার লেখাটি যেসব মুসলিম বোন/ভাই পড়ছেন, তাদেরকেও বলব আপনারাও ভাবুন।

[ ইশতিহাদ এর রাস্তা খুলতে হবে ]

আরও পড়ুন: