কারিগরি শিক্ষা বদলে দেবে জীবন

আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের শিক্ষার মধ্যে কারিগরি শিক্ষা হল অন্যতম সময়োপযোগী শিক্ষা। বর্তমানে সব জায়গায় অভিজ্ঞ ও দক্ষ জনশক্তির ব্যাপক চাহিদা। সুতরাং সহজেই এ বহুমুখী ক্যারিয়ারে প্রতিভার বিকাশ ঘটানো সম্ভব।

কারিগরি শিক্ষা :
হাতে কলমে বাস্তবধর্মী শিক্ষাই হল কারিগরি শিক্ষা। অর্থাৎ যে শিক্ষা কোন একটা বিষয়ে দক্ষ করে তুলে। প্রযুক্তির যুগ। তাত্ত্বিক জ্ঞান থেকে হাতে কলমে প্রশিক্ষিত জ্ঞান বেশি সমাদৃত। তাই কারিগরি শিক্ষার গুরুত্বও বেশি। কোন জাতির স্কিল্ড ওয়ার্কার তৈরিতে যেমন উচ্চশিক্ষা জরুরী, তেমনি জরুরী ভোকেশনাল ট্রেনিং Technical and Vocational Education and Training (TVET)। পেশাগত অর্থে, ভোকেশনাল শিক্ষাব্যবস্থা হল কাউকে চাকুরী বা কর্মের জন্য উপযুক্ত করে তৈরি করা। সামষ্টিক অর্থে ভেট ট্রেনিং ব্যবস্থা নির্ভর করে কোন দেশের আর্থসামাজিক ও ইনভায়ারনমেন্টাল প্রেক্ষাপটের উপর। এ অর্থে পৃথিবীর যেকোনো দেশের চেয়ে আমাদের দেশের টিভেট ব্যবস্থা হবে আরো বেশী বিস্তৃত ও সাস্টেনেবল। বিদেশে ভেটে শিক্ষা দেয় ব্যবসায়ে, প্রশাসনে, বিজ্ঞানে, ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে, হেলথসাইন্সে, ইত্যাদি। তাই মাঝে মাঝে কারিগরি শিক্ষাকে বলা হয় স্বীকৃত টেকনিক্যাল এডুকেশন ব্যবস্থা যার কদর অনেক সময় বিশ্ববিদ্যালয়’কেও ছাড়িয়ে যায়।

কেন কারিগরি শিক্ষা?
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হল – “কারিগরি শিক্ষা নিলে বিশ্ব জুড়ে কর্ম মিলে।” কারিগরি শিক্ষা নিলে কখনই বেকার থাকতে হয় না। এই বিষয়ে পড়লে চাকরি খুঁজতে হবে না। নিজে স্বলম্বী হতে চাইলে, ল্যাব অথবা ওয়ার্কশপ দেয়া যায়। তৈরি করা যায়, নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ। উন্নত দেশ যেমন- জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মালয়েশিয়ার উন্নতির পেছনে রয়েছে এই কারিগরি শিক্ষা। জার্মানিkc কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিতের হার শতকরা ৬৬ ভাগ, সিংগাপুরে ৬৫, জাপানে ৬০, দক্ষিণ কোরিয়াতে ৪০ এবং মালয়েশিয়াতে ২৫ ভাগ। তাই এই শিক্ষা শুধু ব্যক্তি কিংবা পরিবারের নয়, দেশেরও উন্নতি করবে।

 

পড়াশুনা:
কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে ক্যারিয়ার গড়তে চাইলে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটে ৪ বছর মেয়াদি ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্সে পড়াশোনার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে ৪৯টি সরকারী পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট রয়েছে। এর মধ্যে পুরনো ইন্সটিটিউটের সংখ্যা ২০টি, যেগুলো পুরোপুরি সরকারি। নতুন রাজস্বভুক্ত ইন্সটিটিউটের সংখ্যা পাঁচটি, মনোটেকনিক ইন্সটিটিউট তিনটি, প্রকল্পভুক্ত ১৮টি ও মহিলা পলিটেকনিক ইন্সটিটিউটের সংখ্যা তিনটি। বেসরকারী পলিটেকনিকের সংখ্যা একহাজারের চেয়েও বেশি। তবে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হওয়ার আগে ভাল করে খোঁজ নিতে হবে। প্রাতিষ্ঠানিক নিবন্ধন, পড়াশুনার মান ইত্যাদি বিষয়ে।

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড :
Bangladesh Technical Education Board বা বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড ১৯৬৭ সালের ১নং সংসদীয় কারিগরি শিক্ষা আইনবলে স্থাপিত হয়। বাংলাদেশে কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের মান প্রণয়ন, নিয়ন্ত্রণ, মূল্যায়ন ও উন্নয়নের সার্বিক দায়িত্ব বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের উপর ন্যস্ত। বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তর কেন্দ্রীয়ভাবে দেশের সকল পলিটেকনিক পরিচালনা করে। একজন অধ্যক্ষের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে উপাধ্যক্ষের সহযোগিতায় যাবতীয় একাডেমিক, প্রশাসনিক ও উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়।

পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট :
Polytechnic Institute বা লিটেকনিক ইন্সটিটিউট একটি কারিগরি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বাস্তব ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রয়োগ ঘটে। এটি বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ড-এর অধীনে চার(৪) বছর মেয়াদী শিক্ষাক্রম পরিচালিত হয়। চার বছর মেয়াদী শিক্ষাক্রম আটটি(৮) পর্বে বিভক্ত যাদের সেমিষ্টার বলা হয়। এক একটি সেমিষ্টারের কার্য দিবস ১৬-১৮ সপ্তাহ। সে হিসেবে প্রতি বর্ষের কার্য দিবস ৩২-৩৬ সপ্তাহ। নির্ধারিত কার্য দিবস শেষ হওয়ার পর পর্ব সমাপণি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।

 

অন্তর্ভুক্ত কোর্সগুলো :

বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত শিক্ষাক্রমগুলো হলো : ডিপ্লোমা-ইন-ইঞ্জিনিয়ারিং কোর্স পরিচালনা করে থাকে। উল্লেখযোগ্য কোর্সগুলো হল- ডিপ্লোমা-ইন-সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন-ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন-ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন-কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা-ইন-পাওয়ার, ডিপ্লোমা-ইন-আর্কিক্টেচার, ডিপ্লোমা-ইন-অটোমোবাইলস, ডিপ্লোমা-ইন কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, ডিপ্লোমা ইন এগ্রিকালচার, ডিপ্লোমা ইন ফরেস্ট্রি, ডিপ্লোমা ইন মেরিন টেকনোলজি, ডিপ্লোমা ইন হেল্থ টেকনোলজি, এইএসসি(ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা), এইচএসসি(ভোকেশনাল) ও এসএসসি(ভোকেশনাল)।

 

ভর্তির যোগ্যতা :
এসএসসি বা সমমান পরীক্ষায় পাসের পর ভর্তি হতে হয়। সরকারি পলিটেকনিকে ভর্তি হতে চায়লে এসএসসি বা সমমান পরীক্ষায় যে কোনো বিভাগ থেকে কমপক্ষে ৩.৫০ পেতে হবে। এবং ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। বেসরকারিতে কমপক্ষে ২.০০ পেতে হবে।

 

পড়াশোনায় খরচ :
সরকারি পলিটেকনিকে ৪ বছর পড়াশোনার খরচ পড়বে মাত্র ৫০ হাজার টাকা। বেসরকারি পলিটেকনিকে পড়াশোনার খরচ একটু বেশি। সেখানে প্রতিষ্ঠান ও বিষয় ভেদে খরচ পড়বে আলাদা আলাদা। সে ক্ষেত্রে ৯৬ হাজার থেকে ২ লাখ টাকার মতো পড়বে।

 

উচ্চশিক্ষা :
ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়াশোনা শেষে মানোন্নয়ন ও গবেষণার সুযোগ লাভের জন্য দেশে-বিদেশে উচ্চশিক্ষা নেয়ার ব্যবস্থা আছে। আগ্রহ থাকলে বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং, এমএসসি ইঞ্জিনিয়ারিং ও পিএইচডি করা যায়।

 

রোজগার :
সাধারণত, পেশাগত জীবনে এ ক্যারিয়ারে আয় ও রোজগারের বিষয়টি নির্ভর করে কর্মদক্ষতা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং কাজের মনোযোগের ওপর। যেমন এখানে লেখাপড়া করে যে কেউ শুরুতেই মাসে ২০ থেকে ৩৫ হাজার টাকা আয় করতে পারেন। এছাড়া সরকারি ফার্মে জব করতে চাইলে সরকারি বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা যেমন-চিকিৎসক ভাতা, বাড়িভাড়া ইত্যাদি বাদে সরকারি স্কেল অনুযায়ী আপনার বেতন ধরা হবে ৮ হাজার টাকা। বিশেষজ্ঞদের মতে একজন লোক তার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে মাসে ৮০ থেকে ১ লাখ টাকা আয় করতে পারেন। এমনকি মাসে দেড় লাখ পর্যন্ত আয় করা সম্ভব। উল্লেখ্য, সরকারি ফার্মের চেয়ে বেসরকারি ফার্মে আয়ের পরিমাণ অনেক বেশি।

 

ক্যারিয়ার সম্ভাবনা :
কারিগরি শিক্ষায় রয়েছে বহুমুখী স্বপ্নের উজ্জ্বল ক্যারিয়ার। চাকরির জন্য রয়েছে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে অনেক ক্ষেত্র। যেমন- ডিপ্লোমা-ইঞ্জিনিয়ারদের চাকরির সবচেয়ে বড় বাজার হল সরকারি ইপিজেডগুলো ও গাজীপুর মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি। এছাড়া রিয়েল এস্টেট কোম্পানি, সয়েল টেস্ট ফার্ম, কনস্ট্রাকশন, হাইভোল্টেজ ক্যাবল লাইন, পাওয়ার জেনারেটর প্লান্ট, হাউস ওয়ারিং, শিল্প-কলকারখানা, বিভিন্ন স্ট্রাকচার ডিজাইন ফার্ম, ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন অ্যান্ড ডিজাইন ফার্ম, ই-কম্পিউটার ডিজাইনার ডাটা, অ্যান্ট্রি, মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন, সফটওয়ার ফার্ম, হার্ডওয়ার ফার্ম, গ্রাফিকস ডিজাইন, বিভিন্ন ট্রেনিং প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন টেক্সটাইল মিল, গার্মেন্ট অ্যান্ড ফ্যাশন হাউস, গ্লাস অ্যান্ড সিরামিক ডিজাইন সরবরাহ ও প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো, পল্লীবিদ্যুৎ, ডেসকো, আইডিবি, বিটিসিএল, মেডিকেল ল্যাব, একাধিক সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ও ওষুধ কোম্পানিসহ দেশে-বিদেশে শত শত প্রতিষ্ঠানে রয়েছে বহুমাত্রিক ক্যারিয়ারের সুবর্ণ সুযোগ। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানে রয়েছে ডিপ্লোমা ইজ্ঞিনিয়ারদের ব্যাপক চাহিদা। মোটকথা ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের বেকার থাকা বা কাজ না পাওয়ার আশংকা খুব কম। এখানে পড়াশোনা শেষ করেই রয়েছে চাকরির নিশ্চয়তা। রয়েছে সফল ক্যারিয়ারের হাতছানি। আর দেরি না করে এ পেশায় গড়তে পারেন আপনার স্বপ্নের রঙিন ক্যারিয়ার।

 

 

এডিট- এসএস