গজল এক ধরনের উর্দু কবিতা, বা জোড়া দেয়া কবিতার সমগ্র। এই কবিতাগুলো যখন সুর মিশিয়ে গাওয়া শুরু হলো, তখন সেই গানের নামও হল গজল।
উর্দু গজল সচরাচর দুই দুই লাইন করে তৈরি কবিতা। যেটাকে “মিসরা” বলে। মজার বিষয় হচ্ছে, প্রতিটি মিসরা একটি করে স্বাধীন কবিতা। আগের মিসরার সাথে তার সম্পর্ক থাকতেও পারে, নাও পারে। ছন্দ ও অন্যান্য কারিগরি বিষয়ও আমাদের কবিতা থেকে একটু আলাদা। মির্জা গালিবের দুই লাইন নিয়ে আলোচনা করে দেখা যাক :
“দিলে নাদান তুঝে হুয়া কিয়া হ্যায়,
আখির ইস দারদ কা দাওয়া কিয়া হ্যায়”
শেষে “কিয়া হ্যায়, কিয়া হ্যায়” রিপিট করে ছন্দ মেলাতে সহায়তা করা হয়। এই ছন্দ সহযোগী শব্দগুলোকে বলে “রাদিফ“। এবং মুল ছন্দ “হুয়া” বা “দাওয়া”, যা বদলে যাচ্ছে প্রতিটি লাইনে, একে “কাফিয়া” বলে।
প্রথম “মিসরা” টি সচরাচর খুব ছন্দ-মিল রেখে করা হয়, যেটার নাম “মাতলা“। এটাই গজ.লের ভিত্তি। এরপর মোটামুটি একই ধরনের ছন্দ (মিটার) ও রাদিফ ধরে আগানো হয়।
শেষ শের বা মিসরা কে বলে “মাকতা“, যেখানে কবি তার নাম, পেন নেম (তাখাল্লুস) ব্যাবহার করেন।
গজল এর কালেকশন বা সংগ্রহ কে বলে “দিউয়ান”
শুরুর দিকে আগে থেকে কম্পোজড্ গজ.ল গাইবার রীতি ছিল না। রেয়াজ ছিল- গায়ক কবিতার সাথে সময় নিয়ে নিজের বোঝাপড়া শেষ করবেন। এরপর গাইবার সময় কবিতার মুডের সাথে মানাসই একটি রাগ ও তাল বেছে নেবেন, সেটার উপরে ভিত্তি করে মনে যেই সুরে আসবে, সেই সুর দিয়ে কবিতাটি প্রকাশ করবেন।
ওস্তাদ মেহেদি হাসান খান প্রথম দিকে যখন রেডিওতে গাইতেন, তখন সাবধানতার জন্য প্রথমে গজ.ল গুলো কম্পোজ করে নিতেন। একদিন তার বাবা (আজিম খান) ডেকে জিজ্ঞেস করলেন কিভাবে গাইছে ছেলে। মেহেদি হাসান আগে কম্পোজ করার কথা বলাতে তিনি অসন্তুষ্ট হলেন। মেহেদি হাসান বললেন ভুল হলে চাকরি খোয়া যেতে পারে, এজন্য সাবধানতার কারণে তিনি আগে থেকে কম্পোজ করে নিচ্ছেন। বড় খাঁ সাহেব বললেন- গজল যদি আগে থেকে কম্পোজ করেই গাইবে, তবে এত প্রজন্ম ধরে গান শিখে কি লাভ হল? শেষ পর্যন্ত বাবা ছেলে একটা বোঝাপড়ায় এলেন। ৩ টি গজলের একটি আগে থেকে কম্পোজ করে যাবেন, আর দুটি ওই মুহূর্তে যে সুর এবং তাল মনে আসবে তা থেকে গাইবেন।
ওস্তাদ মেহেদি হাসানের এমন অনেক গজ.ল, আছে যেটা প্রথমবার একবারে বসে গাওয়া সুরই জনপ্রিয় হয়েছে। এমনকি কবিতাটি আধা ঘণ্টা আগে হাতে পেয়ে, প্রথম বার সুর লাগিয়েই, পুরো গজলের ফাইনাল টেক হয়ে গেছে।
একজন গাইয়ে প্রথমবারে যে সুরে গান, মোটামুটি ভালো হলে সেই সুরটিকে ধরে রাখেন। তবে গজ.ল মানে প্রতিবার একটু আলাদা করে, ইমপ্রোভাইজ করে গাওয়া। একই সুরে একই রকম করে প্রতিবার গাইলে গজ.লের শ্রোতারা আগ্রহ হারান।
গজলে আমার কয়েকজন প্রিয় শায়ের:
- মীর তকী মীর
- মীর্জা গালিব
- মিয়া মমিন
- বাহাদুর শাহ জাফর
- আহমাদ ফারাজ (সৈয়দ আহমেদ শাহ)
- হাফিজ হোশিয়ারপুরী
- সাগর সিদ্দিকী
- দাঘ দেহেলভী (নওয়াব মীর্জা খান) এর শায়েরি
** আমার পছন্দের সব শায়ের কে কবির উচ্চতা দিয়ে বিচার করিনি। যাদের শায়েরি গজ.ল হিসেবে শুনতে ভালো লেগেছে তাদেরই তালিকা দিয়েছি।
আমার প্রিয় কয়েকজন গজল গায়ক:
- বেগম আখতার
- ওস্তাদ আমানত আলী খান
- ওস্তাদ মেহেদি হাসান (শ্যাহেনশাহে গাজল)
- ইজাজ হুসেইন হাযারভী
- গোলাম আলী
- জগজিৎ সিং
গজল বিষয়ে আরও পড়ুন:
- উইকিপিডিয়া
- মিউজিক গুরুকুল : গাজল
সিরিজের বিভিন্ন ধরনের আর্টিকেল সূচি:
4 thoughts on “গজল | অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ”
Comments are closed.