বিনম্র শ্রদ্ধাঞ্জলি অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ছিলেন বাঙালির ইতিহাস পুনর্গঠনের আয়োজনে- আন্দোলনে-প্রচেষ্টায় পথিকৃৎ। ইতিহাস বিকৃতির বিপরীতে সত্যসন্ধ অনুসন্ধান, পর্যবেক্ষণ ও বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণাকে প্রাধান্য দিয়েছেন। বাঙালির ইতিহাস বিদেশীদের হাতে যেভাবে লিপিবদ্ধ হয়ে আসছিল, সেখানে তিনি বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে ইতিহাস চর্চার দিগন্ত তুলে ধরেছিলেন।

সাহিত্য, ভাষা, সংস্কৃতি. চিত্রকলা এবং প্রত্নতত্ত্ব বিষয়ে অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। ধারণা করা হয় তাঁর বিচক্ষণতায় প্রভাবিত হয়েই কুমার শরৎকুমার রায় বরেন্দ্র রিসার্চ সোসাইটি (১৯১০-১৯৬৩ খ্রি.) এবং বরেন্দ্র গবেষণা জাদুঘর (১৯১০ খ্রি.) প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেনও ‘…বাঙ্গালার ইতিহাসে তিনি যে স্বাধীনতার যুগ প্রবর্তন করিয়াছেন সে জন্য তিনি বঙ্গসাহিত্যে ধন্য হইয়া থাকিবেন।’

ইতিহাসবিদ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় সম্পর্কে বরেণ্য ইতিহাসবিদ রমেশচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন, “সংস্কৃত ভাষায় তাঁহার যথেষ্ট বুৎপত্তি ছিল এবং বাংলা ও সংস্কৃত সাহিত্যের নানা বিভাগের তিনি পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনাও করিয়াছেন। কিন্তু বিশেষভাবে ঐতিহাসিক রচনার জন্যই বিখ্যাত। ‘সিরাজদ্দৌলা’ (১৮৯৮ খ্রি.) ও ‘মীর কাসিম’ (১৯০৬ খ্রি.) নামক দুইখানি ঐতিহাসিক গ্রন্থ লিখিয়া তিনি বিদ্বৎ-সমাজে বিশেষ খ্যাতি লাভ করেন।

মূল দলিল দস্তাবেজের সাহায্যে তিনি ইহাদের প্রকৃত ইতিহাস উদ্ধারের চেষ্টা করেন এবং প্রচলিত অনেক ধারণা ভ্রান্ত বলিয়া প্রতিপন্ন করেন। বাংলা ভাষার এই রূপ বিজ্ঞানসম্মত প্রণালীতে ইতিহাস রচনার তিনিই পথ প্রদর্শক। তাঁহার পরবর্তীকালের রচনা ‘গৌড় লেখমালা’ (১৯১২ খ্রি.) তাঁহার অপূর্ব পাণ্ডিত্যের পরিচায়ক। এই গ্রন্থে বাংলার পালরাজাগণের তাম্রশাসন ও শিলালিপি বাংলা অনুবাদসহ প্রকাশ করিয়া তিনি বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে গবেষণার পথ সুগম করিয়াছেন।”

Akshay Kumar Maitreya | অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়
Akshay Kumar Maitreya | অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়

কবি নজরুল অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র অন্তিম সময়ে সাক্ষাৎ করে বলেছিলেন, ‘যিনি অভিশপ্ত ও কলঙ্কিত ইতিহাসকে পুনর্জীবিত করতে পারেন তিনি মরতে পারেন না।’

 

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয়র জন্ম ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ১ মার্চ বর্তমান কুষ্টিয়া জেলার নওয়াপাড়া থানার শিমুলিয়া গ্রামে। তার পড়াশোনায় হাতেখড়ি ঘটে কাঙ্গাল হরিনাথের (হরিনাথ মজুমদার) কাছে। তিনি ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বোয়ালিয়া ইংলিশ স্কুল (বর্তমানে রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল) থেকে এন্ট্রান্স, ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী কলেজ থেকে এফ.এ ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বি.এ এবং ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে রাজশাহী কলেজ থেকে বি.এল পাস করেন এবং একই বছর তিনি রাজশাহীতে আইন ব্যবসা শুরু করেন।

তিনি রাজশাহী জেলার তৎকালীন নেতৃস্থানীয় আইনজীবী ছিলেন। অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় রাজশাহী রেশম-শিল্প বিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন। তিনি ছিলেন একাধারে এই বিদ্যালয়ের সম্পাদক ও শিক্ষক। রাজশাহী পৌরসভার কমিশনার হিসেবে কাজ করার সময় তিনি শহরের নাগরিক সুবিধাসংশ্লিষ্ট অবকাঠামো ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন কর্মকাণ্ড ত্বরান্বিত করেন। ডায়মন্ড জুবিলি ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুলের শুরুর দিকে তিনি স্কুলটিকে যথেষ্ট পৃষ্ঠপোষকতা দান করেন। এমনকি স্কুলের অবৈতনিক প্রশিক্ষক হিসেবে তিনি ছাত্রছাত্রীদের রেশম চাষ পদ্ধতি শিক্ষা দিতেন। বেশ কিছু সংস্কৃত নাটকের সঙ্গে তিনি জড়িত ছিলেন। একজন ভালো ক্রিকেটার ও চিত্রকর হিসেবেও তাঁর সুনাম ছিল।

বাঙালি ইতিহাসবেত্তা ও সমাজকর্মী অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দের ১০ ফেব্রুয়ারি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।

অক্ষয়কুমার মৈত্রেয় সম্পর্কে আরও পড়ুন:

সুফি ফারুক এর পেশা পরামর্শ সভা সম্পর্কে জানতে: