যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা [ Jukto front 21 Points ] -১৯৫৫ সালের ৫ জুন

যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা [ Jukto front 21 Points ] -১৯৫৫ সালের ৫ জুন ! একুশ দফা ১৯৫৪ সালে পূর্ব বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ শাসনের অবসানের উদ্দেশ্যে আওয়ামী মুসলীম লীগ, কৃষক-শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম এবং গণতন্ত্রী দলের সমন্বয়ে ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট নামে একটি নির্বাচনী মোর্চা গঠিত হয়। এর প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি এ. কে. ফজলুল হক, আওয়ামী মুসলীম লীগের সভাপতি মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং নেতা হোসেন শহীদ সোহ্‌রাওয়ার্দী। যুক্তফ্রন্টের পক্ষ থেকে ২১টি প্রতিশ্রুতি সহকারে যে নির্বাচনী কর্মসূচী ঘোষণা করা হয় তা একুশ দফা কর্মসূচী নামে পরিচিত। যুক্তফ্রণ্টের পক্ষ থেকে ২১টি প্রতিশ্রুতি সম্বলিত যে নির্বাচনী মেনিফেস্টো ঘোষণা করা হয় তা-ই ২১-দফা নামে পরিচিত। এ ২১-দফা কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপ:

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 2 যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা [ Jukto front 21 Points ] -১৯৫৫ সালের ৫ জুন

 

 

যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা [ Jukto front 21 Points ]

 

নীতি: কোরান ও সুন্নাহর মৌলিক নীতির খেলাফ করে কোন আইন প্রণয়ন করা হইবে না এবং ইসলামের সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের ভিত্তিতে নাগরিকগণের জীবন ধারণের ব্যবস্থা করা হইবে।

১. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা হইবে।

২. বিনা ক্ষতিপুরণে জমিদারী ও সমস্ত খাজনা আদায়কারী স্বত্ব উচ্ছেদ ও রহিত করিয়া ভূমিহীন কৃষকের মধ্যে উদ্বৃত্ত জমি বিতরণ করা হইবে এবং উচ্চ হারের খাজনা ন্যায়সঙ্গতভাবে হ্রাস করা হইবে এবং সার্টিফিকেটযোগে খাজনা আদায়ের প্রথা রহিত করা হইবে।

৩. পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করার উদ্দেশ্যে তাকে পূর্ববঙ্গ সরকারের প্রত্যক্ষ পরিচালনাধীনে আনয়ন করিয়া পাটচাষীদের পাটের মূল্য দেওয়ার ব্যবস্থা করা হইবে এবং লীগ মন্ত্রিসভার আমলের পাট কেলেংকারি তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট সকলের শাস্তির ব্যবস্থা ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।

৪. কৃষি উন্নতির জন্য সমবায় কৃষি ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হইবে ও সরকারী সাহায্যে সকল প্রকার কুটির ও হস্তশিল্পের উন্নতি সাধন করা হইবে।

৫. পূর্ববঙ্গকে লবণ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করিবার জন্য সমুদ্র উপকুলে কুটির-শিল্পের ও বৃহৎ শিল্পের লবন তৈয়ারির কারখানা স্থাপন করা হইবে এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার আমলের লবণের কেলেংকারী সম্পর্কে তদন্ত করিয়া সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের শাস্তির ব্যবস্থা করা হইবে ও তাহাদের অসদুপায়ে অর্জিত যাবতীয় অর্থ বাজেয়াপ্ত করা হইবে।

৬. শিল্প ও কারিগরি শ্রেণীর গরীব মোহাজেরদের কাজের আশু ব্যবস্থা করিয়া তাহাদের পুনর্বসতির ব্যবস্থা করা হইবে।

৭. খাল খনন ও সেচের ব্যবস্থা করিয়া দেশকে বন্যা এবং দুর্ভিক্ষের কবল হইতে রক্ষা করিবার ব্যবস্থা করা হইবে।

৮. পূর্ববঙ্গকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করিয়া ও কৃষিকে আধুনিক যুগোপযোগী করিয়া শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হইবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সকল প্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হইবে।

৯. দেশের সর্বত্র একযোগে প্রাথমিক ও অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা প্রবর্তন করা হইবে এবং শিক্ষকদের ন্যায়সঙ্গত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।

১০. শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করিয়া শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকরী করিয়া কেবলমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হইবে এবং সরকারী ও বেসরকারী বিদ্যালয়সমূহের বর্তমান ভেদাভেদ উঠাইয়া দিয়া একই পর্যায়ভুক্ত করিয়া সকল বিদ্যালয়সমূহকে সরকারী সাহায্যপুষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হইবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।

১১. ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল কানুন বাতিল ও রহিত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সমূহকে স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিয়া উচ্চশিক্ষাকে সস্তা ও সুবিধাজনক বন্দোবস্ত করা হইবে।

১২. শাসন ব্যয় সর্বাত্মকভাবে হ্রাস করা হইবে এবং তদুদ্দেশ্যে উচ্চ বেতনভোগীদের বেতন কমাইয়া ও নিম্ন বেতনভোগীদের বেতন বাড়াইয়া তাহাদের আয়ের একটি সুসংগত সামঞ্জস্য বিধান করা হইবে। যুক্তফ্রন্টের কোনো মন্ত্রী এক হাজারের বেশী টাকা বেতন গ্রহণ করিবেন না।

যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা [ Jukto front 21 Points ] -১৯৫৫ সালের ৫ জুন [ Jukto Front Leaders ]
যুক্ত ফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ
১৩. দুর্ণীতি ও স্বজনপ্রীতি, ঘুষ-রিশওয়াত বন্ধ করার কার্যকরী ব্যবস্থা করা হইবে এবং এতদুদ্দেশ্যে সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী পদাধিকারী ব্যবসায়ীর ১৯৪০ সাল হইতে বর্তমান সময় পর্যন্ত সময়ের হিসাব-নিকাশ লওয়া হইবে এবং সন্তোষজনক কৈফিয়ৎ দিতে না পারিলে তাহাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হইবে।

১৪. জন নিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স প্রভৃতি কালাকানুন রদ ও রহিত করত বিনা বিচারে আটক বন্দীকে মুক্তি দেওয়া হইবে ও রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রকাশ্য আদালতে বিচার করা হইবে এবং সংবাদপত্র ও সভা-সমিতি করিবার অধিকার অবাধ ও নিরঙ্কুশ করা হইবে।

১৫. বিচার-বিভাগকে শাসন-বিভাগ হইতে পৃথক করা হইবে।

১৬. যুক্তফ্রন্টের প্রধানমন্ত্রী বর্ধমান হাউসের পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম বিলাসের বাড়িতে বাসস্থান নিদিষ্ট করিবেন এবং বর্ধমান হাউসকে আপাতত ছাত্রাবাস ও পরে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে পরিণত করা হইবে।

১৭. বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবীতে যাহারা মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার গুলিতে শহীদ হইয়াছেন, তাহাদের পবিত্র স্মৃতিচি‎‎হ্নস্বরূপ ঘটনাস্থলে একটি শহীদ মিনার নির্মাণ করা হইবে এবং তাহাদের পরিবারবর্গকে উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া হইবে।

১৮. ২১ শে ফেব্রুয়ারীকে শহীদ দিবস ঘোষণা করিয়া উহাকে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করা হইবে।

১৯. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে স্বায়ত্তশাসন প্রদান ও সার্বভৌমিক করা হইবে এবং দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা ব্যতীত আর সমস্ত বিষয় অবশিষ্টাত্মক ক্ষমতাসমূহ পূর্ববঙ্গ সরকারের হাতে আনয়ন করা হইবে এবং দেশরক্ষা বিভাগের স্থল-বাহিনীর হেডকোয়ার্টার পশ্চিম পাকিস্তান ও নৌবাহিনীর হেড-কোয়ার্টার পূর্ব পাকিস্তানে স্থাপন করা হইবে এবং পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র নির্মাণের কারখানা নির্মাণ করত: পূর্ব পাকিস্থানকে আত্মরক্ষায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করা হইবে। আনসার বাহিনীকে সশস্ত্র বাহিনীতে পরিণত করা হইবে।

২০. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা কোন অজুহাতেই আইন পরিষদের আয়ু বাড়াইবে না। আইন পরিষদের আয়ু শেষ হওয়ার ছয় মাস পূর্বেই মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করিয়া নির্বাচন কমিশনের মারফত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করিবেন।

২১. যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভার আমলে যখন যে আসন শূন্য হইবে, তিন মাসের মধ্যে তাহা পূরণের জন্য উপনির্বাচনের ব্যবস্থা করা হইবে এবং পর পর তিনটি উপনির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের মনোনীত প্রার্থী পরাজিত হইলে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করিবেন।

সূত্রঃ যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা [ Jukto front 21 Points ], যুক্তফ্রন্টের প্রচার দফতর। জানুয়ারি ১৯৫৪। ৫৬, সিমপসন রোড, ঢাকা।

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 1 যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা [ Jukto front 21 Points ] -১৯৫৫ সালের ৫ জুন

 

যুক্তফ্রন্টের ২১ দফার ফলাফল:

একুশ দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে ১৯৫৪ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট পূর্ববাংলা আইন পরিষদের মোট ২৩৭টি মুসলিম অসনের মধ্যে ২২৮টি আসন জয় লাভ করে।

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 3 যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা [ Jukto front 21 Points ] -১৯৫৫ সালের ৫ জুন

 

যুক্তফ্রন্ট কী ছিল?

যুক্তফ্রন্ট হলো পাকিস্তানের পূর্ববঙ্গ প্রাদেশিক পরিষদের ১৯৫৪ খ্রিস্টাব্দের নির্বাচনে, মুসলিম লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করার লক্ষ্যে অন্যান্য বিরোধী দল মিলে গঠিত একটি সমন্বিত রাজনৈতিক মঞ্চ। ১৯৫৩ সালের ১৪ নভেম্বর, যুক্তফ্রন্ট গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলেও পরবর্তীতে আওয়ামী মুসলিম লীগ (মাওলানা ভাসানী) ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর তারিখে কৃষক শ্রমিক পার্টি (শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক), নেজামে ইসলাম পার্টি (মাওলানা আতাহার আলী), বামপন্থী গণতন্ত্রী পার্টি (হাজী মোহাম্মদ দানেশ এবং মাহমুদ আলি সিলেটি) ও পাকিস্তান গণতন্ত্রী দল একসাথে মিলে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে।

যুক্তফ্রন্টের প্রধান তিন নেতা ছিলেন মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এই যুক্তফ্রন্ট ২১ দফার একটি নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করে। ঐ ইশতেহারের মধ্যে প্রধান দাবি ছিল লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পূর্ববঙ্গকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রদান করা, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া, ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা, ভাষা শহীদদের স্মৃতিরক্ষার্থে শহীদ মিনার নির্মাণ করা ইত্যাদি। যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী প্রতীক ছিল “নৌকা” আর মুসলিম লীগ এর নির্বাচনী প্রতীক ছিল “হারিকেন”।

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 1 যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা [ Jukto front 21 Points ] -১৯৫৫ সালের ৫ জুন

 

বঙ্গবন্ধু ও চুয়ান্নর যুক্তফ্রন্ট ও ২১ দফা:

পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ৭ বছরেরও কম সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে পাকিস্তান আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা রাখা দল মুসলিম লীগ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। কয়েকটি দলের যুক্তফ্রন্টকে সে সময় হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট হিসেবেও অভিহিত করা হতো। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ব্রিটিশ আমলে একাধিকবার অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীও এ পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৪৬ সালে। এর আগে শেরেবাংলার মন্ত্রিসভাতেও তিনি ছিলেন।

১৯৩৮ সালে দুজনে এসেছিলেন গোপালগঞ্জে, যেখানে ১৮ বছর বয়সী মুজিবকে দেখে মুগ্ধ হন। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর টাঙ্গাইলের একটি আসন থেকে পূর্ববঙ্গ আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। কিন্তু মুসলিম লীগ সরকার নানা কূটকৌশল করে তার সদস্যপদ খারিজ করে দেয়। পরে আর কখনও তিনি পার্লামেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হননি। কিন্তু যেকোনো নির্বাচনের প্রচারকাজে তার অংশগ্রহণ অপরিহার্য বিবেচিত হতো। তিনি জনগণকে উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত করতে পারতেন।

যুক্তফ্রন্টের শরিক দলগুলোর প্রার্থীরা প্রত্যেকেই চেয়েছেন এই তিন জনপ্রিয় নেতা তাদের আসনে যেন প্রচারকাজের জন্য যান। সে সময় ৩৪ বছর বয়স্ক শেখ মুজিবকেও তারা চাইতেন নিজ নিজ এলাকায় বক্তা হিসেবে।

১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির ঐতিহাসিক আন্দোলনের পর থেকে মুসলিম লীগের পায়ের নিচে মাটি ছিল না। তারা হয়ে পড়ে জনধিক্কৃত দল। আওয়ামী লীগ তখন দ্রুত শক্তি সঞ্চয় করছে। তরুণ শেখ মুজিব বারবার সভা-সমাবেশ করছেন জেলা ও মহকুমাগুলোতে।

আওয়ামী লীগের কমিটি গঠনের পাশাপাশি ছাত্রলীগের সংগঠন শক্তিশালী করার প্রতিও তার নজর ছিল। ভাষা আন্দোলনের কারণে ছাত্রসমাজের ওপর জনগণের আস্থা ও মর্যাদা ছিল আকাশছোঁয়া। যুক্তফ্রন্টের পক্ষে নির্বাচনের প্রচারে তারা বড় ভূমিকা রাখবে, এটা বোঝা যাচ্ছিল।

মুসলিম লীগের অপশাসনে ইতোমধ্যেই পূর্ব বাংলার মানুষের মধ্যে একধরনের ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের অপশাসন থেকে মুক্তিলাভের কৌশল হিসেবে ১৯৫৩ সালের নভেম্বরে ঐতিহাসিক যুক্তফ্রন্ট নামের নির্বাচনি জোট গঠনের ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল। এই জোটটি ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্যের কারণে জনগণের অসন্তুষ্টি, সরকারে বাঙালির নিম্ন প্রতিনিধিত্ব, তৎকালীন শাসনব্যবস্থায় দুর্নীতি ও রাজনৈতিক-দমন-পীড়নের বহিঃপ্রকাশ।

এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছিলেন যুক্তফ্রন্টের স্থপতি যা মূলত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের চারটি দল নিয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ, কৃষক শ্রমিক পার্টি, নেজামে ইসলাম এবং গণতান্ত্রিক দল। জোটের মূল লক্ষ্য ছিল ১৯৫৪ সালের ৮-১২ মার্চের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভা নির্বাচনে তৎকালীন ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে লড়াই করা।

নির্বাচনি প্রচারণায় যুক্তফ্রন্ট প্রচার করে ২১ দফার একটি ম্যানিফেস্টো। এ দফাগুলোর মধ্যে ছিল: বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করা, জমিদারিপ্রথাবিলোপ, পাট ব্যবসা জাতীয়করণ, সমবায়পদ্ধতিতে চাষবাস, উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন, বন্যা প্রতিরোধের স্থায়ী ব্যবস্থা, কৃষির আধুনিকায়ন, শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার, সব কালাকানুন রহিতকরণ, সমন্বিত বেতনকাঠামো প্রবর্তন, দুর্নীতি দমন, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের পৃথকীকরণ, ভাষাশহীদদের স্মরণে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ, মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউসকে বাংলা ভাষা উন্নয়নের কেন্দ্রে রূপান্তর, ২১ ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন ঘোষণা এবং পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা (আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ২০১৭, প্রথমা প্রকাশন)।

এসব দাবি উপস্থাপন করেন এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। বামপন্থী দলগুলোর কর্মীদের সহায়তায় ফ্রন্টের নেতারা প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়েও নির্বাচনের প্রচারণা চালাতে সক্ষম হন।

যুক্তফ্রন্ট যেসব বিষয় জনসমক্ষে তুলে ধরে সেগুলো ছিল ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষার জন্য ছাত্রদের আত্মাহুতি এবং লবণ, চাল ও অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির ক্রমবর্ধমান মূল্য। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর বহু নেতা-কর্মীর ধরপাকড়ে জনসাধারণ মুসলিম লীগ সরকারের বিরুদ্ধভাবাপন্ন হয়ে ওঠে (আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ২০১৭, প্রথমা প্রকাশন)।

তখন শেখ মুজিবসহ বেশির ভাগ সদস্যই যুক্তফ্রন্টের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। শেখ মুজিব বলেন, দেশে আওয়ামী লীগ ছাড়া আর কোনো দল নেই। যুক্তফ্রন্ট করা মানে কিছু মরা লোককে বাঁচিয়ে রাখা। হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী এবং মওলানা ভাসানীও যুক্তফ্রন্টের ঘোর বিরোধী ছিলেন। যুক্তফ্রন্ট হবে না এ সিদ্ধান্তের পর হোসেন শহীদ পাকিস্তানে যান। তখন বঙ্গবন্ধু জেলায় জেলায় সভা করে বেড়ান। আর এদিকে ঢাকায় বসে মওলানা ভাসানী শেরেবাংলার সঙ্গে যুক্তফ্রন্ট সই করে ফেলেন।

যেখানে আওয়ামী লীগ এককভাবে জিততে পারত সেখানে নেজামে ইসলাম পার্টি, কৃষক শ্রমিক পার্টি ও গণতান্ত্রিক দলসহ বিভিন্ন নামের সংগঠন যুক্তফ্রন্টের নামে মনোনয়ন দাবি করতে লাগল। যারা দিনরাত খেটেছে আওয়ামী লীগের জন্য এমন লোক নমিনেশন পেল না, মাত্র তিন চার মাস আগেও মুসলিম লীগে ছিল, এ রকম লোক নমিনেশন পেয়ে যায়।

এখানে উল্লেখ্য যে, বঙ্গবন্ধু প্রথম থেকে যুক্তফ্রন্ট গঠনের বিরোধী ছিলেন। কারণ, তিনি জানতেন রাজনৈতিক দল হিসেবে আওয়ামী লীগ যে শক্তি অর্জন করেছে, মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচনে তারাই জয়লাভ করবে। কিন্তু দলের সিনিয়র নেতাদের মতামতকে সম্মান জানিয়ে তিনি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ করেননি (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১২)।

এদিকে নির্বাচন দিতে পাকিস্তান শাসকরা রাজি হলে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের ইশতেহারে যে ২১ দফা দেয় তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, পশ্চিমা শোষকগোষ্ঠীর কাছ থেকে সাংস্কৃতিক-অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামাজিক মুক্তিই ছিল এর মূল বিষয়বস্তু। যেমন ২১ দফার প্রথম দফা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দান; তা ছাড়াও শিক্ষার উন্নয়ন, কৃষির উন্নয়ন এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন। বঙ্গবন্ধু প্রথম থেকেই বাংলা ভাষা ও বাঙালি সাংস্কৃতিক সত্তা জাগ্রত করতে সচেষ্ট ছিলেন। পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বাধীন রাজনৈতিক সত্তা- তার দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের প্রতিফলন দেখা যায় তার উপস্থাপিত ছয় দফায়।

নির্বাচনের বিজয়লাভের পরে, যুক্তফ্রন্টের নেতা একে ফজলুল হককে ১৯৫৪ সালে ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক গভর্নর মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। তবে মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে প্রথমেই দ্বন্দ্ব বাধে। রাজনৈতিক নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু কতটা বিশাল ছিলেন তার পরিচয় পাওয়া যায় ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর মন্ত্রিসভা গঠনের সময় মন্ত্রিত্ব ভাগাভাগি করা নিয়ে জোটের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয় তখন।

আওয়ামী লীগ থেকে আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমানের নাম প্রদান করা হলেও শেখ মুজিবকে মন্ত্রিত্বে নিতে অনীহা প্রকাশ করেন ফজলুল হক । বঙ্গবন্ধু তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন-

‘হক সাহেব শহীদ সাহেব ও ভাসানী সাহেবকে বলেছিলেন আমি শেখ মুজিবকে আমার মন্ত্রিত্বে নিব না।’

তার উত্তরে শহীদ সাহেব বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের কাকে নেয়া হবে না হবে সেটাতো আমি ও ভাসানী সাহেব ঠিক করব, আপনি যখন বলেছেন নান্না মিয়াকে ছাড়া আপনার চলে না। তখন আমরাও তো বলতে পারি শেখ মুজিবকে ছাড়া আমাদের চলে না।

সে আমাদের দলের সেক্রেটারি। মুজিব তো মন্ত্রিত্বের প্রার্থী না। এ সকল কথা বললে পার্টি থেকে বলতে পারে’ (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১২ পৃ. ২৯ )। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তখন শহীদ সাহেব এবং ভাসানী সাহেবকে বলেছিলেন- ‘আমাকে নিয়ে গোলমাল করার প্রয়োজন নেই। আমি মন্ত্রী হতে চাই না। আমাকে বাদ দিলে যদি পুরো মন্ত্রিত্ব গঠন করতে রাজি হয় আপনারা তাই করুন। (শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১২ পৃ. ২৯ )’।

এ থেকেই বোঝা যায় বঙ্গবন্ধু কতটা ক্ষমতাবিমুখ ছিলেন। বয়সে তরুণ হলেও বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল অনেক বেশি। আর এই কারণেই তিনি যুক্তফ্রন্টের বিরোধিতা করেছিলেন। কারণ, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনি জোট করতে যাচ্ছে সেই জোট বেশি দিন টিকবে না। এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, আওয়ামী লীগ তখন রাজনৈতিক দল হিসেবে যে রকম শক্তিশালী ছিল তাতে একা নির্বাচন করলেও নির্বাচনি বৈতরণী খুব সহজে পার হতে পারত। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট গঠন করার ফলে আওয়ামী লীগের বেশ কিছু ত্যাগী নেতা নির্বাচনে মনোনয়ন পেলেন না, যা তাদের ওপর একধরনের নেতিবাচক প্রভাব ফেলে যেটি প্রকারান্তরে দলের জন্য খারাপ হতে পারে।

এ থেকে বোঝা যায় যে, বঙ্গবন্ধু কতটা দূরদর্শীসম্পন্ন নেতা ছিলেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই কেন তিনি যুক্তফ্রন্টের বিরোধিতা করেছিলেন তা স্পষ্ট হয়ে যায় যখন তিন মাস পরে ১৯৫৪ সালের ৩০ মে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পূর্ব পাকিস্তানের ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর শাসন জারি করলেন (আবুল মনসুর আহমদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, ২০১৭, প্রথমা প্রকাশন)।

আমরা এটাও জানি, বঙ্গবন্ধু বেশির ভাগ সময় ক্ষমতার বাইরে থেকে দেশ ও জনগণের উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েও ক্ষমতায় যেতে পারেননি। এরপরে ১৯৭২ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে দেশে ফিরে মাত্র সাড়ে তিন বছর ক্ষমতায় ছিলেন। এই সময়ে বাংলাদেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে সপরিবারে তাকে হত্যা করা হলে সেই স্বপ্ন বাস্তব লাভ করেনি। রাজনীতিবিদ হিসেবে বঙ্গবন্ধুর বিশালতাকে ব্যাখ্যা করতে গিয়ে প্রখ্যাত রাষ্ট্রবিজ্ঞানী রওনক জাহান তার একটি লেখায় উল্লেখ করেছেন-

‘One of the remarkable features of his political life was his transformation from an ordinary rank and file worker of a political party to an unparalleled leader of millions of people. Bangabandhu possessed outstanding organizational capacity; at the same time he was a great orator. Generally we do not find such a combination of qualities in one leader (Raunaq Jahan, The Political philosophy of Bangabandhu, Dhaka Tribune, 10 June 2019)’.

বঙ্গবন্ধুর কখনও জিডিপির প্রবৃদ্ধি নিয়ে খুব বেশি ভাবেননি। তিনি ভেবেছিলেন কীভাবে সোনার বাংলা প্রতিষ্ঠা করা যায় এবং দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানো যায়। এই দুটি ছিল তার জীবনের মূল লক্ষ্য। তার কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই আমরা তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা উপলব্ধি করতে পারি। আর এই কথার সত্যতা মেলে মাত্র তিনটি বাক্যেই যেখানে বঙ্গবন্ধু তার আত্মপরিচিতি ও মূল্যবোধ অত্যন্ত পরিষ্কার করেছেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র প্রথমেই বঙ্গবন্ধু লিখেছেন: ‘একজন মানুষ হিসাবে সমগ্র মানবজাতি নিয়েই আমি ভাবি। একজন বাঙালি হিসাবে যা কিছু বাঙালিদের সঙ্গে সম্পর্কিত তাই আমাকে গভীরভাবে ভাবায়। এই নিরন্তর সম্প্রীতির উৎস ভালোবাসা, অক্ষয় ভালোবাসা যে ভালোবাসা আমার রাজনীতি এবং অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে’ (অসমাপ্ত আত্মজীবনী, মে ৩, ১৯৭৩)।

যেকোনো নির্দিষ্ট ফ্রেমে বন্দি করে বঙ্গবন্ধুর বিশালতাকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। বাংলাদেশের সকল রাজনৈতিক সংগ্রামে তিনি নিজের জীবন বাজি রেখে মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর জন্য সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট গঠন এবং ২১ দফা প্রণয়নকে মনেপ্রাণে মেনে নিতে না পরলেও সেই প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করেছেন। দলীয় সিদ্ধান্তকে মেনেই নির্বাচনে বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছিলেন। এর মাধ্যমেই তার রাজনৈতিক বিশালতার পরিচয় ফুটে ওঠে।

 

যুক্তফ্রন্ট সম্পর্কে আরও পড়ুন:

Leave a Comment