বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, February]

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস এর একটা সংগ্রহশালা তৈরি করছি। আপাতত যা হাতে আছে তুলে দিলাম। পরে বাকি গুলো যুক্ত করা হবে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, February]

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ভারতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আজ আমার প্রিয় বোনদের উদ্দেশ্যে কলকাতায় এসে দুটি কথা বলার জন্য আমি আনন্দিত। আপনারা আমার ডাকে সারা দিয়েছিলেন বলে মহাঘাতক ইয়াহিয়ার বর্বর বাহিনী আপনাদের বাধ্য করেছিল বাংলার শান্তির নীড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে। আমি জানি ঘাতক পাকিস্তানি বাহিনী আপনাদের বিষয় সম্পত্তি লুট করেছে। হত্যা করেছে আপনাদের বাপ-ভাই সন্তানদের।

ইজ্জত নষ্ট করেছে আমার মা-বোনদের। কিন্তু দেশের ডাকে তবুও আপনারা আনন্দচিত্ত্বে সারা দিয়েছেন। নিজেদের অপিরসীম ক্ষয়-ক্ষতির প্রতি ভ্রুক্ষেপ করেননি। আপনারা চরম ক্ষতির স্বীকার হয়েছেন, চরম মূল্য দিয়েছেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য। দেশবাসির পক্ষ থেকে তাই আমি আপানদের আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।

আপনারা জানেন আমাদের দূর্দিনে ভারতের সুযোগ্য প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরাগান্ধি তাঁর সরকার ও ভারতের জনসাধারণ নিবেদিত বাংলার জনসাধারণকে অপ্রকাশিত সাহায্য দিয়েছেন। তারা আপনাদের আশ্রয় দিয়েছেন, আহার যুগিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, সান্ত¦না দিয়েছেন, রোগে যাতনায় শুশ্রুসা করেছেন। আমি তাদের আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। তারা আমাদের জন্য সম্ভব সবকিছু করেছেন। তাদের এই মহানুভবতা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

আজ স্বাধীন বাংলাদেশের ৬০ লক্ষ শরণার্থী বাংলার মুক্ত মাঠ, ঘাট আপনাদের দু’বাহু বাড়িয়ে আহ্বান জানাচ্ছে। আমার সর্বস্বঃ অনুরোধ আপনারা দেশে ফিরে আসুন। নিজেদের ঘর আবার ঘরে তুলুন। বাংলার বিধ্বস্ত অর্থনীতি পুনঃগঠিত করুণ। আমার আন্তরিক ইচ্ছা ছিল, আমি আপনাদের সাথে গিয়ে দেখা করার কিন্তু সময় বড় সংক্ষিপ্ত। এখন প্রধান কাজ হল দেশ গঠন ও আপনাদের পূনঃর্বাসন করা। আর আপনারা যে যার ঘরে ফিরে যান, সেখানেই আমি আপনাদের সাথে দেখা করব। আপনাদের শুভ কামনা করে আমি বাংলাদেশের শ্যামল জনপদে আপনাদের আন্তরিক অভ্যর্থনা জানাচ্ছি। জয় বাংলা।

১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কলকাতায় প্রথম রাষ্ট্রিয় সফরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

মহান নেতা শ্রীমতী গান্ধী, আমার ভাই ও বোনেরা,

আপনাদের আমি সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিদের পক্ষ থেকে শুভেচ্ছার বাণী বহণ করে নিয়ে এসেছি, কৃতজ্ঞতার বাণী বহণ করে এনেছি। আপনারা জানেন যে, সাত কোটি বাঙ্গালি কিভাবে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। পাকিস্তানের নরপশুর দল, পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর দল, আমার সাত কোটি মানুষের উপর যে অত্যাচার করেছে, দুনিয়ার ইতিহাসে আর কোন জায়গাতে তার তুলনা হয় না। আজ আমার গ্রামে গ্রামে গৃহহারার আর্তনাদ। আজ আমার গ্রামে গ্রামে সর্বহারার আর্তনাদ। আজ আমার মানুষ পথের ভিখারী।

আজ আমার মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করা হয়েছে। আমার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার ১ কোটি লোক দেশ ত্যাগ করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলো। সেদিন যদি শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আপনাদের মহান নেতা, ভারতের জনসাধারণ, পশ্চিম বঙ্গের জনসাধারণ, ত্রিপুরার জনসাধারণ, মেঘালয়ে জনসাধারণ, আসামের জনসাধাণ তাদের স্থান না দিতো, তাদের খাওয়া না দিতো, তাদের আশ্রয় না দিতো, তাদের সান্তনা না দিতো, তাদের অবস্থা কি হতো, আমি যদি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি তাহলে শ্রীমতী গান্ধী, অন্যায় করা হবে।

আমি আপনাদের শ্রদ্ধা জানাতে পারি এর বেশি জানাতে পারি না। আপনাদের এই দান কোন দিন আমরা শোধ করতে পারব না। স্বাধীনতা পেয়েছি, বড়ো রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি। এতো রক্ত কোন জাতি, কোন দেশে কোন দিন দেয় নাই, যা আমার বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে। না হলেও ত্রিশ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছে। শতকরা ৪০ খানা ঘর আমার বাংলাদেশে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। কার্ফূ আইন জারী করে আমার জ্ঞানী-গুণী, বৈজ্ঞানিক, শিক্ষাবিদদের হত্যা করা হয়েছে। আমার ১ কোটি লোক ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে।

আমার সহকর্মীরা আপনাদের দুয়ারো এসেছে, আপনাদের কাছ থেকে জানের সংগ্রাম করার জন্য। সংগ্রাম তারা করেছে। মানুষের মতো সংগ্রাম করেছে। আমি তাদের যাওয়ার সময় অস্ত্র দিতে পারি নাই। আমাকে যখন গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় আমি জানতাম না আমি মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে পারব কিনা। কিন্তু আমার মানুষকে আমি বলে গিয়েছিলাম সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য, আমার কথা তারা রেখেছে।

গত ৭ই মার্চ তারিখে আমি জানতাম পৈশাচিক বাহিনী আমার মানুষের উপর আক্রমণ করবে। আমি বলেছিলাম আমি যদি হুকুম দেবার না পারি তোমরা ঘরে ঘরে দূর্গ তৈরি করো। আমি বলেছিলাম যা কিছু আছে তাই নিয়ে শক্রর মোকাবেলা করো। আমি বলেছিলাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।

আমার লোকেরা জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে বৃদ্ধ থেকে বালক পর্যন্ত সকলে সংগ্রাম করেছে। সে সংগ্রামে কামিয়াব হতে পারতাম না যদি ভারতের জনসাধারণ, ভারতের সরকার, ভারতের সামরিক বাহিনী শ্রীমতী গান্ধীর নেতৃত্বে এগিয়ে না আসত। আমি আপনাদের কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি আপনাদের শুভেচ্ছা জানাই। আমার দেবার মতো কিছুই নাই। শুধু আমি এইটুকু দিতে পারি নিঃস্ব রিক্ত আমি আমি, দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালবাসা, দিলাম শুধু তাই।”

ভায়েরা আমার, আমাদের এ সংগ্রাম আজ থেকে শুরু হয় নাই। আপনাদের নিশ্চয়ই জানা আছে। কলকাতার কথা বলছি। এই জায়গায় আমি লেখাপড়া করেছি। এই মাটির সঙ্গে আমার সম্বন্ধে বহু দিনের ছিলো। কিন্তু আমরা যদিও দু’দেশ হয়েছিলাম কিন্তু এমন একটা চক্রের হাতে পড়েছিলাম যে, আপনাদের সঙ্গে আমরা সম্বন্ধে রাখতে পারি নাই। তারা শুধু আমার স্বাধীনতার হরণ করে নাই, তারা আমার মাতৃভাষার ওপর আঘাত করেছিল। তারা আমার সংস্কৃতির উপর আঘাত করেছিল।

তারা শুধু তাই করে নাই, শোষণ করে বাংলাকে সর্বশান্ত করেছিল। আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। বার বার মোকাবেলা করেছি। ১৯৪৮ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন আপনাদের জানা আছে। ১৯৫২ সালে বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষা করার দাবীতে আমার ছেলেরা জীবন দিয়েছিল। ১৯৫৪ সালে যখন ঢাকা পৌঁছি কলকাতায় কয়েক মিনিট আমি ছিলাম তা জানত, তার কয়েক ঘন্টা পরেই ঢাকা শহরে আমি গ্রেফতার হই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করেন পাকিস্তানে।

এই আইন করা হয়েছিল বাংলাকে শোষণ করার জন্য, এই আইন করা হয়েছিল বাংলাকে কলোনি করার জন্য। এই সামরিক আইন জারি করা হয়েছিল বাংলার মানুষকে পথের ভিখারী করার জন্য। আমরা রুখে দাঁড়িয়েছিলাম। আমার ভায়েরা জীবন দিয়েছিল। আমরা কারাবরণ গ্রহণ করেছিলাম। কিন্তু বাংলার মানুষ আপনারা খবর না পেলেও বাংলার মানুষ মাথা নত করে নাই। তারা সংগ্রাম চালিয়েছিল এবং সংগ্রাম চালিয়েছিল ১৯৬২ সালে। আমার ছেলেদের ওপর গুলি চালালো।

১৯৬৬ সালে আমার ছেলেদের, মা-বোনদের ওপর গুলি চালায়, ১৯৭০ সালের অপর ইতিহাস আপনারা জানেন। আপনাদের কাছে কী বলবো। এসংগ্রাম আজ থেকে শুরু হয় নাই, বহুদিন থেকে শুরু হয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের তিনটা আদর্শ ছিল, সে আদর্শ এ সভ্য জগতে চলতে পারে না। কী ছিল তাদের আদর্শ? ভাগ করেছে দুটো দেশ হয়েছে। তাদের একমাত্র শ্লোগান ছিল, “সব নেতা এ খতমে মে হায়। কাশ্মীর কো ফতে করনে পড়ে গা, হিন্দু হামারা দুশমন হায়।” আর কোন শ্লোগান নাই, আর কোন আদর্শ নাই, মানুষ না খেয়ে মরছে তার কথা বলবে না। কতোটা মানুষ পথের ভিখারী হচ্ছে তার কথা বলবে না। দুঃখী মানুষের গায়ে কাপড় নাই তার কথা বলবে না।

হিন্দুস্থান আমার দুশমন ! হিন্দুস্থান কেন আমার দুশমন হবে? ভারতবর্ষ কেন আমার দুশমন হবে? তারাতো আমার ভাই। তাদের সঙ্গে নিয়ে আমরা ভাই হিসাবে বাস করবো। এরই মধ্যে বাংলায় প্রতিবাদ উঠেছে। কিন্তু আমরা, আপনারা জানেন যে তেইশ বছর পর্যন্ত শতকরা ৫৬ জন লোক আমাদের। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সামরিক বাহিনীতে নেওয়া হতো। বাঙ্গালিদের সামরিক বাহিনীতে নেওয়া হতো না। কারণ বাঙ্গালি হাতে অস্ত্র তাদের উপায় ছিল না। তাই বাঙ্গালিকে অস্ত্র দেওয়া নিষেধ ছিলো।

আমার মতো মানুষের যদি একটা বন্দুক লাইসেন্স করত, নিতে হতো, তো দশবার ঘুরে একটি লাইসেন্স করতে হতো। মনে করেছিল বন্দুক দিয়েই বাংলাদেশকে দাবায়ে রাখবে। আহম্মকের দল জানে না যে জাতি একবার জাগে উঠে, যে জাতি মুক্তিপাগল, যে স্বাধীনতাকে ভালবাসে যে জাতিকে বন্দুক কামান দিয়ে দাবায়ে রাখা যায় না। আহম্মকের দল তারা জানে না। ইতিহাসে তারা পড়ে নাই। ভাইরা আমার, তাই আপনারা জানেন যা কিছু সামান্য আমার পুলিশের লোক ছিল তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।

শতকরা ৬০ ভাগ বাঙ্গালি পুলিশকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। যা কিছু আমার শিক্ষিত লোকছিল তাদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। রাস্তা বাংলাদেশে নাই শেষ করে দিয়ে গেছে। শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যাবার আগে কতগুলো খাবার গুদাম ছিলো যার মধ্যে আটা ময়দা চাউল ছিলো, তা পর্যন্ত ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। কী অবস্থায় আমাদের ফেলে গেছে তারা। আমি নিশ্চয়ই মোবারকবাদ জানাব স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে শ্রীমতী গান্ধীর সরকার এবং ভারতের জনসাধারণ আমাদের সাহায্য দিয়েছেন যাতে অন্ততঃপক্ষে আমার লোকগুলো দাঁড়াতে পেরেছে।

তবে একথা সত্য আমার লোক না খেয়ে সংগ্রাম করেছে। আমার লোক এক এক করে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু আমার লোকের একতা আছে এবং একতাবদ্ধভাবে যদি আমি সংগ্রাম করি আমার দেশকে গঠন করার জন্য আমি বিশ্বাস করি সুজলা-সুফলা বাংলাদেশ আবার হেসে ওঠবে। কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না। বাংলার মাটি বড়ো সুন্দর মাটি, বাংলার মাটি পলি মাটি, বর্ষাকালে বাংলার মাটি বড়ো নরম হয়ে যায়।

আমি একবার এই বক্তৃতা করেছিলাম পল্টন ময়দানে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের হুমিয়ার করে দিয়ে বলেছিলাম যে, ভুলে যেও না এ বাংলা তিতুমীরের বাংলা, ভূলে যেওনা এ বাংলা সূর্যসেনের বাংলা, ভুলে যেওনা এ নেতাজী সুভাষ চন্দ্রের বাংলা, ভুলে যেওনা এ বাংলা ফজলুল হকের বাংলা। ভূলে যেওনা সোহরাওয়ার্দীর বাংলা। এ বাংলা যেমন পলিমাটির বাংলা, চৈত্রে বিচুর্ণ হয়ে যায়।

তারা আমার কথা মানে নাই। তারা বার বার আমাকে, একবার আমাকে করল আগরতলা মামলার আসামী, আমাকে ফাঁসি দেবে, দিতে পারল না। বাংলার মানুষ আমাকে কেড়ে আনল ওদের কয়েদখানা থেকে। এবার আপনাকে মোবারকবাদ জানাই বেশী করে শ্রীমতী গান্ধী। আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়েছিল আমাকে ফাঁসি দেবার জন্য, তারা সমস্ত কিছু ঠিক করে ফেলেছিল। আমি জানি, আপনি দুনিয়ার দুয়ারে দুয়ারে ঘুরেছেন। আপনি দেশে দেশে ঘুরেছেন, আমার দুঃখী মানুষের জন্য ব্যক্তিগতভাবে আমার জন্য। সেজন্য আপনাকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।

আমার দুঃখ ছিল না, আমি মরবার জন্যই প্রস্তুত হয়ে হুকুম দিয়েছিলাম। মৃত্যু স্বাভাবিক। বেঁচে থাকাই অস্বাভাবিক। কিন্তু আমি বিশ্বাস করতাম যে, আমার বাংলাদেশের মানুষকে পশ্চিমা শোসকগোষ্ঠী এবং দানব গোষ্ঠী দাবায়ে রাখতে পারবে না। দুনিয়ার অনেক দেশ আমাদের সহানুভূতি দেখিয়েছে। সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের সহানুভূতি দেখিয়েছে। গ্রেট ব্রিটেনের জনসাধারণ, লন্ডনের জনসাধারণ আমাদের সহানুভূতি দেখিয়েছেন এবং তাদের সাংবাদিকরা আমাদের অনেক সমর্থন করেছে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।

কিন্তু আমেরিকার সরকারকে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই না। কৃতজ্ঞতা জানাতে পারব না। ভারত এগিয়ে এলো আমার জনসাধারণকে সাহায্য করার জন্য যখন আমার বাংলার গ্রামে গ্রামে হত্যাকান্ড চলছিল, যখন দুধের বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করা হচ্ছিল আমেরিকার গভর্নমেন্ট কি জানতেন না সে খবর। তার মেশিনারী আমার বাংলায় ছিল তারা জানতেন। কেমন করে তিনি অস্ত্র দিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনীর হাতে। কেমন করে তিনি ভারতবর্ষের সাহায্য বন্ধ করে দিলেন। ভারত জনসাধারণও দুঃখী জনসাধারণ।

তাদেরও কষ্ট আছে। তারাও তাদের মুখের গ্রাস ভাগ করে আমার বাংলার মানুষকে খাইয়েছেন। সেই সময় তাদের সাহায্য বন্ধ করার অর্থ কি? সাত কোটি লোকের বাজার রাখার জন্য? আপনাদের দালালেরা পশ্চিম পাকিস্তানের দালালেরা বাংলাদেশকে বাজার রাখবে-এই উদ্দেশ্য? আমি আমেরিকার সরকারকে, আমি তার বিরুদ্ধে কিছু বলতে চাই না। তবে এটুকু বলতে চাই আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞা প্রকাশ করতে পারলাম না। আর আপনাদের অনুরোধ করছি, আপনারা গণতন্ত্রের কথা বলেন।

মুখে মুখে, মেহেরবাণী করে গণতন্ত্রের কথা না বলে গণতন্ত্র যাতে চলে সেদিকে একটু খেয়াল রাখুন। দুনিয়ায় সামাজ্যবাদীর দিন চলে গেছে। ভারতবর্ষ আর বাংলাদেশে সামাজ্যবাদী খেলা চলবে না। এ বিশ্বাস আমার আছে।

ভায়েরা আমার. নীতির জন্য সংগ্রাম করেছিলাম। আজ আমার দেশ সার্বভৌম। বিশ্বাস করেন পশ্চিম পাকিস্তানের গরীব ভাইদের বিরুদ্ধে আমার কিছুই বলার নাই। আমি চাই তারা সুখে থাকুক। আমি প্রতিহিংসায় বিশ্বাস করিনা। কিন্তু তারা যদি মনে করে থাকেন এখনো বিদেশে ঘুরে ঘুরে বলেন যে, বাংলাদেশ তাদের অংশ। তাহলে বাধ্য হয়ে আমাকে বলতে হবে তাদের পাগলাগারদ ছাড়া আর কোন জায়গায় স্থান নাই।

আমরা ছিলাম সংখ্যায় বেশি। আমরা ঘোষণা করেছি আমার দেশ স্বাধীন। তুমি কোন জায়গার মাতবর হয়ে পড়লা, তুমি বলছ সার্বভৌম রাষ্ট্র নয়! বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। তোমার ক্ষমতা নাই বাংলার স্বাধীনতা হরন করার। বিনা অস্ত্রে যদি আমার বাংলার মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে সংগ্রাম করে স্বাধীনতা নিয়ে থাকতে পারে, আজ বাংলাদেশকে নিয়ে যদি ষড়যন্ত্র করতে চাও, আর কোন খেলা খেলতে চাও, মনে রেখো-সাত কোটি বাঙ্গালির একটা প্রাণ থাকতে বাংলার মাটিতে ঢুকবার ক্ষমতা তোমাদের নাই।

“নাগিনীরা চারি দিকে ফেলিতেছে বিষাক্ত নিশ্বাস,

কান্তির ললিত বানী মোনাইবে ব্যর্থ পরিহাস

বিদায় নেবার আগে তাই

ডাক দিয়ে যাই

দানবের সাথে যারা সংগ্রামের তরে

প্রস্তুত হইতেছে ঘরে ঘরে।”

আমার বাঙ্গালীরা প্রস্তুত আছে। নাগিনীদের আমরা চিনি। ভয় নাই আমাকে অনেকে প্রশ্ন করেন, যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ব্যক্তিগতভাবে দুনিয়া ঘুরে আপনার জন্য মুক্তি কামনা করেন। আর বাংলার স্বাধীনতা সমর্থন করেন ব্যাপার কি? আমি বরি ব্যাপারটা পরিস্কার এবং সোজা। আপনি যদি বুঝতে চান বুঝবার চান না বলেই বুঝেন না। এটা হলো নীতির মিল। এটা হলো আদর্শের মিল।

আমি বিশ্বাস করি গণতন্ত্রের, তিনি বিশ্বাস করেন গণতন্ত্রে। আমি বিশ্বাস করি সমাজতন্ত্রে, তিনি বিশ্বাস করেন সমাজতন্ত। আমি বিশ্বাস করি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তিনি বিশ্বাস করেন ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট। আমি বিশ্বাস করি জাতীয়তাবাদ। তিনি বিশ্বাস করেন জাতীয়তাবাদ। এটা নীতির মিল, এটা আদর্শের মিল। সেইজন্যে হয়েছে আমাদের বন্ধুত্ব। ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব অটুট থাকবে। কেউর ক্ষমতা নেই আমাদের বন্ধুত্ব নষ্ট করতে পারে।

ভায়েরা আমার, আমার দেশে সাম্প্রদায়িকতা, বাংলার বুকে নাই আপনারা দেখেছেন। ভারতের জনসাধারণের প্রতি অনুরোধ করবো যে ভারতের বুকে যেন সম্প্রদায়িকতার বীজ আর না আসে। কারণ এটা মনুষত্ব্যের বাইরে। এটা মানবতার বাইরে। এটা যে কোন ধর্মের বিরুদ্ধে। সেই জন্যেই ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র যেখানে বলা হয়, পুরাপুরি তা আপনাদের লালন করতে হবে।

আমি আপনাদের কোন রকম advise দিতে চাই না। আমি শুধু বলতে চাই, কারণ আমরা অনেক সময় দেখেছি, যখন আমি বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে গেছি তখন মাঝে মাঝে পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রকারীরা পূর্ব বাংলায় চেষ্টা করেছে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করতে। তার ফল হয়েছে ভারতবর্ষে যাতে আমার আন্দোলন অনেক এগিয়ে গিয়েছে। আর সেই জন্যই আপনাদের কাজে আমার আবেদন থাকবে, আর আমি আপনাদের আশ্বাস দিবার পারি যে বাংলাদেশ চারটি স্তম্ভের উপর চলবে-জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র আর ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র।

এর মধ্যে কোন কিন্তু ফিন্তু নাই। এর মধ্যে কেউ হাত লাগাতে পারবে না। এটা সোজাসুজি আমরা করব। আর আপনারা জানেন আমি সোজা মানুষ, সোজা কথা বলি, যা বলি যেটা বলি, যেটা বুঝি এবং সেটা করি। এরমধ্যে আমি ভয়ও করি না কাউকে এবং করবও না।

আমার সোনার বাংলা সত্যি সোনার বাংলা, তাই আমরা আমাদের জাতীয় সঙ্গীত করেছি-“আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় বড়ো ভালবাসি। তাই আমি আপনাদের সকলকে আমার আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেবার সময় বলে যাই আমাদের বন্ধুত্ব অটুট এবং অক্ষয় থাকবে। আপনারা আমার সঙ্গে শ্লোগান দেন জয় ভারত, জয় ভারত, জয় বাংলা, জয় বাংলা, জয় শ্রীমতী গান্ধী, জয় শ্রীমতী গান্ধী।

আমি যদি বলি বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী আপনারা বলবেন অমর হোক বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী ……..

বাংলাদেশ ভারত মৈত্রী ……..

আমি আপনাদের আবার ধন্যবাদ জানাই।

বিশ্বাস করেন বক্তৃতা করা আমি সত্যি ভুলে গেছি। এই জন্য ভুলে গেছি। আমি জানতাম না যখন আমি পশ্চিম পাকিস্তানে জেলে থেকে আমার বাংলায় এতো সর্বনাশ হয়েছে। এমন কোন বাড়ি নাই, এমন কোন সংসার নাই, যে সংসারে এটি দুটো মানুষকে খুন করা হয় নাই। ঘরে ঘরে যারা জোয়ান যুবক ছিল, ছাত্র ছিলো, যাকে পেয়েছে তাকেই ধরে হত্যা করেছে এই পাষন্ডের দল।

দুনিয়া দেখে নাই, দুনিয়া জানত, কে এগিয়ে এসেছিল, এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী, এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের জনসাধারণ, এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের সরকার, এগিয়ে এসেছিলেন ভারতের সামরিক বাহিনী, এগিয়ে এসেছিলেন পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা স্টেট, মেঘালয়, আসামের ভায়েরা। আমি আমার সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আপনাদের ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় নিচ্ছি। জয় বাংলা।

 

[ক্যাসেটে ধারণকৃত ভাষণের অনুলিপি]

১৯৭২ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারী দেশবাসীর উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

দেশবাসী ভাই ও বোনেরা আমার, আগামী ২১ শে ফেব্রুয়ারী আমরা স্বাধীন দেশের মাটিতেই প্রথম দিবস উদযাপন করতে যাচ্ছি। এ সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ তারিখ থেকে। রাষ্ট্রভাষার আন্দোলন। সেটা শুধু ভাষা আন্দোলনই সেদিন শুরু হয়না, সে আন্দোলন ছিল বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীকারের আন্দোলন, স্বাধীনতার আন্দোলন।

১৯৪৮ সাল থেকে আস্তে আস্তে ঐ সংগ্রাম শুরু হয়ে ৫২ সালে এ সংগ্রাম চরম পর্যায়ে উপনিত হয়। সেদিন আমার দেশের ছেলেরা রক্ত দিয়েছিলাম, শহীদ হয়েছিল বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য। সেদিন শুধু বাংলা ভাষার আন্দোলন ছিলনা। তারা রক্ত দিয়েছিল শুধু ভাষার জন্য নয়, তার সঙ্গে ছিল সাংস্কৃতিক স্বাধীকার, মানুষের মতো বাঁচবার অধিকারের সংগ্রাম। সেদিন অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করেন নাই যে বাংলার মানুষ জেগে উঠেছে। বাংলার মানুষকে দাবায়া রাখা যাবে না। সেদিন থেকে শুরু হয়েছিল আমাদের চরম সংগ্রাম।

বছরের পর বছর এই দিনটি আমার দেশের ভাই ও বোনেরা, কৃষক শ্রমিক, ছাত্র জনতা পালন করেছে শহীদ দিবস হিসেবে। কিন্তু শহীদ দিবস পালন করলেও বারবার এই দিনটির উপর আঘাত হেনেছে। এই দিনটি সত্যিকার অর্থে আমরা উদযাপন করতে পারি নাই। কারণ শাষকগোষ্টি এই দিনটিকে হিংসার চোখে দেখত। এবং তারা এটাকে ধ্বংস করতে বারবার চেষ্টা করেছে। এমনকি যে সামান্য একটি শহীদ মিনার গড়ে উঠেছিল তার উপর বারবার এই ষড়যন্ত্রকারীরা এবং শোষক শ্রেণীরা আঘাত হেনেছে।

তারপর থেকে বছরের পর বছর অনেক ভাই বোন, অনেক জনসাধারণ জীবন দিয়েছে। স্বাধীকারের আন্দোলনে, স্বাধীনতার আন্দোলনে তারা বাঁচতে চেয়েছে মানুষের মতো। তারা চেয়েছে তাদের অধিকার। তারা চেয়েছিল যে তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তারা বাস করবে। কিন্তু পৈচাশিক শক্তি তা কোনদিন মানতে চায় নাই। হত্যা করেছে আমার মা বোনদের, হত্যা করেছে আমার ভাই বোনদের, আঘাত হেনেছে আমার সংস্কৃতির উপর, আঘাত করেছে আমার অর্থনীতির উপর। ধর্ষণ করেছে আমার মা-বোনকে।

পথের ভিখারী করেছে বাংলার জনসাধারণকে। কিন্তু বাঙ্গালী জাত, যে জাত রক্ত দিতে জানে, যে জাত মরতে শিখেছে-সে জাতকে যে কেউ দাবায়া রাখতে পারবে না, পাকিস্তানীরা তা বুঝে নাই। তাই তাদের সমস্ত শক্তি নিয়ে তারা আমাদের উপর আক্রমণ করেছে। আজ স্বাধীনতা পেয়েছি সত্য কিন্তু বড় রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা পেয়েছি।

এত রক্ত কোন দেশে, কোন জাতি তার দেশের জন্য দেয় নাই। রক্ত আমাদের বৃথা যাবে, স্বাধীনতা আমাদের বৃথা যাবে যদি এদেশের মানুষের মুখে আমরা হাসি ফুটাতে না পারি, যদি করতে হয় তাহলে এদেশের মানুষের মুখে আমা হাসি ফুটাতে না পারি, যদি এ দেশের মানুষ শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারে এবং তা যদি করতে হয় তাহলে এদেশের মানুষকে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র এবং ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। আমি আশা করি বাংলাদেশের সাড়ে সাতকোটি মানুষ এবারে শপথ নিবে যে আমরা স্বাধীন হয়েছি।

স্বাধীন হলেও আমরা স্বাধীনতা ভোগ করতে পারব না। যদি শোষণ মুক্ত সমাজ গঠন করতে না পারি। এজন্য জাতি ধর্ম নির্বিশেষে, দল মত নির্বিশেষে ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিক সংঘবদ্ধভাবে দেশ পুনঃর্বাসনের কাজে অগ্রসর হবে এটি আমরা আশা করি। এই দিনের শপথ আমাদের হবে-‘যে স্বাধীনতা এনেছি রক্ত দিয়ে, দরকার যদি হয় এই স্বাধীনতাকে রক্ষা করব, যদি প্রয়োজন হয় আরো রক্ত দিয়ে।

যদি প্রয়োজন হয় এদেশের মানুষকে গড়ে তোলার জন্য আরো রক্ত দিতে হয় তাও করব। কিন্তু করতে হবে আজ এই দিনে শহীদী রক্তের কথা মনে করে। যারা মারা গেছে, তাদের কথা স্মরণ করে, তাদের নামে শপথ নিয়ে প্রতিজ্ঞা করতে হবে যে, বাংলার মাটিতে, আমার বাপ মার মাটিতে শোষণহীন সমাজ গড়তে হবে।

সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি করতে হবে এবং এদেশের মানুষ যাতে আর দুঃখ কষ্ট না পায়, আর কোনদিন অত্যাচার নীপিড়ীত না হয়, এইটাকেই স্মরণ করে আমাদের কাজে অগ্রসর হতে হবে। তাই আমি অনুরোধ করছি বিশেষ করে আমার যুব সমাজ ভাইদের, কৃষক শ্রমিক ভাইদের-সংঘবদ্ধভাবে এগিয়ে যান। আমরা মহাবিপদের মধ্যে আছি। আমাদের কিছুই নাই, নতুন করে গড়তে হবে। আসুন ঐক্যবদ্ধভাবে দেশকে গড়ে উঠাই। একটা শোষণহীন সমাজ তৈয়ার করি। শহীদ স্মৃতি অমর হউক।      জয় বাংলা।

 

১৯৭২ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারী পাবনা জেলার নগরবাড়ির জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

বাংলাদেশের মানুষ হিন্দু মুসলমান জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অস্ত্র ধরেছিল এক পৈচাশিক শক্তির বিরুদ্ধে। তারা মানুষ নয়, তারা অমানুষ। তারা পশুর চেয়ে খারাপ। দুনিয়ার ইতিহাসে কোনদিন দেখা যায় নাই যে নিরীহ মা-বোনদের উপর অত্যাচার করে হত্যা করে। বৃদ্ধ-বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করে রাস্তায় রাস্তায় গর্ত করে স্তুপ করে রেখে দিয়েছে। দুনিয়ায় দেখি নাই যে মা-বাপের সামনে থেকে ধরে নিয়ে তাদের গায়ের সমস্ত রক্ত, হত্যা করে নদীতে মেরে ফেলে দিয়েছে। দুনিয়ায় দেখা যায় নাই চামড়া উচিয়ে ফেলে দিয়েছে।

তাজা মানুষের চামড়া উঠিয়ে ফেলে দিয়েছে তারপর নুন মেরে দিয়েছে। দুনিয়ায় দেখা যায় নাই যে একদিন, দুই দিন, তিন দিন, চারদিন, মাসের পর মাস অত্যাচার করে আমার দুধের বাচ্চাদের হত্যা করেছে। দুনিয়ার ইতিহাসে নাই এক কোটি লোক ঘর বাড়ি ছেড়ে দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। আমার বাংলাদেশের এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল, তাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, জ্বালায়া দিয়েছিল। এদেশের আড়াই কোটি তিন লক্ষ মা-বোন আমাদের কাছে এসেছে এ পর্যন্ত।

Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman : বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি মাস
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman

যাদের ঘরে ঘরে গিয়ে পাষবিক অত্যাচার করেছে। আমার আজকের ত্রিশ লক্ষ লোক, আমার বাংলার কৃষক, আমার বাংলার যুবক, আমার বাংলার শ্রমিক, আমার বাংলার ছাত্রদের হত্যা করেছে। আমি কল্পনা করতে পারি না। আমি মাঝে মাঝে ভাবি, আমি কেন বেঁচে এলাম? আমার এই দেশকে দেখার জন্য! এদেশে আমার মানুষ আজ সর্বহারা, এদেশে আমার মানুষ আজ গৃহহারা, এদেশে আমার মানুষ আজ না খাওয়া। আজ লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি বেকার।

পাটের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। রাস্তা ঘাট ভেঙ্গে দিয়েছে। কারেন্সি নোট জ্বালিয়ে দিয়েছে। রেল লাইন উড়িয়ে দিয়েছে, পোর্ট নষ্ট করেছে, আমার সমস্ত সম্পদ ধ্বংস করে দিয়ে চলে গেছে। এত রক্ত কোন দেশ কোন জাতি দেয় নাই যা আমার বাংলাদেশের ভাইয়েরা বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে স্বাধীনতার জন্য। খালি হাতের এই সরকার আমাকে নিতে হয়েছে। আমার দলকে নিতে হয়েছে। আমার শতকরা ৭০ জন পুলিশকে হত্যা করেছে। আমার ই.পি.আরে শতকরা ত্রিশ জন চল্লিশ জন পঞ্চাশ জনকে করেছে।

আমার সামরিক বাহিনীর ছেলেদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। আমার ভালো ভালো কর্মচারীদের নিয়ে হত্যা করেছে। আমার বুদ্ধিজীবী কেউ ডাক্তার, কেউ ইঞ্জিনিয়ার, যারা যোগ্য লোক, যারা সাংবাদিক তাদের ধরে নিয়ে হত্যা করেছে কার্ফিও দিয়ে। দুনিয়ার মানুষ আশ্চর্য হয়ে যায়, যখনই খবর পায়, আমি আমার সহকর্মীদের বলি, ওরা আমায় বক্তৃতা করেত বলে। সত্যি আজকে আর আমি বক্তৃতা করতে পারি না। আমি আর সেই মুজিবর রহমান এখন আর নাই। আমার মুখের থেকে সে আগুন যে চলে গেছে। আমি যেন ভেঙ্গে পড়ি।

আমি যখন চিন্তা করি, চারদিকে দেখি বাংলার গ্রাম শেষ, দেখি কৃষকের ফসল নাই, দেখি তাদের ঘর বাড়ি নাই, দেখি আমার পুলিশ বাহিনী নাই, দেখি তাদের পোষাক নাই, দেখি আমার শ্রমিক ভাইদের ত্রাণ দিতে পারি না, আমার কৃষক ভাইদের দুঃখি ভাইদের খাবার দেবার পারি না। আর আমার যে হাজার হাজার লক্ষ লক্ষ ভাই বোনেরা এতিম হয়েছে, মা হয়েছে পুত্র হারা, স্ত্রী হয়েছে স্বামী হারা, ভাই হয়েছে ভাই ছাড়া-এদের আমি কি দিয়ে শান্তনা দিব? এদের কোথা থেকে আমি সাহায্য করব? কি করে এদের মুখে অন্ন দিব, কি করে এদের আমি পানি খাওয়ার বন্দোবস্ত করব?

দস্যুর দল যাবার পূর্বে আমার মানুষদের শুধু হত্যা করে নাই, আমার সম্পদকে শেষ করে দিয়ে গেছে। আমার মুক্তি বাহিনীর ভাইয়েরা, তোমরা সংগ্রাম করেছ, জীবন দিয়েছ, তোমাদের কাছে আমার জাতি তোমাদের কাছে কৃতজ্ঞ। সমস্ত জাত তোমাদের একটি অংশ। আমি তোমাদের, যাতে দেশ গড়তে, তোমরা কাজ করতে পার সেজন্য ক্যাম্পে এসে কার্ড জমা দিয়ে তোমাদের নাম রেজিষ্ট্রি করতে বলেছি। রেজিষ্ট্রি করার পরে যারা বাংলাদেশ রক্ষী বাহিনীতে যেতে চায়, যতদূর সম্ভবপর সেখানে নেয়া হবে। কিছু সংখ্যক নেয়া হবে পুলিশে।

যারা ছাত্ররা, যারা যুদ্ধ করেছে, তারা লেখা-পড়া করার জন্য স্কুল কলেজে ফিরে যাবে। তাদের জন্য যতদূর সম্ভব সাহায্য সহযোগিতার বন্ধ্যোবস্ত করা হয়েছে। যারা মাঠে আছে তারা সার্টিফিকেট নিয়ে ২৯ তারিখের মধ্যে ক্যাম্পে গিয়ে আপনারা যার যার গ্রামে ফিরে যান। কাস্তে কোদাল হাতে নেন। যখন সময় আসবে, নিশ্চই আপনাদের আমি দেখব কি করে আপনাদের একটা ব্যবস্থা করা যায়। আপনাদের ভূললে চলবে না যে, ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে, তাদের সংসার রয়েছে, তাদের আমি কি দিতে পেরেছি?

আপনাদের অন্তত এক মাসের খাবারের বন্দ্যোবস্ত করতে পারি না। কিন্তু ত্রিশ লক্ষ লোক যাদের মা ভাই বোন মারা গেছে তাদের আজ পযন্ত এক প্যাকেট খাবার দিতে পারি নাই। এক আনা পয়সাও দিতে পারি নাই। আমি করতেছি কোন রকমে ইষ্ট বেঙ্গলে এই ত্রিশ লক্ষ লোক যাদের মারা গেছে ভাই-বোন, তাদের সাহায্য করতে পারি কি না? যে বোনেরা আমার বিধবা হয়েছে, যে বোনেরা আমার বলতে পারিনা বুক ফেটে যায়, ধর্ষিতা হয়েছে তাদের আমার ক্যাম্পে রাখতে হয়েছে।

দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে লঙ্গরখানায় এনে তাদের আমি দিয়েছি, যাতে তাদের সংসার টিকে থাকতে পারে। যুবক ভাইয়েরা আমার, যে বোনোরা, আমার যে মেয়েরা পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বরদের কাছে ধর্ষিতা হয়েছে, তারা ইচ্ছে করে উজ্জত দেয় নাই, তাদের ইজ্জত নষ্ট করা হয়েছে। তারা আমার মা, তারা আমার বোন, তারা আমার কন্যা।

তোমাদের যারা ত্যাগ দিয়ে তোমরা যুদ্ধ করেছ, তোমাদের কাছে আমার আবেদন, এই ত্যাগ নিয়ে তোমাদের এগিয়ে যেতে হবে। এই মেয়েদের তোমাদের অনেকের বিবাহ করতে হবে। দুনিয়াকে দেখাতে হবে যুদ্ধ শুধু অস্ত্রই নিতে পারো নাই মা বোনের ইজ্জতও যেন এগিয়ে দিতে পেরেছ।

তারা ধর্ষিত হয়েছে তাদের দোষে নয়, স্বাধীনতার সংগ্রামে। যেমন তোমাদের উপরে সরকারের দায়িত্ব রয়েছে তাদের উপরও সরকারের দায়িত্ব রয়েছে। তোমরা যারা আমার ভক্ত, তোমরা যারা আমার কথায় শহীদ হয়েছ, তোমরা যারা আমার কথায় সরকার করেছ। তোমাদের কাছে আমার বড় ভাই হিসেবে, তোমরা আমাকে আদর করে মুজিব ভাই বল, এই হিসেবে তোমাদের কাছে আমার এই আবেদন রইল-তোমরা জেলায় জেলায় লিষ্ট কর, যারা ধর্ষিতা কন্যাদের সাদী করতে চায়। তাদের জন্য আমি সব ব্যবস্থা করব যা আমার তওফিকে কুলায়।

যারা আমার কথা শুনে না, যারা আমার হুকুম মানেনা, তারা মুক্তি বাহিনী নয়, তারা বদর বাহিনী, রাজাকার। আর আজকে কিছু কিছু লোক, কিছু কিছু ছেলে, যারা বদর বাহিনী, রাজাকারে ছিল ১৬ তারিখের পরে জামা বদলাইয়া মুক্তিবাহিনী হয়েছে। তারা লুটতরাজ করে, মা-বোনদের উপর অত্যাচার করে, তারা অন্যের সম্পত্তি লুট করে আর গাড়ী দখল করে, বাড়ী দখল করে।

আমি পরিস্কারভাবে বলে দেবার চাই এ রকমের যে অত্যাচার অবিচার করবে, আমি পুলিশ ব্যবহার করতে চাইনা, পুলিশ দিয়ে আমি স্বাধীনতা সংগ্রাম করি নাই- আমি করেছি সাড়ে সাতকোটি লোক দিয়ে। তোমাদের কাছে আমার অনুরোধ, তাদের প্রতিরোধ করো, তাদের দাবাও।

আজকে এই গ্রামে-গ্রামে শহরে শহরে যারা দেশকে ভালবাসে, তারা গুন্ডা বদমাইশদের শাসন করো। শুধু মনে রেখো কোন লোক নিরাপরাধ লোকের উপর যেন অত্যাচার না হয়। আমার মুখের উপর যেন কালি না পরে। দ্বিতীয় কথা আরেকটা কথা বলে দেবার চাই, নেতৃবৃন্দের রিকমান্ড করা বন্ধ করে দেন। সাত কোটি মানুষের নেতা আমি। সাতকোটি লোকের টাকা। সাতকোটি লোক আমাকে ভালবাসে, আমি তাদের ভালবাসি।

আমার চোখে মানুষে মানুষে কোন ভেদাভেদ নাই। আপনারা রিকমান্ড করা বন্ধ করেন। যার যা শক্তি আছে, যতদূর যার বুদ্ধি আক্কেল আছে, সেভাবে সরকারী সুযোগ সুবিধা পাবেন। তার উপরে আমার দলের মন্ত্রী হন অন্যদলের নেতা হন, প্রাক্তন নেতারা হন, যুক্তফ্রন্টের ভাইরা হন, তারা মনে রাখবেন দলের লোকরে খুশি করার জন্য রিকমান্ড দিবেন না। আর যে লোককে রিকমান্ড দিবেন, আমি আমার সরকারকে হুকুম দিয়ে দিয়েছি, তার চাকুরী কোনদিন জীবনে হবে না।

একগ্রামে বাস করইন্যা ছেলে তোমাদের কাছে যেতে পারে না। শহরের লোক তোমাদের বাড়িতে বাড়িতে যাবে, তোমরা দরখাস্ত করবে। আমি ক্রমিক নং বসাইয়া দেবো। সে ক্রমিক নং অনুযায়ী ইন্টারভিউ হবে। যার যার যোগ্যতা অনুযায়ী তার চাকুরী হবে। কোন সুপারিশ এদেশে চলবে না। তবে যারা মুক্তিবাহিনীতে সংগ্রাম করেছে, যারা সার্টিফিকেট পেয়েছে, তারা ২৯ তারিখে ক্যাম্পে ছেড়ে চলে যাবে, তাদের জন্য একটা প্রভিশন রাখা হয়েছে-যাতে তাদের প্রতি প্রথমে সুবিচার করা হয় এবং তাদের জন্য দরকার হলে একটা কোটা করে দেয়া যেতে পারে। কিন্তু তাই বলে আমার দেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্য আমার কাজ করতে হবে। পৃথক সুযোগ-সুবিধা নেয়া উচিৎ হবে না।

ভাইয়েরা আমার, আমি বলেছি আমি জেল থেকে বেরিয়ে এসেছি। ফাঁসির কাষ্ট থেকে আসছি আমি শুধু খালি হাতে নয়, খালি হাত হলেও ভাল হয়। খালি হাত থেকেও খারাপ অবস্থায় এই সরকার ক্ষমতা নেয়। টাকা, পয়সা, সোনা, রূপা যা ছিল চুরি কইরা লুটের দল বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানে নিয়া গেছে।

আমাকে দিন-রাত ভিক্ষা করতে হচ্ছে যে আমারে চাল দাও, আমারে ঔষধ দাও, আমারে কাপড় দাও, আমারে ডাল দাও, আমার মানুষকে বাঁচাতে হবে। আমি পারিনা, সত্যি আমি পাগল হয়ে যাই। জেল থেকে বের হয়ে আইস্যা নামার পর থেকে আজো পর্যন্ত একটা দিন কেমন করে ভালো বিশ্রাম করতে হয়, তা আমি জানি না। আমি বিশ্রাম চাইনা, আমার প্রয়োজন নাই। যতদিন বেঁচে আছি কাজ করে যাব, তারপরে আমি বিদায় হয়ে যাব।

সংগ্রামে নামছিলাম মরবার জন্য। বেঁচে যে আছি আপনাদের দশ জনের দোয়া। এছাড়া বাঁচবার আমার কোন উপায় ছিলনা। আপনাদের কাজ করতে হবে। কিচ্ছু নাই আমার। যদি কেউ বলেন এটা দেন ওটা দেন, আমি বলি কিচ্ছু নাই, কিচ্ছু দেবার পারব না। চেষ্টা করছি আনার জন্যে যদি আসে পাবেন। যদি না আসে আমি পারব না। আমি আমার স্বাধীনতা বিক্রি করতে পারব না। আমি আমার লোকদের গোলাম করতে পারব না। আমি সাহায্য চাই। আমরা সাহায্যের জন্য স্বার্থ ছাড়ব না। আমি দুনিয়ার খেলা বুঝি।

আবার যদি আমি আপনাদের গোলাম করে যাই, মরে গেলেও আমি আর শান্তি পাবনা। বহু রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা এনেছি, আপনারা এনেছেন। এ স্বাধীনতা রাখতে হবে। শান্ত হন, কষ্ট করতে হবে। একটা গাছ লাগালেও পাঁচ বছরের আগে ফল হয়না। আর সাত কোটি মানুষের গাছ, গাছকে পথের ভিখারী করে দিয়ে গেছে। তাঁকে বাঁচাতে হলে কি প্রয়োজন আপনারা তা বুঝেন। আমি কি করব? আমার কৃষক খাজনা দিবার পারে না। আমি বলে দিলাম, গভঃর্ণমেন্ট বলে দিল বকেয়া খাজনা সুদসহ সব মাপ। কি বলে মাপ পাইছেন না।

তাহল গভঃর্ণমেন্টের টাকা আসবে কোত্থেকে। মাপতো কইরা দিছি। নুনের উপর ট্যাক্স মাপ, গভঃর্ণমেন্ট কোন ট্যাক্স পেল না। এ রকম করে গরীবের যা ছিল, সেগুলো মাপ কইরা দিছি। ২৫ বিঘা যাদের জমি আছে, ২৫ বিঘা পর্যন্ত তাদের খাজনা, মনে আছে আপনাদের বলেছিলাম, এখানে আগে যে রোজ কেয়ামত পর্যন্ত মাপ হয়ে যাবে। মাপ কইরা দিছি আর খাজনা দিতে হবে না। শুনেন ট্যাক্স দিতে হবে, না হলে জমির মালিকানা থাকা কষ্টকর হবে। যদি দেন অন্যান্য যে ট্যাক্স আছে তা দিতে হবে, না হয় সরকার চালানো যাবে না।

যাতে আপনাদের সহজ সরল পাইয়া এনের টাকা হেন দিয়া, হেনের টাহা ওনে দিয়া দুই টাহা পাঁচ টাহা নিয়ে দৌড় না পারতে পারে সেজন্য ২৫ বিঘা জমির খাজনা মাপ সেজন্য আপনাদের কাজ করতে হবে। আপনাদের গ্রামে গ্রামে এই যে কুড়ালি পয়সা যদি আমার থাকত আমি বলতাম দিলাম পয়সা, খুড়াও কুড়াল, পয়সা নাই বলে আমি বলছি। আমিও কুড়াল মারি, তোমরাও মার। ইনভেষ্টমেন্ট যত রাস্তা খাল এগুলো আপনাদের কাটতে হবে। তাছাড়াও কিছু কিছু জায়গাও ব্যাক্তিগতভাবে আপনাদের দিছি।

এরমধ্যেও দিয়া ফেলেছি, তাই আল্লাহর মর্জি আপনাদের দোয়ায় দুনিয়ার ৪৫ টি দেশ বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছে। এই ষড়যন্ত্রকারীরা ঐ পশ্চিশ পাকিস্তানের নেতারা যে লাগছে, সে দাবা খেলা বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমার ভাই ভুট্টো সাহেবের হারাধনের একটি ছেলে পাগল হয়ে গেছে। সুখে থাক। তোমাদের কাছে মাপ চাই, আর না। তোমরা যা করে গেছ, তা যদি পশ্চিম পাকিস্তানের মা-বোনেরা জানত, তাহলে মনে হয় সে দেশেও আগুন জ্বলে উঠত।

তবে একথা সত্য আমার চার লক্ষ বাঙ্গালী আছে পশ্চিম পাকিস্তানে, সরকারী কর্মচারী আছে, সামরিক বাহিনীর লোকেরা আছে, আমি চাই তোমার লোক তুমি নিয়ে যাও, আমার লোক আমাকে দিয়ে দাও। তবে মনে রেখ, যারা আমার বোনকে হত্যা করেছে, যারা আমার ভাই বেরাদরকে হত্যা করেছে, যারা আমার মা-বোনকে পথের ভিখারী করেছে, যারা আমার নিরাপরাধ দুধের বাচ্চাদের হত্যা করেছে-সে হিসাব বাংলার মাটিতে দিতে হবে যদি শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকে।

আর যারা দালালী করেছে, পশ্চিমারা দালালী করেছে, যারা পশ্চিমাদের রাস্তা দেখাইয়া দিয়া আমার গ্রামকে গ্রাম জ্বালাইয়া দিয়াছে। যারা আমার ছেলেদের ধরাইয়া দিয়া গুলি করে মেরেছে। দল ওদের গ্রেফতার কর। কিন্তু নিরাপরাধ কোন লোকের উপর যেন হাত না চলে, দেশের বদনাম হবে। আল্লাহ বেজার হবে। আমি সবিনয় অনুরোধ করছি, স্কুলে-কলেজে আশ্রয়ে যারা আছে। যারা যুদ্ধ করেছে, মুক্তিযোদ্ধারা আমার বাহিনীর ছেলেরা এবং যারা গরীব তাদের জন্য আমি কার্ড সাহায্যের বন্দ্যোবস্ত করে দিয়েছি।

স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করা তেমনি কষ্টকর। আজ স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি আমার সোনার বাংলা গড়ে না উঠে। স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি আমার ছেলেরা কাজ না পায়, কিন্তু সময়ের প্রয়োজন। আপনাদের থেকে আসবে না যে, আমি তাড়াতাড়ি আপনাদের সবকিছু করে দেবার পারব। আপনাদের সহ্য করতে হবে, কাজ করতে হবে, খাটতে হবে। আর আমি বলেছি কৃষি বিপ্লব। আমার দুনিয়ার কাছ থেকে খালি থেকে খালি খাবার কিনতে হবে-পারব না। খাবার তৈরি করতে হবে।

আপানাদের গ্রামে গ্রামে খাবার উৎপাদন করতে হবে। আমি জানি বন্যায় নষ্ট হয়ে যায় কিন্তু পয়সা কোথায়? চেষ্টা করতেছি। সারাদেশে আইন-শৃঙ্খলা রাখতে হবে। এই দায়িত্ব যেমন সরকারের এই দায়িত্ব তেমনি জন সাধারণের। আপনারা সকলে যেমন নষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানীদের, টিক্কা ইয়াহিয়া খানদের, তারিয়ে ছিলেন, তেমনি করে গুন্ডা পান্ডা বদমইশদেরও তাড়িয়ে দিবেন। আল্লাহর মর্জি মদ খাওয়া পাকিস্তানে ছিল। ওরা ইসলামি রাষ্ট্র, বাংলাদেশে বন্ধ হয়ে গেছে। ওটা ছিল ইসলামী রাষ্ট্র সেজন্য ওখানে মদ খাওয়া হতো।

আল্লাহর মর্জি এখন এদেশে একদম বন্ধ। এদেশে মদ খাবে কেন? হারাম, বন্ধ করে দিলাম। আপনারা সেদিকেও খেয়াল রাখবেন, রাত্রিবেলা যেন পলাইয়া পলাইয়া মদ খাবার না পারে। এই মদ খাইলেই মাতলামি করে, মাতলামি করলেই বদমাশি করে, বদামাশি করলেই গুন্ডামি করে। এই মদ বন্ধ করতে হবে। আপনারা কাজ করেন, আপনাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি, আপনারা আওয়ামী লীগ গঠন করেন। সেচ্ছাসেবক লীগ গঠন করেন। সেচ্ছাসেবক বাহিনী করেন।

আর আমি রক্ষিবাহিনী গঠন করেছি, যারা আমার মুক্তিবাহিনীতে ছিল তাদের মধ্যে কিছু সংখ্যক লোক নিয়ে, পুলিশ বাহিনীতে তাদের নিয়েছি। আপনারা আজ আমাকে কথা দিন সবাই মিলে আপনারা কাজ করবেন কিনা। কোনে পুকুর নাই পুকুর কেটে দাও, কোনে রাস্তা নাই, রাস্তা কেটে দাও। যেখানে গরীব কাজ করতে পারে না, কাজ দিয়ে দাও। সকলে মিলে মিশে আপনারা কাজ করবেন কিনা আমি জানতে চাই। জয় বাংলা।

 

১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আমরা আজ শহীদ দিবস পালন করছি, লক্ষ লক্ষ ভাই বোনের রক্তের বিনিময়ে আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। খেলায় রাখবেন এই স্বাধীনতা যেন বৃথা না যায়। আজ যে আর্দশের জন্য আমার ভাইয়েরা শহীদ হয়েছিল সে আদর্শ সেদিন পূরণ হবে, যে দিন বাংলাদেশের মানুষ শোষণমুক্ত সমাজ গঠন করতে পারবে।

আপনাদের কাছে আমার আবেদন রইল যে, আজ প্রতিজ্ঞা করুণ, যে পর্যন্ত না শোষণ মুক্ত সমাজ গঠন না হবে, সে পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। আমাদের চারটি আদর্শ। এই চারটি আদর্শ কায়েম না হওয়া পর্যন্ত জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র যে পর্যন্ত আমরা এই বাংলাদেশকে এই চারটি স্তম্ভের উপর গঠন করতে না পারব। সে পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে।

আমার দেশবাসী ভাই ও বোনেরা, শহীদের রক্ত যেন বৃথা না যায়। ষড়যন্ত্রকারীরা আজও চেষ্টা করছে আমার স্বাধীনতাকে নসাৎ করার জন্য। মনে রাখবেন ষড়যন্ত্র বন্ধ হয় নাই। আমাদের হুঁশিয়ার থাকতে হবে। দল মত নির্বিশেষে, জাতি ধর্ম নির্বিশেষে ছাত্র-যুবক-কৃষক-শ্রমিক-একাত্ববোধ হয়ে দেশ গঠনের কাজে অগ্রসর হন।

আমার দেশের মানুষ দুখী, না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। আপনাদের সরকারের এমন কিছু নাই মানুষকে পেটভরে ভাত দেবার পারে। আপনারা গ্রামে গ্রামে সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে এগিয়ে যান এবং দেশের মানুষকে সুখী করেন। সেদিন এই শহীদদের আত্মা শান্তি পাবে। বাংলার মানুষ পেটভরে ভাত খাবে। সুখে-শান্তিতে বাস করবে। বেকার সমস্যা দূর হবে। ছাত্ররা লেখাপড়ার সুযোগ পাবে। সেজন্য বলছি আমি, শহীদ স্মৃতি অমর হউক। জয় বাংলা।

আরও দেখুন:

Leave a Comment