বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের মে মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, May]

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের মে মাস

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের মে মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, May]

১৯৭২ সালের ১লা মে জাতির উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আমার প্রিয় শ্রমজীবী ভাই ও বোনেরা,

স্বাধীন বাংলার মুক্ত মাটিতে এবারই সর্বপ্রথম ঐতিহাসিক মে দিবস পালিত হচ্ছে। বাংলার মেহনতী মানুষ শৃঙ্খলমুক্ত পরিবেশে এই দিনটিকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করার অধিকার অর্জন করছে, এজন্য দেশ ও জাতি আজ গর্বিত। মহান মে দিবস শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের এক জ্বলন্ত প্রতীক। সারা বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত নীপিড়িত মানুষের বিশেষ করে আজকের এ দিনটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বাংলার মেহনতী মানুষ, বিশেষ করে শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-যুবক যাঁরা সম্রাজ্যবাদী শোষণ, প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের জুলুম এবং ঔপনিবেশিক জালেমদের বিরুদ্ধে লড়াই করে স্বাধীনতার ইতিহাস লিখে গেলেন, তাঁদের ত্যাগ ও তীতিক্ষার কথা বাংলাদেশের মানুষ কোনদিন ভুলবে না।

তাঁরা আর কোনদিন আমাদের কাছে কোন দাবী দাওয়া নিয়ে আসবেন না। কিন্তু এই লাখো লাখো শহীদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এদেশের ইতিহাসে। যুগ যুগ ধরে বাংলাদেশের মানুষ দেশ গড়ার সংগ্রামে তাঁদের কাছ থেকে পাবে প্রেরণা। তাই আজকের এই মহান দিনে আমার দেশের শ্রমজীবি মানুষদেরকে আমি শোষণহীন বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকায় নেমে আসার আহ্বান জানাচ্ছি।

আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসী

আপনারা অতীতে বারবার আমার ডাকে সাড়া দিয়ে নির্ভীক সংগ্রামে কাঁপিয়ে পড়েছেন। আমার বিশ্বাস, এবারও আপনারা আমার আহ্বানে মনে প্রাণে এগিয়ে আসবেন। অতীতে আমরা একটি মর্মান্তিক পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থার বাঁধা পড়ে গিয়েছিলাম। গুটি কয়েক সুবিধাবাদী ব্যক্তি ও গোষ্ঠী জাতীয় সম্পদ ও শ্রমজীবী মানুষের উৎপাদন নিজেদের কুক্ষিগত করে রেখেছিল। দেশ আজ স্বাধীন। সম্পদের মালিক জনগণ।

তাই কোন শ্রেণীবিশেষের ভোগ লালসার জন্য এবং লোভ চরিতার্থ করার নিমিত্তে এই সম্পদকে অপচয় করতে দেওয়া হবে না। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সমাজতন্ত্র কায়েম করা। এই ব্যবস্থায় দেশের সমুদয় উৎপাদিত ও প্রাকৃতিক সম্পদ কৃষক শ্রমিক ও সর্বশ্রেণীর মানুষের মধ্যে সুষমভাবে বন্টন করা হবে। যদিও বাধা অনেক, সমস্যার শেষ নেই, তবুও লক্ষ্য অর্জনের জন্য আমাদের এগিয়ে যেতেই হবে।

আমার সংগ্রামী দেশবাসী

আপনারা জানেন, আমাদের বর্তমান জাতীয় উৎপাদন সাড়ে সাত কোটি দারিদ্র-পীড়িত মানুষের ন্যূনতম চাহিদা মেটানোর জন্য পর্যাপ্ত নয়। শত শত বছর ধরে আমরা একটা নিকুষ্ট উপনিবেশ এবং বিদেশীদের বাজার হিসেবে লুষ্ঠিত হয়েছি। বিদেশীরা দেশের অর্থনীতিকে জনগণের প্রয়োজনের উপযোগী করে গড়ে তোলেনি। এরপরে ইয়াহিয়ার বর্বর সৈন্যরা আমাদের অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়ে গেছে।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে এ দেশের অর্থনীতিকে পুনঃর্গঠনের কাজে হাত দিয়েছে। আমরা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির গোড়াপত্তন, করেছি। পাশাপাশি দুঃখী জনগণের অভাবমোচন ও দূর্দশা লাঘবের জন্য আমাদের সাধ্যমত আশু সাহায্যের ব্যবস্থা করতে হবে। সুদসহ কৃষকদের সমস্ত বকেয়া খাজনা ও পঁচিশ বিঘা পর্যন্ত জমির কর চিরদিনের জন্য বিলোপ করা হয়েছে। লবণ উৎপাদনকে আর আবগারি শুল্ক দিতে হবে না।

নির্যাতনমূলক ইজারাদারী প্রথা বিলুপ্ত করা হয়েছে। সরকার প্রায় ষোল কোটি টাকার টেস্ট রিলিফ জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করেছে। দরিদ্র চাষীদের দশ কোটি টাকার ডাকাতি ঋণ, এক লাখ নব্বই হাজার টন সার, দু’লাখ মন বীজ ধান দেওয়া হয়েছে। সমবায়ের মাধ্যমে চার কোটি টাকা বিতরণ করা হবে। যুদ্ধবিধ্বস্ত ও স্কুল ঘর পুনঃনির্মাণ ও ছাত্র-শিক্ষকদের সাহায্যের জন্য প্রায় দশ কোটি টাকা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলোকে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

মুক্তিসংগ্রামের সময় ক্ষতিগ্রস্ত ২৮৭টি রেল সেতুর মধ্যে ২৬২ টির এবং ২৭৪টি সড়ক সেতুর মধ্যে ১৭০টির মেরামতের কাজ ইতিমধ্যেই শেষ করা হয়েছে। বাকীগুলির কাজ বর্ষার আগে শেষ করার জন্য আমাদের ইঞ্জিনিয়াররা অবিরাম পরিশ্রম করে চলেছেন। স্বাধীনতার প্রাক্কালে ব্যাংক, বীমা থেমে গিয়েছিল। দক্ষ পরিচালকের অভাব, খুচরা যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল এবং ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের টানাটানি শিল্পজীবনে নিশ্চয়তা এনে দিয়েছিল। শূন্য হাতে সরকার ব্যাংক, বীমা পূঁজিবিনিয়োগ সংস্থা এবং শিল্প কারখানাভিত্তিক সক্রিয় করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। এই পরিস্থিতিতে আমরা বিধ্বস্ত অর্থনীতিকে সমাজতান্ত্রিক ভিত্তিতে গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

অতীতে কতিপয় সুবিধাভোগী দেশের সমুদয় সম্পদের সিংহভাগ ভোগ করতো। বর্তমান ব্যবস্থার চূড়ান্ত পর্যায়ে কৃষক, শ্রমিক, দরিদ্র ও বঞ্চিত লোকেরা উপকৃত হবেন। এ জন্যই সরকারের উপর অত্যন্ত গুরুতর সত্ত্বেও আমরা চলতি বৎসরের ছাব্বিশে মার্চ আমাদের অর্থনীতির কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ, যেমন- ব্যাংক, বীমা, সমগ্র পাট, বস্ত্র ও চিনি শিল্প, আভ্যন্তরীন নৌ-পরিবহন ও বৈদেশিক বাণিজ্যসহ শিল্প কারখানার একটা বিরাট অংশ জাতীয়করণ করেছি। পুরাতন পুজিবাদী পদ্ধতির ফলে সমাজতান্ত্রি পদ্ধতি কায়েমের পথে এটা একটা সুস্পষ্ট দুঃসাহসীক পদক্ষেপ। নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে আমরা এগিয়ে চলেছি।

সমাজতান্ত্রি অর্থনীতি পুরাপুরিভাবে গড়ে তোলার কাজ আমাদের সামনে পড়ে রয়েছে। এখানেই শ্রমজীবীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হলে, তাঁদের বৈপ্লবিক দৃষ্টিভঙ্গী গ্রহণ করতে হবে, আমরা এখন আর পুঁজিপতি প্রভূদের ভোগের জন্য সম্পদ উৎপাদন করতে যাচ্ছি না। এখন যা উৎপাদন হবে তা শ্রমিক-কৃষক এবং বাংলাদেশের সব মানুষের কল্যাণে লাগবে।

সমাজতন্ত্রের শত্রুরা এই লক্ষ্য অর্জনে বাঁধা এবং জাতীয়করণ কর্মসূচির সাফল্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করতে চায়। শ্রমিকরা সরকারের সঙ্গে একযোগে কাজ করে সমাজতন্ত্রের শত্রুদের ধ্বংস করতে পারেন। কিন্তু এটা করতে হলে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় শ্রমিকরা যে ভূমিকা পালন করেছেন, সে দৃষ্টিভঙ্গীর ও আচরণের আমল পরিবর্তন আনতে হবে। তাঁদের অবশ্যই উৎপাদন বৃদ্ধি করতে হবে এবং সম্পদকে রক্ষা করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে শিল্পোৎপাদনের সুফল সমাজের সকল শ্রেণীর মানুষ বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ চাষী ভাইদের ভোগ করতে দিতে হবে। সুতরাং জাতীয় স্বার্থের প্রতিকূল দাবী দাওয়া পেশের মনোভাব ত্যাগ করা দরকার। এক কথায় সমাজতান্ত্রিক শৃঙ্খলা ছাড়া সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েম করা সম্ভব নয়।

ভায়েরা আমার,

শ্রমিকরা যাতে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের পরিচালনায় সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে পারেন সেজন্য আমি ইতিমধ্যেই শ্রমিক নেতাদের সাথে শিল্প-কারখানা পরিচালনায় শ্রমিকদের অংশগ্রহণের ব্যাপারে একটি তীব্র প্রণয়নের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা করেছি। নতুন ভূমিকা পালনের জন্য শ্রমিকদের যেমন তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হচ্ছে তেমনি সরকারি প্রশাসনকে নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রয়োজনীয়তা মেটানোর জন্য সরকারি কর্মচারীদের দৃষ্টিভঙ্গির মৌলিক পরিবর্তনের প্রয়োজন রয়েছে। সরকারের উচ্চ ও নিম্ন বেতনভোগী কর্মচারীদের বেতনের ক্ষেত্রে যে বিরাট ব্যবধান ছিল তা কমিয়ে আনার জন্য বেতন কাঠামোর পুনঃর্বিন্যাস করার উদ্দেশ্যে একটি জাতীয় বেতন কমিশন গঠন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।

সরকারী চাকরির এই নয়া কাঠামোতে কর্মচারীরার জাতীয় পুনঃর্গঠন সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে পারবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। গত কয়েক মাসে জনসাধারণ যে সাহস ও ধৈর্য্যরে পরিচয় দিয়েছেন সেজন্য আমি তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। বেকারত্ব ও অত্যাবশ্যকীয় জিনিসের দূর্মুল্য আমাদেরকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। আমি আপনাদের আশ্বাস দিতে পারি? আমরা জনসাধারণের দুঃখ দূর্দশা সম্পর্কে সজাগ রয়েছি এবং পরিকল্পিত উপায়ে এ সমস্যার মোকাবিলার জন্য অবিরাম কাজ করে যাচ্ছি।

জনগণের জানা আছে, আমদানী কমে যাওয়ায় এবং উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় বাজারে জিনিসপত্রের অভাব হয়েছে। যুদ্ধে বন্দর যোগাযোগ ব্যবস্থা ও কারখানাগুলি ক্ষতিগ্রস্থ ও বিকল হয়ে যাওয়ার ফলে আমরা বিশেষ অসুবিধার সম্মুখিন হয়েছিলাম। কিছু সংখ্যক এজেন্ট, অসৎ ব্যবসায়ী ও কালোবাজারীরা পণ্যদ্রব্য গুদামজাত করে বেশ খানিকটা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করেছিল। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সামগ্রিক চাহিদা মেটানোর জন্য ব্যাপক প্রচেষ্টা চালানো হচ্ছে। ইতিমধ্যে খাদ্যশষ্যের আমদানি উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি করা হয়েছে।

এপ্রিল মাসে প্রায় দু’লক্ষ চল্লিশ হাজার টন খাদ্য শস্য বিদেশ থেকে আনা হয়েছে। মে মাস নাগাদ আরো তিন লক্ষ পচাশি টন খাদ্যশস্য আসছে। আমাদের প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র ভারত সাড়ে সাত লক্ষ টন এবং জাতিসংঘের বিভিন্ন সদস্য ও বন্ধুরাষ্ট্রসমূহ আমাদের প্রায় সাত লক্ষ টন খাদ্যশস্য দেবার আশ্বাস দিয়েছেন। এর ফলে খাদ্য শস্যের দাম ক্রমান্বয়ে কমে যাবে আমার বিশ্বাস। খাবার তেল, কেরোসিন প্রভৃতি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের আমদানীর ব্যবস্থা করা হয়েছে। মোটামুটিভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি এবং উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেই জিনিসপত্রের দাম আরো কমে যাবে।

আমার ভাই ও বোনেরা,

আমাদের সমগ্র পরিকল্পনার গুরুত্বপূর্ণ অংশের মধ্যে রয়েছে বন্টন ও সরবরাহ ব্যবস্থার পূনঃবির্ন্যাস করা। ইতিমধ্যেই বেসরকারী ডিলার, এজেন্ট এবং সংশ্লিষ্ট সকলকে সর্তক করে দেয়া হয়েছে যে, যদি তারা অসাধু ও সমাজ বিরোধী কার্যকলাপ বন্ধ না করে তাহলে তাদের সকল লাইসেন্স, পারমিট বাতিল করে দেয়া হবে। আশু ব্যবস্থা হিসেবে সরকার প্রতি ইউনিয়নে সমস্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানে সমবায় ভিত্তিতে ন্যায্যমূল্যের দোকান খোলার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। এর ফলে বেসরকারী ব্যক্তিদের বন্টনের ক্ষেত্রে একচেটিয়া কর্তৃত্বের অবসান ঘটবে এবং সরবরাহের ক্ষেত্রে সামরিক স্বল্পতার সুযোগে যুক্তিহীন মূল্য বৃদ্ধির সম্ভাবনা রোধ হবে।

এই পরিকল্পনা কার্যকরী করার সাথে সাথে বেতনের লোকদের জন্য আমরা কিছু সাহায্যের ব্যবস্থা করেছি। আপনারা জানেন, জিনিসপত্রের দাম না কমিয়ে কেবল বেতন বাড়িয়ে দিলেই জনসাধারণের অসুবিধা দূর হয় না। কাজেই মূল্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য আমরা ইতিপূর্বে বর্ণিত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করেছি। সেই সাথে আমরা মনে করি এই দূর্মূল্যের বাজারে টিকে থাকার সংগ্রামে লিপ্ত নিম্ন আয়ের মানুষের কাছে কিছু আর্থিক সাহায্য দেয়া দরকার।

আপনাদের সরকার স্বতঃস্ফুর্ত হয়ে দেশের গরীব সরকারী কর্মচারীদের জন্য কিছু আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করেছে। স্বায়ত্তশাসিত ও অর্ধ-স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, প্রাথমিক স্কুল শিক্ষক, পুলিশ, জাতীয় রক্ষীবাহিনী, বাংলাদেশ রাইফেলস, দেশরক্ষা বাহিনী, রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকার পরিচালিত শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সদস্য ও শ্রমিকরা এই বাড়তি সাহায্য পাবেন। আজ থেকে এটা কার্যকরী হবে এবং আগামী পহেলা জুনের বেতনের সাথে আপনারা এই বাড়তি টাকা পেয়ে যাবেন। যে সকল সরকারী কর্মচারী প্রতি মাসে ৩৫৫ টাকা পর্যন্ত মূল বেতন পান তাঁদের সাময়িক ভিত্তিতে সরকার এই হারে পর্যন্ত মাসিক ২৫ টাকা।

১।           মাসিক বেতন ১২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক টাকা ২৫ টাকা।

২।            মাসিক বেতন ১২৬ টাকা থেকে ২২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ২০ টাকা। এই শ্রেণীভূক্ত কর্মচারীরা সর্বনিম্ন মাসিক ১৫০ টাকা পাবেন।

৩।          মাসিক বেতন ২২৬ টাকা থেকে ৩৩৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ১৫ টাকা।

ক)           এই শ্রেণীভূক্ত কর্মচারীরা সর্বনিম্ন ২৪৫ টাকা পাবেন।

খ)           যে সকল কর্মচারীরা মাসিক ৩৪৯ টাকা পর্যন্ত বেতন পান তাঁদের জন্য মার্জিনাল এডজাস্টমেন্ট করা হবে।

যেসকল বেসামরিক কর্মচারী প্রতিরক্ষা বরাদ্দ হতে বেতন পান বা যাঁরা ওয়ার্ক চার্জড, এবং কনটিনজেন্ট কর্মচারী, তাঁদের বেলায়ও এই আদেশ প্রযোজ্য হবে। এই সাময়িক সুবিধার কোন অংশই বেতন হিসেবে গণ্য হবে না।

যেসকল শ্রমিক সরকারি মালিকানাধীন কর্পোরেশন সংস্থা ও কর্তৃপক্ষ রাষ্ট্রায়ত্ত ও সরকারি তত্ত্বাবধানের অধিন ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান ইত্যাদিতে নিযুক্ত আছেন ও মাসিক ৩৫৫ টাকা পর্যন্ত বেতন পাচ্ছেন তাঁদের সাময়িক ভিত্তিতে এই হারে সাহায্য মঞ্জুর করা হয়েছেঃ

১।           মাসিক বেতন ১২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক টাকা ২৫ টাকা।

২।            মাসিক বেতন ১২৬ টাকা থেকে ২২৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ২০ টাকা। এই শ্রেণীভূক্ত কর্মচারীরা সর্বনিম্ন মাসিক ১৫০ টাকা পাবেন।

৩।          মাসিক বেতন ২২৬ টাকা থেকে ৩৫৫ টাকা পর্যন্ত মাসিক ১৫ টাকা।

ক)           এই শ্রেণীভূক্ত কর্মচারীরা সর্বনিম্ন ২৪৫ টাকা পাবেন।

খ)           যে সকল কর্মচারীরা মাসিক ৩৪৯ টাকা পর্যন্ত বেতন পান তাঁদের জন্য মার্জিনাল এডজাস্টমেন্ট করা হবে।

এই সুবিধা স্থায়ী, অস্থায়ী, বদলী ও ওয়ার্কচার্জড, শ্রমিকরাও পাবেন।

সরকারের মালিকানাধীন বা তত্ত্বাবধানকারী চা বাগানের শ্রমিকরা এই হারে এসব সাময়িক সুবিধা ভোগ করবেন।

ক)           দুই সদস্যবিশিষ্ট অদক্ষ শ্রমিক পরিবার মাসিক অতিরিক্ত ২০ টাকা পাবেন।

খ)           এক সদস্যবিশিষ্ট অদক্ষ শ্রমিক পরিবার মাসিক অতিরিক্ত ১০ টাকা করে পাবেন।

আমার শোষিত ভাই ও বোনেরা,

আমি বিশ্বাস করি, এই পদক্ষেপগুলি আপনাদের বর্তমান দূর্দশার কিছুটা লাগব করবে। অবশ্য জনগণের ভবিষ্যত জীবনের প্রকৃত মান উন্নয়ন এই বেতন বৃদ্ধির উপর কোনক্রমেই নির্ভরশীল নয়। সেটা তখনি সম্ভব হয়ে উঠবে যখন আমাদের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে পূনঃর্গঠিত এবং কারখানাগুলি পুরোমাত্রায় চালু হবে। আমরা এ পর্যন্ত কোন নতুন করে, খাজনা ধার্য করি নাই।

আপনারা শুনে অবাক হবেন যে, আপনাদের এই বেতন বাড়াবার জন্য সরকারকে প্রতি বছর অতিরিক্ত ৩০ থেকে ৩৫ কোটি টাকা খরচ করতে হবে। কৃষক সর্বস্তরের জনসাধারণকে সুবিধা দেয়ার জন্য ইতিপূর্বে প্রায় ৭০ কোটি টাকার বকেয়া সুদ খাজনা ও কর মাফ করে দেওয়া হয়েছে। উৎপাদন বৃদ্ধি করে আমরা এই ঘাটতি পূরণ করতে পারি।

আমার গরীব শ্রমিক ভাই ও বোনেরা,

আপনারা সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি কায়েমের উপযোগী সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করছেন। আমাদেরকে পরিশ্রম করতে হবে, উৎপাদনের লক্ষ্য অর্জন করতে হবে। দেশের সম্পদ বাড়িয়ে আমরা জীবনযাত্রার প্রকৃত মান উন্নয়ন করলে সফল হবে। আজকের এই মে দিবসে আসুন আমরা এই শপথ গ্রহণ করি যে, সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য আমরা অবিরাম সংগ্রাম করে যাব। এ দেশের চাষী-তাঁতী কামার-কুমোর শ্রমিক ও মজলুম জনতার জীবনে সুখ ও সমৃদ্ধি ফিরিয়ে আনার জন্য আমরা কাজ করব।

আমার পার্টির সহকর্মীগণ এবং সরকার এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ সজাগ যে, দুঃখের মধ্য দিয়ে আপনাদের দিন কাটছে। ঘরে খাবার নেই, পরনে কাপড় নেই, মাথা গুজবার জন্য নেই এতটুকু ঠাঁই। ইয়াহিয়ার বর্বর সেনাবাহিনীর নিষ্ঠুর ধ্বংসলীলা আপনাদের সবকিছু নষ্ট করে দিয়ে গেছে। তবে আপনারা সম্পূর্ণভাবে আশ্বস্ত থাকতে পারেন যে, এই বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পূনঃর্গঠনের জন্য জনগণের সাহায্য ও সহযোগিতা নিয়ে আমরা আমাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করব।

ইতিমধ্যে কিছু সংখ্যক বিদেশী এজেন্ট ও দুস্কৃতিকারী স্বার্থান্বেষী মহল মানুষের দুঃখ-দূর্দশার সুযোগ নিয়ে মাঠে নামার চেষ্টা করছে। এদের অতীতের কার্যকলাপ আপনারা জানেন। আমার অনুরোধ আপনারা এই সমরাজ্যবাদী দালালদের সম্পর্কে সর্তক থাকবেন। কিছু কিছু দুস্কৃতিকারী জায়গায় জায়গায় শান্তি শৃঙ্খলা নষ্ট করার জন্য চেষ্টা করছে। আপনারা তাদের উপর কঠোর দৃষ্টি রাখবেন। সরকার তাঁদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

ভায়েরা আমার,

আমি আপনাদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিব না। আপনারা জানেন আমি একবার কোন অঙ্গীকার করলে নিজের প্রাণের বিনিময়ে হলেও সেটা পালন করতে চেষ্টা করি। আমি বিগতদিনে যে সকল প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম সেগুলি পালনের চেষ্টা করেছি। কিন্তু আমি আলাদিনের আশ্চর্য প্রদ্বীপ হাতে নিয়ে সরকারের দায়িত্বভার গ্রহণ করিনি যে রাতারাতি সবকিছু ঠিকঠাক করে দেব। সমৃদ্ধির পথে কোন সংক্ষিপ্ত রাস্তা আমার জানা নেই।

শতাব্দীর শোষণের পূঞ্জীভূত সমস্যা আমাদের সামনে জড়ো হয়ে রয়েছে। এগুলোর সমাধানের উদ্দেশ্যে কঠোর পরিশ্রম ও আরও আত্মত্যাগের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। তাহলেই আমরা আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার ভিত্তি গড়ে যেতে পারব। আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরেরা শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যে সেখানে বসবাস করতে পারব। খোদা আমাদের সহায় আছেন।

জয় বাংলা।

 

১৯৭২ সালের ৯ মে রাজশাহী মাদ্রাসা প্রাঙ্গণে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা,

আমি জানি, আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আমি জানি, আপনারা অনেক দূর থেকে এসেছেন। আমি জানি, রৌদ্রের মধ্যে আপনাদের কষ্ট হচ্ছে। আপনারা শান্ত হোন। আপনারা জানেন, ত্রিশ লাখ লোক জীবন দিয়েছে। আজ প্রথম আপনাদের কাছে জেল থেকে বেরোবার পর আমি রাজশাহীতে এসেছি। আমি বক্তৃতা শুরু করার আগে আপনাদের অনুরোধ করবো, যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করে দোয়া করবেন। আসুন, প্রথমে বক্তৃতা শুরু করার আগে তাঁদের আত্মার জন্য দোয়া করি আমরা।

আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, আজ আমার স্বাধীনতা পেয়েছি, কিন্তু বড় ত্যাগের বিনিময়ে। এত রক্ত কোন দেশ কোনদিন কোন জাতি দেয়নি, যা আজ আমার বাংলার মানুষকে দিতে হয়েছে। আজ ঘরে ঘরে, গ্রামে গ্রামে মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। জালেমরা রাস্তাঘাট ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে। চালের গুদাম ধ্বংস করে দিয়েছে। আমার সরকারী কর্মচারীদের গুলি করে হত্যা করেছে। আমার পুলিশ ভাইদের, বিডিআর সামরিক বাহিনীর ছেলেদের গুলি করে হত্যা করেছে। হত্যা করেছে আমার ছাত্র, আমার যুবক, আমার কৃষক, আমার বুদ্ধিজীবী, আমার সাংবাদিকদের।

মানুষ যে এত বড় পাষন্ড হতে পারে, দুনিয়ার ইতিহাসে তা কোনদিন দেখা যায় নি-যা পাকিস্তানের বর্বর সৈন্যরা করে গেছে।

আপনারা রাজশাহীর জনসাধারণ, আপনারা তা জানেন। আপনারা নিজেরা ভূক্তভোগী। এই রাজশাহীর ওপর দিয়ে তান্ডবলীলা চলেছে।

আমি জানতাম না যে, আপনাদের কাছে আমি ফিরে আসব। আমাকে ২৫ তারিখে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। আমার ভাইদের ওপর মেশিনগান চালানো হয়। আমি মরে গেলেও আমার দুঃখ হতো না, কেননা আমার বাংলাদেশের মানুষ সংগ্রাম করে স্বাধীন হয়েছে। আমার আত্মা দেখতো। বিশ্বাস করুন, আমি জানতাম না যে, আপনাদের সাথে আমার আর জীবনে দেখা হবে। আমি জানতাম না যে, বাংলার মাটিতে আমি আবার ফিরে আসব। আমি জানতাম না যে, আপনাদের মুখ আমি আর দেখতে পাবো।

আমি জানতাম না যে, জীবনে কোনদিন আর এই সোনার দেশে সোনার বাংলায় আমি ফিরে আসতে পারব। আপনারা দোয়া করেছেন, আপনারা রক্ত দিয়েছেন আপনারা সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে সংগ্রাম করেছেন। সেই সংগ্রামের ফল হিসেবে আমি পশ্চিম পাকিস্তানের জেল থেকে মুক্ত হয়ে মাত্র ৪ মাস পূর্বে বাংলার মাটিতে এসেছি।

এসে কি দেখলাম? দেখলাম চারদিকে হাহাকার। এসে দেখলাম গৃহহারার, সর্বহারার আর্তনাদ। এসে দেখলাম লাখ লাখ লোক বেকার। এসে দেখলাম আমার মা বোন কাঁদছে। হত্যা করা হয়েছে কারো স্বামীকে, কারো ছেলেকে, জ্বালিয়ে দিয়েছে তার ঘর, ধ্বংস করে দিয়েছে, বাজার, গ্রামকে গ্রাম। রেল লাইন উড়িয়ে দিয়েছে, ষ্টিমার ভেঙ্গে দিয়েছে, অর্থ লুট করে নিয়ে গেছে। লুট করেছে বৈদেশিক মুদ্রা। কিছু রেখে যায়নি, ভস্মীভূত একটা দেশ ছাড়া।

আপনারা আমাকে ভালোবাসেন, আমি আপনাদের ভালোবাসি। আমি যাবার বেলায় বলেছিলাম, আমি যদি মরে যাই, আমি যে ডাক দিয়ে যাব আমার বাংলার মানুষ অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করবে। আপনারা তা করেছেন। আপনারা বিনা অস্ত্রে জালেমদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন। বাংলার মাটি থেকে বর্বরের দল চলে গেছে। কিন্তু ধ্বংস করে দিয়েছে আমার সব কিছু।

ইনশাল্লাহ সোনার বাংলা একদিন হাসবে। ইনশাল্লাহ, সোনার বাংলার মানুষ একদিন পেটভরে ভাত খাবে। ইনশাল্লাহ, বাংলার মানুষ আবার সুখী হবে। শোষণ বাংলাদেশে থাকতে পারবে না। ভাইয়েরা আমার আজ আপনাদের আমি কিছুই দিতে পারি না। আমি কিছুই দিতে পারব না। যারা আপনাদের ধোকা দেয়, তারা দিতে পারে। আমি ধোকা দিতে পারি না।

আপনারা জানেন, জীবনে আমি কোন দিন মিথ্যা ওয়াদা করিনা। আমি জীবনে প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হওয়ার জন্য রাজনীতি করিনি। একদিকে ছিল আমার প্রধানমন্ত্রীর সিংহাসন আর একদিকে ছিল আমার ফাঁসীর ঘর। আমি বাংলার জনগণকে মাথা নত করতে দিতে পারি না বলেই ফাঁসীকাষ্ঠ বেঁছে নিয়েছিলাম।

আমি কি চাই?

আমি কি চাই? আমি চাই আমার বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার বেকার কাজ পাক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কি চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসে খেলে বেড়াক। আমি কি চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণ ভরে হাসুক। কিন্তু বড় দুঃখ ভাই, জালেমরা কিছুই রেখে যায় নি। সমস্ত নোটগুলি পর্যন্ত পুড়িয়ে দিয়ে গেছে। বৈদেশিক মুদ্রা, বিশ্বাস করুন, যেদিন আমি এসে সরকার নিলাম এক পয়সার বৈদেশিক মুদ্রাও পাইনি।

এক কোটি লোক, এক লাখ, দশ লাখ, পঞ্চাশ লাখ নয়, এক কোটি লোক বাংলাদেশে তাদের ঘর বাড়ি ত্যাগ করে, মাতৃভূমির মায়া ছেড়ে স্ত্রী-পুত্র কন্যার হাত ধরে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। মহিয়সী নারী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী ও ভারতের জনসাধারণ আমার দেশের লোককে ভাত দিয়েছিল, আশ্রয় দিয়েছিল। আমার মুক্তিবাহিনীর হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল, যে অস্ত্র নিয়ে পাষন্ড ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্য বাহিনীকে পর্যুদস্ত করতে পেরেছিল আমার মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা। কত ছেলে যে আজ মারা গেছে।

৩০ লাখ! এক লাক, দুই লাখ নয়। আজ যখন এখানে এলাম আমার বোনেরা আমার কাছে এলো, তাঁদের স্বামীকে ধরে নিয়ে হত্যা করেছে। আমি যখন গ্রামে যাই, আমি দেখতে পাই, চারিদিকে শুধু চোখের পানি। মানুষ এত বড় নির্দয় হতে পারে, মানুষ এত বড় পাষন্ড হতে পারে, দুনয়ার ইতিহাসে দেখা যায় নি। শুনেছি নমরুদের নাম, শুনেছি ফেরাউনের নাম, শুনেছি হিটলারের নাম, শুনেছি চেঙ্গিস খাঁর নাম। কিন্তু সব খানদেরকে পরাজিত করেছে ইয়াহিয়া খাঁর সৈন্যবাহিনী। তাঁরা এসেছিল ইসলামের নামে, তারা এসেছিল মুসলমানদের নামে।

শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা, দুই লাখ মা বোনকে আমি উদ্ধার করেছি, যাদের উপর ইয়াহিয়ার সৈন্যরা পাশবিক অত্যাচার করেছে। আপনারা কি বিনা অস্ত্রে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেননি? করেছেন? পারবেন না, এই গুন্ডাদেরকে শায়েস্তা করতে?

ওরা আমার শতকরা ৬০ ভাগ পুলিশকে হত্যা করেছে। শতকরা ৫০/৬০ ভাগ বি.ডি.আর হত্যা করেছে। অর্ধেকের মত বাঙ্গালী সৈন্য তাঁরা হত্যা করেছে।

পুলিশেরা আপনাদের ভাই। আপনারা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে তাদের সঙ্গে যুদ্ধ করেছেন। এবারও তাঁরা অস্ত্র ধরবে। আমি চাই যে, জনগণ তাদের সাহায্য করবে। আমার অস্ত্র না থাকতে পারে, আমার বাঁশের লাঠি আছে, আমি বলেছিলাম যে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোল। যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত হও। আবারও আমি বলছি বাঁশের লাঠি তৈয়ার করো। দরকার যদি হয় তোমাদের কাছে আমি অস্ত্র দিয়ে দেবো। কিন্তু বাংলার স্বাধীনতার দুশমনদের সঙ্গে আমার আপোষ নেই। ৩০ লক্ষ লোকের রক্তের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা এসেছে, সে স্বাধীনতা আমি নষ্ট করতে দিতে পারি না।

সকল বকেয়া খাজনা চিরদিনের জন্য মাফ করে দিয়েছি,

ভাইয়েরা আমার, বোনেরা আমার, আপনাদের কাজ করতে হবে। আমি ১৬ কোটি টাকা দিয়েছি টেস্ট রিলিফের কাজে। আপনারা গ্রামে গ্রামে টেস্ট রিলিফের কাজ করেন এবং কেউ যেন এই টাকা চুরি করতে না পারে। দু’লাখ মা বোন! বলুন এদের আমি কোথায় কি করবো? কি করে আমি বাঁচাবো? কি করে আমি বাঁচাবো। কি করে আমি খাবার দেবো। আমার গুদামে চাল নাই। আমার তহবিলে পয়সা নাই। কিন্তু আমি মানুষের দুঃখ সহ্য করতে পারি না। তাই প্রথমে আমি বলে দিলাম, টাকা নাই ঠিক, কিন্তু গরীবকে অত্যাচার করে খাজনা আদায় করা চলবে না। তাই যত বকেয়া খাজনা ছিল আমি চিরদিনের জন্য মাফ করে দিয়েছি। লবণের ওপর কর থাকতে পারেনা। আমি তা তুলে নিয়েছি।

এই ময়দানে একবার আমি একটা কথা বলেছিলাম, আপনাদের তা মনে আছে কিনা জানি না। আমি যদি বেঁচে থাকি ২৫ বিঘা জমি পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ হয়ে যাবে। আমি মাফ করে দিয়েছি। প্রায় ৭০ কোটি টাকা আমি মাফ করে দিয়েছি। বলুন আমি টাকা পাবো কোথায়? আমার গুদামে চাল নেই। গত বছর মানুষ কৃষি কাজ করতে পারেনি। সাড়ে সাত কোটি টন ভারত সরকার এবং মিসেস গান্ধী দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন এবং পাঠাচ্ছেন। জাতিসংঘ থেকে আমরা খাবার পাচ্ছি। বিভিন্ন দেশ থেকে খাবার আমি কিনছি। আনবো কি করে? জাহাজ কোথায়? বর্বরা জাহাজ ডুবিয়ে দিয়ে গেছে, যাতে অন্য জাহাজ না আসতে পারে।

রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে জাহাজগুলো তুলছি। জাতিসংঘ আমাকে ৬ লাখ টন চাল দেবে। এছাড়াও দুনিয়ার অন্যান্য দেশকে বলছি, আমার লোককে বাঁচাও, আমার লোককে খাবার দাও। আমার দেশের লোক মরে গেলো। খাবার দাও। দুঃখ হয় কি জানেন? আমি ভিক্ষা করে চাল নিয়ে আসি, আমি গ্রামে গ্রামে পাঠাই, আর চোরাকারবারীরা সে মাল চুরি করে খায়। ইচ্ছে হয়, ওদের পেটের মধ্যে আঙ্গুল ঢুকিয়ে আমি কালোবাজারীর পয়সা বের করে আনি। বাংলার জনগণ বিনা অস্ত্রে মোকাবেলা করেছে ইয়াহিয়ার সৈন্যদের। পারবেন না এদেরকে শেষ করতে? আমিতো অস্ত্র দিয়ে যাইনি। আমিতো পয়সা দিতে পারিনি। আমিতো দিয়েছিলাম শুধু আদর্শ, দিয়েছিলাম স্বাধীনতার ডাক।

বাংলা আজ স্বাধীন হয়েছে। আজ বাংলার পতাকা উড়ছে। দুনিয়ার প্রায় ৭০ টি দেশ আমার বাংলাদেশকে মেনে নিয়েছে। আজ এই পতাকা দুনিয়ার দেশে দেশে উড়ে। আজ আমি মনে শান্তি পাই যে, আমি আপনাদেরকে দেখতে পাই। কিন্তু শান্তি আমার নাই। আমার পয়সা নাই। গরীব কর্মচারী না খেয়ে কষ্ট পায়। আমি কি করবো? আমি বললাম, ২৫ টাকা বেতন বাড়িয়ে দাও। তাতে আমার ৪০ কোটি টাকা দিতে হয়েছে। পাবো কোথায়? ট্যাক্স কোথায়? খাজনা কোথায়? কোথা থেকে আনবো। কার কাছ থেকে আনবো? কিভাবে দেবো? রাস্তা নেই। বাস ট্রাক নেই। ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। রাস্তাগুলোর পুল উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। ট্রাক ছিলনা।

আমি ট্রাক পাঠিয়েছি। ট্রাক আনছি দুনিয়ার কাছ থেকে। আনতে সময় লাগে না? আনতে সময় তো লাগে। স্কুল-কলেজ ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়ে গেছে। কেমন করে ছেলেরা লেখাপড়া শিখবে? বই পর্যন্ত নেই। ল্যাবরেটরী নেই। টেবিল-চেয়ার নেই। কি করে ছেলেরা লেখাপড়া করবে? দশ কোটি টাকা দিয়েছিল আমি তাদের জন্য। আমি কোথায় পাব? কি করে দেবো? আমার তো নেই কিছু। আমি তো গরীব মানুষের উপর ট্যাক্স বসাতে পারব না। আজ পর্যন্ত আমি তা এক পয়সা ট্যাক্স বাড়াইনি। তাহলে বলবে কি করে?

আপনাদের কাজ করতে হবে। ছেলেদের কাজ করতে হবে। আপনারা মনে রাখবেন, স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনি কষ্টকর। দুশমনরা বসে নেই। দুশমনরা খেলছে। দুশমনরা পয়সা লুটছে।

বাংলাদেশে দালাল ছিল, রাজাকার ছিল। ইয়াহিয়ার সাথে হাত মিলিয়ে ওরা আমার লোককে হত্যা করেছে। কিছু ধরেছি। আরো কিছু ধরার চেষ্টায় আছি। আপনারা খবর দেবেন তাদের ধরা হবে।

আমি বলেছি, ওমুক তারিখের মধ্যে অস্ত্র জমা দাও। আমার বাংলার মানুষ, যারা আমাকে ভালবাসে, তারা অস্ত্র জমা দিয়েছে। এখনও দু’চার জন যারা অনেকে নিজেকে মুক্তিবাহিনী বলেন, অথচ তারা মুক্তি বাহিনীর লোক নন, তারা অস্ত্র জমা দেননি। তাঁরা ১৬ তারিখের পরে আচকানডা বদলিয়ে মুক্তিযোদ্ধা হয়ে গিয়েছেন। রাতে তারা সেই অস্ত্র দিয়ে ডাকাতি করে, মানুষকে খুন করে।

আমি দিয়েছি ১০ কোটি টাকার ঋণ যাতে মানুষ গরু কিনতে পারে এবং হাল চাষ করতে পারে। আমরা তো আল্লাহর মর্জি কম নই, সাড়ে সাত কোটি। ঐ ১০ কোটি, ৫ কোটি টাকা, কিছুই না। কিন্তু দেবো কোত্থেকে আমি? পাবো কোথায়? কার কাছ থেকে আনবো? টাকা আমি পেতে পারি। টাকা আমি আনতে পারি। কিন্তু আমার ভবিষ্যৎ বংশধরকে গোলাম করে সেই পয়সা আমি মানুষের কাছ থেকে আনতে চাই না। আমি চাই না যে আমার ভবিষ্যৎ বংশধর গোলাম হয়ে থাক।

যে যা বলুক না কেন, আমি পরিস্কার জানিয়ে দিতে চাই, আমি আপনাদের ধোকা দিতে পারব না। কারণ আমি গদির জন্য রাজনীতি করিনি। আমি মরবার জন্যে রাজনীতি করেছিলাম। আমি আপনাদের ১০০ কোটি টাকার মত রিলিফ দিয়েছি। তবুও আমি বলছি তিন বছর আপনাদের কিছু দিতে পারব না। আপনারা যদি রাজী থাকেন, তবে হাত তুলে দেখিয়ে দেন। হাত তুলুন, দু’হাত তুলুন। (উপস্থিত জনসাধারণ দু’হাত তুলে সায় দিলো) আমি বলছি ইনশাল্লাহ, নিশ্চয়ই আপনাদের আমি এনে দেব মানুষের কাছ থেকে। কিন্তু কষ্ট করতে হবে। কষ্টে থাকতে হবে।

এই ধ্বংস্তুপকে যদি একবার খাড়া করতে পারি, ইন্শাল্লাহ বাংলাদেশের মানুষ কষ্টে থাকবে না। কিন্তু সময় লাগবে। একটা গাছ লাগালেও পাঁচ বছরের আগে ফল হয় না।

সবাইকে আজ শুধু কাজ করতে হবে,

শ্রমিক ভাইয়েরা আমার, কাজ করতে হবে। আর ছাত্র ভাইদেরকে বলি, একটু লেখাপড়া করো। বাবার হোটেলে আর কত কাল খাবে? পয়সা-কড়ি নেই। তোমাদের কষ্ট হচ্ছে জানি। কিন্তু লেখাপড়া একটু করো। আন্দোলন করো আমার আপত্তি নেই। আমার জন্ম আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে। কিন্তু তোমাদের একটু মানুষ হতে হবে। মানুষ না হলে দেশ গড়তে আমি পারব না। ভবিষ্যতে তোমাদের এ দেশের শাসনভার হাতে নিতে হবে। চুঙ্গা ফুঁকাও, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু মেহেরবানি করে একটু কাজ কর।

কৃষক ভাইয়েরা, চেষ্টা করবো, দুনিয়া থেকে বীজ ও পাম্প এনেছি আপনাদের দেবার জন্য। কিন্তু আপনাদেরকে কাজ করতে হবে। কাজ করে ফসল উৎপাদন করতে হবে। জানেন কত লাখ টন, বাংলাদেশে খাদ্যের অভাব? আমি কোথা থেকে দেবো? কি করে দেবো? কেমন করে বাঁচাব? আমার ঘুম হয় না। ৪ মাস হলো আমি জেল থেকে এসেছি কিন্তু একা দিন কেমন করে বিশ্রাম করতে হয় আমি তা জানি না। কিন্তু করবো কি?

কি করে চালাবো? এই রাজশাহী আসলাম। রাস্তাঘাট নেই। মানুষের খাবার নেই। পানি নেই। বন্যায় সব নষ্ট হয়ে যায়। কি করে আমি চালাবো? আমি তো বুঝতে পারি না। আমি তো পাগল হয়ে যাই। আমি কি করে কি করবো? আমার তো চিন্তায় ঘুম হয় না। ভাইয়েরা আমার, আপনাদের কাজ করতে হবে। কাজ না করলে কিছুই হবে না।

একটা কথা আমি বলে দেবার চাই। একদল লোক এখন বেরিয়েছে, যারা মাঝে মাঝে এটা বলে, ওটা বলে। যখন রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম চলছিল তাদের চেহারা দেখা যায় নি। তারা পালিয়ে ইয়াহিয়ার দালালী করেছে। এরা মনে করেছে শেখ মুজিবুর রহমান কিছু বলে না, বড় দয়ালূ লোক। আমি সত্যিই দয়ালু লোক। কিন্তু গরীবকে যদি কেহ শোষণ করে তখন আমি দয়ালু নই।

আর একদল লোক বের হয়েছে। তারাও এটা ওটা বলছে। কোথায় ছিলেন? ঘুমিয়ে ছিলেন আরামে। এখন এ কথা সে কথা বলেন। জীবনে কোন কাজ করতে পারে নি। মরবার আগেও করতে পারবে না। খারী মাঝে মাঝে মানুষের দুঃখ দূর্দশা দেখে হা হা এটা হলো না, এটা হলো না। এসো কাজ কর। তোমাকে মানা করেছে কে? একটা গ্রামে যাও। গ্রামের লোককে পেট ভরে খাবার দাও। আমি তো মানা করছি না। তবু কেন বলো কিছু হলো না। এ কারণেই বলতে হয় মার পোড়ে না, পোড়ে ডাইনীর।

ভাইয়েরা আমার, আমার এ দেশে সাম্প্রদায়িকতা আর থাকতে পারবে না। আপনারা আমাকে ভালবাসেন আমি জানি। আমি জানি আপনারা আমার কথা রাখবেন। আমার বাঙ্গালী। আমরা জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছি। আমরা বাঙ্গালী। আমরা জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করেছি। আমরা বাঙ্গালী আমার বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। আমরা আর পাকিস্তানী নই। আমরা আর কোন দেশের মানুষ নই। আমরা বাংলাদেশের মানুষ আমরা বাঙ্গালী।

সমাজতন্ত্র ছাড়া বাংলার মানুষ বাঁচতে পারে না। সেজন্য সমাজতন্ত্র কায়েম করার পদক্ষেপ নিয়েছি। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন, বড় বড় ব্যাংক ছিল। ভূড়ীওয়ালাদের ব্যাংক। আল্লাহ মর্জি ঐ ব্যাংক আমি কেড়ে নিয়েছি। ঐ ব্যাংক এখন আর ভূঁড়ীওয়ালাদের ব্যাংক নয়। ঐ ব্যাংক এখন সাড়ে সাত কোটি মানুষের। বীমা কোম্পানি আর ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষের। সেই আইন আমি পেশ করে দিয়েছি।

বড় বড় কাপড়ের কল। বড় বড় চট কল। বড় চিনির কল। আমি জাতীয়করণ করে সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্পত্তি করে দিয়েছি। আপনাদের এর সূফল ভোগ করতে একটু সময় লাগবে। কিন্তু এ সম্পত্তি আর ২/৫ জনের নয়। এই সম্পত্তি আমার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পত্তি। কোন লোক একশ বিঘার ওপর জমি রাখতে পারবে না। এতে যে জমি উদ্বৃত্ত হবে তা ভূমিহীন গরীবদের মধ্যে বিলি করে দেওয়া হবে। খাসমহলের জমি গরীবকে ছাড়া কাকেও দেওয়া যাবে না।

আর সাম্প্রদায়িকতা যেন মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে। ধর্ম নিরপেক্ষ রাষ্ট্র বাংলাদেশ। মুসলমান তার ধর্মকর্ম করবে। হিন্দু তার ধর্মকর্ম করবে। বৌদ্ধ তার ধর্মকর্ম করবে। কেউ কাউকে বাঁধা দিতে পারবে না। কিন্তু ইসলামের নামে আর বাংলাদেশের মানুষকে লুট করে খেতে দেওয়া হবে না। পশ্চিমারা ২৩ বছর ইসলামিক টেবলেট দেখিয়ে আমাদেরকে লুটেছে। আপনারা জানেন? খবর রাখেন? এই বাংলা থেকে ২৩ বছরে তিন হাজার কোটি টাকা পশ্চিমারা আমার কৃষকের কাছ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে গেছে।

 

বেঈমানের কাছে মাথা নত করবো না

আজ ৪ লাখ লোক পশ্চিম পাকিস্তানে আটক রয়েছে। আমি বললাম, ওদের ছেড়ে দাও। ভূট্টো সাহেব ছাড়ছেন না। ভূট্টো সাহেব! ছাড়তে হবে। ওদের আমি ইন্শাল্লাহ আনবো বাংলার মাটিতে। ওরা ফিরে আসবে এই মাটিতে। আপনি ত মুজিবুর রহমানকে ছাড়তেন না। আপনি মনে করেছেন আপনার সৈন্যরা আমার মা-বোনের উপর অত্যাচার করেছে, আমার গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, আমার ছেলেদের হত্যা করেছে, পশুর মত গ্রাম-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে আমি তাদের মাফ করে দেবো? আমি যদি বেঁচে থাকি, ভুট্টো সাহেব, এই বাংলার মাটিতে তাদের বিচার হবে। কেউ রুখতে পারবে না।

আমি কারো কথা শুনবো না। তুমি যতই দুনিয়া ভরে চিৎকার করে বেড়াওনা কেন, যারা আমার মা-বোনের উপর পাশবিক অত্যাচার করেছে, যারা আমার দুধের বাচ্চাকে গুলি করে হত্যা করেছে, যারা আমার গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, যারা আমার সেপাই পুলিশকে হত্যা করেছে-এই বাংলার মাটিতে ওদের বিচার হবে যদি শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকে। মনে করেছো তোমার কথায় ভয় পাই। আমার সাথে খেলবার চেষ্টা করো না। দরকার যদি হয়, আমি আমার বাংলার মানুষকে ডাক দিয়ে অস্ত্র দিয়ে মোকাবেলা করবো। কিন্তু বেঈমানের কাছে মাথা নত করবো না।

ভাইয়েরা আমার, আমি কিছুই দিতে পারবো না। ধোকা আমি দিই না। ধোকা আমি দিবো না। মিথ্যা ওয়াদা আমি করি না। আমার হাতে কিছুই নেই। ভাইরা, আমি পেয়েছি, আমার যা পাবার। আমা হাতে কিছুই নেই। ভাইরা, আমি পেয়েছি, আমার যা পাবার। আমার চেয়ে বেশি কোন দেশে কোন নেতা কোনদিন পাননি। সেটা হলো আপনাদের ভালবাসা। যে ভালবাসা আপনারা আমাকে দিয়েছেন। আপনারা আমাকে দোয়া করুন, আমি যেন সেই ভালবাসা নিয়ে মরতে পারি। আমার পাবার মত আর কিছুই নেই। প্রধানমন্ত্রীত্ত্ব আমার কাছে কিছুই না। ওটা নিতে আমি বাধ্য হয়েছি।

আমি প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য স্বাধীনতা আন্দোলন করিনি। আমি প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলতে চাইনি। আমি আমার বাংলায় মানুষকে ভালবাসতাম। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালবাসি। আমি বাংলার আকাশকে ভালবাসি। আমি বাংলার বাতাসকে ভালবাসি। আমি বাংলার নদ-নদীকে ভালবাসি। আমি বাংলার প্রত্যেক মানুষকে মনে করি আমার ভাই, মাকে মনে করি আমার মা, ছেলেকে মনে করি আমার ছেলে। কিন্তু আমার হাতে ত কিছু নেই। আমার হাতে ত আলাদীনের প্রদীপ নেই। আমি আপনাদেরকে কোথা থেকে এনে দিবো। আমাকে চেষ্টা করতে হবে। ধ্বংসপ্রায় একটা দেশের মধ্যে এই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে।

একে গড়তে হবে। চাই ত্যাগ ও সাধনা। ত্যাগ এবং সাধনা ছাড়া এদেশকে গড়া যাবে না। সবুর করতে হবে। সহ্য করতে হবে। কাজ করতে হবে। যুবক ভাইয়েরা, তোমরা আমার গরীব ভাইদেরকে লুট করে খাবার চেষ্টা করো না। তোমরা চেষ্টা করো, যাতে ওর সুখ হয়। কিছু কিছু যুবক অস্ত্র নিয়ে রাতের অন্ধকারে ডাকাতি করে। মনে করোনা যে আমরা খবর রাখি না। খবর আমাদের কাছে আসবে ঠিকই। সময় মত আসবে। তোমাদেরকে আমরা ধরে ফেলবো। এমন ধরা ধরবো যেদিন দুনিয়ার আর মুখ দেখাতে পারবে না।

তোমরা অনেকে ভদ্র লোকের ছেলে বলে দাবী করো। অনেকে শিক্ষিত বলে দাবী করো। কিন্তু আমি জানি ২/১ টা পিস্তল আছে। বের করে ফেলবো। আপনারা খবর দিবেন থানায় থানায়। খবর দিবেন? (জনতার হাঁ সূচক জবাব) আমিও পুলিশদের বলে দিচ্ছি এই গুন্ডা পান্ডা যদি বন্দুক নিয়ে কোন লোককে আক্রমণ করে, এক মিনিট দেরী করো না। জনগণের সহযোগিতায় এদের ধরবে। আমার হুকুম, গুলি করে এদের নিশ্চিহ্ন করবে। আমি দেশে শান্তি শৃঙ্খলা চাই। আমি চাই, মানুষ আরামে ঘুমাক।

পেটে ভাত না থাকলেও আরামে ঘুমাতে হবে। ওরা বন্দুক নিয়ে গ্রামে যায়। একটা গরীবের ঘরে গিয়ে লুটপাট করে নিয়ে আসে। এটা ফ্যাশন হয়ে গেছে? না। ফ্যাশন! মনে করেছ বুঝি আমি খুব দয়ালূ? বেশিদিন দয়ালু থাকবো না ভাই। একবার যদি নেমে পড়ি পিছনে আর ফিরি না। তাই  তোমাদের কাছে আবেদন করি, বন্দুকখানা আর ব্যবহার করো না। পানিতে ফেলে দিওনা, আমার কাছে ফেলে দাও। তা না হলে বিপদ আছে। আমার রাজশাহীর ভাইয়েরা, আপনারা অনেক কষ্ট করে এসেছেন।

আমার ভাই কামরুজ্জামানের বক্তৃতা করার কথা ছিল। তিনি বক্তৃতা করতে পারলেন না। আপনারা অনেক জায়গা থেকে কষ্ট করে এসেছেন। আর আমি বড় ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। আগের মত আর বক্তৃতা করতে পারি না। আর যখন আপনাদের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে এক কোটি মানুষের কথা যাদেরকে তাড়িয়ে দিয়েছিল ইয়াহিয়া খাঁ, তখন আমার বুক ভেঙ্গে যায়। গত চার মাসে এরা ফিরে এসেছে ভারতবর্ষ থেকে। এই এক কোটি মানুষের ঘরবাড়ি নেই। আর ২ কোটি মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে পশুরা।

বলুন তো, আমি কি করে এদের ঘরবাড়ি দেবো? কোথায় পয়সা পাবো? যার ঘর নেই, তার ঘর আপনারা চেষ্টা করে তৈরী করে দেবেন। যার খাবার নেই, নিজে একবেলা খেয়ে তাকে খাবার দেবেন। এটাই হলো মনুষ্যত্ব, এটা হলো মানবতা। এটা হলো ভ্রাতৃত্ব। আমি আশা করি, তাই আপনারা করবেন।

আপনারা গরমের মধ্যে অনেক কষ্ট পাচ্ছেন। আমি আপনাদের কাছ থেকে বিদায় দিচ্ছি। ইন্শাল্লাহ আবার দেখা হবে। আপনারা কাজ করুন। আপনারা প্রতিজ্ঞা করুন, আমরা সোনার বাংলা গড়ে তুলবো। আপনারা শান্তি রক্ষা করুন। এই কামনা করি। আমার কর্তব্য আমি করবো। আপনাদের কর্তব্য আপনারা পালন করুন, জয় বাংলা।

আরও দেখুন: