বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র [ Declaration of Awami League Party ]

আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র রচনায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব অংশ গ্রহণ করেন। ঘোষণাপত্রটিকে এখানে সংযোজিত করলাম:

সত্তরের দশকে পৌঁছেই পাকিস্তানের জনগণ যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছে, অন্যকোন দেশের মানুষকে তারচেয়ে বড় কোন চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করতে হয়নি। স্বাধীনতা অর্জন এবং পাকিস্তানসৃষ্টির ফলে দেশবাসীর যে হৃদয় মন আশা-আকাঙ্খার উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল সে মন নৈরাশ্য এবং বঞ্চনাবোধের কাছে আজ পরাজিত। স্বাধীনতার অঙ্গীকার ছিল নতুন সমাজ প্রতিষ্ঠা এবং সুষ্ঠু সজীব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার-যেখানে মানুষ স্বাধীনতার স্বাদ অনুভব করবে, ন্যায় বিচার এবং সাম্য বিরাজ করবে। এই অঙ্গীকার আজও অপূর্ণ রয়ে গেছে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র [ Declaration of Awami League Party ] - বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ - দুর্যোগে দুর্বিপাকে, সর্বদা মানুষের পাশে 3
বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ – দুর্যোগে দুর্বিপাকে, সর্বদা মানুষের পাশে
গণতন্ত্রকেই শিকড় মেলতে দেয়া হয়নি এবং একটার পর একটা ‘কোটারি’ এসে অন্যায়ভাবে জনগণের ক্ষমতা দখল করেছে। এইসব ‘কোটারি’ তাদের সঙ্কীর্ণ স্বার্থ উদ্ধারের নগ্ন প্রয়াসে লিপ্ত থেকে রাজনৈতিক ক্ষমতা এবং সম্পদ নিজেদের হাতে সংহত ও পুঞ্জীভূত করেছে এবং পাকিস্তানের কোটি কোটি মানুষকে শোষণের শিকারে পরিণত করেছে। এইভাবে স্বাধীনতা জনগণের জন্য মুক্তি আনার বদলে আরো বেশী রকম দাসত্ব নিয়ে এসেছে।

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘোষণাপত্র [ Declaration of Awami League Party ]

আমাদের সমাজ যে বাস্তব অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছে তাই গুরুতর। দ্রুত বর্ধমান জনসংখ্যার তুলনায় আমাদের সম্পদ যথেষ্ট নয়। দেশের দুইটি অংশ সহস্রাধিক মাইলের ব্যবধানে বিচ্ছিন্ন। তাই এখানে একটা সুষ্ঠু সমাজ গঠনের কাজ স্বাভাবিক ভাবেই কঠিন। সুদীর্ঘ বাইশ বছরে প্রায় কখনোই এই দায়িত্বকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। পক্ষান্তরে আমরা মুষ্টিমেয় ভাগ্যবানকে ক্ষমতা এবং সম্পদ অর্জনের হীন ও নগ্ন প্রয়াসে লিপ্ত থাকতে দেখেছি। কাজটি তাই আজ জটিল হয়ে দাঁড়িয়েছে।

শহর এবং গ্রামাঞ্চলের মেহনতি জনতা আজ জেগে উঠেছে এবং তারা আর তাদের অধিকারের বঞ্চনা সহ্য করতে রাজী নয়। বারো কোটি মানুষের একটা জাতি সুবিধাভোগি একটা কোটারির হাতে কিছুতেই নিজেকে সমর্পন করে দিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে পারেনা। এই কোটারির হাত থেকে নিজেদের ন্যায় সঙ্গত ক্ষমতা ছিনিয়ে আনতে তারা বন্ধপরিকর। মানুষে মানুষে এবং অঞ্চল অঞ্চলের মধ্যে অনুষ্ঠিত এই অবিচারকে চিরস্থায়ী করার বিরুদ্ধে পাকিস্তানের জনসাধারণ বিদ্রোহ আরম্ভ করেছে।

Logo of Bangladesh Awami League, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর লোগো ব্যাজ [ Transparent, PNG ]
Logo of Bangladesh Awami League, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর লোগো ব্যাজ [ Transparent, PNG ]
মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগীর হাতে সম্পদ পুঞ্জীভূত করার এবং অবশিষ্ট জনগণের প্রতি সম্পর্ণ উপেক্ষা প্রদর্শনের ফলে আজ অর্থনৈতিক কাঠামোর আশু এবং আমূল পরিবর্তন অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। পাকিস্তানের দুই অংশের উৎকট বৈষম্য ক্রমাগত আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানের সামগ্রিক অর্থনীতি আজ ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।

এই ধ্বংসের হাত থেকে আঞ্চলিক অর্থনীতি বাঁচানোর জন্য আঞ্চলিক সরকারকে জরুরী ভিত্তিতে কাজ করার এবং অর্থনীতি পরিচালনার ক্ষমতা দিয়ে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্বশাসন দিতে হবে। শাসনতান্ত্রিক কাঠামোর আমূল পরিবর্তন ছাড়া এটা সম্ভব নয় বলেই আজ শাসনতন্ত্রের এই পরিবর্তনের দাবী অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে।

জনগণই আমাদের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ। সমাজকে ন্যায় বিচারের ভিত্তিতে পুর্নগনের সাধারণ প্রচেষ্টায় জনগণকে সক্রিয় এবং সমবেতভাবে আত্মনিয়োগের সুযোগ দেওয়ার জন্য সমাজ ব্যবস্থা বিধি ও কাঠামোর আমুল পরিবর্তন দরকার। আর এটা করতে হলে আমাদের প্রয়োজন গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একটি সামাজিক বিপ্লব সাধন করা এবং এই জন্যই আমাদের একটি নতুন শাসনতান্ত্রিক রাজনৈতিক এবং সামাজিক কাঠামোর প্রয়োজন। এই বিরাট চ্যালেঞ্জের সামনে আজ আমরা এসে দাড়িয়েছি। এই চ্যালেঞ্জ আমাদের গ্রহণ করতেই হবে। কারণ এর উপর আমাদের অস্তিত্ব নির্ভর করছে।

ঔপনিবেশিক শাসনকালের উত্তরাধিকারী হিসাবে আমরা যে প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো লাভ করেছি তাকে ভেঙ্গে ফেলতেই হবে। আজকে দেশের জনগণ ও সমাজের জরুরী প্রয়োজন মিটানোর উপযোগী করে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর ডিজাইন (নকশা) করতে হবে।

Logo of Bangladesh Awami League, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর লোগো ব্যাজ, JPG
Logo of Bangladesh Awami League, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এর লোগো ব্যাজ, JPG

এরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠাই গণতান্ত্রিক সংগ্রামের মাধ্যমে জনগণের অধিকার আদায়ের দৃঢ় সংকল্পের প্রথম বহি:প্রকাশ। আজ পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। শাসকচক্রের বারংবার আক্রমনের মুখে অগণিত পরিবার ও জীবন ধ্বংস হয়ে গেছে।

প্রকৃতপক্ষে মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজেও জনস্বার্থের জন্যই শহীদ হয়েছেন। স্বাধীনতার শিখা অনির্বাণ রাখার জন্য হাজার হাজার মানুষ জীবন দিয়েছে। এই সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য অসংখ্য মানুষকে দীর্ঘকাল কারারুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার স্বাদ থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়েছে এবং অনেকেই পরিবার, সম্পত্তি এবং জীবিকা নির্বাহের উপায় হারাতে হয়েছে।

জনগণের নিরবিচ্ছিন্ন, সুকঠিন ও সুপ্রতিজ্ঞ এই সংগ্রামের ঐতিহ্যময় পটভূমিতে আওয়ামী লীগ আমাদের সম্মুখে সমুপস্থিত চ্যালেঞ্জকে গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই চ্যালেঞ্জকে গ্রহণ করার জন্য যে সাহস এবং সংকল্পের প্রয়োজন জাতির উপর আমাদের বিশ্বাস, জনগণের উপর আস্থা এবং সর্বোপরি সর্বশক্তিমানের উপর আমাদের ঈমানের মাধ্যমেই আমরা তা লাভ করেছি।

তাই গণতান্ত্রিক উপায়ে বিল্পব সাধনের জন্য এবং তা দিয়ে বর্তমান অন্যায় অবিচারের উপরে প্রতিষ্ঠিত কাঠামোর স্থলে অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে সুবিচার রক্ষাকারী একটি নতুন শাসনতান্ত্রিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগের এই ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রতিটি অঞ্চল ও প্রতিটি নাগরিকের ক্ষেত্রে সুবিচারের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য এই ঘোষণাপত্রে একটি ব্যাপক রূপরেখা পেশ করা হয়েছে।

– সংগ্রহ-মুজিবুরের রচনা সংগ্রহ পৃষ্ঠা-১৫৭

আও পড়ুন:

Leave a Comment