উদ্যোক্তা বনাম কর্মী পরিচালিত ব্যবসা ১ম পর্ব

এযুগে দশানন হওয়া সম্ভব না। উদ্যোক্তা নাছোড় বান্দা হলে আর কিছুদূর আগায় বটে। তাতে নিজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনে প্রভাব পড়ে। তার আত্মিক উন্নয়ন ও অন্যান্য উদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক পর্যায়ে উদ্যোক্তাকে হার মানতেই হয়। অথবা বলি দিতে হয় ব্যবসার প্রবৃদ্ধিকে।

প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে ব্যবস্থাপনা কৌশলে পরিবর্তন আনতে হয়। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার আকার ও ক্ষমতা বাড়াতে হয়। একজন ব্যবস্থাপক এর বদলে একটি ব্যবস্থাপনা টিম তৈরি করতে হয়। তাদের মাধ্যমে দায়িত্ব এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হয়। এসবের মুল উদ্দেশ্য – বিভিন্ন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ানো, সেই সিদ্ধান্ত সঠিক হবার সম্ভাবনা বাড়ানো। বরে-শাঁপ যেন না হয় – সে কারণে প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহিতার আওতা বাড়ানো। এই মডেলটিকে কর্মী পরিচালিত ব্যবসা বা Management Run Business বলে।

Owner run Business VS Management Run Business1

উদ্যোক্তা পরিচালিত ব্যবসা বনাম কর্মী পরিচালিত ব্যবসা (১ম পর্ব):
বাংলাদেশের উদ্যোক্তাদের প্রথম প্রজন্ম এখনও নেতৃত্বে। তারা জীবনের সকল – সময়, শ্রম, ভালোবাসা ঢেলে ব্যবসা তৈরি করেছেন। আজ পর্যন্ত পারলে সবচেয়ে ছোট কেনাকাটাটা নিজের হাতে করেন। প্রতিটি সিদ্ধান্ত নিজে বসে নেন। সব কিছুর নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পছন্দ করেন। তার উদ্যোক্তা পথ পরিক্রমায় শেখা কিছু অভিজ্ঞতাকে সব কিছুর উপরে স্থান দেন। সেই ধারনার বাইরে কিছু করে আরাম বোধ করেন না। তাই ব্যবসার বাইরে তাদের অন্য কোন জীবন নেই। জীবনের অন্য বোধগুলোর জন্য খুব বেশি সময় দেয়া সম্ভব নয়।

ইতোমধ্যে ২য় প্রজন্ম বিশ্ববিদ্যালয় পড়ে এসে সরাসরি নেতৃত্বের চেয়ারে বসতে শুরু করেছে। তারা ব্যবসায়ের খুঁটিনাটিতে মনোযোগ দেয়াকে সময় নষ্ট মনে করে। তারা শুধুমাত্র নীতি নির্ধারণই সিদ্ধান্ত নিতে চান। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া জ্ঞানকে কাজে লাগাতে চান। কিছু কাজ নিজে করার চেয়ে আউট-সোর্স করতে পছন্দ করেন। কোম্পানিকে পেশাদারি কর্পোরেশন মডেলে চালাতে চান। তারা খরচ কমিয়ে লাভ বাড়ানোর চেয়ে, আয় বাড়িয়ে লাভ বাড়াতে পছন্দ করে।

একটা মজার বিতর্ক প্রতিটি উদ্যোক্তা পরিবারে মাঝে মধ্যেই দেখা যায়। প্রবীণরা বলেন – ব্যবসায়ীর আবার ব্যবসা বাদে অন্য জীবন কি? নতুন প্রজন্ম বলে – টাকা আয় করার জন্য জীবনের সবটুকু দিয়ে দেয়ার অর্থ নেই। গতকাল সন্ধ্যার আড্ডায় এরকম একটা বিষয় নিয়ে কথা হচ্ছি। সকালে উঠে অলস মাথায় ভাবলাম এ নিয়ে দুকথা লিখি।

উদ্যোক্তার কাছে তার উদ্যোগ নিজের সন্তানের মত। সেটাকে তেল কাজল দিয়ে নাইয়ে-ধুইয়ে বড় করতে অনেক সময় – শ্রম দিতে হয়। সকল সিদ্ধান্ত একা নিতে হয়। কাজগুলোও একই সামলাতে হয়। উদ্যোগ বিফল হলে তো গেলই। সফল হয়ে হাত পা বড় হয় আর কাজ বাড়ে। সফলতার প্রধান শর্ত হিসেবে আসে নিয়মিত প্রবৃদ্ধি। ক্রমশ আরও বড় হতে থাকা। ব্যবসার আকারে, আয়ে, মুনাফায়, সুনামে, নিয়ন্ত্রণে, দক্ষতায়, আরও অনেক কিছুতে। তখন চারদিকে বাড়বাড়ন্তও কারবার প্রতিষ্ঠাতার একার পক্ষে সামাল দেয়া অসম্ভব হয়ে দাড়ায়। প্রবৃদ্ধির জিনিষটা নিষ্ঠুরভাবে আরও সময় চায়, নেতৃত্বে চায়। সেটা চাহিদামত না দিতে পারলেই বিপদ।

এযুগে দশানন হওয়া সম্ভব না। উদ্যোক্তা নাছোড় বান্দা হলে আর কিছুদূর আগায় বটে। তাতে নিজের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনে প্রভাব পড়ে। তার আত্মিক উন্নয়ন ও অন্যান্য উদ্যোগ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এক পর্যায়ে উদ্যোক্তাকে হার মানতেই হয়। অথবা বলি দিতে হয় ব্যবসার প্রবৃদ্ধিকে।

প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে ব্যবস্থাপনা কৌশলে পরিবর্তন আনতে হয়। প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনার আকার ও ক্ষমতা বাড়াতে হয়। একজন ব্যবস্থাপক এর বদলে একটি ব্যবস্থাপনা টিম তৈরি করতে হয়। তাদের মাধ্যমে দায়িত্ব এবং ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ করতে হয়। এসবের মুল উদ্দেশ্য – বিভিন্ন পর্যায়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা বাড়ানো, সেই সিদ্ধান্ত সঠিক হবার সম্ভাবনা বাড়ানো। বরে-শাঁপ যেন না হয় – সে কারণে প্রতিটি পর্যায়ে জবাবদিহিতার আওতা বাড়ানো। এই মডেলটিকে কর্মী পরিচালিত ব্যবসা বা Management Run Business বলে।

Management Run Business ও Owner run business বিজনেসের সুবিধা অসুবিধা নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। উদ্যোক্তা পরিচালিত ব্যবসায় ব্যবস্থাপনা ব্যয় কম। বিভিন্ন খাতে অপচয় কম। কিছু ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তও দ্রুত। ব্যবস্থাপনা পরিষদের ক্ষেত্রে এগুলোর পরিমাণ কিছুটা বেশি। সেই তুলনায় প্রবৃদ্ধিও কয়েকগুণ বেশি। দিনশেষে শ্রম ও মুনাফা হিসেবে করলে ম্যানেজমেন্ট রান ব্যবসার পক্ষে যুক্তি বেশি আসে।

ম্যানেজমেন্ট রান ব্যবসা বলেই বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এত বড় হতে পেরেছে। ফরচুন ৫০০ লিস্টে থাকা কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতাও ৩ মাস ছুটি কাটাতে পারেন অথবা কোম্পানিকে বছরে ১২ দিন সময় দিয়েও প্রবৃদ্ধি ঠিক থাকে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে চিত্রটা একটু ভিন্ন। প্রথম প্রজন্মের উদ্যোক্তাদের বিভিন্ন ধরনের চরাই উৎরাইয়ের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। কখনো ইচ্ছে না থাকলেও সাদা কালোর আশ্রয় নিতে হয়েছে। ব্যবসার কৌশল ছাড়াও কিছু গোপনীয় বিষয় থেকে গেছে। তাই সেটা অন্য কারও হাতে দিয়ে নিশ্চিত হতে পারেন না। আবার ভাল ব্যবসা ব্যবস্থাপনার পেশাজীবীরা প্রয়োজন অনুযায়ী তৈরি হয়নি। উদ্যোক্তা ও ব্যবস্থাপকদের মধ্যে প্রক্রিয়া (প্রসেস) সম্পর্কে শোধবোধও খুব একটা তৈরি হয়নি। ব্যাংকিং সহ দু একটি ইন্ডাস্ট্রির ম্যাচিউরিটি ধরার মত যায়গায় এসেছে মাত্র। অন্যান্য চেইন ইন্ডাস্ট্রিগুলো এখনো শিশুর পর্যায়ে। তাই এসব ব্যবসাকে ম্যানেজমেন্ট চালিত ব্যবসায় পরিণত করা কঠিন। আবার নিয়মিত প্রবৃদ্ধি উদ্যোক্তার জীবন কঠিন করে তুলছে।

বাংলাদেশি গ্রুপের মধ্যে রহিমাফরোজ, ইস্পাহানীর মত প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানেজমেন্ট চালিত ইউনিটগুলো মোটামুটি সফল হয়েছে। এগুলো দেখে অনেকেই উৎসাহ বোধ করছেন। আর ২য় প্রজন্মের চাপ তো আছেই।

এই সংস্কৃতি তৈরি করতে এবং সফলতার গল্প উপহার দিতে আমাদের কাজ করা দরকার। একদিকে উদ্যোক্তাদের মানসিক ভাবে তৈরি করা দরকার। পাশাপাশি ব্যবস্থাপনার ভাল জনশক্তি তৈরি করতে কাজ করতে হবে।

(ব্যবস্থাপনা টিমের কাছে হস্তান্তর কৌশল সম্পর্কে আলোচনা করতে থাকবে ২য় পর্ব)

 

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment