গ্রীষ্ম ঋতুসংগীত

গ্রীষ্ম ঋতুসংগীত নিয়ে আজকের আলোচনা। গ্রীষ্ম হলো বছরের উষ্ণতম কাল, যা পৃথিবীর উত্তর গোলার্ধে সাধারণত জুন, জুলাই এবং আগস্ট জুড়ে অবস্থান করে। পৃথিবীর সর্বত্রই গ্রীষ্ম হলো কর্মোদ্যমের সময়। বিশেষ করে শীতপ্রধান দেশগুলোতে গ্রীষ্ম খুবই আরাধ্য, কারণ সেসকল দেশে শীতকালে কোনো ফসল উৎপাদিত হয় না, গ্রীষ্মকালেই সব ফসল উৎপাদন করে রাখতে হয়।

 

গ্রীষ্ম ঋতুসংগীত

 

বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী প্রথম দুই মাস বৈশাখ ও জ্যৈষ্ঠ জুড়ে গ্রীষ্মকাল। এই সময় সূর্যের প্রচন্ড তাপে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে ভূমি, পানি শুকিয়ে যায়, অনেক নদীই নাব্যতা হারায়, জলশূণ্য মাটিতে ধরে ফাটল। ইংরেজি এপ্রিল মাস সবচেয়ে উষ্ণতম মাস। এ সময় তাপমাত্রা সর্বোচ্চ ৩৮ ° সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যেতে পারে। গ্রীষ্মকালের শেষার্ধ্বে সন্ধ্যাসমাগত সময়ে ধেয়ে আসে কালবৈশাখী ঝড়। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে এসময় গাছে গাছে বিভিন্ন মৌসুমী ফল দেখা যায়, যেমন: আম, কাঁঠাল, লিচু ইত্যাদি। বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী এর পরের ঋতুটিই হলো বর্ষাকাল। সেসময় প্রচন্ড বৃষ্টিপাত গ্রীষ্মকালীন সব তপ্ততা মিটিয়ে দেয়।

রবীন্দ্রসংগীতে ঋতুপ্রকৃতি ও গ্রীষ্ম

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋতু সৌন্দর্যের কবি। তাঁর ঋতু-সাহিত্যে যে বৈচিত্র্য দেখা যায়, তা শুধু আকাশে-বাতাসে, মেঘে-বর্ষণে, ফুলে-পল্লবেই প্রকাশ পায় এমন নয়, সে বৈচিত্র্য মানুষের শৈশব-কৈশোর, যৌবন-বার্ধক্যেও সমান। ঋতুর মধ্যে রবীন্দ্রনাথ একদিকে দেখেছেন তার কঠোর রূপ, অন্যদিকে দেখেছেন রস-কোমলতা, সৃষ্টির স্নিগ্ধতা। দারুণ গ্রীষ্মে একদিকে যেমন ‘প্রখর তপন তাপে, আকাশ তৃষায় কাঁপে, বায়ু করে হাহাকার’, তার পরেই সেখানে আসে চাঁপাফুলের ছোঁয়া, বকুলমালার গন্ধ।

বৈশাখের রুদ্রতা ও কোমলতা দিয়ে তিনি কামনা করেছেন সমস্ত গ্লানি দূর করে পবিত্র ও নির্মল এক পৃথিবীর।রবীন্দ্র-পূর্ব বাংলায় ষড়ঋতুর ব্যবহারিক দিকটাই তত্কালীন কবিদের কাব্যে প্রাধান্য পেয়েছিল, আলাদাভাবে ঋতুবৈচিত্র্য বর্ণনার প্রয়াস তেমন একটা দেখা যায়নি। রবীন্দ্রনাথ সেই বাঁধা পথে না গিয়ে ব্যক্তিগত অনুভূতির স্পর্শ নিয়ে এসেছেন। ফলে প্রকৃতিগাথা হয়ে উঠেছে জীবন্ত।

রবীন্দ্রনাথের গানে প্রতিটি ঋতু যেন তাদের নিজ নিজ চিত্র, ধ্বনি, বর্ণ ও গন্ধ নিয়ে উপস্থিত হয়েছে। এ গানগুলো যেন বাংলার প্রকৃতির চিরকালের মর্মবাণী। তাঁর অন্যান্য গানের মতো প্রকৃতির গানেও তিনি বিশ্ববোধ ছড়িয়ে দিয়েছেন। ‘কুসুমে কুসুমে’ তিনি তাঁর অন্তরাত্মার ‘চরণচিহ্ন’ দেখেছেন, তাঁর আগমনে পৃথিবীর বুকে ‘আকুলতা ও চঞ্চলতা’ অনুভব করেছেন।

‘আকাশভরা সূর্য তারা’ এবং ‘বিশ্বভরা প্রাণের’ মাঝখানে ‘বিস্ময়ে’ নিজেকে আবিষ্কার করেছেন।প্রতিটি ঋতু একেকটি দার্শনিক তাত্পর্য নিয়ে রবীন্দ্রসংগীতে উপস্থাপিত হয়েছে। গ্রীষ্মের গানে দারুণ দাহনবেলার রসহীনতার চিত্র যেমন আঁকা হয়েছে, বৈশাখী ঝড়কে তেমনি জীর্ণতার অবসানে নতুনের আগমনের পূর্ব সংকেতরূপে পাওয়া যায়। রবীন্দ্রভাবনায় বৈশাখী ঝড় কেবল বাইরের প্রকৃতিতেই আসে না, হৃদয়ের ভেতরেও সে ঝড় তোলে। গ্রীষ্মের মধ্যে তিনি একদিকে দেখেছেন এর কঠোর রূপ, বৈরাগীর বেশ, অন্যদিকে তার রস-কোমলতা ও সৃষ্টির স্নিগ্ধতায়ও মুগ্ধ হয়েছেন।

গীতবিতানে গ্রীষ্মের গান ১৬টি, যা রবীন্দ্রনাথ তাঁর ৬০ থেকে ৭২ বছর বয়সের মধ্যে রচনা করেছেন। গীতবিতানে দেওয়া ক্রমানুসারে—১. নাই রস নাই, দারুণ দাহনবেলা; ২. দারুণ অগ্নিবাণে রে; ৩. এসো এসো হে তৃষ্ণার জল; ৪. হৃদয় আমার, ওই বুঝি তোর বৈশাখী ঝড় আসে; ৫. এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ; ৬. নমো নমো হে বৈরাগী; ৭. মধ্যদিনে যবে গান বন্ধ করে পাখি; ৮. ওই বুঝি কালবৈশাখী; ৯. প্রখর তপন তাপে; ১০. বৈশাখের এই ভোরের হাওয়া; ১১. বৈশাখ হে মৌনী তাপস; ১২. শুষ্কতাপের দৈত্যপুরে দ্বার ভাঙবে ব’লে; ১৩. হে তাপস, তার শুষ্ক কঠোর রূপের গভীর রসে; ১৪. মধ্যদিনের বিজন বাতায়নে; ১৫. তপস্বিনী হে ধরণী; ১৬. চক্ষে আমার তৃষ্ণা।

তাঁর প্রথম গ্রীষ্মের গান ৬০ বছর বয়সে রচিত ‘দারুণ অগ্নিবাণে রে’ এবং শেষ গান ৭২ বছর বয়সে রচিত ‘চক্ষে আমার তৃষ্ণা’। এ ছাড়া অন্যান্য পর্যায়ের বেশ কিছু গানেও গ্রীষ্মের আবহ রয়েছে। রবীন্দ্রনাথ তাঁর সব সংগীত সৃষ্টিকে প্রেম, প্রকৃতি, পূজা প্রভৃতি পর্যায়ে ভাগ করলেও প্রায় সব গানকেই আত্মনিবেদনের গান বললে অত্যুক্তি হয় না। জীবনের যত দিক আছে, যত রকম অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা, রবীন্দ্রনাথের গানে তার প্রায় প্রতিটির প্রতিফলন রয়েছে। তাই আমাদের মন সব অবস্থায় আশ্রয় পায় তাঁর গানে। জীবনকে গানের মধ্য দিয়ে এমন করে উপলব্ধি করার অভিজ্ঞতা সম্ভবত আর কোনো রচয়িতার গানে অনুভব করা যায় না।

 

আরও দেখুন:

 

Leave a Comment