আমার গ্রামে ঢাকার দামে ব্যান্ডউইথ চাই -মুভমেন্টটির কিছু বিষয়ে আমার মতামত : আমি আমার গ্রামে ঢাকার দামে ব্যান্ডউইথ চাই -মুভমেন্টটির পাতায় কিছু পাবলিক কমেন্ট পড়ে, কিছু বিষয়ে আমার নিজের মতামত জানাতে ইচ্ছে হল।

প্রথম প্রশ্ন – ইন্টারনেট কি বিলাসদ্রব্য? গ্রামের গ্রাহকরা কয় টাকা দেবে, তাতে গ্রামে ইন্টারনেট পৌঁছে দেবার খরচ কি পোষাবে? এই দাবী কতটুকু যৌক্তিক?
আমার মতামত হল- না ইন্টারনেট আমাদের জন্য বিলাসদ্রব্য নয়। ইন্টারনেট পাকা রাস্তা বা সেতুর মতো একটি প্রয়োজন। সভ্যতার অগ্রগতি, জন-দুর্ভোগ কমানো বা দেশের আর্থিক উন্নয়নের জন্য, যেমন গ্রামের কাঁচা রাস্তা পাকা করার দরকার হচ্ছে, বিদ্যুৎ পৌঁছে দিতে হচ্ছে, ঠিক একই ভাবে এই প্রজন্মের শিক্ষা ও কাজের প্রয়োজনে, গ্রামে গ্রামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছে দেয়া দরকার। পাকা রাস্তা-সেতুর প্রয়োজন যদি ন্যায্য এবং যৌক্তিক হয়, সরা দেশে ন্যায্য দামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের দাবীও যৌক্তিক। এজন্যই ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গ্রামে নিয়ে যাবার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে, ব্যবসায়ী দৃষ্টিভঙ্গির বদলে, জাতিয় বিনিয়োগের দৃষ্টিভঙ্গি নিতে হবে। অবকাঠামো এবং শিক্ষা খাতের মতো, জাতির ভবিষ্যতের জন্য দীর্ঘ মেয়াদের বিনিয়োগ ভেবে করতে হবে। এর মুনাফা আসবে দীর্ঘ মেয়াদে এবং বহুমুখী। আর এই কারণেই – এই প্রয়োজনটির ক্ষেত্রে খরচে-আয়ে পোষানোর প্রশ্নটা অবান্তর মনে করি।
শিক্ষায় কি ভূমিকা রাখবে ইন্টারনেট? গ্রামের মানুষ এসব প্রযুক্তির ব্যাবহার জানে?
দেখুন- একটি ইউটিউব টিউটোরিয়াল দিয়ে, যত কম খরচে, যত বেশি মানুষকে, একটি বিষয় প্রশিক্ষণ দেয়া সম্ভব, অন্য যেকোনো মাধ্যমে তার চেয়ে বহুগুণ বেশি খরচ হয়। ইন্টারনেটের মতো স্বল্প খরচে অন-ডিমান্ড কন্টেন্ট আর কোন মাধ্যমেই দেয়া সম্ভব নয়। তাই আমাদের মতো ঘনবসতিপূর্ণ দেশের মানুষের শিক্ষার জন্য, ইন্টারনেট সবচেয়ে সস্তা মাধ্যম হতে পারে।

তাছাড়া- বাংলাদেশের মানুষ ইন্টারনেট ব্যাবহার শেখেনি বা অনলাইন টিউটোরিয়াল কেউ দেখবে না, এই কথাটিও সত্য নয়। আমাদের দেশের ছেলেদের করা বিভিন্ন অনলাইন টিউটোরিয়ালে লক্ষাধিক ভিউ, অনলাইন লার্নিং এর জনপ্রিয়তা এবং গুরুত্বের প্রমাণ দেয়। একজন ফ্রিল্যান্সারের সহায়তা নিয়ে, গ্রামের একজন নিরক্ষর সেলাই-কর্মী মহিলা, ফটোশপের ক্লিপিং-পাথের কাজ করে, বিদেশ থেকে অর্থ উপার্জনও এর পক্ষে উজ্জ্বলতম প্রমাণ।
এছাড়া সরকার দেশের তৃণমূল পর্যায়ে, তথ্য-প্রযুক্তি পেশাজীবী তৈরির জন্য, শত সহস্র কোটি টাকা খরচ করে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এখনও দিচ্ছে। ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট না পেলে, সেই হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ কিন্তু কোনই কাজে লাগবে না। বরং ইন্টারনেট দিলে, এই জনগোষ্ঠী কাজের মাধ্যমে, নিজেদের দক্ষতাকে আরও শানিত করে, একসময় দারুণ জনসম্পদে পরিণত হবে।
বর্তমান আর্থ সামাজিক পরিস্থিতি গ্রামে গ্রামে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট পৌঁছানো কি সম্ভব?
অবশ্যই সম্ভব। বাড়তি খুব বেশি খরচ ছাড়াই সম্ভব। কারণ সরকার উপজেলা পর্যন্ত ফাইবার বসাতে বিনিয়োগ করেছে। ইউনিয়ন পর্যায়ে ফাইবার পৌঁছানোর কাজ হাতে নিয়েছে। রেল, বিদ্যুৎ, বিটিসিএল ছাড়া সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ফাইবার নেটওয়ার্ক রয়েছে। তাই ইন্টারনেট পৌঁছানোর মুল কাজের অনেকখানি শেষ। এখন দরকার এই ব্যাক-বোনগুলো ব্যাবহারের জন্য কমার্শিয়াল সেবা-দাতাদের সাথে একটি সুষ্ঠু সমন্বয়। সারা দেশে একই মূল্যে ব্রডব্যান্ড সেবা দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে – NTTN Policy সহ সম্পৃক্ত সব আইন, নীতিমালা, প্রবিধানমালা সংশোধন করা দরকার। প্রয়োজনে বিটিআরসির সোশাল অবলিগেশন ফান্ড থেকে অপারেটরদের মফস্বলে ইন্টারনেট দেবার ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে।

সারা দেশে মোবাইল কোম্পানির ইন্টারনেটের তো একই দাম, আপনার সমস্যা কি?
এই মুভমেন্টট যারা করছে, তারা চাইছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। চাইছে শিক্ষা আর কাজের জন্য। তাই ওরা মোবাইল বা মিটারড্ ইন্টারনেট নিয়ে কথা বলছে না। তাই এই প্রশ্ন প্রাসঙ্গীক নয়। ওরা বলছে – ঢাকাতে টার্মিনেট হওয়া জাতিয় ফাইবারের ইন্টারনেট, মফস্বলে নিয়ে যাবার জন্য আমাদের বাড়তি ৭০০০-১৪০০০ টাকা পর্যন্ত দিতে হচ্ছে NTTN Operator দের। ঢাকায় যে ইন্টারনেট ১৪০০ টাকায় কেউ পাচ্ছে, সেটা আমাকে কুষ্টিয়ার কুমারখালির মতো কোন মফস্বল শহরে নিতে খরচ হচ্ছে ৮৪০০ টাকা +ভ্যাট। এই বৈষম্যটি অন্যায্য।

আপনি কি বাণিজ্যিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেরে ফেলতে চান?
আমি কোন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা করার বিপক্ষে না। বরং গ্রাহক পর্যায়ে সেবা দেবার কাজে, নীতিগত ভাবে আমি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের পক্ষের মানুষ। কিন্তু আমাদের খেয়াল রাখতে হবে- বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফার প্রয়োজন, যেন জাতিয় অর্জনকে ব্যর্থ করে না দেয়। বরং এমন একটি আইনি পরিবেশ দরকার, যেখানে জাতিয় লক্ষে পৌঁছাবার জন্য, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরকারকে সহায়তা করতে পারে, সাথে তাদের নিজের জন্য মুনাফাও করতে পারে। আমি চাই NTTN, IIG, ISP এবং অন্য অপারেটররা সবাই ব্যবসা করুক। একটা কম্পিটিটিভ এনভায়রনমেন্টে তারা ন্যায্য মুনাফায় ব্যবসা করুক। মনোপোলি নয়।
সারা দেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট গেলে তরুণ প্রজন্ম নষ্ট হয়ে যাবে !!!
এই যুক্তিটি খালেদা জিয়া সরকারের সেসব মৌলবাদী আমলা-উপদেষ্টাদের যুক্তির মতো। তাদের “বিদেশে তথ্য পাচার হয়ে যাবার” মত হাস্যকর থিওরির কারণে, বাংলাদেশ সেসময় বিশ্ব ইন্টারনেট মহাসড়কে যুক্ত হবার, ফ্রি অফার থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হয়েছিল, যা পরে আমাদের বহু পয়সা দিয়ে নিতে হয়েছে।
তাছাড়া তথ্য-প্রযুক্তির অবাধ প্রবাহের কারণেই, আজ তরুণ প্রজন্ম আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের ইতিহাস ও রাজনীতি সম্পর্কে অনেক গোপন করা তথ্য জানতে পারছে। সেসব তথ্য-উপাত্ত-ছবি-ভিডিও নিয়ে বিতর্ক করতে পারছে। বিভিন্ন দলমতের সত্য-মিথ্যা প্রচার শুনে, সেগুলো নিয়ে তর্ক বিতর্ক করে, নিজের একটি স্বচ্ছ মতামত তৈরি করতে পারছে। তারা বুঝতে পারছে কারা বাংলাদেশের পক্ষে আর কারা বিপক্ষে। যেটা বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশি দরকার। এদের পরিমাণটা বাড়লে জাতির দীর্ঘ মেয়াদে বহুমুখী লাভ।

গ্রামে গ্রামে ইন্টারনেট পৌঁছে দিলে, সেটার সবচেয়ে বড় লাভ হবে সেসব দলের, যারা বাংলাদেশের সত্য ইতিহাসের উপরে দাড়িয়ে উন্নয়নের রাজনীতি করতে চান। ভেঙ্গে যাবে তাদের ঘর, যারা মিথ্যা প্রচারের মাধ্যমে জনগণকে বিভ্রান্ত করার রাজনীতি করতে চান।
শেষ করি –
সরকারকে অনুরোধ করবো। এরা পেট্রোল বোমা মারছে না, গাড়ি পোড়াচ্ছে না। এরা একটি দারুণ সৃষ্টিশীল কায়দায় একটি ন্যায্য দাবী জানাচ্ছে। এই দাবীটি বাস্তবায়ন করলে দীর্ঘ মেয়াদে আপনারাই লাভবান হবেন।
প্রতিটি দেশপ্রেমিক বাংলাদেশিকে অনুরোধ করবো। আপনারা এই দাবী আদায়ে যুক্ত হন। গ্রামের মানুষগুলো এগিয়ে এলে আমাদের সবারই দীঘ মেয়াদে লাভ হবে।
[ আমার গ্রামে ঢাকার দামে ব্যান্ডউইথ চাই -মুভমেন্টটির কিছু বিষয়ে আমার মতামত ]
আরও পড়ুন: