ঘরানা সংস্কৃতি ও গুরু শিষ্য পরম্পরা

ঘরানা সংস্কৃতি এসেছে ভারতবর্ষের হাজার বছরের গুরু শিষ্য-পরম্পরা থেকে। একজন ভাল ঘরানার গুরুর নিজস্ব তত্বাবধানে অল্প বয়স থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার মাধ্যমে একজন ঘরানা-ওয়ালা ভাল শিল্পী হওয়া সম্ভব। সাধারণ গান বাজনা যেকোনো ভাবেই শেখা যায়। তবে কেউ যদি হাই প্রোফাইল শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্প হতে চায়, তবে গুরু-শিষ্য পরম্পরা ছাড়া হওয়া প্রায় অসম্ভব। এই পদ্ধতিটি আজ পর্যন্ত পরিক্ষিত সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 3 ঘরানা সংস্কৃতি ও গুরু শিষ্য পরম্পরা

ঘরানা সংস্কৃতি ও গুরু শিষ্য পরম্পরা

 

গুরু-শিষ্য পরম্পরায় গুরুই সকল জ্ঞানের উৎস। গুরুর ঘর, গুরুগৃহ বা ওস্তাদখানা হচ্ছে স্কুল। সেখানে গুরুর কাছে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে সমর্পণ করতে হয়। ভক্তি এবং নিষ্ঠা নিয়ে, কঠোর নিয়মানুবর্তিতার মধ্যে, গুরুর নিবিড় তত্বাবধানে, শিক্ষা নিতে হয়। সনাতনী শ্লোকে মেনে নিতে হয় “গুরু ব্রহ্মা, গুরু বিষ্ণু”। মুসলিমদের কাছে গুরু বা ওস্তাদ মা-বাবা বা পীরের সমান। শিষ্য ভালো হলে গুরুও সন্তান স্নেহ দেন, সব কিছু উজাড় করে শেখান, শিষ্যের মধ্যে নিজে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেন।

পরম্পরা অনুযায়ী গুরুর নিজের বাড়িতে বসবাস করে শিক্ষা নেবার নিয়ম। প্রথমে গুরুর কাছে শিষ্য হবার প্রার্থনা করতে হয়। গুরু গ্রহণ করতে রাজী হলে, শিষ্য হবার শর্তগুলো জানিয়ে দেন। এরপর একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে (গান্ডা বন্ধন) শিক্ষাজীবন শুরু হয়। গুরুর পরিবারের অন্যান্য সদস্য, ওস্তাদখানার সিনিয়র শিষ্যদের সাথে নিজের পরিবারের মতো সম্পর্ক স্থাপন করতে হয়। গুরুগৃহের সবার সাথে মানানসই জীবনযাপনে অভ্যস্ত হতে হয়। শেখার সময় গুরুর পাশাপাশি তাঁরাও তৈরি হতে সাহায্য করেন। গুরুকে নজর (সম্মানী, অর্থ, উপঢৌকন) প্রদানের পাশাপাশি গুরুর পরিবারের সদস্য এবং গুরুগৃহের সিনিয়র শিষ্যদের (নিজের সামর্থ্য অনুযায়ী) নজর প্রদান করতে হয়।

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 2 ঘরানা সংস্কৃতি ও গুরু শিষ্য পরম্পরা

 

শিক্ষা-কালীন গুরুর অনুমোদিত সঙ্গীত ছাড়া, কোন সঙ্গীত সাধনা করা যায় না। গুরুর ইচ্ছা ছাড়া, বাইরে কোথাও গান করা যায় না। কঠোর নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্য দিয়ে গুরুর প্রত্যাশিত লেভেল পর্যন্ত শিখতে হয়। গুরু সন্তুষ্ট হলে, পরীক্ষা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। গুরু তার শিক্ষার্থীর পরীক্ষা নেবার জন্য, বাইরে থেকে ওস্তাদ-পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রিত সকল ওস্তাদ পণ্ডিতের সামনে, গুরু ওই শিক্ষার্থীকে বাইরে গাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। আগত সব ওস্তাদ-পণ্ডিতরা বিভিন্নভাবে শিষ্যকে পরীক্ষা করেন। শিষ্য প্রত্যাশা পূরণ করলে, তারা সমন্বিত ভাবে বাইরে যাবার অনুমতি দেন এবং আশীর্বাদ করেন। গুরু সেদিন তার ঘরানার নাম ব্যাবহারের অনুমতি দেন এবং আশীর্বাদ করেন।

গুরু, গুরুগৃহ এবং ঘরানার সাথে শিল্পীর সম্পর্ক আজীবনের। শিষ্য ফর্মাল শিক্ষাজীবন শেষ করার পরে নিয়মিত গুরু এবং গুরুগৃহের সাথে যোগাযোগ রাখে। গুরু এবং গুরুগৃহে নজর দেয়। গুরুও শিষ্যের ম্যাচিউরিটির সাথে সাথে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শিক্ষা দিতে থকেন। শিষ্য যদি গুরুর জীবদ্দশায় কোন শিষ্য গ্রহণ করে, তবে গুরুর অনুমতি নিয়ে গ্রহণ করে।

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 1 ঘরানা সংস্কৃতি ও গুরু শিষ্য পরম্পরা

 

গুরু শিষ্য বন্ধন কেন এত মজবুত হয়, তা আমি জানি না। তবে বিভিন্ন বড় ওস্তাদ পণ্ডিতরা তাদের সাক্ষাৎকারে বলেছেন- তারা বারবার নিজের প্রাণের টানে গুরুর কাছে ফিরে যেতেন। গুরুকে মনে হতো – এক অসীম শাস্তির সমুদ্র, নিরাপত্তার পাহাড়।

গুরু ছাড়াও প্রতিটি ঘরানার আলোকবর্তিকা বাহক (torchbearer) থাকে। তাদেরকে কেউ কেউ “খলিফা”ও বলে। ঘরানার প্রতিষ্ঠাতার সময় থেকে এই রেওয়াজ চলে আসতে থাকে। প্রত্যেকেই তার উত্তরাধিকারী ঠিক করে দিয়ে যান। ওই ঘরানার সব শিল্পী সেই আলোকবর্তিকা বাহককে সম্মান করেন। একসাথে কোন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করলে নজর (উপঢৌকন, অর্থ) প্রদানের মাধ্যমে সম্মান জানায়।

 

সূচি: