পাকিস্তান রাস্ট্রের উর্দু ভাষা চাপানোর কারণ

পাকিস্তান রাস্ট্রের উর্দু ভাষা চাপানোর কারণ : ছোটবেলার প্রতিটি ২১শে ফেব্রুয়ারিতে শুনতাম, পাকিস্তান আমার মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চেয়েছিল। মায়ের ছেলেরা সেদিন ভাষার জন্য রক্ত দিয়েছিলো। সহজেই বুঝতাম, মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চাইলে তো প্রতিবাদ করতেই হবে, প্রয়োজনে প্রাণ দিতে হবে। কিন্তু বুঝতাম না কেন পাকিস্তানিরা আমাদের মায়ের ভাষা কেড়ে নিতে চাইবে, ওদের কি লাভ?

পাকিস্তান রাস্ট্রের উর্দু ভাষা চাপানোর কারণ - মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ [ Muhammad Ali Jinnah ]
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ [ Muhammad Ali Jinnah ]

সেই প্রশ্নটি খুব বেশিদিন বিরক্ত করার সুযোগ পেতো না। কারণ ওই একটা দিন বাদে, বাংলা শেখার গুরুত্ব নিয়ে তেমন কোন আলাপ ছিল না। বাকি দিনগুলো আমাদের চিরদুঃখী বাংলার শিক্ষক ছাড়া এই ভাষা নিয়ে কারও কোন মাথাব্যথা থাকতো না। বরং বাকি সকলেই ইংরেজি শিক্ষার ভবিষ্যৎ গুরুত্ব বয়ান করতেন। শিক্ষিত আত্মীয়রা বাড়িতে বেড়াতে এসে আমাদের ইংরেজি-জ্ঞানের পরীক্ষা নিতেন, “বল দেখি, রহিমেরা তিন ভাই… এটার ইংরেজি কি হবে?” বাংলার দরকার নেই, আর ইংরেজির চেষ্টা করছি – এই কথা বলে দুটো ভাষার পড়াতেই ফাঁকি মারার সুযোগ খুঁজতাম।

কিন্তু ২১শে ফেব্রুয়ারি এলেই এই প্রশ্নটা আমাকে বিরক্ত করতো। অথচ যুক্তি খুঁজে পেতাম না, কেন পাকিস্তানি শাসকরা শুধুমাত্র আমাদের ভাষা বদলে দেবার প্রয়োজনে এতো ঝামেলা সহ্য করবে। এক পর্যায়ে জেনে নিশ্চিত হয়েছিলাম যে, ইসলামিক (!) ভাষা হিসেবে পাকিস্তানি শোষকদল উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চেয়েছিল। কিছুদিন শান্ত থাকার পরে আবার মাথা চুলকায়। নাহ, এই কারণটা যথেষ্ট মজবুত না। এর পেছনে অন্য কোন কারণ নিশ্চয়ই আছে… কারণ পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী এতখানি ধার্মিকও না, আবার কোন বড় লাভ-লোভ ছাড়া এত ঝামেলা সহ্য করনে-ওয়ালাও না। তাই বড় হবার সময়ে ঠুকঠাক পড়ালেখা করে কিছু জিনিসে একে একে মিলিয়েছি। ইতিহাসের কিছু ঘটনা মেলালে হিসেবটি পরিস্কার হওয়া কঠিন না।

আমরা সাধারন জনতা জিন্নাহ সাহেবের টু-নেশন থিওরিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে পাকিস্তানে যোগ দিলাম। সেটা ছিল মূলত মুসলিম জাতীয়তাবাদ থিওরি। পৃথিবীর সব মুসলিম এক জাতি; অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ (দারুল হার্ব) রাষ্ট্রে মুসলিমদের স্বেচ্ছায় বসবাস করা জায়েজ না − এগুলোই ছিল মূল স্পিরিট। অমুসলিমদের প্রতি ঘৃণা তৈরি করে, উগ্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদ জাগ্রত করে, একক ইসলামিক রাষ্ট্রের দাবি জোরদার করাই ছিল এই নীতির লক্ষ্য।

যতদূর জানি, কায়দ-ই-আজম সাহেব প্র্যাকটিসিং মুসলিমও ছিলেন না। আমার হিসেবে, তিনি জননেতাও ছিলেন না। তিনি ছিলেন মুসলিম রেওয়েতি জমিদারদের আলাদা সুবা (দেশ) তৈরি করে দেবার জন্য নিযুক্ত উকিল মাত্র। জীবন যাপনে সম্পুর্ন ব্রিটিশ জিন্নাহ সাহেবের- ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি ও তার ওপরে ভিত্তি করে গড়ে ওঠা জাতীয়তার প্যাঁচ সম্পর্কে তার তেমন কোন ধারণা ছিল না। তাই সেই বিষয়ে তিনি তখন তেমন একটা মাথা ঘামাননি। তিনি কোরআন-সন্নাহ-ইজমা-কিয়াসের রেফারেন্স ধার নিয়ে সেই রাষ্ট্রের যৌক্তিকতা প্রমাণ করেছেন। এরপর দক্ষ উকিল হিসেবে ব্রিটিশ কোর্টে সেই থিওরি প্রমাণ করে মামলা জিতে পাকিস্তান বানিয়ে নিয়েছেন।

পাকিস্তান ঘোষণা হবার কিছুদিন আগে থেকেই হবু ক্ষমতা-প্রার্থী বিহার এবং পাঞ্জাবের মুসলমানদের আচরণে জিন্নাহ সাহেব পরিষ্কার বুঝতে পারছিলেন, আগত রাষ্ট্রে সব জাতের মুসলমান কোনোভাবেই সমান হবে না, এবং সেই অর্থে এক জাতি হবে না। এই এলিটরা তাদের একক ক্ষমতা নিশ্চিত করতে যা প্রয়োজন, সবই করবে। পাঞ্জাবি ভাইদের মধ্যে আবার গণ্ডগোল মুহাজির বনাম আদি পাকিস্তানি নিয়ে। তাই মুহাজির-অমুহাজির পেট ভরার পরে যদি কিছু বাঁচে, সেটা থাকবে বাঁকি মুসলিম ভাই (বাঙালি, বেলুচি, সিন্ধি) দের জন্য। তার ওপরে রেওয়েতি জমিদার তার স্বগোত্রের জমিদারের স্বার্থ দেখবে আগে।

[ পাকিস্তান রাস্ট্রের উর্দু ভাষা চাপানোর কারণ ]

ইসলামের সমতার কথা বলে দেশ তৈরি হবে ঠিকই, কিন্তু সেই ইসলামের দোহাই দিয়েই সবচেয়ে বেশি অনাচার হবে। যখন উনি সেটা বুঝেছেন, ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। তারপরেও তিনি মিনমিন করে কয়েকটি বক্তৃতায় সেকুলারিজমের কথা তুললেন। কিন্তু ইসলামের জাতীয়তাবাদ, অমুসলিমদের প্রতি ঘৃণা আর সেকুলারিজম পাশাপাশি বসালে স্রেফ আলু হয়! তাই লিয়াকত আলির পরামর্শে তিনি সে আলাপ গিলে ফেললেন। বরং আল্লামা ইকবালের পরামর্শে “পাকিস্তান মানেই ইসলাম” ক্যাম্পেইনে মনোযোগী হলেন।

তার সামনেই ফল আসা শুরু হল। সাম্প্রদায়িকতা নগ্ন হতে শুরু করলো পাকিস্তান ঘোষণার পরদিন থেকেই। যেমন, ওয়াদা করার পরেও শুধুমাত্র বাংলার মানুষ বলে সোহরাওয়ার্দীকে প্রধানমন্ত্রী করার বদলে তার নাগরিকত্ব বাতিল করা হল। কারণ দেখানো হল, সোহরাওয়ার্দী ইসলামের শত্রু এবং পাকিস্তানের গাদ্দার। তিনি জিন্নার ডাইরেক্ট অ্যাকশনের সময় হিন্দু-হত্যার বদলে গান্ধীর সাথে হিন্দু-মুসলিম ভাই-ভাই ক্যাম্পেইনে নেমেছিলেন। তবে সোহরাওয়ার্দীকে যতোই ইসলামের শত্রু বলে ক্যাম্পেইন করা হোক না কেন, বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ লোকজন ‘বাঙালিকে ঠকানো হয়েছে’ বলেই বুঝতে পেরেছিল।

স্যার মুহাম্মদ ইকবাল [ Muhammad Iqbal ]
স্যার মুহাম্মদ ইকবাল [ Muhammad Iqbal ]
পাকিস্তান দেখে না যেতে পারলেও, পাকিস্তানের আউটলাইন করেছিলেন আল্লামা ইকবাল। ইকবাল ধর্মে-কর্মে জিন্নার মতো হলেও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ভালো বুঝতেন। সেভাবেই তিনি তার ভক্তদের তৈরি করেছিলেন। তারা একসময় পাঞ্জাবি এবং মুহাজিরদের ক্ষমতার নিউক্লিয়াসকে বোঝালেন, মুসলিম জাতীয়তাবাদের সুগার কোটিং ক্রমশ হালকা হতে থাকলে পাকিস্তান কনসেপ্টটাই মিথ্যা হয়ে যাবে এবং পাকিস্তান বাঁচানো মুশকিল হবে। তাই পাকিস্তান বাঁচিয়ে রাখলে গেলে পাকিস্তানকে ইসলামের পরিপূরক হিসেবে তুলে ধরতে হবে। পাকিস্তান না বাঁচলে ইসলাম বাঁচবে না, এই বিষয়টি প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এর পাশাপাশি নাগরিকদের শুধুমাত্র ধর্ম ছাড়া ছাড়া, পার্থক্য করতে পারার মতো, আলাদা করে সংগঠিত হবার মতো সকল পরিচয় মুছে দিতে হবে।

তারা আমাদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের ওপরে গবেষণা করে মুসলিম ইউনিটির প্রথম শত্রু হিসেবে বের করলেন স্বতন্ত্র ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি। এর মধ্যে মেরুদণ্ডটা হল ভাষা। এই পার্থক্যগুলো মুছে ফেলা গেলেই আমরা সবাই স্রেফ মুসলমান। এরপর আর কেউ পাঞ্জাবি, বাঙালি, বালুচ, সিন্ধি নয়। এরপরে অত্যাচার করলেও নিপীড়িতরা কোন জাতীয়তার ছায়াতলে এক হয়ে সংগঠিত হতে পারবে না। আর সেসব সমাজ থেকে কিছু লোভি দালাল বের করে নিলেই কাজ শেষ। সব বাড়াবাড়ি ধর্মের কলে ফেলে সাইজ করা কঠিন হবে না। তাই এমন একটি ভাষাকে সবার ভাষা বানিয়ে দিতে হবে যেটার ওপর গোষ্টির নৃতাত্বিক অধিকার নেই।

এর পরিক্রমায় প্রথম পাঞ্জাবিকে রাষ্ট্রভাষা করার পরিকল্পনা থাকলেও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়ের শেকড় তুলে ফেলার জন্য তারা ওই আইডিয়া বাদ দেন। তারা পাঞ্জাবি সংখ্যাগরিষ্ট ক্ষমতার নিউক্লিয়নকে পাঞ্জাবি ভাষার স্বত্ব ত্যাগ করার জন্য রাজিও করিয়ে ফেললেন। কারন ক্ষমতার নিউক্লিয়াস শুধুমাত্র ক্ষমতার প্রত্যাশী ছিল, তা সে পাঞ্জাবি বা মুসলিম… যে পরিচয়েই হোক, ক্ষমতা পেলে তারা সব কিছুতেই রাজি।

তাদের প্রথম চেষ্টা ছিল কোরআনের ভাষা আরবিকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার। এজন্য তারা বান্নার শিষ্য সাঈদ রামাদন (ব্রাদারহুডের তারিক রামাদনের বাবা) আর ইহুদি পিতামাতার সন্তান জেলখাটা জিহাদি ইসলামিক বুদ্ধিজীবী (সৌদি বাদশাহ সাউদের স্নেহধন্য) মোহাম্মদ আসাদকে গবেষণার ভার দিলেন। শুদ্ধ আরবি সম্ভব না হলেও যেন আরবি উর্দু মিশিয়ে আর একটু প্রো-ইসলামিক একটি রাষ্ট্রভাষা তৈরি করা যায়।

বলা বাহুল্য, পাকিস্তানের জনগণ সেই চেষ্টাকে ‘মুড়ি খাও’ বলে দিলো। এ বিষয়ে এটা রসিকতা প্রচলিত আছে। এক উপদেষ্টা নাকি গোস্বা করে কমপ্লেইন করেছিলো, “আপনার আরবি রাষ্ট্রভাষা কাউন্সিলের পাঞ্জাবি প্রতিনিধিরা, আমাদের সাথে মিটিং করে আরবিতে, আর নিজেদের মধ্যে কথা বলে পাঞ্জাবীতে। এদের দিয়ে রাষ্ট্রভাষা আরবি করবেন কীভাবে?”

যা হোক, আরবি-চেষ্টা বিফল হবার পরে উর্দুকে নিয়ে চেষ্টা করা হল। পক্ষে যুক্তি ছিল, উর্দু পাকিস্তানের কোন জনগোষ্ঠীরই নিজস্ব ভাষা নয় (কিছু মোহাজের ছাড়া)। এ ভাষার হরফ আরবি। হরফের পাশাপাশি দীর্ঘ দিন ধরে এলিট সমাজে ব্যবহৃত হবার কারণে এ ভাষা সম্পর্কে মুসলিমদের এক ধরনের ভয় ও ভক্তি আশা করা যায়। কিন্তু সেখানকার রেজাল্টও ‘মুড়ি খাও’। এছাড়া আরবি হরফে অন্য ভাষা লেখা, অন্য ভাষায় উর্দু শব্দ ঢোকানো, সাম্প্রদায়িক চেতনা জাগ্রত করে এ ধরনের সাহিত্য বন্ধ করা, ভাষাভিত্তিক জাতীয়তা তৈরি হতে পারে এ ধরনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা, ইত্যাদি কম অপচেষ্টা করেনি পাকিস্তান।

চেষ্টার দিকে দিয়ে ধরতে গেলে দেখা যাবে, আমরা মাতৃভাষার রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির জন্য প্রাণ দিয়েছি বটে, কিন্তু আল বাকিস্তানও রাষ্ট্রভাষার জন্য কম সংগ্রাম করেনি! কিন্তু সব মিলিয়ে লাভ হয়েছে কি? আজ আমাদের প্রায় ১০০ ভাগ লোক বাংলায় কথা বলছে। অথচ পাকিস্তান এখনও অফিশিয়ালি উর্দুভাষীর সংখ্যা ৮% ছাড়াতে পারেনি।

তবে এতদিনে এটুকু বুঝেছি – পাকিস্তানের ইসলামিক রাষ্ট্র কায়েমের চেষ্টার পিছনে ইসলাম প্রেম ছিল না, আবার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টার পেছনে ধর্মীয় চেতনা ছিল না। উদ্দেশ্য সম্পূর্ণই ইহ-লৌকিক এবং নিতান্তই আর্থিক। মূলত সাধারণ মানুষকে নির্ঝঞ্ঝাটে শোষণ করার জন্য তাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় কেড়ে নেয়া, জনমনে আরও বেশি ধর্ম ভীতি তৈরি করা এবং নিজেকে সেই ধর্মের কর্তৃপক্ষ হিসেবে প্রতিষ্টত করা।

আরও পড়ুন:

ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানঃ এম আর মাহবুব

Leave a Comment