শাস্ত্রিয় সঙ্গীত, মার্গ সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীত – কী? । অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ

বিষয়ে ঢোকার আগেই হয়তো মাথায় প্রশ্ন আসছে – শাস্ত্রিয় সঙ্গীত, মার্গ সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীত – কী? আমারও তাই এসেছিল। আমি যেভাবে উত্তরটি খুঁজে নিয়েছি, সেটা লিখে আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম।

সুরের মুল উৎস প্রকৃতি। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য থেকেই বিচিত্র সব সঙ্গীতের সৃষ্টি। বড় গোলাম আলি খাঁ সাহেব বলতেন

“সৃষ্টিকর্তা পৃথিবীর সব লোকালয়ে সুর ভাগ করে দিয়েছেন, প্রকৃতির অন্যান্য উপাদানের (element) মত করেই। কোথাও নদী দিয়েছেন, মরুভূমি দিয়েছেন, পাহাড় দিয়েছেন, দীর্ঘ বসন্ত দিয়েছেন, দীর্ঘ খরা দিয়েছেন। ওভাবেই ভাগ করে দিয়েছেন – নদীর, খরা, মরু, পাহাড়ের সুর”।

 

শাস্ত্রিয় সঙ্গীত, মার্গ সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীত - কী?

শাস্ত্রিয় সঙ্গীত, মার্গ সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীত – কী?

 

প্রচলিত সুরের থেকে উৎসারিত রাগ:

সেইসব সুর একেকজন দক্ষ ওস্তাদদের হাতে পড়ে, ক্রমশ সুবিন্যস্ত একটি কাঠামোর রূপ নিয়েছে। তারা সেই সুরের কাঠামোর মধ্যে চমৎকার সব চলন (phrase) তৈরি করে, ওই সুরকে আরও সুন্দর, সুশোভিত হয়ে করে দিয়ে গেছেন। সেই সংকলনগুলো কালেকালে হয়ে উঠেছে রাগ, ঠাট ইত্যাদি শাস্ত্র। যেটা আমাদের আজকের শাস্ত্রিয় সঙ্গীত, মার্গ সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীত। তাই আপনি যদি রাগ পাহাড়ি তে কোন গান/বাজনা (composition) শোনেন, রাগের নাম না জানলেও, বলতে পারবেন এটা পাহাড়ি গান। অথবা যদি কখনও পাহাড়ি গান না শুনে থাকেন, তারপরেও পাহাড় এলাকায় বসে, রাগ পাহাড়ি তে যেকোনো গান/বাজনা শুনতে ভালবাসবেন।

 

মনের সৃষ্টিশীলতা থেকে উৎসারিত রাগ:

প্রকৃতি ছাড়া, সুরের আর একটি বড় উৎস হচ্ছে মানুষের মন। স্থান, কাল, ঘটনা ভেদে আপনার মন যখন যে স্তরে থাকবে, আপনার কথাবার্তাতে সেই স্তরের ভাব-আবেগ (mood) প্রকাশ পাবে। তেমনিভাবে যাদের সুর আসে, তারা গলা খুললেই, ওই সময়ের ভাবাবেগ ধরা পড়বে। সঙ্গীতজ্ঞরা প্রকৃতির সুরের মতোকরে একইভাবে, মানুষের বিভিন্ন ধরনের ভাবাবেগকে, ভিন্ন ভিন্ন সুরের কাঠামোতে বেঁধে দিয়ে গেছেন। সেগুলোও কালেকালে আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অংশ হয়েছে।

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 3 শাস্ত্রিয় সঙ্গীত, মার্গ সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীত - কী? । অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ

 

রাগ ও শাস্ত্রের উন্নয়ন:

পরবর্তী ওস্তাদ/পণ্ডিতেরা সেসব কাঠামোগুলো নিয়ে আরও গবেষণা করেছেন। কিভাবে গাইলে নিখুঁতভাবে রাগের ছবিটি ধরা দেবে, তার রূপরেখা উন্নয়ন করেছেন। সেই রূপরেখাই হলো রাগ, বিধিবদ্ধ সুরের কাঠামো। এই রাগই আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের মুল ভিত্তি। বংশপরম্পরায় শাস্ত্রীয় সঙ্গীত লেখা-পড়ার জন্য গ্রামার তৈরি করা হয়েছে। রাগ, ঠাট, জাতি, স্কেল – বিভিন্ন কারিগরি নাম দেয়া হয়েছে। এসবের সর্বশেষ কারিগরি রুপী আমাদের আজকের শাস্ত্রিয় সঙ্গীত, মার্গ সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীত। তাই শাস্ত্রিয় সঙ্গীত, মার্গ সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীত কোন আলাদা করে আবিষ্কার করা নতুন বিষয় না। বরং আমাদের আশপাশের প্রকৃতি আর জীবনআচারের মধ্যে ফুটে ওঠা বিভিন্ন ভাবাবেগের শ্রেণীবদ্ধ এবং শুদ্ধ সঙ্গীতরূপ।

নানা গায়কী বা গানের রাগের রূপ:

ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে, একটি নির্দিষ্ট ভাবাবেগ কে স্পষ্টতরে ফুটিয়ে তোলার জন্য, যে নির্দিষ্ট সুরের কাঠামো তৈরি করা হয়েছে, সেগুলোই বলে রাগ। ভিন্ন ভিন্ন স্থান,কাল ও ভাবের জন্য স্বতন্ত্র রাগ। এই ভাবের প্রকাশটা একেকজন ওস্তাদ-পাণ্ডিত একেক ভাবে করতে পছন্দ করেছেন। সে কারণে সেই রাগ সঙ্গীতের উপরে তৈরি হয়েছে নানা আন্দাজের গায়কী বা নানা ধরণের গান [ যেমন ধ্রুপদ, ধামার, খেয়াল, ঠুমরী ]

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 2 শাস্ত্রিয় সঙ্গীত, মার্গ সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীত - কী? । অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ

কেন “শাস্ত্রীয়” বলা হয়?

যারা শুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীত পরিবেশন করেন, তারা স্থান-কাল মাথায় রেখে, শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট ভাবাবেগ কে প্রকাশের জন্য, শুদ্ধরুপে যেকোনো একটি রাগ গান/বাজান। এ ধরনের সঙ্গীতে শুদ্ধতার বিষয়টা খুব কঠোরতার সাথে নিশ্চিত করা হয়। শোনার বৈচিত্র্যের জন্য বা অন্য কোন কারণে নিয়ম ভাঙ্গা যায় না। এ ধরনের গানবাজনার অনুষ্ঠানকে আমরা – শাস্ত্রীয় সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীতের অনুষ্ঠান বলি।

উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীত ও রাগ:

শুদ্ধ শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের পাশাপাশি, উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীত (semi classical music) নামে একটি ধারা আছে। এই ধারা নির্দিষ্ট রাগের উপরে ভিত্তি করে, শ্রবণবৈচিত্র্য তৈরির জন্য অনেক রকম অলংকরণ (ornamentation) করা হয়। বিভিন্ন ধরনের অলঙ্করণের কারণে, মাঝে মধ্যে সামান্য রাগ ভ্রষ্ট হতে পারে। উপশাস্ত্রীয় সঙ্গীতে নিয়মকানুন শিথিল হলেও, রাগের মুল মেজাজটা ধরে রাখার চেষ্টা করা হয়। শুদ্ধ গানের শ্রোতারা হালকা মেজাজে এধরনের সঙ্গীত শুনতে পছন্দ করেন। এই ধারা শুদ্ধ গানের শ্রোতাদের পাশাপাশি সাধারণ শ্রোতাদের মধ্যেও জনপ্রিয়।

প্রচলিত গানবাজনা ও রাগ:

আমাদের প্রচলিত সাধারণ গানগুলোও কিন্তু রাগের বাইরে নয়। গানের অংশগুলোকে আলাদা আলাদা করে ভেঙ্গে নিয়ে, বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে, ওই অংশগুলো কোন একটি রাগ চলনের সাথে মিলে যাবে। কিন্তু যেহেতু বহু রাগের অপরিমিত মিলমিশ হয় এবং কোন রাগের মুল মেজাজ ধরে রাখা হয় না, তাই এগেুলোকে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের কাতারে ফেলা যায় না। এ ধরনের গানকে শাস্ত্র অনুযায়ী বলা হয় “লঘু সঙ্গীত”।

 

SufiFaruq.com Logo 252x68 1 শাস্ত্রিয় সঙ্গীত, মার্গ সঙ্গীত, উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত বা রাগ সঙ্গীত - কী? । অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ

সেই উত্তর যদি পেয়ে থাকেন, তবে চুলুন আবার ফিরে যাই : অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ সূচি [ সূচি ] তে।

চাইলে সঙ্গীতের প্রয়োজনীয় তথ্য দিয়ে তৈরি উইকির “ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীত” আর্টিকেলটি দেখতে পারেন।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment