রুস্তমচাচা – শচীন ভৌমিক [ প্রিয় গল্প সংগ্রহ ] Rustamchacha -Sachin Bhowmick

রুস্তমচাচার গাড়ির শুধু রঙ নয়, নম্বর, হর্নের আওয়াজ এমনকি পোড়া মোবিল অয়েলের গন্ধ পর্যন্ত আমাদের মুখস্থ ছিল। আর রুস্তমচাচা মানে কি?
রুস্তমচাচা মানে চকোলেট, রুস্তমচাচা মানে খেলনা, রুস্তমচাচা মানে দরাজ গলার উচ্চহাসি।

রুস্তমচাচা - শচীন ভৌমিক [ প্রিয় গল্প সংগ্রহ ] Rustamchacha -Sachin Bhowmick, ফর এডাল্টস্ ওনলি - শচিন ভৌমিক | For Adults Only - by Sachin Bhowmik
ফর এডাল্টস্ ওনলি – শচিন ভৌমিক | For Adults Only – by Sachin Bhowmik
কি করে আমাদের পরিবারের সঙ্গে এমন ঘনিষ্ঠতা হল চাচার বলতে পারব না । প্রথম অবিশ্যি আলাপ ডাক্তার হিসেবে বাবার সঙ্গে, তারপর সে সূত্রেই একদিন আমাদের বাড়িতে এলেন চাচা, কি মন্ত্রে কে জানে ভাব জমিয়ে ফেললেন আমাদের সঙ্গে। ছোটদের সঙ্গে। ছোটদের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়ে গেল রুস্তমচাচার। আমরা সব ভক্ত জুটেছিলাম চাচার।

হঠাৎ এতদিন বাদে সেই রুস্তমচাচার কথা মনে পড়ে গেল কেন জানি না। মাঝে মাঝে এমনি হয়, অনেকদিনের পুরনো স্মৃতি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে বিস্মরণের সমুদ্র থেকে, মনে পড়ে আট বছর আগে কোন এক শীতার্ত রাতের চাঁদকে, ইরাবতীর ধারে সেগুন বনের ভেতর একক কোন কাঠের বাড়ির জাফরির ভেতর দিয়ে যাকে দেখেছিলাম আমি।

রুস্তমচাচার গল্প আমরা শুনেছিলাম মালীর মুখে, অনেকদিন পর। রুস্তমচাচা ততদিনে মারা গেছেন। মৃত্যুটা একটু রহস্যময়, রুস্তমচাচার মৃতদেহ ইরাবতীতে পাওয়া গিয়েছিল। তারপর অনেকদিন কেটে গেছে। আমরা ভুলেও গেছি তাঁর কথা, এমন সময় বোমা পড়ল রেঙ্গুনে, প্রোমেও। শহর থেরেক তখন আমরা পালিয়ে গেলাম সেই রুস্তমচাচার জঙ্গলবাড়িতে, সেটা তখন খালি, শুধু চাচার মালীটা থাকত একা। সেই আমাদের অনুরোধ করে ওখানে নিয়ে যায়। এবারই চাচার সমস্ত কাহিনী শুনিয়েছিল রহমান মালী।

কিন্তু তার আগে আমাদের প্রথমবারের অভিজ্ঞাতার কথা বলা দরকার।
সেটাই বলি।
রুস্তচাচাকে একদিন আমরা ধরলাম, চাচার বাসায় যাবো।
একটু গাঁইগুঁই করল চাচা,– জঙ্গলের মধ্যে বাসা, কেউ নেই কাছেপিঠেত, শুধু একটা মালী আর আমি, তোমাদের ভালো লাগবে না যে।
তারচেয়ে চলো লম্বা মোটর ড্রাইভ দি, তোমাদের নিয়ে কোথাও বেড়াতে যাই।–

না চাচা না,– আমি, ছোড়দি, বড়কা, ডাবলু সবাই প্রায় কোরাস গাইলাম। শেষ পর্যন্ত রাজী হলেন। বললেন, কাল রোববার কাল সকালে নিয়ে যাবো তোমাদের সোমবার সাকলে ফিরিয়ে দিয়ে যাবো।

আমাদের নৃত্য তখন দেখে কে!
পরদিন সকালে গাড়ি এলো।
আমরা সবাই সেজেগুজে তৈরি। প্রোম শহরের বাইরে এইটুকু জানতাম, কিন্তু শহর থেকে কতদূর জানতাম না। গাড়ি এঁকেবেঁকে গভীর জঙ্গলে ঢুকল, তারপরও আরো অন্তত সাত আট মাইল ভেতরে রুস্তমচাচার বাড়ি।

বাড়িটা দেখে সত্যি বলতে দিনের বেলাতেই আমাদের কেমন গা ছমছম করতে লাগল। পুরনো কাঠের দোতলা, চারপাশের শুধু সেগুনের ঘন অরণ্য পেছনে ছোট্ট একটা ইরাবতীর খাড়ি।
কেমন বোবা বোবা, বিধবা বিধবা বাড়ি।

তারপর ভয় পেলাম কানা মালীকে দেখে, নাম জানতাম, রহমান। দেখলে সত্যি বেশ ভয় ভয় করে।
আমাদের বাড়িতে রেখে চাচা গেলেন বাজার করতে ফের প্রোমে।
বিপত্তি হল এসেই।
আবিষ্কারটা ছোড়দির। খালি বাড়িতে ঘুরতে ঘুরতে একটা ঘরে একটা সিন্দুক পাওয়া গেল। তালা খোলা।
আয় এটা খুলি,– ছোড়দির দুষ্টবুদ্ধি উদ্বেল হয়ে উঠল। চারজনের ঘাম বার করা চেষ্টার পর লোহার ঢাকুনি তোলা গেল। আর তুলেই আমরা অবাক।

মণিমুক্তো হীরে জহরত নয় অজস্র খেলনা, ব্যবহৃত কিছু—কিছু নতুন, আর ছোড়দির বয়সী কোন মেয়ের পোশাক থাক করে সাজানো। দামী কাপড়ের পোশাক, চোখ ঝলসানো। কার এগুলো?

চাচার ওতা মেয়ে আছে কোনদিন শুনি নি, তবে? আর এমন যত্নে এগুলো রাখারও কি কারণ থাকতে পারে? ছোড়দি ওসব ভাবছে না। ও হঠাৎ বেছে বেছে একটা ঘাগরা আর জামা বার করে পরে নিল। পরে সিঁড়ি দিয়ে বুঝি নিচে নামছিল, প্রচণ্ড একটা আর্তচিৎকার শুনে সবাই আমরা ছুটে গেলাম।

রুস্তমচাচার এ চেহারা আমরা কোনদিন দেখি নি। রাগে থরথর করে কাঁপছে চাচা আর ভয়ে ছোড়দি দাঁড়িয়ে পড়েছে পুতুলের মতো, নড়তে পারছ না।

ঝড়ের মতো উঠে এলেন চাচা, তারপর নিজে ছোড়দির পোশাকগুলো টানতে টানতে পাগলের মতো চেঁচাতে লাগলেন,– খোলা খোল সব। কে তোমাকে এগুলো পরতে বলেছে, খোল।

চাচার হিংস্র-টানে ঘাগরাটা ফড়াৎ করে ছিঁড়ে গেল, দৌড়ে ছোড়দি চলে এল ঘরে, আমরাও। সব সিন্দুকের জিনিস সিন্দুকে ভরে রাখলাম। তারপর চারজন কাঁপতে লাগলাম যেন যমের মুখে পড়েছি আমরা।

চাচা তখন এলেন না।
এলেন বেশ খানিক বাদে। এসেই নিজের দুর্ব্যবহারের লজ্জায় কেঁদে ফেললেন। ছোড়দিকে জড়িয়ে ধরে কি কান্না। কে বলবে এই সেই রুস্তমচাচা, একটুক্ষণ আগে যে বদ্ধ উন্মাদের মতো ব্যবহার করছিল।

খানিকক্ষণ পর্যন্ত রুস্তমচাচা এমন কাণ্ড করলেন যে আমরা বেমালুম তার খানিক আগের চেহারা ভুলে গেলাম।

দ্বীতীয় ঘটনা ঘটল রাত্তির বেলায়।
রাত্তির তখন আটটা হবে।

রুস্তমচাচা তার কাজে বেরিয়েছেন গাড়ি নিয়ে, বলেছেন—যাবো আর আসব, আর আসবার সময় তোমদের জন্য ঝুড়ি ভর্তি বাজি নিয়ে আসব, চমৎকরে সব বাজি। খুব মজা করা যাবে।

আমরা খুশিতে টইটুম্বর।
কিছুক্ষণ চুপচাপ কাটালাম বাড়ির স্বপ্ন দেখে।
কিন্তু কতক্ষণ আর মুখ বন্ধ করে ভদ্রলোক থাকতে পারে। আমিই বললাম সবাইকে, চলো লুকোচুরি খেলা যাক, সবাই এক পায়ে খাড়া।
খেলা চলল। এক সময় আমিই চোর হলাম। লুকোবার জায়গা খুঁজতে খুঁজতে সোজা তেতলায়। হঠাৎ দেখলাম সিঁড়ির ঠিক শিয়রে একটা তালাবদ্ধ ঘর। ঢোকবার কি কো্নই রাস্তা নেই? সতর্ক চোখ মেলে দেখি। ব্যস, তারপরই ইউরেকা।

সিঁড়ির রেলিং-এর শেষদিকে একটা জানালা, আধ ভেজানো। রেলিং ধরে ধরে খুব সাবধানে জানালার নিচে গিয়ে দাঁড়ালাম। রেলিং-এর দু’ইঞ্চি পরিসরে ভারসাম্য বজায় রাখা বেশ কষ্টকর, আর পা হড়কালেই সিঁড়ি গড়িয়ে একেবারে নিচে। কিন্তু লুকোতে হবে আমাকে, এমন লুকনো, কেউ বার না করতে পারে।
সুতরাং ভেজানো জানালা খুলে এক লাফে ভেতরে!

মাত্র ভেতরে ঢুকেছি অমনি শুনতে পেলাম ওদের অগ্রসরমান কলকণ্ঠ। নিঃশ্বাস চেপে দাঁড়িয়ে থাকি। ওরা উঠে আসছে।
আরে, এ কার গলা, রুস্তমচাচার গলা না?
ছোড়দির চেঁচানি কানে এলো।
খোকা বেরিয়ে আয় চাচা এসেছে।

আসছি,– জবাব দিলাম আমি। বেরিয়ে রেলিং-এ দাঁড়িয়েছি অমনি নিচ থেকে হুঙ্কার শোনা গেল রুস্তমচাচার।

আরেকটু হলেই গিয়েছিলাম, অতি কষ্টে সামলে ঢিপঢিপ বুকে নেমে এলাম। রুস্তমচাচার হুঙ্কারে সবাই একেবারে নিশ্চুপ।
আমি থরথর। ধীর পায়ে সামনে এসে কঠিন গলায় বললেন চাচা,

— ঐ ঘরে কেন ঢুকেছিলে?
–চোর—চোর খেলতে গিয়ে—
–কেন ঢুকেছিলে?
—যেন স্বপ্নের মধ্যে থেকে বলে চলেছেন চাচা। সমস্ত মুখ আগুন রঙে রাঙা, চোখ দুটি হিংস্র দ্যুতিতে বিষাক্ত। তারপরই এক চড়।
প্রস্ত্তত ছিলাম না, ঘুরে ছিটকে পড়লাম দূরে। কান ঝাঁ ঝাঁ করতে লাগল। দুমদুম পা ফেলে নিচে নেমে গেলেন চাচা।
আমরা ভাইবোনরা সব হতভম্ব, ভয়ে সবাই কাঠ। রুস্তমচাচার পর পর দু’টো ব্যবহারই রহস্যময় মনে হল।
ডাবলু বলল,– চল দাদা, আমরা এখুনি চলে যাই।

ছোড়দি বলল, চল হেঁটে পালিয়ে যাই এখান থেকে। বড়কাও ঘাড় কাত। সবাই রাজি।
নেমে এলাম নিচে
ছোট একটা ব্যাগ ছিল, তাতে টুকিটাকি সব ভরে নিলাম।

বেরুবার আগেই দেখি রস্তমচাচা ঘরের দরজায়, দু’চোখ দিয়ে দরদর জল। বললেন,– তোমরা ভয় পেয়েছ জানি, থাকতে চাও না, সেই ভালো। চলেই যাও। বড় কষ্ট দিলাম তোমাদের, আর এসো না। আর কোনদিন এসো না। এ বাড়িটা বড় খারাপ, বড় খারাপ।–
রুস্তমচাচার বেদনা আমাদের হৃদয় স্পর্শ করে, এটুকু বুঝলাম কোথাও গভীর কোন দুর্বল জায়গা আছে রুস্তমচাচার মনে, যেখানে ঘা খেলে নিজেকে আর সামলাতে পারে না।

–তোমাদের আর খেতে বলব না, তোমরা যাও। শুধু এই বাজিগুলো নিয়ে যাও, ইচ্ছে হয় জ্বালিও। মালী, এগুলো গাড়িতে তুলে দে।– রুস্তমচাচা নিঃশব্দে চলে গেলেন। আমরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করি, তারপর মালীর সঙ্গে হেঁটে গাড়িতে চেপে বসি। নির্জীবের মতো আড়ষ্ট ভঙ্গিতে।

ড্রাইভার গাড়ি ছাড়বার আগে মালী শুধু বলল,– তোমরা সাহেবের ওপর রাগ করো না। সাহেবের মস্ত বড় একটা কষ্ট আছে, সেখানে ধাক্কা খেলে অমন খেপে যায়। আর আজই হচ্ছে সতেরোই এপ্রিল, বড় সাংঘাতিক দিন। তোমরা শেষ-পর্যন্ত এমন দিনেই এসেছিলে,– কেমন বোবার মতো চুপ করে যায় রহমান।

তারপর ফিসফিস করে বললো,– লক্ষ্মী খোকা খুকুরা, বাড়িতে যেন আজকের কাণ্ডকারখানা কিছু বলো না, সাহেবর মনটা খারাপ নয়, কিন্তু—আচ্ছা যাও–। স্পষ্ট দেখলাম রহমান মালীর কানা চোখ জলে ভরে এসেছে। গলা ভারি। ততক্ষণে গাড়ি চলতে শুরু করল। রাস্তায় কেউ একটা কথাও বলতে পারলাম না। সবাই চুপ।

কিসের সতোরোই এপ্রিল, কিসের কি, কিছুরই রহস্যোদ্ধার করতে পারি নি। বলা বাহুল্য বাড়িতে এসে কাউকে কিছু বলিনি আমরা।

তারপর থেকে রুস্তমচাচা কম আসতেন, তেমন হৈহৈ করতেন না। ঠিক তার এক বছর বাদে উনি মারা গেলেন। মৃতদেহ ইরাবতীর জলে ভাসছিল।

বাবার কাছে শুনেছিলাম মর্গে জানা গেছে মরার তারিখ, আশ্চর্য সেটা সতেরোই এপ্রিল।

তারপর অনেক দিন কেটেছে।
ভুলেই গেছি চাচার কথা। অতঃপর বোমা। মেষ পর্যন্ত বুড়ো রহমান মালীর অনুরোধে সবাই গিয়ে উঠলাম সেই বাড়িতে। রুস্তমচাচার পরিত্যক্ত বাংলোতে।

এইবার রহমান মালী জানালো সতোরোই এপ্রিলের রহস্য।
সেটাই বলছি শুনুন।

বারান্দায় বসেছিলাম আমি। মস্ত বড়ো চাঁদ উঠেছিল আকাশে। জাফরি দিয়ে এসে বাঘবন্দীর ছকের মতো পড়েছিল দোতলার নির্জন বারান্দায়। সেখানে বসে জলভরা চোখে রুস্তমচাচার গল্প শোনাল রহমান। শোনাল তার অপমৃত্যুর মর্মান্তিক ইতিহাস। শীতের কনকনে হাওয়া ছিল, তার চেয়েও বেশী শীত ছিল রহমান মালীর গলায়।

রস্তমচাচা যখন প্রথম প্রোমে আসেন তখন তিনি একেবারেই গরীব ছিলেন। ভাগ্যান্বেষণে তিনি এলেন সুদূর বর্মা মুল্লুকে। মা আর নতুন বৌ ফেলে, একা। এখানে এসে প্রথম রিকশা টানলেন কিছুদিন, কিছুদিন চায়ের দোকানে চাকরের কাজ করলেন। তারপর কাঠের ব্যাবসায়ী ইয়ং পো-র কারখানায় কাজ পেলেন। ইয়ং পো-র নেকনজরে পড়লেন রুস্তমচাচা। বুড়ো পো ভালোবেসে ফেলল চাচাকে। ব্যাস, এতেই সর্বনাশটা ঘটল। পো বাড়িতে নিয়ে যেতে শুরু করল চাচাকে।

সেখানে চাচা দেখলেন ইয়ান মিয়াওকে। ইয়ান মিয়াও ইয়ং পো-র একমাত্র মেয়ে। আগুনের মতো রূপ তার, আর আগুনের মতোই তেজ। সেই রূপ পাগল করে ফেলল ভারতবর্ষের উষ্ণ রক্তের জোয়ান ছেলে রুস্তমজী করাঞ্জিয়াকে। সে মেয়ের জন্য সব ভুলে গেলেন চাচা। মেয়েও সমান উৎসাহী। সেও নিজেকে সামলাতে পারল না।

মার কথা, নতুন বৌ-র কথা সব তুচ্ছ হয়ে গেল। রুস্তমচাচার জীবেনের একমাত্র মন্ত্র তখন—ইয়ান মিয়াও।

কিন্তু ভুল করেছিলেন, মস্ত ভুল।

ইয়ান মিয়াওকে বিশ্বাস করছেলিন চাচা, সমস্ত হৃদয় সমর্পণ করেছিলেন এক মিথ্যে কুহেলিকাকে। দুর্বার বর্মার উগ্র যৌবনের মধুকর ইয়ান মিয়াও। কোথাও থেমে থাকবার মেয়ে নয় ও, একজনের হৃদয় পেয়ে তৃপ্তি নেই ওর, একজন ওর ক্ষুধা মেটাতে পারবে না। ঘুরে ঘুরে বৈচিত্রের মধ্যে আনন্দ খোঁজে ও। সেই ওর স্বভাব। একে সামলাবে কি করে রুস্তমচাচা। বুকভরা প্রেম দিয়ে? অসম্ভব, রুস্তমচাচার ব্যর্থ জীবনই সে অসম্ভাব্যতার স্বাক্ষর।

বিয়ে করল চাচা ওকে। খবর পেয়ে মা আর বৌ ছুটে এসেছিল এখানে। কিন্তু চাচা তখন অন্ধ, উন্মাদ অবস্থা তাঁর। তাই প্রায় গায়ের জোরেই বাড়ি থেকে মা বৌকে বার করে দিলেন রাস্তায়। কাণ্ডজ্ঞানহীন রুস্তমচাচার জীবনের তখন একমাত্র সত্য ইয়ান মিয়াও। কিন্তু কি দাম দিল ইয়ান মিয়াও?

ওর বাপের সাহায্যে রুস্তমচাচা নিজে বেশ প্রতিষ্ঠা অর্জন করেছে এর মধ্যে। এখন শুধু ইয়ান মিয়াও আর চাচা, শান্তিময় দাম্পত্য জীবন। কিন্তু যেখানে শান্তি, যেখানে স্বস্তি সেখানে কি থাকতে পারে ইয়ান মিয়াও? না, এ জাতের মেয়েরা তা পারে না। তাই একদিন চাচার প্রিয়পাত্র কারখানার দারোয়ান তেজবাহাদুর নেপালীর সঙ্গে পালিয়ে গেল ইয়ান মিয়াও। সামান্য একজন দারোয়ানের সঙ্গে। আর এই তেজবাহাদুরকে চাচা ছেলের মতোই ভালোবাসতেন।

মাথায় যেন বাজ ভেড়ে পড়ল চাচার। এতবড় একটা কুৎসিত ব্যাপার ঘটতে পারে এ তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেন নি। ইয়ান মিয়াও কিনা পালালো সামান্য একজন নেপালী দারোয়ানের সঙ্গে? সমস্ত কাজকর্ম ভুলে গেলেন চাচা। ইয়ান মিয়াওকে খুঁজতে লাগলেন পাগলের মতো। পেলেন না কয়েকদিনের ভেতর বিশ্রী চেহারা হয়ে গেল চাচার, চান নেই, খাওয়া নেই।দেখে সবাই ভয় পেল। মরে যাবে না তো লোকটা।

কিন্তু পাঁচ মাস বাদে ফিরে এল ইয়ান মিয়াও। শুধুই ফিরে এলো না, সঙ্গে নিয়ে এলো কুৎসিত যৌনব্যাধি, তবু এমন ভাবে এলো যেন কিছুই হয় নি, তাঁর গৌরব ক্ষুণ্ণ হয় নি এতটুকু, তাঁর স্থানে সে এখনও অটুট। কোন কথা জিজ্ঞেস করলেন না চাচা, নির্বিকার চিত্তে গ্রহণ করলেন। বুকে জড়িয়ে ধরে বললেন,– কোন জবাবদিহি চান না তিনি তাঁর কাছে, শুধু এইটুকু কথা চান সে যেন চাচাকে ছেড়ে আর না যায় কোথাও। ইয়ান মিয়াও মাথা নাড়ল। বলল,– যাবে না।

আবার সুস্থ হয়ে উঠল চাচা তারপর রেঙ্গুন থেকে বড় ডাক্তার আনল ইয়ান মিয়াওর চিকিৎসার জন্য। ধীরে ধীরে ভালো হয়ে উঠল ইয়ান মিয়াও। নরক থেকে ফিরে এলো সুস্থ জীবনেরে স্বর্গে। কিন্তু ফিরে কি এলো তাঁর হৃদয়? তার প্রেম? না।

দারোয়ান গেল। রেখে গেল চিহ্ন। রোগ। রোগ গেল ডাক্তারের দৌলতে, কিন্ত ডাক্তার গেল না। ডাক্তার জড়িয়ে পড়ল ইয়ান মিয়াওর জালে। ডাক্তার হল দ্বিতীয় শিকার।

রস্তমচাচা দেখেও কিছু বুঝতে পারতেন না, ঠেকেও কিছু শেখেন নি। শেষ পর্যন্ত মাস সাত ঘুরতে না ঘুরতে ইয়ান মিয়াও পালালো আবার। ডাক্তারের সঙ্গে। এবার রুস্তমচাচা খুঁজলেন না। কিছুই করলেন না যেন জমাট পাথর হয়ে গেছেন তিনি।

তারপর? চুপচাপ সময় কাটতে লাগল। রুস্তমচাচা কম কথা বলেন, হাসেন না, কাঁদেন না, যেন যন্ত্র বিশেষ। কাজের সময় নিঃশব্দে কাজ করেন, বাকী সময় চুপ করে থাকেন বোবার মতো।

দীর্ঘ ছ’বছর এমনি কেটে গেল। তারপর একদিন কাঠের ব্যবসা সংক্রান্ত কাজে চাচা মাণ্ডেলেতে এলেন? সঙ্গে রহমান মালী যথারীতি রয়েছে। আর মাণ্ডেলেতে তখন একটা কার্নিভাল চলছিল। চাচার বন্ধু জোর করে একদিন কার্নিভালে নিয়ে এলো চাচাকে। আর কার্নিভালের দরজায় দেখা গেল ইয়ান মিয়াওকে।

ছোট্ট একটা মেয়ে পাশে নিয়ে ভিক্ষা করছে। বছর তিন বয়েস মেয়েটির। ছেঁড়া কাপড়, বিশ্রী স্বাস্থ্য, জটবাঁধা চুল।
বিদ্যুৎশ্রী ইয়ান মিয়াও নয়, যেন তার কঙ্কাল।

চাচা ফের ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওর ওপর। জাড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেললেন হাউহাউ করে। বললেন,– তাকে ফিরে যেতেই হবে। কার্নিভালের সামনে সে এক দৃশ্য বটে। ইয়ান মিয়াও কিছু তেই যাবে না। ওর ভয় চাচা ওকে আর তার বাচ্চাকে মেরে ফেলে দেবে। কিন্তু চাচা ওর পা জড়িয়ে ধরল।

শেষ পর্যন্ত ফিরে এলো ইয়ান মিয়াও। মেয়ে সঙ্গে। কার মেয়ে? ইয়ান মিয়াও লুকোল না। জানাল, এ মেয়ে সেই ডাক্তারের। রুস্তমচাচা আর শুনতে চান নি কিছু। বলেছিলেন শুধু—হোক্, তবু এ তাঁরও মেয়ে। মেয়েকে রুস্তমচাচা ভালোবাসতে শুরু করলেন। কিন্তু ইয়ান মিয়াওর ভয় কিছুতেই কাটে না। ওর বিশ্বাস মেয়েকে কোন এক সময় মেরে ফেলবে চাচা। সে ভুল ভাঙানোর আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন চাচা, পারেন নি।

অ্যাকসিডেন্ট ঘটল এক বছর বাদে। মেয়েকে নিয়ে ইরাবতীতে নৌকোয় চড়ে বেড়াতে বেরিয়েছিলান চাচা। প্রচণ্ড ঝড় উঠল সেদিন। ঝড়ের অনেক পরে চোরের মতো ফিরে এলেন চাচা। একা।

নৌকাডুবি হয়েছিল। নিজে বেঁচেছেন কিন্তু মেয়েকে খুঁজে পান নি। মেয়েটি মারা গেল সেই ঝড়ে। তোলপাড় করে খুঁজেছিলেন। পান নি।

সে রাতের কথা বলতে গিয়ে কেমন শিউরে শিউরে উঠছিল রহমান।

মেয়ের মৃত্যুর খবর পেয়ে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল ইয়ান মিয়াও। বলল,–সব মিথ্যে, আসলে চাচা তাঁকে খুন করে এসেছে। কি?—হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন চাচা। ইয়ান মিয়াওর ওপর এই তার প্রথম ক্রোধ। এই তার শেষও।

–যা বললাম তাই। তুমি খুন করেছো।
হিংস্র বাঘের মতো ঝাঁপিয়ে পড়লেন চাচা। দুই হাতে নিষ্ঠুরভাবে গলা ধরলেন ইয়ান মিয়াওর, বললেন, আর বলবি?

ইয়ান মিয়াও-ও বর্মার মেয়ে। তাঁরও জেদ কম নয়। সে অবস্থাতেই চেঁচিয়ে সে বলে চলল,– বলব, বলবই। খুনী, তুমি খুনী-খুনী। ব্যস, আর বলতে পারি নি। দুটি লৌহকঠিন নিষ্ঠুর হাতের পেষণে সে গলা চিরদিনের মতো স্তব্ধ হয়ে গেল। এই সমস্ত ঘটনাটা রহমান নিঃশব্দে দেখল। বাধা দিল না। ইচ্ছা করেই।

ইয়ান মিয়াওকে গলা টিপে মারলেন চাচা। শেষ করে দিলেন তাঁর ব্যর্থ জীবনের জন্য দায়ী সর্বনাশীকে। রাতারাতি মৃতদেহ কবর দেওয়া হল জঙ্গলের গভীরে। চাচা আর রহমান দু’জনে। সেদিন সতেরোই এপ্রিল।

তারপর দিন কাটতে লাগল। সব ঠিক হয়ে গেল ক্রমশ। শুধু মাঝে মাঝে সিন্দুক খুলে মেয়ের জামা কাপড়, খেলনা বুকে চেপে ধরে কাঁদেন চাচা। মেয়েকে বড় ভালোবাসতেন তিনি।

তাই তাঁর মৃত্যুতে সত্যিকারের কষ্ট পেয়েছেন। মেয়ের কথা মনে পড়লে সামলাতে পারতেন না নিজেকে। আর সতোরোই এপ্রিলের বিভীষিকা। এ তারিখে রাত্তিরে চেঁচিয়ে ওঠেন চাচা ভয়ে। স্বপ্নে নাকি দেখেন মেয়ে ইরাবতী থেকে উঠে এসেছে। মা’র সঙ্গে দেখা করতে, আর যে ঘরের ভেতর ইয়ান মিয়াওকে খুন করেছিলেন সে ঘরের দরজায় ধাক্কা দিচ্ছে আর ডাকছে মা মা বলে।
ভেতর থেকে নাকি ইয়ান মিয়াও-ও ‘আসছি মা’ বলে দরজা খোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, পারছে না।

এ স্বপ্ন দেখেই আর্তস্বরে চেঁচিয়ে ওঠেন চাচা, তারপর জেগে উঠেই টর্চ নিয়ে ছোটেন ওপরের ঘরে, দেখতে। কিন্তু কিছুই দেখতে পান না। দরজার বাইরে কেউ নেই, মরচে-ধরা তালা তেমনি ঝুলছে, ঘরের ভেতরেও কোন সাড়াশব্দ নেই। শুধু রাত্রির বাতাস

বয়ে যাচ্ছে শিরশির করে গাছের পাতা কাঁপিয়ে। দুঃস্বপ্ন। দুঃস্বপ্ন মাত্র। কিন্তু সতেরোই এপ্রিলের জন্য এই দুঃস্বপ্ন তাঁর বাঁধা। অন্য সময় বেশ ভালো মানুষ। কে বলবে রুস্তমচাচার জীবনে এত সব ইতিহাস রয়েছে, এত বিচিত্র ঘটনাবহুল জীবন তাঁর।
মৃত্যুটা মর্মান্তিক। সতেরোই এপ্রিল অনেক কেটেছে।

কিন্তু সেদিন ছিল ঠিক প্রথম দুর্ঘটনার দিনের মতো ঝড়ো সতেরোই এপ্রিল। প্রচণ্ড ঝড়ে তোলপাড় করছিল সব। গাছপালাগুলো যেন আছড়াচ্ছিল মাটিতে, বিদ্যুৎ চমকাচ্ছিল নীল তীব্র দ্যুতিতে, অঝোর বৃষ্টি, বজ্রের হুঙ্কার; প্রকৃতি যেন তাণ্ডবে মেতে ছিল সেদিন।

সেই ঝড়ের মধ্যে নিয়মিত হাতছানিতেই বুঝি রুস্তমচাচা বেরিয়ে পড়েছিলেন। কেউ জানতে পারে নি, রহমান মালীও নয়।

হয়তো মেয়েকে খুঁজতেই গিয়েছিলেন ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ ইরাবতীতে। আর ফেরেন নি। মৃতদেহ জলে ভাসতে দেখা গিয়েছিল তিনদিন বাদে।

রহমান মালীর কাছে এ গল্প শোনার পর সমস্ত রহস্যের মর্মোদ্ধার করতে পারলাম। বুঝলাম সতেরোই এপ্রিলের গুপ্ত কথা। কেন সেদিন ও সিন্দুক খুলে জামাকাপড় পরাতে ছোড়দির ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন চাচা, কেন আমাকে মেরেছিলেন বদ্ধ দোতলায় ঘরটায় ঢোকাতে, সবই পরিষ্কার হয়ে গেল।

কিন্তু একটা জিনিস আজও আমি বুঝতে পারি নি—সত্যি সত্যি কি ইয়ান মিয়াওকেই ভালোবাসতেন রুস্তমচাচা? নাকি নিজের ভালোবাসার অহমিকাকে?…..ইয়ান মিয়াওর কাছেই হেরে গিয়ে-ছিলেন রুস্তমচাচা, না নিজের কাছে?..এ রহস্যের কিনারা আমি আজো করতে পারি নি।

[ রুস্তমচাচা – শচীন ভৌমিক [ প্রিয় গল্প সংগ্রহ ] Rustamchacha -Sachin Bhowmick ]

শচীন ভৌমিক কে আরও পড়ুন:

Leave a Comment