বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, January]

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস – সংগ্রহশালা তৈরির চেষ্টা চলছে। হাতে যা ছিল আপলোড করে রাখলাম। পরবর্তীতে যুক্ত করা হবে।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, January]

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি লন্ডনের হোটেলে সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[বর্বর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাত থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে নৃশংস অত্যাচার চালায়। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিয় শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপ্রধান করে স্বাধীন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকার শত্রুর মোকাবিলা করতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা মাতৃভূমির মুক্তির জন্যে প্রাণপন যুদ্ধে লিপ্ত হয়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বিমান কয়েকটি ভারতীয় শহরে বোমা বর্ষণ করে। ভারতও পাল্টা আক্রমণ করে। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করেন।

Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman : বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাস

পরদিন ভূটানও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ঢাকায় বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করে। বাংলাদেশ পাক দখলদার বাহিনীর হাত থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত হয়। ইয়াহিয়া খান বাধ্য হলেন ভূট্টোকে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে। ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ৩ জানুয়ারী, ১৯৭২ করাচীর এক জনসভায় ঘোষণা করলেন, শেখ মুজিবকে বিনাশর্তে মুক্তি দেয়া হবে। ৬ জানুয়ারী ভুট্টো জানালেন, শেখ সাহেবকে ঢাকায় ফেরার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগ নেতা ডঃ কামাল হোসেনকে লন্ডনে পাঠানো হয়। ভুট্টো বিমানবন্দরে বঙ্গবন্দুকে বিদায় জানান। ৮ জানুয়ায়ী ভোরে বঙ্গবন্ধু লন্ডনে পৌঁছে সাংবাদিকদের কাছে একটি বিবৃতি প্রদান করেন। তাঁর হোটেলে সমবেত জনাকীর্ণ সাংবাদিকদের সামনে তিনি ইংরেজিতে বিবৃতি পাঠ করেন। বিবৃতির বঙ্গানুবাদ দেয়া হলো।]

জয় বাংলা!

বাংলার মুক্তি সংগ্রামে আজ আমি স্বাধীনতার অপরিসীম ও অনাবিল আনন্দ অনুভব করছি। এই মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লক্ষ্য ছিল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমার জনগণ যখন আমাকে বাংলাদেশের ‘রাষ্ট্রপতি’ হিসেবে ঘোষণা করেছে তখন আমি ‘রাষ্ট্রদ্রোহ’ এর দায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামী হিসেবে একটি নির্জন ও পরিত্যক্ত সেরে বন্দি জীবন কাটাচ্ছি।

বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্যে ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, পোল্যান্ড, ফ্রান্স ও ব্রিটেনকে আমি ধন্যবাদ জানাই। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সমর্থন দানকারী মার্কিন জনগণ ও অন্যান্য জনসাধারণকেও আমি ধন্যবাদ জানাই। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ এখন একটি বাস্তব সত্য। এ দেশকে বিশ্বের স্বীকৃতি দিতে হবে। বাংলাদেশ অবিলম্বে জাতিসংঘের সদস্য পদের জন্য অনুরোধ জানাবে।

পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ আমার বিরুদ্ধে বিচারের নামে এক প্রহসন অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। শুনানি অর্ধেক সমাপ্ত হবার পর পাক কর্তৃপক্ষ আমার পক্ষ সমর্থনের জন্যে একজন আইনজীবি নিয়োগ করে। আমি কারাগারের অন্ধ প্রকোষ্ঠে ‘বিশ্বাসঘাতক’এর কলঙ্ক নিয়ে মৃত্যুদন্ডের জন্যে অপেক্ষা করছিলাম। কিন্তু সবচেয়ে বিস্মময়, আমার বিচারের জন্যে যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছিল তার রায় কখনো প্রকাশ করা হবে না। সাবেক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বিচারের নামে প্রহসন অনুষ্ঠান করে আমাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানোর ফন্দি এঁটেছিলেন। কিন্তু ভুট্টো এই মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে অস্বীকার করেন।

জনাব ভুট্টো আমাকে না বলা পর্যন্ত স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিজয় সম্পর্কে আমি কিছুই জানতাম না। জেলখানা এলাকায় বিমান আক্রমণের জন্যে নিষ্প্রদীপ জারি করার পর আমি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের কথা জানতে পারি। জেলখানায় আমাকে এক নিঃসঙ্গ ও নিকৃষ্টতম কামরায় বন্দি করে রাখা হয়েছিল, যেখানে আমাকে তারা কোন রেডিও, কোন চিঠিপত্র দেয় নাই। এমনকি বিশ্বের কোথায় কি ঘটছে, তা জানতে দেয়া হয় নাই।

স্বাধীনতা সংগ্রামে বাংলাদেশের জনগণের মতো এত উচ্চমূল্য, এত ভয়াবহ ও বিভীষিকাময় জীবন ও দুর্ভোগ আর কোন দেশের মানুষকে ভোগ করতে হয় নাই। বাংলাদেশে নির্মম হত্যাকান্ড ঘটানোর জন্যে পাকিস্তানী সৈন্যরা দায়ী। হিটলার যদি আজ বেঁচে থাকতো, বাংলাদেশের হত্যাকান্ডে সেও লজ্জা পেতো।

প্রেসিডেন্ট ভুট্টো আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে যে কোন একটি সম্পর্ক বজায় রাখার ব্যাপারটি বিবেচনা করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। আমি তাঁকে বলেছি, আমার দেশবাসীর সাথে আলাপ-আলোচনা না করে আমি কোন কিছু বলতে পারবো না।

আমি আর এক মূহুর্তে এখনে থাকতে রাজি নই। আমি আমার জনগণের কাছে ফিরে যেতে চাই।

[সূত্র ঃ দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক বাংলা ও পূর্বদেশ; ৯ জানুয়ারী,১৯৭২]

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ভারতের পালাম বিমান বন্দরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সকারে ব্রিটেনের রাজকীয় বিমানবাহিনীর একটি বিশেষ বিমানে করে বঙ্গবন্ধু নয়াদিল্লির পালাম বিমানবন্দরে পৌঁছলে রাষ্ট্রপতি ভি.ভি. গিরি এবং প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতিকে স্বাগত জানালেন। বিমানবন্দরে ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের বঙ্গানুবাদ।]

আমার জন্যে এটা পরম সন্তোষের মুহূর্ত। বাংলাদেশের যাবার পথে আমি আপনাদের মহতী দেশের ঐতিহাসিক রাজধানীতে যাতাবিরতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি এ কারণে যে, আমাদের জনগণের সবচেয়ে বড় বন্ধু ভারতের জনগণ এবং আপনাদের মহীয়সী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী-যিনি কেবল মানুষের নয় মানবতারও নেতা, তাঁর নেতৃত্বাধীন ভারত সরকারের কাছে এর মাধ্যমে আমি আমার নূন্যতম ব্যক্তিগত কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারব। এ অভিযাত্রা সমাপ্ত করতে আপনারা সবাই নিরলস পরিশ্রম করেছেন এবং বীরোচিত ত্যাগ স্বীকার করেছেন।

এ অভিযাত্রা অন্ধকার থেকে আলোয়, বন্দিদশা থেকে স্বাধীনতায়, নিরাশা থেকে আশায় অভিযাত্রা। অবশেষে, আমি নয় মাস পর আমার স্বপ্নের দেশ সোনার বাংলায় ফিরে যাচ্ছি। এ নয় মাসে আমার দেশের মানুষ শতাব্দীর পত পাড়ি দিয়েছে। আমাকে যখন আমার মানুষের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল, তখন তারা কেঁদেছিল; আমাকে যখন বন্দি করে রাখা হয়েছিল, তখন তারা যুদ্ধ করেছিল আর আজ যখন আমি তাদের কাছে ফিরে যাচ্ছি, তখন তারা বিজয়ী।

আমি ফিরে যাচ্ছি তাদের নিযুত বিজয়ী হাসির রৌদ্রকরে। আমাদের বিজয়কে শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করার যে বিরাট কাজ এখন আমাদের সামনে তাতে যোগ দেয়ার জন্যে আমি ফিরে যাচ্ছি আমার মানুষের কাছে।

আমি ফিরে যাচ্ছি আমার হৃদয়ে কারো জন্যে কোন বিদ্বেষ নিয়ে নয়, বরং এ পরিতৃপ্তি নিয়ে যে, অবশেষে মিথ্যার বিরুদ্ধে সত্যের অপ্রকৃতিস্থতার বিরুদ্ধে প্রকৃতিস্থতার, ভীরুতার বিরুদ্ধে সাহসিকতার, অবিচারের বিরুদ্ধে সুবিচারের এবং অশুভের বিরুদ্ধে শুভের বিজয় হয়েছে। জয় বাংলা! জয় হিন্দু।

[সূত্র : টাইমস অব ইন্ডিয়া, নয়াদিল্লি, ১৩ জানুয়ারি,১৯৭২

 

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী ভারতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

আপনাদের প্রধানমন্ত্রী, আপনাদের সরকার, আপনাদের সেনাবাহিনী, আপনাদের জনসাধারণ যে সাহায্য সহানুভূতি আমার দুঃখী মানুষকে দেখিয়েছে, চিরদিন বাংলার মানুষ তা ভুলতে পারবে না। ব্যাক্তিগত ভাবে আপনারা জানেন, আমি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্ধকার সেলের মধ্যে বন্দি ছিলাম দু দিন আগেও। শ্রীমতি গান্ধী আমার জন্য দুনিয়ার এমন কোন জায়গা নাই, যেখানে চেষ্টা করেন নাই আমাকে রক্ষা করার জন্য। আমি ব্যাক্তিগত ভাবে তাঁর কাছে কৃতজ্ঞ। আমার সাড়ে সাতকোটি মানুষ ব্যাক্তিগতভাবে তার কাছে কৃতজ্ঞ।

আমার জনসাধারণ ভারতবর্ষের জনসাধারণের কাছে কৃতজ্ঞ। আর যেভাবে এক কোটি মানুষের থাকার ব্যবস্থা, রাকার বন্দোবস্ত আপনারা করেছেন- আমি জানি ভারতবর্ষের মানুষও দুখে আছে, এখানে তারাও কষ্ট পাচ্ছে, তাদেরও অভাব আছে, তা থাকতেও তারা সর্বস্ব দিয়েছে আমার লোকেরে সাহায্য করার জন্য। চিরদিন আমরা তা ভুলতে পারব না।

আমরা আশা করি, আপনারা জানেন, আজ বাংলাদেশ শেষ হয়ে গেছে। আমি আরো সাহায্য সহযোগিতা আশা করি এবং এও আশা করি, দুনিয়ার যত শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক মানুষ আছে তারা এগিয়ে আসবে আমার মানুষকে সগযোগিতা করার জন্য। আমি বিশ্বাস করি সেকুলারিজমে, আমি বিশ্বাস করি গণতস্ত্রে, আমি বিশ্বাস করি সোস্যালিজমে। আমাকে প্রশ্ন করা হয়, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আপনার আদর্শের এত মিল কেন? আমি বলি এটা আদর্শের মিল, এটা নীতির মিল, এটা মনুষত্বের মিল, এটা বিশ্ব শান্তির মিল।

(সিডি শুনে লেখা হয়েছে)

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারী স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে সোহরাওয়ার্দি উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ

[বঙ্গবন্ধু ভারতের রাজধানীতে পৌঁছার সাথে সাথে বাংলাদেশে অপেক্ষামান লক্ষ লক্ষ মানুষের উত্তেজনা ও উৎকণ্ঠা আরো বেড়ে যায়। বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে বঙ্গবন্ধু দিল্লীতে একটি জনসভায় বক্তৃতা করেন এবং রাষ্ট্রপতি ভবনে যান। এই জনসভায় বঙ্গবন্ধু প্রথমে ইংরেজিতে তার বক্তৃতা শুরু করলেও শ্রোতাদের অনুরোধে পরে বাংলায় বলেন।

ইতোমধ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষ দীর্ঘ নয় মাস পর তাদের অবিসংবাদী নেতার বক্তৃতা শোনার জন্যে ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হয়। ১০ জানুয়ারি অপরাহ্নে বৃটিশ রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি বিশেষ বিমানযোগে বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করেন। অতি কষ্টে জাতির জনককে একটি খোলা ট্রাকে করে বিমানবন্দ থেকে সারা পথ প্রচন্ড ভিড়ের মধ্যে দিয়ে রেসকোর্সে আনা হয়। রেসকোর্সে পৌঁছুতে ট্রাকটির প্রায় আড়াই ঘন্টা সময় লাগে। ১০ জানুয়ারী ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর ভাষণের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো।]

যারা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন, যারা বর্বর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছেন, তাদের আত্মার প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই।

ভাইয়েরা আমার, লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রাণ দানের পর আজ আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম। তোমরা আমার সালাম নাও।

আমার বাংলায় আজ এক বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীনতা এসেছে। ৩০ লক্ষ লোক মারা গেছে। আপনারাই জীবন দিয়েছেন, কষ্ট করেছেন। আমাকে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল। কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে, খেয়ে-পরে সুখে থাকবে, এটাই ছিল আমার সাধনা। বাংলার এক কোটি লোক প্রাণভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের খাবার, বাসস্থান দিয়ে সাহায্য করেছে ভারত। আমরা ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, ভারত সরকার ও ভারতবাসীকে আমাদের অন্তরের অন্তস্থল থেকে জানাই কৃতজ্ঞতা। বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ব্রিটিশ, জার্মান, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন জনগণকে আমি ধন্যবাদ জানাই।

গত ৭ই মার্চ আমি রেসকোর্সে বলেছিলাম দুর্গ গড়ে তোলো। আজ আবার বলছি, আপনারা এ কথা বজায় রাখুন। আমি বলেছিলাম, ‘বাংলাদেশকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ।’ বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। একজন বাঙ্গালী বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীন দেশরূপেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে দাবায়ে রাখতে পারে এমন কোনো শক্তি নাই।

গত দশ মাসে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাংলাকে বিলীন করেছে। বাংলার লাখো লাখো মানুষের আজ খাবার নাই, অসংখ্য মানুষ গৃহহারা। এদের জন্য মানবতার খাতিরে আমরা সাহায্য চাই। বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আমি সাহায্যের আবেদন জানাই। বিশ্বের সকল মুক্ত রাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি-বাংলাকে স্বীকৃতি দিন। আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় অত্যন্ত ভালবাসি। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন- ‘সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙ্গালি করে মানুষ করোনি।’ কবিগুরুর এই আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। বাঙ্গালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা মানুষ, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা এবার করেছে যার নজির ইতিহাসে নাই।

আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসাবে বলছি, যদি দেশবাসী খাবার না পায়, যুবকরা চাকরি বা কাজ না পায়, তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে- পূর্ণ হবে না। তোমরা আমার ভাইয়েরা, গেরিলা হয়েছিলে দেশমাতার মুক্তির জন্য। তোমরা রক্ত দিয়েছ। তোমাদের রক্ত বৃথা যাবে না।

তোমরা বাংলায় যারা কথা বলো, তারা এখন থেকে বাংলার মানুষ হও। ভাইয়েরা, তাদের গায়ে হাত দিও না, তারাও আমাদের ভাই। বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই, বাঙ্গালিরা কেবলমাত্র স্বাধীনতার জন্যই আত্মত্যাগ করতে পারে, তাই না, তারা শান্তিতেও বাস করতে পারে।

কিন্তু ইয়াহিয়া সরকারের সাথে যারা সক্রিয়ভাবে সহায়তা করেছে তাদের  বিরুদ্ধে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদের বিচার হবে। সে ভার সরকারের উপর ন্যস্ত রাখুন। ইয়াহিয়া খান আমার ফাঁসির হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙ্গালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙ্গালিরা একবার মরতে জানে। তাই বলেছি, ক্ষমা চাই না। তাদের বলেছি, তোমরা মারলে ক্ষতি নাই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌঁছে দিও।

মার্চের সেই রাতে আমাকে কেড়ে নেবার সময়ে আমার সহকর্মী তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল ও অন্যরা কাঁদছিলেন। কিন্তু আমি বলেছি, এখানেই আমি মরতে চাই। তবুও মাথা নত করতে পারবো না। আমি তাদের বলেছিলাম, তোমরা নির্দেশ মতো সংগ্রাম চালিয়ো। তারা সে ওয়াদা পালন করেছে।

বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। কিন্তু আজ আমাদের সামনে অসংখ্য সমস্যা আছে, যার আশু সমাধান প্রয়োজন। বিধ্বস্ত বাংলাকে নতুন করে গড়ে তুলুন। নিজেরা সবাই রাস্তা তৈরি করতে শুরু করুন। যার যার কাজ করে যান।

পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমার কোনো ক্ষোভ নেই। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা- আপনারা অসংখ্য বাঙ্গালিকে হত্যা করেছেন, অসংখ্য বাঙ্গালি মা-বোনের অসম্মান করেছেন, তবু আমি চাই আপনারা ভাল থাকুন।

আমি আজ বক্তৃতা দিতে পারবো না। ওরা আমার লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে, এমন গ্রাম নাই যেখানে আগুন দেয় নাই, সেখানে মা-বোনদের ইজ্জত নষ্ট করে নাই। আজ বহু ছাত্র, যুবক, বুদ্ধিজীবী, সহকর্মীকে আমি দেখছি না। এত বেসামরিক লোককে হত্যা করার নজীর আর নাই। প্রথম মহাযুদ্ধ, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধেও এত বেসামরিক লোক মরে নাই।

সকলে জেনে লাখুন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম ও ভারত তৃতীয়। বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোনো ধর্মীয় ভিত্তিক হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে আমি চিনি। তাকে আমি জানাই আমার শ্রদ্ধা। তিনি পন্ডিত জহরলাল নেহেরুর কন্যা, পন্ডিত মতিলাল হেরেুর নাতনী। তার রক্তে মিশে আছে রাজনীতি। তিনি ব্যক্তিগতভাবে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে আমার মুক্তির জন্য আবেদন করেছেন। আমার সাথে দিল্লীতে শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর আলাপ হয়েছে। আমি যখনই বলব, ভারতীয় সেনাবাহিনী তখন দেশে ফেরত যাবে। এখনই আস্তে আস্তে অনেককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে অংশগ্রহণকারী সকল শ্রেণীর জনতাকে আমি পরম কৃতজ্ঞতার সাথে সালাম জানাই। সালাম জানাই, মুক্তি বাহিনীকে, গেরিলা বাহিনীকে, কর্মী বাহিনীকে। আমি সালাম জানাই সংগ্রামী শ্রমিক শ্রেণীকে, কৃষককুলকে, বুদ্ধিজীবীদের। বাংলাদেশকে একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে গড়ে তুলতে হবে। একটি লোককেও আর না খেয়ে মরতে দেওয়া যাবে না। সকল রকমের ঘুষ লেনদেন বন্ধ করতে হবে।

আমি ফিরে আসার আগে ভুট্টো সাহেব অনুরোধ করেছেন, দুই অংশের মধ্যে ব্যবধান সামান্য হলেও রাখা যায় কিনা। আমি তখন বলেছিলাম আমি আমার মানুষের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারছি না। আজ আমি বলতে চাই-ভুট্টো সাহেব, আপনারা সুখে থাকুন। আপনাদের সাথে আর না। মরে যাবে, তবুও বাঙ্গালি আর স্বাধীনতা হারাতে পারে না। আমি আপানাদের মঙ্গল কামনা করি। আপনারা স্বাধীন দেশকে মেনে নিন। আপনারা স্বাধীনভাবে থাকুন।

গত ২৫শে মার্চ থেকে এ পর্যন্ত দীর্ঘ নয় মাসে বর্বর হানাদার বাহিনী দেশের প্রায় সব বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে। তারা আমার মানুষকে হত্যা করেছে। হাজার হাজার মা-বোনের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। বিশ্ব এসব ঘটনার সামান্য কিছুমাত্র জানে। বিশ্বকে মানব ইতিহাসের জঘন্যতম কুকীর্তির তদন্ত অবশ্যই করতে হবে। একটি নিরপেক্ষ আন্তজাতিক দল বর্বর পাক বাহিনীর কার্যকলাপের সুষ্ঠু তদন্ত করুক। জাতিসংঘের উচিত অবিলম্বে বাংলাদেশকে আসন দিয়ে তার ন্যায়সঙ্গত দাবী পূরণ করা।

জয় বাংলা॥ বাংলাদেশ-ভারত ভাই ভাই॥

সংগ্রহ- সিডি থেকে।

১৯৭২ সালের ১৬ জানুয়ারীতে প্রসিডেন্ট ভবনে বাস্তুহারাদের উদ্দেশ্যে বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা

আমার ভাইয়েরা ও বোনেরা

আপনারা একটু শান্ত হন। আপনারা কষ্ট করে না আসলেও পারতেন। আমি জানি, যে রাত্রে আমাকে গ্রেফতার করে, সে রাত্রে আপনাদের গর-বাড়ি সব জ্বালাইয়া দেওয়া হয়। আমাকে যখন গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়, তখন আমি দেখতে পেয়েছিলাম যাদের ঘর নাই, ছোট ছোট কুড়ে ঘর বানাইয়া আছে সেগুলোও জালিম পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর লোকগুলো পুড়াইয়া দিয়াছিল।

আমি জানি, আজ স্বাধীনতা পেয়েছি, আপনারা আজ স্বাধীন দেশের নাগরিক কিন্তু কত রক্ত দিতে হয়েছে তার হিসাব নাই। কোন দেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে ত্রিশ লক্ষ লোক মৃত্যুবরণ করে নাই। লক্ষ লক্ষ ঘর বাড়ি জ্বালাইয়া দেয়া হয়েছে। জালিমের দল চলে গিয়াছে সত্য, আমার দেশের সাতকোটি লোককে বাস্তুহারা করে গেছে। কিন্তু আমার মাটি আছে, আমার মানুষ আছে, আমার ঈমান আছে, আমার যা কিছু আছে তাই নিয়ে নতুন করে সোনার বাংলাকে নতুন করে গড়তে হবে এবং নতুন করে মানুষের জীবিকার বন্দোবস্ত করতে হবে।

ধৈর্য্যরে প্রয়োজন আছে। আপনারা শহরে আছেন, আমি আপনাদের বহু আগে বলেছিলাম আপনাদের জন্য শিঘ্রই আমি একটা বন্দোবস্ত করব। সেখানে আপনাদের সকলে একযোগে এক জায়গাতে আপনাদের বাসস্থানের বন্দোবস্ত করতে হবে। রাস্তা-ঘাট, এখানে-ওখানে বাড়ি-ঘর আপনারা যা করেছেন আপাতত থাকেন।

আমি আমার ছোট ভাইদের বলেছি, তোমরা তারাতারি একটা লিষ্ট বানও। কত আমার বাস্তুহারা ঢাকা শহরে আছে, তাদের জন্য আমি একটা জমি, এরিয়ার বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি, আপনারা সব সেখানে উঠে নেন। আপনারা সে জায়গায় থাকবেন, পরে আমি আপনাদের জন্য ঘর-বাড়ির কি ব্যবস্থা করতে পারি-দেখব। আপনারা ধৈর্য্য ধরেন, আপনাদের আইন শৃঙ্খলা মানতে হবে।

দেশের অর্থনীতি ভেঙ্গে চুরমার হয়ে গেছে। টাকা নাই, পয়সা নাই, চাল নাই, অর্থ নাই, খাবার নাই, জামা নাই, কিছুই নাই। কিছু কিছু সংখ্যক ব্যাসসায়ি জিনিস পত্রের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছে। তাদের জানা উচিৎ যে বাংলাদেশে স্বাধীন বাংলার সরকার দৃস্কৃতিকারীদের ক্ষমা করবে না। তাদের আমি অনুরোধ করছি, জিনিস পত্রের দাম বাড়াতে পারবে না। যাতে ন্যায্য মূল্যে আমার জনসাধারণ জিনিস পত্র পায় সেদিকে খেয়াল রাখবে, নইলে তোমাদের ভবিষৎ অন্ধকার হয়ে যাবে।

আমি আপনাদের কাছে বলব যে, আমি খবর পাই জায়গায় জায়গায় দু’এক জায়গাতে একজন আরেকজনকে অত্যাচার করা হয়। স্বাধীনতা মানে বিশৃক্ষলা নয় স্বাধীনতা মানে গুন্ডামি বদমায়েশি নয়, স্বাধীনতা মানে একজনের কাছ থেকে জুলুম করে পয়সা উপার্জন করা নয়, স্বাধীনতা মানে মানুষ, মুক্ত দেশের মুক্ত মানুষ স্ব-সম্মানে উজ্জতের সাথে বাস করবে। এই সমাজে শোষণমুক্ত সমাজ গড়ার অঙ্গিকার, প্রতিজ্ঞা আমি কখন করেছি- আমি কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে যখন এসেছি। লক্ষ লক্ষ মা-ভাই-বোন আমার জন্য জীবন দিয়েছে।

৩০ লক্ষ লোককে হত্যা করা হয়েছে। আমার মা-বোনদের উপর পাশবিক অত্যাচার করা হয়েছে। আমার দেশের মানুষের ঘর-বাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। স্কুল-কলেজ সব ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। যা করেছে-নমরুদ, ফেরাউন বোধ হয় লজ্জা পেত দেখলে, যা পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর লোকেরা করেছে।

চিন্তা নাই, আমার এত সুন্দর জনগণ, আমার এমন সোনার মানুষ আর আমার এমন সোনার বাংলাদেশ। ধৈর্য্য ধরে যদি কাজ করেন সকলে মিলে, ইনশাল্লাহ্ নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলতে পারব। আমার কোন লোভ নাই আপনারা জানেন। প্রধানমন্ত্রী আমি সারা পাকিস্তানের হতে পারতাম আপনারা জানেন। আপনারা আমাকে ভোট দিয়েছিলেন, প্রধানমন্ত্রীত্ব আমি চাই নাই, আমি চেয়েছিলাম ফাঁসি কাষ্ট। এইজন্য যে, আমি বাংলার মানুষকে অপমান করতে চাই না।

তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল, আপনারা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য চারদিকে নজর রাখবেন। একজন আরেকজনের উপর অত্যাচার করবেন না। আর দ্বিতীয় কথা আমার বাস্তুহারা ভাইরা, সাতকোটি মানুষ আজ বাস্তুহারা হয়ে গেছে। লক্ষ লক্ষ ঘর বাড়ি গ্রামে গ্রামে পুড়াইয়া দিয়াছে, এইজন্য বারবার আমি একথা বলছি, আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন যত তারাতারি হয় আপনাদের নিজের জায়গায় বন্দোবস্ত করে দিচ্ছি। এখানে-ওখানে রাস্তার পাশে থাকলে চলবে না, কারণ আপনাদের অসুবিধা জনগণের অসুবিধা, আপনাদের কষ্ট জনগণের কষ্ট।

একটা এরিয়া আমি দিব, যার মধ্যে আপনারা সুখে সাচ্ছন্দে এবং ঐ জায়গা আপনার নিজের জায়গা হবে। আমি এপিএসকে বলেছি, আমি ১৫ দিনের সময় দিলাম, ১৫ দিনের মধ্যে লিষ্ট করে তুমি আমার নিকট পৌঁছাইয়া দিবা। আমি আশা করি এক দুই মাসের মধ্যে এর সমাধান হবে। আপনারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক। আজ আমি দেখি আমার এই নীল আকাশের তলে সবুজ মাঠে ওই আমার জাতীয় পতাকা উড়ে। ঐ জাতীয় পতাকাকে আপনারা ছালাম দেন।

আল্লাহর উপর নির্ভর করে আপনারা দোয়া করেন, আমাদের সহকর্মীদের সকলে যেন ইমানের সঙ্গে রাখে এবং আপনাদের জন্য যেভাবে এদেশের যুবক ছেলেরা রক্ত দিয়েছে, সমস্ত দলের মুক্তিবাহিনীরা জীবন দিয়েছে, আমার সামরিক বাহিনীর ভাইয়েরা রক্ত দিয়েছে, পুলিশ রক্ত দিয়েছে, বুদ্ধিজীবীরা রক্ত দিয়েছে, মা-বোন রক্ত দিয়েছে। এই রক্ত যেন বৃথা না যায়। যারা রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা দিয়ে গেল, তাঁ মরে নাই। তাদের আত্মা বেঁচে আছে।

তারা দেখবে, তাদের আত্মা দেখবে যে বাংলার মানুষ সুখে বাস করছে কি না, বাংলার মানুষ পেট ভরে খাচ্ছে কি না, বাংলার মানুষ শান্তিতে বাস করছে কি না। ওদের আত্মা তখনই শান্তি পাবে যেদিন আপনারা পেট ভরে ভাত খাবেন, গায়ে আপনাদের কাপড় হবে, থাকার বন্দোবস্ত হবে, বেকার সমস্যা দূর হবে- সেদিনই আমি সেদিনই আপনাদের সত্যিকারের স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আপনাদের দাবী করতে পারব-এর আগে আপনাদের দাবী করার অধিকার আমার নাই। আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন। আমি বিদায় নিচ্ছি। বলেন জয়বাংলা।

সংগ্রহ- সিডি থেকে।

১৯৭২ সালের ১৮ জানুয়ারী নিউইয়র্কের সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া স্বাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু

ডেভিট ফ্রষ্ট-স্যার, সেই রাতের কথা আপনি বলুন। সেই রাত, যে রাতে একদিকে আপনার সঙ্গে যখন চলছিল আলোচনা এবং যখন সেই আলোচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আক্রমনে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সেই ২৫ মার্চ রাত আটটায় আপনি আপনার বাড়িতে ছিলেন। পাকিস্তানী বাহিনী আপনাকে গ্রেফতার করেছিল। আমরা শুনেছিলাম, টেলিফোনে আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল, কিন্তু আপনি বাড়ি পরিত্যাগ করলেন না। আপনি গ্রেপতার বরণ করলেন। কেন এই সিদ্ধান্ত?

শেখ মুজিব-হ্যাঁ, সে এক করুণ কাহিনী। সেটা বলা প্রয়োজন। সেদিন সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডো বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, ওরা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলোচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে।

আমি বাড়ী থেকে বেরুবো, নাকি বেরুবো না এই নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তানী বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি স্থির করলাম, আমি মরি, তাও ভালো, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।

ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনি হয়ত কলকাতা চলে যেতে পারতেন।

শেখ মুজিব- আমি ইচ্ছা করলে যে কোন জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাব? দেশবাসীর সাথে আমি সংগ্রাম করবো। মৃত্যুবরণ করবো। পালিয়ে কেন যাব? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল যেন তারা প্রতিরোধ গড়ে তোলে।

ডেভিট ফ্রাষ্ট- আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক ছিল। কারণ এই ঘটনাই বিগত ন’মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনাকে একটি বিশ্বাসের প্রতীকরূপে পরিণত করেছে। আপনি তো এখন তাদের কাছে প্রায় ঈশ্বরবৎ।

শেখ মুজিব- আমি তা বলিনে। কিন্তু একথা সত্য, তারা আমাকে ভালোবাসে। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালোবেসেছিলাম। আমি তাদের জীবনকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হানাদার বর্বর বাহিনী আমাকে সে রাতে আমার বাড়ি থেকে গ্রেফতার করলো। ওরা আমার নিজের বাড়ি ধ্বংস করে দিল।

আমার গ্রামের বাড়ি, সেখানে আমার ৯০ বছরের বৃদ্ধ পিতা এবং ৮০ বছরের বৃদ্ধা জননী ছিলেন। গ্রামের সে বাড়িও ধ্বংস করে দিল। ওরা গ্রামে ফৌজ পাঠিয়ে আমার বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বিতারিড়ত করে তাদের চোখের সামনে সে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। আমি বেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগ্য মানুষদের হত্যা করবে না। কিন্তু আমি জানতাম, আমাদের সংগঠনের শক্তি আছে।

আমি একটি সংগঠনকে জীবনব্যাপী গড়ে তুলেছিলাম। জনগণ তার ভিত্তি। আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রতি ইঞ্চিতে তোমরা লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, হয়তো এটাই আমার শেষ নির্দেশ। কিন্তু মক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তাদের লড়াই করতে হবে। লড়াই তাদের চালিয়ে যেতে হবে।

ডেভিট ফ্রষ্ট- আপনাকে ওরা ঠিক কীভাবে গ্রেফতার করেছিল? তখন তো রাত ১-৩০ ছিল? তাই নয় কি? তখন কী ঘটলো?

শেখ মুজিব- ওরা প্রথমে আমার বাড়ির ওপর মেশিনগান দিয়ে গুলি চালিয়েছিল।

ডেভিট ফ্রষ্ট-ওরা যখন এলো, তখন আপনি বাড়ির কোনখানে ছিলেন?

শেখ মুজিব- এই যেটা দেখছেন, এটা আমার শোবার ঘর। আমি তখন শোবার ঘরেই বসেছিলাম। প্রথমে সামনের দিক থেকে ওরা মেশিনগান চালাতে আরম্ভ করে। তারপর এদিক-ওদিক, সবদিক থেকে গুলি ছুড়তে আরম্ভ করে। জানালার ওপর গুলি চালায়। এগুলো সব তখন ধ্বংস করেছিল। আমি তখন আমার পরিবার পরিজনদের সঙ্গে ছিলাম। একটা গুলি আমার শোবার ঘরে এসে পড়ে। আমার ছ’বছরের ছোট ছেলেটি বিছানার ওপর তখন শোয়া ছিল। আমার স্ত্রী এই শোবার ঘরে দু’টি সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন।

ডেভিট ফ্রষ্ট- পাকিস্তানী বাহিনী কোনদিক দিয়ে  ঢুকেছিল?

শেখ মুজিব- সবদিক দিয়ে। ওরা জানালার মধ্য দিয়ে গুলি ছড়তে শুরু করে। আমি আমার স্ত্রীকে দু’টি সন্তানকে নিয়ে বসে থাকতে বলি। তারপর তার কাছ থেকে উঠে আমি বাইরে বেড়িয়ে আসি।

ডেভিট ফ্রষ্ট- আপনার স্ত্রী কিছু বলেছিলেন?

শেখ মুজিব- না, কোনো শব্দ উচ্চারণের তখন অবস্থা নয়। আমি শুধু তাকে একটি বিদায় ইঙ্গিত জানিয়েছিলাম। আমি দরজা খুলে বাইরে বেড়িয়ে ওদের গুলি বন্ধ করতে বলেছিলাম। আমি বললাম, তোমরা গুলি বন্ধ কর। আমি তো এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তোমরা গুলি করছ কেন? কি চাও তোমরা? তখন চারদিক থেকে ওরা আমার দিকে ছুটে এলো বেয়নেট উদ্যত করে। ওদের একজন অফিসার আমার বুক বরাবর অস্ত্র উচিয়ে ধরে। আরেক অফিসার তাদের থামিয়ে ছিল?

ডেভিট ফ্রষ্ট-একটা অফিসারই ওদের থামিয়ে ছিল?

শেখ মুজির- হ্যাঁ, ওই অফিসারটি থামিয়ে ছিল। ওরা তখন আমাকে টেনে গাড়িতে উঠাল নামাল। ওরা পেছন থেকে আমার গায়ে, পায়ে বন্দুকের বাট দিয়ে আঘাত করতে লাগল। অফিসারটা আমাকে ধরেছিল। তবু ওরা আমাকে ধাক্কা দিতে লাগল। আমি বললাম, তোমরা আমাকে টানছো কেন? আমিতো যাচ্ছি।

আমি বললাম, আমার তামাকের পাইপটা নিতে দাও। ওরা একটু থামল। আমি ওপরে গিয়ে আমার তামাকের পাইপটা নিয়ে এলাম। আমার স্ত্রী তখন দুই ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাকে কিছু কাপড়-জোপড়সহ একটি ছোট সুটকেস দিলেন। তাই নেয় আমি নেমে এলাম। চারদিকে তখন আগুন জ্বলছিল।

ডেভিট ফ্রষ্ট- আপনার ৩২ নম্বর ধানমন্ডির বাড়ি থেকে সেদিন যখন আপনি বেড়িয়ে এলেন, তখন কি ভেবেছিলেন আর কোনোদিন আপনি এখানে ফিরে আসতে পারবেন?

শেখ মুজিব-না, আমি তা কল্পনা করতে পারিনি। আমি ভেবেছি, এই হয়তো শেষ, কিন্তু আমার মনের কথা ছিল, আজ আমি যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তর লজ্জার কোনো কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পন করলে, আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে তাকাতে পারবে না। আমি মরি, তাও ভালো। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোনো হানি না ঘটে।

ডেভিট ফ্রষ্ট- শেখ সাহেব, আপনি একবার বলেছিলেন, যে মানুষ মরতে রাজি, তুমি তাকে মারতে পার না। কথাটি কি এমন ছিল না?

শেখ মুজিব- হ্যাঁ,আমি তাই মনে করি। যে মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। তবেতো তার দেহ নিথর হবে, কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারবেন? না, তা কেউ পারে না। এটাই আমার বিশ্বা। আমি একজন মুসলমান এবং মুসলমান একবারই মরে, দু’বার নয়। আমি মানুষ। আমি মানুষকে ভালোবাসি। আমি আমার জাতির নেতা।

আমি আমার দেশের মানুষকে ভালোবাসি। আজ তাদের কাছে আমার আর কিছু দাবি নেই। তারা আমাকে ভালোবেসেছে। আমার জন্য তাদের সবকিছুকে বিসর্জন দিয়েছে। কারণ, আমি আমার সব কিছুই তাদের দেয়ার অঙ্গীকার করেছি। আজ আমি তাদের মুখে হাসি দেখতে চাই। আমি যখন আমার প্রতি আমার দেশবাসীর স্নেহ-ভালোবাসার কথাভাবি, তখন আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।

ডেভিট ফ্রষ্ট- পাকিস্তানি বাহিনী আপনার বাড়ির সবকিছুই লুট করে নিয়েছিল?

শেখ মুজিব- হ্যাঁ, আমার সবকিছুই ওরা লুট করেছে। আলমারি, কাপড়-চোপড় সবকিছুই লণ্ঠিত হয়েছে। মিস্টার ফ্রষ্ট, আপনি দেখতে পাচ্ছেন, এ বাড়ির কোনো কিছুই আজ নেই।

ডেভিট ফ্রষ্ট- আপনার বাড়ি যখন মেরামত হয়, তখন এসব জিনিস লন্ঠিত হয়েছে, না পাকিস্তানিরা সব লুণ্ঠন করেছে?

শেখ মুজিব- পাকিস্তানী ফৌজ আমার সবকিছু লুণ্ঠন করেছে। কিন্তু এই বর্বর বাহিনী আসবাব-পত্র, কাপড়-চোপড়, আমার সন্তানদের দ্রব্য-সামগ্রী লুণ্ঠন করেছে তাতে আমার দুঃখ নেই। আমার দুঃখ, ওরা আমার জীবনের ইতিহাসকে লুণ্ঠন করেছে। আমার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের দিনলিপি ছিল। আমার একটি সুন্দর লাইব্রেরী ছিল। বর্বররা আমার প্রত্যেকটিরই মূল্যবান দলিল-পত্র লুণ্ঠন করেছে। সবকিছুই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-তাই আবার সেই প্রশ্নটা আমাদের সামনে আসে। কেন ওরা সব কিছু লুণ্ঠন করল?

শেখ মুজিব- এর কি জবাব দেব? আসলে ওরা মানুষ নয়। কতগুলো ঠগ, দস্যু, উন্মাদ, অমানুষ আর অসভ্য জানোয়ার। আমার নিজের কথা, ছেড়ে দিন। তা নিয়ে আমার কোন ক্ষোভ নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, ২ বছর, ৫ বছরের শিশু, মেয়েরা কেউ রেহাই পেল না। সব নিরীহ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। আপনি অবশ্যই দেখেছেন জ্বালিয়ে দেয়া পোড়া বাড়ি, বস্তি। একেবারে গরীব, না খাওয়া মানুষ বসবাস করতো এই বস্তিতে। সেগুলোকে ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। বস্তিতে আগুন দিয়েছে। বস্তির মানুষ জীবন নিয়ে পালাতে চেয়েছে। আর সেইসব মানুষের ওপর চারদিক থেকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-কী আশ্চর্য! ওদের ঘরে আগুন দিয়ে, ঘর থেকে বের করে খোলা জায়গায় পলায়মান মানুষকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করেছে!

শেখ মুজিব-হ্যাঁ এমনিভাবে গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়েছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-কেন মানুষ মারল? তারা কেন পরোয়া করল না?

শেখ মুজিব- না তারা কোন পরোয়া করেনি।

ডেভিট ফ্রষ্ট-কেবল হত্যার জন্য হত্যা। যাকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে?

শেখ মুজিব-ওরা জানে প্রত্যেকেই শেখ মুজিবের মানুষ, তাই প্রত্যেককেই হত্যা করেছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনি যখন দেখেন, মানুষ মানুষকে এমনিভাবে হত্যা করছে, তখন আপনি কি মনে করেছেন। আপনি কি মনে করেছেন মানুষ আসলেই ভালো, না খারাপ।

শেখ মুজিব- ভালো-মন্দ সর্বত্রই আছে। মনুষ্যত্ব আছে এমন মানুষ আমি অনেক দেখেছি। কিন্তু আমি মনে করি পশ্চিম পাকিস্তানের ঐ ফৌজগুলো মানুষ নয়, পশুর চেয়ে অধম। মানুষের যে পাশবিক চরিত্র নেই তা নয়। কিন্তু মানুষ যে পশুর অধম হয় কি করে। ওই বাহিনীতো পশুর চেয়েও অধম। কারণ একটা পশু আক্রান্ত হলেই কিন্তু আক্রমণ করে, না হয় করে না। পশু যদি মানুষকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে, তবু সে তাকে অত্যাচার করে না। কিন্তু এই বর্বরের দল আমার দেশবাসিকে কেবল হত্যাই করেনি। দিনের পর দিন মানুষকে অত্যাচার করেছে। ৫ দিন ৭দিন ১৫ দিন নির্মম অত্যাচার করেছে আর হত্যা করেছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট- পাকিস্তানে বন্দি থাকাকালে ওরা আপনার বিচার করেছিল। সে বিচার সম্পর্কে আপনি আমাদের কিছু বলুন।

শেখ মুজিব- ওরা একটা কোর্ট মার্শাল তৈরি করেছিল। এদের মধ্যে ৫ জন ছিল সামরিক অফিসার, বাকীরা ছিল বেসামরিক অফিসার।

ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনার বিরুদ্ধে কি অভিযোগ আনলো তারা?

শেখ মুজিব- অভিযোগ রাষ্ট্রদ্রোহিতা। পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। পাকিস্তানের ফৌজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। বাংলাদেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধ, আরো কত কি। বারো দফার অভিযোগ। এর ছটাতে একেবারে ঝুলিয়ে ফাঁসি।

ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনার পক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন? আত্মপক্ষ সমর্থনের কোন উপায় ছিল?

শেখ মুজিব-সরকারের পক্ষ থেকে গোড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু যখন দেখলাম অবস্থাটা এমন যে, যুক্তির কোন দাম নেই। দেখলাম যে এ হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র। তখন আমি বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে বললামঃ জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবদের যেতে বলুন। আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এ হচ্ছে এক গোপন বিচার। আমি বেসামরিক লোক। আমি সামরিক লোক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট তাই নয়, তিনি প্রধান শাসকও। এ বিচারের রায়কে অনুমোদনের কর্তাও তিনি। এই আদালত গঠন করেছেনও তিনি।

ডেভিট ফ্রষ্ট-তার মানে তার হাতেই ছিল সব।

শেখ মুজিব- সে ছিল দন্ডমুর্খের কর্তা। তার ইচ্ছাই ইচ্ছা।

ডেভিট ফ্রষ্ট-তার মানে আপনি আদালতে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন।

শেখ মুজিব- আরতো কোন উপায় ছিল না, আমিতো ছিলাম বন্দি।

ডেভিট ফ্রষ্ট-হ্যাঁ তাতো বটেই। আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার তো কোন মূল্যে ছিল না। ওরা কি বিচার শেষে সরকারীভাবে কোন রায় তৈরী করেছিল।

শেখ মুজিব- ৪ ডিসেম্বর ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সাথে সাথে ইয়াহিয়া খান হয়ে উঠেন সব কিছুর বিচারক। যথা- লেফটেন্যান্ট, কর্ণেল, ব্রিগেডিয়ার, এদের সবাই’কে পাঠায় রাওয়ালপিন্ডিতে রায় তৈরি করার জন্য। সেখানে ওরা ঠিক করলো ওরা আমাকে ফাঁসি দিবে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-আর তাই জেলের পাশে কবর খোঁড়া দেখে আপনি বুঝতে পেরেছিলেন ওরা আপনাকে ওখানেই কবর দেবে?

শেখ মুজিব- হ্যাঁ আমি আমার চোখের সামনে দেখলাম, ওরা কবর খুঁড়ছে। আমি নিজের কাছে নিজে বললাম : আমি জানি এ কবর আমার কবর। ঠিক আছে কোন পরোয়া নেই, আমি প্রস্তুত আছি।

ডেভিট ফ্রষ্ট-ওরা কি বলেছিল, ওটা আপনার কবর?

শেখ মুজিব-ওরা তা বলেনি।

ডেভিট ফ্রষ্ট-কী বলেছিল ওরা?

শেখ মুজিব- ওরা বলল, না না তোমার কবর নয়। ধরো যদি হঠাৎ বম্বিং হয়, তাহলে তুমি এখানে সেল্টার নিতে পারবে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-সে সময় আপনার মনের চিন্তা কী ছিল? আপনি কি সারাটা সময় অর্থাৎ এই নয় মাস কি মৃত্যুর চিন্তায় কাটিয়েছিলেন।

শেখ মুজিব- আমি জানতাম ওরা যে কোন সময়েই আমাকে শেষ করে দিতে পারে। কারণ ওরা অসভ্য বর্বর।

ডেভিট ফ্রষ্ট-এমন অবস্থায় আপনার কেমন করে সময় কাটতো? আপনি কী প্রার্থনা করতেন?

শেখ মুজিব-এমন সময় আমার নির্ভর ছিল আমার বিশ্বাস, আমার নীতি। আমার পৌঁনে আট কোটি মানুষের উপর আমার বিশ্বাস। তারা আমায় ভালোবেসেছে ভাইয়ের মতো, পিতার মতো। আমাকে তাদের নেতা বানিয়েছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনি যখন দেখলেন, ওরা কবর খনন করছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জেগেছে? আপনার দেশের কথা, না আপনার পুত্র-পরিজনের কথা?

শেখ মুজিব-আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আত্মীয় স্বজনদের চাইতেও আমি দেশকে সব সময় বড় করে দেখেছি। আপনিতো দেখেছেন তারা আমাকে কত ভালবাসে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-হ্যাঁ একথা আমি বুঝি, স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বাংলাদেশের আপনি নেতা। আপনার প্রথম চিন্তা অবশ্যই আপনার দেশের চিন্তা।

শেখ মুজিব- জনগণই আমার সব। আমিতো জানি আমি অমর নই। আজ কিংবা কাল কিংবা পরশু আমাকে মরতে হবে। সবাকে-ই একদিন চলে যেতে হবে। আমার বিশ্বাস মানুষ মরবে সাহসের সঙ্গে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-কিন্তু ওরাতো আপনাকে কবর দিতে পারেনি। কিন্তু কে আপনাকে রক্ষা করেছিলেন বলে আপনি মনে করেন।

শেখ মুজিব- আমার বিশ্বাস সর্বশক্তিমান আল্লাহই আমাকে সেদিন রক্ষা করেছিলেন।

ডেভিট ফ্রষ্ট-আমি একটা বিবরণে দেখলাম, আপনাকে নাকি এক সময়ে সরিয়ে রেখেছিল। ইয়াহিয়া যখন আপনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন আপনাকে অন্যত্র নিয়ে গিয়েছিল। একি যথার্থ?

শেখ মুজিব-ওরা জেলখানায় একটা অবস্থা তৈরি করেছিল। কতকগুলো কয়েদিকে ওরা সংগঠিত করেছিল যেন সকালের দিকে আমার উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে। আমার মনে হয় আমার তত্ত্বাবধানের ভার যে অফিসারের উপর পড়েছিল।

আমার উপর তার অনেকটা সহানুভূতি জেগেছিল। হয়তবা যে অফিসার এমনো বুঝতে পেরেছিল যে ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। হঠাৎ রাত তিনটায় আমাকে সে ঘুম থেকে জাগিয়ে নিয়ে তার নিজ বাংলোয় আমাকে আশ্রয় দিল। দু’দিন আমার উপর কোন সামরিক পাহারা ছিল না। দু’দিন পর ওই অফিসার আবার আমাকে একটি আবাসিক কলোনির নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিল। সেখানে আমাকে হয়তো চার পাঁচ কিংবা ছ’দিন রাখা হয়েছিল। এই সময়টাতে আমার অবস্থান সম্পর্কে নিম্নপদস্থ কিছু অফিসার বাদে আর কেউ জ্ঞাত ছিল না।

ডেভিট ফ্রষ্ট-শেষ মুহুর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, তখনো নাকি সে ভুট্টোর কাছে আপনার ফাঁসির কথা বলেছিল? এটা কি ঠিক?

শেখ মুজিব-হ্যাঁ, ঠিক। ভুট্টো আমাকে সে কাহিনীটা বলেছিল ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়ার সময়ে ইয়াহিয়া বলেছিলঃ মিস্টার ভুট্টো, আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি না দেয়া।

ডেভিট ফ্রষ্ট-ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল!

শেখ মুজিব- হ্যাঁ, ভুট্টো একথা আমায় বলেছিল এবং আরো বলেছিলেন  ‘ইয়াহিয়ার দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসি দেবে।’ কিন্তু তার এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি ভুট্টো।

ডেভিট ফ্রষ্ট- ভূট্টো কি জবাব দিয়েছিল? তার জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?

শেখ মুজিব- হ্যাঁ বলেছিল।

ডেভিট ফ্রষ্ট-কি বলেছিল ভুট্টো?

শেখ মুজিব-ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেছিলেন-‘না, আমি তো তা হতে দিতে পারি না। তাহলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। বাংলাদেশে এখন আমাদের একলাখ তিন হাজার সামরিক বাহিনীর লোক আর বেসামরিক লোক বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি রয়েছে। তাছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙ্গালি বাংলাদেশে আছে।

মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তাহলে একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তান ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। তার প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে। তখন আমার অবস্থা হবে সঙ্কটজনক। ভুট্টো একথা আমাকে বলেছিল। ভুট্টোর কাছে আমি অবশ্যই এজন্য কৃতজ্ঞ।

ডেভিট ফ্রষ্ট-শেখ সাহেব, আজ যদি ইয়াহিয়া খানের সাথে আপনার স্বাক্ষাৎ ঘটে তাহলে আপনি কী করবেন?

শেখ মুজিব- ইয়াহিয়া খান একটা জঘন্য খুনি। তার ছবি দেখতেও আমি রাজি নই। তার বর্বর ফৌজ দিয়ে সে আমার ৩০ লাখ বাঙ্গালিকে হত্যা করেছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-ভুট্টো এখন তাকে গৃহবন্দি করেছে। ভুট্টো তাকে নিয়ে এখন কি করবে? আপনার কী মনে হয়?

শেখ মুজিব- মিস্টার ফ্রষ্ট, আপনি জানেন, আমার বাংলাদেশে কি ঘটেছে। শিশু, মেয়ে, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সকলকে ওরা হত্যা করেছে। ৩০ লাখ বাঙ্গালিকে ওরা হত্যা করেছে। ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ঘর-বাড়ি ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে এবং তার সবকিছুই ওরা লুট করেছে। খাদ্যের গুদামগুলোকে ওরা ধ্বংস করেছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-নিহতের সংখ্যা ৩০ লাখ, একথা আপনি সঠিকভাবে জানেন?

শেখ মুজিব- আমার লোকজন তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে। এখনো আমার চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসিনি। সংখ্যা হয়ত একেও ছাড়িয়ে যাবে। ত্রিশ লাখের কমতো নয়ই।

ডেভিট ফ্রষ্ট-কিন্তু এমন হত্যাকান্ডতো নিরর্থক। মানুষকে ঘর থেকে টেনে এনে হত্যা করা।

শেখ মুজিব- হ্যাঁ, কাদের ওরা হত্যা করেছে? একেবারে নিরীহ শান্তি প্রিয় মানুষকে। গ্রামের মানুষকে, যে গ্রামের মানুষ পৃথিবীর কথাই হয়তো কিছু জানতো না। সে গ্রামে পাকিস্তানি ফৌঁজ ঢুকে পাখি মারার মতো গুলি করে এই মানুষকে হত্যা করেছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট- আমারও প্রশ্ন কেন এমন হলো?

শেখ মুজিব-না, আমি জানি না। আমি বুঝি না। এ রকমটা পৃথিবীতে আর ঘটেছে বলে আমার জানা নেই। ওরা নিজেকে মুসলমান বলে পরিচয় দেয়, মুসলিম মুসলিম ভাই ভাই বলে। অথচ ওরা নির্যাতন ও হত্যা করেছে মুসলমান মেয়েদের। আমরা অনেককে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। আমাদের ত্রাণ শিবিরে এখনো অনেকে রয়েছে। এদের স্বামী, পিতা সকলকে হত্যা করা হয়েছে। মা বাবার সামনে ওরা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। পুত্রের সামনে মাকে ধর্ষণ করেছে। আপনি চিন্তা করুন! আমি এ কথা চিন্তা করে চোখের অশ্রুকে রোধ করতে পারিনা।

এরা নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে কী ভাবে? এরাতো পশুরও অধম। মনে করুন, আমার বন্ধু মশিউর রহমানের কথা। আমাদের দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন তিনি। আমাদের সরকারের একজন প্রাক্তনমন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাকে নির্যাতন করে করে হত্যা করা হয়েছে। ২৪ দিন ধরে তার ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। প্রথমে তার এক হাত কেটেছে। তারপর তার আর একটা হাত কেটেছে। তারপর তার কান কেটেছে। তার পা কেটেছে। ২৪ দিন ব্যাপী চলেছে এম নির্যাতন। (শেখ মুজিব কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন) কিন্তু এতো একটা কাহিনী।

আমাদের কতো নেতা আর কর্মীকে, বুদ্ধিজীবী আর সরকারী কর্মচারিকে জেলখানায় আটক করে সেখান থেকে নিয়ে দিনের পর দিন অত্যাচার করে হত্যা করেছে। এমন অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনী ইতিহাসে কোথাও শুনিনি। একটা পশু, একটা বাঘওতো মানুষকে হত্যা করলে এমনভাবে হত্যা করে না।

ডেভিট ফ্রষ্ট-ওরা কী চেয়েছিল?

শেখ মুজিব- ওরা চেয়েছিল, আমাদের এই বাংলাদেশকে একেবারে উপনিবেশ করে রাখতে। আপনিতো জানেন মিস্টার ফ্রস্ট, ওরা বাঙ্গালি পুলিশ বাহিনীর লোককে, বাঙ্গালি সশস্র বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে। ওরা বাঙ্গালি শিক্ষক, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, বাঙ্গালি ডাক্তার, যুবক, ছাত্র-সকলকে হত্যা করেছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-আমি শুনেছি, যুদ্ধের শেষ অবস্থাতেও ঢাকাতে ওরা ১৩০ জন বুদ্ধিজীবিকে হত্যা করেছে?

শেখ মুজিব-হ্যাঁ, স্যারেন্ডারের মাত্র একদিন আগে। কেবল ঢাকাতেই ১৫০ জন। সারাদেশে ৩০০ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, মেডিক্যাল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। কারফিউ দিয়ে মানুষকে বাড়ির মধ্যে আটক করেছে। আর বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে এই সব মানুষকে হত্যা করেছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-মানে-কারফিউ জারি করে খবরা-খবর বন্ধ করে হত্যা করেছে?

শেখ মুজিব-হ্যাঁ, তাই করেছে।

ডেভিট ফ্রষ্ট-শেখ সাহেব, আপনার কি মনে হয় ইয়াহিয়া খান দূর্বল চরিত্রের লোকক, যাকে অন্যরা সবাই খারাপ বলছে, না সে নিজেই একটা দস্তর মত খারাপ লোক?

শেখ মুজিব-আমি মনে করি, ও নিজেই একটা নরাধম। ও একটা সাঙ্ঘাতিক লোক। ইয়াহিয়া খান যখন প্রেসিডেন্ট, তখন জন-সাধারণ নেতা হিসাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনার সময়েই আমি দেখেছি।

ডেভিট ফ্রষ্ট-সে আপনাকে বিভ্রান্ত করেছিল, তাই না?

শেখ মুজিব- সে আমাকে বিভ্রান্ত করতে পারেনি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম সে কি করতে যাচ্ছে। তবে আমি আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এবং আঘাত সে পেয়েছিল।

ডেভিট ফ্রষ্ট- বন্দি হওয়ার পরে আপনি কি ওকে দেখেছিলেন?

শেখ মুজিব-না, না।

ডেভিট ফ্রষ্ট-ভুট্টোর এখন কি করা উচিত বলে আপনি মনে করেন?

শেখ মুজিব-আমার মনে হয় ওর প্রকাশ্যে বিচার হওয়া উচিত।

ডেভিট ফ্রষ্ট-আপনি কি মনে করেন ভুট্টো তা করবে?

শেখ মুজিব-তাঁর করা উচিত?

ডেভিট ফ্রষ্ট-ভুট্টো সম্পর্কে এখন আপনার ধারণা কি? আপনি কি মনে করেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অথবা প্রধানমন্ত্রী হিসাবে একদিন তিনি মুক্ত ঢাকায় আসবেন? তিনি কি কখনো আলোচনার জন্য এখানে আসবেন?

শেখ মুজিব-আমি জানি না। তবে আগে সে বর্তমান বাস্তবতা অনুধাবন করুক, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশ তার ভূ-খন্ড বলে চেঁচিয়ে কোনো লাভ হবে না। ওরা যদি এক পাকিস্তানের দাবিতে অনড় থাকে, তবে এটা জানুক যে, আমি হচ্ছি সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং আমি দাবি করতে পারতাম আমি হচ্ছি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রশাসক, এবং গোটা পাকিস্তান আমার এলাকা।

আমি জাতীয় সংসদের সভা ডেকে গোটা দেশের নাম বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা করতে পারি এবং তাদের বলতে পারি পশ্চিম পাকিস্তান হচ্ছে আমার এলাকা। আমি ভুট্টোকে বিদায় নিতে বলতে পারি এবং তাঁকে জানাতে পারি যে পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তানের গভর্ণর আমি নিয়োগ করছি।

আমি তাকে বলতে পারি এটা আমার ভূখন্ড এবং আপনি বিদায় হোন, নতুবা মিত্র বাহিনীসহ আমি আবার সৈন্য পাঠাব ও পশ্চিম পাকিস্তান দখল করবো। তবে আমি এই গন্ডগোল চাই না। আমার কোনো ভূখন্ড নেই। ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে খুশি থাকুক। যদি তারা পশ্চিম পাকিস্তান নাম ব্যবহার করতে চায় তারা সেটা করুক। আমার কোনে আপত্তি থাকবে না। আমি বাংলাদেশে আমার জনগণকে নিয়ে সুখি হতে চাই। আর বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এটা আমার এবং আমার সাত কোটি জনগণের দেশ।

সংগ্রহ-ফাদার অব দ্য নেশন

আরও দেখুন:

Leave a Comment