বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭১ সালের মার্চ মাস [ Bangbandhu Sheikh Mujibur Rahman’s Speech, March Month, 1971 ]

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭১ সালের মার্চ মাস

Table of Contents

[ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭১ সালের মার্চ মাস ]

১ মার্চ ১৯৭১, সাংবাদিক সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা

হোটেল পূর্বানী, ১ মার্চ ১৯৭১

আপনারা সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নামে প্রচারিত বিবৃতি শুনেছেন। সাধারণত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ তার কণ্ঠেই শোনা যেত। অথচ ও ক্ষেত্রে বিবৃতিটি অন্য কারো কণ্ঠে প্রচারিত হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানের সকল এম.এন.এ এখন ঢাকায়, ভূট্টো ও কাইয়ুম খানের দল ছাড়া আর বাকি সব পশ্চিম পাকিস্তানী এম.এন.এ অধিবেশনে যোগদান করে শাসনতন্ত্র রচনায় সহায়তা করতে প্রস্তুত। এই মুহুর্তে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে মূলতবি ঘোষণা সত্যিই দূর্ভাগ্যজনক।

আমি আগে থেকে বলেছি, ষড়যন্ত্র চলছে। এই ঘোষণা এক সুদীর্ঘ ষড়যন্ত্রেরই ফলশ্রুতি এবং আমরা এর কঠোর নিন্দা ও প্রতিবাদ না করে পারি না। একটি সংখ্যালঘু দলের একগুয়ে দাবির ফলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মূলতবি ঘোষিত হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে এটা আমাদের জন্য দূর্ভাগ্যজনক। জনগণের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে, তাই আমরা একে বিনা চ্যালেঞ্জে  ছেড়ে দিতে পারি না।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭১ সাল [ Bangbandhu Sheikh Mujibur Rahman's Speech 1971 ]
Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman
এর প্রতিবাদে কাল মঙ্গলবার ঢাকায় এবং পরশু সারাদেশে সাধারণ হরতাল পালিত হবে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি শিগগিরই মওলানা ভাসানী, জনাব নূরুল আমিন, প্রফেসর মুজাফ্ফর আহমদ এবং জনাব আতাউর রহমান খানের সাথে আলোচনা করবো। আগামী ৭ মার্চ রেসকোর্সে এক গণসমাবেশে বাংলার মানুষের আতঙ্ক নিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচী ঘোষণা করা হবে।

আমরা যে কোন অবস্থার জন্য প্রস্তুত আছি। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ভিত্তিতে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা নির্বাচিত হয়েছি। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। কিন্তু পুরোনো ষড়যন্ত্র আবার শুরু করেছে। বাংলাদেশকে উপনিবেশ এবং বাজার হিসাবে শোষণ করার জন্যই এই ষড়যন্ত্র। কিন্তু আমরা আমাদের সম্মিলিত সংগ্রাম চালিয়ে যাব। কারণ আমরা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। আপনারা যে কোন ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকুন। তবে সব রকম হিংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকবেন। আমাদের দল একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং আমরা শান্তি পূর্ণভাবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাব।

জনগণ আমাদের নির্বাচিত করেছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আমরাই জনগণের কাছে দায়ী। শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আমরা সবার সহযোগিতা চাই। পশ্চিম পাকিস্তানেরও জনাব ভুট্টো- কাইয়ুম খানের দল ছাড়া আর সব দলের সদস্যরাই শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ঢাকা আসতে আগ্রহী ছিলেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর পর তার একটা নিজস্ব কার্যধারা রয়েছে। শাসনতান্ত্রিক বিল পেশের পর সেভাবেই আলোচনায় অগ্রসর হওয়া যেত। কিন্তু একটি দলের আবেগে সাড়া দিতে গিয়ে তা বানচাল করা হয়েছে। জনাব ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পরিষদ সদস্যকে হুমকি দিয়েছেন। তিনি আইন নিজ হাতে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তার বিরুদ্ধে তো আইন প্রয়োগ হচ্ছে না? তবে কি আইন সব দরিদ্র বাঙালিদের জন্যে।

আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আহ্বানের দাবী করেছিলাম। সেই সময়ে জনাব ভুট্টো মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আহ্বানের দাবী জানান এবং ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশনে তারিখ ধার্য করা হয়েছিল। আমি পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার বিরুদ্ধে আমার মত ঘোষণা সত্ত্বেও জনাব ভুট্টো স্থগিত রাখার দাবী জানান এবং সেটাই করা হচ্ছে। এর অর্থ কি এই নয়, কর্তৃপক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠকে উপেক্ষা করে গণতান্ত্রিক নীতি লঙ্ঘন করেছেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাশুরুর মতই গৃহীত হয় এবং আমরা সংখ্যাগুরু।

বাঙ্গালিদের আর কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আমরা ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম করছি। দাবী আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমি পাঞ্জাব, সিন্ধু বেলুচিস্তান ও সীমান্ত প্রদেশের জনগণকে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর অনুরোধ করবো। প্রদেশে বসবাসকারী অবাঙ্গালিরা এদেশেরই সন্তান। জনগণের সংগ্রামে তাদেরও অবশ্যই যোগ দিতে হবে। জনগণ ৬-দফার পক্ষে রায় দিয়েছে। দাবী আদায়ের জন্য এগিয়ে গেলে কেউ আমাদের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে, তার পরিণতির জন্য তারাই দায়ী থাকবেন।

[সূত্র ঃ পূর্বদেশে, আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক সংগ্রাম, ২মার্চ, ১৯৭১]

 

১৯৭১ সালের ১ মার্চ বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের সামনে হরতাল পালনে ঘোষণা দেন

[১ মার্চ, ১৯৭১ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঢাকায় অনুষ্ঠেয় জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করেন। ‘পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধান রাজনৈতিক দল পিপল্স পার্টিসহ আরও কয়েকটি দল ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান না করার সংকল্প প্রকাশ করায় এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হয়েছে, বলে কারণ দেকানো হয়। বাংলাদেশের জনসাধারণ ও ঘোষণার সাথে সাথে প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ঢাকায় শত শত স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভ মিছিল বেরিয়ে যায়।

দোকানপাট বন্ধ হয়ে যায়, সরকারী বেসরকারী অফিস, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী, ছাত্র-শিক্ষক, শ্রমিক, আইনজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে পড়েন। মিছিলকারীরা ভুট্টো বিরোধী এবং বাংলার স্বাধিকার দাবিতে স্লোগান দেয়। সে সময়ে ঢাকায় হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির বৈঠক চলছিল। হাজার হাজার বিক্ষোভকারী বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের জন্যে হোটেলের সামনে সমবেত হয়।

হিংসাত্মক ঘটনার আশঙ্কায় তিনি জনগণকে শান্ত করতে চাইলেন। হোটেলে সমবেত সাংবাদিকদের কাছে তিনি তাঁর কর্মসূচি ঘোষণা করেন। এর প্রতিবাদে ২ মার্চ ঢাকায় ও ৩ মার্চ সারাদেশে তিনি হরতাল পালনের আহ্বান জানান। সাংবাদিকদের সামনে দেয়া ঘোষণার অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো।]

আপনারা সম্ভবত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া নামে প্রচারিত বিবৃতি শুনেছেন। সাধারণত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ভাষণ তাঁর কণ্ঠেই শোনা যেত। অথচ এ ক্ষেত্রে বিবৃতিটি অন্য কারো কন্ঠে প্রচারিত হয়েছে।

পূর্ব পাকিস্তানের সকল এম,এন,এ, এখন ঢাকায়, ভুট্টো ও কাইয়ুম খানের দল ছাড়া আর বাকি সব পশ্চিম পাকিস্তানী এম.এন.এ অধিবেশনে যোগদান করে শাসনতন্ত্র রচনায় সহায়তা করতে প্রস্তুত। এই মূহুর্তে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা সত্যিই দুর্ভাগ্যজনক।

আমি আগে থেকেই বলেছি, ষড়যন্ত্র চলছে। এই ঘোষণা এক সুদীর্ঘ ষড়যন্ত্রেরই ফলশ্রুতি এবং আমরা এর কঠোর নিন্দা ও প্রতিবাদ না করে পারি না। একটি সংখ্যালঘু দলের একগুঁয়ে দাবির ফলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘোষিত হয়েছে এবং গণতান্ত্রিক পদ্ধতি ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে-এটা আমাদের জন্য দূর্ভাগ্যজনক। জনগণের প্রতি আমাদের দায়িত্ব রয়েছে, তাই আমরা একে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দিতে পারি না।

প্রতিবাদে কাল মঙ্গলবার রাজধানী ঢাকায় এবং পরশু সারাদেশে সাধারণ হরতাল পালিত হবে। বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আমি শিগগিরই মওলানা ভাসানী, জনাব নূরুল আমিন, প্রফেসর মুজাফ্ফর আহমদ এবং জনাব আতাউর রহমান খানের সাথে আলোচনা করবো। আগামী ৭ মার্চ রেসকোর্সে এক গণসমাবেশে বাংলার মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার অর্জনের কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

আমরা যে কোন অবস্থার জন্য প্রস্তুত আছি। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আমরা নির্বাচিত হয়েছি। এখন আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। কিন্তু পুরোনো ষড়যন্ত্র আমার শুরু হয়েছে। বাংলাদেশকে উপনিবেশ এবং বাজার হিসাবে ঘোষণা করার জন্যই এই ষড়যন্ত্র। কিন্তু আমরা আমাদের সম্মিলিত সংগ্রাম চালিয়ে যাব। কারণ আমরা জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারি না। আপনারা যে কোন ত্যাগ স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকুন। তবে সব রকম হিংসাত্মক কাজ থেকে বিরত থাকবেন। আমাদের দল একটি গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান। আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং আমরা শান্তি পূর্ণভাবে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন চালিয়ে যাব।

জনগণ আমাদের নির্বাচিত করেছে এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসাবে শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আমরাই জনগণের কাছে দায়ী। শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আমরা সবার সহযোগিতা চাই। পশ্চিম পাকিস্তানেরও জনাব ভুট্টো-কাইয়ুম খানের দল ছাড়া আর সব দলের সদস্যরাই শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ঢাকা আসতে আগ্রহী ছিলেন। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরুর পর তার একটা নিজস্ব কার্যধারা রয়েছে। শাসনতান্ত্রিক বিল পেশের পর সেভাবেই আলোচনায় অগ্রসর হওয়া যেত। কিন্তু একটি দলের আবেগে সাড়া দিতে গিয়ে তা বানচাল করা হয়েছে। জনাব ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পরিষদ সদস্যকে হুমকি দিয়েছেন। তিনি আইন নিজ হাতে গ্রহণ করেছেন। কিন্তু তাঁর বিরুদ্ধে তো আইন প্রয়োগ হচ্ছে না? তবে কি আইন সব দরিদ্র বাঙ্গালিদের জন্যে?

আমি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন গত ১৫ ফেব্রুয়ারি আহ্বানের দাবি করেছিলাম। সেই সময়ে জনাব ভুট্টো মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে আহ্বানের দাবি জানান এবং ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশনের তারিখ ধার্য করা হয়েছিল। আমি পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার বিরুদ্ধে আমার মত ঘোষণা সত্ত্বেও জনাব ভুট্টো স্থগিত রাখার দাবি জানান এবং সেটাই করা হচ্ছে। এর অর্থ কি এই নয়, কর্তৃপক্ষ সংখ্যাগরিষ্ঠকে উপেক্ষা করে গণতান্ত্রিক নীতি লঙ্ঘন করছেন? গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সংখ্যাগুরুর মতই গৃহীত হয় এবং আমরা সংখ্যাগুরু।

বাঙ্গালিদের আর কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না আমরা ন্যায় ও সত্যের জন্য সংগ্রাম করছি। দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। আমি পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিন্তান ও সীমান্ত প্রদেশের জনগণকে এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর অনুরোধ করবো। প্রদেশে বসবাসকারী অবাঙ্গালিরা এদেশেরই সন্তান। জনগণের সংগ্রাম তাঁদেরও অবশ্যই যোগ দিতে হবে। জনগণ ৬-দফার পক্ষে রায় দিয়েছে। দাবি আদায়ের জন্য এগিয়ে গেলে কেউ যদি আমাদের পথে অনরায় সৃষ্টি করে, তার পরিণতির জন্য তাঁরাই দায়ী থাকবেন।

[সূত্রঃ পূর্বদেশ, আজাদ, দৈনিক পাকিস্তান ও দৈনিক সংগ্রাম; ২ মার্চ, ১৯৭১]

১৯৭১ সালের ১লা মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

পহেলা মার্চ হঠাৎ ঘোষণা হলো জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বাতিল। তারপরই বাংলাদেশের মানুষের সামনে উচিয়ে ধরা হলো মিলিটারির বন্দুক। নিরস্ত্র মানুষ, মজুর, শ্রমিক এবং ছাত্র ভাইয়েরা এই ঘোষণার প্রতিবাদ জানিয়েছিল, নির্বিচারে গুলি চালানো হয়েছে তাদের উপর। গত সপ্তাহে যারা মারা গেছে তারা সব অমর শহীদ। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য তারা প্রাণ দিয়েছে। এই শহীদদের ‘দুস্কৃতকারী’ আখ্যা দেওয়া চুড়ান্ত মিথ্যা। প্রকৃত দুস্কৃতকারী তারাই যারা বাংলাদেশের মানুষের উপর নিলর্জ্জ সন্ত্রাসের রাজত্ব চালাচ্ছে।

বড়ই দুঃখের কথা, গত সপ্তাহে যে নৃশংস কান্ড ঘটে গেল, তা নিজে যাচাই করে দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট একবার ঢাকায় আসতে পারলেন না। উনি বলেছেন, এই নাকি ‘সামান্যতম’ অস্ত্রের ব্যবহার-তাতেই যদি হাজার হাজার মানুষ মরে, তাহলে ‘যথোপযুক্ত’ ব্যবহার মানে কি দেশশুদ্ধ সবাইকে খতম করা? বাংলাদেশে নিরস্ত্র মানুষের ওপর অস্ত্রশক্তির এই নগ্ন অত্যাচারের প্রচন্ড ধিক্কার জানাচ্ছি আমি।

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ
বলা হয়েছে যে জাতীয় পরিষদ স্থগিত রাখার হুকুম নাকি ‘ভুল বোঝাবুঝি’ হয়েছে। আমি প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞাসা করতে চাই, পরিষদের একটি সংখ্যালঘিষ্ট দলের প্ররোচনাতেই কি এই বাতিলের সিন্ধান্ত নেওয়া হয় নাই? সংখ্যাগরিষ্ঠ দল এবং পশ্চিম দিকের অনেকগুলি ছোট ছোট দলের সদস্যদের ঘোষিত নীতির বিরুদ্ধেই কি এটা করা হয় নাই?

আমরা চেয়েছিলাম ১৫ ফেব্রুয়ারীর অধিবেশন বসুক। কিন্তু ঐ বিশেষ সংখ্যালঘিষ্ঠ দলটি চেয়েছে মার্চের প্রথম সপ্তাহে। ওনাদের ইচ্ছেটাই প্রাধান্য পেল, ৩ মার্চ অধিবেশন ডাকা হলো। অথচ ওনারাই অধিবেশনে যোগ দিতে নারাজ হলেন। প্রথমে ওনারা অত্যন্ত আপত্তিকরভাবে জানালেন যে, ঐ দলের সদস্যরা ঢাকায় এলে বিপদে পড়বেন এবং তাদের নাকি ফন্দি করে বন্দি করে রাখা হবে। তারপর তারা বললেন, ঐ দল আসবেন। এ তো গেল। এরপর ভাব দেখালেন যে, ও দলের সকল সদস্য পদত্যাগ করবেন। পরেই আবার বললেন পদত্যাগ করবেন না। কিন্তু ওদের বাদ দিয়ে জাতীয় পরিষদ বসলে ওরা গণআন্দোলন করবেন।

এমনও হুমকি দিলেন যে, পরিষদের অধিবেশনে যারা যোগ দেবে, জনতা তাদের উপর প্রতিশোধ নেবে আর জনতা যদি প্রতিশোধ না নেয়, তাহলে ঐ পার্টিও কর্মীরা তাদের খতম করবে।

এদিকে কিন্তু আমাদের সংসদীয় দল ঢাকায় এসে জমায়েত হয়েছে এবং পশ্চিম খন্ডের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে বিভিন্ন দলের সদস্যরা এসে পৌঁছেছেন। মূখ্য নির্বাচনী কমিশনারও এসে গেছেন এবং নারী সদস্যদের নির্বাচনের দিন নির্দিষ্ট হয়েছে ২ মার্চ। অধিবেশন উদ্বোধন করার জন্য প্রেসিডেন্টের ১ মার্চ পৌঁছে যাবার কথা। ২৪ ফেব্রুয়ারীর বিবৃতিতে আমরা সংবিধান রচনা সম্পর্কে আমাদের মতামত স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছি।

এমনকি আমরা একথাও আবার জানিয়ে দিয়েছি যে জাতীয় পরিষদের যে কোন সদস্য-পাকিস্তানের যে কোন অঞ্চলেরই হোক-এই ঐতিহাসিক দায়িত্বে মতামত দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করুণ। ২৭ ফেব্রুয়ারী আমরা বলেছি যে, অধিবেশন শুরু হবার আগে কেউ যদি কোন একটি ব্যাপারেও যুক্তি সম্মত আপত্তি তোলেন, আমরা মেনে নেব। কিন্তু এ প্রস্তাবও যারা অগ্রাহ্য করলে, তাদের মনোভাবকে কি উদ্দেশ্যমূলক বলা যায় না?

১ লা মার্চ হঠাৎ রেডিও বিবৃতিতে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি রাখার কথা ঘোষণা করা হলো। এজন্য যুক্তি দেখানো হলো কি না, বোঝাবোঝির জন্য আরও সময় দরকার। এ কথাও বলা হলো যে পূর্ব পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের মধ্যে রাজনৈতিক বৈষম্য দেখা দিয়েছে।

এতে বাংলাদেশের লোক কি একথা মনে করতে পারে না যে, একটি সংখ্যালঘু দলের প্ররোচনায় একটি গণতান্ত্রিক অধিকারে নির্লজ্জের মতো হস্তক্ষেপ করা হয়েছে? এই সঙ্গে সঙ্গে সামরিক বাহিনীর তৎপরতার ফলে এই ধারণা আরো দৃঢ় হয়। এতেই বোঝা যায়, ওদিককার সংখ্যালঘু দলের কথা মতন না চললে এদিককার সংখ্যাগরিষ্ট দলকে রাজনৈতিক সংঘর্ষের বদলে সামরিক সংঘর্ষের মুখোমুখি হতে হবে।

বাঙ্গালীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র
২৪ ফেব্রুয়ারীর বিবৃতিতে আমরা সাবধান করে দিয়েছিলাম যে, দেশে যখনই গণতান্ত্রিক হস্তান্তরের সম্ভাবনা দেখা যায়, তখনই ষড়যন্ত্রকারীরা তা বানচাল করে দেবার জন্য উঠে পরে লাগে। পশ্চিমের শ্রেণী স্বার্থের ধ্বজ্জাধারীরা সংখ্যায় ক্ষুদ্রের চেয়ে ক্ষুদ্র হয়েও বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকে ধ্বংস করে দেয়। পশ্চিমের সাধারণ মানুষের অধিকারও তারা দমন করে রাখে। পশ্চিমের সাধারণ মানুষের অধিকারও তারা দমন করে রাখে। ১৯৫৩ সালে পাঞ্জাবী শাসকগোষ্ঠির ষড়যন্ত্রে বাঙ্গালী প্রধানমন্ত্রীকে হঠে যেতে হয়।

১৯৫৪ সালে ঐ ষড়যন্ত্রকারীরাই বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকার ভেঙ্গে দেয়। ১৯৫৯ সালে যখন সাধারণ নির্বাচনের কথা হয়েছিল, তখনও পাঞ্জাবের স্বার্থ সম্পন্ন লোভীগোষ্ঠী ক্ষমতা দখল করে রাখে। আজো তারা সেই খেলা খেলছে।

একটা সোজা কথা জানিয়ে দিতে চাই, রাজনৈতিক দলের সম্মেলন আমি কখনোই চাইনি। আমি শুধু প্রেসিডেন্টকে জানিয়ে দিয়েছিলাম, বাংলাদেশে যে বিভৎস হত্যাকান্ড চলছে, তিনি নিজে এসে সেটা দেখে যান। আমাদের এখানকার কার্যসূচী বন্ধ রেখে রাওয়াল পিন্ডিতে গিয়ে মিটিং করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে না। তাছাড়া একথাও মনে করিয়ে দিয়েছিলাম যে, সংবিধান সংক্রান্ত যে কোন আলোচনা সংসদেই করতে হবে, তার আগে গোপন আলোচনার কোন মানে হয় না।

এত কথা বলতে হলো শুধু এই অভিযোগ খন্ডন করার জন্য যে, আওয়ামী লীগ কখনোই ক্ষমতা হস্তান্তরে বাঁধা সৃষ্টি করেনি। তাছাড়া যে দল সম্পূর্ণ সংখ্যাগরিষ্ঠ-তার পক্ষে এ রকম বাঁধা সৃষ্টি করে কি কোন লাভ হয়? দেশের জনসাধারণ এবং সারা পৃথিবী আজ স্পষ্টই জেনে গেছে যে পশ্চিমের একটি মাত্র সংখ্যালঘু দল অনবরত বাঁধা সৃষ্টি করে যাচ্ছে। একথাও বোঝা যাচ্ছে যে প্রেসিডেন্ট ঐ সংখ্যালঘু দলের কাছে নথি স্বীকার করতেই তাঁর নৈতিক দায়িত্ব অনুভব করলেন।

যে কোন সুবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষই আজ একটা কথা প্রশ্ন তুলতে পারে ঃ দেশের নিরস্ত্র জনসাধারণকে খুন করে সামরিক বাহিনী কি দেশের অখন্ডতা, সমভাতৃত্ব এবং নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখছে? না কি, তারাই এভাবে দেশের বিচ্ছিন্নতা ব্যাপারে প্রধান কারণ হয়ে দাড়াচ্ছে।

নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা
নির্বাচন হয়ে যাবার পর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের থেকে বেশী আইনগত অধিকার আর কারুর নাই? কোন ব্যক্তি বিশেষই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়ে বেশী ক্ষমতা দাবী করতে পারে না।

বাংলাদেশের মানুষের অবিসংবাদী প্রতিনিধি হিসেবে আমরা জোরের সঙ্গে বলতে চাই যে আমরাই বাংলাদেশ চালানোর ব্যাপারে একমাত্র আইন সঙ্গত ক্ষমতাবান। বস্তুত, সংখ্যাগরিষ্ঠতার বলে গোটা দেশেরই ক্ষমতার অধিকারী আমরা। গত সাত দিনের ঘটনার বুঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশে সরকারের সমস্ত শাখা আমাদের আইন সঙ্গত পরিচালক হিসাবে গ্রহণ করেছে এবং আমাদের সব নির্দেশ দিয়েছে।

আজ প্রেসিডেন্ট এবং ইসলামাবাদ সরকারের এই চরম সত্য বোঝা উচিৎ। বাংলাদেশের জনসাধারণ রায় দিয়েছে যে, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতার ব্যাপাওে কারুর বাঁধা সৃষ্টি করা আর সহ্য হবে না।

এরপর প্রস্তাব এসেছে ২৫ মার্চ অধিবেশন বসবার। আমরা বার বার বলেছি অধিবেশন যথাসম্ভব আগে শুরু করতে। আজ দেশের অবস্থা অস্বাভাবিক ও সাংঘাতিক। দেশে ত্রাশের রাজত্ব চালাবার চেষ্টা হচ্ছে। হাজার হাজার মানুষ নিহত হওয়ার খবর আসছে, সব দিক থেকে ধ্বনি হচ্ছে গণহত্যা বন্ধ করতেই হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ এবং পৃথিবীর শুভবুদ্ধি সম্পন্ন সব মানুষেরই এই দাবি।

জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কি ত্রাসের রাজত্বের কাছে নতি স্বীকার করবেন? যতদিন সংঘর্ষ চলবে, যতদিন পশ্চিমাঞ্চল থেকে দলে দলে সেনাবাহিনী ও অস্ত্র আনানো হবে, যতদিন দমননীতি অব্যাহত থাকবে, যতদিন বাংলাদেশের উপর গুলি চালানোর খবর আসবে-ততদিন বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগ দেবার কথা ভাববে না। তারা কি বন্দুকের মুখে গণতান্ত্রিক অধিকার নিতে যাবে?

আওয়ামী লীগের প্রস্তাব
প্রেসিডেন্ট যদি সত্যই চান যে, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসুক, তাহলে এই কয়টি ব্যবস্থা তাঁকে অবিলম্বে গ্রহণ করতে হবে: সমস্ত সামরিক বাহিনীকে এক্ষুণি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে ব্যারাকে।
১. নাগরিকদের উপর গুলি চালনা বন্ধ করতে হবে। আর একটি গুলির আওয়াজও শোনা যাবে না।
২. সরকারী কাজে সামরিক বাহিনীর হস্তক্ষেপ চলবে না। কোন সরকারী কর্মচারির উপর প্রতিশোধ-মূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে না।
৩. আইন পরিচালনার ভার নিবে পুলিশ আর পূর্ব পাকিস্তানরাইফেলস্ বাহিনী। দরকার হলে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছা-সেবকরা তাদের সাহায্য করবে।
৪. মার্শাল কানুন অবিলম্বে প্রত্যাহার করতে হবে।
৫. নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে অবিলম্বে ক্ষমতা দিতে হবে। যদি সামরিক অত্যাচার চলে, আমাদের নিরস্ত্র মানুষ মারা যায়-তাহলে জাতীয় পরিষদ যে কার্যকর হবে না, সে সম্পর্কে কোন সন্দেহ রাখার দরকার নেই।

সংগ্রাম শুরু হয়েছে
আমাদের দেশের মানুষ পৃথিবীকে জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা আর শোষিত কলোনি হয়ে থাকবে না। তারা স্বাধীন দেশের স্বাধীন মানুষ হতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। আমাদের অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকে বাঁচাতে হবে। আমাদের পরিশ্রমী মানুষদের বাঁচাতে হবে দারিদ্র, রোগ এবং বেকারত্ব থেকে। সাইক্লোন বিধ্বস্ত এলাকায় লক্ষ লক্ষ মানুষ এখনো পুর্নবসতি পায়নি। ক্ষমতাশীল চক্র যদি এগুলো বানচাল করতে চায়, তাহলে আমাদের জনসাধারণ দীর্ঘস্থায়ী মুক্তির লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত। আমরা এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেবার জন্য প্রতিশ্রুতিবন্ধ এবং মুক্তি আমরা আনবোই। শত শত শহীদের রক্ত আমরা ব্যর্থ হতে দেব না।

আমাদের সংগ্রামের প্রথম পর্ব শুরু হয়ে গেছে এদেশের নির্ভিক মানুষ অসাধারণ সাহস ও আত্ম প্রত্যয়ের পরিচয় দিয়েছে। বুলেটকে তারা অগ্রাহ্য করেছে, কারফিউ অস্বীকার করেছে সংঘবন্ধভাবে। অভিসন্ধি নিয়ে যেসব কুৎসিত সমাজ বিরোধী লুটেরা বাঙ্গালী-প্রবাঙ্গালী কিংবা বিভিন্ন ধর্র্মীয় ব্যাক্তিদের মধ্যে বিভেদ জাগাতে চেয়েছিল-জনসাধারণ এবং আওয়ামী লীগের সেচ্ছাসেবকরা তাদের চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়েছে। তাদের অভিনন্দন জানাই।

আবার আমি সবাইকে মনে করিয়ে দিতে চাই, বাংলাদেশে যারা আছে তারা সবাই বাঙ্গালী-তাদের জীবন সম্পত্তি এবং সম্মান আমরা রক্ষা করবই। আমরা গর্বের সঙ্গে বলতে পারি আমাদের স্বেচ্ছাসেবকরা কাজে নামবার পর সে রকম কোন অবাঞ্চিত ঘটনা ঘটেনি।
আমাদের এ সংগ্রাম চলবেই।

১৯৭১ সালের ২ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তীব্র নিন্দ্রা প্রকাশ করে বিবৃতি

[১৯৭১ সালের ২ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ডাকে ঢাকায় সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। ঢাকা বিক্ষোভ মিছিলে সয়লাব হয়ে যায়। সান্ধ্য আইন উপেক্ষা করে রাত্রে মানুষের ঢল নামে। জনগণের ‘জয়বাংলা’ ধ্বনি ঢাকাকে প্রকম্পিত করে তোলে। সেনাবাহিনী জনগণকে ছত্রভঙ্গ করার জন্য গুলি ছোড়ে। এতে কয়েকজন নিরস্ত্র মানুষ নিহত ও অসংখ্য আহত হয়। মধ্যরাত পর্যন্ত অন্তত তিনজনের লাশ এবং আহত ব্যক্তিদের হাসপাতালে আনা হয়। ২ মার্চ এক বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু গুলিবর্ণের ঘটনার নিন্দা করেন। তাঁর বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ দেয়া হলো।]

আজ এখানে নিরস্ত্র বালকের উপর গুলি চালানো হয়েছে। এতে কমপক্ষে ২ ব্যক্তি নিহত ও আরো কয়েকজন আহত হন। তাদের উপর গুলি চালানো হয়েছে, কারণ তারা বাংলাদেশের প্রতি এক চরম অবমাননার বিরুদ্ধে সারা বাংলারই অপরাপর জনমানুষের সাথে একাত্ম হয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন। সে যে কোন অবমাননা করুক না কেন। আমি এই গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা জানাই এবং যারা শক্তি দিয়ে জনগণ মোকাবিলা করতে চান, তাদের এই ধরনের বেপরোয়া পথ থেকে বিরত থাকার জন্য আবেদন জানাচ্ছি, তাদের খেয়াল রাখা উচিত যে, নিরস্ত্র জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ গণহত্যার শামিল এবং সেটা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধও বটে।

তাদের জানা উচিত, বাংলাদেশে যদি আগুন জ্বলে ওঠে তবে তারা এর শিখা এড়াতে পারবেন না। এই ধরনের সংঘাত অব্যাহত থাকলে আগুন জলবেও। আমরা বাংলাদেশের ৭ কোটি লোকের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পশ্চিমাঞ্চলের প্রতিনিধিদের সাথে ৩ মার্চ অধিবেশনে বসতে রাজি ছিলাম। প্রকৃত পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু প্রতিনিধি এর মধ্যেই এ ব্যাপারে ঢাকা এসে পৌঁছেছিলেন।

কিন্তু এক আকস্মিক হস্তক্ষেপের ফলে এই অধিবেশন স্থগিত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমি স্বার্থবাদী দলের ত্রাণকারীরূপে একটি সংখ্যালঘু দল এ হস্তক্ষেপে উৎসাহ দেয়। তারা জানায় যে, একমাত্র তাদের আরোপিত শর্ত ছাড়া অধিবেশন হতে পারবে না। এমন কি তারা পশ্চিম পাকিস্তানের কোন প্রতিনিধি এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গেলে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা গ্রহণের ভয় দেখায়।

একটি অগণতান্ত্রিক সংখ্যালঘু দলের নিদের্শক্রমে সংখ্যাগুরু প্রতিনিধিদলের অধিকার অস্বীকার জনগণের প্রতি দুঃসহ অপমান ছাড়া আর কিছুই না।

বাংলাদেশের মানুষ এই ধরনের নির্দেশ কিংবা ভীতির কাছে নতি স্বীকার করতে রাজি নয় বলে বর্তমানে শক্তি দিয়ে তাদের মোকাবিলার চেষ্টা করা হচ্ছে। এটা মর্মান্তিক যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বহনের জন্য যে বিমানগুলো ব্যবহার হতে পারত তা এখন সামরিক অফিসার ও সেনাবাহিনীর লোকদের অস্ত্রশস্ত্র বহণ করার কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সাত কোটি বাঙ্গালিকে দমনের উদ্দেশ্যে এসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকলে জনগণ গতকাল থেকে সরব বাংলাদেশে স্বতঃস্ফুর্ত বিক্ষোভ প্রদর্শনের মাধ্যমে বিশ্ববাসীর সামনে প্রমাণ করে দিয়েছে যে, বাঙ্গালিরা আর নির্যাতিত হতে রাজি নয় এবং তারা একটি স্বাধীন দেশের পরাধীন নাগরিক হতে প্রস্তুত নয়। এই সঙ্কটাপন্ন মুহূর্তে সরকারী কর্মচারীসহ সব শ্রেণীর বাঙ্গালির পবিত্র দায়িত্ব হচ্ছে গণবিরোধী শক্তিকে কোনভাবে সহযোগিতা না করা এবং বস্তুত বাংলাদেশের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করার জন্য তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করা। এখন যেহেতু প্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছেন- তাঁরাই সব কর্তৃত্বের একমাত্র উৎস। সব কর্তৃপক্ষই এই সত্যটির প্রতি লক্ষ্য রাখবেন আশা করি।

এরকম পরিস্থিতিতে সামরিক শাসন বা সামরিক আইন আর অব্যাহত রাখার যৌক্তিকতা থাকতে পারে না। আমি তাই অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার, সংঘাতের আশু অবসান ও জনপ্রতিনিধিদেরকে ক্ষমতা প্রয়োগের বাঁধা অপসারণের দাবি জানাচ্ছি।

উপরোক্ত দাবি পূরণ না হওয়া এবং বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি হাসিল না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

আমি আগামী ৭ মার্চ পর্যন্ত কর্মসূচী ঘোষণা করছি এবং আমাদের জনগণকে নিম্নোক্ত নির্দেশ দিচ্ছি :

(ক) কাল ৩ মার্চ থেকে আগামী ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল ৬ টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত সরকারী অফিস, সেকেটারিয়েট, হাইকোর্ট ও অন্যান্য কোর্ট-কাচারি, স্বায়ত্তশাসিত কর্পোরেশন, পিআইএ, রেলওয়ে ও অন্যান্য যোগাযোগ সংস্থা, পরিবহন, সরকারী ও বেসরকারী কল-কারখানা, ফ্যাক্টরি, শিল্প ও বাণিজ্যিক সংস্থা ও বাজারসহ সর্বত্র হরতাল যা যা হরতালের আওতার বাইরে থাকবে সেগুলো হলঃ এম্বুলেন্স, সংবাদপত্রের গাড়ি, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ সংস্থা।

শান্তিপূর্ণ ও সুশৃংখলভাবে হরতাল পালন এবং লুট, অগ্নিসংযোগ প্রভৃতি অবাঞ্ছিত ঘটনা যাতে না ঘটে তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য সকলের প্রতি সর্তক থাকতে হবে। স্মরণ রাখতে হবে বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রত্যেকে, তা তাঁরা যেখানকারই হোন না কেন বা যে ভাষায়ই কথা বলুন না কেন, তাঁরা আমাদের কাছে বাঙ্গালি। তাঁরা নিজেরা, তাঁদের সম্পত্তি ও ইজ্জত আমাদের পবিত্র আমানত এবং এসব অবশ্যই রক্ষা করতে হবে।

(খ)          ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের কথা ছিল। এই দিন এখন জাতীয় শোখ দিবস হিসেবে পালন করা হবে। এই উপলক্ষে বিকেল ৪ টায় ছাত্রলীগের জনসভার অব্যবহিত পর পল্টন ময়দান থেকে এক মিছিলের আমি নেতৃত্ব করবো।

(গ)          রেডিও, টেলিভিশন বা সংবাদপত্রসমূহ ঘটনাবলী সম্পর্কে আমাদের বক্তব্য বা বিবৃতি পেশ না করলে এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত সকল বাঙ্গালি বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের অপচেষ্টার সাথে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করবেন।

(ঘ)          ৭ মার্চ বিকেল দুইটায় রেসকোর্স ময়দানে এক জনসমাবেশে আমি বক্তৃতা করবো। তখন পরবর্তী কর্মপন্থা জানানো হবে।

(ঙ)         আমি শান্তিপূর্ণ সুশৃঙ্খলভাবে আমাদের সাধারণ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আবেদন জানাচ্ছি। আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, কোন প্রকার শৃঙ্খলা ভঙ্গ আমাদের আন্দোলনের স্বার্থের পরিপন্থি হবে এবং উস্কানিদাতা ও গণবিরোধী চক্রের স্বার্থের অনুকুল হবে।

[সুত্র ঃ আজাদ ও দৈনিক পাকিস্তান, ৩ মার্চ, ১৯৭১]

 

১৯৭১ সালের ৩ রা মার্চ পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকায় ১০ ঘন্টার জন্যে সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। জনগণ তা অগ্রাহ্য করে রাস্তায় অসংখ্য মিছিল বের করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান দেয়। সান্ধ্য আইন ভঙ্গকারীদের লক্ষ্য করে সেনাবাহিনী গুলি ছোড়ে। এতে বহু হতাহত হয়। সংবাদপত্রে এতদসংক্রান্ত সংবাদ ও ছবি ছাপার ওপর সেন্সরশিপ ও সামরিক আইন বিধি জারি করা হয়। ৩ রা মার্চ সারা বাংলাদেশে পূর্ণ হরতাল পালিত হয়।

পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভার আয়োজন করে। এ জনসভা ছিল তৎকালের এক জঙ্গি সমাবেশ। মিছিল-সমাবেশের অগণিত নারী-পুরুষের হাতে বাঁশের লাঠি, বল্লম, লোহার রড, টেটা আ তলোয়ার ছিল। উল্লেখ্য, ছাত্র সমাজ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার জন্যে বঙ্গবন্ধুকে চাপ দিচ্ছিল। বঙ্গবন্ধু জনগণকে শান্তিপূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবার আহ্বান জানান। তাঁর ভাষণের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো।]

গতকাল আর আজ এই শহরের অলিতে-গলিতে শত শত নিরপরাধ মানুষকে গুলি করা হয়েছে। অনেকে আহত এবং নিহত হয়েছে। এ ধরনের হত্যাকান্ড যাঁরা করছেন, তাঁদের সতর্ক করে দিতে চাই, হত্যা করে এ আন্দোলন থামানো যাবে না। ৭ কোটি মানুষকে হত্যা করা সম্ভব নয়। আমাদেরকে মৃত্যুর ভয় দেখিয়ে লাভ নাই, কারণ আমরা প্রাণ দিতে জানি। আমরা মারা গেলেও বাংলার মানুষের স্বাধিকার অর্জিত হবে।

সেনাবাহিনীর কাজ বিদেশী শত্রুর মোকাবিলা করা, ভাইকে হত্যা করা নয়। গুলি করার জন্যই আমাদের করের পয়সার আপনাদের অস্ত্র দেয়া হয়। মেহেরবানি করে আপনারা ব্যারাকে ফিরে যান। আমার মানুষ শান্তি পূর্ণভাবে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।

বাঙ্গালির উপর গতরাতে যে নির্মম হর্ত্যাকান্ড চালানো হয়েছে, তারপর আর স্থির থাকা যায় না। নিরস্ত্র বাঙ্গালিকে হত্যার মধ্যে কোন বীরত্ব নেই, এটা কাপুরুষতা। গতকাল রাতে নিজ কানে আমি মেশিনগানের গুলির শব্দ শুনতে পেয়েছি।

দেশের বর্তমান অবস্থার জন্য বাংলার মানুষ বা আওয়ামী লীগ দায়ী নয়। এ অবস্থায় আমরা সৃষ্টি করিনি। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও আমাদের কথা শোনা হয়নি। জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানের অনুরোধ জানাই। কিন্তু জনাব ভুট্টো তাতে অসম্মতি জানিয়ে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন আহ্বানের কথা বলেন। তাঁর কথামত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াও ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবানের কথা ঘোষণা করেন।

আমরা প্রেসিডেন্টের ঘোষণা অনুযায়ী পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের প্রস্তুতি নেই। কিন্তু জনাব ভুট্টো আবার এই অধিবেশন পিছিয়ে দেবার দাবি তোলেন। আমরা অধিবেশন বাতিল না করার জন্য বলি। জনাব ভুট্টো তখন শুধু অস্বীকৃতিই নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের আগুন জ্বালাবেন বলে হুমকি দিলেন। অথচ তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ না করে ৭ কোটি বাঙ্গালির বিরুদ্ধে অন্ত্র ধারণ করা হলো। এর থেকে বড় লজ্জার আর কিছু নাই।

যারা বাংলার স্বাধীকার আদায়ের আন্দোলন নস্যাৎ করতে চায়, তারাই হরতালের সুযোগে লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও দাঙ্গা করছে। যদি আপনারা আমাকে ভালবাসেন, যদি সংগ্রামে জয়ী হতে চান, তাহলে আপনারা এসব লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও গুন্ডামিকে দৃঢ়তার সাথে বাঁধা দেবেন। বাঙ্গালি হোক, বিহারী হোক, স্থানীয় হোক আর বহিরাগত হোক-সবাই আমাদের জিম্মায়, এদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। তাই শান্তিপূর্ণভাবে শৃঙ্খলার সাথে গণআন্দোলনের লক্ষ্যপথে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আপনাদের সবাইকে আহ্বান জানাচ্ছি। শৃঙ্খলার সাথে আন্দোলন না করলে লাভের চেয়ে ক্ষতিই বেশী হবে। আপনারা হলেন একটি সুশৃঙ্খল স্বেচ্ছাবাহিনী। যে নির্দেশ দেব তা তালিম করবেন।

আমি আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে জনতার সামনে আসতে বাধ্য হয়েছি। ইচ্ছা ছিল ৭ মার্চ সব কথা বলবো। কিন্তু পরিস্থিতিতে বাধ্য হয়ে আবার ছাত্রলীগের সভায় এসেছি। জানি না আপনাদের সামনে আর বক্তৃতা করতে পারবো কি পারবো না। তাই আজ স্পষ্টভাবে আমি আমার কর্মসূচি জানিয়ে দিতে এসেছি।

যারা আমাকে কারাগার থেকে মুক্ত করে এনেছে এবং ভোট দিয়েছে-আমি মরে গেলেও আমার আত্মা তাদের সুখ ও সমৃদ্ধি যখন দেখতে পাবে, তখন শান্তি পাবে। ৭ কোটি মানুষের হত্যা করতে পারবেন না। আমি না থাকলেও বাংলার মানুষ তাদের লক্ষ্যপথে এগিয়ে যাবে।

পশ্চিম পাকিস্তানের শোষিত, সাধারণ মানুষ আমাদের ভাই, আমরা তাদের সাথে থাকতে চাই। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা তা চান না। গত ২৩ বছর বাংলাদেশকে শোষণ করে ছোবড়া বানিয়ে ফেলা হয়েছে, তাই পশ্চিম পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দ বাংলার মানুষের সাথে থাকতে চান না।

সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের সাংবাদিকরা নির্ভীকভাবে সকল খবর পরিবেশন করবেন। যদি আপনাদের কোন বিধি-নিষেধ আরোপ করা জয়, আপনারা তা মানবেন না। সংবাদপত্র মালিক যদি এতে বাঁধা দেয় তাহলে চাকা বন্ধ করে দেবেন।

আগামী ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন সকাল থেকে বেলা ২ টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হবে। এই সময়ে কোর্ট-কাছারি, অফিস-আদালত, সরকারী অফিস, কল-কারখানা, রেল, স্টীমার, বিমানসহ সকল যোগাযোগ ব্যবস্থা বন্ধ থাকবে। সরকারী কর্মচারীবৃন্দ অফিস-আদালতে যোগ দেবেন না। সামরিক বাহিনী প্রত্যাহার ও জনগণের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করা পর্যন্ত সকল প্রকার ট্যাক্স ও খাজনা প্রদান থেকে প্রত্যেকে বিরত থাকুন।

আমি সংবাদপত্র, এম্বুলেন্স, ওষুধের দোকান, বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহ, বন্ধ না করার নিদের্শ দিয়েছি। এই কয়দিনের মধ্যে যদি সরকারী মনোভাব পরিবর্তন না হয়, তাহলে ৭ মার্চ আমি আমার যা বলার তা বলবো। হরতাল চলাকালে সকলে গরিব-দুঃখীদের সাহায্য করবেন এবং বেলা ২টার পর রিকশাওয়ালাদের বেশি পয়সা দিবেন। হাসপাতালে গুলির আঘাত আহত ব্যক্তিদের জন্য ব্লাড ব্যাংকে রক্তদানেরও আমি জরুরি আহ্বান জানাই।

আমরা শান্তিপূর্ণভাবে সত্যাগ্রহের মাধ্যমে দাবি আদায় করতে চাই। মনে রাখবেন আমি জনগণের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবো না। রক্তের বিনিময়ে হলেও দুঃখী জনগণের বিশ্বাস অক্ষুন্ন রাখবো। যদি আমার মৃত্যু হয়, তবুও বেঈমানী করবো না।

[সূত্র ঃ সংগ্রাম, পূর্বদেশ, দৈনিক পাকিস্তান ও আজাদ; ৪ মার্চ, ১৯৭১]

 

১৯৭১ সালের ৩ মার্চ সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর বিবৃতি

[১৯৭১ সালের ৩ মার্চ পিন্ডির প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে এক ঘোষণায় বলা হয় যে, একটি সাধারণ লক্ষ্য অর্জনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে সাহায্য করতে প্রেসিডেন্ট তাঁর সাধ্যানুযায়ী সবকিছুই করবেন বলে গত ১ মার্চ যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, তার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ঢাকায় এক বৈঠকে মিলিত হবার জন্যে জাতীয় পরিষদের সকল পালামেন্টারী গ্রুপের নেতাদের কাছে জরুরী ব্যক্তিগত আমন্ত্রণলিপি পাঠিয়েছেন।

আগামী ৮ মার্চ পবিত্র আশুরার দিন হওয়ায় আগামী ১০ মার্চ এ সম্মেলনের দিন নির্ধারণ করা হয়েছে। এ সম্মেলন অনুষ্ঠানের পর প্রেসিডেন্ট তার কোন কারণ দেখাচ্ছেন না। বঙ্গবন্ধু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার এ আমন্ত্রণকে ‘নিষ্ঠুর তামাশা’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন এবং সংবাদপত্রে প্রদত্ত বিবৃত্তির মাধ্যমে তা প্রত্যাখ্যান করেন। বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ উদ্ধৃত হলো।]

ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বাংলাদেশের অন্যান্য জায়গায় যে মুহুর্তে ব্যাপকভাবে নিরস্ত্র বেসামরিক ব্যক্তিদের হত্যা করা হচ্ছে, যে সময় আগামী ১০ মার্চ ঢাকায় পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের সাথে রাজনৈতিক নেতাদের এক সম্মেলনে মিলিত হবার প্রস্তাবিত আমন্ত্রণ বেতারে ঘোষণা করা হয়।

এখানো যখন বিভিন্ন সড়কে শহীদদের রক্ত শুকিয়ে যায়নি, এখনো যখন কিছু কিছু লাশ কবর না দেয়া অবস্থায় পড়ে রয়েছে এবং শত শত ব্যক্তি হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে সংগ্রাম করছে, সে সময় একটি নিষ্ঠুর পরিহাসের মত এই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। আর এমন কিছু ব্যক্তিদের সাথে মিলিত হবার জন্য এই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে যাদের দূরভিসন্ধিই নিরপরাধ ও নিরস্ত্র কৃষক, শ্রমিক ও ছাত্রদের মৃত্যুর জন্য দায়ী।

সেনাবাহিনী মোতায়েনসহ আমাদের কানে এখনো যে অস্ত্রের কর্কশ ভাষা শোনা যাচ্ছে, তাতে এই ‘আমন্ত্রণ কার্যত বন্দুক উঁচিয়েই জানানো হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে এ ধরনের আমন্ত্রণ গ্রহণের প্রশ্নই উঠতে পারে না। তাই আমি এ ধরনের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করলাম।

[সূত্র ঃ দৈনিক সংগ্রাম; ৪ মার্চ, ১৯৭১]

 

১৯৭১ সালের ৪ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আহ্বান

[১৯৭১ সালের ৩ মার্চ রাতে ঢাকাসহ কয়েকটি শহরে পুনরায় সান্ধ্য আইন জারি করা হয়। জনগণ আবার সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করে এবং সেনাবাহিনীর মোকাবিলা করে গুলিবর্ষণে ঢাকায় অন্তত ২৩ জন নিহত ও ৩০০ জনেরও বেশি আহত হয়। চট্টগ্রামে ১২১জন নিহত ও অগণিত মানুষ আহত হয়। ৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু জনগণকে আহ্বান জানান। তাঁর অভিনন্দন বার্তার বর্ণনা নিম্নরূপ ছিল।]

শোষণ ও ঔপনিবেশিক শাসন বজায় রাখার ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো এবং আমাদের আহ্বানে বাংলাদেশের প্রতিটি নারী-পুরুষ ও শিশু যে স্বতস্ফুর্ত সাড়া দিয়েছেন, তার জন্য আমি আমাদের বীর জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। বাংলাদেশের নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণ, যেমন-শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্ররা তাদের অধিকার কেড়ে নেয়ার বিরুদ্ধে বুলেটের সামনে যে সাহস ও দৃঢ়সংকল্প নিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে, বিশ্বের জনগণের তা জানা দরকার।

ক্রমাগত হরতালের ফলে জনগণকে যে অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা সহ্য করার জন্যও আমি আমাদের দৃঢ়প্রতিজ্ঞ জনগণকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। তাদের অবশ্য এ কথা মনে রাখতে হবে যে চরম আত্মত্যাগ ব্যতীত কোন জনগণই মুক্তি পায়নি। কাজেই জনগণকে যে কোন মূল্যে মুক্তির সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।

পাঁচ ও ৬ তারিখের ৬ টা থেকে বেলা ২ টা পর্যন্ত হরতাল অব্যাহত থাকবে। তবে নিম্নলিখিত ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম হবার প্রয়োজন দেখা দিয়েছেঃ

১.            যে সমস্ত সরকারী ও বেসরকারী অফিসে কর্মচারীদের এখনো বেতন দেয়া হয়নি, সে সমস্ত অফিস কেবল কর্মচারীদের বেতন প্রদানের জন্য বেলা আড়াইটা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত খোলা থাকবে। বেতনের চেকের টাকা প্রদান এবং বাংলাদেশের মধ্যে নগদ অর্থ আদান-প্রদানের জন্য ব্যাংকগুলো উক্ত সময় (বেলা আড়াইটা থেকে সাড়ে ৪টা) খোলা থাকবে। ষ্টেট ব্যাংকের এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

বেতনের ব্যাপারে বাংলাদেশে অনুর্ধ্ব দেড় হাজার টাকার চেক ষ্টেট ব্যাংক থেকে ভাঙ্গানো যাবে; তবে ষ্টেট ব্যাংকের মারফত বা অন্য কোনভাবে বাংলাদেশের বাইরে কোন টাকা পাঠানো যাবে না। রেশনের দোকান বা খাবার সরবরাহকারীদেরও তাদের ব্যবসার জন্য এই সুযোগের সদ্ব্যবহার করতে হবে।

২.            নিম্নলিখিত অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিসগুলোকে হরতালের আওতামুক্ত রাখা হয়েছেঃ

(ক) হাসপাতাল ও ওষুধের দোকান (খ) এম্বুলেন্স গাড়ী (গ) চিকিৎসদের গাড়ী (ঘ) ডাক্তারদের গাড়ী (ঙ)সংবাদপত্র (চ) পানি সরবরাহ (ছ) গ্যাস সরবরাহ (জ) বিদ্যুৎ সরবরাহ (ঝ) স্থানীয় টেলিফোন এবং বাংলাদেশের অন্যান্য জেলার মধ্যে ট্রাঙ্কল টেলিফোন (ঞ) দমকল (ট) ঝাড়–দার ও ময়লাবাহী ট্রাক।

[সূত্র ঃ দৈনিক পাকিস্তান; ৫ মার্চ, ১৯৭১]

 

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ [ সম্পূর্ণ ]

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ : (সরকার থেকে মানুষ ছুটছে রেসকোর্সের দিকে। কৃষক, শ্রমিক, কামার, তাঁতী, জেলে, সাংবাদিক সরকারী-বেসরকারী চাকুরীজীবিসহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ ভীড় করল রেসকোর্স ময়দানে। সব পত্রিকার হেড কাভারেজ হলঃ শেখ মুজিব একটি দেশ, একটি নাম। কারো হাতে লাঠি, কারো হাতে বৈঠা, কারো হাতে লাঙ্গল। মুহুর্তেই লাখো লাখো জনতা এসে করল ভীড়। যেন এক বিশাল সীমাহীন জনসমুদ্র। সবার মুখে মুখে একটাই শ্লোগান, “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু”।

ছাত্রনেতারা মাইকে বারবার ঘোষণা করছেঃ আপনারা ধৈর্য্য ধরে বসুন। শান্ত হোন। আপনাদের প্রিয় নেতা এখনই আসবেন। কিন্তু একি! জনগণের যেন বাঁধ সইছে না। কোথায় প্রিয় নেতা? কোথায় আমাদের প্রাণের নেতা? কখন আসবে? কখন আসবে? জনগণের অপেক্ষার বাঁধ ভেঙ্গে কিছুক্ষণের মধ্যেই প্রিয় নেতা স্টেজে উঠে দাঁড়ালেন।

হাত নাড়লেন বিশাল জনসমুদ্রের দিকে। জনসমুদ্র মুখরিত হয়ে উঠল শ্লোগানেঃ “জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু”। শেখ মুজিব দু’চোখ ভরে দেখলেন স্বাধীনতাকামী মানুষের দিকে। সবাই যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে। একমাত্র ভরসাই এখন শেখ মুজিব। শেখ মুজিব মাথা উঁচু করে বুক টান টান করে দাঁড়ালেন। হাতে তুলে নিলেন মাইক। মুহুর্তেই গর্জে উঠলেন-)

‘ভাইয়েরা আমার, আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হচ্ছে। আজ বাংলার মানুষ চায়, বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়। কি অন্যায় করেছিলাম। নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামীলীগকে ভোট দেয়।

আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে। আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করবো এবং এদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। এদেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে কিন্তু দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস, এদেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালের রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৮ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে দশ বৎসর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে।

১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে, ৭ জুনে আমাদের ছেলেদের হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার দায়িত্বভার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো।

আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেয়া করেছি। আমি শুধু বাংলার নয় পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ ফেব্রুয়ারী তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না। তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন প্রথম সপ্তাহের মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম, ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসবো। আমি বললাম এ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব। এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।

জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন। বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরো আলোচনা হবে। তারপর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম আপনারা আসুন, বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করি। তিনি বললেন পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এ্যাসেম্বলি। তিনি বললেন যে, তাকে মেরে ফেলে দেয়া হবে। যদি কেউ এ্যাসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত জ্বালিয়ে দেয়া হবে। দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে।

আমি বললাম এ্যাসেম্বলি চলবে-তারপর হঠাৎ এক তারিখে এ্যাসেম্বলি ডেকেছিলেন, আমি বললাম যে, আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। পঁয়ত্রিশ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তানথেকে এখানে আসলেন। তারপর হঠাৎ বাদ করে দেয়া হলো। দোষ দেয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেয়া হলো আমাকে। বাদ করে দেয়ার পরে এদেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল। আমি বললাম আপনারা কল-কারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ যারা ছিল আপন ইচ্ছায় রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্যে স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো।

কি পেলাম আমরা? যে পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি বহিঃশত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে। আজ সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার দেশের গরীব দুঃখী আর্ত মানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু, আমরা বাঙ্গালীরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করছি, তখনই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে।

টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম, জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কিভাবে আমার গরীবের উপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপর গুলি করা হয়েছে! কি করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে! কি করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। আপনি আসুন, দেখুন, বিচার করুন। তিনি বললেন,  আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিলে কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলেছি, কিসের আর সিটিং, কার সঙ্গে বসব? ঐারা আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে বক্তৃতা দিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব?

বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ [ সম্পূর্ণ ]
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান | Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman
হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচঘন্টা বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপর দিয়েছেন। বাংলার মানুষের উপরে দিয়েছেন। ভাইয়েরা আমার, পঁচিশ তারিখে এ্যাসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি দশ তারিখে বলে দিয়েছি, হয় ঐ শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আর,টি,সিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এ্যাসেম্বলি কল করেছেন আমার দাবী মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল উইথ ড্র করতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখব আমরা এ্যাসেম্বলি বসতে পারব কি পারব না।

এর পূর্বে এ্যাসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না। আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না। আমরা এদেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিস্কারভাবে বলতে চাই, বাংলাদেশের কোর্ট, কাচারী, আদালত, ফৌজদারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরীবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য রিক্সা, ঘোড়ার গাড়ি, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে, শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রিম কোট, ওয়াপদা কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এরপর যদি বেতন দেয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে, আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল, প্রত্যেক ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তোলো।

তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। জীবনের তবে রাস্তা-ঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দিবার নাও পারি, তোমরা বন্ধ করে দেবে। আমরা ভাতে মরাব, আমরা পানিতে পারব, তোমরা আমার ভাই, তোমরা ব্যারাকে থাক। কেউ তোমাদের কিছ বলবেনা। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা কর না। সাত কোটি মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারবে না। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামীলীগ থেকে যতদুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব।

যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌঁছিয়ে দেবেন। সরকারী কর্মচারীদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এ দেশের মুক্তি না হবে ট্যাক্স বন্ধ করে দাও। কেউ দেবে না। মনে রাখবেন, শত্রু বাহিনী ঢুকেছে। নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙ্গালী, নন বাঙ্গালী যারা আছেন তারা আমাদের কথা না রাখবেন রেডিও, টেলিভিশনের কর্মচারীরা যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে, তাহলে কোনো বাঙ্গালী রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমার নিউজ না দেয়, কোনো বাঙ্গালী টেলিভিশনে যাবেন না।

দুই ঘন্টা ব্যাংক খোলা থাকবে, যাতে মানুষ তাদের মাইনাপত্র  নিবার পারে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানথেকে পশ্চিম পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাফ আমাদের এই পূর্ব পাকিস্তানে চলবে এবং বিদেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙ্গালীরা বুঝে শুনে কাজ করবেন। প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্তা আরো দেব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, ‘জয় বাংলা।

বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে আরও পড়ুন:

 

৭ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যায় সংবাদপত্রে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর বিবৃতি

[১৯৭১ সালের ৬ ও ৭ মার্চ তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বাসভবনে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির রুদ্ধতার বৈঠক হয়। দুপুরে সামান্য বিরতি ছাড়া দীর্ঘ সময় ধরে বৈঠক চলে। রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দিতে যাবার পূর্বে এই বৈঠক হয়। ছাত্র-জনতার দাবী অনুযায়ী বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়ার প্রশ্নে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। শেষ মুহুর্তে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বঙ্গবন্ধু সভায় চারটি দাবী উত্থাপন করবেন বলে স্থির হয়। ৭ই মার্চ সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধুর জনসভায় প্রদত্ত ভাষণে উত্থাপিত দাবী বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে এবং সমগ্র পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেন। সংবাদ মাধ্যমে প্রদত্ত উক্ত বিবৃত্তির পূর্ণ বয়ান উদ্ধৃত হলো।]

পহেলা মার্চ আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণার পর থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনসাধারণকে সামরিক বাহিনীর মোকাবিলা করতে হচ্ছে। নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণ শ্রমিক, কৃষক ও ছাত্র যারা জাতীয় পরিষদ স্থগিত রাখার আকস্মিক ও অনভিপ্রেত ঘোষণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর জন্যে রুখে দাঁড়িয়েছিল, তাদের উপর বেপরোয়াভাবে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। গত সপ্তাহে যারা প্রাণ দিয়েছেন, অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার সেচ্ছাচারমূলক ও অযাচিত কাজের বিরুদ্ধে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা করতে গিয়েই তারা শহীদ হয়েছেন।

এই শহীদের ধ্বংসাত্মক কাজে লিপ্ত ব্যক্তি বলে চিত্রিত করা সত্যের অপলাপ মাত্র। সত্যিকারের রাজত্ব কায়েমের জন্য যারা দায়ী বস্ততপক্ষে তারাই হচ্ছে আসল দুস্কৃতকারী। এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয় যে, গত সপ্তাহে যে ভয়াবহ অবস্থার অবতারণা করা হয়েছে তা দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট ঢাকা আসার একটু সময় করতেও সক্ষম হয়নি। প্রেসিডেন্ট যাকে ‘ক্ষমতার নূন্যতম প্রয়োগ’ বলে অভিহিত করেছেন, তার ফলেই যদি হাজার হাজার লোক হতাহত হয়ে থাকে, তাহলে কি আমাদের এটাই বুঝতে হবে যে, তিনি যাকে পর্যাপ্ত ক্ষমতার প্রয়োগ’ বলবেন, তার লক্ষ হবে সবকিছু নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া।

বাংলাদেশের নিরস্ত্র বেসামরিক জনগণের বিরুদ্ধে ক্ষমতার এই নগ্ন হুমকির আমি নিন্দা করছি। জাতি অনেক অর্থব্যয়ে সশস্ত্রবাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করেছে বিদেশী হামলা প্রতিহত করার জন্য, বেসামরিক নারিকদের নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার জন্য নয়। অপর অঞ্চলের উর্দি পরা সৈনিকরা যে বাড়াবাড়ি করছে, তারা দখলকারী বাহিনীর মতো যে ভূমিকা পালন করছে তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের আজ রক্ষা-ব্যবস্থা প্রয়োজন।

বলা হয়েছে যে, জাতীয় পষিদের অধিবেশন স্থগিত রাখাকে ভূল বোঝা হয়েছে। আমি প্রেসিডেন্টকে জিজ্ঞেস করতে চাই, পশ্চিম পাকিস্তানের বেশ কিছু সংখ্যক সদস্য এবং একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের ঘোষিত অভিপ্রায়ের বিরুদ্ধে একটি সংখ্যালঘু দলের একক খেয়ালের প্রতি সাড়া দিয়েই কি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত রাখা হয় নাই?

আমরা ১৫ ফেব্রুয়ারীর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের সুপারিশ করেছিলাম। অপরদিকে উক্ত সংখ্যালঘু গ্রুপটি চেয়েছিলো মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিশেন হোক। এই সংখ্যালঘু গ্রুপটির মতের কাছেই নতি স্বীকার করা হয়েছে এবং ৩ মার্চ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে আপত্তি উত্থাপন করেছে। প্রথমত এই সংখ্যালঘু গ্রুপ একটি অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য উত্থাপন করে বলেছে যে, ঢাকা এলে এর সদস্যরা বিপন্ন হয়ে পড়বে এবং তারা ডবল জিম্মি হয়ে যাবে।

এরপর এই দল থেকে এই মর্মে মত প্রকাশ করা হয় যে, তারা যেসব শর্ত আরোপ করতে তা মেনে নিলেই শুধু তারা পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করবে। এরপর আরেক পর্যায়ে এই সংখ্যালঘু গ্রুপের সদস্যরা জাতীয় পরিষদ থেকে পদত্যাগেরও সিদ্ধান্ত নেয়। সবচেয়ে নিম্নতর তা হলো এই যে, উক্ত গ্রুপের পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নেওয়ার সাথে সাথেই আইনগত কাঠামো আদেশে আনা হলো একটি সংশোধনী। এতে বলা হলো পরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার আগেই সদস্যরা ইচ্ছা করলে পদত্যাগ করতে পারবেন। কিন্তু এরপর উক্ত সংখ্যালঘু গ্রুপ সিদ্ধান্ত নিলেন পদত্যাগ না করার।

এই দলের এই এলোপাতাড়ি ইচ্ছা অনিচ্ছা চরমে পৌঁছালে ২৭ ফেব্রুয়ারী। সেদিন এই দল থেকে ঘোষণা করা হলো যে, এই দলটির অংশগ্রহণ ছাড়া যদি পরিষদের অধিবেশন বসে তাহলে এই দল একটি গণ-আন্দোলন শুরু করবে। এই দল এতদূর পর্যন্ত বলতে পারল যে, পরিষদের অধিবেশনে যারা যোগদান করবে, তাদের ওপর জনগণ পূর্ণ প্রতিশোধ নেবে এবং জনগণ যদি প্রতিশোধ নিতে ব্যর্থ হয় তাহলে এই দলটিই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এই দলটি থেকে আরো হুমিক দেয়া হয় যে, এই দলের কোন সদস্য যদি পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করে তাহলে দলীয় কর্মীরাই তাদের চিশ্চিহ্ন করে দেবে। এই সময়ের মধ্যে আমাদের পার্লামেন্টারী পার্টি ঢাকায় সমবেত হন এবং পশ্চিম অঞ্চলের বিভিন্ন প্রদেশ থেকেও পরিষদ সদস্যরা ঢাকা আসতে শুরু করেন।

প্রধান নির্বাচনী কমিশনারও ঢাকা এসে পৌঁছেন এবং ২ মার্চ পরিষদের মহিলা সদস্যদের নির্বাচন হবে বলে ঘোষণা করেন। উদ্বোধনী অধিবেশনের জন্য প্রেসিডেন্টের নিজেরও ১ মার্চ  ঢাকা আসার সম্ভাবনা ছিল।

শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ব্যাপারে আমাদের  নিজেদের অবস্থানও আমরা অত্যন্ত ষ্টুস্পষ্টভাবে বিবৃত করেছিলাম ২৪ ফেব্রুয়ারী তারিখে প্রদত্ত আমাদের বিবৃবিতে। এতে আমরা পাকিস্তানের প্রত্যক অংশ থেকে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত প্রতিটি সদস্যকে আবারও আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম এই ঐতিহাসিক কাজে আমাদের সহযোগিতা করার জন্য। গত ২৭ ফেব্রুয়ারী আমরা এই পর্যন্ত বলেছিলাম যে, কোনো সদস্য নয় ও যুক্তিসঙ্গত কিছু পরিষদে উত্থাপন করলে আমরা তা মেনে নেবো। কিন্তু সে প্রস্তাবও উপেক্ষা করা হয় এবং তা করা হয় সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃতভাবে।

পহেলা মার্চ থেকে বিবৃতিতে আকস্মিক ও অহেতুকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্র্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। এজন্য অজুহাত দেখান হয়, পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক বিরোধ চলছে। বাংলাদেশের মানুষ কি এর থেকে মনে করতে পারে না যে, একটি অগণতান্ত্রিক সংখ্যালঘু দলের নির্দেশে তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন করা হচ্ছে। তারা কি যুক্তিসঙ্গতভাবেই ভাবতে পারে না যে, একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ শাসনতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ব্যাহত করা এবং সংখ্যাগুরু জনসাধারষতে তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্য কতিপয় শক্তির সাথে হাত মিলিয়েছে? দ্রুত সামরিক প্রস্তুতি গ্রহণ থেকে এসব সন্দেহ আরো দৃঢ়তর হয়ে উঠে। এতে প্রমাণ হয়, ‘রাজনৈতিক বিরোধ’ রূপ নিচ্ছে, যদি না সংখ্যাগুরু সংখ্যালঘুর নির্দেশের কাছে মাথা নত করে।

কার্যত ২৪ ফেব্রুয়ারির বিবৃতিতে আরো হুশিয়ার করে দিয়েছিলাম, যখনই আমাদের দেশে জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ক্ষমতা গ্রহণ করতে গেছে, তখনই জঘন্য চক্রান্তকারীরা তাতে হস্তক্ষেপ করেছে। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের কায়েমি স্বার্থের প্রতিভূ গোটা কয় ব্যক্তি গণতন্ত্রকে বানচাল করে বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষকে বঞ্চনা করেছে। ১৯৫৩ সালে ক্ষমতাসীন পাঞ্জাবী জোটের চক্রান্তে বাঙ্গালী প্রধানমন্ত্রী বরখাস্ত হন। একই চক্র ১৯৫৪ সালে বাংলার নির্বাচন সরকার এবং খোদ গণ-পরিষদকেই কায়েমি স্বার্থ সেখানেও আবার আঘাত হানে এবং ক্ষমতা জবরদখল করে নেয়। কিন্তু তাদের এ কথা জেনে রাখা দরকার, বাংলাদেশের জাগ্রত জনসাধারণ এবং পশ্চিমাঞ্চলে নির্যাতিত জনতা সম্ভাব্য সব উপায়ে তাদের এই হীন চক্রান্ত প্রতিরোধ করবেই।

সত্যের খাতিরে আমি পরিস্কারভাবেই বলে দিতে চাই, গোলটেবিল বৈঠকে জাতীয় সম্মেলনে অনুষ্ঠিত হোক, এ ধরণের কোন ধারণাই আমি দিই নাই। আমি প্রেসিডেন্টকে কেবল এই কথাই জানিয়ে দিয়েছিলাম, বাংলাদেশে কি মারাত্মক পরিস্থিতি বিরাজ করছে তা দেখা এবং যথেষ্টভাবে নিরস্ত্র জনসাধারণকে হত্যা বন্ধ করার উদ্দেশ্যে তার ঢাকা আসা উচিত। প্রেসিডেন্ট প্রস্তাবিত পূর্ববর্তী বৈঠকের ব্যাপারে ঘটনা হচ্ছে এই যে, আমরা পরিস্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, কয়েক সপ্তাহ আগেই কার্যনির্বাহী কমিটি ও পার্লামেন্টরী বোর্ডের বৈঠক নিয়ে ব্যস্ত থাকায় তখন আমাদের পক্ষে রাওয়ালপিন্ডি যাওয়া সম্ভব ছিলো না।

অধিকন্তু আমরা এ কথাও জানিয়ে দিয়েছিলাম যে, শাসনতান্ত্রিক সদস্যাদি গোপন আলোচনার বদলে জাতীয় পরিষদ ও তার কমিটিসমূহের মাঝেই সমাধান করা উচিত এবং একবার জাতীয় পরিষদ গঠিত হবার পর গোলটেবিল কিংবা গোপন বৈঠকের কোনো যুক্তিই নাই।

আওয়ামী লীগ কোনভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাঁধা সৃষ্টি করছে এ অবিযোগের জবাবেই আমি এসব বিস্তারিত ভাবে উল্লেখ করলাম। এ ধরণের বাঁধা সৃষ্টি থেকে যাদের ফায়দা হতে পারে সংখ্যাগুরু দল তাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারে না। দেশের জনসাধারণ এবং কার্যত সারা বিশ্বের কাছেই এই আজ এ কথা পরিস্কার যে, পশ্চিমাঞ্চলের একটি সংখ্যালঘু গ্রুপ ক্ষমতা হস্তান্তরের পথে বাঁধা সৃষ্টি করেছে এবং করে চলেছে। দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট নিজে ও সংখ্যালঘু চক্রটির নির্দেশে নতি স্বীকার করাকেই তার নৈতিক কর্তব্য বলে ধরে নিয়েছেন।

একটি সংখ্যালঘু চক্র যদি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে বানচাল করার জন্য কায়েমি স্বার্থের সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়, তবে গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্থাই বানচাল এবং প্রস্তাবিত ক্ষমতা হস্তান্তর অসম্ভব। শেষ পর্যন্ত যদি গণতান্ত্রিক জীবনব্যবস্তাই বানচাল এবং প্রস্তাবিত ক্ষমতা হস্তান্তর ব্যর্থ হয় তবে তার দায়িত্ব এই সংখ্যালগু চক্র এবং তার সাথে চক্রান্তকারীদেরই বইতে হবে।

এসব মহলই কি সেই গুটিকয় লোক নয়, যারা একত্রে বসবাসের ভিত্তি উদ্ভাবনের জন্য  জনসাধারণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রচেষ্টার উপর মারাত্মক আঘাত হেনেছে। প্রতিটি সুস্থমনা ব্যক্তিই আজকে যে প্রশ্নটি উত্থাপন করবেন তা হচ্ছে, বাংলাদেশের সর্বত্র নিরস্তু জনতাকে গুলি করে সেনাবাহিনী পাকিস্তানের সংহতি অকন্ডতা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব পালন করেছে, না অন্য কিছু? এ ভূমিকা নিয়ে যাবার পর এখন দেশে ক্ষমতার একমাত্র বৈধ উৎস হচ্ছে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। কোন ব্যক্তিবিশেষই নিজেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের চেয়ে অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন বলে দাবী করতে পারেন না।

বাংলাদেশে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা এই দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করছি, বাংলাদেশে আমরাই একমাত্র বৈধ উৎস। গত সাত দিনের ঘটনাবলি প্রমাণ করেছে যে, বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারের সমস্ত শাখা আমাদেরকে বৈধ ক্ষমতার উৎস হিসেবে মেনে নিয়েছে এবং আমাদের নির্দেশাবলি মেনে চলেছে। প্রেসিডেন্ট ও ইসলামাবাদস্থ সরকারকে এই মূল সত্য মেনে নিতে হবে। কাজেই জনগণের নির্বাচিত  প্রতিনিধিদের ক্ষমতা প্রয়োগের ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ না করা বাংলাদেশের জনগণের ঘোষিত ইচ্ছার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে।

এরপর আমাদের আসতে হয় আগামী ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের কথায়। আমরা বহুবার এ অধিবেশন আহ্বানে জরুরী প্রয়োজনীয়তার কথা জোর দিয়ে বলেছি। কিন্তু আজ এক অস্বাভাবিক এবং মারাত্মক পরিস্থিতির সৃষ্টি করা হয়েছে। বাংলাদেশের বেসামরিক জনগণকে সামরিক শক্তির সাহায্যে মোকাবিলা করার নীতির অনুসরণে প্রকৃতপক্ষে এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষ হতাহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ ও বিশ্বের সর্বত্র সুবিবেক জনগণসহ সবদিক থেকে এই গণহত্যা বন্ধ করতে হবে বলে আওয়াজ তোলা হচ্ছে।

জাতীয় পরিষদের সদস্যরা ভীতিপদ পরিবেশে কাজ করবে এটা আশা করা যায় না। যতক্ষণ পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও অস্ত্র আমদানীসহ এই মোকাবিলাজনিত অবস্থা বজায় থাকে, যতক্ষণ পর্যন্ত এই নির্যাতনের পরিবেশ অব্যাহত থাকে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশ থেকে বেসামরিক জনতার উপর প্রতিদিন সামরিক বাহিনীর গুলিবর্ষণের খবর আসতে থাকবে, ততক্ষণ পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত সদস্যরা বন্দুকের মুখে জাতীয় পরিষদে অধিবেশনে যোগদানের বিষয় বিবেচনা করবেন, এটা আশা করা যায় না।

যদি প্রেসিডেন্ট আন্তরিকভাবে কামনা করেন যে, জাতীয় পরিষদ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সার্বভৌম পরিষদ হিসেবে কাজ করবে, তাহলে অবিলম্বে নিম্নলিখিত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

ক.           অবিলম্বে সকল সৈন্যকে ছাউনিতে ফিরিয়ে নিতে হবে।

খ.            বেসামরিক জনগণের ওপর গুলিবর্ষণ অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে, যাতে এখন থেকে একটা বুলেটও ছোড়া না হয়।

গ.            সামরিক শক্তিবৃদ্ধি এবং দেশের পশ্চিম অংশ থেকে বিপুল সংখ্যক সৈন্য আমদানী অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে।

ঘ.            বাংলাদেশে সরকারের বিভিন্ন শাখায় কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ চলবে না এবং সরকারি অফিসার ও কর্মচারীদের বিরুদ্ধে আক্রমনজনিত শাস্তি মূলক ব্যবস্থা গ্রহণ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দিতে হবে।

ঙ.           আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষার কাজ কেবলমাত্র পুলিশ ও বাঙ্গালি ইপিআর বাহিনীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে। যখনই প্রয়োজন হবে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকরা তাদের উক্ত কাজে সহায়তা করবেন।

চ.            অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে।

ছ.            অবিলম্বে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

যদি সামরিক মোকাবিলা চলতে থাকে এবং আমাদের নিরস্ত্র গনগণের ওপর বুলেট নিক্ষেপ অব্যাহত থাকে, তবে সন্দেহের কোন অবকাশ না রেখে আমি বলতে চাই যে, সে অবস্থায় কোন জাতীয় পরিষদই কাজ করতে পারবে না।

আমাদের জনগণ ইতিমধ্যেই বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তারা তাদেরকে আর উপনিবেশ অথবা বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হতে দেবেন না। তারা একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হবার দৃঢ়সংকল্প প্রকাশ করেছে। আমাদের অর্থনীতিকে অবশ্যই ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে। আমাদের মেহনতি জনগণকে অনাহার, রোগ ও বেকারত্ব  থেকে বাঁচাতে হবে।

উপদ্রুত এলাকার লাখ লাখ লোকের পুনর্বাসনের কাজ এখনো বাকি রয়েছে। যদি শাসকগোষ্ঠী এ সমস্ত আশা-আকঙ্খা ব্যর্থ করে দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে মুক্তির জন্যে দীর্ঘ ও নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম চালাতে জনগণও প্রস্তুত। যে মুক্তির জন্যে অনেক শহীদের রক্ত ঝরেঝে এবং যার জন্য বহু লোক আত্মত্যাগ স্বীকার করেছেন, জনগণের সেই চরম লক্ষ্যে পৌঁছার সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শহীদের রক্ত কখনো বৃথা যাবে না।

আমাদের সংগ্রামের প্রথম পর্যায় ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে। আমাদের বীর জনগণ অদম্য সাহস ও সংকল্পের পরিচয় দিয়েছেন। তারা বীরত্বের সাথে বুলেটের মোকাবিলা এবং সুপরিকল্পিতভাবে সান্ধ্য আইন ভঙ্গ করেছেন। বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায় এবং বাঙ্গালি ও তথাকথিত অবাঙ্গালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে দালাল, উস্কানিদাতা ও সমাজবিরোধী ব্যক্তিদের দূরভিসন্ধি ব্যর্থ করে দেওয়ার জন্য আমি আমাদের জনগণ ও আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকদের প্রতিও অভিনন্দন জানাচ্ছি।

আমি আবার বলছি যে, বাংলাদেশে বসবাসকারী প্রতিটি লোকেই বাঙ্গালি এবং তার শারীরিক নিরাপত্তা, সম্পদ ও মর্যাদা রক্ষা করা আমাদের পবিত্র দায়িত্ব এবং যে কোন মূল্যে তা করতে হবে। আমাদের সংগ্রামের বর্তমান পর্যায়ে লক্ষ্য হচ্ছে অবিলম্বে সামরিক শাসনের অবসান ঘটানো এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। যতক্ষণ পর্যন্ত এই লক্ষ্য অর্জিত না হয়, আমাদের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

 

আগামী এক সপ্তাহের কর্মসূচী

১৯৭১ সালের ৮ মার্চ থেকে এক সপ্তাহের জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছেঃ

১.            খাজনা-ট্যাক্স বর্জন আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।

২.            সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও বাংলাদেশের অন্যান্য হরতাল পালন করবে। মাঝে মাঝে প্রয়োজনবোধে এ ব্যাপারে কোন কোন অংশকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হবে।

৩.           রেলওয়ে ও বন্দরগুলো চালু থাকতে পারে। কিন্তু যদি জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর উদ্দেশ্যে সৈন্য সমাবেশের জন্য রেলওয়ে ও বন্দরগুলোকে ব্যবহার করা হয় তাহলে রেলওয়ে শ্রমিকরা সহযোগিতা করবেন না।

৪.            বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলোকে আমাদের বিবৃতিসমূহের পূর্ণ বিবরণ প্রচার করতে হবে এবং তারা জনগণের আন্দোলন সর্ম্পকে খবর গোপন করতে পারবে না, অন্যথায় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত বাঙ্গালিরা সহযোগিতা করবেন না।

৫.            কেবল স্থানীয় এবং আন্তঃজেলা ট্রাঙ্ক টেলিফোন যোগাযোগ চালু থাকবে।

৬.           সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।

৭.            ব্যাংকগুলো স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোন উপায়ে দেশের পশ্চিম অংশে অর্থ পাচার করতে পারবে না।

৮.           প্রতিদিন সকল ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করতে হবে।

৯.            অন্য সকল ক্ষেত্র থেকে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থা বিশেষে যে কোন সময় উপরোক্ত ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ অথবা আংশিক হরতাল ঘোষনা করা হতে পারে।

১০.         প্রতি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ ইউনিটের নেতৃত্বে একটি করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে।

[সূত্র ঃ দৈনিক পাকিস্তান, ৮ মার্চ-১৯৭১]

 

১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু নির্দেশসহ দেয়া বিবৃতি

[১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর আহবানের পর ৮ মার্চ থেকে সারা বাংলাদেশে এক অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। সরকারী-বেসরকারী সকল ভবন, শিক্ষা ও ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠানে কালো পতাকা উত্তোলন করা হয়। প্রতিটি যানবাহনে ছোট ছোট কালো পতাকা লাগানো হয়। বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য সব নির্দেশ পালিত হয়। লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের পূর্ব পাকিস্তানের গভর্ণর হিসেবে শপথ গ্রহণ করাতে পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিসহ সব বিচারপতি অস্বীকৃতি জানান।

প্রেসিডেন্ট ১০ মার্চ টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে অবাঙ্গালী সামরিক অফিসারের পরিবারবর্গকে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো শুরু হয়। বিদেশী নাগরিকগণও বাংলাদেশ থেকে সরে যেতে থাকেন। ১৯৭১ সালের ১৪ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৩৫টি নির্দেশ জারি করে, এক অর্থে বাংলাদেশের প্রশাসনের ভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু নির্দেশাবলী যখন সংবাদপত্রে বিতরণ করা হয়, তখন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকার পথে ১৫ মার্চ কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে বিমানবন্দর থেকে প্রেসিডেন্ট ভবনে আসেন।

এর আগের দিন অর্থাৎ ১৪ মার্চ টিক্কা খান একটি সামরিক আইন আদেশ জারির মাধ্যমে সকল সরকারী প্রতিরক্ষা কর্মচারীকে ২৪ ঘন্টার মধ্যে কাজে যোগ দেয়ার জন্যে বলা হয়। তাদের চাকরিচ্যুত করার এবং সামরিক আদালতে বিচারের হুমকিও দেয়া হয়। বাঙ্গালি কর্মচারীরা এ নির্দেশ উপেক্ষা করেন। বঙ্গবন্ধুর ১৪ মার্চের বিবৃতি এখানে উদ্ধৃত হলো। এ বিবৃতির সাথে আলাদাভাবে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ হিসেবে বিশদ ব্যাখ্যাসহ ৩৫টি নির্দেশ সংবাদপত্রে প্রেরিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশও এতদসহ দেয়া হলো।]

জনগণের বীরত্বপূর্ণ সংগ্রাম এগিয়ে চলেছে। মুক্তিকামী মানুষ বিশ্বের সবখানে যাঁরা প্রাণপণ লড়াই করে যাচ্ছেন মুক্তির জন্য, আমাদের সংগ্রামকেও তাঁদের নিজেদের বলে গণ্য করা উচিত। শক্তির সাহায্যে যারা শাসনের চক্রান্ত করে তাদের বিরুদ্ধে দৃঢ়সংকল্প ও সংঘবদ্ধ জনশক্তি কেমন করে মুক্তির দূর্জয় দূর্গ গড়ে তোলে, আমাদের জনগণ তা প্রমাণ করেছে।

আজ বাংলাদেশের প্রতিনি নারী-পুরুষ এমন কি শিশু পর্যন্ত মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার সাহসে বলীয়ান। নগ্নভাবে শক্তি প্রয়োগ করে মানুষকে দলিত করার কথা চিন্তা করেছিল যারা, তারা নিশ্চিতই পরাভূত হয়েছে। বাংলাদেশের প্রতিটি স্তরের মানুষ, সরকারী কর্মচারী, অফিস আর কল-কারখানার শ্রমিক, কৃষক আর ছাত্র সবাই দৃপ্তদম্ভে ঘোষণা করেছে-তারা আত্মসমর্পণের চেয়ে মরণ বরণ করতেই বদ্ধপরিকর।

এ বড় দুঃখজনক যে, এমন পর্যায়ে কিছু অবিবেচক মানুষ সামরিক আইন বলে নির্দেশ জারি করে বেসামরিক কর্মচারীদের একাংশকে ভীতি প্রদর্শনের চেষ্টা করছে। কিন্তু আজ এ দেশের মানুষ সামরিক আইনের কাছে মাথা নত না করা দৃঢ়তায় একাট্টা। আমি তাই, সর্বশেষ নির্দেশ যাদের প্রতি জারি করা হয়েছে, তাঁদেরকে হুমকির কাছে মাথা নত না করার আবেদন জানাই। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ তাদের ও তাদের পরিবারের পেছনে রয়েছে। তাদের ত্রাসিত করার উদ্দেশ্যে এই যে চেষ্টা তা বাংলাদেশের মানুষকে রক্তচক্ষু দেখাবার অন্যান্য সাম্প্রতিক চেষ্টার মতো নস্যাৎ হতে বাধ্য।

বাংলাদেশের মুক্তির স্পৃহাকে স্তব্ধ করা যাবে না। আমাদের কেউ পরাভূত করতে পারবে না, কারণ প্রয়োজনে আমাদের প্রত্যেকে মরণ বরণ করতে প্রস্তুত। জীবনের বিনিময়ে আমরা আমাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের স্বাধীনতা দিয়ে যেতে চাই। মুক্তির লক্ষ্যে না পৌঁছা পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম নবতর উদ্দীপনা নিয়ে অব্যাহত থাকবে। আমি জনগণকে যে কোন ত্যাগের জন্য এবং সম্ভাব্য সবকিছু নিয়ে যে কোন শক্তির মোকাবিলায় প্রস্তুত থাকতে আবেদন জানাচ্ছি।

১৯৭১ সালের ১৫ মার্চ থেকে যে নয়া কর্মসূচী শুরু হবে নির্দেশাবলীর আকারে তা বিশদভাবে নিচে উল্লেখ করা হলো। নিম্নলিখিত নির্দেশাবলী কার্যকরী হওয়ার সাথে সাথে পূর্ব ঘোষিত সকল নির্দেশ, অব্যাহতি ও ব্যাখ্যাসমূহ বাতিল বলে বিবেচিত হবে।

 

আগামী কর্মসূচি ঘোষণাঃ

১নং নির্দেশ

সরকারী সংস্থাসমূহ

কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সেকেটারিয়েটসমূহ, সরকারী ও বেসরকারী অফিসসমূহ, স্বায়ত্বশাসিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানসমূহ, হাইকোর্ট এবং বাংলাদেশস্থ সকল কোর্ট হরতাল পালন করবে এবং নিম্নে বর্ণিত বিশেষ নির্দেশাবলী এবং বিভিন্ন সময়ে যেসব ছাড় ব্যাখ্যা দেয়া হবে তা সবই মেনে চলবেন।

 

২নং নির্দেশসমূহ

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ

সমগ্র বাংলাদেশে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।

 

৩নং নির্দেশ

আইন ও শৃঙ্খলা রক্ষা

(ক)         ডেপুটি কমিশনারগণ ও মহকুমা অফিসারগণ তাঁদের কোন দপ্তর না খুলে সংশ্লিষ্ট এলাকার আইন ও শৃক্ষলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন এবং উন্নয়ন কাজও প্রয়োজন হলে এই সকল নির্দেশ কার্যকরী বা প্রয়োগ করার দায়িত্ব পালন করবেন। ডেপুটি কমিশনারগণ ও মহকুমা অফিসারগণ তাদের এই সব দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও নিবিড় সহযোগিতা বজায় রাখবেন।

(খ)          পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবেন এবং প্রয়োজন বোধে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সাথে যোগ দেবেন।

(গ)          জেলের দপ্তরে কাজ চলবে এবং জেল ওয়ার্ডরগণ তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করে যাবেন।

(ঘ)          আনসার বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করবেন।

 

৪নং নির্দেশ

বন্দর (অভ্যন্তরীণ বন্দরসহ)

বন্দর কর্তৃপক্ষ পাইলটেজসহ সকল কাজ করে যাবে। বন্দর কর্তৃপক্ষের কেবলমাত্র সেই সব অফিস খোলা থাকবে যেগুলো জাহাজসমূহের সহজ ও সুষ্ঠ আসা-যাওয়ার জন্য বিশেষভাবে প্রয়োজনীয়। কিন্তু সৈন্য চলাচলে কিংবা সমরাস্ত্র আনানোর ও বাংলাদেশের মানুষকে নির্যাতনের জন্য সৈন্য ও সমরাস্ত্র না নেয়ার কাজে কোনভাবেই সহযোগিতা বা সাহায্য করা যাবে না। জাহাজসমূহের বিশেষ করে বাংলাদেশের মানুষের জন্য খাদ্যবাহী জাহাজসমূহের মাল খালাস ত্বরান্বিত করার সম্ভাব্য সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর শুল্ক (পোর্ট ডিউজ) ও মাল খালাসের কর বা শুল্ক আদায় করবেন। অভ্যন্তরীণ বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দর শুল্ক ও অন্যান্য শ্রল্ক আদায় করবেন।

 

৫নং নির্দেশ

আমদানি

আমদানিকৃত সকল মাল দ্রুত খালাস করতে হবে। শুল্ক বিভাগের সংশ্লিষ্ট শাখাসমূহ কাজ করে যাবেন এবং ধার্যকৃত শুল্ক সম্পূর্ণরূপে পরিশোধের পর মাল খালাসের অনুমতি দেবেন। এই কাজ সমাধানের জন্যে ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেডে ও ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেডে বিশেষ একাউন্ট খোলা হবে। কাস্টমস কালেক্টরগণ এই বিশেষ একাউন্ট পরিচালনা করবেন। আওয়ামী লীগ বিভিন্ন সময়ে যেসব নির্দেশ ইস্যু করবেন, কাস্টমস কালেক্টরগণ তদনুযায়ী  একাউন্ট পরিচালনা করবেন। যে শুল্ক আদায় করা হবে তা কোনমতেই কেন্দ্রীয় সরকারের নামে জমা হবে না।

 

৬নং নির্দেশ

রেলওয়ে

রেলওয়ে চালু থাকবে। তবে রেল কর্তৃপক্ষের কেবলমাত্র সেই অফিসই খোলা থাকবে যেগুলো রেল চলাচলের জন্য প্রয়োজনীয় কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ওপর নির্যাতন চালানোর জন্যে সৈন্যদের আনা-নেয়া বা সমরাস্ত্র পরিবহনের কোন কাজে কোনভাবেই সাহায্য বা সহযোগিতা করা যাবে না। বন্দর থেকে দেশের অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য পরিবহনের জন্য রেলওয়ে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে রেল ওয়াগনের ব্যবস্থা করবে।

 

৭নং নির্দেশ

সড়ক পরিবহন

সারা বাংলাদেশে ইপিআরটিসি চালু থাকবে।

 

৮নং নির্দেশ

অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর কাজ চালু রাখার জন্য ইপিএসসি অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন ও আইডব্লিউটিএ’র প্রয়োজনীয় কিছুসংখ্যক কর্মচারী কাজ চালিয়ে যাবেন। গণনির্যাতনের জন্য সৈন্য বা রণ সম্ভার আনা-নেয়ার ব্যাপারে এসব প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীরা কোন সহযোগিতা করতে পারবেন না।

 

৯নং নির্দেশ

বাংলাদেশের মধ্যে শুধু চিঠিপত্র, টেলিগ্রাম ও মনি অর্ডার পৌঁছানোর জন্য ডাক ও তার বিভাগ কাজ করে যাবে। সরাসরি বিদেশে চিঠিপত্র ও টেলিগ্রাম প্রেরণ করা যাবে না। ব্যাংকের বিভিন্ন নির্দেশ নেয়ার ও দেয়ার জন্য সোম, মঙ্গল,বুধ ও বৃহস্পতি শুধু অপরাহ্ন ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত এই এক ঘন্টা আন্তঃআঞ্চলিক টেলিপ্রিন্টার যোগাযোগ চালু থাকবে। ২৫ নং নির্দেশে এই অনুমতি দেয়া হয়েছে। আন্তঃআঞ্চলিক প্রেস টেলিগ্রাম চালু থাকবে। পোষ্টাল সেভিংস ব্যাংক ও বীমা কোম্পানি কার্যরত থাকবে।

 

১০নং নির্দেশ

বাংলাদেশের মধ্যে কেবলমাত্র স্থানীয় আন্তঃজেলা ট্রাক টেলিফোন যোগাযোগ অব্যাহত থাকবে। টেলিফোন মেরামত ও সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় বিভাগগুলি কাজ করে যাবে।

 

১১নং নির্দেশ

বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলি কাজ চালিয়ে যাবেন। তাঁরা গণআন্দোলন সম্পর্কিত সকল বক্তব্য, বিবৃতি, সংবাদ ইত্যাদি প্রচার করবেন। যদি না করেন তবে এই সব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ব্যক্তিরা সহযোগিতা করবেন না।

 

১২নং নির্দেশ

জেলা হাসপাতাল, টিবি ক্লিনিক, কলেরা ইন্সষ্টিটিউটসহ সকল হাসপাতাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য ও স্যানিটেশান সার্ভিসগুলো যথারীতি কাজ করে যাবে। সেন্ট্রাল মেডিক্যাল সোর্স কাজ করে যাবে এবং সকল হাসপাতাল ও হেলথ সেন্টারে প্রয়োজনীয় ঔষুধপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী সরবরাহ করবেন।

 

১৩নং নির্দেশ

বিদ্যুৎ সরবরাহের কাজের সাথে ও এই কাজের সংরক্ষণ ও মেরামত কাজের সাথে জড়িত ইপিওয়াপদার বিভাগগুলো কাজ করে যাবে।

 

১৪নং নির্দেশ

গ্যাস ও পানি সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। এসবের সরক্ষণ ও মেরামতের কাজও চালু থাকবে।

 

১৫নং নির্দেশ

ব্রিক ফিল্ড ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় কাজের জন্য কয়লা সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।

 

১৬নং নির্দেশ

আমদানি, বন্টন, গুদামজাতকরণ ও খাদ্যশস্যের চলাচল জরুরি ভিত্তিতে কার্যকরী থাকবে। এ সবের প্রয়োজনে ওয়াগন, বাস, ট্রাক ও অন্যান্য সকল প্রকার পরিবহন ব্যবস্থা জরুরি ভিত্তিতে চালু থাকবে।

 

১৭নং নির্দেশ

(ক)         ধান ও পাটবীজ, সার ও কীটনাশক ক্রয়, চলাচল ও বন্টন অব্যাহত থাকবে। কৃষি খামার ও চাল গবেষণা ইনষ্টিটিউট ও এর সকল প্রকল্পগুলো যথারীতি কাজ করবে।

(খ)          পাওয়ার পাম্প ও অন্যান্য কারিগরি যন্ত্রপাতির চলাচল, বন্টন, মাঠে চালু রাখা ইত্যাদি অব্যাহত থাকবে। তাছাড়া, তেল, জ্বালানি, যন্ত্রপাতি ও এসবের সংরক্ষণ ও মেরামতের জন্যে প্রয়োজনীয় বিভাগ খোলা থাকবে।

(গ)          নলকূপ খনন, খাল খনন ও এই জাতীয় পানি সেচ সম্পর্কিত সকল কাজ চালু থাকবে।

(ঘ)          পূর্ব পাকিস্তান সমবায় ব্যাংক, কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক ও তার অঙ্গ সংস্থাগুলো থানা সমবায় সমিতি এবং অন্যান্য সমবায় সংস্থাগুলোকে কৃষি ঋণ দেয়া অব্যাহত থাকবে।

(ঙ)         যে বিষয়গুলো উল্লেখ করা হলো তার কাজ সুচারুরূপে পরিচালনার জন্যে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি উন্নয়ন সংস্থার প্রয়োজনীয় শাখাগুলো খোলা থাকবে।

(চ)          কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকগুলো থেকে ঘূর্ণিদুর্গতদের জন্যে সুদবিহীন ঋণ ও কৃষকদের প্রয়োজনীয় ঋণ দেওয়া বলবৎ থাকবে।

(ছ)          আলু কিনে গুদামজাত করার জন্যে কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের তহবিল মওজুদ রাখতে হবে।

 

১৮নং নির্দেশ

বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও শহর সংরক্ষণ

বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ, শহর সংরক্ষণ এবং নদী খনন ও যন্ত্রপাতি স্থাপনসহ ওয়াপদার পানি উন্নয়ন কাজ, মালপত্র খালাস ও আনা নেয়া এবং এই ধরনের অন্যান্য জরুরি কাজ সুচারুরূপে চালিয়ে যাওয়া হবে। সরকারী এজেন্সী কিংবা সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্ত্বশাসিত সংস্থা কন্ট্রাক্টরদের পাওনা মিটিয়ে দেয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করবে।

 

১৯নং নির্দেশ

উন্নয়ন ও নির্মাণ কার্য

বৈদেশিক সাহায্যে তৈরি রাস্তা ও পুল প্রকল্পগুলোসহ সকল প্রকার সরকারী, আধা সরকারী ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকবে। সরকারী এজেন্সী ও সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা থেকে ঠিকাদারদের পাওনা যথারীতি মিটিয়ে দেয়া হবে। উক্ত সংস্থাগুলো থেকে যদি মালমসলা সরবরাহের চুক্তি থাকে তাহলে সেই চুক্তি মোতাবেক যথারীতি সরবরাহ করা হবে।

 

২০নং নির্দেশ

ঘূর্ণিদুর্গত এলাকার বাঁধ তৈরি ও উন্নয়নমূলক কাজসহ সকল প্রকার সাহায্য পুনর্বাসন ও পুননির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকবে। সরকারী এজেন্সী ও স্বায়ত্বশাসিত সংস্থাগুলো ঠিকাদারদের পাওনা মিটিয়ে দিবে।

 

২১নং নির্দেশ

ইপিআইডিসি, ইপসিক ফ্যাক্টরি ও ইষ্টার্ণ রিফাইনারি

ইপিআইডিসি ও ইপসিকের সকল কারখানায় কাজ চলবে এবং যতদূর সম্ভব উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করতে হবে। এই সকল কারখানা চালু রাখার জন্যে প্রয়োজনীয় অর্থ সরবরাহের ব্যাপারে ইপিআইডিসি ও ইপসিকের যে সকল শাখা খোলা রাখা প্রয়োজন হবে তা খুলে রাখতে হবে। ইষ্টার্ণ রিফাইনারির কাজ যথারীতি চালিয়ে যেতে হবে।

 

২২নং নির্দেশ

বেতন দান

সরকারী ও আধা সরকারী সংস্থার কর্মচারী ও প্রাইমারী শিক্ষকদের বেতন যাদের রোজ, সাম্পাহিক, পাক্ষিক কিংবা মাসিক হিসাবে দেয়া হয়ে থাকে, তাদের সেভাবে দিতে হবে। যাদের বন্যায় সাহায্য মঞ্জুর করা হয়েছে এবং বাকি বেতন দেয়ার কথা, তা দিয়ে দিতে হবে। বেতন বিল তৈরির জন্য সরকারী আধা-সরকারী বিভাগের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলো খোলা রাখতে হবে।

 

২৩নং নির্দেশ

পেনসন

সামরিক বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীসহ সকল অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারীদের পেনসন নির্দিষ্ট তারিখে পরিশোধ করতে হবে।

 

২৪নং নির্দেশ

এ.জি (ইপি) ও ট্রেজারী

এই নির্দেশে যে সকল কাজ চালিয়ে যাবার জন্যে হুকুম দেয়া হয়েছে তাদের টাকা-পয়সা দেয়া-নেয়া ও সরকারী কর্মচারীদের বিল তৈরী করা জন্যে সামান্য সংখ্যক কর্মচারী দ্বারা এ.জি (ইপি) অফিসের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।

 

২৫নং নির্দেশ

(ক)         ব্যাংকিং কার্য পরিচালনার জন্যে সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত এবং প্রশাসনিক প্রয়োজনে ৪টা পর্যন্ত সকল ব্যাংক খোলা থাকবে। (অবশ্য মাঝে টিফিনের ছুটি থাকবে) কিন্তু শুক্রবার ও শনিবারে  ব্যাংকিং কাজের জন্যে সকাল ৯টা থেকে ১১-৩০ মিনিট পর্যন্ত এবং প্রশাসনিক কাজের জন্য ১২-৩০ মিঃ পর্যন্ত খোলা থাকবে। অনুমোদিত লেনদেনের ক্ষেত্রে বুক ব্যালান্সসহ অন্যান্য কার্যাবলী নিয়মিতভাবে চলবে।

(খ)          কয়েকটি বিধি-নিষেধ ছাড়া ব্যাংকগুলো যে কোন পরিমাণ জমা গ্রহণ, বাংলাদেশের ভিতর যে কোন পরিমাণ আন্তঃব্যাংক ক্লিয়ারেন্স, বাংলাদেশের ভিতর আন্তঃব্যাংক ট্রান্সফার এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে টিটি বা মেইল ট্রান্সফার ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থ ড্র করাসহ তাদের কাজকর্ম চালিয়ে যাবে। যেসব বিধিনিষেধ মানতে হবে সেগুলো হচ্ছেঃ

১.            যদি চেকের মধ্যে সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংস্থার প্রতিনিধির বা বেতন রেজিষ্ট্রারের সার্টিফিকেট থাকে তাহলে বেতন ও মজুরী পরিশোধ করা।

২.            সপ্তাহে এক হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাফাইড ব্যক্তিগত ড্রইংস।

৩.           চিনিকলের জন্য আখ ও পাটকলের জন্যে পাটসহ শিল্পের কাঁচামাল কেনা জন্যে অর্থ দান।

৪.            বাংলাদেশের ক্রেতাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়সহ যে কোন বাণিজ্যিক খাতে সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত পেমেন্ট। ঐ অংক ক্যাশ অথবা ক্যাশ ড্রাফট মারফত উঠানো যাবে। কিন্তু উপরে উল্লিখিত ২ ও ৪ নম্বর শর্তে কোন অর্থ দেওয়ার পূর্বে অতীত রেকর্ড দেখে ব্যাংকে সন্তুষ্ট হতে হবে যে, অর্থ গ্রহণকারী একজন বোনাফাইড শিল্প অথবা বাণিজ্যিক সংস্থা অথবা ব্যবসায়ী এবং সে যে অর্থ উঠাচ্ছে তা তার এক বছরে সাপ্তাহিক গড় অর্থ উঠানোর চাইতে বেশি না হয়।

৫.            উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের নিযুক্ত তালিকাভুক্ত কন্ট্রাক্টরদের অর্থদান। তবে যে কর্তৃপক্ষের অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে তার কাছ থেকে চেকে একটি সার্টিফিকেট আনতে হবে, যে টাকাটা উঠাতে চাওয়া হচ্ছে তা উল্লিখিত কাজের জন্যে প্রয়োজনীয়।

(গ)          বাংলাদেশের অভ্যন্তরের যে কোন একাউন্টে ক্রস চেক ও ক্রস ডিম্যান্ড ড্রাফট প্রদান করা ও জমা নেয়া যাবে।

(ঘ)          ষ্টেট ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক, ঢাকা থেকে অর্থ প্রদানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে টিটি পাঠানো যাবে। যে সমস্ত ব্যাংকগুলোর সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত সেগুলো ঢাকাস্থ ষ্টেট ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পাওনা গ্রহণ করতে পারবে।

(ঙ)         অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত বিষয়ের জন্যে সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত এক ঘন্টা আন্তঃশাখা টেলিপ্রিন্টার সার্ভিস চালু থাকবে।

১.            প্রত্যেকটি বাণিজ্যিক ব্যাংককে সোমবার ও বুধবার বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি খবর পাঠাতে ও পেতে পারে।

২.            প্রত্যেক ব্যাংক অর্থ পাঠানোর ব্যাপারে মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে একটি খবর পেতে পারে।

(চ)          বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিল সংগ্রহের অনুমতি দেয়া হয়েছে। কিন্তু ক্রস চেক বা ক্রস গ্রান্টের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করতে হবে।

(ছ)          অনুমোদিত ডিলারের সাহায্যে ফরেন ট্রাভেলার্স চেক ভাঙ্গানো যাবে।

(জ)         কুটনীতিকগণ অবাধে তাঁদের একাউন্টের কাজ পরিচালনা করতে পারবে এবং বিদেশী নাগরিকগণ বৈদেশিক মুদ্রা একাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণ করতে পারবেন।

(ঝ)         লকার্স পরিচালনার কাজ বন্ধ থাকবে।

(ঞ)         ষ্টেট ব্যাংক বা অন্য কোন কিছুর মাধ্যমে বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানো যাবে না।

(ট)          বিদেশী রাষ্ট্র থেকে লাইসেন্সের মাধ্যমে দ্রব্যাদি আমদানির জন্যে লেটার অব ক্রেডিট খোলা যাবে।

(ঠ)          পণ্য বিনিময়ের চুক্তি (যে সমস্ত দ্রব্য ইতিমধ্যে পাঠানো হয়েছে) মোতাবেক প্রেরিত দ্রব্যের ছাড় করতে হবে।

(ড)         ইষ্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড ও ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং কর্পোরেশ লিমিটেডের মারফত বকেয়া রপ্তানি বিল সংগ্রহ করতে হবে এবং এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর প্রতি নির্দেশ মোতাবেক কাজ পরিচালিত হবে।

 

২৬নং নির্দেশ

ষ্টেট ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংকের মতো কাজ করবে এবং সে একই অফিস সময়ে চলবে এবং বাংলাদেশের ব্যাংকিং পদ্ধতি কাজ করার জন্যে ও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যে অনুরূপভাবে খোলা থাকবে। উল্লিখিত কাঠামো ও বিধি নিষেধ এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। ‘পি ফর্ম বরাদ্দ করা যেতে পারে এবং বিদেশে অবস্থানরত ছাত্র ও অন্যান্য অনুমোদিত প্রাপকের জন্যে বিদেশে প্রেরণের টাকা ও গৃহীত  হতে পারবে।

 

২৭নং নির্দেশ

বাংলাদেশের জন্যে আমদানি লাইসেন্স ইস্যুকরণ ও আমদানিকৃত দ্রব্যাদি চলাচলের বিধি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্যে আমদানি-রপ্তানি কন্ট্রোলারের অফিস নিয়মিতভাবে চলবে।

 

২৮নং নির্দেশ

সকল ট্রাভেল এজেন্ট অফিস ও বিদেশী বিমান পরিবহন অফিস চালু হতে পারে। কিন্তু তাদের বিক্রয়লদ্ধ অর্থ বাংলাদেশের ব্যাংকে জমা রাখতে হবে।

 

২৯নং নির্দেশ

বাংলাদেশে সকল অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা চালু থাকবে।

 

৩০নং নির্দেশ

পৌরসভার ময়লাবাহী ট্রাক, রাস্তায় বাতি জ্বালানো, সুইপার সার্ভিস এবং জনস্বাস্থ্য বিভাগীয় অন্যান্য ব্যবস্থা চালু থাকবে।

 

৩১নং নির্দেশ

কোন খাজনা কর আদায় করা যাবে না।

(ক)         পুনঃনির্দেশ দেয়া পর্যন্ত-

(১)          সকল ভূমি-রাজস্ব আদায় বন্ধ থাকবে। (২) বাংলাদেশের কোথাও কোন লবণ কর আদায় করা যাবে না। (৩) বাংলাদেশের কোথাও কোন তামাক কর আদায় করা যাবে না, (৪) তাঁতীরা আবগারী শুল্ক দান ব্যতিরেকেই বাংলার সুতা কিনবেন। মিল মালিক ও ডিলাররা তাদের কাছ থেকে আবগারী শুল্ক আদায় করতে পারবেন না।

(খ)          এছাড়া সকল প্রাদেশিক সরকারের কর, যেমনঃ প্রমোদ কর, হাট, বাজার, পুল ও পুকুরের উপর ধার্যকৃত কর আদায় করা যাবে এবং বাংলাদেশের সরকারের একাউন্টে জমা দিতে হবে।

(গ)          অকট্রয়সহ স্থানীয় কর আদায় করা যাবে।

(ঘ)          কেন্দ্রীয় সরকারের পরোক্ষ কর- যেমন আবগারী কর, বিক্রয় কর এখন থেকে আদায়কারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা আদায় হবে, তবে তা কেন্দ্রীয় খাতে জমা করা যাবে না অথবা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে হস্তান্তর করা যাবে না। এসব আদায়কৃত কর ইস্টার্ণ মার্কেন্টাইল ব্যাংক অথবা ইষ্টার্ণ ব্যাংকিং কর্পোরেশনে ‘বিশেষ একাউন্ট’ খুলে জমা রাখতে হবে এবং ব্যাংক দুটিও তাদের প্রতি প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী এগুলো গ্রহণ করবে। সকল আদায়কারী প্রতিষ্ঠানকে এ নির্দেশ ও বিভিন্ন সময়ে তাদের প্রতি যে নির্দেশ দেয়া হবে, তা মানতে হবে।

(ঙ)         কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রত্যক্ষ কর, যেমন আয়কর আদায় ইত্যাদি পরবর্তী নির্দেশ জারি হওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।

 

৩২নং নির্দেশ

পাকিস্তান বীমা কর্পোরেশন চালু থাকবে এবং পোষ্টার লাইফ ইন্সুরেন্সসহ সকল বীমা কোম্পানী কাজ করবেন।

 

৩৩নং নির্দেশ

সকল ব্যবসা, শিল্প প্রতিষ্ঠান ও দোকানপাট নিয়মিতভাবে চলবে।

 

৩৪নং নির্দেশ

সকল বাড়ির শীর্ষে কালো পতাকা উত্তোলন হবে।

 

৩৫নং নির্দেশ

সংগ্রাম পরিষদগুলো সর্বস্তরে কাজ চালু রাখবে এবং এ সকল নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে যাবে।

 

[সূত্র ঃ দৈনিক পাকিস্তান ও পূর্বদেশ, ১৫ মার্চ ১৯৭১]

 

১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণকে যেভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত জাতীয় সংসদের অধিবেশনে যোগ দেয়ার অন্যতম পূর্বশর্ত বলে উল্লেখ করায় ১৭ মার্চ, ১৯৭১ ‘খ’ অঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসন ‘কি পরিস্থিতিতে ২ মার্চ থেকে ৯ মার্চ, সময়কালে পূর্ব পাকিস্তানে বিভিন্ন স্থানে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সহায়তা করার জন্যে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছিল  তা তদন্তের জন্যে একটি কমিশন গঠন করেন। নির্দেশে বলা হয় পূর্ব পাকিস্তানহাইকোর্টের একজন বিচারপতির নেতৃত্বে কমিশন গঠিত হবে।

শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার তদন্ত দাবি করেছিলেন, কিন্তু সামরিক কর্তৃপক্ষ কি পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী তলব করা হল তা নিরূপণের জন্যে তদন্ত কমিশন গঠন করলেন। সঙ্গতভাবেই বঙ্গবন্ধু এই কমিশন প্রত্যাখ্যান করলেন। কমিশনের কাজে কোনভাবে সহায়তা না করার জন্যে তিনি জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। পূর্ব পাকিস্তানআওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোন্দকার মুশতাক আহমদ এবং চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এম.এন.এ আবিদুর রেজা খানকে সদস্য করে বঙ্গবন্ধু একটি পাল্টা তদন্ত কমিশন গঠ করেন এবং তাঁদের সরজমিন তদন্তের জন্যে চট্টগ্রাম প্রেরণ করেন। সামরিক কর্তৃপক্ষ কর্তৃক গঠিত তদন্ত কমিশন প্রত্যাখ্যান করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ১৮ মার্চ যে বিবৃতি দেন, এখানে তার বয়ান উদ্ধৃত হলো।]

আমি দুঃখের সাথে বলছি যে, বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমি যে দাবি জানিয়েছিলাম, ঘোষিত “তদন্ত কমিশন” সে দাবি পূরণ করতে পারবে না। সামরিক আইন প্রশাসকের আদেশবলে এ তদন্ত কমিশন গঠন এবং সামরিক আইন কর্তৃপক্ষের কাছে তাদের রির্পোট পেশ করার যে নির্দেশ দিয়েছেন তা অত্যন্ত আপত্তিজনক। কারণ এর শর্তাবলী পূর্বাহ্নে বিবেচ্য প্রধান প্রধান মৌলিক বিষয়গুলো নস্যাৎ এবং পৃথককৃত ঘটনাবলী সম্পর্কে তদন্ত করার পথ রুদ্ধ করে দেবে।

এ তদন্ত কমিশনের একমাত্র বিবেচ্য বিষয় হলো-‘২ মার্চ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত কি পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন স্থানে বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্যের জন্যে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছিল। সুতরাং মৌলিক বিষয়টি এভাবেই স্থির করে দেওয়া হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে তদন্তের বিষয় ছিল বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহয্যের জন্যে জন্যে নিয়োগ না করে সেনাবাহিনীর নিয়োগ ও শক্তি প্রয়োগ রাজনৈতিক স্বার্থেই করা হয়েছিল কিনা? তাছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকৃতপক্ষে যেসব জোর-জুলুম করা হয়েছে এবং হাজার হাজার লোক হতাহত হয়েছে বলে সংবাদ পাওয়া গিয়েছে ‘কমিশন’-এর সে ব্যাপারে তদন্তের পথ রূদ্ধ করা হয়েছে। এর ফলে এমন কি হতাহতের সংখ্যা কত এবং কোন পরিস্থিতিতে নিরস্ত্র জনগণের প্রতি গুলিবর্ষণ করা হয়েছে তারও তদন্ত করা যাবে না।

সুতরাং ‘কমিশন’ কোন সত্যিকার উদ্দেশ্য সাধন করতে পারবে না। ফলে, সত্যি ঘটনার মূল উদঘাটনের ব্যাপারে তদন্ত হবে না এবং এটা জনগণকে বিভ্রান্ত করার একটা ফন্দিমাত্র।

সুতরাং আমরা এরূপ ‘কমিশন’ অনুমোদন করতে পারি না। বাংলদেশের জনগণ কোনক্রমেই এরূপ ‘কমিশনের’ সাথে সহযোগিতা করতে পারে না। এ ‘কমিশনে’ কারো কোন সদস্য মনোনীত কিংবা কারো এর সদস্য হিসেবে কাজ করা উচিত নয়।

জনগণের পক্ষ থেকে আমরা ৭ মার্চ ৪-দফা শর্ত উপস্থিত করেছি। তার মধ্যে একটি দাবী ছিল যথাযথ শর্ত সম্বলিত ন্যায্য, নিরপেক্ষ ও প্রকাশ্য তদন্ত। সেগুলোর মধ্যে কেবল নামমাত্র এবং খন্ড খন্ড দাবি গ্রহণ এবং যেভাবে এ দাবি গ্রহণ করা হয়েছে তার ফলে আমরা যে চরম সঙ্কটের সম্মুখীন হয়েছি, সে সমস্যার সমাধান হবে না।

 

[সূত্র: পূর্বদেশ, ১৯ মার্চ ১৯৭১]

১৯৭১ সালের ২০ মার্চ বঙ্গবন্ধুর সংবাদপত্রে দেয়া বিবৃতি

[বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রশাসন চলার দিনগুলোতে ১৭ মার্চ শেখ মুজিবের ৫২তম জন্ম দিন সমুপস্থিত হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে দ্বিতীয় দফা বৈঠকের পর বঙ্গবন্ধু তাঁর বাসভবনে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, আমি আমার জন্মদিনের উৎসব পালন করি না। এই দুঃখিনী বাংলায় আমার জন্মদিন ইবা কি আর মৃত্যুদিনই বা কি?

ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ও বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণকে নির্বিচারে হত্যার প্রতিবাদে শিল্পচার্য জয়নুল আবেদীন, প্রবীন সাংবাদিক সাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষ নাট্যকার মুনীর চৌধুরী সহ কয়েকজন পাকিস্তানসরকার প্রদত্ত এক বিবৃতিতে আন্দোলনে শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার আহ্বান জানান। নিচে বিবৃতিতে উদ্ধৃত হলো।]

একটি স্বাধীন দেশের মুক্ত নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য জনগণ যে কোন ত্যাগ স্বীকার প্রস্তুত। তাই মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়ার পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। শান্তিপূর্ণ ও সুশৃঙ্খলভাবে এ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানাই।

এবারের সংগ্রামে প্রতিটি শহর, নগর, বন্দুর ও গ্রামে আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা বাংলাদেশের দাবির পেছনে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ সারা বিশ্বের স্বাধীনতা-প্রিয় মানুষের হৃদয় জয় করতে পেরেছে। একটি ঐক্যবদ্ধ ও দৃঢ়সংকল্প জাতি কিভাবে স্বীয় লক্ষ্যপানে এগিয়ে যেতে পারে, বিশ্বের সামনে বাংলার আজ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।

আওয়ামী লীগের নির্দেশের আওতা থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার কাজে নিরলস পরিশ্রম করার জন্য সর্বস্তরের জনগণ, ক্ষেতের চাষী, কারখানার শ্রমিক, অফিসের কর্মচারী সবাইকে আমি অভিনন্দন জানাই। আওয়ামী লীগের নির্দেশমূহ যথাযথভাবে প্রয়োগ করার জন্য যাঁরা অতন্দ্র প্রহরীর মতো কাজ করছেন, সেইসব ছাত্র, শ্রমিক এবং কর্মচারী সংগঠনগুলোর সদস্যদের আমি বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাচ্ছি।

আমাদের জনগণ প্রমাণ করেছে তাঁরা সুচারুভাবেই তাদের নিজেদের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। উস্কানির্মূলক তৎপরতা থেকে বিরত থাকার জন্য ধ্বংসাত্মক ব্যক্তিদের আমি হুশিয়ার করে দিচ্ছি। জনসাধারণের নিত্যদিনের প্রয়োজন মিটানো অব্যাহত রাখার স্বার্থেই অর্থনৈতিক তৎপরতার প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের জনগণকে কঠোর শৃঙ্খলা পালন করতে হবে।

[সূত্র : দৈনিক আজাদ,২১ মার্চ, ১৯৭১]

 

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ ৩২ নং ধানমন্ডির বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[সারাদেশ জুড়ে পাকিস্তান দিবসের পরিবর্তে পালিত হয় প্রতিরোধ দিবস। পাকিস্তানী পতাকার পরিবর্তে বাংলাদেশী নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই দিন ছাত্রলীগ প্রতিরোধ বাহিনী পল্টন ময়দানে এক আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথের আমার সোনার বাংলা গানটি গেয়ে পতাকা উত্তোলন করে। শহরের সব মিছিল গিয়ে শেষ হয় বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ ৩২ নম্বর বাড়ির সামনে। সেদিন বঙ্গবন্ধু মিছিলকারীদের সমাবেশের উদ্দেশ্যে এই ভাষণটি প্রদান করেন।]

আমি আপনাদের কাছে মাত্র একটা কথা বলতে পারি-সাত কোটি লোক মুক্তি পাওয়া না পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। আপনাদের মনে রাখা দরকার-নীতির সাথে আপোষ হয়না। যদিও আমরা শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে চাই, কিন্তু নীতির সাথে আপোষ হয়না। এদেশের মানুষকে কলোনিয়ার মনে করতে হবে। যে কোন ত্যাগের মাধ্যমে আপনারা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হন-শহীদের রক্ত আমরা বৃথা যেতে দেব না এবং যেভাবেই হোক এদেশ থেকে বাজার আমরা বন্ধ করে দেব এবং বাংলার মানুষকে আমরা মুক্ত করব। কারো সঙ্গে মাথা নথ করব না। দরকার হয় আরো রক্ত দেবো কিন্তু বাংলার মানুষকে আর আমরা পরাধীন থাকতে দেব না এবং আপনাদের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম চলবে। জয় বাংলা।

 

১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

[প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবর রহমানের সাথে তথাকথিত আলোচনায় মিলিত হন। পরবর্তী ঘটনাবলী থেকে এটা প্রতীয়মান হয়েছে, ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে ধোঁকা দেবার চেষ্টা করছিলেন। প্রথম দফা আলোচনার দিন চট্টগ্রাম বন্দরের শ্রমিকরা চীন থেকে আনা অস্ত্র ও গোলাবারুদের চালান জাহাজ থেকে খালাস করতে অস্বীকৃতি জানায়। ১৯ মার্চ সেনাবাহিনী ঢাকার কাছে জয়দেবপুরে বেসামরিক লোকদের ওপর গুলিবর্ষণ করে। এতে কমপেক্ষ ২০ জন লোক নিহত হয়।

বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, পরের দিন প্রেসিডেনেটর সাথে নির্ধারিত বৈঠকে নাও যেতে পারেন। ১৯ মার্চ ঢাকায় সান্ধ্য আইন জারী করা হলে পরিস্থিতির আরো অবনতি ঘটে। প্রেসিডেন্টের জরুরি বার্তা পেয়ে ২১ মার্চ ভুট্টো ঢাকা এলে ক্রুদ্ধ জনতা বিমানবন্দর ও হোটেলের সামনে তাঁর বিরুদ্ধে প্রচন্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। পরের দিন ভুট্টো প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বৈঠকে বসেন। ‘রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতৈক্য প্রতিষ্ঠার সুযো সৃষ্টির’ কথা বলে ২২ মার্চ প্রেসিডেন্ট ২৫ মার্চ থেকে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন পুনরায় স্থগিত ঘোষণা করেন।

২৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে পাকিস্তানদিবসের পরিবর্তে প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। পাকিস্তানী পতাকার পরিবর্তে সকল স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ছাত্রলীগ (প্রতিরোধ বাহিনী) ঢাকার পল্টন ময়দানে এক আনুষ্ঠানিক কুচকাওয়াজের আয়োজন করে। রবীন্দ্রনাথের ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’ গানটি গেয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। অধিকাংশ বিদেশী দূতাবাসেও বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। চীনা দূতাবাসে পাকিস্তানী পতাকা ছাত্ররা নামিয়ে বাংলাদেশের পতাকা ওড়ায়।

পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকতা শেষে ছাত্রা প্যারেড করে করে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি বাসভবনে যায়। তাঁরা বাড়ির সামনে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দকে সাথে নিয়ে প্রতিরোধ বাহিনীর সালাম গ্রহণ করেন। তিনি ছাত্রদের সামনে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। উক্ত বক্তব্যের অংশবিশেষ উদ্ধৃত হলো।]

এবারের সংগ্রাম, মুক্তির সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের দাবির প্রশ্নে আপোস নাই। শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও আমরা দাবি আদায় করবোই। জনগণের অধিকার আদায় না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম চলতে থাকবে এবং বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি আত্মার একটি আত্মা ও বেঁচে থাকা পর্যন্ত আমরা রক্ত দিতে প্রস্তুত থাকবো।

আমরা নিশ্চয়ই শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চাই। কিন্তু তার অর্থ এই যে, যে কোন আক্রমণ আমরা সহ্য করবো। গত ২২ দিনের অসহযোগ আন্দোলন ক্ষমতাসীন চক্রের মাজা ভেঙ্গে দিয়েছি। বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষের দাবির প্রশ্নে কোন আপোস নাই। বাঙ্গালিরা আজ ঐক্যবদ্ধ, তাই বিশ্বের কোন শক্তিই তাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। মা-বোনেরাও আজ সংগ্রামে রাস্তায় নেমে এসেছেন। বাংলাদেশে যাতে একটিও শোষণকারী থাকতে না পারে, সে জন্যে ব্যাপক আন্দোলন অব্যাহত রাখা হবে।

আমাদের সংগ্রামে ঐক্য ও শৃঙ্খলার ব্যাপারে সর্তক থাকতে হবে। আমরা যদি ঐক্যবদ্ধ ও শৃঙ্খলাবদ্ধ থাকি তবে কোন শক্তিই আমাদের চূড়ান্ত বিজয়কে ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না, কোন শক্তিই আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না। সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব আমার ওপর অর্পণ করতে হবে। মনে রাখবেন, সেই ভাল সিপাহসালার, যিনি কম রক্তপাতে সফলতা অর্জন করতে পারেন।

[সূত্র : আজাদ ও দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ মার্চ ১৯৭১]

 

১৯৭১ সালের ২৫  মার্চে বঙ্গবন্ধুর বিবৃতি

[১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ কোন কারণ না দেখিয়ে প্রেসিডেন্ট তাঁর নির্ধারিত বেতন ও টিভি ভাষণ বাতিল করেন। ২৩ ও ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ বেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সাথে বৈঠক করেন। ২৪ মার্চ ভুট্টোর দলের নেতৃবৃন্দ এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দ ঢাকা ত্যাগ করেন। বাংলাদেশে একটি চক্রান্তের অভ্যাস পাওয়া যায়। পঁচিশ মার্চ বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে সেনাবাহিনীর গুলিতে কমপক্ষে ১১০ জন নিহত হন।

চট্টগ্রাম বন্দরে একটি জাহাজ থেকে মাল খালাসের সময় জনসাধারণ বাঁধা দিলে সেনাবাহিনীর গুলিতে অনেকে প্রাণ হারায়। শেখ মুজিবুর রমান এবস গুলিবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ করেন। ২৭ মার্চ বাংলাদেশব্যাপী হরতালের আহ্বান জানিয়ে বঙ্গবন্ধু ২৫ মার্চ সংবাদপত্রে এক বিবৃতি দেন। ২৫ মার্চ সামরিক বাহিনীর অপারশনের কারণে ২৬ মার্চ বাংলাদেশে কোন পত্রিকা প্রকাশিত না হওয়ায় বিবৃতিটি কেবল পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকটি দৈনিকে প্রকাশিত হয়। সেনাবাহিনীর অভিযানের মাত্র কয়েক ঘন্টা আগে দেয়া বিবৃতিটির বাংলা অনুবাদ দেয়া হলো।]

প্রেসিডেন্টের ঢাকা আগমন ও তাঁর পরবর্তী আলোচনা থেকে জনমনে একটা ধারণা হয়েছিল যে, দেশে বিরাজমান গভীর সঙ্কট সম্পর্কে কর্তৃপক্ষের চেতনার সৃষ্টি হয়েছে এবং রাজনৈতিকভাবে তা সমাধান সম্ভব। এ কারণেই আমি প্রেসিডেন্টের সাথে সাক্ষাৎ করি। প্রেসিডেন্ট জোর দিয়ে বলেন যে, সঙ্কট কেবল রাজনৈতিকভাবেই সমাধান সম্ভব। সে আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট যেসব মৌলিক নীতির ভিত্তিতে সঙ্কটের সমাধান হতে পারে তা গ্রহণ করেন। পরবর্তী সময়ে আমার সহকর্মীরা প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সাথে সেসব নীতি নির্ধারণের জন্য বৈঠকে মিলিত হন।

এভাবে আমরা আমাদের দায়িত্ব পালন করছি এবং একটি রাজনৈতিক সমাধানের পূর্ণ বাস্তায়নের আমাদের সাধ্যমত চেষ্টা চালিয়েছি। বিশ্বের কোন কারণ বা যৌক্তিকতা নাই। সংশ্লিষ্টরা যদি রাজনৈতিক সমাধান কামনা করেন, তবে তাঁদের এটা বোঝা উচিত যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাঁদেরকে তাড়াতাড়ি করেত হবে নতুবা এ ব্যাপারে কোন বিলম্ব দেশ ও দেশের মানুষকে গভীর সঙ্কটে নিপতিত করবে।

তাই সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানে অনবভিপ্রেত বিলম্ব দুঃখজনক। ইতিমধ্যে বিরাজমান পরিস্থিতি একের পর এক সেনাবাহিনীর তৎপরতায় আরো জটিল করে তোলা হচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে প্রাপ্ত সংবাদ অনুযায়ী ও তৎপরতা জোরদার করা হচ্ছে।

সৈয়দপুর, রংপুর ও জয়দেবপুর সেনাবাহিনীর তৎপরতা সংবাদে আমি মর্মাহত। বেসামরিক লোকদের উপর প্রচন্ড গুলিবর্ষণ ও তাদের উপর অত্যাচারের খবর যাচ্ছে। পুলিশকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করা হচ্ছে। চট্টগ্রাম থেকে প্রচন্ড গুলিবর্ষণের খবর আসছে।

এটা আরো দুঃখজনক এজন্যে যে, সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের ঘোষিত উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের ঢাকা উপস্থিতির কালে এসব ঘটনা ঘটেছে। অবিলম্বে এসব সামরিক অভিযান বন্ধ করা নির্দেশ দেয়ার জন্য আমি তাঁর প্রতি আহবান জানাচ্ছি। এটা জেনে রাখা উচিত যে, যেভাবে নিরস্ত্র মানুষ হত্যা এবং অত্যাচার বিনা চ্যালেঞ্জে পার পাবে না। আমি নিশ্চিত বাংলাদেশের বীর সন্তানেরা বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির যে চরম লক্ষ্য তা অর্র্জনে যে কোন পরিস্থিতির মোকাবিলা করতে প্রস্তুত রয়েছে।

যেটা আরো নিন্দনীয় তা হচ্ছে যে, স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টির জন্যে গণবিরোধী শক্তি একটি মহলকে নিয়োজিত করেছে। আমি একাধিকবার বলেছি, যাঁরা বাংলাদেশে বাস করেন তাঁরা যে জায়গা থেকেই এসে থাকুন না কেন বা যে ভাষায়ই কথা বলেন না কেন-তাঁরা সবাই আমাদের লোক এবং তাঁরাও তা মনে করবেন এবং বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রামে পুরোপুরিভাবে আত্মনিয়োগ করবেন। তাঁদের জান-মাল-সম্মান আমাদের পবিত্র আমানত।

এটা তাই স্পষ্ট যে যারা উত্তেজনা সৃষ্টি করছে তারা একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা বানচাল করার ঘৃণা উদ্দেশ্যে এবং নিরস্ত্র মানুষের ওপর আক্রমণ চালাবার অজুহাত সৃষ্টি করার জন্যেই তা করছে। বিশ্ববাসী আজ দেখুক, একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে পেতে আমরা যখন যথাসাধ্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছি, তখন জোর করে একটি সমাধান চাপিয়ে দিতে একটি অশুভচক্র শেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ধ্বংসের সেসব অশুভ শক্তিকে আমি জানিয়ে দিতে চাই, তাদের চক্রান্ত সফল হবে না, কারণ জোর করিয়ে কোন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে যে কোন ত্যাগ স্বীকারে সাড়ে ৭ কোটি মানুষ আজ ঐক্যবদ্ধ।

বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় যে গুলিবর্ষণ ও নির্যাতন চালানো হয়েছে আমি তার নিন্দা করি। এ ধরণের গুলিবর্ষণের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ, ১৯৭১ সারা বাংলাদেশব্যাপী হরতাল পালিত হবে।

সামরিক বাহিনী ও নিরস্ত্র বেসামরিক লোকের মধ্যে সংঘাতের পরিস্থিতি সৃষ্টি না করার জন্য আমি সংশ্লিষ্টদের আহ্বান জানাচ্ছি। তাঁরা যদি এতে কর্ণপাত না করেন, সামরিক সংঘর্ষের পথ বেছে নেন, তবে একটি রাজনৈতিক সমাধান বানচাল করা এবং তার মারাত্মক পরিণতির জন্যে তাঁরাই পুরোপুরি দায়ী থাকবেন।

আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্যে আমি আমাদের বীর জনগণকে আহ্বান জানাই। কিন্তু আমাদের অর্থনীতি স্বাভাবিকভাবে চালু রাখতে হবে। সর্বাধিক দক্ষতার সাথে যাতে অর্থনীতি চালু থাকে-তা নিশ্চিত করা প্রত্যেকের পবিত্র দায়িত্ব মনে করতে হবে। এ ব্যাপারে কল-কারখানায় আমাদের শ্রমিকদের একটা বড় দায়িত্ব রয়েছে। সর্বাধিক উৎপাদনের জন্যে স্বাভাবিক অবস্থা বজায় রাখতে তাদেরকে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে।

আমাদের আন্দোলন এগিয়ে যাবে। সময়ে সময়ে ব্যাখ্যা দেয়া সাপেক্ষে ১৪ মার্চ, ১৯৭১ তারিখে জারিকৃত নির্দেশাবলী বলবৎ থাকবে।

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা ২৬ শে মার্চ ১৯৭১

[প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ বিকাল ৫টা নাগাদ সকলের অগোচরে ঢাকা ত্যাগ করেন। বঙ্গবন্ধু সাথে সাথেই এ খবর পান। সেনাবাহিনী তৎপরতা চালাবে, এ আশঙ্কায় তিনি নেতৃস্থানীয় সহকর্মীদের আন্দোলনের স্বার্থে গোপন আশ্রয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। তার শুভাকাঙক্ষীরা তাকেও নিরাপদ আশ্রয়ে যাবার জন্য তাগিদ দেন। কিন্তু তিনি তাতে রাজি হননি। রাত সাড়ে আটটা নাগাদ সম্ভাব্য সামরিক অভিযানের খবর ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে। জনগণের মধ্যে উত্তেজনা দেখা যায় এবং তারা ঘর থেকে বেরিয়ে এসে রাস্তায় রাস্তায় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে শুরু করে। রাত সাড়ে দশটা নাগাদ শহরে সেনাবাহিনী প্রবেশ করতে শুরু করে এবং পূর্ব পরিকল্পিত অভিযান চালায়।

রাত সাড়ে বারোটা পর্যন্ত টেলিফোনে কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতে সক্ষম হয়েছিলেন। রাত দেড়টার দিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে তার বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। ঢাকায় সেনা অভিযান শুরু হওয়ার পরপরই বঙ্গবন্ধু ২৫ শে মার্চ মধ্যরাতে পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলস-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র প্রচারের জন্যে চট্টগ্রামে একটি বার্তা পাঠান। স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত বার্তাটি ইংরেজি ও বাংলা উভয় ভাষায় এখানে উদ্ধৃত হলো।]

“এটাই হয়তো আমার শেষ বার্তা।”

আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন।

বাংলাদেশের মানুষ যে যেখানে আছেন, আপনাদের যা কিছু আছে তা দিয়ে সেনাবাহিনীর দখলদারির মোকাবেলা করার জন্য আমি আহ্বান জানাচ্ছি। পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীর শেষ সৈন্যটিকে বাংলাদেশের মাটি থেকে উৎখাত করা এবং চুড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আপনাদেরকে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে।

[বাংলাদেশ সরকার, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিবির্শ্ব প্রচারকেন্দ্র কর্তৃক প্রকাশিত পুস্তিকা ‘বঙ্গবন্ধু স্পিকস’ তারিখ ঃ ২৬ মার্চ, ১৯৭১]

Declaration of Independence

This may be last message, from today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh where you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of the Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved”

[Message embodying Declaration of Independence sent by Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman to Chittagong shortly after midnight of 25 March. I,e early of 26th March, 1971 for transmission throughout Bangladesh over the ex-EPR transmitter.]

 

আরও পড়ুন: