বিএনপি-জামাত যুগের স্মৃতিচারণ: যখন বিদ্যুৎ বিভ্রাটই ছিল স্বাভাবিক

২০০৫ সালে বাংলাদেশের এক শীর্ষস্থানীয় সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছিল, কিভাবে বিএনপি-জামায়াত-এ-ইসলামী জোট সরকার দেশের বিদ্যুৎ খাতকে এক অভূতপূর্ব সংকটে ফেলে দেয়। বিদ্যুৎ খাতে তিনটি ব্যর্থতার রেকর্ড শিরোনামের ওই প্রতিবেদনে শিল্পায়নের জন্য অপরিহার্য এই খাতের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছিল।

বিদ্যুৎ খাতে ব্যর্থতার তিন রেকর্ড

১. রেকর্ড সংখ্যক বিদ্যুৎ সংকট ও বিভ্রাট
২. কম বিদ্যুৎ উৎপাদন
৩. জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ সংযোজনের নিম্নগামী হার

এই ব্যর্থতাগুলো সাধারণ মানুষকে অকূল হতাশায় ফেলেছিল। শিল্প উৎপাদন প্রায় সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল, আর ঘরে ও কারখানায় অবিরত বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নতা মানুষকে রাস্তায় নামতে বাধ্য করেছিল। তারা মুক্তি চাইতে শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ করলে, তখনকার সরকারের নির্দেশে পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লাঠিচার্জ ও গুলি চালায়।

আরেক প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছিল যে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জনসম্মুখে বিক্ষোভ হওয়ার সম্ভাব্য স্থান সম্পর্কে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এটি স্পষ্টতই “শৃঙ্খলা রক্ষার” ছদ্মবেশে রাষ্ট্রীয় যন্ত্রের নগ্ন অপব্যবহার ছিল।

এই আন্দোলন চলাকালে অন্তত ২০ জন নিহত হয়েছিলেন, যা বিএনপি শাসনের (২০০০–২০০৫) একটি কালো অধ্যায় হয়ে ইতিহাসে থেকে গেছে। পনেরো বছর পেরিয়ে গেলেও সেই স্মৃতি আজও শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের সাফল্যের সাথে একেবারে বিপরীত প্রতিচ্ছবি হিসেবে তুলনা করা হয়।

 

তারেক রহমানের মন্তব্য বিদ্রূপাত্মক বাস্তবতা

আইআরআইসহ আন্তর্জাতিক সংস্থার একাধিক জরিপে শেখ হাসিনার জনপ্রিয়তার উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা যায়। অথচ বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সেই সময়ে বিদ্যুৎ বিভ্রাট নিয়ে জনসাধারণের ক্ষোভ দমন করতে গিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন:

আমার অফিসে প্রতিদিনই পাঁচ থেকে ছয় ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিভ্রাট হয়। বাংলাদেশ জাতীয় অর্থনীতির জন্য বাড়ি শপিং মলে একসঙ্গে বিদ্যুৎ সরবরাহ আশা করা সম্পূর্ণ অবাস্তবএটি মানুষের কাছে কেবল এক ধরনের বিলাসিতা।

তিনি আরও যোগ করেছিলেন:
পুরো দেশের মানুষকে বিদ্যুৎ সরবরাহের আওতায় আনা কোনো দলের জন্যই শুধু একটি দুঃস্বপ্ন।

কিন্তু সম্প্রতি এই সাক্ষাৎকারের ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে, কারণ বর্তমান বাংলাদেশে ১০০% বিদ্যুৎ কভারেজ নিশ্চিত হয়েছে। অতীতের ঘনঘন বিভ্রাটের সেই চিত্র আজকের বিদ্যুৎ-সমৃদ্ধ বাংলাদেশের সাথে এক অসাধারণ বৈপরীত্য তৈরি করেছে।

 

দুর্নীতি, লুটপাট ব্যর্থতা

মিডিয়া রিপোর্টে উঠে এসেছে—এই সঙ্কটের পেছনে মূল কারণ ছিল সীমাহীন দুর্নীতি। তারেক রহমানের ঘনিষ্ঠ সহযোগী গিয়াসউদ্দিন আল মামুনের নেতৃত্বে স্থানীয় কিছু ব্যবসায়ী চক্র বিদ্যুৎ খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের দুই-তৃতীয়াংশ আত্মসাৎ করেছিল।

তখন এই খাতে প্রায় ২,০০০ কোটি টাকা ব্যয় দেখানো হলেও, মাত্র ৮০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা যোগ হয়েছিল—যা একেবারেই নগণ্য।

বিদ্যুৎ মন্ত্রণালয়ের এক মন্ত্রী পরবর্তীতে পদত্যাগ করে অভিযোগ করেছিলেন—পাঁচ বছরে খরচ দেখানো ১,৫০০ কোটি টাকার মধ্যে অন্তত ৬০০ কোটির হিসাব তিনি খুঁজে পাননি। তিনি তারেক রহমানকে হিংসাত্মক রাজনীতির প্রতীক বলে আখ্যায়িত করেন।

২০০৮ সালে ঢাকাস্থ মার্কিন দূতাবাসের গোপন ক্যাবলেও একই অভিযোগ প্রতিধ্বনিত হয়। দূতাবাস কর্মকর্তা জেমস এফ. মরিয়াটি লিখেছিলেন:

তারেক রহমান ভয়ংকর রাজনৈতিক দুর্নীতির সাথে জড়িত, যা মার্কিন স্বার্থের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তিনি এক বর্ণাঢ্য অথচ ভয়ঙ্কর ব্যক্তিত্ব, এবং বাংলাদেশের ক্লেপটোক্র্যাটিক শাসন হিংসাত্মক রাজনীতির প্রতীক।

 

শেখ হাসিনার বিদ্যুৎ খাতে সাফল্য

যদিও শেখ হাসিনার সময়ে এখনো মাঝে মাঝে বিদ্যুৎ বিভ্রাট দেখা যায়, তবুও ২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে অভূতপূর্ব অগ্রগতি হয়েছে।

  • বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতা ,৯৪২ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে ২৫,৫১৪ মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে।
  • সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ উৎপাদন ,২৬৮ মেগাওয়াট থেকে বেড়ে চারগুণে ১৩,৭৯২ মেগাওয়াটে পৌঁছেছে।
  • বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এর মধ্যে ,১৬০ মেগাওয়াট আমদানি করা হলেও বাকি ১৯,৬২৬ মেগাওয়াট স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত।
  • সম্প্রতি নতুন ,৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালু হওয়ায় বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে তরুণ দেশ হয়েও বিদ্যুৎ সরবরাহে ভারত ও পাকিস্তানকে পেছনে ফেলেছে।

বিশ্বব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ভারতের বিদ্যুৎ কভারেজ ৯৮% এবং পাকিস্তানের ৭৪%। তুলনায় বাংলাদেশ আজ ১০০% বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করেছে।

 

ব্যর্থতা বনাম সাফল্য: সরল তুলনা

বিএনপি-জামায়াত জোটের বিদ্যুৎ খাত ব্যবস্থাপনা আর আওয়ামী লীগের সাফল্যের সরল তুলনা শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে বিরোধীদের সমালোচনাকে নস্যাৎ করে। অথচ বিএনপি তাদের ভয়াবহ ব্যর্থতাগুলো স্বীকার করতে না পেরে বরং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেই অভিযোগ-প্রতিআপত্তি চালিয়ে যাচ্ছে। এমনকি বিদ্যুৎ বিভ্রাটের মাত্রা কমে যাওয়ার পরও তারা দায় চাপানোর কৌশল থেকে সরে আসেনি।

এই কৌশল জনগণের কাছে বিএনপির বিশ্বাসযোগ্যতাকে আরও ক্ষুণ্ন করছে।

বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিএনপির ব্যর্থতা ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ, যা সরাসরি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ও জাতীয় অর্থনীতিকে অচল করে দিয়েছিল। বিপরীতে, আওয়ামী লীগ জনসেবায় নতুন উচ্চতা স্পর্শ করেছে।

আজ যখন বাংলাদেশ ডিজিটাল রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে, তখন বিএনপি—যাকে অনেকেই ‘ব্যারাক্স থেকে নির্মিত দল’ বলে অভিহিত করে—শুধু ধর্মীয় সংবেদনশীলতা উস্কে দিয়ে কিংবা বিদেশী শক্তির ওপর নির্ভর করে ক্ষমতায় ফিরে আসার চেষ্টা করছে।