রাগ শোনার সময় বা প্রহর নিয়ে শুরুর দিকের শ্রোতাদের অনেক জিজ্ঞাসা ও দ্বিধা থাকে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দুটি ধারাই রাগ নির্ভর। তবে কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের রাগ সময় নির্ভর নয়। মানে কর্ণাটকী শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের যেকোনো রাগ যেকোনো সময় গাওয়া বাজানো যায়। শুধুমাত্র হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের সময় নির্ভরতা আছে। তার মানে হিন্দুস্থানি গান বাজনায় সুনির্দিষ্ট রাগ, সুনির্দিষ্ট সময়ে গাওয়া বাজানো হয়।
এই সুনির্দিষ্ট সময়টির কারণ – রসের পূর্ণতা। প্রকৃতিগত কারণে দিনের নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট রাগের পূর্ণ রূপ অনুভব করা সহজ হয়। সঠিক সময়ে শিল্পীর পক্ষে যেমন রাগের অবয়ব আঁকা সহজ হয় ঠিক তেমনই শ্রোতার মনে সহজেই রস জেগে ওঠে। রাগ শোনার সময় বা প্রহর ঠিক করে করলে রাগ পরিবেশন করা এবং শোনার উদ্দেশ্য পূর্ণ হয়।
রাগ শোনার সময় বা প্রহর
সময় সঠিক না হলে, শিল্পী খুব ভাল পারফরমেন্স করেও হয়তো শ্রোতার হৃদয়ে রস জাগবে না। আর শ্রোতার রস জাগা ছাড়া পারফরমেন্স বৃথা।
রাগের ব্যাকরণ ভিত্তিক সময় নির্ভরতা:
প্রধানত – বাদী, সমবাদী এবং অনুবাদী স্বরের উপর ভিত্তি করে রাগের সময় নির্ণয় করা হয়। এই স্বরগুলো সপ্তক (অকটেভ) এর কোন অংশে পড়েছে, তার উপরে ভিত্তি করে রাগের সময় নির্ধারণ করা হয়।
রাগের মৌসম ভিত্তিক নির্ভরতা:
এছাড়া বছরের নির্দিষ্ট কিছু সিজন ভিত্তিক রাগ আছে। ওই রাগগুলো ওই ঋতুর প্রকৃতির সাথে সবচেয়ে ভালভাবে সাজতে পারে।
তবে শিল্পী খুব দক্ষ হলে অসময়েও রাগ জমাতে পারেন। তিনি শীতকালে তৈরি করতে পারেন গ্রীষ্মের অনুভব, আর গ্রীষ্মকালে আনতে পারেন মেঘের ছায়া ।
অকটেভ ভিত্তিক বিভাজন:
রাগের সময় নির্ধারণের জন্য প্রথমে দিনকে দু’ভাগে ভাগ করে নিতে হবে। প্রতিটি ভাগে ১২ ঘণ্টা। সপ্তক (অকটেভ) আধাআধি ভাবে এই দুটি ভাগে ফেলে দিতে হবে। আমরা এই উদাহরণের মধ্যে সপ্তক নিয়ে কথা বলছি।
– পূর্ব ভাগ :
রাত ১২ টা (AM) থেকে দুপুর ১২টা (PM) পর্যন্ত সময়কে দিনের পূর্ব ভাগ বলা হয়। ষড়জ থেকে মধ্যম (সা রা গা মা) পর্যন্ত সুরগুলো এই “পুর্বাঙ্গ, poorvang, পূর্ব-অঙ্গ বা পূর্ব-ভাগ” বলে।
– উত্তর ভাগ :
এরপর দুপুর ১২টা থেকে রাত ১২ টা পর্যন্ত সময়ে দিনের উত্তর ভাগ বলা হয়। মধ্যম থেকে তার সপ্তকের এর ষড়জ পর্যন্ত (মা, ধা, না, র্সা) সুরগুলোকে “উত্তরাঙ্গ, Uttar-ang, উত্তর-অঙ্গ, উত্তর ভাগ” বলে।
কোন রাগের বাদী স্বর যদি পূর্বভাগে পড়ে তবে সেই রাগ সাধারণভাবেই রাত ১২টা থেকে দুপুর ১২টার মধ্যের যেকোনো একটি সময়ে পড়বে।
সময়ের অষ্টপ্রহর:
অষ্ট মানে আট আর প্রহর মানে ৩ ঘণ্টার সময়কাল। যেহেতু দিনটি ২৪ ঘন্টায় ভাগ করা হয় তাই প্রতি ৩ ঘন্টার প্রহর হয় এবং তাই 8টি প্রহর রয়েছে। আর সকাল ৬টা থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত সময়কালকে অষ্টপ্রহর বলে। তবে প্রহরের ঐতিহ্যগত পদ্ধতি মুহুর্তের ঐতিহ্যগত পদ্ধতির (সুনির্দিষ্ট জ্যোতির্বিজ্ঞানের গণনার উপর ভিত্তি করে গণনা করা হয় মুহুর্তের পদ্ধতি) সাথে ওভারল্যাপ করে ।
সময় ১ম প্রহর (রাত ৩ টা থেকে – সকাল ৬ টা):
চন্দ্রকোষ, মালকোষ, গোপিকা বসন্ত, পঞ্চম, মেঘ রঞ্জিনী, ভঙ্কর, ললিতা গৌরী, ললিতা, কথা, গুর্জরি তোরি, বারাতি তোরি, ভাওপাল তোরি, প্রভাতী কীর্তন।
সময় ২য় প্রহর (সকাল ৬টা থেকে – সকাল ৯ টা):
বৈরভ, বেঙ্গল বৈরভ, রামকালী, বিভাস, জোগাই, তোরি, জয়দেব, প্রভাত কীর্তন, প্রভাত ভৈরব, গুঙ্কালি এবং কলিঙ্গরা।
সময় ৩য় প্রহর (সকাল ৯টা থেকে – দুপুর ১২ টা):
দেব গান্ধার, ভৈরবী, মিশ্র ভৈরবী, আসাবরী, জোনপুরী, দুর্গা, গান্ধারী, মিশ্র বিলাওয়াল, বিলাওয়াল, বৃন্দাবনী সারং, সামন্ত সারং, কুরুভ, দেবনাগিরি।
সময় ৪র্থ প্রহর (দুপুর ১২টা থেকে – বিকেল ৩ টা):
গোর সারং, ভীমপলাসী, পিলু, মুলতানি, ধনি, ত্রিবেণী, পলাসী, হংসকিনি।
সময় ৫ম প্রহর (বিকেল ৩ টা থেকে – বিকেল ৬ টা):
বাংলার ঐতিহ্যবাহী কীর্তন, ধানসারি, মনোহর, রাগাশ্রী, পুরবী, মালশ্রী, মালভি, শ্রীটঙ্ক ও হংস নারায়ণী।
সময় ৬ষ্ঠ প্রহর (বিকেল ৬ টা থেকে – রাত ৯ টা):
ইয়ামন, ইয়ামন কল্যাণ, হেম কল্যাণ, পূরবী কল্যাণ, ভূপালী, পুরিয়া, কেদার, জলধর কেদার, মারওয়া, ছায়া, খামাজ, নারায়ণী, দুর্গা, তিলক কামোদ, হিন্দোল, মিসরা খামাজ নাটা, হামির।
সময় ৭ম প্রহর (রাত ৯ টা থেকে – রাত ১২ টা):
দেশকর (রাত্রি), দেশ, দেশ মিশ্র, সোরাত, বিহাগ, দর্শ, চম্পক, মিশ্র গারা, তিলাং, জয় জাবন্তী, বাহার, কাফি, অরণ, মেঘ, বাগিশারি, রাগেশ্বরী, মালহাল, মিয়া, মালহার।
সময় ৮ম প্রহর (রাত ১২ টা থেকে – রাত ৩ টা):
মালগুঞ্জি, দরবারী কাঁড়া, বসন্ত বাহার, দীপক, বসন্ত, গৌরী, চিত্রা গৌরী, শিবরঞ্জিনী, জৈতশ্রী, ধওয়ালশ্রী, পরজ, মালি গৌরা, মাদ, সোহানি, হংস রথ, হংস ধোয়ানি।
শাস্ত্র সিদ্ধান্ত:
তবে ওস্তাদ পণ্ডিতদের সমন্বিত শাস্ত্র সিদ্ধান্তই রাগের প্রকৃত সময় নির্ধারণ করে। তবে ঘড়ির কাঁটার চেয়ে সূর্যের উদয়-অস্ত বা প্রকৃতির ভাবের উপরে শাস্ত্র সিদ্ধান্ত বেশি নির্ভর করে।
তবে আপনাকে শ্রোতা হবার জন্য যে একেবারে ওই সময়েই রাগ শুনে শুনে কান প্রস্তুত করতে হবে, এমন কোন কথা নেই। আপনি বরং শুনতে থাকুন এক টানা একটি রাগ। খুব ভালো ভাবে চিনে যাবার পরে নির্দিষ্ট সময় আর পরিবেশে শুনুন।
সিরিজের বিভিন্ন ধরনের আর্টিকেল সূচি: