পটের বিবি [ Poter Bibi ] !
সর্বনাশ পঞ্চি, গাড়ির তেল ফুরিয়ে আসছে—
তা হলে, ভয় ছমছম গলায় চেঁচিয়ে ওঠে পঞ্চি—কি হবে, কি হবে আয়ার?
স্টিয়ারিং-এ হাত রেখে চুপ করে থাকে আয়ার। জবাব দেবে কি? কি আর দেবার আছে? আয়ারের মুখে অনিশ্চয়তার ফ্যাকসা ঘনিয়েছে হেমন্তের কুয়াশার মতো।
জোরে আরও জোরে চালাও আয়ার। যে করেই হোক এ জঙ্গলটা পেরিয়ে যেতেই হবে। এ জঙ্গলে রাত কাটাতে হলে, উঃ, আমি ভাবতেই পারছি না—
–কিন্তু তেল কই অতো—ছোট্ট কথা ক’টি চাপাকন্ঠে বলল আয়ার।
পঞ্চির মনে হলো ওরা যেন জালে আটকানো মাছির মতো জালের পাকে পাকে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আর মাঝখানে লালাসিক্ত দু’টি চোখ নিয়ে বসে আছে হিংস্র মাকড়সাটা। তারপর, তারপর সেই রোমশ নখবল্লামবৃত দীর্ঘ একটা বাহু বাড়িয়ে সেই মূর্তিমান নৃশংসতাটি যেন তাকে, তাকে….উঃ, বড্ড ভয় করছে পঞ্চির।
দু’বাব র্হন বাজালো আয়ার। হেড লাইটের চোখ ঝলসানো আলোর আওতা থেকে ছুটে পালালো কয়েকটা খরগোশ। আয়ারের কপালে দুশ্চিন্তার ঘাম। ওর দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ফিরিয়ে নেয় পঞ্চি।
কান পাতলে সমস্ত বনটা জুড়ে একটা বেদনার্ত আর্তি শুনতে পাওয়া যায় যেন। একটা বোবা শনশন আওয়াজ কাঁপিয়ে দিয়ে যায় বুনো রাত্রির অন্ধকার। কানদুটোকে প্রখর করে রাখে পঞ্চি। কয়েকটা রাতজাগা পাখির কলকাকলী গাড়ির দ্রুততার ওর ঝাপট মেরেই মিলিয়ে গেল পেছনের ঘনান্ধকারে। হঠাৎ সমস্ত নিস্তব্ধতা ভেঙে খানখান করে দিয়ে বাঘের গর্জন ফেটে পড়ল বনভূমির প্রান্ত থেকে প্রান্তে। শিউরে উঠে চোখ বুজে দু’হাতে আয়ারকে আঁকড়ে ধরল পঞ্চি। আর ঠিক সেই মুহূর্তে একটি বিশ্রী আওয়াজ করে গাড়িটা থেমে পড়ল সেখানেই তেল ফুরিয়ে গেছে।
কোডার্মা রিজার্ভ ফরেস্টের আদিম বন্যাতা চাপ বেঁধে ওঠে ওদের থেমে তাকা গাড়ির চারপাশে।
কি হবে আয়ার, উঃ—অস্ফুট কন্ঠে একবার প্রশ্ন করে পঞ্চি সমস্ত মুখটাতে ভয়াটে অসৌন্দর্য কেমন কুৎসিত হয়ে দেখা দিচ্ছে।
শুকনো ঠোঁটদুটো বিসদৃশভাবে একবার চেটে নেয় আয়ার।
জবাব দেয় না কিছু।
মরীচিকা নয়, সত্যি সত্যিই ওয়েসিস। একটা আশ্বাস। মৃত্যুঞ্জয় সঙ্গীতের সুর যেন শুনতে পাচ্ছে রঙ্গস্বামী আয়ার। পিপাসার শেষ সীমান্তে এসে যেন শুনতে পাওয়া যাচ্ছে শান্ত নির্ঝরিণীর কলস্বর। গোবির বিশুষ্কতার মধ্যে যেন উশীর সান্ত্বনা। ঠিক। কানদুটোকে যথাসম্ভব সজাগ করে রাখে আয়ার। ঠিক। মোটরবাইকের আওয়াজ। জীবনের স্পন্দন। সভ্যতার আলোকদূত ছুঁটে আসছে যেন ত্রাণকর্তা হয়ে।
শুনতে পাচ্ছো—দু’হাতে ধ’রে পঞ্চিকে প্রবল ঝাঁকুনি দিলো আয়ার।
–কি, বাঘটা কি এগোচ্ছে? ফ্যাকাসে মুখ পঞ্চির।
না, ওই শোন্—
মোটরবাইকের আওয়াজ, মানুষ?—সমস্ত মুখটা বাসন্তী-বিকেল হয়ে ওঠে পঞ্চির।
হ্যাঁ, এগিয়ে আসছে—
শব্দ বাড়ছে। অগ্নিচক্ষু জ্বালিয়ে আদিম অরণ্যের ভেতর ছুটে আসছে একটা যন্ত্র-দানব। সভ্যতা। বাঁকটা পেরোতেই মোটর- বাইকের আলোটা দৃষ্টিগোচর হলো ওদের। গাড়ির হেড লাইটটা জ্বলছে, তবু একটা হাত সামনে বাড়িয়ে রাখল আয়ার। থামো। ব্রেক কষতে কষতে মোটরবাইক এসে থামলো।
আপনার কে? এখানে, এসময়?—প্রশ্ন হলো ইংরেজীতে।
সাধ্যমত জবাব দেয় আয়ার, বলল,–আমি মাইকা ফিল্ড ইনস্পেকশনে এসেছি কোডার্মা। রাঁচীতে রাত করে ফেরার পথে হঠাৎ দেখি গাড়ির তেলের ট্যাঙ্ক খালি, তাই আটকে পড়ে গেছি এখানে, উনি আমার স্ত্রী—
–যাক, ভয় পাবার কিছু নেই। আমি এ বনেরই ফরেস্টার। চলুন, আমার বাঙলোতেই থাকবেন চলুন, কাছেই আমার বাঙলো। কাল ভোরে যা হয় করবেন। আর গাড়ির জন্যে ভাববেন না। আমার কুলী পাঠিয়ে ওটাকে ঠেলে ঠেলে এক্ষুণি বাঙলোতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করব। বলিষ্ঠ লোকটার কালো পাথুরে মুখটা উজ্জ্বল দেখায়। পিঠে রাইফেলের নলটা মূর্তিমান সাহসের মতো উদ্ধত হয়ে রয়েছে।
–হেঁটে যাবো? এই মাত্র বাঘ ডাকল যে, পঞ্চির ভিতু গলা শ্রুতিগোচর হয় ওদের। ইংরেজীতেই বলে পঞ্চি।
–সে আমিও শুনেছি মিসেস আয়ার। ভয় পাবেন না, সে অনেক দূরে, আরেক তল্লাটে। এদিকে বাঘ আসবে না, এছাড়া আপনারা আমার রাইফেলটার ওপর রিলাই করতে পারেন, ওটা কখনও বেইমানী করে না-বলে লোকটি একটু হাসল কিনা অন্ধকার স্পষ্ট বোঝা গেল না।
ইফ ইউ ডোন্ট মাইণ্ড, আপনার নামটা-আয়ার শুধোল।
–নিশ্চয়ই—পরিতোষ চ্যাটার্জি, আউট এণ্ড আউট বেঙ্গলী—জবাব দেয় ফরেস্টার সাহেব।
–বেঙ্গলী। ওঃ লাভলি, আমিও কোলকাতারই মানুষ, বাঙলা জানি। মোর ওভার, আই অ্যাম ম্যারেড টু এ বেঙ্গল গার্ল। পঞ্চি, এদিকে এসো—
বাঙালী শুনে পঞ্চিও খুশীতে রামধনু হয়ে উঠেছিল। সংক্ষিপ্ত হেসে শুধু বললো—বাঁচলুম।
–চলুন, চলুন আপনারা—ফরেস্টার চ্যাটার্জি তাড়া দেয় ওদের ও যা খুশী হবে আপনাদের পেয়ে, মানে আমার স্ত্রীর কথা বলছিলাম—
পঞ্চির চমকাতে হলো। এরকম ঘটনাচক্রের জন্যে ও প্রস্তুত ছিল না মোটেই। কুন্তীকে ও আদৌ আশা করে নি এখানে, এমন আশ্চর্য আকস্মিকতার ধাক্কা কাটাতে তাই পর পর দু’গ্লাস জল খেল পঞ্চি।
কুন্তী নির্বিকার।–ওমা বৌদি দেখছি, বলেই জিভ কাটল। মাপ করো ভাই পঞ্চিদি, আগেকার অভ্যেসের ঝোঁকে ও কথাটা বেরিয়ে গেছল। এখন তো তুমি মিসেস—সপ্রশ্ন চোখে তাকায় কুন্তী। ‘আয়ার’ যোগ করে
কথাটাকে সম্পূর্ণ করে পঞ্চি, তারপর যেন মেয়েলী আদূরেপনার সুযোগ পেয়ে বলে বসল—তাতে কি, পঞ্চিদি নয়, তুমি বৌদি বলেই ডেকো না, কৌশিক তোমার দাদা হতে পাবে, রঙ্গস্বামীও হোক না। আরেক জনে দোষ কি—শেষের দিকে গলাটা একটু কাঁপলো কি? রুমালটা অমন অনাবশ্যক গলায় বুলোবার বা অমন চটকাবারই কি প্রয়োজন ছিল পঞ্চির?
–বাঁচলুম, তাই ডাকবো—তারপর চাপা গলায় বললো, নতুন বিয়েটা কবে করলে? কি করে হয়েছে?
–বছর খানেক। তা প্রেমে পড়েই বলতে পারো। ছ’মাসের কোর্টশীপের পর।
–ও। আচ্ছা বোস তোমরা, আমি বাবুর্চিটাকে একটু তাড়া দিয়ে আসি। ভয়ানক ফাঁকিবাজ সব: বলে রান্নাঘরের দিকে চলে যায় কুন্তী।
সেই কুন্তী, আশুতোষের শানানো মেয়ে, প্রখর ডিবেটার , ছেলেমহলের হৃৎকম্প। আজ ফরেস্টার পরিতোষ চ্যাটার্জির স্ত্রী। পাখার রঙের রামধনুতে সবাইকে চমকে দিয়ে কোন প্রজাপতি যেন গুটিপোকা হয়ে এই আরন্যক কুটিরে এসে মাথা গুঁজেছে শেষ পর্যন্ত। ঝড়ের দিনে যারা হাল ধরতে চেয়েছিল, সেইসব রমেন, মনীষ, দীপকদের এড়িয়ে নীড় বাঁধল এসে পরিতোষ চ্যাটার্জির সঙ্গে। আশ্চর্য! আশ্চর্য লাগে ভাবতে। কৌশিক, কৌশিক কেমন আছে, কোথায় আছে কৌশিক? পঞ্চির প্রথম স্বামী, প্রথম পুরুষ, প্রথম প্রেম, প্রথম অনুভব? বড্ড ইচ্ছে হচ্ছে সে খোঁজ নিতে। কিন্তু না, প্রয়োজন নেই।
কুন্তা হয়ত ভাববে, এটা তার গোপন দুর্বলতার লক্ষণ, আয়ারকে নিয়ে মন না ভরার সঙ্কেত পাবে এ-ধরনের প্রশ্নে। না। মেয়েলী পরাজয়ে খুশী হতে দেওয়া চলে না কুন্তীকে, ওর দাদার অত বড় মূল্যকে স্বীকার করে নিজের মূল্যহীনতার প্রমাণ দিতে রাজী নয় পঞ্চি। কৌশক!…. না না। বরং ওর সম্পর্কে কৃত্রিম নিস্পৃহতায় বেদনাবিদ্ধ করবে সে কুন্তীকে, হারিয়ে দেবে কৌশিককে, অস্বীকার করবে ওর সামান্যতম পরিচয়ের স্বাক্ষরও। বদ্ধপরিকর পঞ্চি। রান্নাঘরে এসে ও মিষ্টি গলায়, বললো, একটা শাড়ি দেবে ভাই। কাপড়টা পাল্টাবো ভাবছি, আর তোমাদের বাথরুমটা যেন কোনদিকে?
–ওমা, ওই দেখো, ভুলে গেছি শাড়ি পাল্টানোর ব্যবস্থা করতে। না, সংসারী আর হতে পারলাম না আজো। এই ডিমটা ভাজ তো কাংড়া, আমি আসছি। চলো বৌদি, ওই যে বাথরুম, যাও। তারপর এসো। আমি শাড়ি জামা দিচ্ছি তোমায়—
কুন্তীর আতিথ্যটাই অসহ্য মনে হয় পঞ্চির ও বুঝতে পারে, হৃদ্যতাটা হঠাৎ চমকে দিয়ে ওঠা একটি আগন্ত্তক দম্পতির জন্য নয়।
কৌশিকের সেতু পথের যোগাযোগ দিয়ে পুরনো পরিচিত আত্মীয়ার প্রতি কুন্তীর স্বাভাবিক হৃদয়বৃত্তির ফল্গুস্রোত পঞ্চির আয়েশের বদলে অস্বস্তির মতো গায়ে এসে লাগে। বেঁধে। উঃ,কৌশিক। ভুল। বিশ্বাসঘাতক কৌশিককে সে ক্ষমা করে নি, ঠিক করেছে। সে এখন সুখী হ্যাঁ, খুব সুখী।
–খবর জানো বৌদি, দাদার নতুন উপন্যাস ‘সপ্তদ্বীপ’ দিল্লী য়ুনিভার্সিটির গণপতি সিংহ প্রাইজটা পেয়েছে, এবছরের সেরা বাঙলা বই হিসেবে প্রাইজটা পেয়েছে দাদা। দ্যাখো নি তুমি?
আমার কৌশিক! না, কালই তাকে পালাতে হবে, কালই। হেসে জবাব দেয় পঞ্চি—কই না তো? আয়ারটা বড্ড ভবঘুরে। তাই দেশ ঘুরে ঘুরে বই-টই দেখবার বা পড়বার অবসরই পাইনে—
ওমা, সে কি, দাদার বই পড়েই তো তুমি দাদাকে,–আচ্ছা দাঁড়াও! কুন্তী কি ভেবে নিয়ে একটা সুটকেস খুলে বসলো,তারপর রঙীন ঝকঝকে মলাটের একখানা বই বের করে এনে হাতে দিল পঞ্চির। ‘সপ্তদ্বীপ’—লেখক কৌশিক গুহঠাকুরতা। মলাট খুলেই মাথাটা কেমন ঝিমঝিম করে ওঠে পঞ্চির। কৌশিকের হাতের লেখা। সেই আশ্চর্য ভাল হাতের লেখা কৌশিকের।
‘স্নেহের কুন্তীকে—দাদা’। তারপর মাসখানেক আগের তারিখটা; না, হেরে যাচ্ছে, ক্রমশ হেরে যাচ্ছে পঞ্চি। মন্ত্রমুগ্ধ সাপের মতো কেউ যেন তাকে এনে ফেলেছে কুন্তীর এই ঝাঁপিতে। চোখ তুলে দেখলে সামনে কুন্তী নেই, আর ও’ঘর থেকে চুরুটের কড়া গন্ধ বুনো হা্ওয়ায় ভেসে আসছে এ’ঘরে। ওদের অনর্গল এত কি কথা বলা ছিল বুঝতে পারে না পঞ্চি। মাঝে মাঝে নেহরুর ফরেন পলিসী, ম্যাড্রা-সের কমিনিস্টদের হোল্ড,কোরিয়ার জার্ম ওয়ার, মানকড়ের খেলা, হাজারের বোলিং, অলিম্পিক, মাইকার পিট, ফিল্ম ইণ্ডাষ্ট্রি, মমের লেখা, সার্তর-এর মূলকথা, বেটি ডেবিসের অভিনয়, সবরকম সাত-সতেরো আলোচনার ভগ্নাংশ শুনতে পাচ্ছে ও। আলোচনায় দু’জনে একেবারে জম-জমাট। উঃ, এতোও বকতে পারে পুরুষমানুষগুলো।
পুরুষমানুষগুলো?—
না, তা’হলে কৌশিক ওরকম স্বল্প কথার মানুষ হলো কি করে? শুধু স্বল্প কথার, লোকটা কখনও কথা বলতো কিনা, বলতে পারে কিনা, মাঝে মাঝে সন্দেহ হতো পঞ্চির। ও’রকম বোবাও হয় মানুষ। মূক শিলাভূত স্ট্যাচুরও মুখেচোখে একটা বাঙ্ময় রূপ দেয় আর্টিস্টে কিন্তু কৌশিকের মুখ বুঝি স্ট্যাচুর চাইতেও কঠিন।
অথচ এতেও ওর ভালো-লাগা এড়ায় নি। তবু কৌশিককে আশ্চর্য ভালোবাসতে পেরেছিল পঞ্চি। পেরেছিল কি? হ্যাঁ, পেরেছিল বৈকি।
সতেরোর চৌকাঠ ডিঙিয়ে আঠারোর বসন্তে পঞ্চি স্কটিশের সেকেণ্ড ইয়ারের ছাত্রী। সাহিত্য পাঠে ওর প্রবল ঝোঁক তখন, বাবার উৎসাহ আর মা’র বিরোধিতার মাঝখানে প্রবল জোয়ারের মতো এতো এগোচ্ছিল ওর বই পড়।
–হ্যাঁ পড়ো, শিক্ষাই জ্ঞান, সাহিত্যই হচ্ছে দেশ—বাবা বলতেন। সারাদিন নভেল আর নভেল পড়া কি লো—বলতেন মা। দু জায়গায়ই হাসতো পঞ্চি, প্রতিবাদ করতো না। বেশ তো চলছে, এমনি করেই যায় যদি দিন, যাক না!
তখন নতুন লিখিয়ে কৌশিক গুহঠাকুরতার প্রথম উপন্যাস বেরিয়েছে ‘সূর্যকন্যা’। তুমুল আলোড়ন সে বই নিয়ে। রোমান্স আর রিয়ালিজম-এর এমন আশ্চর্য মিশেল নাকি বাঙলা সাহিত্যে নতুন। একজন প্রখ্যাত সমালোচক বলেছেন, এর নাম হচ্ছে ‘রেভ্যুলুশনারী রোমান্টিসিজম’। আর একজন লিখেছেন এদিন কোথায় ছিল এই শক্তিধর? আর দ্বিতীয় বই রম্যরচনা আর উপন্যাস-এর সংমিশ্রণ ‘নতুন দিল্লীর পুরনো গল্প’ বেরুনোর পর বইয়ের দোকানগুলো কৌশিক ছাড়া কিছু শুনলো না একটানা কয়েক মাস।
সঙ্গে সঙ্গে পঞ্চির মনের রাজা হয়ে বসল কৌশিক। একটি সাহিত্য-পত্রিকায় কৌশিকের অনিন্দ্যসুন্দর চেহারার ফটো আর সংক্ষিপ্ত জীবনীতে য়ুনিভার্সিটির ফিফত ইয়ারের চব্বিশ বছর বয়সের ছেলেটার কথা জেনে অসম্ভব দুর্বলতা দেখা দিল ওর। পঞ্চির মনের একচ্ছত্র সম্রাট হয়ে বসল কৌশিক, ওর হৃদয়ের টঙের একমাত্র পায়রা। হয়তো এমনি ভালো-লাগার রোমাঞ্চ নিয়ে কেটে যেতো কিছুদিন, তারপর ক্রমে একদিন ধূলির প্রাপ্য ধূলিকে দিয়ে সব ভুলে যেতো পঞ্চি, সহস্রের জটিল বাঁধনে জীবনের কোন পথ দিয়ে কোথায় চলে যেতো কে জানে! তখন দূরান্তের কোন তারার মতো কৌশিক শুধু ওর এককালের প্রিয় লেখকমাত্র, পছন্দসই ভালো ডিজাইনের শাড়ি তৈরির এককালের প্রিয় মিলের মতো, এককালের প্রিয় সেণ্টের কোম্পানী।
কিন্তু আসলে অভাবনীয় অনেক কিছু ঘটে যায় পৃথিবীতে। পৃথিবীতে ইতিহাস তো আকস্মিকতারই মালা গাঁথা। তাই সেদিন ট্রামের ভিড়কে পরবর্তী জীবনে পঞ্চির কাছে আর্শীবাদের মতো মনে হয়েছিল। দীর্ঘ তিন বছর অন্তত সে ভিড়ের ওপর কৃতজ্ঞতা ছিল পঞ্চির। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। প্রফেসর সেনগুপ্তের ক্লাস শুরু হতে আর আধ মিনিট বাকী। হন্তদন্ত হয়ে মেয়েদের কমনরুমে এসে ঢুকল পঞ্চি।
–এটা কোন ফ্যাশান ভাই? নতুন স্টাইল বুঝি?—বীণা প্রশ্ন করে হেসে। কৌতুককণ্ঠে। হঠাৎ সব মেয়েদের চোখ পড়ে ওর ওপর, তারপর সবাই হেসে উঠল কলকণ্ঠে।
কি ব্যাপার, হকচকিয়ে যায় পঞ্চি, কি হয়েছে? হাসছিস কেন?
–না, ব্লাউজের ওপর পেন রাখা বুঝি আজকাল সেফ নয় তোর পক্ষে, তাই কালো কেশে বেঁধেছিস ঝরনা কলম? উদ্দেশ্য, যতোই কালি ঝরুক, ঝরুক কালো চুলের গহিনেই, হৃদয়ের পদ্মে কোন কালি নয়, সেখানে কালির কলঙ্ক সইবে না, তাতে ফেটে চৌচির হয়ে যাবে অন্য কোন হতভাগ্যের হৃদয়, তাই নারে পঞ্চি?
–মুখরা মল্লিকার লম্বা কথার শানে হেসে লুটিয়ে পড়ল সবাই।
চমকে চুলে হাত দিল পঞ্চি, আর অবাক হয়ে দেখল চুলের গোছায় একটা কালো রঙের শেফার্স পেন আটকে রয়েছে। আলতোভাবে পেনটাকে খুলে ফেলে পঞ্চি। আশ্চর্য, এটা কোত্থেকে কেমন করে এল ওর চুলে? ভোজবাজী নাকি, ম্যাজিক?
–অমন দমে গেলি যে, ব্যাপার কি?—সান্ত্বনা শুধোয়।
–সত্যি ভাই, এটা কি করে এল আমার চুলে। কিছুই বুঝতে পারছি না? পঞ্চির সারা মুখে বিস্ময়ের মেঘ।
মল্লিকা ফের একটা লম্বা লেকচার ঝাড়তে উদ্যত হয়েছিল, কিন্তু ক্লাসের ঘন্টা পড়ায় ওকে থেমে যেতে হল। তাড়াহুড়ো করে পেনটা ব্লাউজে আটকে নিয়ে ক্লাসে ঢুকল পঞ্চি।
ভেবে খানিকটা আঁচ করে পঞ্চি। ট্রামের ভিড়ে সে যখন সেই জমাট জনজঞ্চালের ভিড় ঠেলে বেরিয়েছিল, তখনই হয়তো কারুর আলগা পকেট থেকে পেনটা ওর চুলের সঙ্গে আটকে চলে এসেছে। ভাগ্যিস, এর মালিক তখন দেখে নি, দেখলে তুমুল হাস্যরসের অবতারণায়, ট্রামভর্তি লোকের হাসিতে কুঁকড়ে এতটুকু হয়ে যেতে হতো হও। কি বিড়ম্বনা।
–তবে কি পেনটা চেপে যাবে, বেশ চমৎকার শেফার্স পেন। কি হবে চেষ্টাচরিত্র করে মালিককে ফেরত দিয়ে? না না, ছি ছি ছি, একি ভাবছে পঞ্চি। ক্লাস শেষ হলে পঞ্চি বেরিয়ে এলো। তারপর ইচ্ছে করে কমনরুমে না গিয়ে চলে এল লাইব্রেরীতে। একটা গল্প পড়তে শুরু করল পত্রিকা টেনে নিয়ে। এক পাতা শেষ করে বুঝল, সে চোখ বুলিয়ে যাচ্ছে মাত্র আসলে একটা অক্ষরও পড়া হয় নি ওর।
কি ভেবে বইটা বইটা বন্ধ করে বেরিয়ে এল পঞ্চি। আরো দু’টো অফ পীরিয়ডের পর স্পেশাল বাংলার ক্লাস ছিল। থাক, আজ আর ও ক্লাসটা করবে না পঞ্চি। ট্রামে ভিড় কম একটুক্ষণ ভেবে ও টিকিট কাটলো কলেজ স্কোয়ার।
দেড়টায় দাদার অফ রয়েছে। এগারো নম্বরে খোঁজ করলে পাওয়া যাবে হয়তো দাদাকে। সিঁড়ি ভেঙে ইউনিভার্সিটির দোতলায় এল পঞ্চি। তারপর এগারো নম্বরে উকি মারার আগেই নজরে পড়ল দেয়ালের ওপর নোটিশ বোর্ডের মতো একটা রাজনৈতিক পোস্টার। তার একদিকে একটি প্রাচীরপত্র। কৌতুহল জাগে পঞ্চির—প্রাচীরপত্রের এক কোণে লাল কালিতে লেখা একটা আঠা দিয়ে সাঁটা চিরকুটে চোখ আটকে যায় ওর।
‘হারিয়েছে—আমাদের প্রাচীরপত্রের সম্পদাক কৌশিক গুহঠাকুরতার একটি কালো শেফার্স কলম হারিয়েছে। ট্রামের পথে বা ইউনিভার্সিটিতে, কোন সহৃদয় ছাত্র বা ছাত্রী পেয়ে থাকলে লাইব্রেরীতে গিয়ে মালিকের কাছে কলমটি ফেরত দিলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব। সময়—দুটো থেকে সাড়ে তিনটা—সম্পাদকমণ্ডলী।’ আঠার ভেজা ভাব শুকোয় নি এখনো।
বুকটা ছলাৎ করে ওঠে পঞ্চির। লনের তটপ্রান্তে আছাড় খেয়ে পড়ে বিরাট একটি সামুদ্রিক ঢেউ। কানের পাশটায় একটানা ঝিঁঝিপোকার ডাক।
–কি রে তুই এ সময়?—দাদা এসে দাঁড়িয়েছেন পেছনে,–তোর ক্লাস-ট্লাস নেই এখন?
–ছিল একটা, চলে এলাম। ভালো লাগছে না।
–কেন শরীর খারাপ?
–না এমনি—
–তা চল্ ওয়াই এম সি-এতে যাবি?
–চলো।
ওয়াই এম সি-এর কেবিনে দাদাকে সবিস্তারে পেন প্রসঙ্গটি বললো পঞ্চি। শুনে দাদা অবাক হলেন খুব। তারপর বললেন চল তাহলে তিনটে বাজে, কৌশিককে ফেরত দেয়া যাক কলমটা। এটাই কৌশিকের পেন সন্দেহ নেই। আমার সঙ্গে আলাপ নেই কৌশিকের, তবে মুখ চিনি। চল্, তুইও যা ভক্ত হয়ে পড়েছিস ওর লেখার, আলাপ করলে খুশী হবি—কৌশিকের সঙ্গে সেই প্রথম আলাপ হল পঞ্চির। প্রথম পরিচয়।
আলাপ? আহা, আলাপের কি ছরি! পঞ্চির এখন ভাবতেও হাসি পায়।
–এই যে ভাই কৌশিক, শুনুন, আপনার কলমটা, ধরুন, যদি ফেরত দিতে পারি এখন, কি খাওয়াচ্ছেন? দাদা প্রশ্ন ছোড়েন।
লম্বা রোগা ফর্সা একটি ছেলে। লজ্জাভরা মুখ-চোখ। সদাকুণ্ঠিত ভাব। ওমা, এই কৌশিক গুহঠাকুরতা? হালের সবচেয়ে মিষ্টি লিখিয়ে? দেখলে বিশ্বাস করা শক্ত। অবাক হয়ে ওকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে পঞ্চি। ট্রামের ভিড়ে এই কাতর-মতো-মুখ ছেলেটাকে মনে আনবার চেষ্টা করে ও। ছিল, হ্যাঁ, এও ছিল সেই অচেনা মুখদের ভিড়ে।
পেয়েছ্নে?—কোন উৎসাহ নেই, উত্তেজনা নেই, ঠাণ্ডা নিস্পৃহ গলা। হতাশ হয়ে যায় পঞ্চি। আর চরিত্রটা আশানুরূপ নয় বলেই কৌতুহলীও হয়ে ওঠে ও।
মিষ্টি সুরেলা গলায় মুদৃস্বরে ও পেনটার কাহিনী বলে যায় কৌশিককে। তারপর বাড়িয়ে দেয় কলমটা।
‘ওঃ, ধন্যবাদ। অনেক ধন্যবাদ। হ্যাঁ, আপনার নামটা যেন কি পুলিন, পুলিন ব্যানার্জি না?—কৌশিক জানতে চায় এবার। নেহাত নিয়মরক্ষার জন্যেই দাদাকে শুধোয় ও।
হ্যাঁ, আর আমার বোনের নাম পঞ্চি, পাঞ্চালী বন্দ্যোপাধ্যায়। ও কিন্তু আপনার লেখার ভয়ানক ভক্ত পাঠিকা, আপনার সঙ্গে আলাপের ওর খুব শখ,–দাদা বললেন—চলুন না, ওয়াই এম সি-এতে। একবার পঞ্চির দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিল কৌশিক, তারপর একটা কথাও না বলে, খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,–কিছু মনে করবেন না আপনারা। আমার পক্ষে হয়তো আপনাদের খাওয়ানোই উচিত ছিল, নয় তো একটুক্ষণ বসে আলাপ করার। কিন্তু আমার পকেটে পয়সা নেই তেমন, আর, আর, এখন একটু কাজ আছে আমার, এক্ষুণি মেতে হবে। চলি—কৌশিক বেরিয়ে গেল পাশ কাটিয়ে।
দাঁত দিয়ে ঠোঁট চেপে ধরল পঞ্চি, তারপর চাপা গলায় বলল,–অভদ্র। চলো দাদা, না-কি তোমার ক্লাস বাকি আছে?
–হ্যাঁ, একটু বাদে যাবো আমি, তুই চলে যা।
সারা গায়ে যেন বিছুটির জ্বালা নিয়ে বেরিয়ে এল পঞ্চি। সমস্ত শরীর রি রি করছে। একে-ই সে এত শ্রদ্ধা করেছে এতকাল, এত ভক্তি! অথচ, ঠাণ্ডা নিস্পৃহ গলায় একটি কলেজে পড়ুয়া মেয়েকে এতটা অপমান করতে সাহস পায় ও। এত অহংকার। কিন্তু এ রাগ আর ক’দিনের? মাস দুই বাদে কৌশিকের লেখা ‘অতলান্তিক’ উপন্যাসখানা যখন দাদা এনে ওর হাতে দিয়ে বললো—এই নে, ছেলেটার চরিত্রই ওইরকম, আসলে খুব খারাপ নয়রে। দ্যাখ, নতুন বইখানা তোকে এক কপি নিজের হাতে লিখে দিয়েছে। বলল, পেন ফেরত পেয়ে খাওয়াতে পারি নি, বই দিয়েই তার শোধই না হয় দিলাম। পাতা খুলে পুলিন দেখালো আশ্চর্য ভালো হাতের অক্ষরে লেখা কয়েকটি শব্দ—‘পঞ্চি বন্দ্যোপাধ্যায়—সুচরিতাষু’—কৌশিক, তারপর তারিখ।
আর কি বলেছে জানিস, পড়ে কেমন লাগল জানালে ও খুব খুশী হবে, ঠিকানা রয়েছে ভূমিকার তলায়—পঞ্চি কোন কথা খুঁজে না পেয়ে হাসলো। কিন্তু আশ্চর্য, বইটা পড়ে মতামত জানাতে গিয়ে ওর কথা আর ফুরুতে চাইলো না। মুখের কথার শোভাযাত্রা মস্ত প্যাডের পাঁচ পাতা ছাড়াবার পর যেন সচেতন হয়ে লজ্জা পেয়ে সাড়ে পাঁচে শেষ করলো চিঠি। তবু কি মন ভরে? আরো দশ লাইন বাড়ল পুনশ্চর তলায়। তবু কি খুঁতখুঁত পঞ্চির, বইটার উপহার-পত্রে কৌশিকের সংক্ষিপ্ত চারটে শব্দে যেন এর চেয়ে অনেক বেশী কিছু বলেছে কৌশিক।
যেন সে চারটে শব্দের ফুলে আকাশ-ভরা রৌদ্র এসে ভালোবাসার শিশির-ফোঁটায় সপ্ত রঙের ইন্দ্রধনু জ্বালিয়ে দিয়েছে। মস্ত একটা উপন্যাসের কাহিনী বুঝি লুকিয়ে আছে সেই চারটে শব্দের চতুষ্কোণে। সে শব্দ চারটের কাছে যেন পঞ্চির এই ছ’ পাতার চিঠিখানা হেরে গেছে, তুচ্ছ হয়ে গেছে!
তারপর অনেক ঢেউ ভাঙলো ওর মনের শ্যামতটে, অনেক সময় ওর ছোট্ট লেডিজ ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায়। সে কাঁটার দিকে যখন একদিন নজর পড়ল ওর, তখন আর ফেরবার পথ নেই। আর বেশী এগোলে কাঁটাটা বুঝি রক্তাক্ত করে ফেলবে ওর হৃৎপিণ্ড, অনিবার্য-ভাবে কোন এক অবাঞ্ছিত অনাহূতের ইঙ্গিত জানাবে ওর ছোট্ট শুচিমুখের অগ্রগতিতে।
তাই টইটম্বুর রঙখুশীর মন দিয়ে একদিন ওরা দু’জন সন্ধির স্বাক্ষর রাখল ম্যারেজ রেজিস্টারের কোর্টে। পদবী বদলালো পঞ্চি। বাবা মারা গিয়েছিলেন ইতিমধ্যে, দাদা মাকেও রাজী করাতে পেরেছিলেন। কৌশিকদের বাড়িতে সেদিন নিটোল একটি অনুষ্ঠানে হেসে হেসে সবাইকে খুশীটুশী করে পঞ্চি গুহঠাকুরতা যখন অনুষ্ঠান শেষে খোঁজ করল স্বামীকে, তখন চমকে দেখতে পেল ও, কৌশিক ওর বৌদির ঘরে বৌদির খাটে শুয়েই ঘুমুচ্ছে। স্বামীর নিস্পৃহ উদাসীনতায় হিংস্র হয়ে ওঠে পঞ্চির মন। ধীর পায়ে এগিয়ে ও নাড়া দেয় কৌশিককে।
অ্যাই, শুনছ—থাক না ভাই, ঘুমুচ্ছে ঘুমুক না –শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বললেন বৌদি। কৌশিকের বিধবা বৌদি। যার স্বামী গত যুদ্ধে মারা গেলেন আরাকানে। বিয়ের মাত্র দু’বছর বাদে। মুখ ঘুরিয়ে তীক্ষ্ণ চোখে বৌদির দিকে তাকালো পঞ্চি। দরজা ধরে শ্বেতশুভ্র পোশাকে দাঁড়িয়ে বৌদি। কিন্তু সে চোখের দিকে তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নিলে ও। উঃ, কি আশ্চর্য সৌন্দর্য, কি অসম্ভব রূপ। কমনীয় নয়, হিংস্র, দ্যুতিময় সম্মোহনী। সাক্ষাৎ কিরণময়ী বুঝি।
পিঠে হাত পড়ায় চমকে ওঠে পঞ্চি। যেন ঠাণ্ডা একটা সাপ। ধীর গলায় বললেন বৌদি—চলো, তোমার ঘরে গিয়ে ঘুমুই আমরা—
প্রতিবাদ নয়, প্রতিরোধ নয়; অজস্র সজ্জায় অনিন্দিতা নববধূ পঞ্চি নিশি-পাওয়ার মতো ধীর পায়ে বেরিয়ে এল ঘর থেকে। পেছনে বৌদি, উদ্যত ফণা—পদ্মনাগ।
অনেক চেষ্টা করেছিল পঞ্চি। অনেক। কিন্তু হেরে গেল, পারল না। কিছুতেই পারল না কৌশিককে সে মাকড়সার জাল থেকে ছিঁড়ে নিয়ে আসতে। অসহায়, বড় অসহায় কৌশিক। আর পঞ্চি? ভগ্নপক্ষ জটায়ু। পরাজিত। আশ্চর্য বৌদির ক্ষমতা। বার বার চেষ্টাতেও হেরে গিয়ে পঞ্চি অধৈর্য হয়ে উঠতে লাগল। কৌশিককে বাজী ধরে যেন আসলে ওর আর বৌদির মধ্যে পাঞ্জা চলছে। দ্বন্দ্ব। গোপন সংগ্রাম।
ব্যর্থমনোরথ হয়ে পঞ্চি এবার নিজের ওপর প্রতিশোধ নিতে শুরু করল। ভাবল যদি এ আঘাতে বিচলিত হয় কৌশিক। দেখাই যাক; ফিল্মের ব্যাপারে ঘোরাঘুরি শুরু করল ও। মাড়োয়ারী প্রযোজকের কথায় রাতে তার সঙ্গে দেখা করতে রাজী হল ও। ডিরেক্টরের গাড়িতে হাওয়া খেতে যাওয়ার নেমন্তন্নে এতটুকু আপত্তি জানালো না। সজ্জায় কতটা মার্কিনী হওয়া যায় তার প্রচেষ্টা চললো, খাওয়ায় কতটা বেনিয়ম সহ্য হয় তার কসরতও।
বলা বাহুল্য, চান্স জুটল ঠিকই। সিনেমা্র কয়েকটি পত্রিকা উল্লেখ করতে ভুলল না যে, হালের নামী সিনেমা স্টার কাজলী দেবীর আসল নাম পঞ্চি গুহঠাকুরতা, তিনি এক সম্ভ্রান্ত বংশেরই বধূ, ব্যক্তিগত জীবনে সুলেখক কৌশিক গুহঠাকুরতার স্ত্রী।
কিন্তু না, কৌশিক নির্বিকার। বৌদিও। যেন কিছু নয় এ-সব, সব তুচ্ছতাচ্ছিল্যের ব্যাপার। রাতে না ফিরলেও কেউ কিছু শুধোত না। শুধু হ্যাঁ, শুধু কৌশিকের অন্ধ মা বিড়বিড় করতেন কি সব, তাকে ধমকে চুপ করিয়ে দিত কুন্তী। কৌশিকের বোন। হস্টেলে থেকে পড়াশুনা করত ও। ছুটিছাটায় এলে খুব জমাতো পঞ্চির সঙ্গে। ও বাড়ির একমাত্র মেয়ে, যাকে ভয়ানক ভালোবাসত পঞ্চি। সিনেমায় নামার পর শুধু একবার ছোট্ট চিঠিতে লিখেছিল কুন্তী—বৌদি কী শুরু করেছো বল তো? নিজেকে ওভাবে ধ্বংস করে কি লাভ?
কি লাভ? কেন, কি ক্ষতি? কৌশিক আর বৌদির নিস্পৃহতা যতো দেখতো, ততো উন্মত্তের মতো উচ্ছৃঙ্খলতার বন্যায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ত পঞ্চি। নিজেকে পন্যের মতো নিয়ে নিজেই লোফালুফি করতো।
হঠাৎ কোন একটা বাঙলা ছবির তালিম সংস্করণ করত গিয়ে আলাপ হল আয়ারের সঙ্গে। সহযোগী ব্যবস্থাপনায় ছিল রঙ্গস্বামী আয়ার। এ ছবিটার পরই পঞ্চি ওর সঙ্গেই ভেসে পড়ল। মাদ্রাজ বোম্বাই ঘুরল। কত জায়গা। সারা ভারতবর্ষে ঘুরে বেড়ায় এখন ও । হারাতে পারে নি ওদের, হারাতে পারে নি কৌশিককে, বৌদিকে। তাই সে নিজেই পালিয়ে চলে এলো ওদের সেই চক্রজাল থেকে।
পরাজয় মেনে বসে থাকার চেয়ে পলায়ন ঢের ভালো। নিজেকে নিঃশেষে ফুরিয়ে দেওয়ার চাইতে ঢের ভালো কানা-লন্ঠনের আলোই। সূর্যের আলো না পেয়ে সূর্য তপস্যার পক্ষপাতী নয় পঞ্চি, তাই কানা লণ্ঠনের মরা আলোতেই পথে বেরিয়ে পড়ল ও। চুকিয়ে দিল পেছনের যত গ্লানিময় দেনা, যতো ব্যর্থ আক্রোশের স্মৃতি।
কিন্তু সব চুকলো কি? তবে কেন আজও ইচ্ছে হয় কৌশিকের খবর জানবার? কে জানে?..
ওমা বৌদির কাণ্ড দ্যাখো, বইটা নিয়ে বসে আছে। কি ভাবছ অতো, অ্যাঁ?—চমক ভাঙলো পঞ্চির। কুন্তী এসে দাঁড়িয়েছে কখন।
না, কিছু না—বলে পঞ্চি। তারপর রান্নাঘরের পাট চুকল? হ্যাঁ ভাই, উঃ বাঁচা গেল। ওদিকে তোমাদের পেট তো ক্ষিধেয় চোঁচোঁ করছে, তাই না?—
না—না—লজ্জিত হাসি হাসল পঞ্চি!
–ওদিকে দ্যাখো, দু’টি মানুষের বকার রকমটা দ্যাখো। বাব্বা, আমার লোকটি জানো, এক নম্বরের বাচাল। এখানে যখন আমার
সঙ্গে কথা বলে বলে অতিষ্ঠ করা শেষ হয়, তখন উনি ওই ‘টাইগার’, ওই কুকুরটার কথা বলছি গো, তার সঙ্গে যাবতীয় রাজনীতি সমাজনীতি সবরকম কথা শুরু করবেন, সে যদি দ্যাখো তুমি—হেসে লুটিয়ে পড়ল কুন্তী, অনর্গল খুশীর ফোয়ারা।
আনন্দ। আনন্দ? এত খুশী কুন্তী? এত দাম্পত্য মাধুর্য। মনের মধ্যে একটা নিষ্ঠুর আকাঙ্ক্ষা ফণা দোলায় পঞ্চির। অসহ্য। ঘর তো সেও চেয়েছিল, একমুঠো একটা ঘর-ই। কেন তা হল না, কেন ভেঙে গেল সে স্বপ্ন? কোন ঝড়ে, কার জন্যে? কে দায়ী? আজকের যাযাবরী জীবন তো তার মুখোশ মাত্র, মুখশ্রী নয়।
কাংড়া, যা বাবুদের ডাক তো এবার, টেবিল ঠিক করেছিস, বেশ। ডাক বাবুদের, বল রাত আরো কিছুটা কাটাতে পারলে ডিনার নয়, একেবারে ব্রেকফাস্টই হয়ে যাবে এ টেবিলে। যা ডেকে আন্ শীগগির—তারপর মুখ ঘুরিয়ে বলল কুন্তী,– এসো বৌদি।
খাওয়া চুকলো শেষ পর্যন্ত। পঞ্চিই বললো কুন্তীকে—এসো আমরা একসঙ্গে শুই, বেটা ছেলেদের ও-ঘরে দাও, রাত্তিরভর ওরা বকে মরুক।–
সেই ভালো—বললো কুন্তী।
শুয়ে শুয়ে উসখুস করে পঞ্চি। তারপর যেন এমনিতে আচমকা প্রশ্ন করে বসল—তোমার দাদা এখন কোথায় কুন্তী?
–কেন জানো না, গরমের ছুটিতে হঠাৎ হাতের ওই গণপতি সিংহ প্রাইজের টাকাটা পড়ে যাওয়ায় দাদা দার্জিলিং গেছে—পরশু দাদা আর বড় বৌদির লম্বা চিঠি পেলাম। খুব মজাতে আছে। খুব নামজাদা হোটেলে উঠেছে—কি নাম যেন, দাঁড়াও বলছি—
হোটেলের নামটা স্মরণ করার চেষ্টা করে কুন্তী।
থাক্—অস্বাভাবিক কটুকণ্ঠে বলে উঠল পঞ্চি। আবার সেই বৌদি? সেই হিংস্র মাকড়সাটার জালের পাকে পাকে এখনও ঘুরে মরছে মাছিটা। কৌশিক। উঃ নিদারুণ পরাজয়। এতো দেশ ঘুরলো, এত ছবি করলো, কতো ছেলের দল, কতো প্রযোজক, কাহিনাকার, টেকনিশিয়ান, কতো যুবরাজ, নবাবনন্দনের দল পায়ের কাছে এতটুকু স্থান পাওয়ার জন্যে ধনমনপ্রাণ উৎসর্গ করতে বসেছিল, অথচ কৌশিককে কিছুতেই ও টেনে আনতে পারলো না বৌদির নিষ্ঠুর থাবা থেকে। এ লজ্জা লুকোবার মুখ কোথায় ওর?
হঠাৎ মনে হল পঞ্চির, কুন্তীর কথায় ও-রকম রূঢ়ভাবে বাধা দেওয়া ঠিক হয় নি। একটু ম্লান হেসে বলল ও—কিছু মনে করো না ভাই, থাক তোমার দাদার কথা। এবার তোমার কথাই শুনি। বলো কি করে অমন রাঙা বরটাকে যোগাড় করলে—
বারে, বৌদির খালি ঠাট্টা—কুন্তীর লজ্জিত কণ্ঠে মধুরতা ঝরে।
–ঠাট্টা কি, বলোই না শুনি, রোমান্সের কথা তো এখনও খুব রোমাঞ্চকর লাগে আমার—
— ছাই রোমান্স। রাঁচীতে সেই যে এসেছিলাম বন্ধুদের নিয়ে, তখনই ওঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল, আমার বন্ধু শীলার দাদা ও।
— চলুক, বলো না, বেশ তো বলছ—
–কি আর বলব। শীলা একদিন বলল—দাদা তো কোডার্মা রিজার্ভ ফরেস্টের ফরেস্টার। চল্ বাঘের জল খাওয়া দেখবি?
জ্যোৎস্না রাত্তিরে কি চমৎকার দেখায় যে, কি বলব তোকে।– শুনে প্রথমে তে আমি ভয়েই অস্থির। দরকার নেই বাঘ দেখার। জল খাওয়া, তারপর, যখন আমাদের খেতে আসবে। শুনে ও হেসেই আকুল।– কি যে বলিস তুই, যেরকম ব্যবস্থা, বাঘের বাবারও সাধ্য নেই আমাদের কিছু করে। চল—তারপর আমরা কয়েকজন এলাম ঠিকই, বাঘ দেখলামও রাত্তিরে—
–কিন্তু সে বাঘ না ধরলেও আরেক বাঘের খপ্পরে পড়ে গেলে শেষ পর্যন্ত, এই তো—পঞ্চি হেসে ওঠে।
যা বলেছো—হাসে কুন্তীও। তৃপ্তির হাসি। সব-পাওয়ার আনন্দ।
তারপর ক’দিন হল তোমাদের বিয়ের?
–মাত্র দেড় বছর—
–কোন আগন্ত্তক?
খুব চাপা গলায় বললে কুন্তী, আসছে।
–তাই নাকি?—প্রায় উচ্চকণ্ঠে চেঁচিয়ে ওঠে পঞ্চি।
–যাও। তুমি যেন কি বৌদি—কুন্তী পঞ্চির বুকে মুখ লুকোল। লজ্জার এত মাধুর্যের খবর রাখত না পঞ্চি, সে অবাক হয়ে গেল। প্রেম এত সুন্দর? মাতৃত্ব এমন রোমঞ্চকর?…
–ক’মাস?
–চার—তারপর খানিকটা চুপ করে থেকে বলল কুন্তী—জানো মানুষটা এ খবর পেয়ে কি যে করবে ভেবে পাচ্ছে না। বাপ হওয়ার আনন্দ কতো, যেন পৃথিবী জয় করেছে। দুধ, মাখন, ফল, মাছ-মাংস, ওষুধপথ্যি, এখন থেকেই যা শুরু করেছে না, তুমি হলে পাগল হয়ে যেতে বৌদি। নামজাদা ডাক্তার থেকে নার্স সমস্ত ব্যবস্থা একেবারে পাকা। এমন হৈ-হুজ্জোত করে না বৌদি, যে আমার লজ্জা করে,– আবেশ-বিহ্বল কণ্ঠ কুন্তীর। নিস্তব্ধতার প্রতিটি মুহূর্তকে সে যেন সম্ভোগ করছে। উঃ এত তৃপ্তি, এত সুখানুভূতি?
.. অসহ্য, অসহ্য লাগে পঞ্চির। এ ও কিছুতেই হতে দেবে না। প্রতিশোধ, হ্যাঁ, প্রতিশোধই নেবে সে, নির্মম প্রতিশোধ। কিন্তু কুন্তী তো কোন দোষ করে নি ওর কাছে, কুন্তী তো তার শত্রুপক্ষ নয়? না হোক,– ভাবল পঞ্চি,– তবু এত নিটোল জীবন সে কিছুতেই বরদাস্ত করবে না।
কেন, সেও কি কৌশিকের বৌদির কাছে কোন অপরাধ করেছিল, তবে তার জীবনকে এভাবে চূর্ণ করে দিলো কেন সে? কেন? কৌশিকের কাছে, তাঁর বৌদির কাছে হেরে গেছে ও। আজ না হয় কুন্তীকে হারিয়ে দিয়েই সে তার শোধ নেবে। বন্দুকের গুলীতে উড়ন্ত ঝাঁকের প্রথম পাখিটা না পড়ুক, শেষেরটা পড়লেই সে খুশী। অসম্ভব রাগ হয় তাঁর, নিদারূণ ঘৃনা জাগে কৌশিকের ওপর। কেন কৌশিক তাকে বিয়ে করেছিল? সেও কি বৌদির
ইচ্ছেতেই, হাতের মুঠোয় এনে একটা মেয়েকে হারিয়ে দেবার উল্লাসে বৌদিই কি এই নাটকের যবনিকা তোলার নিশানা দেখিয়েছিলেন? নাগিনী?..
জলের কুঁজোটা কোন দিকে ভাই,– পঞ্চি শুধোল। গলাটা কেমন শুকনো শুকনো হয়ে উঠেছে।
দাঁড়াও দিচ্ছি আমি—কুন্তী ওঠবার উপক্রম করে।
–না –দু’হাতে ওকে জোর করে শুইয়ে দেয় পঞ্চি—তুমি বলে দাও, আমিই নিয়ে নিচ্ছি—
–ওই যে বারান্দার কোণে, ওই দিকে—
বারান্দায় বেরিয়ে এল পঞ্চি। কাঠের জাফরি কাটা বারান্দা।
জাফরির ফাঁক দিয়ে অজস্র জ্যোৎস্না এসে বাঘবন্দীর ছকের মতো লুটিয়ে পড়েছে। মৃদু বাতাস এসে জুড়িয়ে দেয় ওর উত্তপ্ত শরীর। বুনো লতাপাতার মিশেল হাওয়ায় কেমন এক নেশা ধরানোর গন্ধ। অনেকক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে পঞ্চি। নিশ্চুপ। আঃ, কি মিষ্টি হাওয়া। হঠাৎ চুরুটের গন্ধ এল নাকে। এত রাতে চুরুট খাচ্ছে কে। চমকে তাকালো ও, বারান্দাটা দিয়ে বাংলোর সামনেটা দেখা যাচ্ছে বেশ। সেখানে কয়েকটা ডেক চেয়ার ছড়ানো ইতস্তত। আর রেলিং-এ ভর দিয়ে যে দাঁড়িয়ে আছে, জ্যোৎস্নায় স্পষ্ট বোঝা গেল সে পরিতোষ। ফরেস্টার পরিতোষ চ্যাটার্জি; কুন্তীর স্বামী।
হঠাৎ দপ্ করে জ্বলে ওঠে পঞ্চির মাথা। হিংস্র প্রতিশোধাতুর মনটা ফণা দুলিয়ে ওঠে আহত কালকেউটের মতো। এই তো, এই তো, কি? সুযোগ?..না, পরিতোষ ওকে দেখে নি? ওর চোখ বাইরে, বন-জ্যোৎস্নার রূপ দু’চোখ ভরে পান করছে ও, পান করছে আরণ্যক নির্জনতায়। ঘরে ঢুকে পা টিপে টিপে দেখল পঞ্চি, কুন্তী ঘুমিয়ে পড়েছে। ওর সুখসুপ্তির আয়েশী শ্বাসপ্রশ্বাসের ভারি শব্দ শোনা যাচ্ছে স্পষ্ট। পা টিপে খুট করে দরজাটা খুলে বেরিয়ে আসে ও।
পেছনে খাটটা যেন নড়ে উঠল একটু, কুন্তী কি তবে জেগে উঠেছে? রুদ্ধশ্বাসে খানিকক্ষণ দাঁড়ায় পঞ্চি, না, জাগে নি, ধীর সতর্ক পদেক্ষেপে ও এগিয়ে আসে সামনের বারান্দাটার দিকে। জানালা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখলো ও, আবার ঘুমিয়ে পড়েছে। বাঃ চমৎকার। মনে মনে নিজেকে শক্ত করে নেয় পঞ্চি। জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অভিনয় করতে চলেছে ও, তারেই চরম প্রস্ত্ততি সেরে নেয়। ভয় নেই, অভিনেত্রী কাজলী দেবী, ভয় পেয়ো না তুমি।.. ক্যামেরা, সাউণ্ড স্টার্ট..অলক্ষে পরিচালকের নির্দেশ শুনতে পেল যেন পঞ্চি। তারপর এগিয়ে এল আস্তে।
–ঘুম পাচ্ছে না আপনার?—পরিতোষের প্রায় গা ঘেঁষে দাঁড়ায় পঞ্চি।
সঙ্কুচিত লজ্জিত পরিতোষ চমকে ওঠে,– না, মানে বাইরে বেশ ঠাণ্ডা! কিন্তু আপনার কি হল?
–মাথাটা বড্ড ধরেছে,–বললো পঞ্চি,– মাঝে মাঝে মাথাটা আমার কেমন যেন করে ওঠে—
–ভালো নয়। শুনেছি স্টুডিওতে তীব্র লাইট আর গুমোট গরমের মধ্যে কাজ করতে হয়, হয়তো তাতেই হবে,– সমবেদনার ঠাণ্ডা গলা পরিতোষের।
না, এত নরম হয়ে এগোলে চলবে না।
বাবা, কি বিশ্রী করছে মাথাটা—রেলিংটা শক্ত করে চেপে ধরে পঞ্চি, সামনের দিকে ঠিক ততখানিই ঝুঁকে পড়ে ও, যতখানি ঝুঁকলে কাঁধের ওপর থেকে আঁচল খসে পড়তে পারে। আগুন আসুক চোখে, নেশা লাগুক মনে।
–তাহলে মিঃ আয়ারকে ডাকব, না হয় কুন্তীকে ডাকি—ব্যস্ত হয়ে ওঠে পরিতোষ।
না, না—অসহ্য যন্ত্রণাকাতরকণ্ঠে ধ্বানিতে হল পঞ্চির গলা—কাউকে ডাকতে হবে না, কাউকে না। আপনি একটু ধরবেন আমাকে, এক্ষুনি কেটে যাবে এ অবস্থা, শুধু—যেন টাল সামলাতে পারছে না পঞ্চি।
শশব্যস্ত হয়ে দু’হাতে পঞ্চির কাঁধ জড়িয়ে ধরে পরিতোষ, তারপর বললো—আপনি কোনরকমে আমার ওপর ভর দিয়ে আসুন, ওই ডেক চেয়ারটায় বসবেন চলুন—
তাই চলুন—নিবিড় হাতে পরিতোষের কোমর জড়িয়ে এগোতে চেষ্টা করে পঞ্চি। উষ্কখুষ্ক চুল পঞ্চির, কোমর থেকে ছড়ানো আঁচলটা লুটোচ্ছে মাটিতে। খানিকটা এসে আচমকা পঞ্চির-হ্যাঁচকা জোরালো একটা টানে পরিতোষ টাল সামলাতে পারল না। কাঠের মেঝেতে হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ত্রস্তে বাঁ হাতের ধারালো রুলিটা নিজেরই গালে ঘষে দিল পঞ্চি যেন ছাড়িয়ে নেবার চেষ্টাতেই ওর গাল কেটে গেছে। আকস্মিক ঘটনাগুলোয় কেমন ঝিম মেরে যায় পরিতোষ। তারপর নিজেকে ছাড়াবার জন্যে ও ধস্তাধস্তি শুরুকরে দেয় পঞ্চির সঙ্গে। আর সুযোগ বুঝে হঠাৎ তীব্র আর্তকণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলো পঞ্চি,– ছাড়ুন, ছাড়ুন বলছি। জানোয়ার, স্কাউণ্ডেল—পরিতোষ হক্চকিয়ে ততক্ষণে উঠে দাঁড়িয়েছে।
–আপনি এত নীচ, এত ইতর পরিতোষবাবু—অসংবৃত বেশবাস গুছোবার আয়োজন করে পঞ্চি। ওর চিৎকারে আয়ার এসে দাঁড়িয়েছে দরজায় কুন্তীও আলথাল পোশাকে দৌড়ে এসে দাঁড়ালো। কিংকর্তব্যবিমূঢ় পরিতোষ।
আঃ এই তো চাই, মনে মনে ভাবল পঞ্চি, সফল, সফল প্রয়াস। লুটনো আঁচলটা কাঁধে তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করে পঞ্চি, য্নে ধর্ষিতা কোন শ্রান্তা মেয়ে।
আয়ার একেবারে নিশ্চুপ। ওর নির্বোধে চোখ ভাষাহীন আর আগুনের স্ফুলিঙ্গ জ্বলছে কুন্তীর চোখে। একবার ওর জ্বলন্ত চোখের দিকে তাকালো পঞ্চি, তারপর আঁচল দিয়ে গালের কাটা দাগটার ওপর বুলিয়ে নিয়ে দেখতে লাগল রক্তের লালিমাসিক্ত সাদা আঁচলটার চেহারা। সবচেয়ে অদ্ভুত দেখাচ্ছে পরিতোষকে। লম্বা জোয়ান একটা পুরুষমানুষের চোখে এত ভয়, এত বিস্ময় বুঝি আর কখনো ভাবাও যায় না। মৃত চোখ। কঠিন মুখ। কয়েকটি নিরুদ্বিগ্ন মুহূর্ত।
তারপর হঠাৎ শান্ত অথচ চাপা কণ্ঠে খুব আস্তে আস্তে বলল কুন্তী—চমৎকার অভিনয় করলে বৌদি। তোমার সমস্তটুকু অভিনয় আমি জল খেতে উঠে ও-বারান্দায় ‘বক্সে দাঁড়িয়েই দেখেছি। দরজা খুলে বেরুবার সময়ই ঘুম ভেঙেছিল আমার। যাক্—তারপর কি ভেবে ঘরে ঢুকে মুহূর্তেই বেরিয়ে এলো। হাতে একটা শিশি। বর্তমান নাটকের সবচেয়ে মহিমময়ী চরিত্র যেন কুন্তী, ঋঝু, সংযমী, কঠোর। শিশিটা সামনের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল কুন্তী,
— পুরুষমানুষের দাঁতের দাগে মেয়েদের কোন ক্ষতি হয় না বৌদি, কিন্তু চুড়ির আঁচড়ের কাটা তো, টিটেনাস হতেই বা কতক্ষণ, নাও টিংচার আইডিনটা লাগিয়ে নিও—তারপর স্থবির অনড় পরিতোষকে শক্ত হাতে ধরে টেনে নিয়ে ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলল—বারান্দায় চেয়ারে বসে একটু জিরিয়ে নাও বৌদি, স্টোভ ধরিয়ে এক্ষুনি আমি তোমাকে এক কাপ চা পাঠিয়ে দিচ্ছি।
–কি দাঁড়িয়ে আছো হাঁ করে, ইডিয়ট,– ঠাস করে আয়ারের গালে একটা চড় বসিয়ে দিল পঞ্চি। তারপর প্রচণ্ড জোরে টিংচার আইডিনের শিশিটা বারান্দা থেকে ছুঁড়ে ফেলে দিল বাইরে। বাগানের লোহার জালি জালি রেলিংটায় লেগে তীব্র কাঁচ-ভাঙা আওয়াজে ভেঙে চুরমার হয়ে গেলো শিশিটা।
[ পটের বিবি- শচীন ভৌমিক [ প্রিয় গল্প সংগ্রহ ] Poter Bibi-Sachin Bhowmick ]
শচীন ভৌমিক কে আরও পড়ুন:
- ফর অ্যাডাল্টস ওন্লি – শচীন ভৌমিক (ভূমিকা) [ Sachin Bhowmick – For Adults Only ]
- কৌতুকী সংগ্রহ– শচীন ভৌমিক
- রুস্তমচাচা– শচীন ভৌমিক
- বেঞ্জী সাহেব– শচীন ভৌমিক
- পটের বিবি– শচীন ভৌমিক
- কর্নেল ব্রাগাঞ্জা– শচীন ভৌমিক
- ঝিনুক– শচীন ভৌমিক
- একটি আটপৌরে গল্প– শচীন ভৌমিক
- উর্দু শের– শচীন ভৌমিক
- গুজব– শচীন ভৌমিক
- পটের বিবি থেকে POT এর বিবি– শচীন ভৌমিক
- এনার্জি– শচীন ভৌমিক
- সফর সংকীর্তন– শচীন ভৌমিক
- কাগজ – শচীন ভৌমিক
- কুড়েমি – শচীন ভৌমিক
- স্ট্রিকিং– শচীন ভৌমিক
- বচন ফকিরের কল্কে – শচীন ভৌমিক
- একটি ডেড্ লেটারের ইতিহাস – শচীন ভৌমিক