ফোন সাইলেন্ট করে মিটিং এ ঢুকেছি। বেরিয়েই দেখি জননীর একাধিক মিসড্ কল। পৃথিবীর অন্য সকল জননী আর স্ত্রীর মতো, আমার ওনারাও ভাবেন, আমি ইচ্ছে করে কল মিস করি। তাই কল ব্যাক করার পরে, সময়মত ফোন না ধরার তিরস্কার শেষ করে, লাঞ্চের খবর নিলেন। এর পরে বললেন, তিনি এক ছেলেকে আমার কাছে পাঠিয়েছেন। ছেলেটাকে যেভাবেই হোক একটি চাকরির ব্যবস্থা যেন করে দেয়া হয়। ছেলেটির পরিবার আমাদের পরিচিত, তাকে খুব ধরছে, চাকরির খুব দরকার ইত্যাদি… ইত্যাদি…
অফিসে ঢুকতেই আমার সহকারী জানালেন চাকুরী প্রার্থীকে আমার রুমে বসানো হয়েছে। তিনি ইতোমধ্যে আমি কত বেতন পাই, গাড়ি-বাড়ি সুযোগ সুবিধা কি কি পাই, ইত্যাদি বিষয়ে একটা সার্ভে করে ফেলেছে। সাথে আমার সহকারীর বেতন, দেশের বাড়ি সহ বিভিন্ন প্রশ্নও তিনি করেছেন। এই টাইপ আচরণগুলো আমি লক্ষ্য করি এবং তার উপরে আমার দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয় বলে, আমি রুমে পৌঁছাবার আগেই সহকারী আমাকে জানিয়ে দিল।
রুমে ঢোকার মুখে দেখলাম আমার টেবিলের উপরে – ব্যাগ, ফাইল এবং মোবাইল ফোন রেখে, চেয়ারে বসে পা দোলাচ্ছে বেশ রংচংগা কাপড় পরা এক তরুণ। আমি ঢুকতেই ধচমচ করে উঠে দাড়িয়ে সালাম। এক নি:শ্বাসে তার পারিবারিক পরিচয় দিয়ে ফেলল। আমার পরিবারের সাথে তারা কতদিন থেকে যুক্ত তারও একটা ফিরিস্তি শুনলাম। তার বক্তব্য শেখ হবার পরে, ধিরে সুস্থ্যে আমি দু চারটা প্রশ্ন করলাম।
আমার কাছে তার সব আলোচনার সামারি যা দাঁড়ালো, তা হল – সে সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিগ্রি শেষ করেছে এবং একটি চাকুরীর জন্য সম্পূর্ণ প্রস্তুত। তার চাকরিটি খুবই দরকার। তাই এর জন্য আর কোন অপেক্ষা করা সম্ভব নয়। গত কাল এপোয়েন্টমেন্ট লেটার পেলে ভাল হত।
কথা বলতে গিয়ে লক্ষ করলাম- সে ভাষায় আমাদের এলাকার আঞ্চলিকতা কাটাতে না পারলেও, ঢাকার স্থানীয় কিছু মুদ্রা দোষ শ্রদ্ধার সাথে রপ্ত করেছে। আমি সব কথা বাংলায় বললেও সে ভুলভাল ইংরেজিতে আমাকে মুগ্ধ করার খুব চেষ্টা করছে।
এরপর ঠুক ঠাক একাডেমিক প্রশ্ন করে নিরুৎসাহিত হয়ে এক পর্যায়ে সিভি দেখতে চাইলাম। সিভির শুরুতে তার কন্টাক্টে অদ্ভুত নামের (স্বপ্নবিলাসী টাইপ) একটি ইমেইল এড্রেসে নজর আটকে গেল। সেই ইমেইল ঠিকানার সাথে তার নামের কোন সম্পর্ক নেই। সিভির তথ্য অনুযায়ী দু চারটা প্রশ্ন করতেই বোঝা গেল পুরো সিভিটি কপি পেস্ট।
আমার রুমের পাশে একটি গেস্ট টার্মিনাল ছিল। সেখানে তাকে বসিয়ে দিলাম। একটা চিরকুটে কিছু প্রশ্ন লিখে দিলাম। যতদূর মনে পড়ে প্রশ্নগুলো ছিল:
• তুমি নিজেকে ১০ বাক্যের মধ্যে কিভাবে নিজেকে পরিচয় করাতে চাও?
• তুমি কি ধরনের কাজ চাও? তোমার সেই প্রত্যাশিত কাজ পাবার জন্য কি কি যোগ্যতা দরকার বলে তুমি মনে করো? সেই যোগ্যতার কোনগুলো তোমার আছে, আর কোনগুলো নেই? দিনে কয় ঘণ্টায় তুমি সেই কাজ কি পরিমাণ করতে পারবে? সেই কাজের জন্য তুমি মাসে কত টাকা বেতন প্রত্যাশা করো? সেই কাজে সফল এরকম ৩ জন মানুষ, যারা তোমাকে চেনেন, তাদের যোগাযোগের নম্বর সহ লেখো।
• তোমার ৫ টি বিশেষ যোগ্যতা যে কারণে তুমি গর্ব করো।
• তোমার ৫ টি অযোগ্যতা যেটা তুমি কাটিয়ে উঠতে চাও।
• তোমার স্বপ্নের মত সফল দুজন মানুষের নাম এবং পরিচয় লেখ।
• বর্তমান যে কাজ চাচ্ছ সেটার সাথে তাল রেখে আগামী ৫ বছর পরে নিজেকে কোথায় দেখতে চাও?
তাকে সময় দিলাম ২ ঘণ্টা। এর মধ্যে সে – এগুলোর উত্তর লিখে, নিজের সিভি ও ছবি যুক্ত করে, আমার বরাবর ইমেইল করতে বললাম। এরপর আমার বরাবর একটি কাভার লেটার লিখে, সেই উত্তরগুলো প্রিন্ট করে সংযুক্ত করে, আমার সহকারীকে দেবে। এও বলে দিলাম- সে চাইলে উত্তরগুলো ইন্টারনেট থেকে কপি পেস্ট করতে পারবে। তবে সাবমিট করার পরে, আমার সামনে বসে, ওই উত্তরগুলোই বুঝিয়ে দিতে হবে। তাকে চা/কফি দিতে বলে, সহকারীকে নজর রাখতে বলে, অন্য কাজে চলে গেলাম।
দুঘণ্টা পরে তাকে রুমে ডেকে নিলাম। প্রথমে চেক করলাম ইমেইলটি। খোঁজা খুঁজি করে তার ইমেইল পেলাম জাঙ্ক বক্সে। কারণ সাবজেক্ট এবং বডি টেক্সট ছাড়া ইমেইল পাঠিয়েছে! সব কিছুই এটাচ করা (কাভার )! তার নিজের ইমেইলে নামের যায়গাও ফুল-পাখি টাইপ! প্রিন্ট করা চিঠিটিও তথৈবচ।
তার ইমেইল এবং হার্ড কপি চিঠি বিষয়ে আলাপ করা অর্থহীন। আউটপুটের সামারি হচ্ছে – সে তার নিজের পরিচয় দিতে পারে না। কি জানে সেটা বলে/লিখে বোঝাবার ক্ষমতা নেই। কি কাজ চায় সেটাও স্পষ্ট জানে না। তার প্রার্থিত কাজের যোগ্যতা-অযোগ্যতা বিষয়ে জানা নেই। তার যোগ্যতা অনুযায়ী কি কাজ বা কত বেতন হওয়া উচিৎ সেটাও জানে না। সব কিছুর একই উত্তর – আপনি যা ভাল বোঝেন, চাকরি পেলে আমি সব শিখে নিতে পারব, আমার খুব চাকরিটা দরকার।
আমি সেদিন তাকে কোন কাজ দিতে পারিনি। এর বদলে তাকে একটি তালিকা করে দিয়েছিলাম। কিছু বেসিক জিনিস শিখে নেবার তালিকা। যেটা শিখতে বড়জোর ৩ মাস সময় দরকার ছিল। কিন্তু দুঃখজনক ভাবে সেই প্রার্থী সেই রাস্তায় হাটেনি। বরং প্রতি মাসে আমাকে চাকরি দেবার জন্য অনুরোধ নিয়ে এসেছে। কখনও আমার মা কে, কখনও অন্য কোন আত্মীয়কে পারস্যু করতে চেয়েছে। মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে, বাড়ির ফল নিয়ে বা পুকুরের ইলিশ নিয়ে। পরিশ্রম সে কম করেনি। ফলাফল হলে- তার দু বছরের বেকারত্ব। এই দু বছর শেষে তার যোগ্যতা এবং প্রার্থনা একই ছিল। দুই বছর পরে একদিন তাকে বললাম – তুমি এত ফালতু শ্রম না দিয়ে যদি ৩ টি মাস আমার কথামত দিতে, তবে আজ তুমি অনেক আগেই একটা ভাল যায়গায় থাকতে।