চিত্রশিল্পী, নন্দনতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ ​অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিনে শ্রদ্ধা

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (৭ আগস্ট ১৮৭১ – ৫ ডিসেম্বর ১৯৫১) ছিলেন বাংলা ও ভারতীয় শিল্পকলার ইতিহাসে এক অনন্য প্রতিভা। বহুমাত্রিক সৃজনশীলতায় তিনি একদিকে চিত্রশিল্পী, অন্যদিকে নন্দনতাত্ত্বিক, সাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ হিসেবে সমান খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। বাংলা শিল্পকলাকে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরার অন্যতম কারিগর তিনি।

তিনি কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছিলেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাইপো এবং গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও সৌদামিনী দেবীর পুত্র।
শৈশবে সংস্কৃত কলেজে পড়াশোনা করেন এবং পরে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে ইংরেজি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। তবে তাঁর জীবনের প্রকৃত অনুরাগ ছিল শিল্পচর্চায়। ইউরোপীয় শিল্পীদের কাছ থেকে প্যাস্টেল ও তেলরঙের ব্যবহার শেখার মাধ্যমে তিনি নিজের শিল্পীজীবনের ভিত্তি গড়ে তোলেন।

অবনীন্দ্রনাথ ভারতীয় শিল্পকলাকে ইউরোপীয় প্রভাব থেকে মুক্ত করে স্বদেশি চেতনার ভিত্তিতে নতুন ধারার সূচনা করেন। তিনি মুঘল ও রাজপুত চিত্রশৈলীকে আধুনিক রূপ দিয়ে বঙ্গীয় শিল্পশৈলী (Bengal School of Art) প্রতিষ্ঠা করেন।

  • তাঁর সৃষ্ট ভারত মাতা’ (১৯০৫) ভারতীয় জাতীয়তাবাদের প্রতীক হয়ে ওঠে।
  • ‘The Passing of Shah Jahan’ (১৯০২)-এ মৃত্যুশয্যায় সম্রাট শাহজাহানের চোখে তাজমহলের প্রতি ভালোবাসা চিত্রিত হয়—যা ভারতীয় ঐতিহ্য, আবেগ ও আধুনিকতার অনন্য মেলবন্ধন।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলা শিশু ও কিশোর সাহিত্যে এক নতুন ধারা প্রবর্তন করেন। তাঁর রচিত—

  • খীরের পুতুল
  • বুড়ো আংলা
  • রাজকাহিনী

এসব গ্রন্থ কল্পনা, রূপকথা ও বাস্তবতার মিশ্রণে রচিত হওয়ায় বাংলা সাহিত্যে কালজয়ী হয়ে আছে। বিশেষ করে রাজকাহিনী গ্রন্থের গল্প আজও শিশু-কিশোরদের জাতীয়তাবাদ ও বীরত্বের শিক্ষা দেয়।

অবনীন্দ্রনাথ শুধু নিজে সৃষ্টি করেননি, বরং শিল্পশিক্ষায়ও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন।

  • নন্দলাল বসু, অসিত কুমার হালদার, সরদা উকিল প্রমুখ তাঁর ছাত্র হিসেবে ভারতীয় শিল্পকলায় অমর অবদান রেখেছেন।
  • ১৯৪২ সালে তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। সেখানে শিল্পশিক্ষার সঙ্গে স্বদেশি চেতনা মিশিয়ে নতুন শিক্ষাধারা চালু করেন।

অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবন ও কর্ম ভারতীয় শিল্প, সাহিত্য ও সংস্কৃতিতে এক অমলিন দৃষ্টান্ত। তিনি প্রমাণ করেছেন, শিল্পকলা কেবল নন্দনের প্রকাশ নয়, এটি জাতীয় চেতনা ও স্বাতন্ত্র্যের বাহকও হতে পারে। তাঁর হাতে জন্ম নেওয়া বঙ্গীয় শিল্পশৈলী শুধু ভারতেই নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাঙালি শিল্পীর আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা করেছে।

আজ তাঁর জন্মদিনে আমরা এই মহান শিল্পীকে গভীর শ্রদ্ধা জানাই। তাঁর সৃষ্টিশীলতা ও দৃষ্টিভঙ্গি আমাদেরকে এখনও অনুপ্রাণিত করে, এবং আগামী প্রজন্মের জন্য এক অমূল্য সম্পদ হয়ে থাকবে।