
জীবনে দু’একবার ভীষণ প্রেমে পড়েছি।
সেরকম এক প্রেমের সময়, সৈয়দ মুজতবা আলী দেখা দিয়েছিলেন আমার জীবনে, একদম নতুন করে। আমার প্রেয়সী আমাকে পড়তে দিলেন সৈয়দ সাহেবের প্রেমের উপন্যাস “শবনম”। ঠিক যেন গল্প বা উপন্যাস নয়, মনে হয় বিরাট প্রেমের কবিতা। আফগানিস্তানের অস্থির সময়ের প্রেক্ষাপটে লেখা। বরফ জমা শীতকালের গল্প বলে, প্রেয়সীও আমাকে খুব শীতের মধ্যেই পড়তে দিলেন।
বই তো প্রায় এক বসাতেই শেষ করলাম। কিন্তু পড়ার পরে দেখা দিল নতুন এক গভীর মধুর যন্ত্রণা। দিন যেমনই কাটুক, রাত হলেই কিভাবে যেন “মজনুন” হয়ে যেতাম। আশ্রয় নিতাম আফগানিস্তানের এক শিক্ষকের একাকী ঘরে। কখনো শবনমের অপেক্ষা, তার ভাবনা। আবার কখনো শবনম যেন এসেই পড়তো। আমার বোকাবোকা কথার পিঠে, পিঠ দিয়ে বসাতো তার দুর্দান্ত সব কবিতা। আলোচনা সেই এগিয়ে নিতো। সৈয়দ সাহেবের মতো আমারও জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে হতো- ‘তুমি বাস্তবে বাস করো না কাব্যলোকে?’ কখনও শবনম আমার পাশে, ক্যানভাস ফেলে আঁকতে বসে যেত। দুঁদে আঁকিয়ের মতো আঁকতো অসম্ভব সব ছবি। এতো কাছে, তবুও যেন তাকে পুরো ধরা-ছোঁয়া যেত না! শবনমের প্রায় সবই ভাবনার রাজ্যে এনে ফেলতাম, শুধুমাত্র ছোটবেলা থেকে ভয়ডর একটু কম থাকায়, তার প্রভাবশালী সর্দার বাপ আওরঙ্গজেব কখনো আসেননি 😉
প্রেয়সীকে নিয়ে আফগানিস্তান যাবার ইচ্ছে ছিল। ইচ্ছে ছিল সে আর আমি দুটি আলাদা জায়গায় থাকবো। মাঝে মধ্যে দেখা হবে অনেক অপেক্ষার পর। সেসব আর আসেনি। মাঝ থেকে বিরহ এসে গেল। বিরহের সময় শবনমের চলে যাবার সময়ের কথাটাই বারবার মনে হতো – ‘আমার বিরহে তুমি অভ্যস্ত হয়ে যেও না।’

যা হোক, মূল কথায় ফিরি।
গত ১৩ সেপ্টেম্বর সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মদিন ছিলো। খুব প্রিয় শিল্পীদের জন্মদিনে, তাঁদের কথা একটু ভেবে, খোরখাতায় দু লাইন লেখা, তার শিল্পকে একটু উল্টে পাল্টে দেখাটা আমার অনেক দিনের অভ্যাস। কিন্তু রাজনৈতিক ব্যস্ততা এমন এক ধরনের ব্যস্ততা, যেখানে জীবনের এসব চ্যাপ্টার যেন উল্টে পাল্টে দেয়। বিশেষকরে আমার মতো ৩০ বছরে, এক জীবন শেষ করে, নতুন করে আরেক জীবন শুরু করার মতো মানুষদের ঝাক্কিটা ডবল। গতকাল হঠাৎ তাঁর জন্মদিন উপলক্ষ্যে আমার এক বন্ধুর পাঠানো পুরোনো মেসেজ দেখে মনে পড়লো। লেখাটি শেয়ার করার লোভে উপরের সব হাবিজাবি লিখলাম। তার লেখাটি হুবহু তুলে দিলাম:
” সরস্বতী পূজার এক সকাল।
সৈয়দ মুজতবা আলী হাঁটতে গিয়েছেন গঙ্গার ঘাটে।
বেলা প্রায় দশটা। গৌরবর্ণ সৌম্য-কান্তি আলী সাহেবের কাছে হঠাৎ হাজির এক বৃদ্ধা। সঙ্গে তার ছোট্ট নাতনী।
বৃদ্ধা আলী সাহেবকে অনুরোধ করলেন-
‘বাবা আমার বাড়ির পূজাটা করে দাও। পুরোহিত এখনো আসেনি, আমি পুরুত খুঁজতে বেরিয়েছি। বাচ্চাটা না খেয়ে অঞ্জলি দেবে বলে বসে আছে।’

বৃদ্ধার অনুনয়ে, আরও বিশেষ করে বাচ্চাটার মুখের দিকে চেয়ে, আলী সাহেব বৃদ্ধার বাড়িতে গেলেন। বিশুদ্ধ সংস্কৃত মন্ত্রোচ্চারণে, যথাবিহিত পূজা পদ্ধতি মেনে, তিনি সরস্বতী পূজা করলেন। বাড়ির লোকও খুব খুশী। দক্ষিণা নিয়ে মুজতবা আলী সাহেব বিদায় নিলেন।
পরে মুজতবা আলী বলেছিলেন- জানিনা মাতা সরস্বতী এই বিধর্মীর পূজায় অসন্তুষ্ট হলেন কিনা! তবে আশা করি তিনি উপোষী বাচ্চাটির শুকনো মুখের দিকে চেয়ে এই অধমকে ক্ষমা করবেন।
আজ সৈয়দ মুজতবা আলীর জন্মদিন। জন্মদিনে সেই অমর কথাশিল্পীকে জানাই অন্তরের পরম শ্রদ্ধা। ”
বহু ভাষায় ও তুলনামূলক ধর্মতত্ত্বে পণ্ডিত, একজন পূর্ণ মানুষ, সৈয়দ মুজতবা আলীকে দেরিতে হলেও জন্মদিন উপলক্ষে স্মরণ করি।