গতকাল বণিক বার্তার প্রথম বর্ষপূর্তি অনুষ্ঠানে আমাদের বেছে দেয়া ১৬ টি কোম্পানির মধ্য থেকে ৩ টি কোম্পানি এ বছরের জন্য সম্মাননা পেল। খুব কম সময়ের মধ্যে আয়োজনটি ছিল ছিমছাম, সুন্দর। আমার ধারনা বনিক বার্তা কর্তৃপক্ষ এত স্বতঃস্ফূর্ত অতিথি অংশগ্রহণ আশা করেননি। সব মিলিয়ে আয়োজনটি ছিল চমৎকার। বাড়তি হিসেব ছিল প্রাচ্যনাটের মিউজিক্যাল শো, বন্ধুবর রাহুল আনন্দের বাঁশির মূর্ছনা। আমাদের অনেকগুলো উদ্যোক্তা আগামী বছরের নমিনেশনে চলে যাওয়া এবং আমাদের সহকর্মী টিম এঞ্জিনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সামিরা জুবেরি হিমিকা অনুপস্থিত থাকার কারণে একটু মন খারাপ ছিল। প্রার্থনা করি – আরও বড় হউন জাহিদুল ইসলাম, মাহাবুবুল মতিন ও শারফ ইমদাদ এর মতো উদ্যোক্তারা। আমারা যেন তাদের মত উদ্যোক্তাদের গড়ে ওঠার গল্প সুন্দর করতে পরি, বড় হবার গল্প ট্রাজেডি মুক্ত করতে পারি।
জমকালো আয়োজন, চমৎকার উপস্থাপন, ভারি প্রোফাইলের অতিথি, এওয়ার্ড প্রাপ্ত উদ্যোক্তাদের উচ্ছ্বাস, অতিথিদের মসৃণ বক্তব্য – সব মিলিয়ে যাকে বলে ‘পারফেক্ট’। .কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে একটি কথা আমার বারবার মনে হচ্ছিল ‘যে সকল উদ্যোক্তাকে ঘিরে আমাদের আজ এত আয়োজন এত উচ্ছ্বাস, তাদের শুরু থেকে বন্ধুর পথ পরিক্রমায় আমাদের রাষ্ট্রীয় কি অংশগ্রহণ ছিল, আর তাদেরকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় সহায়তার কি পরিকল্পনা ?’ । প্রশ্ন সহজ, কিন্তু উত্তর আমার অজানা।
যে সকল উদ্যোক্তা সম্মানিত হলেন তাদের সবাইকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি। নানা প্রতিকূলতার মধ্যে তারা আজ এমন একটি যায়গাতে পৌঁছেছেন যেখানে আমারা তাদেরকে এরকম একটি এওয়ার্ড ফাংশনে ডেকে নিজেরা গর্বিত হতে পারি। উদ্যোক্তারা এতে উৎসাহিত হবেন, এগিয়ে যাবার অনুপ্রেরণা পাবেন, নতুন রা উৎসাহিত হবে – সবই ঠিক। কিন্তু তার পরে কি? বণিক বার্তা যে উদ্দেশ্যে আয়োজনটি করেছে তা নাহয় সফল হল, কিন্তু অতিথি হিসেবে নীতি নির্ধারক মহলের যারা এসেছিলেন তারা কি ভাবনা নিয়ে গেলেন? কোন কর্তব্যের ডাক পেলেন তারা?
এ ধরনের উদ্যোক্তাদের গল্প মানে – শত প্রতিকূলটা পার হয়ে এ পর্যন্ত আসা সংগ্রামের একটি সুন্দর “গল্প”। শুনতে ভাল লাগে, অনুপ্রেরণা দেয়। শুরুতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পেলে হয়ত গল্পের ট্র্যাজিক দিকগুলো এত সুন্দর হতো না, তবে এ ধরনের আরও অসংখ্য সফলতার গল্প যে পাওয়া যেত সে বিষয়ে আমি নিশ্চিত। এবং পরবর্তী বাস্তবতা যা, তা হল – রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা ছাড়া একান্ত নিজস্ব প্রচেষ্টায় কিছু মানুষ হয়ত আসতে পারে, কিন্তু এর পরে বড় হতে গেলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া প্রায় অসম্ভব। সেটা করা সম্ভব না হলে আরেকটি গল্প তৈরি হয় – সেটা হল দ্রুত বেড়ে উঠতে উঠতে মাঝারি অবস্থায় থেমে যাবার ট্র্যাজিক গল্প। কিন্তু তো আমরা বাংলাদেশকে উদ্যোক্তা তৈরির ট্র্যাজিক গল্পের ফ্যাক্টরি বানাতে চাই না। ২০২১ বা ২০৩০ যাই বলুন, সবকিছুর সফলতার জন্য অসংখ্য উদ্যোক্তার সফলতার গল্প দরকার। কোটি সফলতার গল্প তৈরির চেষ্টার কিছু তো বিফল গল্প তৈরি হবেই, তবে তা যেন সফলতার গল্পকে ছাপিয়ে যেতে না পারে।
প্রকৃত চিত্রটি তুলে ধরতে চলুন কোন একজন উদ্যোক্তাকে বেছে নেই। চলুন যাই এসএসডিটেক এর মাহাবুবুল মতিন সাথে। কয়েকদিন আগে তার গ্যালারিতে বসে আড্ডা দেবার সময় পিছনের দিনগুলোতে ফিরে দেখার সুযোগ হয়েছিল।
চাকরি জীবনে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হিসেবে খুব ভাল টাকা মাইনে সহ অন্যান্য সুযোগ সুবিধা পেতেন উদ্যোক্তা মাহাবুবুল মতিন। স্বামী স্ত্রী দুজনেই কাজ করতেন। সব ঠিকঠাক চলছিল, দেখলে মনে হতো মজাতেই চলছিল। কিন্তু দিন সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরাধীনতার যন্ত্রণা ছিল নিয়মিত। তার প্রতিদিন কাজ শেষে নাকি মনে হতো “আমি প্রতিষ্ঠানকে অনেক দুরে নিয়ে যেতে পারতাম, যদি প্রতিষ্ঠানের নীতিনির্ধারকরা আর একটু সাহসী হতেন, একটু বড় স্বপ্নের অধিকারী হতেন”। একদিনের ঘটনা – সকাল বেলা দুজনেই কাজে বেরিয়েছেন । তিনি হঠাৎ স্ত্রীকে টেলিফোন করে জানালেন – চাকরি আর ভাল লাগছে না, তিনি নিজের উদ্যোগে নিজের ব্যবসা শুরু করতে চান, তার সমর্থন পাবেন কি না। স্ত্রী কিছুক্ষণ চুপচাপ থেকে জবাব দেন “শুধু সমর্থনই নয়, সবটুকু বিশ্বাস ও সহযোগিতা থাকবে”। সেই মুহূর্ত চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে সেদিন থেকেই শুরু। সেই পথ পরিক্রমা আমাদের দেশের আর সব সফল উদ্যোক্তাদের মতই বন্ধুর, জানা-বোঝা ভাল হবার কারণে কিছুক্ষেত্রে আরও বেশি কষ্টের।
উদ্যোক্তা নিজে বলেছেন, আয় ভাল হবার কারণে খরচের হাতটাও বড় ছিল। সেই কারণে সঞ্চয় তেমন কিছু হয়নি। এমনকি প্রথম ব্যাংক গ্যারান্টির ২৫ হাজার টাকা এক বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা। সেই টাকাটি বন্ধুর কাছ থেকে সহজে যোগাড় হলেও কাজ তুলতে টাকার কারণে অনেক বেগ পেতে হয়েছিল। এছাড়া কিছু সুযোগ সামনে দিয়ে বিদেশি কোম্পানির হাতে চলে গেছে যেগুলো তিনি কয়েকগুণ কম টাকায় করতে পারতেন। এভাবে ছোটখাটো কাজ চলছিল, কিন্তু বড় কাজ নেয়া সম্ভব হচ্ছি না। বিদেশি কোম্পানির ক্লায়েন্টকে নিয়ে মিটিং করার মত সুন্দর মিটিং রুম ছিলনা। নিজে একসময়ের ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকার হবার পরেও নগদ টাকা বা মর্টগেজ দেবার মত সম্পত্তি না থাকায় ‘পে অর্ডার’/‘ব্যাংক গ্যারান্টি’ যোগাড় করতে ব্যর্থ হয়ে অনেকগুলো কাজ হাতছাড়া হয়ে গেছে। নিজস্ব প্রোডাক্ট তৈরির মত দীর্ঘমেয়াদী বিনিয়োগের মত অর্থ সংস্থান ছিল না। বিদেশি কোম্পানির হেড অফিসে বিমান ভাড়া খরচ করে গিয়ে প্রেজেন্টেশন দিয়ে আসার মত আর্থিক ঝুঁকি নেয়া প্রায় অসম্ভব ছিল। আরও অনেক সমস্যা। ধীরে ধীরে অর্থ সঞ্চয় করে, বন্ধু বান্ধবের সহায়তা নিয়ে কাজগুলো করতে হয়েছে। তিনি মনে করেন যে অনেক অপ্রয়োজনীয় বিষয় নিয়ে অনেক বেশি সময় ব্যয় করতে হয়েছে যোটার সংস্থান থাকলে প্রবৃদ্ধি অনেক দ্রুত হত। গল্পের এ পর্যায়ে যদি আমরা দেখি তবে দেখব – সেসময় ওই উদ্যোক্তাদের জন্য সহযোগিতা হিসেবে দরকার ছিল – সিড ফান্ড, ওয়ার্ক অর্ডার ফাইনান্স, অফিস সাপোর্ট, সেলস মার্কেটিং সাপোর্ট ইত্যাদি যার কোনটাই প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে বাইরে থেকে আসেনি। না বেসরকারি উদ্যোগে না রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে। অথচ এই কাজটি করার জন্য দরকার ছিল – সিড ফান্ডে ও বিজনেস ইনকিউবেটর – যার কোনটির ব্যবস্থাই আজও আমরা রাষ্ট্রীয় ভাবে করতে পারি নাই। এপর্যন্ত গল্পের ট্র্যাজিক অংশগুলোতে সামান্য কুশন দিয়েছে বন্ধুবান্ধব কিন্তু কি সবার ভাগ্যে জোটে।
রবি (তৎকালীন একটেল) – তে কাজ করার সময় আমার সহকর্মী আমিনুল ইসলাম বেগ এর মাধ্যমে এসএসডি টেক এর সাথে পরিচয় হয়। তখন তাদের ব্যবসার উঠতি সময়। সে সময়ে ওদের অন্যান্য প্রতিদ্বন্দ্বী কোম্পানিগুলোর মত অভিজ্ঞতা, আর্থিক শক্তি বা বড় লবি তাদের ছিল না। তাদের যে বিষয়গুলো আমাদেরকে সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ করেছে তা হল – আত্মবিশ্বাস, প্রযুক্তির অতীত/ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভাল জানাশোনা, যোগ্য যায়গায় যোগ্য লোক, কাজের প্রয়োজনে লোক খুঁজে বের করার ক্ষমতা, আর সীমানা পেরোনোর স্বপ্ন দেখার সাহস। কিন্তু এ সকল গুনের আমাদের দেশে তো এখনও অর্থনৈতিক ভ্যালুতে মাপার সময় আসেনি । আর এ এধরনের কোম্পানিকে কাজ দেবার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের ভিতরে বাইরে অনেক রকমের শক্তি থাকে যেগুলো সমালোচনার ভয়ে অনেকেই মোকাবেলা করতে চায় না। সেসময় আমাদের কিছু দেশের কিছু বড় তথ্য প্রযুক্তি কোম্পানি ও বিজনেস এসোসিয়েশন তাদেরকে প্রোডাক্ট রেফারেন্স ও ফাইনান্সিয়াল রেফারেন্স দিয়ে সাহায্য করতে পারতেন। সেটি না করে বরং তারা সামান্য কিছু মুনাফার আশায় বিদেশি কোম্পানিকে রেফারেন্স দিয়েছেন, তাদের জন্য লবি করে এই উদ্যোক্তার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। এখানের গল্পের ট্র্যাজিক অংশে ঠিক একইভাবে কুশন দিয়েছে কিছু সুহৃদ কিন্তু সবার জন্য তা সম্ভব হবে কেন।
যাহোক এসবের কিছুই তাকে রুখতে পারেনি। বারবার বাধা এলেও তারা এগিয়েছে। এ পর্যন্ত বাংলাদেশের বাইরে ৫ টি দেশে তারা তাদের ব্যবসা সম্প্রসারিত করেছে। এ দেশের বৃহৎ একটি টেলিকম প্রতিষ্ঠান সহ আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাকে কিনতে চেয়েছে। সম্পদ হিসেবে তৈরি হয়েছে কিছু ৭০ জনের মত আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষিত জনশক্তি, কিছু ভাল সফটওয়ার, বিশ্বের কিছু সেরা প্রতিষ্ঠানে কাস্টমার রেফারেন্স। এই সবকিছু গল্পগুলোর সুন্দর অংশ। এবার কথা বলা যাক এদের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সফলতা মানেই প্রবৃদ্ধি বাড়ানো। আগামীর বাজার বিবেচনা করে তারাও বাড়তে চান। সেই বাড়ার পরিকল্পনায় দরকার – জনশক্তি ৭০ থেকে ন্যূনতম ৩০০ করার মত অর্থনৈতিক শক্তি ও নীতি নির্ধারনী পর্যায়ে সহযোগিতা। অর্থনৈতিক সহযোগী হিসেবে তারা ব্যাংক কে পাবেন না, কারণ তাদের সম্পদ ভ্যালু করে কোলেটারাল হিসেবে গ্রহণ করা বর্তমান ব্যাংক নীতিমালার মধ্যে সম্ভব নয় (একমাত্র সম্ভাবনা ভেঞ্চার ক্যাপিটালে)। পলিসি সাপোর্ট কি পাবেন সেটা অতীত দেখে আমি খুব আশাবাদী নই।
আর সেটি সম্ভব না হলে তবে ব্যবসার মডেল বদলাতে হবে। প্রবৃদ্ধিকে কোরবানি দিয়ে প্রতিষ্ঠানকে কোনভাবে লাভজনক হিসেবে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। সেটা করতে গেলে জনশক্তি কমিয়ে ৩০ জনে নিয়ে এসে কোনভাবে কোম্পানিকে লাভজনক রাখতে হবে। সেক্ষেত্রে এত উৎসাহের গল্প হরিপদ কেরানির গল্পের সাথে মিলে একই বৈকুণ্ঠের দিকে চলে যাবে। সেটি পরিণাম স্বাভাবিক। তবে যেহেতু বাংলাদেশিরা প্রতিবছর জলোচ্ছ্বাসে ঘর ভেঙ্গে যাবার পরে আবার নতুন করে জীবন শুরু করতে পারি তাই ওরা হয়ত ওরকম করে কিছু খুঁজে নেবে। কিন্তু এমন তো আমরা চাই না।
আমাদের উদ্যোক্তাদের গল্পের এই পরিণতি পাল্টাতে হবে। শুরুর দিকের উদ্যোক্তাদের জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপন করতে হবে প্রয়োজনীয় সংখ্যক বিজনেস ইনকিউবেটর, যোগান দিতে হবে সিড ফান্ডের। তারা বড় হতে শুরু করলে প্রয়োজন হবে ভেন্চর ক্যাপিটাল ও ওই নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বান্ধব পলিসি। তারা ভেন্চর ক্যাপিটাল নিয়ে ক্যাপিটাল মার্কেটে আসার কাছাকাছি এলে তাদেরকে ক্যাপিটাল মার্কেটে নিয়ে আসার জন্য সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের বিজনেস এ্যক্সেলারেটর স্থাপন করতে হবে। এর সাথে পাল্টাতে হবে বিভিন্ন ক্ষেত্রের এসএমই বান্ধব নীতিমালা, নিশ্চিত করতে হবে নবীন উদ্যোক্তাদের জন্য ন্যূনতম ১০ বছরের ট্যাক্স পলিসি কমিটমেন্ট, সংশোধন করতে হবে আইপিআর সহ অনেকগুলো ব্যবসা ও সম্পদ সংপৃক্ত নীতিমালা। তবেই বাড়ানো যাবে উদ্যোক্তাদের সফল গল্প , কমতে থাকবে ট্র্যাজিক পার্ট।
আরও দেখুন: