গুজব [ Gujob ] শচীন ভৌমিক

গুজব [ Gujob ] !

গুজবের সংজ্ঞা কি?
‘চলন্তিকা’য় রাজশেখর বসু তো গুজব মানে “জনরব’ বলে বুঝিয়েছেন। অক্সফোর্ড ডিক্শনারীতে রয়েছে Rumour=Report of doubtful accuracy. এগুলো গুজবের মানে হতে পারে কিন্তু সংজ্ঞা বলা যায় না। সংজ্ঞা ভাবতে গিয়ে আমার সংজ্ঞাহীন হবার যোগাড়। “মিথ্যে রটনা” বলতে পারেন। শেকসপীয়র অবশ্য বলেছেন চমৎকার। উনি বলেছেন—

Rumour is a pipe
Blown by surmises, jealousies
conjectures.
–Henry IVFor Adults Only - by Sachin Bhowmik

বুড়ো ঠিক সংজ্ঞা দিয়েছে। নয় কি?

সবসময়ে শুনবেন লোক বলবে—গুজবে কান দেবেন না। কান দেবো না তো কি দেবো, নাক দেবো? গুজব এ যুগের অনেকেরই Main Job. মানুষের জীবনে ত্রিগুণ কি কি অবশ্যপ্রয়োজনীয় আমরা জানা নেই, কিন্তু ‘ত্রিগু’ কি কি বলতে পারি। ত্রি-গু হল—গুল, গুজব ও গুঞ্জন। এই তিন বস্তু ছাড়া সাধারন লোক, বিশেষ করে স্ত্রীলোক, বাঁচতেই পা্রবে না। গুল থেকে গুঞ্জন আর গুঞ্জন থেকে গুজব। গুলের উৎপত্তি কোথায়?

উর্দু ভাষীরা বলবেন বাগানে কেননা ওই ভাষায় গুল মানে ফুল। কিন্তু আমাদের ভাষায় গুলকে উর্দু ভাষীরা বলবেন ‘ফেকনা’। গুলবাজকে বলবেন ফেকুমাস্টার। যাই হোক ভাষার মাস্টারি না করে আসুন গুলের গুলতানীতে। গুলের উৎপত্তি হয় ইনফিরিয়ারিটি কমপ্লেক্স বা হীনমন্যতা থেকে।

আত্মপ্রচারণা প্রণোদিত ও ঈর্ষাপরায়ণা প্রণোদিত। অস্কার ওয়াইল্ড বলেছিলেন—Whatever I like it is either immoral, illegal or illicit. মানে অনৈতিক, বেআইনী ও বিকারগ্রস্ত। এই তিনক্ষেত্রে থেকেই কিন্তু বেশীর ভাগ গুল ও গুঞ্জনের সূত্রপাত হয় আর সেটা ক্রমে গুজবের নায়েগ্রা প্রপাত হয়ে দেখা দেয়। তিল থেকে তাল হয়। গাগর থেকে সাগর হয়। বিন্দু থেকে সিন্ধু হয়। চেস্ট্ থেকে ব্রেস্ট্ হয়। ক্যরাভেল্ থেকে কনকর্ড হয়।

এই ধরুন আমার বন্ধু রমেশ চাড্ডা। চাড্ডা আড্ডা মারতে ওস্তাদ আর গুলের গাঁজা মানে গুলের রাজা। আমাকে এসে একদিন বলল, –জানিস গুজরাটের বরোদা থেকে সত্তর মাইল দূর একটা জায়গা আছে নাম ‘ভবিষ্’। ছোট্ট শহর এই ভবিষ্। মানের ভবিষ্যৎ। ওখানে বড়লোকেরা সব যায় গোপনে হলিডে করতে। সবাই নেকেড্ থাকে সেখানে। একেবারে ইডেন গার্ডেন বা নন্দনকানন বলতে পারো।
চোখ গোল গোল করে আমি বললাম—নিউডিস্ট কলোনী বুঝি এদেশেও শুরু হয়েছে? হ্যাঁ রে চাড্ডা, কমপ্লিট নিউড থাকে ছেলে ও মেয়েরা?

ডোন্ট্ বি সিলি, — জবাব দেয় চা্ড্ডা, –না। কমপ্লিট থাকবে কেন? দে আর নট্ পারভার্ট। সে শহরে একটা ব্যাংক আছে ও আরেকটা পোস্ট অফিস আছে। ছেলেদের পোশাক ব্যাংক সরবরাহ করে, মেয়েদের পোশাক পোস্ট অফিস।

আমি বুড়বাক, –মানে?

চাড্ডা আমার গাড্ডার মতো খোলা মুখ দেখে হাসে। তারপর বলল,–ছেলেরা তাদের লজ্জাস্থান ঢাকে টাকার নোট দিয়ে। একর্ডিং টু ফাইনানসিয়াল্ স্ট্যাটাস্, বুঝেছো? গরীবরা এক টাকার নোট দিয়ে ঢাকে, মধ্যবিত্তরা দশ টাকার নোট দিয়ে, ধনীরা একশ’টাকার নোট দিয়ে। যারা দেশী পোশাক পছন্দ করে না তার অবশ্য স্মাগল নোট ব্যবহার করে। লিরা, ফ্রাংক, পাউণ্ড, ডলার পাওয়া যায়।

স্মাগল্ বিদেশী নোরে টভীষণ দাম। আমি ষোল টাকা দিয়ে দু‘টো পাকিস্তানী নোট কিনে পরেছিলাম। মেয়েরা পোশাক কেনে পোস্ট অফিস। সেটা হল স্ট্যাম্প। ওদের লজ্জা ঢাকতে তিনটে স্ট্যাম্প কিনতে হয়। এখানে আর্থিক অবস্থা অনুযায়ী পোশাক।

গরীব মেয়েরা দশ পয়সা থেকে পঁচিশ পয়সার স্ট্যাম্প কেনে, মধ্যবিত্তরা এক টাকার স্ট্যাম্প পর্যন্ত কেনে, পাঁচ টাকা দশ টাকার স্ট্যাম্প পরে ধনীর দুলালীরা। রতনপুরের মহারানীকে দেখলাম স্মাগল্ করা ইংলণ্ডের স্ট্যাম্প পরেছিলেন। সেগুলোর একটার দাম চল্লিশ টাকার কম হবে না। মেয়েরা স্মাগল্ পোশাকই বেশী পছন্দ করে। তোদের ধর্মেন্দর আর হেমা মালিনীকেও দেখলাম। ধর্মেন্দর দেশী একশ’ টাকার নোট পরেছিল। কিন্তু হেমা পরেছিল তিনটে লাইট ব্লু কালারের ফ্রেঞ্চ স্ট্যাম্প। তোদের হেমা কিন্তু ধর্মেন্দরের মতো এতটা পেট্রেয়টিক্ নয়। ভদ্রমহিলার হংকং, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়ার স্ট্যাম্প পছন্দই হয়। উনি চান শুধু ফ্রেঞ্চ ও আমেরিকান স্ট্যাম্প। কাঁচা টাকা তো, তাই। রমেশ চাড্ডার এই গুলতানী শুনে কি জাবাব দেবেন? আমি তো সরকারকে অনুরোধ করেছি আগামী বছর যেন চাড্ডা মশাইকে ‘গুলভূষণ’ না হোক, নিবেদন পক্ষে ‘গুলশ্রী’ উপাধি দেওয়া হয়। এরকম গুলের গোলন্দাজ কমই পাওয়া যাবে এদেশে।

হলিউডের একটা রিপোর্টরের গুল শোনাই।

উনি লিখেছিলেন যে একদিন বিরাট এক প্রিমিয়র শো ভাঙার পর বিখ্যাত অভিনেতা অভিনেত্রী পরিচালকরা লাউঞ্জে বেরিয়ে এসেছেন। গেটকীপার মাইকের সামনে একে একে স্বনামধন্য অতিথিদের নাম বলে তাঁদের গাড়ির জন্য ডেকে পাঠাচ্ছে। হলের পেছনে পার্কিং লটে লাউডস্পিকারের মাধ্যমে সে নাম শুনে ড্রাইবাররা গাড়ি চালিয়ে হলের সামনে আসছে ও সে অতিথি গাড়িতে উঠে বাড়ি যাচ্ছেন।
অভিনেতা জন কার্ লাউঞ্জে এলেন।

গেটকীপার ঘোষণা করলেন—জন কারস্ কার্ প্লিজ।

গাড়ি এল। উনি উঠে চলে গেলেন।

ডেবোরা কর্ বেরিয়ে এলেন। উনি ঘোষকের কাছে গিয়ে বললেন, –শোন, আমি আমার পদবী Curr-এর উচ্চারণ ‘কার্’ করি না। আমি ‘কুর্’ করি। সুতরাং সঠিক ঘোষণা করো।
গেটকীপার বলল, –ইয়েস্ ম্যাডাম। তারপরই মাইকে ঘোষণা করল,–মিস্ কারস্ কুর্ প্লিজ। নো নো স্যরি। মিস কুরস্ কুর্ প্লিজ। নো নো, মিস কুরস্ কার্ প্লিজ।
উল্টোপাল্টা বলে বেচারা ঘেমে অস্থির।

এরপর গেটকীপার দেখল এলিজাবেথ টেলর আর আলফ্রেড হিচকক্ এগিয়ে আসছেন। মাইকি ধরে সে ঘোষণা করল, –মিস্টার আলফ্রেড হিচককস্ কক্ প্লিজ।
শুনে সবাই বোবা। লোকটা আলফ্রেড হিচককের গাড়ির বদলে তাঁর পুরুষাঙ্গকে আহ্বান জানিয়েছে?

কিন্তু সবাই ধাতস্থ হবার আগেই মাইকে গমগম করে উঠল। গেটকীপারের গলা, –মিস্ এলিজাবেথ টেলরস্ টেল্ প্লিজ। হিচককের লিঙ্গকে আহ্বান করার পর গাধাটা এলিজাবেথ টেলরের গাড়িকে না ডেকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন ভদ্রমহিলার টেল্ মানে তাঁর দুর্মূল্য নিতম্বকে।

ল্যাঠা আর কাকে বলে। উপস্থিত অতিথিদের ভিরমি যাবার যোগাড়। কিন্তু সম্প্রতি আল উইলসনের একটা প্রবন্ধে জানলাম উপরোক্ত সমস্ত ঘটনাটাই গুল। সেই রিপোর্টারের কৌতুকোর্বর মস্তিস্ক থেকে বানানো। গুল বটে, তবে রসিক রিপোর্টার এমন গুলু ঝেড়েছেন যা পাঠক-পাঠিকাদের মশুগুল রাখতে পারে।

যদিও নামের ওপর কমেডী করে ওপরের উল্লিখিত গুলটির সৃষ্টি হয়েছে তবু নামকরণের বিপদের সত্যিকারের নজিরও আছে। দুটো ঘটনা এখানে আমি অনায়াসে উল্লেখ করতে পারি। দুটোই ফ্যাক্ট, ফিকশন্ নয়। ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের কতিপয় ছাত্র আমার সঙ্গে হলিউডে বেভারলী হিলস হিলটন্ হোটেলে দেখা করতে এসেছিল। লস্ এঞ্জেলেস্ শহর থেকে বেশ দূরে আমার এই হোটেল। ওদের ক্যাম্পাস থেকেও দূরে। যাই হোক সদ্য দেশ থেকে আসা ভারতীয়কে পেয়ে বেশ খানিকক্ষণ বিশুদ্ধ আড্ডা মারা গেল। লক্ষ্য করছিলাম ওদের মধ্যে একটি ছেলে রাজেন্দ্র দিক্ষিত একটু বেশী চুপচাপ।

প্রশ্ন করলাম—মিঃ ডিকশিট্ আপনি এত চুপচাপ কেন?

বঙ্গসন্তান প্রসুন বোস বলল, –আমি বলছি শচীনদা ওর মৌনের কারণ।

বললাম, –নিশ্চয়ই কোন মার্কিন তনয়ার সঙ্গে প্রেম।

প্রসূন বলল—প্রেমে ব্যর্থতা বলতে পারেন।

মানে?—আমি জানতে চাইলাম।

প্রসুন বলল,–আপনি বোম্বে থাকেন তাই নিশ্চয়ই জানেন ওর সঠিক পদবীর উচ্চারণ। আমরা বাংলায় দিখ্যিত’ বলি, কিন্তু আসলে ‘দিকশিত’ ইংরেজীতে Dikshit লেখা হয়। ঠিক কিনা্? আমি বললাম, –ঠিক।
এখানের ছাত্র ছাত্রী, বিশেষত মার্কিন মেয়েরা ওকে জ্বালিয়ে মারে। ওর প্রাণ ওষ্ঠাগত করে ছেড়েছে।

কেন?—আমি শুধোলাম।

প্রসুন বলল,–মেয়েরা সহজকণ্ঠে ওকে প্রশ্ন করে,–What you said your name? Dik,–then what?

এর জবাব কি হয় বুঝতেই পারছেন। Dik-এর পর ওর পদবীর শেষাংশ ইংরেজী ভাষায় Shit হয়। মানে বিষ্ঠা। তাহলে বুঝুন বেচারীর অবস্থা। প্রেম করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। মেয়েরা ওর পদবী নিয়ে বিস্তর হাসাহাসি করে। এক একবার বেচারী কেঁদে ফেলে! বলুন দাদা, পদবী নিয়ে কি বিভ্রাট। এ দেশে ওর প্রেমের চান্স শুন্য। হাসি আমারও পেয়েছিল। নাম বেচারাকে সত্যি বিপদেই ফেলেছে। Dik-এর পর Shit থাকলে বিদেশে বাঁচবে কি করে! আপনারাই বলুন।

আরেকটি সত্যি ঘটনা শুনুন। এটা কোলকাতার।

এটাও Dikshit-এর মতো বানানঘটিত না হলেও উচ্চারণ –ঘটিত। পাঞ্জাবী মেয়ে। আমার-বন্ধু প্রকাশ মেহরার বোন পদ্মিনী মেহরা। চেহারাটির লচক আছে। বক্ষপ্রদেশ ও বস্তিপ্রদেশে ঈশ্বরের দানে কৃপণতা নেই। ওর দোদুল্যমান তরঙ্গায়িত পশ্চাৎ-দেশটির পেছনে পেছনে রগরগে যে কোন ছেলে পাকা সড়ক, কাঁচা সড়ক দিয়ে হেঁটে হেঁটে চাই কি নরক পর্যন্ত যেতে রাজী হবে। যাই হোক, এই পদ্মিনীর কোলকাতায় চাকরির বদলী হল। তিন মাস পর সাতদিনের ছুটিতে বোম্বে এসে আমার কাছে কেঁদে ফেলার যোগাড়।

কাঁদছ কেন?-প্রশ্ন করলাম।

ইউ বেঙ্গলীজ্ আর টু মাচ্,–বলল পদ্মিনী।

কেন কি হয়েছে?—প্রশ্ন করলাম।

ও যা বলল তার সারমর্ম হল এই।

বাঙালীরা ওর নাম উচ্চারণ করতে ‘পদ্মিনি’। ভুল উচ্চারণ বলে বেচারী সবাইকে বলত,–নো নো। রং প্রনানসিয়েশান। মাই নেম ইজ্ পোদমিনি। ব্যাস্, যায় কোথায়? সব বাঙালী ছেলেরা, এমনকি মেয়েরা পর্যন্ত তখন থেকে পেছনে লাগল। তোমার নামের সঠিক উচ্চারণটা যেন কি, –প্রশ্ন করত ওরা। তারপর হাসি চেপে বলত,-‘পোদমিনি’। তাই না? বেশ নাম। বলে অনেকে হেসে গড়িয়ে পড়ত। বেচারী, বাংলায় তার এই নাম উচ্চারণের প্রথম দুই অক্ষরে মিলে যে এমন অসভ্য কথা হয় তা সে মোটেই জানত না। জেনে লজ্জায় মরে যায় আর কি।

যাই হোক, আমি ওর দুঃখের কথায় সায় দিয়ে বললাম,-সত্যি নাম নিয়ে কোলকাতায় বাঙালীমহলে তুমি বড্ড বিপদে পড়েছো। তবু একটা কথা বলব অসভ্য অর্থেও কিন্তু সার্থকনামা তুমি।
কি?-চোখে বিদ্যুৎ এনে বলল পদ্মিনী-,তুমভী এয়সা বাৎ করতা হ্যায়।

স্যরি,–বললাম আমি,–অন্ সেকেণ্ড থট্ সার্থকনামা নয় তোমার নাম। ‘মিনি’ মোটেই নয় তোমার ইয়ে। উচিত ছিল তোমার নাম হওয়া ‘পোদম্যাক্সি’। কি বল? ঠিক না?
ইউ ব্রুট্, আই অ্যাম নট্ এ হিপোপটোমাস, আই অ্যাম নট্ বটম্ হেভী। ইউ বেঙ্গলী রাসকেল্। গো এণ্ড গেট্ লস্ট্,-বলে পদ্মিনী মেহরা ঘরে ঢুকে গেল। বলা বাহুল্য তার ম্যাক্সি বটম্ সহ।
‘দিক্ষিত’ আর ‘পদ্মিনী’র নামের জন্য বিড়ম্বনা কেমন দেখলেন তো?

সত্যি ঘটনা ছেড়ে আসুন আবার রটনার আলোচনায় ফিরে যাই। ফিরে যাই গুল—গুঞ্জন—গুজবের রাজত্বে।

দেখুন মহাকবি ইকবাল কি এ দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বলে গিযেছিলেন তাঁর বিখ্যাত গানে। উনি বলেছিলেন—
সারে জাহাঁসে আচ্ছা হিন্দুস্তাঁ হামারা।
হাম বুলবুল হ্যায়, ইসকা, এ গুলিস্তাঁ হামারা।
উনি এদেশকে গুলিস্তান বলেছেন। বাংলা অর্থেই বলেছেন।
গুলের দেশ বলে উনি গুলিস্তান বলেছেন এদেশকে। ঠিকই বলেছেন। ছোটবেলা থেকে আমি ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ঘুরেছি। দেখেছি, কিছু কিছু গুল সর্বভারতীয়। সর্বজনীন ব্যাপার আর কি! দু’টো উদাহরণ দিই।

প্রথম উদাহরণ।
আমাদের পাড়ায় এক ডাক্তার থাকতেন। শীতের রাত। বাইরে ঘন কুয়াশা। মাঘ মাস। হঠাৎ ঝনঝন করে ডাক্তারের ফোনটা বেজে উঠল। ওধারে কাতর কণ্ঠ,–ডাক্তারবাবু, শীগগির আসুন। বড্ড যন্ত্রণা হচ্ছে। বাঁচবো না বোধ হয়।
ডাক্তার : আপনার ঠিকানা বলুন।
রোগী : রতন কুঠি, ১০ সরোজিনী রোড।
ডাক্তার: ঠিক আছে। এক্ষুনি আসছি।

তৈরি হয়ে ডাক্তার তার গাড়ি হাকিয়ে এলেন সরোজিনী রোড। খুঁজে বার করলেন ১০ নম্বর ‘রতন কুঠি’। মান্ধাতার আমলের জরাজীর্ণ প্রাসাদ। এককালে ঐশ্বর্যময় ছিল বোঝা যায়। এখন দুর্দশাগ্রস্ত।
কড়া নাড়তেই দেখলেন দরজাটা ধীরে ধীরে খুলে গেল। ভেতরে ঘুরঘুট্টে অন্ধকার। ডাক্তার একটু চিন্তিত হলেন। উপরে তাকালেন। দেখলেন সিঁড়ির ওপর দোতলায় একটা ঘর থেকে ক্ষীণ আলোর রেখা দেখা যাচ্ছে। কাতর গোঙানির আওয়াজ্ও শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে রোগী ওই ঘরে কষ্ট পাচ্ছে। বাড়িতে। বোধ হয় অন্য কোন প্রাণী নেই। ডাক্তার পকেট থেকে দেশলাই বার করে জ্বালালেন। এক একটা কাঠি জ্বালিয়ে তিন চারটে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে উপরে উঠে এলেন।

তারপর রোগীর ঘরে প্রবেশ করলেন। ঘরে কোন ইলেকট্রিক আলো নেই। টিমটিম করে শুধু একটা মোমবাতি জ্বলছে।

গুমোট একটা দুর্গন্ধ রয়েছে ঘরে। বিছানায় কম্বল চাপা একটি মানুষের অবয়ব। সেখান থেকেই গোঙানির শব্দ আসছে।

বিছানার কাছে গিয়ে ডাক্তার বললেন, –আমি ডাক্তার। মাথা-টাথা ঢেকে শুয়েছেন কেন? নিন হাতটা দিন।

কম্বলের তলায় নড়াচড়া দেখা গেল, তারপরই একটা হাত বেরিয়ে এল ডাক্তারের দিকে। ডাক্তারের চোখ ছানাবড়া হয়ে উঠল। ভয়ে সারা মুখ রক্তশুন্য হয়ে উঠল। হাতটা মানুষের মাংসল হাত নয়। একটা কংকালের হাত। ধীরে মাথা থেকে কম্বল সরে গেল। কংকালের মাথা। শূন্য চক্ষু কোটরের মধ্যে নীল নীল আলো। ঠোঁটহীন মাড়িহীন সাদা দাতগুলো নৃশংসভাবে হাঁ করে হঠাৎ নারকীয় উল্লাসে হা-হা-হা অদ্ভুত শব্দে হেসে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে মোমবাতিটা নিভে গেল দপ্ করে।

প্রচণ্ড আর্তনাদ করে উঠে ডাক্তার প্রাণভয়ে দৌড় লাগালেন। কি করে অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছেন। দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছেন রাস্তায়। গাড়ি চালিয়ে বাড়ি এসেছেন ডাক্তারবাবুর কিছু মনে নেই। বাড়ি এসে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এসে গেল ডাক্তারের।

পরদিন সু্স্থ হয়ে ডাক্তার প্রথমেই পুলিশ স্টেশনে খবর দিয়ে জানালেন তাঁর এই ভুতুড়ে অভিজ্ঞতার কথা।

পুলিশ ডাক্তারকে সঙ্গে নিয়ে পৌঁছুলেন রতন কুঠিতে।

দেখলেন দরজার বাইরে মরচে ধরা মম্ত তালা ঝুলছে।

প্রতিবেশীরা জানালেন এই বাড়িটা গত ত্রিশ বৎসর ধরে এভাবে খালি পড়ে রয়েছে। না, ওখানে কেউ থাকে না। কাউকে কেউ আসতে যেতেও দেখে নি। ডাক্তার হতভম্ব। তবে কি কালকের সব ঘটনাই দুঃস্বপ্ন মাত্র? ডাক্তারের অনুরোধে দরজার তালা ভাঙা হল। ওপরের ঘরে গিয়ে দেখা গেল, না, কোন কংকাল নেই। শুধু একটা পুরনো খাট রয়েছে আর ধুলোবালি মাকড়সার জাল ভরা অতীত দিনের কিছু অন্যান্য আসবাবপত্র পুলিশ বললেন, স্যরি ডাক্তারবাবু ভুতটুত বাজে কথা। এ বাড়িতে কাল রাতে আপনি মোটেই আসেন নি। সবটাই আপনার উর্বর মস্তিঙ্কের ফসল।

ডাক্তারের কিছু জবাব দেবার নেই। মাথা নীচু করে মোহ-গ্রস্তের মতো উনি নেমে আসছিলেন পুলিশের পিছু পিছু্ তখনেই চোখে পড়ল তাঁর।

হ্যাঁ, ঐ তো, সিঁড়িতে পড়ে রয়েছে।

দেশলাইয়ের পোড়া কাঠি। কালকে যেগুলো জ্বালিয়ে জ্বালিয়ে উনি সিঁড়ি চড়েছিলেন। সেগুলো। সদ্য পোড়া দেখলেই বোঝা যায়। একটা একটা করে তুলে নিলেন ডাক্তার। ছ’টি পোড়া কাঠি। পুলিশকে দেখালেন। দেখুন স্যার প্রমাণ। ছ’টি পোড়া কাঠি। সদ্য জ্বালানোর সব লক্ষণ পাবেন এগুলোতে। এগুলোই প্রমাণ দিচ্ছে যে কাল রাতে আমি এসেছিলাম এখানে। এই বাড়িতে। সত্য কিনা বলুন?
পুলিশের মুখে এখন আর কোন শব্দ নেই। তারা স্থাণুর মতো তাকিয়ে রইল ওই পোড়া দেশলাই-কাঠিগুলোর দিকে।

উপরোক্ত এই ভূতের গল্পটা আমাকে বিভিন্ন প্রদেশের প্রায় বাইশ জন শুনিয়েছে। প্রত্যেকেরই দাবি যে এ ঘটনাটা তার পাড়াতেই হয়েছে। ডাক্তার তাদের বিশেষ পরিচিত, ওই ভূতুড়ে বাড়িটা তারা ভালো করে চেনে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আসলে এটা গল্পই, গুলই। প্রত্যেকে নিজেরা প্রত্যক্ষ করেছে বলে এই ভূতুড়ে গুলটা চালিয়ে আসছে। এটা আমার ধারণা খুব পপুলার গুল।

দ্বিতীয় উদাহরণটা শুনুন।

কিশোর বয়েসে এই গুলটা সবাই শুনে থাকবেন। বা শুনিয়ে থাকবেন।

জানিস, আমাদের পাশের বাড়ি এই ঘটনাটা ঘটেছিল। ছেলেটা আর মেয়েটা দু’জনকেই আমি চিনতাম। ওরা ভাইবোন দু’জনের যৌন সম্পর্ক ছিল। একবার লুকিয়ে এরকম পাপাচার করতে গিয়ে বিপদ হল ওদের। সংসর্গের পর কিছুতেই বিযুক্ত হতে পারছিল না ওরা। শেষ পর্যন্ত ডাক্তার আসে। এম্বুলেন্সে করে হাসপাতাল নিয়ে যেতে হয়েছিল। সার্জণ অপারেশন করে ওদের আলাদা করে।
মেয়েটি সুইসাইড করে। লজ্জায় ফ্যামিলিটা পাড়া ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়।

উপরোক্ত এই সেক্সুয়াল ফ্যান্টাসীটা খুবই বহু পরিচিত গুল কিশোর মনের ফ্রাস্ট্রেশন থেকে এর জন্ম। দৃশ্যমান সাবমেয়-সংগমের পরিপ্রেক্ষিতে অসামাজিক ইনসোটুয়াস সম্পর্ক-সবটাই গুলবাজের যৌন-হীনমন্যতার ফসল। এ গল্প রেঙ্গনে, কোলকাতায়, ঢাকায় সর্বত্র আমি কিশোর বয়েসে শুনেছি। প্রতিটি বক্তাই বলেছেন এ ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী সে। কেউ প্রতিবেশীর ঘটনা বলে চালান, কেউ আবার বলেন, যে সার্জন ওদের মুক্ত করেছে সে তার আপন কাকা মামা বা জ্যাঠামশাই।

আসলে সব গল্পটাই তার মনের জ্যাঠমো মাত্র।
গুল থেকে গুঞ্জন যাকে ইংরেজীতে বলে গসিপ।
আর গুঞ্জন থেকেই গুজব, যাকে ইংরেজীতে বলে রিউমার।
রউমারের একটা আদিরসাত্মক সংজ্ঞাও রয়েছে। এই সংজ্ঞাটা ইংরেজদের সৃষ্টি। প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে জোকটা চালানো হয়েছে।

প্রশ্ন : ফরাসী মেয়েদের যোনিকে কেন ‘রিউমার’ বলা হয়?

জবাব : Because it travels from month to month। কৌতুকীস্রষ্টা বলতে চান ফরাসী মেয়েরা ‘ফেলাশিও’র ভক্ত। ওঁরা নর্মাল সেক্স-এর চাইতে এব্ নরমালের ভক্ত। গুজব মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায় বলে তাকে “গুজব’ বলা হয়, তাহলে ফরাসী মেয়েদের যৌনাঙ্গকে কেন গুজব আখ্যা দেওয়া হবে না যখন সেটা travels from month to month।

এখানে আমি অবশ্য উল্লেখ করে দিতে চাই যে ফরাসীরা সত্যি সত্যি যৌনবিকারগ্রস্ত এ ধারণা ভুল। অন্য যে কোন দেশের অধিবাসীদের মতোই ফরাসী জাতির যৌনজীবন। মানে সুস্থও রয়েছে, অসুস্থও রয়েছে। যা একান্ত স্বাভাবিক। ইংরেজরা ফরাসীদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে চিরকালই হীনমন্যতায় ভুগত। তাই ওদের সব রকমভাবে হেয় করে ওরা। কৌতুকগুলিতে বেশি করে হেয় করার প্রচেষ্টা হয়।

এটা মানুষের অদ্ভুত এক দুর্বলতা। সেজন্য না বলে ছুটি নেওয়াকে ইংরেজরা খামোকাই বলে “ফ্রেঞ্চ লিভ্” মুখ দিয়ে যৌনাঙ্গ সম্ভোগ, যাকে বলে “ওরাল সেক্স” সেটার মিছিমিছি নামকরণ করা হয়েছে “ফ্রেঞ্চ লাভ্”, প্রফেলেকটিক্-কে বলে “ফ্রেঞ্চ লেদার” ইত্যাদি। এসব আগেই বলেছি, হীনমন্যতার ফসল। এদেশেও সর্দারজীদের শক্তি সাহস সম্পর্কে অন্যান্য প্রদেশীদের ইনফিরিয়রিটি কমপ্লেক্স আছে বলেই কৌতুকাতে ওদের নির্বোধ বানানো হয়। এই কারণে আমেরিকার শ্বেতচর্মীরা নিগ্রোদের আদর কৌতুকীতে পশুবৎ বানিয়ে আনন্দ পাচ্ছে।

মাপ করবেন, লিখতে লিখতে প্রসঙ্গান্তরে চলে এসেছি।

একানে শুধু এটুকু বলে দিই। আদিরসাত্মক কৌতুকী কেন সৃষ্টি হয়েছে এ প্রসঙ্গে যদি গভীর গবেষণার ইচ্ছে হয় তাহলে আপনাদের সব প্রশ্নেরই উত্তর পাবেন-Rationale of Dirty Jokes বইয়ের দুই খণ্ডে। লেখক G. Legman। মোটা মোটা দু’টি খণ্ডে লেখকমশাই প্রচুর রিসার্চের ফলশ্রুতি-সংকলিত ও বিশ্লেষণ করেছেন। প্রচণ্ড পরিশ্রমের কাজ। বই দু’টির প্রকাশক লণ্ডনের Jonathan Cape Company, এ প্রসঙ্গের এখানেই ইতি টানি।

প্রচুর জ্ঞানদান করা গেল। এবার আবার গুলদান করা যাক। শচীন ভৌমিক এখন আর বচন ফকির নয়, গুলবচন ফকির। ‘গুলমগীর’ বলতে পারছি না, কেননা সেটা সৈয়দ মুজতবা আলী আগেই আত্মসাৎ করেছেন। গুলের যাবতীয় পদবীই উনি নিয়ে নিয়েছেন। “চতুরঙ্গে”র তাঁর “গাঁজা” নিবন্ধ থেকে উদ্ধৃতি দিচ্ছি–

…“অজন বুঝিয়ে বলে,– ‘আলম অর্থাৎ দুনিয়া জয় করে পেলেন বাদশা আওরঙজেব ঐ আলমগীর নাম। সেই ওজনে আপনি গুলমগীর।’

আমি বললুম, –হাসালিরে হাসালি। এ আর নতুন কি শোনালি? প্রথমে আমি পরীস্তানে ছিলুম গুল্-ই-বকাওলী, তারপর লণ্ডনে নেমে হলুম ডিউক অফ্ গুলস্টার, তারপর ফ্রান্সে হলুম হ্য গুল। তারপর পাকিস্তানে হলুম গুল মহম্মদ, এখানে এসে হলুম গুলজারিলাল নন্দ।
তা ভোলো, ভালো। গুলমগীর। বেশ বেশ।’……

দেখলেন তা গুলের কোন পদবী কি আর বেঁচে আছে আমার জন্য? সবেই তো সৈয়দ সাহেব নিয়ে বসেছেন। ঠিক আছে, আমি তাহলে ‘গুলবচন’ই হলাম। আদর করে ‘গুলবচন’ না ডেকে ‘গুলবদন’ও ডাকতে পারেন, আপত্তি করব না। জানি প্রতিটি গুল্ শুরু হয় মিথ্যা থেকে। প্রতিটি না হোক, বেশীর ভাগই রং চড়িয়ে গুল থেকে-গল্প হয়। উর্দু ভাষীরা বলে যোখ চিল্লীর গল্প।

তা হোক, কিন্তু ভেবে দেখুন, গুলগাল যদি না থাকতো পৃথিবীটা তাহলে কি রকম বোরিং জায়গা হতো। তাই না?
Heywood Broun সেজন্য বলে গেছেন—“What a dull world this would be if every imaginative maker of legends was stigmatized as liar.” হক্ কথা কিনা বলুন।
সেজন্য গুল-গুঞ্জন-গুজব আমাদের আবশ্যকীয় জাতীয় সম্পত্তি। অবহেলা করবেন না। এসব আমি পছন্দ করি না বলে সাধু সাজবার, উন্নাসিক সাজবার কোন প্রয়োজন নেই।

Joseph Corerad বলেছেন—
Gossip is what no one claims to like—but every body enjoys. সুতরাং নাক সিটকোবেন না। ফ্যাক্ট ইজ ফ্যাক্ট।
গুল ও গুঞ্জন সর্বদা মিথ্যে থেকে উৎপন্ন হয় এটা সঠিক নয়। কথায় বলে,–“যা রটে তার কিছু তো বটে।” এধরনের অতিরঞ্জিত গুঞ্জনের চমৎকার সংজ্ঞা দিয়েছেন খলিল জিব্রান। উনি বলেছেন— An exaggeration is a truth that has lost its temper. চমৎকার সংজ্ঞা নয়?

আগেই উল্লেখ করেছি গুল-গুঞ্জন-গুজব আদিরসাত্মক হলেই বেশী মুখরোচক হয়। কেউ কেউ বলবেন শচীন ভৌমিকটা কি সব গুলতানী করছে। বলবেন,–শচীনের বড় বেশী ব্যাড্ টোট্! বলতে চান বলুন তাতে দমবার পাত্র নই আমি। আর্নল্ড বেনেটের কোটেশনটা অনেক আগেই তাবিজে বেঁধে নিয়েছি। ভয়ের কি আছে?
উনি বলেছেন—

Good taste is better than bad taste, but bad taste is better than no taste at all.

মানে—নাইরুচির চাইতে কানারুচি ভালো।

আমার এই নিবন্ধ কানা রুচিরই কানামাছি। কানারুচিরই কানন কুসুম। নন্দনকানন বলুন ভালো কথা, মুখ বাঁকিয়ে ক্রন্দন-কানন বললেও আমি রাগ করব না।
আপনারা অনেকেই খবর রাখেন না হয়তো যে বোম্বেতে বিরাট একটা গুজবের ফ্যাক্টরী আছে। জানেন? না তো। জানতাম। হ্যাঁ, মশাই, বিরাট সেই ফ্যাক্টরী। সম্প্রতি আমি সেই কারখানা প্রদর্শন করে এসেছি। এবার আপনাদের আমি সেই প্রদর্শনের ধারাবিবরণী না হোক, সংক্ষিপ্ত রিপোর্ট দিচ্ছি।

ফ্যাক্টরীর নাম—হিন্দুস্থান রিউমার ফ্যাক্টরী।

বোম্বে পুণা হাইওয়েতে আধ মাইল জায়গা জুড়ে ফ্যাক্টরী। ডে নাইট্ কাজ চলছে।

ম্যানেজার বেশ অমায়িক ভদ্রলোক। বাঙালী। নাম অতিরঞ্জন ঘোষাল।

আমি প্রশ্ন করলাম,–মিঃ ঘোষাল, ফ্যাক্টরী কেমন চলছে?

আর বলবেন না,–অতিবাবু জবাব দিলেন,–দিন রাত কাজ হচ্ছে। এত ডিমাণ্ড যে অর্ডার অনুযায়ী মাল সাপ্লাই দিতে পারছি না।
মাপ করবেন আমার আনাড়ীর মতো প্রশ্ন শুনে। আমি জানতে চাই আপনারা গুজব কি করে তৈরি করেন?

ম্যানেজার জবাব দিলেন,–দেখুন গুলবচনবাবু, ফরমুলা জানা থাকলে গুজব তৈরি করা কিছু শক্ত নয়। প্রথম র মেটেরিয়েল মানে কাঁচা মাল সংগ্রহ করা হয়। কাঁচা মাল হল ‘ফ্যাক্টস্’ মানে ‘সত্যি ঘটনা’। এবার তার সঙ্গে মেশানো হয় জনতার গুঞ্জন আর ‘ফ্যানটাসি’ মানে কাল্পনিক অবস্তাব গাঁজা—এইবার মেশিনে সেগুলোর রাসায়নিক মিশ্রণের পর বেরিয়ে আসে সলিড্ গুজব।

প্রস্তুত করতে সময় বেশী লাগে না। তবে কোন ‘সত্যটা’ গুজবায়িত করা সম্ভব সেই বিচারটা খুব শক্ত কাজ। সেজন্য আমাদের স্পেশালিস্ট রয়েছেন।
আমি প্রশ্ন করলাম,–আচ্ছা ওই যে চিমনিগুলো থেকে ধোঁয় বেরুচ্ছে ওগুলো কেন?

মিঃ ঘোষাল বললেন,–আমাদের হট্ প্লেট রুমের জন্য ওই চিমনিগুলো রাখা হয়েছে। গুজবের সবচেয়ে বড় কথা সেগুলো প্রপারলি গরম হওয়া চাই। ইংরেজীতে শুনেছেন নিশ্চয়ই—হট্ রিউমার। গুজব গরম হতে হয়, কেকের মতোই। তাতেই তার কাটতি বেশী হয়। শোনেন নি, সেলিং লাইক হট কেক্ বলে একটা কথা আছে? তেমনি কথা আছে—স্প্রের্ডিং লাইক এ হট্ রিউমার। বুঝেছেন?

আমি জিজ্ঞেস করলাম,–র মেটেরিয়েল আপনারা কোথা থেকে সংগ্রহ করেন?

–শহরের বার্ বা মদের দোকান থেকে, সেলুন থেকে, মেয়েদের বাথরুম বিশেষত মেয়ে কলেজের বাথরুম, লেডিস ক্লাব ও লেডিস হোস্টেলের বাথরুম, হেয়ার ড্রেসিং করার দোকান, ডাক্তাদের ওয়েটিং রুম। এছাড়া মেয়েদের টেলিফোনের কথাবার্তা ট্যাপ্ করে। শহরের বিভিন্ন পার্টি থেকে, স্টেশনের ওয়েটিং রুম থেকে। এসব জায়গায় আমাদের স্পাই রয়েছে। এছাড়া ঝি-চাকররা অনেক র মেটেরিয়েল দিয়ে থাকে। পার্কে বাচ্চা নিয়ে যে সব আয়ারা বিকেলে হাওয়া খাওয়াতে বেরোয় তারা আমাদের বিরাট সোর্স। গ্রাম্যগুজবের কাঁচা মাল আমরা সাধারণত পুকুর ঘাটেই পেয়ে যাই।

আই সি,–আমি অবাক হয়ে বললাম,–গুজব তৈরি হয়ে গেলে সেগুলোর প্রচার কি করে হয়?

খুব সোজা,–বললেন ঘোষাল মশাই,–ট্যাক্সি ড্রাইভার, ক্লাব ও পার্টি মারফত। বিশেষ করে টেলিফোন মারফত খুব তাড়াতাড়ি আমরা সেগুলো ছড়িয়ে দিই। গুজবের কাঁচা মাল সংগ্রহে ও প্রচারে দু’ক্ষেত্রেই মহিলারা সবচেয়ে উৎসাহী কর্মী।

প্রশ্ন করলাম,–কোন জাতীয় গুজবের কাটতি বেশী?

অতিবাবু বললেন,–নিঃসন্দেহে রাজনৈতিক ও চলচ্চিত্র জগৎ সংক্রান্ত রিউামরই বেশী চলে।

আমি বললাম,–রাজনীতি সম্পর্কে আমার জ্ঞান কম। সিনেমা সংক্রান্ত এই কারখানার তৈরি কয়েকটি গুজব শোনান না।

মিঃ ঘোষাল বললেন,–কিছুদিন আগে আমাদের ফ্যাক্টরীর তৈরি দু’টো গুজব খুব জনপ্রিয় হয়েছিল। একটা হল ডিম্পল কাপাডিয়া আসলে রাজ কাপুর ও নার্গিসের কন্যা। এটা পিওর গাঁজা। কিন্তু গুজবটার খুব কাটতি হয়েছিল। দ্বিতীয় গুজবটা হল জয়া ভাদুড়ী অমিতাভ বচ্চনের সঙ্গে বিয়ে করবার আগে বিবাহিতা ছিলেন। এটাও ডাহা মিধ্যে। কিন্তু মার্কেটে এ গুজবটাও খুবই জনপ্রিয় হয়েছে। বললাম,–হ্যাঁ, এ দুটো গুজবের জনপ্রিয়তার কথা জানি।

অতিবাবু আত্মপ্রসাদের হাসি হাসলেন। তারপর গর্বিত কণ্ঠে বললেন,–সাত দিন হল আমাদের আরেকটা প্রোডাক্ট হট্ ফেভরিট্ হয়ে উঠছে। সেটা হর ধর্মেন্দর ও হেমা মালিনী মুসলমান ধর্ম অবলম্বন করে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয়েছেন। শুনেছেন নাকি?

বললাম,–একবার কানে এসেছিল।

মিঃ ঘোষাল বললেন,–টপ্ সেল চলেছে এটার।
আমি প্রশ্ন করলাম,–আপনাদের কোন গুজব ফ্লপ করেছে কি?

দেখুন,–মিঃ ঘোষাল বললেন,–বিজনেসে আপ্ এণ্ড ডাউন্ তো থাকেই। তবে আমাদের রেকর্ড খুব ভালো। আপনাকে লুকোব না সম্প্রতি আমাদের একটা গুজব ফ্লপ করেছে। আমরা ফ্যাক্টরী থেকে একটা গুজব তৈরি করেছিলাম যে সত্যজিৎ রায় অবিলম্বে তাঁর প্রথম হিন্দী ছবি করছেন। গুজবটা দশ বৎসব ধরে বেশ কাটছিল। কিন্তু গুজবটা সত্যে পরিণত হচ্ছে জানতে পারলাম। ফলে বাজার থেকে গুজবটা আমাদের তুলে নিতে হল। এতে কিছু লস্ তো হল। তা আর কি করা যাবে বলুন।

বললাম,–শুনেছি সত্যজিৎবাবু সঞ্জীব কুমারকে নিয়ে প্রথম হিন্দী ছবি শুরু করবেন। এটা ঘটনা বলেই তো জানি।
সেজন্যই তো ওঁর সম্পর্কে চালু গুজবটাকে উইথড্র করতে হচ্ছে,–অতি বিরস কণ্ঠে বললেন অতিবাবু। শ্রীঅতিরঞ্জন ঘোষাল।

কারখানা ঘুরে ঘুরে দেখে শেষ পর্যন্ত আমি বেরিয়ে এলাম। পেছনে পড়ে রইল মিঃ ঘোষাল আর কারখানা বিশাল। ভদ্রলোককে দেখে বুঝলাম ‘সেন্স অফ হিউমার’ থাকলে যেমন বড় হওয়া যায়, তেমনি সেন্স্ অফ রিউমার থাকলেও বড় হওয়া যায়। কপাল থাকলে রিউামর ফ্যাক্টরীর ম্যানেজার পর্যন্ত হতে পারেন আপনি।

সাহিত্য জগৎ সম্পর্কে কোন গুজব এই কারখানায় তৈরি হয়েছেল কিনা জিজ্ঞেস করায় উনি বলেছিলেন,–না, মশাই, ঐ বিভাগটা এখনো চালু করা হয় নি। ফাইভ ইয়ার প্ল্যানে-রয়েছে।
জিজ্ঞেস করেছিলাম—তাহলে বলতে চান রবীন্দ্রনাথের পায়ে গোদ ছিল এটা আপনাদের কারখানার তৈরি নয়?

মোটেই না,–বললেন ঘোষাল।

বলতে চান,–আমি বললাম,–বঙ্কিমচন্দ্রের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের যখন দেখা হয়েছিল তখন বঙ্কিমবাবু বিদ্যাসাগরের পুরনো দোমড়ানো হোঁচট-খাওয়া চটির দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন—
বিদ্যার সাগর কেন উর্ধ্ব পানে ধায়?

উত্তরে বিদ্যাসাগর বলেছিলেন,–

চট্টোপাধ্যায় বৃদ্ধ হয়ে বঙ্কিম হয়ে যায়।

এই গুজবটাও আপনাদের কারখানার নয়?

নো, নেভার, নকো,–ইংরাজী থেকে শেষ পর্যন্ত মারাঠী ‘নকো’ দিয়ে অতিবাবু তার প্রতিবাদ, তার নেতিবাদ জানালেন।
আমার বিষণ্ণ মুখ দেখে দয়া হল অতিরঞ্জন ঘোষালের। বললেন,–সাহিত্য বিভাগের প্রোডাকশন চালু হলেই আপনার নামে সলিড্ একটা গুজব চালু করব। গুজবটা আমার মাথায় এসে গেছে। শুনুন।

বার্নার্ড শ’ বলেছিলেন—There great Indians impressed me the most—They are Gandhi, Tagore and Bhau-mick.
ভয়ে আনন্দে বললাম,–গ্রাণ্ড হবে। দারুণ হবে।
আপনাদের আগে থেকেই অনুরোধ জানাই—বাজারে গুজবটা চালু হলে প্লিজ বিশ্বাস করবেন।
গুজব—কারখানার সমাচারের এইখানেই ইতি।

এ ছাড়া গুলবচনের গাঁজার কলকের আগুনও নিভে আসছে। সুতরাং আমার এই নিবন্ধকে কবন্ধ করার সময় হয়ে এসেছে।
শেষ করার আগে গুজব সম্পর্কে কৌতুকী শোনাবার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। রিউমার সম্পর্কে এর থেকে মজার হিউমার আমি অন্তত শুনি নি। আপনার শুনে থাকলে দয়া করে জানাবেন।
কৌতুকীটা হল এই।

স্বামী ঘুমিয়ে পড়াতেই কালু সিং এর বৌ ধীর পায়ে সিড়ি ভেঙে ছাদে এল অভিসারে। তার প্রেমিক মাখন সিং সেখানে অপেক্ষা করছিল। ছাদের দরজা বন্ধ করে কালু সিং এর বৌ সালোয়ার খুলতে খুলতে লজ্জানম্র কণ্ঠে বলল,–সারা গ্রামের লোকে বলাবলি করছিল।

বেল্ট খুলতে খুলতে মাখন সিং বলল,–কি বলছিল ওরা?

বলছিল,–কাঁচুলী খুলে ছুড়ে ফেলে বলল কালুর বৌ,–বলছিল তোর সঙ্গে নাকি আমার গোপন সম্পর্ক আছে!

সালোয়ারের পাশে প্যাণ্টটা লাথি মেরে রেখে পরম আবেশে মাখন সিং জড়িয়ে ধরল কামজর্জর কালুর বৌকে। তারপর বলল,–গাঁয়ের লোকদের খেয়েদেয়ে কাজ নেই। শুধু মিথ্যে যতসব গুজব ছড়ানো। লোকগুলোর সত্যি কোন ক্যারেকটার নেই। ঈশ্বর জানেন এদেশের ভবিষ্যৎ কি।

আপনারাই বলুন এর চাইতে কৌতুককর কৌতুকী শুনেছেন গুজব সম্পর্কে?
গুলবচনের গুলতানির এখানেই শেষ। বচন ফকিরের বচনের ভান্ডার বাড়ন্ত হয়েছে। সত্যি সত্যি ফকির এখন আমি। এটা কোন ফাঁকির কথা নয়, সত্যি কথা। মূলবচন এটা। গুলবচন নয়!!

[ গুজব [ Gujob ] শচীন ভৌমিক ]

শচীন ভৌমিক কে আরও পড়ুন:

Leave a Comment