বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৫৫ সাল [ Bangbandhu Sheikh Mujibur Rahman’s Speech 1955 ]
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৫৫ সাল [অক্টোবর]
পাকিস্তান গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ -১৯৫৫ সালের ১ অক্টোবর
মিঃ স্পিকার :
প্রস্তাব উত্থাপিত।
বিলের তফসিলের ৩৮ সংখ্যক আইটেম বা দফার পর নিম্নবর্ণিত নতুন আইটেম বা দফা যুক্ত করা হোক। যথা :
38 A. Government of India (Third Amendment) Act. 1954. 17th July, 1954
38 B. Government of India (Fourth Amendment) Act. 1954. 17th July, 1954
38 C. Government of India (Fifth Amendment) Act. 1954…. 21st September, 1954.”
শেখ মুজিবুর রহমান :
মহোদয়, জনাব আতাউর রহমান খান-এর সংশোধনী প্রস্তাবকে সমর্থন জানিয়ে আমি আমার অপর পারের সম্মানিত বন্ধুবর্গ ও তাঁদের নেতাদের উপলব্ধি করতে অনুরোধ করবো যে, এই সংশোধনী গণতন্ত্রের সত্যিকার নীতির উপর ভিত্তি করে না হয়েছে। এই পরিষদ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী।
আমরা যারা বিরোধী দলে রয়েছি এবং আমরা যারা মন্ত্রী নাই, তাদের কথা এক রকম, কিন্তু তাঁরা মন্ত্রী এবং বস্তুতঃ তাঁদের রক্ষাকবজের জন্যই জনাব আতাউর রহমান খান এই সংশোধনী প্রস্তাব এনেছেন। অবশ্য আমার অপরপক্ষের বন্ধুরা বলতে পারে যে, এ কথা ঠিক যে আজ তাঁরা সরকারি বেঞ্চে রয়েছেন। আগামীকাল অন্য কেউ আসতে পারেন। কিন্তু আমি বলবো আজ তাঁরা ক্ষমতায় রয়েছেন এবং তাঁদের রক্ষাকল্পেই আমরা এই সংশোধনী প্রস্তাব আনছি।
এখন প্রশ্ন হলো প্রধানমন্ত্রী কে? প্রধানমন্ত্রী এমন একজন ব্যক্তি যিনি জনগণের প্রতিনিধি, যাঁর প্রতি জনগণের আস্থা রয়েছে এবং যার প্রতি, এমন কি, এই হাউজের সদস্যদের আস্থা রয়েছে, কারণ তাঁরা তাঁকে সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে নির্বাচিত করেছেন এবং সেই কারণেই আমরা তাঁকেই এসব ক্ষমতা দিতে চাই। আমরা এমন কোনো ব্যক্তিকে ক্ষমতা দিতে চাই না যিনি জনগণের প্রতিনিধি নন কিন্তু ইংল্যান্ডের মহামান্য রাণী কর্তৃক নিযুক্ত। তাহলে মহোদয়, বলুন যে পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে এমন একজন ব্যক্তির নিকট থেকে ন্যায়বিচার আশা করা কিভাবে সম্ভব যিনি তাদের প্রতিনিধি নন? তাই গণতান্ত্রিক নীতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়ে আমি এই সংশোধনী প্রস্তাব সমর্থন করি। মহোদয়, আমরা চাই যে, গভর্ণর জেনারেল একজন শোভাবর্ধক বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং তিনি অবশ্যই মন্ত্রিবর্গ ও মন্ত্রিপরিষদের পরামর্শক্রমেই কাজ করবেন।
আপনি জানেন যে কিভাবে এই সব ক্ষমতা সৃষ্টি করা হয় এবং তা কায়েদে আজম মোহাম্মদ আী জিন্নাহর ওপর অর্পণ করা হয়। এখন, মহোদয়, আপনি অনুধাবন করতে পারছেন যে কায়েদে আজমের মতো গুণসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব যিনি আমাদের জন্য পাকিস্তান নামক রাষ্ট্র ছিনিয়ে এনেছেন, যাঁর ছিল পাকিস্তানের অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির জন্য সর্বাত্মক ভালবাসা এবং যিনি পাকিস্তান অর্জনের জন্য যাবতীয় ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তার মত এই সব গুণাবলীসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব গভর্ণর জেনারেল হলে জনগণ বিশ্বাস করতে পারতো যে তারা ন্যায়বিচার লাভ করবে এবং সেক্ষেত্রে এ ব্যাপারে কেউ বাধা প্রদান করতো না।
কিন্তু মহোদয়, যাঁরা স্বীয় উদ্দেশ্য সাধনে কারচুপি করে, চক্রান্ত করে, দলীয় স্বার্থে বা অসৎ উপায়ে ক্ষমতা দখল করে গভর্ণর জেনারেল হয় তাঁদের গণতান্ত্রিক রীতিনীতির প্রতি কোনো শ্রদ্ধাবোধ থাকবে না। তাঁরা পাকিস্তানের জন্য কোনো ত্যাগ স্বীকার করেনি। আবার এমনও হতে পারে যে বিশেষ কোনো ব্যক্তি যিনি পাক-ভারত স্বাধীনতা আন্দোলনকে দমিয়ে রাখার অপপ্রয়াস চালিয়েছিলেন তিনিই হয়তো ঘটনাচক্রে গভর্ণর জেনারেল হলেন। তাহলেতো আমরা তাঁর নিকট থেকে কখনও সুবিচার আশা করতে পারিনা।
সুতরাং জনগণের নিকট দায়-দায়িত্ব নাই এমন কোনো ব্যক্তিকে আমরা এসব ক্ষমতা অর্পণ করতে চাই না। সাপের দাঁত থেকে আমরা মধু লাভের আশা করতে পারি না। সেখান থেকে আমরা কেবল বিষই পেতে পারি। সুতরাং এসব কারণেই আমরা আমাদের বন্ধুদের ক্ষমতা দিতে চাই যাদের খুব শিগগিরই আজ বা কাল-বরখাস্ত হয়ে যাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আমরা তাদের নিরাপত্তার জন্যই জন্যই তাদের ক্ষমতা দিতে চাই। তাদের প্রতি কোনরূপ দয়াপরবশ হয়ে নয় কিংবা তাদের প্রতি আমাদের ভালবাসার খাতিরে নয় বরং নীতির প্রশ্নে তথা গণতান্ত্রিক নীতির প্রশ্নেই আমরা তাদের এই ক্ষমতা প্রদান করছি এবং আজ আমরা এই সব ক্ষমতা গভর্ণর জেনারেলকে প্রদান করতে যাচ্ছি।
ঐ প্রক্রিয়া যদি অব্যাহক থাকে তাহলে আমি জানিনা দেশের হাল কী হবে এবং পাকিস্তানের ভাগ্যেই বা কী ঘটবে! আমরা যদি এটা করি তাহলে এর জন্য জনগণের প্রতিনিধিদের উপর দায়িত্ব বর্তাবে। আমরা যদি এই ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীকে প্রদান করি, যিনি এই হাউসের একজন সদস্য, তাহলে আমরা তার সংগে এ বিষয়ে আলোচনা করতে পারি, কিন্তু আমরা যদি গভর্ণর জেনারেলকে এইসব ক্ষমতা প্রদান করি তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে?
তাহলে এই দাঁড়াবে যে, কোনো একদিন গভর্ণর জেনারেল সাহেব গণপরিষদের সদস্যদের নিকট এই মর্মে নোটিশ জারি করতে পারেন যে, যেহেতু আপনারা আমার ক্ষমতা কাটছাঁট করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন সেহেতু আপনারা যথাযথভাবে কাজ করছেন না এবং এ কারণে আপনাদের বরখাস্ত করা হলো।
আমরা যদি তাঁকে এই সব ক্ষমতা প্রদান করি তাহলে তিনি বলবেন যে, আপনারা আমার ক্ষমতা কর্তন করতে চাইছিলেন, আপনাদের মতো লোকজনের প্রতি আমার কোনো শ্রদ্ধাবোধ নাই এবং সেই হেতু আপনাদের মতো লোকজনের প্রতি আমার কোনো শ্রদ্ধাবোধ নাই এবং সেই হেতু আপনাদের মতো লোকজনের প্রতি আমার কোনো শ্রদ্ধাবোধ নাই এবং সেই হেতু আপনাদের আজ এখুনি বরখাস্ত করা হলো।
তাহলে এর পরিণাম কি হবে এবং পাকিস্তানের ভাগ্যেই বা কী ঘটবে? এদেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যতই বা কী হবে? আমি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর নিকট থেকে শুধু এটুকুই জানতে চাইবো যে আপনি যদি এই ক্ষমতা গভর্ণর জেনারেলকে অর্পণ করেন তাহলে কি তিনি পাকিস্তানের গণতন্ত্রকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিবেন না?
আমরা বিরোধী পক্ষ তাঁকে বলছি: নিজের হাতে ক্ষমতা নিন, মন্ত্রিপরিষদকে ক্ষমতা দিন, জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দিন, কিন্তু এমন কোনো ব্যক্তির হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিবেন না, যার পাকিস্তানের জনগণের প্রতি কোনো দায়িত্ব নাই।
আমি মাননীয় আইন মন্ত্রীর কাছে আবেদন জানাচ্ছি, যিনি (লোকে বলে থাকে) গণতন্ত্র সম্পর্কে ওয়াকিবহাল, যদিও আমি ঠিক জানি না, কারণ তাঁর সঙ্গে আমার কাজ করার সুযোগ হয়নি। তবু আমি আপনার মাধ্যমে তাঁর কাছে আবেদন জানাতে পারি যেম, তিনি তাঁর বন্ধুদের (যাঁরা মন্ত্রী হয়েছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার কথা ভাবছেন) এই মর্মে প্রত্যয় উৎপাদন করতে পারেন যে আমরা তাঁদেরকে ক্ষমতা প্রদান করতে যাচ্ছি এবং তাঁরা তা ব্যবহার করতে পারবেন। যদি তাঁরা এটা গ্রহণ করেন, তাহলে আমরা আর কি করতে পারি?
জনাব আবদুল আলীম :
আপনাদের সুযোগ আসবে।
শেখ মুজিবুর রহমান :
নিশ্চয়ই সেই সময় খুব শিগগিরই আসছে। তাঁরা দৈবক্রমে ক্ষমতায় এসেছে। কিন্তু আমরা ক্ষমতায় আসবো দৈবক্রমে নয়। আমাদের অনেক ভোগান্তি হয়েছে এবং আমাদের ক্ষমতায় আসার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে। আপনারা বলতে কি অপ্রত্যাশিতভাবেই ক্ষমতায় এসেছেন এবং এর পেছনে ছিল আপনাদের দুরভিসন্ধিমূলক কর্মকান্ড এ চক্রান্ত। আমরা অনেক দুঃখ-কষ্ট করেছি, আমরা বুলেটের আঘাত সয়েছি এবং নিশ্চয়ই আমরা ক্ষমতায় আসবো। তাহলেই কেবল জনগণের প্রতিনিধিরা ক্ষমতায় আসবে। আপনারা কোনো সময় কিছু লোককে ধোঁকা দিতে পারেন, কিন্তু আপনারা সব সময় সকলকে ধোঁকা দিয়ে যেতে পারেন না।
আমি আপনাকে বলতে পারি: মহোদয়, আপনি ইউনাইটেড ফ্রন্ট এর অন্যতম সদস্য, এঁরা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে এই র্মে প্রতিশ্র“তি দিয়েছিলেন যে তাঁরা ৯২-ক ধারা বিলুপ্তির পক্ষে থাকবেন এবং গভর্ণর জেনারেলকে ক্ষমতা প্রদানের বিরুদ্ধে থাকবেন। পূর্ববঙ্গে যখন সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তখন সেখানে এই প্রতিশ্র“তিই দেওয়া হয়েছিলো।
পাকিস্তান সরকার মাত্র দু’মাস পরেই পূর্ববঙ্গে ৯২-ক ধারা আরোপ করে। কেন্দ্রের স্বার্থান্বেষী মহল পূর্ববঙ্গে ৯২-ক ধারা জারি করে জনগণের কল্যাণের জন্য নয়, বরং তা করে নিজেদের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য। আপনারা কোনো রকম ভোগান্তির শিকার হননি, হয়েছি আমরা এবং তা যথেষ্ট পরিমাণেই হয়েছি। আমরা তাঁকে ক্ষমতা প্রদান করতে প্রস্তুত আছি, কিন্তু গভর্ণর জেনারেলকে নয়। আমি আমার বন্ধু জনাব আলীমকে ব্যক্তিগত ভাবে কিছু বলতে চাই না। তিনি আমার একজন বড় রকমের বন্ধু। তিনি যদি এতে কিছু মনে করেন, তাহলে আমি তা কিছুতেই বলবো না।
জনগণ তাদের প্রতিনিধিদের নির্বাচন করেছেন, আর এক সুপ্রভাতে আমরা খবরের কাগজে দেখছি গভর্ণর জেনারেল সন্তোষ প্রকাশ করেছেন এবং ৯২-ক ধারা জারি করা হয়েছে এবং অনেককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে আমি গণতন্ত্রের নামে, পাকিস্তানের নামে তাঁদের কাছে আবেদন জানাবো; আপনারা ব্যক্তিবিশেষকে ক্ষমতা অর্পণ করবেন না, যিনি আপনাদের প্রতিনিধি নন।
বন্ধুগণ, আমি আপনাদের হুঁশিয়ার করে দিতে চাই, সেই সময় আসন্ন যখন আপনারা ফল ভোগ করবেন। সেই কারণে আমি আপনার কাছে এই মর্মে আবেদন জানাচিছ যে আপনার নিজের খাতিরে, দেশের খাতিরে এবং নিজের মান-সম্মানের জন্য এই সংশোধনী গ্রহণ করুন। এই ক’টি কথা বলে আমি আনীত সংশোধনীর প্রতি আমার সমর্থন জ্ঞাপন করছি।
মি. স্পিকার :
এখন মাগরিব নামাজের জন্য অধিবেশনের বিরতি।

আরও পড়ুন: