আজকের আলোচনার বিষয় শ্রুতি। মানুষ অসংখ্য নাদ (ধ্বনি) শুনতে পায়। কিন্তু আমাদের কানের স্বাভাবিক ক্ষমতা দিয়ে খুব সূক্ষ্মভাবে আলাদা করতে পারা যায় মাত্র ২২টি ভিন্ন ধ্বনি। এগুলোকেই বলা হয় শ্রুতি।
অর্থাৎ—
শ্রুতি হচ্ছে সঙ্গীতের ক্ষুদ্রতম স্বরভেদ, যা কানে ধরা যায়।
পাশাপাশির দুটি শ্রুতির মধ্যে পার্থক্য অত্যন্ত সূক্ষ্ম। মনোযোগ দিয়ে না শুনলে সাধারণ শ্রোতার পক্ষে এ পার্থক্য উপলব্ধি করা কঠিন।
ভারতীয় শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে বলা হয়: “শ্রুতি বিনা রাগ-সঙ্গীত অচল।” কারণ রাগের স্বরের ভেদাভেদ, কোমল-শুদ্ধতার সূক্ষ্মতা আসলে শ্রুতির ওপরেই প্রতিষ্ঠিত।

শ্রুতি
শ্রুতির গুরুত্ব:
শ্রুতি হলো স্বরের ভিত্তি। সপ্তস্বর (সা, রে, গ, ম, প, ধ, নি)-এর সূক্ষ্ম বিভাজনেই শ্রুতির জন্ম।
হিন্দুস্থানি শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে শ্রুতিকে বলা হয় ‘স্বরের প্রাণ’।
যদিও প্রাথমিক স্তরে শ্রুতি নিয়ে আলাদা করে পড়াশোনার প্রয়োজন নেই, তবুও শ্রুতির নামগুলো অত্যন্ত কাব্যিক এবং সঙ্গীতপ্রেমীদের জন্য আকর্ষণীয়।
২২ শ্রুতির তালিকা:
শ্রুতির নামগুলো যেহেতু অসম্ভব সুন্দর, তাই আপনাদের জানানোর লোভ সামলাতে পারছি না। শুধুমাত্র জেনে রাখার জন্য শ্রুতির তালিকাটি দিলাম :
১) তীব্রা
২) কুমুদ্বতী
৩) মন্দা
৪) ছন্দবতী
৫) দয়াবতী
৬) রঞ্জনী
৭) রক্তিকা
৮) রৌদ্রী
৯) ক্রোধী
১০) বজ্রিকা
১১) প্রসারিণী
১২) প্রীতি
১৩) মার্জ্জনী
১৪) ক্ষীতি
১৫) রক্তা
১৬) সন্দিপনী
১৭) আলাপনী
১৮) মদন্তী
১৯) রোহিনী
২০) রম্যা
২১) উগ্রা
২২) ক্ষোত্তিনী
সাত স্বরের মধ্যে ২২ শ্রুতি বিভাজন:
| স্বর | শ্রুতির সংখ্যা | শ্রুতির নাম | 
|---|---|---|
| ষড়জ (সা) | ৪ | তীব্রা, কুমুদ্বতী, মন্দা, ছন্দবতী | 
| ঋষভ (রে) | ৩ | দয়াবতী, রঞ্জনী, রক্তিকা | 
| গান্ধার (গা) | ২ | রৌদ্রী, ক্রোধী | 
| মধ্যম (মা) | ৪ | বজ্রিকা, প্রসারিণী, প্রীতি, মার্জ্জনী | 
| পঞ্চম (পা) | ৪ | ক্ষীতি, রক্তা, সন্দিপনী, আলাপনী | 
| ধৈবত (ধা) | ৩ | মদন্তী, রোহিনী, রম্যা | 
| নিষাদ (নি) | ২ | উগ্রা, ক্ষোত্তিনী | 
ব্যাখ্যা:
মোট ২২টি শ্রুতি সাতটি স্বরের মধ্যে বণ্টিত।
প্রতিটি স্বরের “শুদ্ধ” বা “কোমল/তীব্র” রূপ আসলে এই শ্রুতির সূক্ষ্ম ব্যবধান থেকেই তৈরি।
যেমন—রে, গা, ধা, নি-র কোমল রূপ এবং মা-র তীব্র রূপ আসলে শ্রুতির সামান্য ওঠা-নামা।
এজন্য বলা হয়—“শ্রুতি হলো রাগের প্রাণ”।
রাগের মধ্যে শ্রুতির ব্যবহারের উদাহরণ:
| স্বর | শ্রুতি সংখ্যা | শ্রুতির ভেদ | রাগে ব্যবহারিক উদাহরণ | 
|---|---|---|---|
| ষড়জ (সা) | ৪ | তীব্রা, কুমুদ্বতী, মন্দা, ছন্দবতী | সা সাধারণত ভিত্তি স্বর, যেমন ভূপালী, ইয়ামন, ভৈরব সব রাগেই এর ভিন্ন ভিন্ন সূক্ষ্মতা অনুভূত হয়। | 
| ঋষভ (রে) | ৩ | দয়াবতী, রঞ্জনী, রক্তিকা | ভৈরব রাগে কোমল ঋষভ (অত্যন্ত গম্ভীর), দরবারী কানাড়ায় সূক্ষ্ম ঋষভ ব্যবহৃত হয়। | 
| গান্ধার (গা) | ২ | রৌদ্রী, ক্রোধী | ভূপালীতে শুদ্ধ গা, ভৈরবীতে কোমল গা ব্যবহৃত হয়। বাগেশ্রী রাগের সৌন্দর্য নির্ভর করে কোমল গানের টানে। | 
| মধ্যম (মা) | ৪ | বজ্রিকা, প্রসারিণী, প্রীতি, মার্জ্জনী | ইয়ামনে তীব্র মা, ভূপালীতে শুদ্ধ মা, ভৈরবীতে গম্ভীর মা। | 
| পঞ্চম (পা) | ৪ | ক্ষীতি, রক্তা, সন্দিপনী, আলাপনী | ভূপালীতে শুদ্ধ পা, মালকোষে পঞ্চম বর্জিত; তাই রাগের চরিত্র অনেকটা বদলে যায়। | 
| ধৈবত (ধা) | ৩ | মদন্তী, রোহিনী, রম্যা | ভৈরবীতে কোমল ধৈবত, ভূপালীতে শুদ্ধ ধৈবত, মুলতানিতে ধৈবতের বিশেষ টান থাকে। | 
| নিষাদ (নি) | ২ | উগ্রা, ক্ষোত্তিনী | ভূপালীতে শুদ্ধ নিষাদ, ভৈরবীতে কোমল নিষাদ, বাগেশ্রীতে কোমল নি অত্যন্ত আবেগময়। | 
রাগের মধ্যে ২২ টি শ্রুতির ব্যবহার:
| ক্র. | শ্রুতি নাম | স্বর বিভাগ | রাগে ব্যবহারিক উদাহরণ | 
|---|---|---|---|
| ১ | তীব্রা | ষড়জ (সা) | ভূপালী, ইয়ামন – সা-এর তীব্র শক্তিশালী রূপ | 
| ২ | কুমুদ্বতী | ষড়জ (সা) | দরবারী কানাড়া – সূক্ষ্ম নিচু সা | 
| ৩ | মন্দা | ষড়জ (সা) | ভৈরব – সা’র গম্ভীর ভাব | 
| ৪ | ছন্দবতী | ষড়জ (সা) | বাগেশ্রী – সা তে কোমল টান | 
| ৫ | দয়াবতী | ঋষভ (রে) | ভৈরব – কোমল ঋষভ (অত্যন্ত গভীর) | 
| ৬ | রঞ্জনী | ঋষভ (রে) | বিলাসখানি টোড়ি – সূক্ষ্ম ঋষভের ব্যবহার | 
| ৭ | রক্তিকা | ঋষভ (রে) | দরবারী কানাড়া – রে’র টান | 
| ৮ | রৌদ্রী | গান্ধার (গা) | ভৈরবী – কোমল গান্ধার | 
| ৯ | ক্রোধী | গান্ধার (গা) | ভূপালী – শুদ্ধ গান্ধার | 
| ১০ | বজ্রিকা | মধ্যম (মা) | ইয়ামন – তীব্র মধ্যম | 
| ১১ | প্রসারিণী | মধ্যম (মা) | ভূপালী – শুদ্ধ মধ্যম | 
| ১২ | প্রীতি | মধ্যম (মা) | ভৈরব – কোমল ধা’র সঙ্গে মা’র টান | 
| ১৩ | মার্জ্জনী | মধ্যম (মা) | মুলতান – বিশেষ মা’র টান | 
| ১৪ | ক্ষীতি | পঞ্চম (পা) | ভূপালী – শুদ্ধ পঞ্চম | 
| ১৫ | রক্তা | পঞ্চম (পা) | কফি – পঞ্চমে রসালো ভাব | 
| ১৬ | সন্দিপনী | পঞ্চম (পা) | ইয়ামন – পা’র উজ্জ্বল ব্যবহার | 
| ১৭ | আলাপনী | পঞ্চম (পা) | তোড়ি – পঞ্চমে আবেগ | 
| ১৮ | মদন্তী | ধৈবত (ধা) | ভৈরব – কোমল ধৈবত | 
| ১৯ | রোহিনী | ধৈবত (ধা) | ভূপালী – শুদ্ধ ধৈবত | 
| ২০ | রম্যা | ধৈবত (ধা) | মুলতান – ধৈবতের উজ্জ্বল রূপ | 
| ২১ | উগ্রা | নিষাদ (নি) | ভৈরবী – কোমল নিষাদ | 
| ২২ | ক্ষোত্তিনী | নিষাদ (নি) | ভূপালী, ইয়ামন – শুদ্ধ নিষাদ | 

শ্রুতিগুলোর ফ্রিকোয়েন্স বা কোন স্বর কোন শ্রুতিতে পড়বে সেটার বিস্তারিত উইকিপিডিয়ার Shruti (music) আর্টিকেলে দেয়া আছে।
শ্রুতিগুলো আলাদা করে শুনতে চাইলে অনলাইনে একটা দারুন ব্যবস্থা আছে। ঘুরো আসুন http://www.22shruti.com এ। ওখানে নিজে বাজিয়ে সবকটি শ্রুতি শুনে নিতে পারবেন।
একটা কারিগরি বিষয় মনে রাখা দরকার। শব্দ জোরে বা আস্তে হলেই শ্রুতি ভিন্ন হবে না। একই ফ্রিকোয়েন্সিতে কিন্তু বেশি ডেসিবেল এ উৎপাদন করা শব্দ একই শ্রুতির মধ্যে পড়বে।

আরও দেখুন:
