সাইবার ক্রাইম নিয়ে আজ বলবো। ডিজিটাল বাংলাদেশের নিয়ে যখন কথা হচ্ছে, তার অন্যতম চ্যালেঞ্জ নিয়েও কথা হোক। বাড়ছে কম্পিউটার, বাড়ছে মোবাইল ফোন, সেই সাথে বাড়ছে ইন্টারনেট, এসএমএসসহ অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর সংখ্যা। গত কয়েক বছর আগেও যেখানে কম্পিউটার ব্যবহার হতো শুধুমাত্র টাইপরাইটার হিসাবে, সেখানেই এখন কম্পিউটার ব্যবহার হচ্ছে কোটি টাকার হিসাব ও তার চেয়ে দামী তথ্য সংরক্ষণে। বর্তমান সরকারের যুগান্তকারী ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের কর্মসূচী প্রতিটি ক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারকে আরও ত্বরান্বিত করবে বলে অনুমান করছে জনগণ। প্রযুক্তির এই বিপ্লব নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য বয়ে আনছে স্বাচ্ছন্দ্য, স্বাধীনতা, গতি ও উন্নয়ন। এই উৎকর্ষতার পাশাপাশি অত্যন্ত নিরবে বেড়ে উঠছে এটির অন্ধকার জগতের ঝুঁকি। যার নাম সাইবার ক্রাইম।

সাইবার ক্রাইম শব্দটি শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়, উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশের প্রান্তিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারকারির কাছে স্বল্প পরিচিত হলেও তথ্য প্রযুক্তিবিদদের কাছে এটি অতি পরিচিত ও ভীতিকর শব্দ। এ বিষয়ে জানা থাক বা না থাক, এর শিকার হচ্ছে প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারকারী। তবে সাইবার অপরাধ বিশ্বে নতুন ধরণের কোন অপরাধ নয়, শুধুমাত্র মাধ্যমটি ভিন্ন। অন্যান্য সাধারণ অপরাধ (যেমন, তথ্য চুরি, তথ্য বিকৃতি, প্রতারণা, ব্লাকমেইল, অর্থ চুরি ইত্যাদি) তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে করা হলে সেগুলোকে সাধারণ ভাষায় সাইবার অপরাধ বলা হয়।
সাইবার ক্রাইম : ডিজিটাল বাংলাদেশের অন্যতম চ্যালেঞ্জ
সরাসরি টাকা চুরি করার বদলে কম্পিউটার বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে ব্যাংকের সার্ভারে ঢুকে অন্য একাউন্টে ট্রান্সফার করে নেওয়া, কারও রুমে ঢুকে ফাইল চুরি করে আনার বদলে তার কম্পিউটারে ঢুকে ফাইল চুরি করে নেওয়া, এছাড়া কারও ঘরে আগুন দিয়ে সকল ফাইল জ্বালিয়ে দেবার বদলে ভাইরাস ঢুকিয়ে কম্পিউটার ক্র্যাশ করে দেওয়া সাইবার অপরাধের সাদামাঠা উদাহরণ। এখানে অপরাধ একই শুধুমাত্র ভিন্ন একটি মাধ্যমে সংগঠিত করা হয়।

অন্যান্য অপরাধের মত সাইবার ক্রাইম শখের বশে, প্রতিহিংসা পরায়ন হয়ে, অর্থলোভে বা যে কোনো কারণে ঘটতে পারে। তবে বাংলাদেশে যতগুলো ঘটনা জনসমক্ষে এসেছে, তার বেশির ভাগই হয়েছে শৌখিন ও কাঁচা হ্যাকার/ ক্র্যাকারদের দ্বারা। তবে গত দুই বছরে কয়েকটি অর্থ ও তথ্য প্রযুক্তি সেবাদানকারি প্রতিষ্ঠানে কিছু বড় অপরাধ ঘটেছে, যা প্রতিষ্ঠানের সুনামের দিকে লক্ষ্য রেখে জনসমক্ষে আনা হয়নি এবং ব্যবহারকারীরাও বিষয়টি বুঝে উঠতে পারেনি। কিন’ ঝুঁকি যে বাড়ছে এই বিষয়টি পরিষ্কার। যে কোনো দেশের শুরুর দিকের প্রবণতা এরকম থাকে যা আস্তে আস্তে তা ভয়ানক রূপ নেয়।
ভাইরাস, প্রতারণা, তথ্য বিকৃতি, তথ্য চুরি ও পাচারসহ লক্ষ অপরাধের শিকার হচ্ছে প্রতিদিন প্রান্তিক তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারকারী। সামাজিক ও অন্যান্য ক্ষতি তো রয়েছেই। তবে ব্যবসা-বাণিজ্যে, আর্থিক কারবার ও রাজনৈতিক বিষয়ে সংগঠিত অপরাধগুলো সবচেয়ে বেশি সামনে এসেছে। শুধুমাত্র বহিঃবিশ্বেই নয় বাংলাদেশেও গত কয়েক বছরে ঘটে গেছে কয়েকটি চাঞ্চল্যকর সাইবার ক্রাইম। পরিচয় লুকিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে (বিরোধী দলীয় নেত্রী থাকাকালীন) ই-মেইল হুমকি, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ওয়েব সাইট হ্যাক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য ও ছবি চুরিসহ আরও অনেক ন্যক্কারজনক ঘটনা।

এরকম বড় খবর ছাড়াও প্রতিটি তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারকারীর জানার বাইরে তার কম্পিউটারে ঘটে যাচ্ছে নানা ধরণের ঘটনা। নিজের অজান্তেই ব্যবহারকারী পরিণত হচ্ছে কোন সার্ভে টিমের সদস্যে, অথবা কোন অপরাধীর ব্যবহৃত অস্ত্রে। এগুলো তদন্তের প্রয়োজনীয় ব্যবসা না থাকায় বেশিরভাগ অপরাধ অজানা থেকে যাচ্ছে।
প্রতিবছর বিশ্বব্যাপি এসব অপরাধের মাধ্যমে বিলিয়ন ডলারের অর্থনৈতিক ক্ষতি হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে বিভিন্ন সংস্থা প্রতি বছর সারা বিশ্বে সাইবার ক্রাইমের কারণে অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণের জরিপ প্রকাশ করে। কম্পিউটার ইকোনোমিক্স এর জরিপ অনুযায়ী ২০০৬ সালে শুধুমাত্র ভাইরাসজনিত ক্ষতি হয়েছিল ১৩.৩ বিলিয়ন ডলার। প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্বে যেহেতু তথ্য বা অর্থ কাগজের বদলে প্রযুক্তির মাধ্যমে সংরক্ষণ করা হচ্ছে, তাই এই অপরাধের শিকার ওরাই বেশি। এ পর্যন্ত বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া সাইবার অপরাধগুলো অর্থনৈতিক মূল্যমানে বড় ছিল না কারণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনা এখন পর্যন্ত পুরোপুরি তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর নয় এবং এই ক্ষতির পরিমাণ নিরূপনেরও ব্যবস্থাও নেই। কিন্তু বর্তমানে উন্নত বিশ্বের ক্ষতি দেখে আমাদের আগত ক্ষতির সম্ভাবনা সহজেই নির্ণয় করা যায়।
তাই দেরি হলেও অনেক বেশি দেরি হয়ে যাবার আগে রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক এমনকি ব্যক্তিগত পর্যায়েও কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কারণ তথ্য প্রযুক্তি বর্তমান ও ভবিষ্যতের বাস্তবতা, যা আলিঙ্গন করা ছাড়া, অস্বীকার করার কোন সুযোগ নেই। তাই প্রযুক্তির উৎকর্ষকে সুখকর করার জন্য প্রযুক্তি ব্যবহারের নিরাপত্তাও বাস্তবিক চাহিদা। এছাড়া তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর ব্যবসা বাণিজ্য বা এই শিল্পকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অবকাঠামো ও সুবিধাদির উন্নয়নের পাশাপাশি এর প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। কারণ এর ফলে শুধু সামাজিক নিরাপত্তা ও তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর আভ্যন্তরীন ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না এর প্রভাব পড়বে বৈদেশিক বিনিয়োগে।

সামপ্রতিক আইটি ম্যানেজমেন্ট এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ ও বাংলাদেশ পুলিশের যৌথ উদ্যোগে দুইদিন ব্যাপি সাইবার ক্রাইম বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। যেখানে উপস্থিত ছিলেন পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ বাংলাদেশের শীর্ষ তথ্য প্রযুক্তির পেশাজীবীরা। সেখানে আমরা দেখেছি যে এই বিষয়ে রাষ্ট্রীয়, প্রাতিষ্ঠানিক ও ব্যক্তিগত পর্যায়ের অজ্ঞতা সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ। সেই সাথে রাষ্ট্রীয় সাইবার আইন, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার দক্ষতা ও উপকরণের অভাব, রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামো ও উদ্যোগের অভাব, যোগাযোগ প্রযুক্তি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর (আই.এস.পি ও টেলিকম কোম্পানিগুলোর) দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডতো রয়েছেই।
এই কর্মশালায় সাইবার অপরাধ ও তার প্রতিকার এবং প্রতিরোধের উপর বিস্তারিত আলোচনা হয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সাইবার অপরাধের সবচেয়ে বড় ঝুকি হলো তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহারকারীদের সনাক্তকরণের উপায়। সেবা গ্রহণ থেকে শুরু করে সেবা ব্যবহার কালে ব্যবহারকারীর গতিবিধি রেকর্ড করার যথেষ্ট ব্যবস্থানেই। অপরাধীরা নিজেদের পরিচয় লুকিয়ে এখনো সহজেই মোবাইল ফোন বা ইন্টারনেট সেবা গ্রহণ ও ব্যবহার করতে পারে।
আমাদের প্রান্তিক ব্যবহারকারীদের সাইবার অপরাধ প্রতিকার বা প্রতিরোধের জন্য এন্টি ভাইরাস ও ব্যক্তিগত ফায়ারওয়াল ব্যবহারসহ সাধারণ কম্পিউটার সিকিউরিটি টিপস (কিছু ঠিকানা) গুলো অনুসরণ করলে মোটামুটি নিশ্চিত থাকতে পারেন। কিন্তু মূল চ্যালেঞ্জগুলো হচ্ছে রাষ্ট্রীয় ও প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আইন, অবকাঠামো ও জনশক্তি এই তিন পর্যায়েই কাজ করা দরকার। যেভাবে প্রয়োজন অনুযায়ী তথ্য পরিবহন নিয়ন্ত্রণ করতে হবে ঠিক একই ভাবে তথ্য অধিকারের বিষয়গুলিও মাথায় রাখতে হবে । যেকোনো পলিসি ও সিস্টেমের পরিকল্পনা করার আগে মাথায় রাখতে হবে যে ‘প্রতিটি ব্যবহারকারী তার প্রয়োজনীয় তথ্যগুলো যেন খুব সহজে পায়, আর যেই তথ্য ওই ব্যক্তির দেখবার অধিকার নেই সে যেন কোনভাবেই দেখতে না পারে’।
এই মূহুর্তে সর্বপ্রথম প্রয়োজন একটি সাইবার আইন। অবকাঠামো ও অন্যান্য বিষয়গুলির পরিবর্তনের সাথে সাথে সেই আইনের সংশোধনের মাধ্যমে একটি পরিণত আইন তৈরি হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বেও অন্যান্য দেশগুলোর উদাহরণ দেখলে দেখা যাবে যে প্রতিটি উন্নত দেশে ও অনেকগুলো উন্নয়নশীল দেশের অবকাঠামোর সাথে সঙ্গতি রেখে সাইবার আইন করা হয়েছে। আবার কিছু ক্ষেত্রে আইনের মাধ্যমে (বিশেষ করে বেসরকারী পর্যায়ে) কিছু অবকাঠামো তৈরি করতে বাধ্য করা হয়েছে। এই দুই ধরণের প্রণালী অনুসরণ করে আমাদের প্রতিবেশি রাষ্ট্র ভারতে সাইবার আইন তৈরি করেছিল যা এখন যথেষ্ট পরিণত।
তবে তারা তথ্য প্রযুক্তি আইনের অংশ হিসাবেই সাইবার আইন তৈরি করেছিল ২০০০ সালে। শুরুতে শুধুমাত্র প্রচলিত পিনাল কোডের উল্লেখিত অপরাধগুলোকে নিয়ে কাজ করলেও পরবর্তিতে তাতে তথ্য প্রযুক্তি নির্ভর বিশেষ অপরাধগুলোও সন্নিবেশিত হয়েছে। এছাড়াও কিছু বিষয় বিশেষভাবে বিবেচনায় নেওয়া দরকার যার মাধ্যমে তথ্য প্রযুক্তির মাধ্যমে সংঘঠিত অপরাধের তদন্ত ও তথ্য প্রমাণ সংগ্রহের নির্দেশনা সেই সাথে প্রাপ্ত প্রমাণের এভিডেন্সিয়াল ভ্যালু বিবেচনা।

আইনের সাথে সাথে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো ও আইনের প্রয়োগের বিষয়টি সরাসরি এসে যায়। এই আইনের সঠিক বাস-বায়নের জন্য জাতীয় তথ্য প্রযুক্তি অবকাঠামোর পাশাপাশি বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোর প্রয়োজনীয় পরিবর্ধন ও পরিমার্জন প্রয়োজন। তথ্য প্রযুক্তি সেবার প্রতিটি অংশ (সার্ভার, স্টোরেজ, নেটওয়ার্ক, ইত্যাদি) ও প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার নীতিমালা এই আইনের সাথে সামঞ্জস্যপুর্ণ হতে হবে। তথ্য প্রযুক্তি সেবাদানকারী ও ব্যবহারকারী উভয়েরই এই বিষয়ে সচেনতা তৈরি করা দরকার।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো এই ধরণের অপরাধ তদন্তের জন্য প্রয়োজনীয় উপকরণ ও প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করতে হবে। এই বিষয়টি নিয়ে কাজ করা স্বেচ্ছাসেবী দেশীও ও আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর সাথে সরকারের কাজ করার মত সম্পর্ক নিশ্চিত করতে হবে। এ সকল বিষয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে না পারলে এ ধরণের অপরাধের সঠিক বিচার নিশ্চিত করা প্রায় অসম্ভব।
দেশের তথ্য প্রযুক্তি পেশাজীবি সহ সকল মানুষ ডিজিটাল বাংলাদেশের শ্লোগানে অত্যন্ত আশাবাদী এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। তাই এই উদ্যোগকে বাস্তবায়ন করতে হলে সরকারকে সাইবার ক্রাইম বিষয়টিতে বিশেষ বিবেচনা দেয়া প্রয়োজন। তা না হলে অনেক ভালো উদ্যোগ মাঝ পথে মুখ থুবড়ে পড়তে পারে। এ বিষয়ে আশার কথা এই যে জাতীয় তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালা- ২০০৯ এর একটি কর্ম পরিকল্পনার অংশ হিসাবে সাইবার আইনের বিষয়টি যুক্ত হয়েছে। বাস্তবায়নের জন্য আইন ও তথ্য প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের পাশাপাশি তথ্য প্রযুক্তি সম্পৃক্ত পেশাদার, ব্যবসায়ী ও মিডিয়াকে এগিয়ে আসতে হবে।
আরও পড়ুন: