হাজার বছরের সংস্কৃতি – টার্মটা নিয়ে কথা উঠলেই কিছু অযোক্তিক বিতর্ক করতে দেখা যায়। তাদের কথা হচ্ছে – হাজার বছর ধরেই আপনারা এমনে রান্না করতেন? এমনে খাইতেন? এমনে কুলি করতেন?
এসব বিতর্ক ফালতু। যারা এই প্রশ্ন করে, তাদের সংস্কৃতি বিষয়টা পরিস্কার হওয়া দরকার আগে।
হাজার বছরের সংস্কৃতি মানে, হাজার বছর ধরে একই রকম থাকে, বিষয়টা এমন না।
সেই সংস্কৃতিই মানুষ ধারণ করে যেটা জীবন্ত। আর জীবন্ত সংস্কৃতি মানে প্রতিনিয়ত বদলাতে থাকা। প্রবাহমান নদীর মত। থেমে যাওয়া মানেই মারা যাওয়া।
ভাষা, সাহিত্য, সংগীত থেকে আরম্ভ করে অভিনয়, চিত্রকলা, কারুকলা, স্থাপত্য ইত্যাদি নানা উপাদান দিয়ে গঠিত হয় আমাদের সংস্কৃতি। ধর্ম, সামাজিক মূল্যবোধ, লোকাচার, লোকবিশ্বাস, খাদ্যাভ্যাস, পোশাক-আশাক, চলন-বলন, ব্যবহার্য উপকরণ এবং হাতিয়ার- এগুলোও সংস্কৃতির উপাদান। আপনার নিজের প্রতিদিনের জীবনেই একটু তাকিয়ে দেখুন, এই সবকিছুই কতটা বদলেছে। তাহলে হাজার বছর কতটা বদল সম্ভব?
সামান্য সময় আমার জীবন। এই জীবদ্দশায় দেখলাম, মূলধারার ভাষায় কত বদল! রেডিও, টেলিভিশন, ফিল্মে ভাষা বদলে গেল। ধর্মের কথায় ছবি তোলা হারাম থেকে শুরু করে ভিডিও করা হালাল হয়ে গেল।
আমাদের শাস্ত্রীয় সঙ্গীত প্রায় ৬ হাজার বছরের। তার মানে কি ৬০০০ বছর ধরে একই রকম রাগ, সুর, তাল, গায়কী চলছে? একদম না। পুরানো বাদ দিলাম। ১২ শতকে লেখা প্রামাণ্য সঙ্গীত শাস্ত্র “সঙ্গীত রত্নাকর” এ উল্লেখিত রাগ গুলোর সাথে আজকের গাওয়া বাজানো রাগের মিল নেই বললেই চলে। সঙ্গীতের ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখবেন ৭০/৮০ বছর পর পর গান বদলেছে, গায়কি বদলেছে।
হাজার বছরের সংস্কৃতি মানে কী?
চর্যাপদ এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া আমাদের প্রাচীনতম সাহিত্য। কিন্তু আজকের জানা বাংলা দিয়ে সেটা কি পড়া সম্ভব? না, সম্ভব নয়। কারণ একই, বদলে গেছে।
বঙ্কিমের লেখা আমার ছেলে বুঝতে পারবে না। আমার নাতি হয়তো রবীন্দ্রনাথের লেখা ভাষায়, রবীন্দ্রনাথ পড়ে বুঝতে পারবে না।
নাস্তালিক রুসমুলখাতে ফার্সি-উর্দু লেখা হতো। সেই প্রতাপশালী বর্ণমালা এখন সংখ্যালঘু। ফার্সি তো গেছেই। এই যুগের উর্দু কবিদের অনেকেই রোমানে লেখেন। উর্দুতে শব্দ জুড়ে নতুন শব্দ বানানোর রেয়াজ মৃতপ্রায়, আজ কোন উর্দু কবি লিখবেন না “উফাক পে খুন-এ-তামান্না-এ-দিল”। বাংলায় রবীন্দ্রনাথের মতো কোন কবি “আপক্কধান্যভারনম্র” টাইপ শব্দ বানানোর সাহস করবেন না।
ভাষার প্রকাশভঙ্গী বদলায়, শব্দ বদলায়, এমনকি বর্ণও বদলায়। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় অবিকৃত থাকে পদবিন্যাস (syntax); তাও বদলায়।
এখন আসি পরের প্রশ্নে।
সব যদি এভাবে বদলেই যায় তবে হাজার বছরে থাকে কি?
থাকে পরিচয়, থাকে বিবর্তনের অভিজ্ঞতা, তা থেকে সৃষ্ট প্রজ্ঞা, পরিশোধিত সর্বশেষ সংস্করণ। সেটাই সম্পদ।
সেই সম্পদ কি কাজে লাগে?
সেই সম্পদের ভিত্তির উপরে দাড়িয়ে উন্নততর ভবিষ্যৎ নির্মিত হয়। যেটা একটি শক্ত বিল্ডিং এর জন্য ফাউন্ডেশনের মতই জরুরী।
এজন্যই আমরা হাজার বছরের সংস্কৃতি বলি।
আরও পড়ুন: