বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের মার্চ মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, March]

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের মার্চ মাস – এসময় বঙ্গবন্ধুর দেয়া সব ভাষণের এর একটা সংগ্রহশালা তৈরির চেষ্টা করছি। যেগুলো আমার কাছে আছে তা তুলে দিলাম।

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের মার্চ মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, March]

১৯৭২ সালের ৬ মার্চ রাশিয়া থেকে সফর শেষে ঢাকা বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান | Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman : বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের মার্চ মাস
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান | Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman

বাংলাদেশের ভাই ও বোনেরা, ৫ দিনের সফর শেষে রাশিয়া থেকে আমি আমার মরুভূমিতে ফিরে এসেছি। যে ভালবাসা রাশিয়ার সরকার এবং জন সাধারণের কাছ থেকে আমি এবং আমার সহকর্মীরা পেয়েছি, সে ভালবাসা শুধু আমাকে দেখানো হয় নাই, সাড়ে সাত কোটি বাংলার জন সাধারণকে দেখানো হয়েছে। আমার এ সফর অত্যন্ত সাফল্যমন্ডিত হয়েছে এবং দুই দেশের মঙ্গলের জন্য নয় বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের মঙ্গলের জন্য আমাদের বন্ধুত্ব অটুট এবং অক্ষয় হয়ে থাকবে।

সোভিয়েতের জনসাধানণ, তার সরকার যে কয়দিন ছিলাম লেলিন সাহেব, তাসখান মস্কোতে যে আদর আপ্যায়ন করেছেন এবং তারা আমাদের যে দেশের জনসাধারণ স্বাধীনতার জন্য যে সংগ্রাম করেছে, যে রক্ত দিয়েছে, যে ত্যাগ স্বীকার করেছে সে খবর তারা জানে  এবং প্রত্যেক রাশিয়ার জনগণ তা জানে। রাশিয়ার জনসাধরণ আমার বাংলার জনসাধারণকে সে জন্য শ্রদ্ধা করে। এজন্য শ্রদ্ধা করে যে রাশিয়াও রক্তের মাধ্যমে সংগ্রামের মাধ্যমে বিপ্লবের মাধ্যমে তার দেশকে মুক্ত করেছে।

সেজন্য তাদের সঙ্গে সাতকোটি বাংলার মানুষও রক্ত দিয়ে সংগ্রামের মাধ্যমে, স্বসস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে তার সাতে সাত কোটি মানুষকে মুক্ত করেছে। সেজন্য তাদের সঙ্গে আমাদের অনেকটা নীতির মিল রয়েছে। আপনারা আমাদের এই বন্ধুত্ব সোভিয়েত রাশিয়া অত্যন্ত, আমার এই ভ্রমনটা এবং আমি সেখানে গিয়েছিলাম সেটা অত্যন্ত ফলপ্রসূ হয়েছে এবং আমাদের এইভাবে আলোচনা আরো ভবিষ্যতে চলতে থাকবে এবং দুনিয়ার শান্তি রক্ষার জন্য বাংলাদেশ সোভিয়েত রাশিয়া পাশাপাশি কাজ করবে, এতে কোন সন্দেহ নাই।

আমি বাংলাদেশের জনসাধারণের পক্ষ থেকে সোভিয়েতের সরকার বিশেষ করে তাদের প্রধানমন্ত্রী এবং তাদের প্রেসিডেন্ট এবং তাদের কমিউনিষ্ট পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল কার্ণেভ বেজনাবকে এবং তাদের জনসাধারণকে সাড়ে সাতকোটি মানুষের পক্ষ থেকে, বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে জনগণের পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন ও ধন্যবাদ জানাচ্ছি।

তারাও আমাদের এই দুখী মানুষের পাশে দাড়াবেন বলে যে কথা তারা দিয়েছেন, সেজন্য তাদের নিকট আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি এবং আমি এও তাদের জানিয়েছি, যেদিন এই সংগ্রাম শুরু হয়, রাষ্ট্রদ্রোহী সংগ্রাম শুরু হয় সেদিন পাকিস্তানের বর্বর বাহিনী আমাদের দেশেরর জনসাধারণের উপর অত্যাচার শুরু করে।

আমার লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি জনসাধারণকে নির্যাতন করে। যেদিন এক কোটি লোক বাংলা ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল সেইদিন ভারতের জনসাধারণ মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এবং তিনি নিজে আমার এক কোটি লোককে স্থান দিয়েছিলেন, এজন্য আমরা সোভিয়েত রাশিয়ার জনসাধারণ ও সরকারের নিকট চিরকৃতজ্ঞ এবং আমাদের এই বন্ধুত্ব অটুট এবং অক্ষুন্ন থাকবে এবং বিশেষ করে সোভিয়েত রাশিয়া থেকে ফিরে এসেছি, আমি আপনাদের পক্ষ থেকে তাদের নেতৃবৃন্দকে আমন্ত্রণ করেছি, এদেশে আসার জন্য।

প্রাইম মিনিষ্টার কেসিগানকে এবং কমিউনিষ্ট পার্টির সেক্রেটারি বেজনভকে এবং তাদের সভাপতি মডারিকে এবং তাদের বৈদেশিক মন্ত্রী-ফরেন মিনিষ্টার, বিশেষ করে আমার সোনার বাংলাকে সাহায্য করেছিল মিঃ গোমিকোকে ও দাওয়াত করেছি সরকার ও জনসাধারণের পক্ষ থেকে। তারা সুযোগ পেলেই বাংলাতে আসবে বলে ওয়াদা করেছেন। আমরা সেই প্রতিক্ষায় রইলাম। আসলে তাদের আমরা সাদর সম্বর্ধনা জানাব-জয় বাংলা। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ সম্পর্ক অটুট হউক। জয় বাংলা।

 

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয় মহিলা ক্রীড়া সংস্থা আয়োজিত আজিমপুর বালিকা বিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ।

বাংলাদেশ জাতীয় মহিলা ক্রীয়া সংস্থার সদস্যাবৃন্দ আমার বোনেরা, ভাইদের কথা নাই বা বললাম, আমার ছোট ছোট মেয়েরা। ভাইদের কথা বললাম না এইজন্য, তারা সব সময় আমাকে চারদিকে ঘিরে রাখে, মুখে মুখে বলে সবাইর সমান অধিকার, কিন্তু ছাড়তে চায়না অধিকার কাউরে।

আমি আপনাদের সঙ্গে মেশবার সুযোগ পেয়ে এবং আপনাদের কাছে আসতে পেরে সত্যিই খুব আনন্দিত। আর আপনারা যে আমাকে সুযোগ দিয়েছেন সেজন্য আপনাদের আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আপনারা যে সংগঠন করেছেন, সত্যি কথা বলতে কি আমাদের দেশে এ রকম সংগঠনের বিশেষ প্রয়োজন রয়েছে এবং আপনারা একে ভালো করে প্রতিষ্ঠিত করুণ।

সমস্ত বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় মহকুমা, জেলায় এ সংগঠন গড়ে তুলুন। আমি আপনাদের শুধু এটুকু বলতে পারি, আমি কাউকে কোন ওয়াদা করি না, কারণ ওয়াদা করার মতো শক্তি আমার নাই। শুধু এটুকু বলতে পারি আমার দিক দিয়ে যত রকম সাহায্য এবং সহযোগিতা আপনারা পাবেন।

আমি ছোট বোনদের, আমি আমার ছোট বোনদের প্যারেড দেখে সত্যিই খুব সন্তুষ্ট হয়েছি। আপনাদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান দেখে আমি খুব আনন্দিত হয়েছি। আমি আশা করি ভবিষ্যৎ বংশধর, স্বাধীন বাংলাদেশের বংশধর ছেলে এবং মেয়েরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এগিয়ে চলবে। যাতে দুনিয়ার সভ্যরা, যেন বাঙ্গালীরা দেখতে পারে। অন্ধ সংস্কারের আমাদের জাতীয় একটা অর্ধেক অংশকে ঘরের মধ্যে বন্দি করে রেখেছিলাম।

আমরা ধর্মের নামে মিথ্যা কথা বলে আমার মা-বোনদের আমরা দাসি করে রেখেছিলাম। আপনারা নিশ্চিন্তে বিশ্বাস করতে পারেন এই স্বাধীন বাংলাদেশের ভাই-বোন সমান পরিচয়ে পরিচিত হবে এবং হচ্ছে। আপনাদের এগিয়ে আসতে হবে। ছোটবোনেরা লেখাপড়া শিখ। স্বাধীন বাংলাদেশে আজ প্রথম স্বাধীনতা দিবস।

সত্য কথা বলতে পারি নাই। আমি প্রাণ খুলে হাসতে পারি নাই। কি করে হাসব বুলন? স্বাধীনতা, রাজনৈতিক স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে অর্থনৈতিক স্বাধীনতাও দরকার। বাংলার মানুষ আজ দুঃখী। লক্ষ লক্ষ মা-বোন আজ অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাপন করছে। পাকিস্তানের দস্যু বাহিনীরা ইসলামের নামে যে প্রচন্ডতম অত্যাচার আমার বাংলার বুকে করেছে, দুনিয়ার ইতিহাসে তার তুলনা নাই।

আজ আমার দুই লক্ষ বোন নির্যাতিত, আজ আমার ত্রিশ লক্ষ লোক শহীদ হয়েছে। আজ আমার তিন কোটি লোকের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার গুদামে চাল ছিলনা। আমার ব্যাংকে টাকা ছিলনা। আমার বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়ে গেছে। যাবার সময় সর্বস্ব ধ্বংস করে চলে গেছে। ধ্বংস স্তুপের উপরে দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশ গড়ার প্রতিজ্ঞা নিয়ে আমরা অগ্রসর হয়েছি।

আমি আমার বাংলার মানুষের কাছে কৃতজ্ঞ। জনসাধারণ আজ কষ্ট পাচ্ছে। তারাও বুঝে যে এই সরকারের হাতে কিছু নাই। ভীক্ষার ঝুলি নিয়ে দুয়ারে দুয়ারে আজ ঘুরতে হচ্ছে। আপনারা জানেন স্বাধীনতা আমার বৃথা হয়ে যাবে, ত্যাগ আমাদের বৃথা হয়ে যাবে, শহীদের আত্মত্যাগ বৃথা হয়ে যাবে যদি সাতকোটি লোক প্রাণভরে না হাসে, আর সাতকোটি মানুষ যদি পেট ভরে ভাত না খায়।

এই বাংলাদেশ শোষণহীন সমাজ হিসেবে গড়তে হবে। ভাইদের  সঙ্গে সঙ্গে আমাদের গড়তে হবে। ভাইদের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বোনদের এগিয়ে আসতে হবে সেই সংগ্রাম, জাতি গঠনের জন্য।

বিশ্বাস করেন, আপনাদের কাছে কি বলব আমি। আজ বোধহয় আড়াই মাস হলো আমি জেল থেকে বেড়িয়ে আপনাদের কাছে এসেছি। কি এসে পেয়েছিলাম আমি আপনাদের কাজে কিছুই বলতে পারব না। কত কঙ্কাল, কত আর্তনাদ, কত হাহাকার। করে যে ওদের মুখে হাসি ফুটাতে পারব জানি না।

শুধু এতটুকু জানি, বাংলার মানুষের ভালবাসা যেন আমার জীবনের পাথেয় হয়ে থাকে। সেই আশীর্বাদ আপনারা করেন। আমি যদি বুঝতে পারি যে বাংলার মানুষ যে ভালবাসা আমাকে দিয়েছে, সে ভালবাসা থেকে যদি এতটুকু দূরে সরে যাই, আপনারা বিশ্বাস রাখতে পারেন, সেদিন আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী আমি থাকব না।

প্রধানমন্ত্রীত্বের জন্য আমি এই স্বাধীনতার সংগ্রাম করি নাই। আপনারা অনেকেই জানেন প্রধানমন্ত্রী আমি হতে পারতাম অনেকবার। আমি চেয়েছিলাম সুখী সমৃদ্ধশালী শোষণহীন বাংলাদেশ। আপনারা আমার দেশের ভাইয়েরা যারা মৃত্যুবরণ করেছে, শহীদ হয়েছে তাদের রক্তের কথা মনে করে, দুঃখী মানুষের কথা মনে করে আমার বোনেরা আপনারা এগিয়ে চলেন।

দেশকে নতুন করে গড়ে তুলি। দেশের মানুষ আবার হাসুক, দেশের মানুষ আবার শান্তি পাক, দেশের মানুষ আবার পেটভরে ভাত খাক, দেশের মানুস আবার সুখে স্বাচ্ছন্দে বাস করুক।

এখনো দুস্কৃতিকারীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমার পুলিশের শতকরা ৬০ জন পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছে। বাংলাদেশ রাইফেলসের শতকরা ৫৬ জনকে গুলি করে হত্যা করেছে। আমার ছাত্রদের গুলি করে হত্যা করেছে। আমার কৃষকদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমার ছোট ছোট বোনদের, দুধের বাচ্চাদের গুলি করে হত্যা করেছে।

এত বড় পশু দুনিয়ার কোথাও দেখা যায় নাই। যে কাজ করে গেছে, এরমধ্যে পেপারে দেখলাম টিক্কা খান বলেন যে-মাত্র, আমি মাত্র ত্রিশ হাজার লোক মেরেছি। টিক্কা খান, আমি যদি তোমার দেশের ত্রিশ হাজার মা-বোনদের মারতাম। তোমার মনে কেমন লাগত। পশুত্বের একটা সীমা থাকা দরকার। এতে বড় বেহায়া মানুষ কি করে হয়, আমি জানিনা।

বলে মাত্র ত্রিশ হাজার লোক মেরেছি। তুমি পশ্চিম পাকিস্তানে আছ বলে তুমি রক্ষা পেয়েছ। বাংলার বুকে থাকলে তুমি কোনভাবে রক্ষা পেতে না। যুদ্ধের সময় তোমার পশ্চিম পাকিস্তানের নামধারী সৈনিকরা আমার বোনদের ধরে নিয়ে ব্যাঙ্কারে রেখেছে। হাজার হাজার মহিলাকে আমরা উদ্ধার করেছি। কত বড় পশু তোমার লোক। না মানুষ না মানুষের বাইরে।

তোমরা অসভ্য। তোমাদের গালি দেবার ভাষা বাংলা ভাষায় নাই। উর্দূ ভাষায় থাকতে পারে। তাই আমার ছোট বোনেরা, আমার মেয়েরা, আমি বিশ্বাস করি কাজ করে যাবেন। ঘরের একটা আলোর অংশ নারী। আমি দেখেছি আমার জীবনে, যে নারী তার স্বামীকে এগিয়ে দেয় নাই, সে স্বামী জীবনে বড় হতে পারে নাই।

আপনারা এমনভাবে গড়ে উঠুন যে, আপনারা এমন মা হবেন, এমন বোন হবেন যা আপনাদের আদর, আপনাদের ভালবাসা, আপনাদের মনের যে স্বতস্ফুর্ততা তা দিয়ে ভবিষ্যৎ বংশধরদের গড়ে তুলবেন। আমি জীবনে অনেক দেখেছি যে গুলির সামনে আমি এগিয়ে গেলেও কোনদিন আমার স্ত্রী আমাকে বাঁধা দেয় নাই।

এমনও আমি দেখেছি যে, অনেকবার আমার জীবনে দশ এগার বছর আমি জেল খেটেছি, জীবনে কোনদিন মুখ কালা করে প্রতিবাদ করে নাই। তাহলে আমার জীবনে অনেক বাধা আসত। এমন সময় আমি দেখেছি যে, আমি যখন জেলে চলে গিয়েছি, আমি এক আনা পয়সাও দিয়ে যেতে পারি নাই আমার ছেলে মেয়ের কাছে।

আমার জীবনে তার অবদান অনেক রয়েছে। পুরুষের নাম ইতিহাসে অনেক লেখা হয়, মহিলাদের নাম লেখা হয় না। সেজন্য আইজকা আপনাদের কাছে একটু ব্যক্তিগত কথা বললাম। যাতে পুরুষ ভাইরা কোন রকমে সংগ্রাম করে নেতা হন বা দেশের কর্ণধার হন, তাদের মনে রাখা উচিৎ, তাদের মহিলাদেরও যথেষ্ট দান রয়েছে এবং তাদের স্থান দিতে হবে।

এজন্যেই আজ আপনাদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিচ্ছি। আপনারা যে সুযোগ আমাকে দিয়েছেন এই প্রথম স্বাধীনতা দিবসে আপনাদের সকলকে আমি শুভেচ্ছা জানিয়ে বিদায় নেবার আগে বলে যাই যে, আপনারা জানেন স্বাধীনতা পাওয়া যেমন কষ্টকর, স্বাধীনতা রক্ষা করাও তেমনী কষ্টকর।

অনেক শত্রুরা খেলছে কিন্তু আমি বাংলার মানুষকে জানি আর বাংলার মানুষকে আমি ভালবাসি, বাংলার মানুষও আমাকে ভালবাসে। ষড়যন্ত্রকারীরা যতই ষড়যন্ত্র করুক না কেন, বাংরার স্বাধীনতা হরণ করার শক্তি তাদের নাই। ইন্শাল্লাহ আপনারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারেন।

যে মন প্রাণ দিয়ে আপনারা স্বাধীনতা সংগ্রামে এগিয়ে গিয়েছিলেন, সেই মন-প্রাণ দিয়ে এই বাংলাদেশকে সুখী সমৃদ্ধশালী এবং শোষণহীন সমাজ গঠন করার জন্য আপনারা এগিয়ে যান-এই কথা বলেই আমি বিদায় নিচ্ছি।

আপনাদের সংস্থাকে আমার বক্তগত পক্ষ থেকে আমি বলতে পারি, যতটুকু প্রয়োজন সাহায্য করতে আমি চেষ্টা করব। কিন্তু আপনারা মনে রাখবেন বাক্স কিন্তু আমার খালি। তার মধ্য থেকে যা পারা যায়-তাই করা হবে।

আবার ধন্যবাদ। জয় বাংলা।

 

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতীয়করণের নীতি ঘোষণা উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশনে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ

বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বেতার ও টেলিভিশন মারফত জাতির উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ভাষণ দান করেন, তার পূর্ণ বিবরণ প্রদত্ত হল ঃ

 

আমার প্রাণপ্রিয় বীর বাঙ্গালী ভাই বোনেরা, আমরা আজ স্বাধীনতার প্রথম বর্ষপূতি উৎস পালন করছি। এই মহান দিনে স্বাধীনতা অর্জনের পথে যে লক্ষ লক্ষ বীর শহীদ হয়েছেন  তাঁদের জন্য গভীর বেদনাপ্লুত মন নিয়ে আমার শোকাতুর দেশবাসীর সাথে পরম করুণাময় আল্লাহ-তায়ালার দরবারে মাগফেরাত কামনা করছি।

সেই সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামে গৌরবোজ্জ্বল ও অন্যান্য ভূমিকা পালনের জন্য আমি মুক্তিবাহিনীর সকল অঙ্গ দল তথা বাংলাদেশ রাইফেলস, পুলিশ, বেঙ্গল, রেজিমেন্ট, বাহিনীর সশস্ত্র বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যবৃন্দ, নির্ভীক যুবক, ছাত্র, কৃষক, মজুর, বুদ্ধিজীবি আর আমার সংগ্রামী জনসাধারণকে অভিনন্দন জানাই।

তাঁদের বলিষ্ঠ ভূমিকা ও একনিষ্ঠ আত্মদান অনাগত কালের, ভাবী বাঙ্গালীদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের অভিজ্ঞতা বিশ্বব্যাপী ঔপনিবেশিকতা ও সম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে লিপ্ত মুক্তি পাগল জনতার চেতনাকে উদ্ভাসিত করবে।

আমার প্রিয় দেশবাসী, বিগত পঁচিশ বছর ধরে আপনারা ক্ষুধা, বঞ্চনা, অশিক্ষা এবং মৃত্যুর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। সম্রাজ্যবাদী শোষকেরা আমাদের প্রিয় মাতৃভূমিকে একটা নিকৃষ্টতম উপনিবেশে পরিণত করেছিল। দুঃসহ ও ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে আমরা দিন কাটাচ্ছিলাম। পিষ্ট হচ্ছিলাম শোষণের জগদ্দল পাথরের নিচে চাপা পড়ে।

দারিদ্র্যের ও অনাহারের বিষপাণে যখন আমরা আকুণ্ঠ নিমজ্জিত, তখন তদানীন্তন পাকিস্তানী শাসকরা আমাদের কষ্টার্জিত তিন হাজার কোটি টাকার সম্পদ লুটে নিয়ে তাদের পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তোলার কাজে মত্ত ছিল। ন্যায় বিচার দাবী করায় মৃত্যুর হিমশীতল স্পর্শ আমাদের উপর নেমে এসেছিল।

সমসাময়িককালে নিষ্ঠুরতম স্বাধীনতা যুদ্ধে আমাদের ত্রিশ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়েছে, আর তিন কোটি মানুষ সর্বস্বান্ত। এসব কিছুই ঘটেছে আমাদের স্বাধীনতার জন্য। আজ আমি যখন আমার সোনার বাংলার দিকে তাকাই, তখন দেখতে পাই যুদ্ধ বিধ্বস্ত ধূসর পান্ডুর, জমি, ধ্বংসপ্রাপ্ত গ্রাম, ক্ষুধার্ত শিশু, বিবস্ত্র নারী আর হতাশাগ্রস্থ পুরুষ।

আমি শুনতে পাই সন্তানহারা মায়ের আর্তনাদ, নির্যাতিত নারীর ক্রন্দন ও পঙ্গু মুক্তিযোদ্ধার ফরিয়াদ। আমাদের স্বাধীনতা যদি এদেরকে আশা-নিরাশার দ্বন্দ্ব থেকে উদ্ধার করে এসব মুখে হাসি ফোটাতে না পারে, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধার্ত শিশুর মুখে তুলে দিতে না পারে এক মুষ্টি অন্ন, মুছে দিতে না পারে মায়ের অশ্রু ও বোনের বেদনা, তাহলে স্বাধীনতা মিথ্যা, সে আত্মত্যাগ বৃথা।

আমাদের এই কষ্টার্জিত স্বাধীনতার বর্ষপূর্তি উৎসবের লগ্নে দাঁড়িয়ে, আসুন আজ আমরা এই শপথ গ্রহণ করি, বিধ্বস্ত মুক্ত বাংলাদেশকে আমরা গড়ে তুলবো। গুটিকয়েক সুবিধাবাদী নয়, সাড়ে সাত কোটি মানুষ তার ফল ভোগ করবে। আমি ভবিষ্যতে বংশধরদের সুখী ও উন্নতর জীবন প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি।

 

পর্বততুল্য সমস্যাঃ

আজ আমাদের সামনে পর্বততুল্য সমস্যা উপস্থিত। মহাসংকটের ক্রান্তিলগ্নে আমরা উপস্থিত হয়েছি। বিদেশ ফেরত এক কোটি উদ্বাস্তু, স্বদেশের বুকে দু’কোটি গৃহহারা মানুষ, বিধ্বস্ত কর্মহীন চালনা-চট্টগ্রাম পোতাশ্রয়, নিশ্চল কারখানা, নির্বাপিত বিদ্যুৎ সরবরাহ, অসংখ্য বেকার, অপরিমিত অরাজকতা, বিশৃংখলা বাণিজ্যিক সরবরাহ ব্যবস্থা, ভাঙ্গা সড়ক, সেতু ও বিচ্ছিন্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা, দারিদ্র্য, খাদ্র্যভাব, দ্রব্যমূল্যেও ঊর্ধ্বগতি এবং অকর্ষিত ভূমি এ সবকিছুই আমরা পেয়েছি উত্তরাধিকার সূত্রে।

জনগণের গভীর ভালবাসা, আস্থা, অদম্য সাহস ও অতুলনীয় ঐক্য এগুলোকে সম্বল করেই আমার সরকার এই মহা সংকট কাটিয়ে উঠার চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেছে।

আমি আশা করব, অতীতে আপনারা যেভাবে দূর্জয় সাহসে বুক বেঁধে ইয়াহিয়ার সামরিক যন্ত্রকে পরাভূত করেছিলেন, গভীর প্রত্যয় ও সাহস নিয়ে তেমনি বর্তমান সংকটের মোকাবিলা করবেন। আমরা পুরাতন আমলের জীর্ণ ধ্বংসস্তুপের মধ্য থেকে নতুন সমাজ গড়ে তুলবো।

 

প্রশাসন কাঠামোঃ

ভাই ও বোনেরা, আপনারা জানেন হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী আমাদের বাংলাদেশ রাইফেলস্ ও পুলিশের বিপুল সংখ্যক সদস্যকে হত্যা করেছে। আইনের শাসন কায়েম ও শান্তি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় সংগঠনের অভাব বিপ্লব বাংলাদেশ সরকারের এক বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছিল।

নতুন নিযুক্তির মাধ্যমে আমরা পুলিশ বিভাগেকে সংগঠিত করছি এবং ইতিমধ্যে যে সব সমাজ বিরোধী দুস্কৃতিকারী স্বাধীনতা উত্তর সুযোগ সুবিধাদির অপব্যবহারে লিপ্ত হয়েছিল, তাদের দমন করে জনসাধারণের মনে নিরাপত্তা বোধ ফিরাইয়া আনার কাজে হাত দেয়া হয়েছে। উত্তরাধিকার সূত্রে আমরা পেয়েছিলাম স্বাধীন জাতির জন্য সম্পর্ণ অনুপযোগী একটি প্রাদেশিক কাঠামো। এর কিছু কিছু আমলা ঔপনবেশিক মানসিকতা কাটিয়ে উঠতে পারছিল না। তারা এখনও বনেদী আমলাতান্ত্রিক মনোভাবকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছে।

আমরা তাদেরকে স্বাধীন জাতীয় সরকারের অর্থ অনুধাবনের জন্য উপদেশ দিচ্ছি এবং আশা করছি, তাদের পশ্চাদমুখী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটবে। আমার সরকার নব রাষ্ট্র এবং নতুন সমাজের উপযোগী করে সময় প্রশাসনযন্ত্রকে পুর্নঃগঠিত করবে। প্রস্তাবিত প্রশাসনিক কাঠামোতে জনগণ ও সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে নৈকট্য সৃষ্টির  পূর্ণ উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে। আমরা বাংলাদেশের সমগ্র মহকুমাগুলোকে জেলা পর্যায়ে উন্নীত করার পরিকল্পনা তৈরি করছি।

 

শাসনতন্ত্রঃ

বিশেষজ্ঞরা খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে নিয়োজিত রয়েছেন। তাঁদের কাজ অনেকটা অগ্রসর হয়েছে এবং খসড়া শাসনতন্ত্র গণপরিষদের সামনে পেশ করা হবে। এই শাসনতন্ত্রের মূল স্তম্ভ হবে জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা। ৫৪ টি বন্ধু রাষ্ট্র এ পর্যন্ত গণ-প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। বিপুল সংখ্যক বন্ধু রাষ্ট্রের এই স্বীকৃতিদান রাষ্ট্রপুঞ্জের নতুন সদস্যকে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার ব্যাপারে উদ্বুদ্ধ করবে।

উদার সাহায্য কামনাঃ

উদ্বাস্তুদের পুনঃর্বাসন ও অর্থনীতিতে পুনঃর্গঠনের জন্য আমরা বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর কাছ থেকে উদার সাহায্য ও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি। বিশেষ করে ভারত আমাদের সুদিন ও দূর্দিনের প্রতিবেশী। সম্প্রতি মহান ভারতের মহান নেত্রী প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধি বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। এই শুভেচ্ছা সফরের প্রাক্কালে আমরা শান্তি, বন্ধুর ও মৈত্রী চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি। এই চুক্তি দুই দেশের মেহনতী মানুষের শুভেচ্ছা, সহযোগিতা, বন্ধুত্ব এবং সংহতির বন্ধনকে মজবুত করবে।

সোভিয়েত রাশিয়া আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের দূর্বোদ্ধময় মুহূর্তে পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল। আমি সোভিয়েত রাশিয়া সফল করে এসেছি। সেখানে তাদের অকৃত্রিম আতিথিয়েতা পুনঃর্গঠনের কাজে সার্বিক সাহার্য্যরে আশ্বাস দিয়েছেন। এই বাংলাদেশের পুনঃর্গঠনের কাজে সার্বিক সাহার্য্যরে আশ্বাস দিয়েছেন।

এই প্রসঙ্গে আমি পূর্ব ইউরোপীয়  সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রপুঞ্জ, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, স্কান্ডিনেভিয়ান দেশগুলো এবং অন্যান্য বন্ধ রাষ্ট্রসমূহ যাঁরা আমাদের দিকে সাহায্যের হাত নিয়ে এগিয়ে এসেছেন তাঁদের  কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করছি। আমাদের পররাষ্ট্র নীতি জোট বহিঃর্ভূত ও সক্রিয় নিরপেক্ষতার ভিত্তিতে রচিত।

বৃহৎ শক্তির আন্তর্জাতিক সংঘাতের বাইরে আমরা শান্তিকামী। আমরা শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতিতে বিশ্বাসী এবং প্রতিবেশীর সাথে সদ্ভাব সৃষ্টিতে আগ্রহী। দেশ গড়ার কাজে কেহ আমাদের সাহায্য করতে চাইলে তা আমরা গ্রহণ করবো। কিন্তু সে সাহায্য অবশ্যই হতে হবে নিঙ্কন্টক ও শর্তহীন। আমরা জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সব জাতির সম মর্যাদার নীতিতে আস্থাশীল। আমাদের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কেহ হস্তক্ষেপ করবেন না, এটাই আমাদের কামনা।

বাঙ্গালীদের ফিরিয়ে আনতে হবেঃ

দুর্ভাগ্যক্রমে পাকিস্তানের শাসকরা বাংলাদেশের বাস্তবতাকে মেনে নিচ্ছেন না। তাঁরা পাঁচ নিরীহ বাঙ্গালীকে দূর্দশার মধ্যে আটকে রেখেছেন। আমি বিশ্বব্যাপী বিবেক সম্পন্ন মানুষ, বিশেষ করে মিঃ ভূট্টোর দৃষ্টি আকর্ষণ। করছি- তাঁদেরকে ফিরিয়ে দেয়া হউক। এই ইস্যুকে কোনক্রমেই যুদ্ধ বন্দীদের সমপর্যায়ে ভাবা চলবে না।

কারণ তাদের মধ্যে এমন অনেকে আছে, যারা শতাব্দীর নৃশংসতম হত্যা, অপরাধে অপরাধী। তারা মানবিকতাকে লংঘন করেছে এবং আন্তজাতিক নীতিমালার ভিত্তিতে তাদের বিচার হবে। পাকিস্তানের সংবেদনশীল সাধারণ মানুষের কাছে আমার আবেদন- নুরেনবার্গ মামলার আসামীদের থেকেও নিকৃষ্ট ধরনের এই অপরাধীদেরকে তারা স্বজাতি বলে ডাকবেন না।

উদ্বাস্তু পুনঃর্বাসনঃ

যারা উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা দেশে ফিরে এসেছে। সাহায্য, পুনঃর্বাসনের জন্য আমরা কার্যকরী কর্মসূচী গ্রহণ করেছি। বিনামূল্যে ও ন্যায্যমূল্যে খাদ্য সরবরাহের জন্যে কিছুটা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ছিন্নমূল মানুষের মাথা গুঁজবার ঠাঁই করে দেয়ার জন্য অস্থায়ী বাসগৃহ তৈরির কাজে হাত দেয়া হয়েছে।

বিধবা, অনাথ ও নির্যাতিতা মহিলাদের পুনঃর্বাসন পরিকল্পনাকে সরকার অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে বিবেচনা করেছেন। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনী যেভাবে বাংলাদেশকে ধ্বংস করে গেছে,  তাতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা পুনঃরুদ্ধার করতে দশ বছর সময় দরকার। আমাদের বিপ্লবী সরকার আশা করছে ৩ বছর সময়ের মধ্যে কাজ সমাধা করবে।

মজুতদাররা হুঁশিয়ারঃ

বিপুল খাদ্য ঘাটতি আমাদের জন্য এক দুঃসহ অভিশাপ। কিন্তু আমি কাউকে না খেয়ে মরতে দিতে চাই না। আগামী জুলাই মাসের মধ্যে আশা করি ১০ লক্ষ টন খাদ্যশস্য বিদেশ থেকে আনতে পারবো। ডিসেম্বরের মধ্যে আরও ১০ লক্ষ টন আমদানী করার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সামনের কয়েক সপ্তাহ আমাদের জন্যে ঘোর দূর্দিন।

আমার প্রাণপ্রিয় দেশবাসী আপনারা ধৈর্যধারণ করুন, উচ্চতম অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে খাদ্য ঘাটতি পুরণের চেষ্টা করা হবে। এ প্রসঙ্গে আমি মজুতদার, চোরা কারবারী ও গুজব বিলাসীদের হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি তারা যেন মানুষের মুখের রুটি নিয়ে ছিনিমিনি না খেলে তাদেরকে কঠোর হস্তে দমন করা হবে।

জাতীয়করণঃ

আমার সরকার আভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাসী। পুরাতন সমাজ ব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে। অবাস্তব তাত্ত্বিকতা নয়, আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। দেশের বাস্তব প্রয়োজনের প্রেক্ষিতে পুরাতন  সামাজিক কাঠামোকে ভেঙ্গে দিয়ে নতুন সমাজ গড়তে হবে।

শোষণ ও অবিচারমুক্তি নতুন সমাজ আমরা গড়ে তুলব এবং জাতির এই মহাক্রান্তিলয়ে সম্পদের সামাজিকরণের পর্যায়ক্রমিক কর্মসূচি শুভ সূচনা হিসেবে আমার সরকার উল্লেখিত বিষয়গুলো জাতীয়করণ করেছে।

১।           ব্যাংকসমূহ (বিদেশী ব্যাংকের শাখাগুলো বাদে)

২।            সাধারণ ও জীবন বীমা কোম্পানিসমূহ, (বিদেশী বীমা কোম্পানির শাখাসমূহ বাদে)

৩।          সকল পাটকল।

৪।    সকল বস্ত্র ও সুতাকল।

৫।           সকল চিনিকল।

৬।          আভ্যন্তরীণ ও উপকূলীয় নৌ-যানের বহুদাংশ।

৭।            ১৫ লক্ষ টাকা মূল্যের তদূর্ধ্ব সকল পরিত্যক্ষ ও অনুপস্থিত মালিকানাভূক্ত সম্পত্তি।

৮।          বাংলাদেশ বিমান ও বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশনকে সরকারি সংস্থা হিসেবে স্থাপন করা হয়েছে।

৯।           সমগ্র বহিঃবাণিজ্যকে রাষ্ট্রীয়করণের লক্ষ্য নিয়ে সাময়িকভাবে বহিঃবাণিজ্যের বৃহদাংশকে এই মুহূর্তে ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে। দেশে ও বিদেশে বাঙ্গালী প্রতিভাবান ব্যক্তিদের আমি দেশ গড়ার কাজে এগিয়ে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছি। সরকারী সেক্টরে কাজ করার জন্য তাদের পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধা দেয়া হবে।

শীগগিরই সেক্টরে কাজ করার জন্য পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধা দেয়া হবে। শীগগিরই যে শিল্পনীতি ঘোষণা করা হচ্ছে, তাতে এসব ব্যবস্থা সম্পর্কে বলা হবে। যে সমস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত্ব প্রতিষ্ঠানের সাথে বাঙ্গালীদের মালিকানার স্বার্থ সরাসরি জড়িত সে সমস্ত প্রতিষ্ঠানের সাবেক মালিক অথবা প্রধান কর্মকর্তাদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি যে, তারা যেন আমাদের অবশ্যই স্বীকার করে নেন, আমরা যে সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করছি, সেগুলো সবদিক থেকে বিপ্লবাত্মক এবং জনসাধারণকে অবশ্যই এসব ক্ষেত্রে তাদের দায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করে  গড়ে তুলতে হবে।

বেসরকারী ক্ষেত্রে মাঝারি ছোট শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোতে আমাদের নীতির সুনিদিষ্ট ভূমিকা রয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সরকারি নীতির কাঠামোর মধ্যে থেকে নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের কাজ ন্যায্যভাবে চালানোর জন্যে উৎসাহ দেয়া হবে।

 

আর শ্রমিক মালিক বিরোধ নয়ঃ

আমি এমন এক নীতি নির্ধারণ করতে চাই, যাতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনায় অংশ নিতে পারবেন। এই বলিষ্ঠ শ্রেণীর কর্তব্যবোধের উপর আমরা অনেকখানি নির্ভর করছি। শ্রম ও পুঁজির মধ্যে আবহমানকাল ধরে যে পরপর বিরোধিতা রয়েছে, তা আমাদের নতুন নীতি গ্রহণের ফলে বাংলাদেশ থেকে অনেকখানি বিলুপ্ত হবে। শ্রমিক কর্মচারীকে আর সর্বদা মালিকের সাথে বিরোধে লিপ্ত থাকতে হবে না। কেননা, বর্তমানে তাদের মালিক হলো বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যারা মালিক ও ম্যানেজারদের হাতে বিশ্বাস করে নিজেদের সম্পত্তি জমা রেখেছে।

আমি খুব শিগগিরই শ্রমিক প্রতিনিধিদের নিয়ে একটি সভা করছি। সেই সভায় শ্রমিক সংক্রান্ত সরকারি নীতি এবং আমাদের বিপ্লবী নীতিসমূহ বাস্তবায়িত করতে তাদের যে পূর্ণ সহযোগিতা লাগবে সে বিষয়ে আলোচনা করা হবে। এ ব্যাপারে পূর্ণ মতৈক্যে পৌঁছানোর পরে আমি আশা করবো যে, শ্রমিক নেতারা আমার সরকার ও আমার সাথে একযোগে কাজ করবেন এবং এই বিপ্লবী নীতি সমূহ সরাসরি শিল্প এলাকার কার্যকরী করবেন। তদুপুরি শ্রমিকদের গুরুদায়িত্ব সম্পর্কে শিক্ষিত করে গড়ে তুলতে হবে।

 

শিক্ষা কমিশনঃ

আমার ছাত্র ভায়েরা যারা মুক্তি সংগ্রামের বীরত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল, তাদের প্রতি আমি আহ্বান জানাচ্ছি যে তারা যেন আমাদের বিপ্লবের লক্ষ্যকে বাস্তবায়িত করার জন্য তাদের কাজ করে যেতে থাকে। আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিপ্লব সাধনের উদ্দেশ্যে একটি পরিকল্পনা তৈরির নির্দেশ সহ আমি একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করতে চলেছি।

 

কৃষি ব্যবস্থাঃ

আমাদের সমাজে চাষীরা হলো সবচেয়ে দুঃখী ও নির্যাতিত শ্রেণী এবং তাদের অবস্থার উন্নতির জন্যে আমাদের উদ্যোগের বিরাট অংশ অবশ্যই তাদের পিছনে নিয়োজিত করতে হবে। সম্পদের স্থূলতা থাকা সত্ত্বেও আমরা চাষীদের সবল্প মেয়াদী সাহায্য দানের জন্যে ইতিমধ্যে ব্যবস্থা গ্রহণ করছি। ২৫ বিঘার কম জমি যাদের আছে তাদের খাজনা চিরদিনের জন্য মওকুফ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে সমস্ত বকেয়া খাজনা মাফ করা হয়েছে। তাবি ঋণ বাবদ ১০ কোটি টাকা বিতরণ করা হচ্ছে এবং ১৬ কোটি টাকা টেস্ট রিলিফ হিসেবে বিতরণ করা হয়েছে। লবণের উপর থেকে কর তুলে দেয়া হয়েছে।

সারা বছর ধরে সেচের কাজ চালানো উন্নতমানের বীজ বপণ, সার, কীটনাশক ঔষধ এবং প্রতিটি চাষীকে পর্যাপ্ত ঋণ দানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। ভূ-মালিকানার ক্ষেত্রে পশ্চাত্যের বৈষম্য দূরীকরণের জন্য পারিবারিক ও ব্যক্তিগত মালিকানার পরিধি কমিয়ে এনে পরিবার পিছু একশ বিঘার আনা হয়েছে। ভবিষ্যতে এই উচ্চ সীমা আরও কমিয়ে আনা যায় কিনা সেটা বিবেচনা করে দেখা যাবে। ছোট ছোট চাষীদের অবশ্যই উৎপাদনক্ষম করে তুলতে হবে। একথা মনে রেখে আমরা পল্লী এলাকায় সমবায় ব্যবস্থার ভিত্তিতে ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করতে চেষ্টা করছি।

এর ফলে চাষীরা কেবলমাত্র আধুনিক ব্যবস্থার সুফলই পাবে না বরং সমবায়ের মাধ্যমে সহজ শর্তে ও দ্রুত ঋণ পাওয়া সম্ভব হবে। এই সাথে আমাদের উদ্দেশ্য হলো ভূমিহীন ও স্বল্প জমির অধিকারী চাষীদের জন্যে ব্যাপক পল্লী পুনঃর্গঠনের কর্মসূচী গ্রহণ করা। কাজ করলে খাদ্য এই কর্মসূচীর অংশ হিসেবে ১ লক্ষ পঞ্চাশ হাজার টন খাদ্যশস্য বরাদ্দ করা হয়েছে। এছাড়া টেষ্ট রিলিফের অধীনে পল্লীর কর্মসংস্থানের জন্য নগদ ১৬ কোটি টাকা দেয়া হয়ে গেছে।

কুটির শিল্পঃ

আমরা আমাদের ক্ষুদ্র কুটির শিল্পকে বেকার সমস্যা সমাধানের উপযোগী করে গড়ে তুলতে চেষ্টা করছি। জনসাধারণের নিত্য নৈমিত্তিক প্রয়োজনের চাহিদার সাথে সমন্বয় রেখে এটা গড়ে তোলা হবে। আমাদের কৃষি ও শিল্পান্নয়নের এটা হবে সহায়ক। এই সরকার নগর ভিত্তিক ও গ্রামীণ জীবনের মধ্যকার বৈষম্য সম্পর্কে সচেতন। সেই সব ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার যাঁরা পাট চাষীদের উপার্জিত অর্থ দিয়ে মানুষ হয়েছেন তাঁদেরকে গ্রামে ফিরে যেতে হবে। আমি ইতিমধ্যে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে গ্রামে কাজ করার জন্য ৫শ ডাক্তারকে নিযুক্ত করেছি।

বাংলাদেশে মানুষে মানুষে, ব্যক্তিত্বে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বন্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে। এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতর উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বি বৈষম্য এতদিন ধরে বিরাজ করছিল সেটা দূর করার ব্যবস্থাদি উদ্ভাবনের জন্যে আমি একটি বিশেষ কমিটি গঠন করার কথা বিবেচনা করছি। আজ আমরা বিশ্ব সভ্যতার এক ক্রান্তিলগ্নে উপস্থিত। একটি নতুন বিশ্ব গড়ে তোলার স্বপ্নে আমরা বিভাগে, একটি সামাজিক বিপ্লব সফল করার প্রতিশ্রুতিতে নিয়োজিত হবে। আমাদের দুস্তর পথ। এ পথ আমাদের অতিক্রম করতেই হবে।

আমার প্রিয় দেশবাসী, লক্ষ লক্ষ শহীদের রক্তের লাল আন্তরণে দাঁড়িয়ে আমি আপনাদের কাছে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেবো না। আমি জীবনেও কোন দিন কাউকে মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেই নাই। শত্রুরা বাংলাদেশের সব কিছু ধ্বংস করে গেছে। কিছুই রেখে যায় নি। কি করে যে এ দেশ চলবে, সত্যিই চিন্তা করলে আমি শিহরীয়া উঠি।

সোনার বাংলা গড়তে হবেঃ

শ্মশান বাংলাকে আমরা সোনার বাংলা করে গড়ে তুলতে চাই। সে বাংলায় আগামী দিনের মায়েরা হাসবে, শিশুরা খেলবে। আমরা শোষণ মুক্ত সমাজ গড়ে তুলব। আপনারা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে সহযোগিতা করবেন। ক্ষেত-খামার, কারখানায় দেশ গড়ার আন্দোলন গড়ে তুলুন। কাজের মাধ্যমে দেশকে নতুন করে গড়া যায়। আসুন, সকলে মিলে সমবেতভাবে আমরা চেষ্টা করি যাতে সোনার বাংলা আবার হাসে, সোনার বাংলাকে আমরা নতুন করে গড়ে তুলতে পারি।

 

বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের মার্চ মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech 1972, March]

 

আরও দেখুন: