আমি যে জলসা ঘরে -মান্না দে (প্রবোধ চন্দ্র দে) । অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ

আমি যে জলসা ঘরে গানটি “অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি” ছায়াছবির জন্য সৃষ্টি করা হয়েছিল। গানটি লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, সুর দিয়েছিলেন অনীল বাগচী এবং কন্ঠ দিয়েছেলেন পদ্মভূষণ পন্ডিত মান্না দে। “অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি” ছবিটি ১৯ শতকের পর্তুগীজ কবিয়াল “অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি”র জীবন নিয়ে তৈরি হয়েছিল সিনেমাটি। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি বা হ্যান্সম্যান অ্যান্টনি যিনি প্রথম ইউরোপীয় বাংলা ভাষার কবিয়াল। পর্তুগীজ নাগরিক হ্যান্সম্যান ১৯ শতকের প্রথম দিকে তিনি বাংলাতে আসেন এবং পশ্চিমবঙ্গের ফরাসডাঙ্গা নামক এলাকায় বসবাস শুরু করেন। প্রথমে তার বাংলা গানগুলোর বাঁধনদার ছিলেন গোরক্ষনাথ, পরে এন্টনি ফিরিঙ্গি নিজেই গান বাঁধতে পারদর্শী হন। তাঁর জন্মসাল সম্পর্কে সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায় না। তবে লোকমুখে শোনা যায় তিনি ১৭৮৬ সালে পর্তুগালে জন্মগ্রহণ করেন। পর্তুগাল হতে আগত বলে তাঁর নামের শেষে যুক্ত হয়েছিল ‘ফিরিঙ্গী’ শব্দটি।

 

আমি যে জলসা ঘরে -মান্না দে (প্রবোধ চন্দ্র দে)

 

আমি যে জলসা ঘরে বেলোয়ারি ঝাড়

 

গৌরী প্রসন্ন মজুমদার [ Gouri Prasanna Majumdar ]
গৌরী প্রসন্ন মজুমদার [ Gouri Prasanna Majumdar ]

কথা : গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার
সুর : অনিল বাগচী
কণ্ঠ : মান্না দে (জন্মনাম : প্রবোধ চন্দ্র দে)
ছবি: এন্টোনি ফিরিঙ্গি (১৯৬৭) – Antony Firingee (1967)

 

আমি যে জলসা ঘরে বেলোয়ারি ঝাড়
নিষি ফুরালে কেহ চায়না আমায় জানি গো আর (।।)
আমি যে জলসা ঘরে বেলোয়ারি ঝাড়।

আমি যে আতর ওগো আতর দানে ভরা,
আমারই কাজ হলো যে গন্ধে খুশি করা।
কে তারে রাখে মনে ফুরালে হায় গন্ধ যে তার (।।)
আমি যে জলসা ঘরে ….

হায় গো কিযে আগুন জ্বলে বুকের মাঝে (।।)
বুঝেও তবু বলতে পারি না যে।
আলেয়ার পিছে আমি মিছেই ছুটে যাই বারেবার (।।)
আমি যে জলসা ঘরে বেলোয়ারি ঝাড়
আমি যে জলসা ঘরে …

 

অনিল বাগচী, সংগীত পরিচালক - Anil Bagchi DP
অনিল বাগচী

 

 

“অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি” ভালবেসে গান গাইতেন, জাতি ধর্ম বর্ণের উর্ধে উঠে তার গানে মানুষ ও মানবতার কথা পাওয়া যায়। তার অন্যতম জনপ্রিয় গানটি হল ‘সাধন ভজন জানিনে মা, জেতে তো ফিরিংগি ‘। তিনি সৌদামিনি নামক এক হিন্দু ব্রাহ্মণ মহিলাকে সতীদাহ হওয়ার থেকে উদ্ধার করেন ও বিবাহ করেন। তিনি কলকতার দক্ষিণে একটি মা কালিকার মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন, যা ফিরিঙ্গি কালীবাড়ি নামে পরিচিত।

 

কারাওকে:

 

কবিগান বলতে আমরা সাধারণত বুঝি লোকসংগীতের প্রতিযোগিতামূলক গানের আসর যেখানে মুখে মুখে কবি নামক গায়করা গানের পদ রচনা করেন এবং তাৎক্ষণিকভাবে তাতে সুরারোপ করেন। কবিগানকে সেকালে ‘কবির লড়াই’ও বলা হতো। তৎকালীন এই কবির লড়াই সংস্কৃতি ও বিনোদনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম ছিল এবং তা দেখতে শত শত মানুষের ভীড় হতো। পশ্চিমবঙ্গে আগমনের পর এন্টনি ফিরিঙ্গীকে যা প্রবলভাবে আকৃষ্ট করেছিল তা হলো এই কবিগান। কবিগান চর্চা করার জন্যই তিনি একটি দল গঠন করেছিলেন। প্রথম প্রথম তিনি গান লিখার জন্যে গোরক্ষনাথের সাহায্য নিয়েছিলেন, পরে তিনি নিজেই গান বাঁধতে সক্ষম হন। তৎকালীন বিখ্যাত কবিয়াল হরু ঠাকুর, ভোলা ময়রা, দশরথি রায়দের সাথে তিনি কবিগানে অংশগ্রহণ করেন এবং বিভিন্ন সময়ে কবিগানের লড়াইয়ে তিনি এ সকল বিখ্যাত কবিয়ালদের পরাজিত করেন।

হিন্দুধর্মের প্রতি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি তাঁর এক কবিগানে উল্লেখ করেছিলেন ‘আমি ভজন সাধন জানি নে মা/ নিজে ত ফিরিঙ্গী, যদি দয়া করে কৃপা কর/ হে শিবে মাতঙ্গী’। তাঁর আগমনী পর্যায়ের গান ‘জয় যোগেন্দ্রজায়া মহামায়া মহিমা অসীম তোমার’ এর মাধ্যমে তাঁর হিন্দুধর্মের প্রতি অগাধ বিশ্বাস প্রকাশ পেয়েছে। এছাড়াও তাঁর রচিত অনেক কবিগানেই অসাম্প্রদায়িকতার ছোঁয়া পাওয়া গিয়েছিল। জাতি, ধর্ম ও বর্ণভেদে সকল মানুষেই যে এক তা তিনি তাঁর কবিগানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। কবিগানে তাঁর এমন অসাধারণ পান্ডিত্য সেকালে সবাইকে মুগ্ধ করেছিল। উনিশ শতকের বিখ্যাত কবিয়ালদের সাথে কবির লড়াইয়ে তিনি অসাধারণ ভূমিকা রেখেছিলেন।

হিন্দু ধর্মের প্রতি তাঁর দুর্বলতা থাকলেও হিন্দু ধর্মের কুসংস্কারকে কখনোই প্রশ্রয় দেননি এন্টনি ফিরিঙ্গী। সৌদামিনি নামক এক ব্রাহ্মণ বিধবাকে সতীদাহ থেকে রক্ষা করে পরবর্তী সময়ে বিয়ে করেছিলেন তিনি। কিন্তু তৎকালীন সমাজ সেই বিয়ের বিরোধিতা করেছিল যার ফলস্বরুপ সৌদামিনিকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। তিনি কলকাতার বউবাজার এলাকায় ‘ফিরিঙ্গী কালীবাড়ি’ নামে একটি কালী মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ইউরোপিয়ান হয়েও এন্টনির এই দেশের মাটি, সমাজ, সংস্কৃতি, গান এসবের প্রতি ছিল অগাধ ভালোবাসা। বিদেশী হয়েও বাংলার সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসার এই নিদর্শন আজও ইতিহাসে বিরল। উনিশ শতকের পর বাংলার সংস্কৃতির অধ্যায়ে আর কোনো ইউরোপিয়ানের পদচারণার ঘটনা তেমন দেখা যায়নি। ১৮৩৬ সালে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

 

আরও দেখুন:

Leave a Comment