জামায়াতে ইসলামী দলটি নিজেকে একটি আদর্শিক ইসলামি দল হিসেবে তুলে ধরলেও, তাদের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় — দলটির অনেক নীতিগত অবস্থান রাজনৈতিক সুবিধাবাদিতা ও আদর্শিক ভণ্ডামির উদাহরণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইসলামকে রাষ্ট্র ও সমাজের কেন্দ্রে স্থাপন করার কথা বললেও, তাদের কর্মকাণ্ড বারবার প্রমাণ করেছে, তারা আদর্শ নয়, ক্ষমতা ও সুবিধার পক্ষে।
১. পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা, কিন্তু পরে পাকিস্তানী রাষ্ট্রব্যবস্থার অংশীদারিত্ব
- আবুল আলা মওদূদী ভারতের মুসলিমদের জন্য আলাদা রাষ্ট্র চায়নি। তিনি ১৯৪৭ সালের আগে পাকিস্তান আন্দোলনের বিরুদ্ধে ছিলেন। তার মতে, “জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠন করা ইসলামবিরোধী”।
- অথচ পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের পর, সেই মওদূদী ও তাঁর অনুসারীরা পাকিস্তানে গিয়ে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক শাখা খুলে রাষ্ট্র ক্ষমতায় ভাগ বসানোর চেষ্টা করেন।
- একদিকে আদর্শিক বিরোধিতা, অন্যদিকে সুযোগ পেলেই ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার চেষ্টা — এটাই ছিল তাদের প্রথম বড় ভণ্ডামি।
২. বাংলাদেশের স্বাধীনতা বিরোধিতা, তারপর স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি
- ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতে ইসলামী সরাসরি বিরোধিতা করে। দলটির নেতারা পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগী হিসেবে রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে যুদ্ধাপরাধে অংশ নেয়।
- তারা বাংলাদেশকে “কাফের রাষ্ট্র”, “ভারতীয় ষড়যন্ত্র” ইত্যাদি বলে কুৎসা রটায়।
- কিন্তু স্বাধীনতার পর, একই দল বাংলাদেশে নির্বাচন করে, সংসদে যায়, এবং মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করে — নিজেদের আদর্শবিরোধী অবস্থানকে ভুলে যায়।
- স্বাধীনতার বিরোধিতা করে এমন একটি দল স্বাধীন রাষ্ট্রের সংবিধান মান্যতা না দিয়েও রাজনীতি করার অধিকার দাবি করে, যা সর্বোচ্চ পর্যায়ের দ্বিচারিতা।
৩. ক্ষমতাসীনদের সঙ্গেই থাকার প্রবণতা
জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দলটি সবসময় ক্ষমতাসীনদের সাথে সখ্য রাখতে পছন্দ করে। নিচে কিছু উদাহরণ দেওয়া হলো:
| সময়কাল | ক্ষমতাসীন দল | জামায়াতের অবস্থান |
| ১৯৭৫–৮১ | জিয়াউর রহমান (সামরিক শাসক) | পূর্ণ সমর্থন, রাজনীতিতে পুনর্বাসন |
| ১৯৮২–৯০ | এরশাদ (সামরিক শাসক) | প্রথমে নীরব সমর্থন, পরে সামান্য বিরোধিতা |
| ২০০১–২০০৬ | বিএনপি সরকার | সরকারে শরিক, মন্ত্রীত্ব গ্রহণ |
| ২০০৯–বর্তমান | আওয়ামী লীগ সরকার | ক্ষমতায় স্থান না পেয়ে বিরোধিতা ও সহিংসতা |
- যখনই ক্ষমতায় অংশ পায়, জামায়াত শান্ত থাকে, নৈতিকতার বুলি ভুলে যায়।
- যখন ক্ষমতায় জায়গা পায় না, তখন তারা বিরোধীদের কাঁধে ভর করে আন্দোলনে নামে।
৪. আদর্শ ও বাস্তবনীতির দ্বিচারিতা
কিছু নির্দিষ্ট ভণ্ডামির উদাহরণ:
| বিষয় | ঘোষিত আদর্শ | বাস্তব চর্চা |
| ধর্মভিত্তিক রাজনীতি | কুরআন-হাদীসভিত্তিক সমাজ গঠন | নির্বাচন ও জোটের মাধ্যমে দুনিয়াবি ক্ষমতা লাভে আগ্রহ |
| সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা | পশ্চিমা আধিপত্যের বিরুদ্ধে | পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের সাথে সহযোগিতা |
| ইসলামি শাসন | শরিয়াভিত্তিক সমাজ | ভোটের জন্য ধর্মনিরপেক্ষ দলের সাথেও জোট |
| সৎ ও আদর্শবান নেতৃত্ব | নীতিনিষ্ঠ রাজনীতি | যুদ্ধাপরাধী, মানবতাবিরোধী অভিযুক্তদের শীর্ষ নেতৃত্বে রাখা |
৫. ইসলাম নয়, ইসলামের নামে সুবিধাবাদীতা
- জামায়াত যে ইসলাম প্রচার করে তা অনেকাংশেই রাজনৈতিক মোড়কে ধর্মের ব্যবহার।
- ইসলামকে তারা নীতির চেয়ে কৌশল হিসেবে ব্যবহার করে — জনগণকে বিভ্রান্ত করতে, ভোট জেতার জন্য ধর্মীয় আবেগ কাজে লাগাতে।
- দলটির বক্তব্য ও কাজের মাঝে বিভ্রান্তি ও কৌশলী ধর্মব্যবসার রূপ স্পষ্ট।
জামায়াতে ইসলামী ইতিহাসের এক গভীর রাজনৈতিক ভণ্ডামির প্রতীক। তাদের ঘোষিত ইসলামি আদর্শ ও বাস্তব চর্চার মধ্যে রয়েছে বিস্তর ফারাক। একদিকে পাকিস্তান বিরোধিতা, পরে পাকিস্তানপন্থা; একদিকে স্বাধীনতা বিরোধিতা, পরে স্বাধীন রাষ্ট্রে রাজনীতি; একদিকে ইসলামি শাসনের দাবি, অন্যদিকে ক্ষমতার জন্য ধর্মনিরপেক্ষ জোটে অংশগ্রহণ — এ সমস্তই প্রমাণ করে, জামায়াত একটি সুবিধাবাদী, আদর্শচ্যুত, দ্বিচারী রাজনৈতিক দল, যাদের মূল লক্ষ্য ইসলাম নয়, বরং ক্ষমতা।
লেখাটি : ০৫/০৮/২০২২ তারিখে এডিটকৃত