ভারত ভাগ-পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন এক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। এ নির্বাচনে বাঙালিরা ক্ষমতায় এলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের ষড়যন্ত্রের কারণে সরকার বেশিদিন টিকতে পারেনি। অল্প সময়ের ব্যবধানে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতন ঘটে। এই নির্বাচনে জাতীয় নেতাদের পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি সারাদেশে নির্বাচনী প্রচারণা চালান, প্রার্থীদের বিজয়ী করার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেন এবং বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি নীলফামারীতেও আসেন।
বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মোট চারবার—১৯৫৩, ১৯৬৯, ১৯৭০ এবং ১৯৭৩ সালে নীলফামারীতে আনুষ্ঠানিক সফরে এসেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রথম নীলফামারী সফর (১৯৫৩)
১৯৫৩ সালের ২২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু প্রথম নীলফামারী সফর করেন। তিনি সেদিন নীলফামারী টাউন ক্লাব মাঠে এক বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। সভায় সভাপতিত্ব করেন রংপুর জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি দবিরউদ্দিন আহমদ। বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতায় উঠে আসে—
- সাম্রাজ্যবাদবিরোধী মনোভাব
- সাধারণ মানুষের জীবনচিত্র
- অসাম্প্রদায়িক ভাবাদর্শ
- বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনা
তিনি জনসভায় বলেন:
“আজ তো স্বাধীন হয়েছি। কথা সত্য, ‘পাকিস্তান’ নামটা পেয়েছি; আর কতটুকু স্বাধীন হয়েছি-আপনারা নিজের দিকে তাকালেই বুঝতে পারবেন। চীন দেশ কৃষিতে বিপ্লব করে যাচ্ছে।”
স্থানীয় নেতৃত্বের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক
নীলফামারীতে বঙ্গবন্ধু সাংগঠনিকভাবে যোগাযোগ রাখতেন দবিরউদ্দিন আহমদ এবং খয়রাত হোসেনের সাথে।
- দবিরউদ্দিন আহমদ রংপুর জেলা আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি হিসেবে ছিলেন প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ।
- খয়রাত হোসেনের সাথে বঙ্গবন্ধুর সম্পর্ক ছিল দীর্ঘদিনের। তার প্রমাণ পাওয়া যায় বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী গ্রন্থে।
সেখানে তিনি উল্লেখ করেছেন, দলীয় সাংগঠনিক কাজে খয়রাত হোসেন সরাসরি সম্পৃক্ত ছিলেন। ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ৯১ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন—
“আমরা তাড়াতাড়ি একশত বারজন কাউন্সিল সদস্যের দস্তখত নিয়ে একটা রিক্যুইজিশন সভা আহ্বান করার দাবি করলাম… মোহাম্মদ আলী, তোফাজ্জল আলী, ডাক্তার মালেক, আবদুস সালাম খান, এম এ সবুর, আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দিন, শামসুল হক, আনোয়ারা খাতুন, খয়রাত হোসেন ও অনেকে এতে দস্তখত করলেন।”
আন্দোলন-সংগ্রামে নীলফামারীর খয়রাত হোসেন
পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান আইন সভার অধিবেশন চলাকালে ঢাকায় প্রায় প্রতিদিনই শোভাযাত্রা বের হতো। এসব আন্দোলনে নীলফামারীর খয়রাত হোসেন সরাসরি যুক্ত ছিলেন। এর ফলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে তার রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও গভীর হয়। অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র ৯৩ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন—
“আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছে… এই সময় শেরে-বাংলা, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন ও আরও অনেকে মুসলিম লীগ পার্টির বিরুদ্ধে ভীষণভাবে প্রতিবাদ করলেন।”
বঙ্গবন্ধুর চিঠি: একটি ঐতিহাসিক দলিল
১৯৫৩ সালের ৫ আগস্ট পাকিস্তান ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চের প্রতিবেদনে বঙ্গবন্ধুর লেখা একটি চিঠির কথা উল্লেখ আছে। সেই চিঠি ছিল নীলফামারীর খয়রাত হোসেনের উদ্দেশ্যে লেখা। সিক্রেট ডকুমেন্টস অব ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চ অন ফাদার অব দ্য নেশন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (ভলিউম-৩) গ্রন্থে এটি সংরক্ষিত আছে (চিঠি নং ১৫৯)।
চিঠিতে বঙ্গবন্ধু খয়রাত হোসেনকে সম্বোধন করেছেন— “প্রিয় খয়রাত ভাই”। এতে ব্যক্তিগত সম্পর্কের পাশাপাশি সাংগঠনিক বিষয়েও আলোচনা আছে।
- দীর্ঘদিন দেখা না হওয়ার আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন বঙ্গবন্ধু।
- খয়রাত হোসেন কবে ঢাকায় আসবেন তা জানতে চেয়েছেন।
- সাংগঠনিক বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আশা প্রকাশ করেছেন।
চিঠিতে মাওলানা ভাসানীর পাঁচবিবি সফরের প্রসঙ্গও এসেছে। আরও উল্লেখ আছে যে, আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যরা বগুড়ায় অবস্থান করলেও বঙ্গবন্ধু ঢাকায় ফিরে আসবেন, কারণ পরদিনই ওয়ার্কিং কমিটির নাম ঘোষণা করা হবে।
এই চিঠিটি শুধু একটি ব্যক্তিগত যোগাযোগ নয়, বরং আঞ্চলিক ও জাতীয় ইতিহাসে একটি অমূল্য দলিল।

যুক্তফ্রন্ট প্রার্থীদের মনোনয়ন ও নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা
১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে নীলফামারী মহকুমা চারটি আলাদা নির্বাচনী এলাকায় বিভক্ত ছিল। যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি বোর্ড থেকে ঘোষিত প্রার্থীদের মধ্যে—
জসিমউদ্দিন আহমদ ছিলেন নীলফামারী দক্ষিণ আসনে,
খয়রাত হোসেন ছিলেন নীলফামারী সদর, কিশোরগঞ্জ ও জলঢাকা নির্বাচনী এলাকায়,
দবিরউদ্দিন আহমদ ডোমার-ডিমলা এলাকায়,
আর সগীর হাশমী ছিলেন সৈয়দপুর ও নীলফামারী সদরের অংশবিশেষ এলাকায় মনোনীত প্রার্থী।
খয়রাত হোসেনের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন মুসলিম লীগের প্রভাবশালী নেতা কাজী কাদের, আর দবিরউদ্দিন আহমদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন মুসলিম লীগের মশিউর রহমান যাদু মিয়ার সাথে। দবিরউদ্দিন জয়লাভ করেন, খয়রাতও বিপুল ভোটে নির্বাচিত হন, তবে সৈয়দপুর আসনে বঙ্গবন্ধুর পূর্বাভাস অনুযায়ী যুক্তফ্রন্টের সগীর হাশমী স্বতন্ত্র প্রার্থী ডা. জিকরুল হকের কাছে পরাজিত হন।
সৈয়দপুর আসন ও শেখ মুজিবের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা
সগীর হাশমী মনোনয়ন পেলেও তিনি মূলত উর্দুভাষী হওয়ায় স্থানীয় জনভিত্তি তৈরি করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সৈয়দপুরের রাজনীতির বাস্তবতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। তিনি স্পষ্টভাবেই মন্তব্য করেছিলেন—
“সৈয়দপুর আসনে যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী পরাজয় বরণ করবে।”
পরবর্তীতে সেটিই সত্য হয়, আর সৈয়দপুর ছিল পাকিস্তানের একমাত্র আসন যেখানে যুক্তফ্রন্ট পরাজিত হয়েছিল।
খয়রাত হোসেন: জনতার প্রিয় প্রার্থী
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে খয়রাত হোসেন ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তার কারণে স্থানীয়ভাবে প্রচলিত হয় একটি লোকমুখে উক্তি—
“খয়রাতের ভোটের জন্য হাঁস, মুরগি, হাঁড়ির জিয়ল মাছ পর্যন্ত খয়রাত! খয়রাত! করেছিল।”
তিনি সাইকেল ও গরুর গাড়িতে করে ৩০-৪০ মাইল জুড়ে প্রচারণা চালিয়েছিলেন। খালি গলায় বক্তৃতা করতেন গ্রামেগঞ্জে, মাইক ছাড়াই মানুষের মন জয় করতেন। অবশেষে তিনি কাজী আবদুল কাদেরকে ৬০ হাজার ভোটের বিশাল ব্যবধানে পরাজিত করে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় নির্বাচিত হন।
দবিরউদ্দিন আহমদ ও যুক্তফ্রন্টের বিজয়
দবিরউদ্দিন আহমদ তাঁর আসনে মুসলিম লীগের যাদু মিয়াকে দুই হাজারের বেশি ভোটে হারান। এই বিজয়ের মধ্য দিয়ে নীলফামারী মহকুমা যুক্তফ্রন্টের শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
যুক্তফ্রন্ট সরকারের গঠন ও মন্ত্রী পরিষদে নীলফামারীর অবদান
১৯৫৪ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যুক্তফ্রন্ট থেকে নির্বাচিত হয়ে পূর্ববঙ্গ আইনসভায় যোগ দেন এবং কৃষি ও বন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৫৬ সালে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ কোয়ালিশন সরকারে যোগ দিলে বঙ্গবন্ধু শিল্প, বাণিজ্য, শ্রম, দুর্নীতিরোধ ও গ্রামীণ সহায়তা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান।
একই সময়ে খয়রাত হোসেনও আতাউর রহমান খানের মুখ্যমন্ত্রিত্বে গঠিত কোয়ালিশন সরকারের মন্ত্রী হন। তিনি কৃষি, পশুপালন ও পশুচিকিৎসা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান। বৃহত্তর রংপুর জেলার একজন সফল মন্ত্রী হিসেবে তাঁর বিশেষ সুনাম ছিল।
বঙ্গবন্ধুর নীলফামারী সফর ও রাজনৈতিক প্রভাব
সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় নীলফামারীতে বঙ্গবন্ধুর একাধিক সফর স্থানীয় রাজনীতিতে বড় প্রভাব ফেলে। তিনি যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের আগেও নীলফামারীতে সফর করে জনসভা করেছেন এবং প্রার্থীদের বিজয় নিশ্চিত করতে সাংগঠনিক কাজে অংশ নিয়েছেন। এসব সফরের মাধ্যমে—
স্থানীয় মানুষের মধ্যে রাজনৈতিক অধিকার সচেতনতা বৃদ্ধি পায়,
আওয়ামী মুসলিম লীগের ভিত্তি শক্তিশালী হয়,
এবং জাতীয় রাজনীতির সাথে নীলফামারীর যোগসূত্র দৃঢ় হয়।
এইভাবে নীলফামারী শুধু যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে ভূমিকা রাখেনি, বরং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে প্রাদেশিক ও পরবর্তী সময়ে জাতীয় রাজনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে।
