বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই নির্বাচন বাঙালি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণে ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আওয়ামী লীগের জয়–পরাজয়ের ওপরই নির্ভর করছিল সাত কোটি মানুষের ভাগ্য।
দীর্ঘ দুই যুগ ধরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। সেই সংগ্রামের রাজনৈতিক পরিণতি ও জাতির প্রত্যাশার পরীক্ষা হওয়ার কথা ছিল ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। নৌকা প্রতীকে ভোট দিয়ে হাজার বছরের দাসত্বের শৃঙ্খল ভাঙার জন্য জাতি ছিল প্রস্তুত।
কিন্তু ইতিহাসের সেই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে নেমে এলো এক ভয়াবহ দুর্যোগ।

১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়: দুর্যোগের মুখে মানবিক নেতৃত্ব
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর বাংলার দক্ষিণাঞ্চলে আঘাত হানে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়। মুহূর্তের মধ্যে ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয় নোয়াখালী, বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনার বিস্তীর্ণ জনপদ। আনুমানিক ১০ লাখেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান। এটি ছিল ইতিহাসের অন্যতম ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগ।
সেই সময় পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নির্বাচনী ইঞ্জিনিয়ারিং ও ক্ষমতা ধরে রাখার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত থাকলেও বঙ্গবন্ধু ছিলেন সম্পূর্ণ ভিন্নধারায়। তিনি নির্বাচনী প্রচারণা বন্ধ করে দুর্যোগকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ান। শুরু করেন ত্রাণ বিতরণ ও মানবিক সহায়তা কার্যক্রম।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় বঙ্গবন্ধুর দিকনির্দেশনা
ঘূর্ণিঝড়-পরবর্তী পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শুধু মাঠপর্যায়ে মানুষকে সহায়তা করেননি, তিনি জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনারও একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা দেন। ২৬ নভেম্বর ১৯৭০ তিনি এক বিশেষ ভাষণ দেন, যেখানে দুর্যোগ মোকাবিলার জন্য রাষ্ট্রীয় উদ্যোগের দিকনির্দেশনা তুলে ধরেন।
এরপর তিনি সরেজমিনে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শনে যান। সেই সফরে তিনি বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচন করেন বাংলার ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের চিত্র। আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তিনি বলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষ গৃহহীন, খাদ্য ও পানির অভাবে দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে।

দুর্যোগ থেকে মানবিক নেতৃত্বের উন্মেষ
এই দুর্যোগ কেবল একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিল না, বরং এটি প্রমাণ করে বঙ্গবন্ধু কেবল একজন রাজনৈতিক নেতা নন—তিনি ছিলেন মানবতার নেতা। ক্ষমতা, অর্থ কিংবা রাজনৈতিক মোহ—কোনো কিছুর সঙ্গে তিনি মানবিক মূল্যবোধের আপস করেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন, বাঙালির লাশ মাড়িয়ে এগিয়ে যাওয়া যায় না।
বাংলার দক্ষিণাঞ্চলের বিধ্বস্ত জনপদে দুর্যোগপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু প্রমাণ করেছিলেন, আওয়ামী লীগ এবং তার নেতৃত্ব জাতির সংকটে সর্বদা মানুষের পাশে দাঁড়াতে প্রস্তুত।

পাকিস্তানি সরকারের ব্যর্থতা ও বঙ্গবন্ধুর প্রতিবাদ
১৯৭০ সালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়ের পর বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান সরকারের চরম ব্যর্থতার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। তিনি তথ্য-উপাত্ত তুলে ধরে বলেছিলেন—
“ঘূর্ণিঝড় উপকূলে আঘাত হানার দু’দিন আগে সুপারকো ও আবহাওয়া উপগ্রহের মাধ্যমে খবর পাওয়া গিয়েছিল। কিন্তু উপকূলবর্তী অঞ্চলের মানুষকে যথাযথভাবে সতর্ক করা হয়নি। হতভাগ্য মানুষদের অন্তত অন্যত্র সরানোর কোনো চেষ্টা পর্যন্ত করা হয়নি।”
তিনি আরও বলেন—
“আজাদীর ২৩ বছর পরেও বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য কোনো কার্যকর পরিকল্পনা হয়নি। ১০ বছর আগে একবার ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে এই অঞ্চলের ভয়াবহ ক্ষতি হয়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকেও কোনো শিক্ষা নেওয়া হয়নি। ঘূর্ণিঝড় প্রতিরোধী আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ, গ্রাম পুনর্বিন্যাস, উপকূলীয় বাঁধ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন নিয়ে পরিকল্পনা হলেও তা কার্যকর হয়নি; প্রকল্পগুলো কাগজেই রয়ে গেছে।”

স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার রূপরেখা
অভিজ্ঞতার আলোকে বঙ্গবন্ধু স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন—
“বাংলাদেশকে প্রকৃতির ধ্বংসলীলার হাত থেকে রক্ষা করতে হলে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন অর্জন করতে হবে। তাহলেই আমরা অর্থনৈতিক উন্নয়ন, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, ঘূর্ণিঝড় দুর্গতদের পুনর্বাসন ও গ্রাম পুনর্গঠন—সব জরুরি সমস্যার সমাধান করতে পারব।”
আজকের বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় যে ‘রোল মডেল’ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত, তার ভিত্তি স্থাপিত হয়েছিল বঙ্গবন্ধুর এই দুর্যোগ-ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত দিকনির্দেশনার মধ্য দিয়ে। তিনি উপকূলীয় বাঁধ নির্মাণ, পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র, আধুনিক সংকেত ব্যবস্থা ও সুষ্ঠু যোগাযোগ নেটওয়ার্ক গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছিলেন। পাশাপাশি, বেঁচে থাকা মানুষের জন্য তাৎক্ষণিক খাদ্য, গবাদিপশু, উন্নত কৃষিযন্ত্র ও বীজ সরবরাহের পদক্ষেপ গ্রহণের উপর গুরুত্ব দেন।
মানবিক সংকল্প ও স্বাধীনতার অঙ্গীকার
১৯৭০ সালের সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শুধু ত্রাণ নয়, স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষাকেও যুক্ত করেছিলেন দুর্যোগ মোকাবিলার দায়িত্বের সঙ্গে। তিনি বলেছিলেন—
“যদি নির্বাচন বানচাল হয়ে যায়, তাহলে ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে নিহত ১০ লাখ মানুষ আমাদের ওপর যে দায়িত্ব অর্পণ করে গেছে, তা সম্পাদনের জন্য, আমরা যাতে স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বাঁচতে পারি, নিজেদের ভাগ্যের নিয়ন্ত্রক হতে পারি—প্রয়োজনে আরও ১০ লাখ বাঙালি প্রাণ দেবে।”
১৯৭০-এর নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জনের পরও বঙ্গবন্ধু বারবার ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি ও বেঁচে যাওয়া ৩০ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশাকে স্মরণ করেছেন। ৯ ডিসেম্বরের সংবাদ সম্মেলনে তিনি দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের সামনে বলেন—এই মানুষগুলোর কষ্ট লাঘব করা এখন জাতির জন্য পাহাড়সম কর্তব্য।
দুর্যোগ মোকাবিলা থেকে রাষ্ট্রীয় কর্মসূচি
১৯৭১ সালের অসহযোগ আন্দোলনের সময় (১৪ মার্চ) বঙ্গবন্ধু প্রশাসনকে যে ৩৫টি নির্দেশনা দেন, তার মধ্যে অন্যতম ছিল ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকায় বাঁধ নির্মাণ, সাহায্য-সহযোগিতা, পুনর্বাসন ও পুনর্নির্মাণ কাজ অব্যাহত রাখা।
স্বাধীনতার পর তিনি তাৎক্ষণিকভাবে ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচি (CPP)’ প্রণয়ন করেন। ১৯৭২ সালে এই কর্মসূচি পরিকল্পনা পর্যায়ে যায় এবং ১৯৭৩ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে চালু হয়। আজও এই কর্মসূচির আওতায় লাখো স্বেচ্ছাসেবক দুর্যোগকবলিত এলাকায় কাজ করে যাচ্ছে।
ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণের নির্দেশনা বাস্তবায়নে তিনি অস্থায়ীভাবে মানুষ ও গবাদিপশু রক্ষার জন্য উঁচু ঢিবি তৈরির উদ্যোগ নেন। স্থানীয় মানুষ কৃতজ্ঞতার সঙ্গে এই আশ্রয়স্থলের নাম দিয়েছিল ‘মুজিব কিল্লা’।
বঙ্গবন্ধুর মানবসেবার শিকড়
দুর্যোগকবলিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো বঙ্গবন্ধুর স্বভাবজাত বৈশিষ্ট্য। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি এই চেতনা ধারণ করেছিলেন। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে কিশোর শেখ মুজিব লেখাপড়া ফেলে ত্রাণকার্যে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিজের অসমাপ্ত আত্মজীবনীতে তিনি লিখেছেন—
“এই সময় শহীদ সাহেব লঙরখানা খোলার হুকুম দিলেন। আমিও লেখাপড়া ছেড়ে দুর্ভিক্ষপীড়িতদের সেবায় ঝাঁপিয়ে পড়লাম। অনেকগুলি লঙরখানা খুললাম। দিনে একবার করে খাবার দিতাম।”
অসুস্থ হয়ে পড়লেও দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের পাশে থাকার অঙ্গীকারে তিনি ছিলেন অবিচল। এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যই তাকে বারবার জনগণের আস্থার প্রতীক করেছে।
