বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার তুলনা করা উচিত নয়

বাংলাদেশের সঙ্গে শ্রীলঙ্কার তুলনা করা অনুচিত। বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশের অর্থনীতি বহু গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্পর্শ করেছে এবং ক্রমাগত অগ্রসর হচ্ছে। সরকার বেশ কয়েকটি বড় অবকাঠামোগত প্রকল্প হাতে নিয়েছে যা দেশের ভবিষ্যৎ বদলে দেওয়ার সম্ভাবনা রাখে।

উদাহরণস্বরূপ, পদ্মা বহুমুখী সেতু এখন প্রায় সম্পূর্ণ এবং আগামী জুন মাসে যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত হবে। এই সেতুটি বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থায় বিপ্লব ঘটাবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১, যা সরাসরি টেলিভিশন, রেডিও, টেলিমেডিসিন, শিক্ষা ও ইন্টারনেটসহ সমন্বিত টেলিযোগাযোগ সেবা প্রদান করে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, ঢাকা মেট্রো রেল, এবং মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ অন্যান্য মেগা প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছে।

এছাড়া, গভীর সমুদ্রবন্দর, রামপাল কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, বঙ্গবন্ধু টানেল, এবং ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চলের নির্মাণকাজ চলমান। একটি উঁচু এক্সপ্রেসওয়ে, ৩০টির বেশি হাইটেক পার্ক এবং আইটি ভিলেজ নির্মাণাধীন। সরকার অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে, যার লক্ষ্য গ্রামকে আধুনিক নাগরিক সুবিধা-সমৃদ্ধ করে “আমার গ্রাম, আমার শহর” ধারণাকে বাস্তবায়ন করা। আজ বাংলাদেশ গর্বের সঙ্গে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে।

সামাজিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। সরকারের আশ্রয়ণ প্রকল্পের আওতায় ৩,২০,০৬২টি পরিবারকে ঘর প্রদান করা হয়েছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে ৬,১৭৯টি পরিবারকে ঘর প্রদান করা হয়েছে। প্রায় ১৪,৫০০টি কমিউনিটি ক্লিনিকের মাধ্যমে মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দেওয়া হচ্ছে। সরকার ৩ কোটির বেশি শিক্ষার্থীকে উপবৃত্তি ও বৃত্তি দিচ্ছে, ৬ লাখ মানুষকে ভাতা দিচ্ছে, ১ থেকে ৫ মিলিয়ন পরিবারকে চাল সরবরাহ করছে এবং কৃষি খাতে কৃষকদের প্রণোদনা দিচ্ছে। কোভিড-১৯ মহামারির সময় সরকার ১,২১,০০০ কোটি টাকার প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিল, যা দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম চাল উৎপাদনকারী দেশ এবং অভ্যন্তরীণ সম্পদের মাধ্যমে মাছ, মাংস, ডিম ও সবজির উৎপাদন বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর সুফল এখন দ্রুত শহর থেকে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ছে। ২০১৮ সালে জাতিসংঘ বাংলাদেশকে স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নয়নশীল দেশের স্বীকৃতি দেয়। স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে জাতিসংঘ এই স্বীকৃতির চূড়ান্ত সুপারিশ দেয়। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের তথ্য অনুযায়ী, ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতি হবে। দেশের দ্বিতীয় দৃষ্টিভঙ্গি পরিকল্পনার লক্ষ্য ২০৩১ সালের মধ্যে চরম দারিদ্র্য দূর করা।

উন্নয়নশীল দেশের যোগ্যতা সাধারণত মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ভিত্তিতে নির্ধারিত হয়। এই প্রতিটি ক্ষেত্রেই বাংলাদেশ অসাধারণ অগ্রগতি করেছে। কোভিড-১৯ সংকটের মধ্যেও বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে, যা আন্তর্জাতিক মহলে প্রশংসিত হয়েছে। নারীর শিক্ষা, ক্ষমতায়ন, স্বাস্থ্যসেবা এবং মাতৃ ও শিশু মৃত্যুহার হ্রাসে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অগ্রগতি করেছে।

বাংলাদেশের নারীরা এখন সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিটি খাতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন। প্রযুক্তিতে দক্ষ গ্রামীণ নারীরা পুরুষদের সঙ্গে সমানতালে এগিয়ে চলেছেন। এই অগ্রগতি আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের ‘সোনার বাংলা’ গঠনের পথে দেশ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে চলেছে।

প্রধানমন্ত্রী ২০২১ সালের মধ্যে ডিজিটাল বাংলাদেশের পূর্ণ বাস্তবায়নসহ বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্য নির্ধারণ করেছিলেন। যদিও অনেক অর্জন হয়েছে, এখনও অনেক কিছু করার বাকি।

প্রত্যেক নাগরিকের দায়িত্ব একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলা—একটি ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত দেশ, যা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG) ১ ও ২ এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বঙ্গবন্ধুর ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শ অটুট রাখতে হবে। বাংলাদেশের সম্পদ সীমিত এবং জনসংখ্যা ঘন হলেও, আজ বাংলাদেশ বিশ্বের সামনে উন্নয়নের এক উজ্জ্বল উদাহরণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে।

বিগত বছরে কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্বের বেশিরভাগ অর্থনীতি নেতিবাচক প্রবৃদ্ধির সম্মুখীন হয়েছে। অর্থাৎ, অনেক দেশের মোট দেশজ উৎপাদন (GDP) আগের বছরের তুলনায় সংকুচিত হয়েছে। দ্রুত অগ্রসর হওয়া প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যেও, যেমন ভারত, তাদের GDP প্রায় ৬ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ছিল ব্যতিক্রম। অর্থনীতি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলেও এই সময়ে তা সংকুচিত হয়নি। ২০১৯-২০ সালের বৈশ্বিক মন্দার মধ্যেও বাংলাদেশের অর্থনীতি স্থিতিশীল থেকেছে এবং প্রবৃদ্ধি অব্যাহত রেখেছে।

বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাস অনুযায়ী, আগামী অর্থবছরে বাংলাদেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালীভাবে এগিয়ে যাবে এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরে GDP প্রবৃদ্ধি হবে ৭.৯ শতাংশ। রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ ভোক্তা ব্যয় এই প্রবণতা বজায় রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে। দেশের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার এবং দারিদ্র্য হ্রাস অনেকাংশে নির্ভর করবে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবার ও ব্যবসায়ীদের জন্য গৃহীত সহায়তা ব্যবস্থার কার্যকারিতার উপর।

স্বীকার করতে হবে, বাংলাদেশ এখনও অনেক উন্নয়নগত চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। তবে সরকার এসব সমস্যা সমাধানে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে এবং ভবিষ্যতেও করবে। উল্লেখযোগ্য যে, ইউরোপীয় ইউনিয়নের বাজারে বর্তমানে বাংলাদেশের শুল্ক ও কোটা মুক্ত প্রবেশাধিকার ২০২৯ সাল পর্যন্ত কার্যকর থাকবে, তাই আগামী পাঁচ বছরের প্রস্তুতি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

অর্থনীতিবিদরা পরামর্শ দিচ্ছেন, বাংলাদেশকে অবশ্যই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDG), অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং টেকসই উন্নয়নের জন্য প্রেক্ষিত পরিকল্পনার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে একটি শক্তিশালী রূপান্তর কৌশল গ্রহণ করতে হবে। মূল অগ্রাধিকার হওয়া উচিত – অভ্যন্তরীণ বাজারের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি, রপ্তানি বৈচিত্র্যকরণ, কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি, অবকাঠামো উন্নয়ন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই, শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং স্বাস্থ্যসেবা সম্প্রসারণ।

অনেক বিশ্লেষক শ্রীলঙ্কার সংকটের দিকে নজর দিয়ে বাংলাদেশকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিচ্ছেন। তবে এটা বোঝা জরুরি যে, দুটি দেশের অর্থনৈতিক কাঠামো এক নয়। শ্রীলঙ্কার মতো বাংলাদেশে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি নেই এবং মৌলিক খাদ্যপণ্য উৎপাদনে অনেকটাই স্বয়ংসম্পূর্ণ। রপ্তানি আয় ও প্রবাসী আয় (রেমিট্যান্স) ধারাবাহিকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে বাংলাদেশ প্রায় ৪৪.৪ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ধরে রেখেছে, যেখানে শ্রীলঙ্কার রিজার্ভ মাত্র ২ বিলিয়ন ডলারেরও কম। এছাড়াও, বাংলাদেশের মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ মাত্র ২৯২ ডলার, যেখানে শ্রীলঙ্কার ঋণ মাথাপিছু ১,৬৫০ ডলার।

বাংলাদেশের অর্থনীতির সম্ভাবনা বিশাল এবং তা দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। কোভিড-১৯ সাময়িকভাবে অগ্রগতি ধীর করেছে বটে, তবে ভবিষ্যৎ ইতিবাচক। শ্রীলঙ্কার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের শেখার আছে—বিশেষ করে, অতিরিক্ত ঋণ গ্রহণ ও বাস্তবতাবর্জিত প্রকল্প বাস্তবায়নের ঝুঁকি সম্পর্কে। জাতীয় সম্পদ ও সক্ষমতার বাইরে গিয়ে প্রকল্প গ্রহণ করলে বিপদ ডেকে আনে। আন্তর্জাতিক সহায়তা, যা বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তা হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

তাই, সরকারকে অবশ্যই এমন খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে যা প্রকৃতপক্ষে উন্নয়ন, আয় সৃষ্টির এবং দারিদ্র্য বিমোচনের সঙ্গে জড়িত। নীতিনির্ধারকদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, ভবিষ্যতের সংকট, যেমন কোভিড-১৯ এর মতো যেকোনো নতুন ধাক্কা মোকাবেলায় দেশ প্রস্তুত থাকবে। কেবল এই সচেতনতার মাধ্যমেই বাংলাদেশ একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারবে এবং সকল নাগরিকের জন্য সমৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে।

বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশকে শ্রীলঙ্কার সঙ্গে তুলনা করা ভুল এবং অবিচারসুলভ। দুই দেশের সামাজিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। মাত্র এক দশক আগে শ্রীলঙ্কা যখন একটি উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হওয়ার দ্বারপ্রান্তে ছিল, আজ তা দেউলিয়া হওয়ার পথে। দেশটি জ্বালানি আমদানির সক্ষমতা হারিয়ে ব্যাপক বিদ্যুৎ সংকটে ভুগছে, পরিবহন ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, কাগজ সংকটে শিক্ষা পরীক্ষা বাতিল হচ্ছে, আর পণ্যমূল্য বেড়ে আকাশচুম্বী। জনগণের বিক্ষোভে সরকার পতনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

শ্রীলঙ্কা এমনকি বাংলাদেশের কাছ থেকেও আর্থিক সহায়তা চেয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেই ঋণ অনুরোধ গ্রহণ করেনি, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায়। শুধুমাত্র আর্থিক সংকটই নয়, শ্রীলঙ্কার বর্তমান দুরবস্থার অন্যতম কারণ হলো চীনের উপর অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা এবং এক পরিবারভিত্তিক একনায়কতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা। বিপরীতে, বাংলাদেশ একটি স্থিতিশীল গণতন্ত্র এবং শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে থাকা একটি উন্নয়নশীল রাষ্ট্র। সরকার পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে এবং শ্রীলঙ্কার ভুল থেকে শিক্ষা নিচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার পরিস্থিতি গভীরভাবে উদ্বেগজনক হয়ে উঠেছে। মূল্যস্ফীতি, ব্যাপক বেকারত্ব এবং প্রায় সব প্রয়োজনীয় পণ্যের তীব্র ঘাটতি শ্রীলঙ্কার জনগণের জীবনে ব্যাপক দুর্ভোগ সৃষ্টি করেছে। গত এক দশকে, শ্রীলঙ্কা একাধিক বৃহৎ অবকাঠামো প্রকল্প হাতে নিয়েছিল, যেগুলো এখন অতিরিক্ত এবং অস্থিতিশীল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

বর্তমানে শ্রীলঙ্কা তার ৭৪ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটের মুখোমুখি। যদিও এটি দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে উন্নত অর্থনীতি ছিল, যার মাথাপিছু জিডিপি ৪,০০০ মার্কিন ডলারের বেশি, এবং যেখানে ৯৫ শতাংশ জনগণ শিক্ষিত একটি মানবকেন্দ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা ছিল—তবুও দেশটির অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা চরমভাবে ভেঙে পড়েছে। এক সময় দক্ষিণ এশিয়ার শীর্ষ পর্যটন গন্তব্য ছিল শ্রীলঙ্কা, কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তাদের অর্থনীতি গভীর সংকটে নিমজ্জিত।

আমদানিকৃত পণ্যের মারাত্মক সংকট প্রতিদিনের জীবনযাত্রাকে বিপর্যস্ত করে তুলেছে। মাসের পর মাস ধরে খাদ্য সংকটে ভুগছে শ্রীলঙ্কা, যা আরও তীব্র হয়েছে কারণ বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ঐতিহাসিকভাবে নিম্নস্তরে নেমে গেছে। ফলে খাদ্য ও অন্যান্য মৌলিক পণ্যের আমদানি কার্যত অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সংকট যত বাড়ছে, ততই দৈনন্দিন পণ্যের জন্য লাইনের দৈর্ঘ্য বাড়ছে, যা জনমনে তীব্র ক্ষোভ এবং সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরালো করেছে।

মাত্র দুই মাসের ব্যবধানে শ্রীলঙ্কান রুপির বিনিময় হার প্রতি ডলার ১৯০ থেকে বেড়ে ৩৬০-এরও বেশি হয়েছে। আগামী এক বছরের মধ্যে দেশটির ৭.৩ বিলিয়ন ডলারের সুদ পরিশোধ করতে হবে, যা দেশটিকে আর্থিক বিপর্যয়ের দ্বারপ্রান্তে ঠেলে দিচ্ছে। বিশ্লেষকরা অনেক আগেই সতর্ক করেছিলেন যে, ২০০৯ সাল থেকে নেওয়া ব্যাপক ঋণভিত্তিক প্রকল্পগুলো শ্রীলঙ্কাকে অর্থনৈতিক পতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।

শ্রীলঙ্কার ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানও বদলে গেছে। গৃহযুদ্ধে ভারতের হস্তক্ষেপের কারণে শ্রীলঙ্কা ভারত থেকে দূরে সরে গিয়ে চীনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়িয়েছে। চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI)-এর আওতায় বেশ কিছু বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়, যেমন হাম্বানটোটার গভীর সমুদ্র বন্দর, কলম্বোর বন্দরের পাশে একটি চীনা শহর এবং বনাঞ্চলে নির্মিত রাজাপাকসা বিমানবন্দর। তবে হাম্বানটোটার চাহিদা আশানুরূপ না হওয়ায় পর্যাপ্ত আয় না পেয়ে শ্রীলঙ্কা বাধ্য হয়ে এটি ৯৯ বছরের জন্য চীনের কাছে ইজারা দিয়েছে। অন্যান্য প্রকল্পগুলিও একই ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে।

বাংলাদেশ নিয়ে কিছুটা উদ্বেগ রয়েছে যে, যদি বাংলাদেশ অতি ব্যয়বহুল প্রকল্পে বিনিয়োগ করে, তবে তা ঋণের দায়ে ফেলতে পারে। তবে উল্লেখযোগ্য যে, ২০১২ সালের জুনে বিশ্বব্যাংক পদ্মা সেতুর অর্থায়ন প্রত্যাহার করে নিলে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী সাহসিকতার সঙ্গে জাতীয় অর্থায়নে প্রকল্পটি শেষ করার সিদ্ধান্ত নেন। সেই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পরিসরে এক নতুন পরিচয় এনে দেয়।

পদ্মা সেতু ৩০ জুন যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে, যা জাতীয় গর্ব এবং আত্মবিশ্বাসের প্রতীক। যদিও বাংলাদেশের অনেক বৃহৎ প্রকল্প চলমান, তবুও স্পষ্টভাবে বলা যায় যে, আমাদের অবশ্যই শ্রীলঙ্কার পতন থেকে শিক্ষা নিয়ে ঋণের ফাঁদে পড়া এড়াতে হবে।

আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, বাংলাদেশ নিজের পথেই থাকবে — শক্তিশালী এবং মাটির সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। আমাদের পায়ের নিচের মাটি শক্ত, এবং আমাদের ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।