আমার কথাটির বিপরীতে কিছু বলার আগে উত্তর দিন তো—কোন বাংলাদেশে বড় শিল্পী হবে বা উন্নত গান-বাজনা হবে?
আমরা কি আসলেই চাই আমাদের দেশের গান-বাজনা উন্নত হোক, কৌশিকী চক্রবর্তী বা রাহাত ফতেহ আলীর মতো বড় শিল্পী তৈরি হোক?
সবাই বলবে—খুব চাই, হাজার চাই!!!
কিন্তু একবার ভেবে বলুন তো—দেশে এখন অজস্র কোটি টাকার বিয়ে হয়, জন্মদিনের পার্টি হয়, উৎসব-উদ্বোধন হয়। সেখানে কি একটি শাস্ত্রীয় সঙ্গীত আসরের আয়োজন থাকে? বাদ দিন শাস্ত্রীয় সঙ্গীত—সেখানে কি পেশাদার শিল্পী দিয়ে আধুনিক গান বা গজলের আয়োজন হয়? অন্তত পরিচ্ছন্ন লোকগানের আয়োজন হয়?
হয় না।
উদ্বোধন বা কোনও খুশির উপলক্ষে আমরা নানা খাতে টাকা ব্যয় করি, কিন্তু কোনও সঙ্গীতশিল্পীকে দু’পয়সা আয় করার সুযোগ করে দিই না।

আমরা কি আসলেই চাই আমাদের দেশের গান বাজনা উন্নত হোক?
শিল্পী আকাশ থেকে হঠাৎ টপকে পড়বে না। সরকারও কারখানায় বানিয়ে দিতে পারবে না।
আমাদের জীবনে তার প্রয়োজনীয়তা যদি প্রকাশ না করি, তবে সে তৈরি হবেই কেন?
একজন পরিশীলিত সঙ্গীতশিল্পী তৈরি হতে লাগে ১০–১৫ বছরের সাধনা।
সেই পরিশ্রম ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার প্রস্তুতির চেয়ে কম নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে বেশি। আবার সেই সাধনা করলেই যে শতভাগ সফলতা আসবে, তারও কোনও নিশ্চয়তা নেই। কারণ ইঞ্জিনিয়ারের কেবল কারিগরি বিষয় শেখাই যথেষ্ট। কিন্তু শিল্পীর ক্ষেত্রে কারিগরি বিষয় শেখার পাশাপাশি গানটিকে ধরা দেবার সাধনাও লাগে।
আমরা যদি তার মূল্য দিতে না জানি, তবে একজন মানুষ সেই ঝুঁকি নেবে কেন? কেনই বা কোনও অভিভাবক তার সন্তানকে সেই ঝুঁকি নিতে দেবেন?

এবং শুধু আর্থিক নিশ্চয়তা নয়, শিল্পের সামাজিক প্রয়োজনীয়তাও থাকতে হবে।
একজন স্থপতিকে (আর্কিটেক্ট) যদি সারা জীবন নিয়মিত বেতন দেওয়া হয়, কিন্তু কোনও ভবন নকশা করার সুযোগই না দেওয়া হয়, কিংবা তার নকশা করা ভবন মানুষ না-ই দেখে—তাহলে কি ভালো স্থপতি তৈরি হবে? হবে না।
একইভাবে আমরা যদি শিল্পীর শিল্পের মূল্যায়ন না করি, প্রশংসা না করি, তবে শিল্পীও তৈরি হবে না।
খেয়াল করবেন—কেউ যদি কোনও সঙ্গীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেও, আমরা ধৈর্য ধরে শুনতে পারি না। পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা তখনই পাশের জনকে বলা জরুরি হয়ে পড়ে। খুব গুরুত্বপূর্ণ ফোন ধরতে হয়। কিংবা একটু উঠে ঘুরে বেড়িয়ে আসার অদম্য ইচ্ছা সামলাতে পারি না।
এসবের ফলে শিল্পী যেমন নিরুৎসাহিত হন, তেমনি আয়োজকরাও হতাশ হয়ে পড়েন।

আমরা যদি সত্যিই চাই আমাদের দেশে গান-বাজনার মান উন্নত হোক, তবে কেবল কথার ফুলঝুরি দিয়ে চলবে না। আমাদের জীবনের অংশ হিসেবেই সঙ্গীতকে জায়গা দিতে হবে, শিল্পীর পরিশ্রমের যথাযথ মূল্য দিতে হবে, আর সাংস্কৃতিক আসরে মনোযোগী ও সম্মানজনক আচরণ করতে হবে।
শিল্পী তৈরি হয় সাধনা, মূল্যায়ন ও সামাজিক সমর্থনের মাধ্যমে—শুধু ইচ্ছার প্রকাশে নয়।
