শিক্ষার উপরে ভ্যাট প্রত্যাহার আন্দোলন

শিক্ষার উপরে ভ্যাট প্রত্যাহার আন্দোলন : শিক্ষা কোন পণ্য নয়। সংবিধানে শিক্ষা, স্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। সেই অনুযায়ী সরকার উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা করতে না পারায় দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত গড়ে উঠেছে। যাদের সামর্থ্য রয়েছে তারাই সেখানে পড়াশোনা করছেন।

সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেটে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল এবং ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি’র ওপর সাড়ে সাত শতাংশ হারে মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট) আরোপ করেছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড গত ৪ জুলাই এ বিষয়ে আদেশ জারি করে। এতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় অভিভাবকদের উচ্চশিক্ষার প্রতি নিরুসাহী হবে। এমন কী অনেক শিক্ষার্থীর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

আমাদের দেশে যে কোন জিনিষের স্ট্যান্ডর বা রেফারেন্সের জন্য ভারতের উদাহরণ দেখা হয়। প্রতিবেশী দেশটিতেও ভ্যাট আরোপ করা হয়ে ছিল। কিন্তু শিক্ষার্থীদের চাপের মুখে তা বাতিল করতে হয়।
বর্তমানে দেশের ৩৭টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে আসন ৪২ হাজার নয়শত ৮৪ জন (জাতিয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় বাদ দিয়ে।), অন্যদিকে ৮৩টি প্রাইভেট ইউনিভার্সিটিতে পড়তে পরে ৩ লক্ষ ২৩ হাজার ৫১১ জন। যাঁদের ৭০ শতাংশই নিম্ন ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান।’

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে খরচ কম কারণ সেখানে ভর্তুকি আছে। এখানে শিক্ষার্থী প্রতি বছরে এক লক্ষ ১০ হাজার টাকা ভর্তুকি দেয়া হয় ট্যাক্স পেয়ারদের টাকায়। প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার খরচ হয় গড়ে ৫-৬ লক্ষ টাকা। ভর্তুকি বাদ দিলে পাবলিক এবং প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের খরচ কিন্তু প্রায় কাছাকাছি চলে আসে। ইউজিসির হিসাব অনুসারে দেশের উচ্চশিক্ষার ৬৩ ভাগ শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছেন এই সব বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে যেসব শিক্ষার্থী পড়ালেখা করছেন, সরকার তাঁদের পড়ালেখা করাতে গেলে ব্যয় হতো প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা।

এই বিষয়ে মাননীয় অর্থমন্ত্রীর ২টি ভাষ্য পাওয়া যায় যার একটিতে তিনি বলেন, “এসব প্রতিষ্ঠানে ৩০ হাজার, ৫০ হাজার টাকা বেতন দিতে পারে। অথচ মাত্র সাড়ে ৭ শতাংশ ভ্যাট কেন দিতে পারবে না?”

অপর পাবলিক স্টেটমেন্টে তিনি বলেন, “শিক্ষাকে বাণিজ্যিক পণ্য হিসেবে ব্যবহার করছে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এদের প্রতি কোনো ধরনের সহমর্মিতা দেখানোর সুযোগ নেই।”

১৯৯২ সালে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশেও উল্লেখ আছে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো হবে অলাভজনক ও সেবামূলক। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর ভ্যাট আরোপ সংবিধানের ১৫, ১৭ ও ১৯ এর লঙ্ঘন। সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেবার বিনিময়ে প্রাপ্ত সমুদয় অর্থের শতকার ৫০ ভাগ। কিন্তু সরকার এর বাইরেও নিট মূল্য সংযোজন করের সাড়ে সাত শতাংশ শিক্ষার্থীদের ওপর চাপিয়ে দেয়। যা সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। কাগজে কলমে মনে করা হচ্ছে ভ্যাট বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ দিবে। কিন্তু চাপিয়ে দেয়া হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের উপরে।

বলা হয়ে থাকে মালিকদের স্বার্থে ২০১০ সালে বেসরকারি অধ্যাদেশের বিভিন্ন ধারার শব্দ ও ভাষার কৌশলগত পরিবর্তন এনে এর খরচ এবং মালিকপক্ষের মুনাফা শিক্ষার্থীর ফি’র উপর নির্ভরশীল করা হয়। এখন ভ্যাট আরোপ করে সরকারও কিন্তু শিক্ষাবানিজ্যের অংশীদার হয়ে পড়ছে।

ভ্যাট আরোপের প্রতিবাদে এতদিন সীমাবদ্ধ ছিল সোশ্যাল নেটওয়ার্কে। এখন সড়ক অবরোধের, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া, লাঠিচার্জ এবং গুলি ছোড়ার মত পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। যা মোটেই কাম্য নয়।

কিন্তু: ১
‘ভ্যাট আরোপ করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না’-এই বিষের উপরে হাইকোটে তিনটি রিট রয়েছে। মাননীয় আদালত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিক্যাল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষার্থীদের টিউশন ফির ওপর সরকারের ভ্যাট আরোপ করা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছেন। অর্থসচিব, অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সচিব, শিক্ষাসচিব, এনবিআর চেয়ারম্যান ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যানকে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।

আদালত পর্যন্ত বিষয়টি গড়ানোর পরেও ছাত্রদের পথে নেমে আসা, সহিংসতা- কি ইংগিত দেয় না ছাত্রদের ক্ষোভ সহিংস আন্দোলনের দিকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা হচ্ছে।

কিন্তু: ২
খোঁজ নিয়ে জানলাম। একাধিক বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাঁরা ভ্যাটের টাকা নিজেরাই দিবে। এই তথ্যটি সঠিক হলে এক্ষেত্রে সমাধানের পথ রয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে তারা চায়লে ভ্যাট নিজেরাই দিয়ে দিতে পারে। পথের নয়, ক্যাম্পাসেই সুরাহা হতে পারে এই পরিস্থিতির।

সমস্যটা যখন যেসব প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে ভ্যাটের টাকা আদায় করছে সেসব জায়গায়। তাহলে কারা কি কারণে অন্যান্য প্রাইভেট এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলনে শরিক হতে বলছে।

Leave a Comment