শাসনতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য -বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ

শাসনতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একটি বিস্তারিত প্রস্তাব রাখেন। প্রস্তাবটি এখানে তুলে ধরা হলো।

Table of Contents

যথাযর্থ সজীব গণতন্ত্র :

এমন একটা যথার্য সজীব গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে যেখানে জনগণ স্বাধীনতা এবং মর্যাদার সাথে জীবন যাপন করতে পারবে এবং ন্যায় ও সাম্য বিরাজ করবে।

ইসলাম :

শাসনতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান | Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান | Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman

জনসংখ্যার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের প্রিয় ধর্ম হলো ইসলাম। আওয়ামী লীগ এই মর্মে সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে শাসনতন্ত্রে সুস্পষ্ট গ্যারান্টি থাকবে যে পবিত্র কোরান ও সুন্নায় সন্নিবেশিত ইসলামের নির্দেশাবলীর পরিপন্থি কোন আইন পাকিস্তানে প্রণয়ন বা বলবৎ করা চলবে না। শাসনতন্ত্রে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান সমূহের পবিত্রতা রক্ষার গ্যারান্টি সন্নিবেশিত হবে। সর্বস্তরে ধর্মীয় শিক্ষা সম্প্রসারণের জন্য পর্যাপ্ত বিধিব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

সংখ্যালঘু :

সংখ্যালঘুরা আইনের দৃষ্টিতে সম্পূর্ণ সমান অধিকার ভোগ করবে এবং আইনের কাছে সমান আশ্রয় পাবে। তারা পূর্ণ নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। নিজেদের ধর্ম পালন এবং প্রচারে, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন এবং পরিচালনায় এবং স্ব-স্ব ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় শিক্ষাদানের ব্যাপারে সংখ্যালঘুদের অধিকার শাসনতান্ত্রিকভাবে রক্ষা করা হবে। স্বীয় ধর্ম ব্যতীত অন্য যে কোন ধর্ম প্রচারের জন্য সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কোন ব্যাক্তিকে কর দিতে বাধ্য করা হবে না। নিজ ধর্মের সহিত সংশ্লিষ্ট না হলে কোন ব্যাক্তিকে ধর্ম সম্পর্কীয় কোন নির্দেশ গ্রহণ অথবা কোন ধর্মীয় উপাসনা বা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার ব্যাপারে জোড় করা হবে না।

জীবনের মৌলিক চাহিদা পূরণের নিশ্চয়তা দানে রাষ্ট্রের দায়িত্ব :

অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা, চিকিৎসা এবং উপযুক্ত পারিশ্রমিকের কর্ম সংস্থানের সুযোগসহ প্রতিটি নাগরিকের প্রাথমিক চাহিদা পূরনের মৌলিক দায়িত্ব রাষ্ট্রের-একতার স্বীকৃতি শাসনতন্ত্রে থাকবে।

আইনের দৃষ্টিতে সাম্য:

প্রত্যেক নাগরিকের শাসনতান্ত্রিকভাবে সাম্য ও আইনের সমান আশ্রয় দেওয়ার গ্যারান্টি দেওয়া হবে। এই গ্যারান্টি কার্যকর করাকে সুনিশ্চিৎ করার জন্য যাতে প্রত্যেকটি নাগরিক নিজের অধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আইনগত সাহায্য পায় তার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব হবে।
আওয়ামী লীগ প্রত্যেক মানুষের মর্যাদা এবং ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, গোত্র নির্বিশেষে সকল নাগরিকের সাম্যের নীতির প্রতি বিশ্বাস পুনরায় ঘোষণা করেছে এবং সকল নাগরিককে গণতান্ত্রিক সমাজের সর্বক্ষেত্রে নাগরিক হিসেবে গণ্য করে।

মৌলিক অধিকার:

বাক্ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা, জনসভা আহ্বানের স্বাধীনতা, সমিতি গঠনের স্বাধীনতা, ধর্মীয় স্বাধীনতা এবং বিগতকাল থেকে শাস্তি কার্যকর করা ও সর্বোপরি বে-আইনী গ্রেফতার এবং বিনা বিচারে আটক থেকে রক্ষার ব্যবস্থাসহ সকল মৌলিক অধিকার শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে সুরক্ষিত করা হবে। অস্পুশ্যতা, দাসত্ব এবং বল পূর্বক শ্রম আদায় নিষিদ্ধ করা হবে।
প্রত্যেক নাগরিকের জন্য ‘সার্বজনীন মানবিক অধিকার ঘোষণার’ অন্তর্গত অধিকার সমূহ নিশ্চিত করা হবে।
এতদ্ব্যতীত শাসনতন্ত্রের বিধান থাকবে যে, যুদ্ধকালীন প্রকৃত আক্রমণাদির সময় ছাড়া মৌলিক অধিকার খর্ব করা যাবে না। জাতীয় জরুরী অবস্থার অজুহাতেও এই অধিকার খর্ব করতে দেওয়া যাবে না।

বিচার বিভাগের স্বাধীনতা:

শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। শাসনতন্ত্রে প্রশাসন বিভাগ থেকে বিচার বিভাগের সম্পূর্ণ পৃথকীকরণের নিশ্চয়তা থাকবে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা বজায় রাখার মত চরিত্রবান, জ্ঞানবান এবং ন্যায়বান ব্যাক্তিরাই যাতে বিচার বিভাগের সদস্য হতে পারেন শাসনতন্ত্রে সেইরূপ বিধান রাখা হবে।

ফেডারেল বিধান:

পাকিস্তানহবে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর প্রত্যেকটিকে ৬ দফা ফর্মুলার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্বশাসন প্রদানকারী ফেডারেল রাষ্ট্র (যুক্তরাষ্ট্র)।

 

১নং দফা:

সরকারের ধরণ হবে ফেডারেল এবং পার্লামেন্টারী। এতে ফেডারেল আইনসভার এবং ফেডারেশনের অন্তর্গত ইউনিটগুলোর আইনসভার নির্বাচন হবে প্রত্যেক এবং সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে। ফেডারেল আইনসভার প্রতিনিধিত্ব হবে জনসংখ্যার ভিত্তিতে।

২নং দফা:

ফেডারেল সরকারে হাতে থাকবে কেবল মাত্র দেশরক্ষা, পররাষ্ট্রীয় বিষয় এবং নিচে ৩ নং দফার বর্ণিত শর্তাধীনে মুদ্রা।

৩নং দফা:

দেশের দুইটি অংশের জন্য দুইটি পৃথক এবং সহজ বিনিময়যোগ্য মুদ্রা থাকবে অথবা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যবস্থা সহ দুই অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। এতে আঞ্চলিক ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক থাকবে। এই ব্যাঙ্কগুলো এক অঞ্চল থেকে অন্য অঞ্চলে সম্পদ হস্তান্তর এবং মূলধন পাচার বন্ধের ব্যবস্থা করবে।

৪নং দফা:

রাজস্ব সম্পর্কিত নীতি নির্ধারণের দায়িত্ব এবং ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর হাতে থাকবে। দেশরক্ষা এবং পররাষ্ট্র দফতর পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় রাজস্ব ফেডারেল সরকারকে দেয়া হবে। শাসনতন্ত্রে বর্ণিত পদ্ধতি অনুসারে নির্ধারিত হারের ভিত্তিতে উক্ত রাজস্ব আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থায় ফেডারেল সরকারের তহবিলে জমা হবে। করনীতির উপর অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার অভিলক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে ফেডারেল সরকারের রাজস্বের প্রয়োজন মিটাবার নিশ্চয়তা বিধানের ব্যবস্থা শাসনতন্ত্রে থাকবে।

৫নং দফা:

ফেডারেশনের অন্তর্গত অঙ্গরাষ্টগুলোর নিয়ন্ত্রণে প্রত্যেকটি ইউনিটের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পৃথক হিসাব রাখার শাসনতান্ত্রিক বিধান থাকবে। শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত পদ্ধতি অনুযায়ী ধার্য হারের ভিত্তিতে অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার চাহিদা মিটাবে। ফেডারেল সরকার কর্তৃক পররাষ্ট্র নীতির কাঠামোর মধ্যে থেকে আঞ্চলিক সরকারগুলোকে বৈদেশিক বাণিজ্য এবং বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে আলাপ-আলোচনা ও চুক্তির ক্ষমতা শাসনতন্ত্রে দেওয়া হবে।

৬নং দফা:

কার্যকরভাবে জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় শরীক হওয়ার উদ্দেশ্যে ফেডারেশনের অঙ্গরাষ্ট্রগুলোকে ‘মিলিশিয়া’ বা ‘প্যারামিলিশিয়া’ রাখার ক্ষমতা দেওয়া হবে।

 

এক ইউনিট বাতিল :

এক ইউনিট বাতিলের ফলে যদি কোন সাধারণ বিষয় অমীমাংসিত থেকে যায় তবে তা ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানের উইনিটগুলোর জনসাধারণের ইচ্ছানুযায়ী মীমাংসা করার জন্য রেখে দেওয়া হবে।

ফেডারেল সরকারের প্রতিনিধিত্ব:

ফেডারেল সরকারের সকল শাখায় ও ফেডারেল সার্ভিসে জনসংখ্যার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সকল অংশের মানুষের ন্যায্য প্রতিনিধিত্ব লাভের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য শাসনতান্ত্রিক সংবিধান থাকতে হবে। স্বল্প প্রতিনিধিত্বশীল অঞ্চলগুলো, বিশেষতঃ পূর্ব পাকিস্তানথেকে বর্ধিত হারে লোক নিয়োগের মাধ্যমে যতসত্বর সম্ভব বর্তমানের স্বল্প প্রতিনিধিত্বের অবসান করা হবে। প্রাথমিক সংশোধনমূলক পদক্ষেপ হিসাবে বর্তমানে করাচিতে অবস্থিত নৌবাহিনীর সদর দফতর ও প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোকে চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করা হবে।

গণতান্ত্রিক প্রশাসন :

বর্তমান প্রশাসনযন্ত্রগুলো একটি ঔপনিবেশিক সরকারের কার্যাবলী সম্পাদনের উদ্দেশ্যে পরিকল্পিত হয়েছিল। একটি চলমান, গণতান্ত্রিক সমাজের বা রাষ্ট্রের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে এই প্রশাসনযন্ত্রের কাঠামোর আমূল পুনগঠনের প্রয়োজন। এজন্য যে অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট্যগুলো নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থায় শাসনতন্ত্রে প্রতিফলিত হবে, তা হলো ঃ

ক. বর্তমান নিখিল পাকিস্তানও সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসের বিলোপ সাধন।
খ. পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা এই দুটি ফেডারেল প্রশাসন পরিচালনার জন্য ফেডারেল সার্ভিস প্রবর্তন এবং জনসংখ্যার ভিত্তিতে পাকিস্তানের সকল অংশ থেকে এতে লোক নিয়োগ।
গ. অঙ্গরাষ্ট্রগুলো কর্তৃক নিযুক্ত ও নিয়ন্ত্রিত কর্মচারীদেও সমন্বয়ে কতিপয় বিশেষ পেশাদার ক্যাডার প্রবর্তন। এই ক্যাডার কর্মকুশলতা ও মেধার মুল্যায়নের ভিত্তিতে অধিকতর সচলতা বিধানকারী সার্ভিস রুলের একটি নয়া কাঠামোর অধীনে থাকবে।
ঘ. জেলা প্রশাসনের দায়িত্ব নির্বাচিত পরিষদের উপর অর্পণ। বিশেষভাবে শিক্ষিত কর্মচারীরা এই পরিষদকে সাহায্য করবে।
ঙ. মহকুমাগুলোকে জেলায় পরিণত করে মৌলিক প্রশাসন উইনিটের আকার হ্রাস ও অন্যান্য ব্যবস্থার মাধ্যমে স্থানীয় সরকারী সংস্থাগুলোকে শক্তিশালী করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
চ. প্রশাসনিক কর্তব্য পালনের ক্ষেত্রে দূর্ণীতি, স্বজনপ্রীতি ও স্বেচ্ছাচার উচ্ছেদের উদ্দেশ্যে প্রশাসনিক কার্যাবলী তদারক ও নিয়ন্ত্রণের জন্য কার্যকর ব্যবস্থাদি গ্রহণ।

অর্থনৈতিক কর্মসূচীর ভিত্তি:

শোষণমুক্ত একটা ন্যায় ও সাম্যবাদী সমাজ গঠন করাই অর্থনৈতিক কর্মসূচীর মূল লক্ষ্য। এটা একটা সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার রূপকল্প-যাতে অর্থনৈতিক অবিচার দূরীকরণ ও দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন করা হবে এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের ও সকল স্তরের মানুষের মধ্যে এই সমৃদ্ধিও ফল যথাযথ বন্টনের বিধান থাকবে। যে সমাজের অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যের অতল তলে নিমজ্জিত এবং জীবনের মৌলিক প্রয়োজনগুলো থেকে বঞ্চিত, সেখানে দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির প্রয়োজন অপরিহার্য। আমাদের সমাজের নব জাতকের সংখ্যার উর্দ্ধগতি ও মৌলিক সম্পদের স্বল্পতার পরিপ্রেক্ষিতে দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি অর্জনে বিরামহীন সংগ্রাম ও বিপুল ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন। আমাদের কাজ হলো গণতান্ত্রিক কাঠামোর আওতায় দেশে একটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লব সাধন। সংগ্রাম ও ত্যাগ ব্যতীত দ্রুত অর্থনৈতিক উন্নতি সাধন ও ন্যায়-পরায়ন সমাজ বা রাষ্ট্র গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া মিথ্যা অঙ্গীকারের সামিল।

দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি সাধনের লক্ষ্য অর্জনের অঙ্গীকার নিজেদের আবদ্ধ করে আমরা দেশবাশীকে প্রকৃতপক্ষে বিরামহীন সংগ্রাম ও সব রকম ত্যাগ স্বীকারে প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানাচ্ছি। আমাদের বিশ্বাস, দেশের সকল স্তরের মানুষ ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চল সমানভাবে ত্যাগের বোঝা বহণ করবে এবং অর্থনৈতিক উন্নতির ফলও সমানভাবে ভোগ করবে-এই নিশ্চয়তা দিতে পারলেই আমরা তাদের কাছে এই আহ্বান জানাতে পারি। অতীতে অধিকতর দরিদ্র মানুষ এবং দরিদ্রতর অঞ্চলগুলোকে দিয়ে এই ত্যাগের বোঝা বইয়ে নেওয়া হয়েছে এবং নগণ্য সংখ্যক সুবিধাভোগী অর্থনৈতিক উন্নতির ফসল ঘরে তুলছে। অর্থনৈতিক উন্নতির এই অন্যায় পন্থাকে আমরা সম্পুর্ণভাবে প্রত্যাখ্যান করি।

সামাজিক অসাম্যের গোড়ায় এমন একটি ক্রুটিপুর্ণ প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো রয়েছে যা ব্যাক্তিগত উদ্যমকে (enterprise) অর্থনৈতিক উন্নতির একমাত্র বাহনে পরিণত করে। ব্যক্তিগত মুনাফার পথ ধরে দেশের সম্পদ অপরিহার্যভাবেই মুষ্টিমেয় কতিপয় ব্যক্তির হাতে পুঞ্জীভূত হয় এবং অর্থনীতির মূল সেক্টরগুলো শক্তিশালী ‘কোটারি’র হাতে চলে যায়। এটা সামাজিক সুবিচার ও সাম্যের লক্ষ্যে পৌঁছা অসম্ভব করে তুলে। তাই জাতীয়করণ, সরকারী সেক্টরের সম্প্রসারণ, সমবায় সংগঠনগুলোর উন্নয়ন এবং শিল্প কারখানার ব্যবস্থাপনা ও মালিকানায় শ্রমিকের অংশীদারত্বের মতো নয়া প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর পরিবর্তন দরকার। নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ভিত্তি স্থাপনের জন্য পরিকল্পিত নির্দিষ্ট নীকিগুলো নিম্নরূপ হবে।

 

সরকারী খাত ও জাতীয়করণ:

শুধুমাত্র ক্রমবর্ধমান ট্যাক্স ধার্য করে এবং নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেই সম্পদ পুঞ্জীভূতকরণ এবং অর্থনীতির প্রধান সেক্টরগুলোর নিয়ন্ত্রণ অধিকার থেকে সুবিধাভোগী কোরিকাকে বিরত রাখা সম্ভব নয়; কার্যকরভাবে এই সমস্যাগুলোর মোকাবেলা করার জন্য অর্থনীতির প্রধান সেক্টরগুলোর জাতীয়করণ এবং ভবিষ্যতে মূল সেক্টরগুলো সরকারী খাতের আওতাভুক্ত করার নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে। সামাজিক ন্যায় বিচারের অভিলক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে অর্থনীতির উন্নতি করতে হলে এই ধরণের জাতীয়করণের কর্মসূচী গ্রহণ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির পূর্বশর্ত। অবশ্য, অত্যন্ত সুসামঞ্জস্য পরিকল্পনা সহকারে জাতীয়করণ-কর্মসূচী রূপায়ন করতে হবে।

প্রশাসনিক কর্মচারীর এবং সর্বোপরি দক্ষতার উপর অতিরিক্ত চাপ না করে সেদিকে লক্ষ্য রেখে জাতীয়করনের মাত্রা, গতি গঠন বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। উপযুক্ত প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা উদ্ভাবিত না হলে মূল্য নির্ধারণ নীতির ত্রুটি এবং আমলাতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও নিয়ন্ত্রণের জন্য রাষ্ট্রায়ত্ব সংগঠনগুলো অদক্ষতায় আক্রান্ত হতে পারে-সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ সজাগ থাকা এবং এটা সুষ্পষ্টই দেখা যায় যে, রাষ্ট্রায়ত্ব সংগঠনগুলোর পরিচালনার জন্য নতুন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সবচেয়ে ভাল পেশাদার কর্মচারী নিয়োগ করলে ব্যবস্থাপনা দক্ষতার সর্ব্বোচ্চমান পোঁছান যেতে পারে। উপরোক্ত বিষয়গুলির প্রতি লক্ষ্য রেখে জাতীয়করণের জন্য অগ্রাধিকারের তালিকাটি নিচে দেওয়া হলো :

১. ব্যাঙ্কিং।
২. বীমা।
৩. লোহা ও ইস্পাত, খনি, মেশিন যন্ত্রপাতি, ভারী ইঞ্জিনিয়ারিং, পেট্রো-কেমিক্যাল, সার, সিমেন্ট, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সহ ভারী শিল্প।
৪. বৈদেশিক বাণিজ্য-বিশেষতঃ নিম্নলিখিত পাট ও তুলা ছাড়াও লৌহ ও ইস্পাত দ্রব্য, কয়লা, খাদ্রশস্য, সিমেন্ট এবং সার সহ প্রধান প্রধান পন্যের আমদানী রপ্তানি।
৫. পাট ব্যবসা।
৬. তুলা ব্যবসা।
৭. শিপিংসহ প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা, আন্তঃ-আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরিবহণ।
৮. পরিকল্পনা সংস্থা কর্তৃক নির্ধারিতব্য অপারাপর মূল শিল্প-কারখানা।

 

ক্রমবর্ধমান কর:

দেশের বর্তমান কর প্রথায় মুষ্টিমেয় বিশেষ সুবিধাভোগীর প্রতি চিরাচরিত আনুকূল্যই প্রতিফলিত হয়েছে এবং এই করপ্রথা পৃথিবীতে সর্বাপেক্ষা পশ্চাৎমুখি। উচ্চতর উপার্জনকারী শ্রেণীর উপর ধার্য করে বোঝা আন্তর্জাতিক মানের হিসাবে সবচেয়ে কম। সামাজিক সুবিচার প্রতিষ্ঠানকল্পে সাধারণ মানুষের স্কন্ধে পরোক্ষ করের মাধ্যমে অধিক পরিমাণে অর্থ আদায়ের নিশ্চয়তা বিধানের জন্য কর কাঠামোর আমূল রদ-বদলের প্রয়োজন। এইজন্য আয়করে একটি সত্যিকারের ক্রমবর্ধমান প্রথা প্রচলন এবং মূলধনের লাভ (Capital gains) মুনাফা, সম্পদ, উপহার ও উত্তরাধিকারের উপর থেকে মোটা পরিমানের ট্যাক্স আদায় করা আবশ্যক। উপরন্ত বর্তমানে প্রচলিত ‘ছাড়’ (deduction) অব্যাহতি (exemptions) এবং ‘ট্যাক্স হলিডে’ প্রথা সামাজিক অসাম্য আরো বাড়িয়ে দিয়েছে এবং সম্পদ পুঞ্জিভূত করতে সাহায্য করছে। এই সকল বিষয় ব্যাপকভাবে পর্যালোচনা করা প্রয়োজন এবং উপরোল্লিখিত সামাজিক অভিলক্ষ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয় এ ধরনের ‘ছাড়’ অব্যাহতি ‘ট্যাক্স হলিডে’ প্রথা দূর করতে হবে।

আন্তঃ আঞ্চলিক ও আন্তঃ আঞ্চলিক বৈষম্য:

গত ২৩ বছরেরও বেশী সময় ধরে পূর্ব পাকিস্তানথেকে ক্রমাগত পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার এবং বৈদেশিক মুদ্রা ও সাহায্যের সিংহভাগ পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যবহারের দরুণ পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আন্তঃ আঞ্চলিক বৈষম্য আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে গেছে। পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলেই এবং প্রত্যেক অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার মধ্যে বৈষম্য রয়েছে। ন্যায় বিচারের খাতিরে পাকিস্তানের অধিক উন্নত অঞ্চলগুলো থেকে স্বল্পোন্নত অঞ্চলে উল্লেখযোগ্য পরিমানে সম্পদ স্থানান্তর করা উচিত এবং আন্তঃ আঞ্চলিক বৈষম্য হ্রাস ও পরিশেষে নির্মূল করার উদ্দেশ্যে ফেডারেশনের ইউনিট সরকারগুলোকে নীতি গ্রহণ করতে হবে।

মৌলিক প্রয়োজন মিটানোর ব্যবস্থা:

জনগণ তাদের মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পেতে পারেন তার ব্যবস্থা করা রাষ্ট্রের দায়িত্ব-এই নীতি অনুসরণ করে বিপুল পরিমান পণ্য মজুদ, বন্টন ও গুদামজাত করার এবং সর্বোপরি অর্থ সাহয্যের (সাবসিডি) মাধ্যমে যাতে জনগণ সব সময়ে ন্যায্য মূল্যে মৌলিক প্রয়োজনীয় জিনিসগুলো পেতে পারেন তার নিশ্চয়তা বিধানের জন্য দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। প্রথমেই যে সব প্রধান পণ্যকে এই ব্যবস্থার আওতায় আনা হবে তার মধ্যে থাকবে চাল, গম, লবন, কেরোসিন। খাদ্য হিসাবে ব্যবহার্য্য তৈল ও মোটা সূতি কাপড়।

মনোপলি ও কার্টেল:

মনোপলি (একচেটিয়া ব্যবসায়) ও কার্টেল (দাম বেঁধে দেওয়ার উদ্দেশ্যে বনিকদের আঁতাত) প্রথা মুলতঃ ন্যায় ও সাম্যনৈতিক সমাজ প্রতিষ্ঠার দুশমন এবং সেজন্য অর্থনৈতিক কাঠামোগত যে পরিবর্তন উদ্ভাবন করা হয়েছে তা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে মনোপরি ও কার্টেল প্রথাকে সম্পূর্ণ নির্মূল করার নিশ্চয়তা দেবে।

বিলাস দ্রব্যের উপর বিধি নিষেধ:

দ্রুত অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় ত্যাগের সমান অংশীদারিত্বের মূলনীতি অনুসরণে বিলাসদ্রব্য ব্যবহারের উপর কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করতে হবে। কতিপয় ভাগ্যবানকে যথেচ্ছ পরিমান বিলাস দ্রব্য ব্যবহারের প্রশ্রয় দিয়ে মেহনতি মানুষের প্রতি ত্যাগ স্বীকারের আহ্বান জানানো অন্যায়। বিলাস পণ্যের ব্যবহার সীমাবদ্ধ করার জন্য যে সমস্ত বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তাতে থাকবে :

ক. বিলাস দ্রব্যের আমদানির উপর পূর্ণ নিষেধাজ্ঞা।
খ. দেশে বিলাস দ্রব্য উৎপাদনের উপর কঠোর বিধিনিষেধ।
গ. জনগণের আশ্রয়স্থলের মৌলিক চাহিদা পূরণ না হওয়া পর্যন্ত বিলাসবহুল ও জাঁকালো দালান নির্মানের উপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা।

ক্রমবর্ধমান মুদ্রাস্ফীতির চাপে গুরুতররূপে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের কেবলমাত্র অর্থমঞ্জুরী নহে, প্রকৃত মজুরীর মান রক্ষা ও বৃদ্ধির জন্যই উপরে বর্ণিত মূল্য স্থিতিশীলতার ব্যবস্থা প্রণয়ন করা হয়েছে।

 

শিল্প:

অতীতে শিল্প উন্নয়নের জন্য গৃহীত নীতিগুলো সমাজের প্রয়োজন মিটানোর দিকে বড় নজর দেয়নি। আমাদের সমাজের শিল্পোন্নয়নের মূল লক্ষ্য হবে-

ক. উৎপাদনশীল সরঞ্জাম (Capital goods) ও ভোগ্যপন্যের মূল আবশ্যকতা পুরণার্থে একটি শৈল্পিক ভিত্তি স্থাপন।
খ. মৌলিক আবশ্যকীয় দ্রব্যের জন্য বৈদেশিক সূত্রের উপর বিপজ্জক নির্ভরশীলতা হ্রাস।
গ. কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি।

উপরোক্ত লক্ষ্য অর্জনে আমাদের অতীতের নীতিগুলো শুধু ব্যর্থই হয়নি উপরোক্ত বৈদেশিক মুদ্রা ও বৈদেশিক ঋণ সহ দুষ্প্রাপ্য সম্পদগুলোর বিপুল অপচয় ঘটিয়াছে। মৌলিক সামাজিক লক্ষ্য অর্জন ত্বরাম্বিত করার জন্য পরিকল্পিত শিল্পায়নের নয়া বাস্তবায়ন কৌশলের রূপরেখা নীচে দেওয়া হলোঃ

ভারী ও বৃহদায়তন শিল্প কারখানা:

রাষ্ট্রায়ত্ব খাতঃ

ভারী ও বৃহদায়তন শিল্প কারখানার জাতীয় করণের ক্ষেত্রে উপরোক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

অ-রাষ্ট্রায়ত্ব খাতঃ

যে সব বৃহদায়তন শিল্প জাতীয়করণ করা হয়নি সেগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনা সংস্থাগুলো কর্তৃক আরোপিত শৃংক্ষলার অধীন থাকবে।

ব্যবস্থাপনা ও ইকুইটি মুলধনে শ্রমিকদের অংশিদারিত্বঃ

যে সমস্ত শিল্প কারখানা সত্বর জনগণের মালিকানধীনে আনা হবে না, সরকার ক্রমবর্ধমান হারে তাদের ‘ইকুইটি’ মুলধন দখল করবে। সরকার যেটুকু ইকুইটি মুলধন আয়ত্ব করবে সংশ্লিষ্ট শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিকরা যৌথভাবে সেই পরিমান অংশের মালিকানা লাভ করবে এবং সেই পরিমান অংশের মুনাফার ভাগ পাবে। শ্রমিকরা কেবল ইকুইটি মুলধনের নয় শিল্প কারখানার ব্যবস্থাপনায়ও অংশগ্রহণ করবে।

 

মাঝারি আয়তন শিল্প কারখানাঃ

বেসরকারী খাতে মধ্যমায়তন শিল্প কারখানার উন্নতির জন্য সরকার উৎসাহ ও প্রয়োজনীয় প্রেরণা যোগাবে। অবশ্য এইসব শিল্প কারখানা পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো কর্তৃক আরোপিত শৃক্ষলার অধীনে থাকবে।

ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পঃ

আমাদের অর্থনীতিতে ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকার উৎসাহ ও সাহায্য যোগাবে এবং নিয়মিত কাঁচামাল সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধান করবে। উদাহরণ স্বরূপ, তাঁতীরা ন্যায্যমুল্যে সুতা, প্রচুর পরিমানে ঋণ ও বাজারের যাবতীয় সুবিধা পাবে। ক্ষুদ্রায়তন শিল্প-কারখানা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচীর উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বৃহদায়তন শিল্প-কারখানার পরিপুরক হওয়ার মত করে এই সব ক্ষুদ্রায়তন শিল্প-কারখানাকে উন্নত করা হবে। সমবায়ের মাধ্যমে এইসব ক্ষুদ্রায়তন শিল্প-কারখানাকে যতদূর সম্ভব উন্নিত করা হবে।
কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে চাল ও আটার কল, তেল কারখানা, চিনির কল এবং অনুরূপ কৃষিজ পন্যশিল্প যতদূর সম্ভব বেশী করে স্থাপন করা ও চালানো হবে। যাতে গ্রামাঞ্চলে দূরপ্রাপ্তসহ দেশের সর্বত্র ক্ষুদ্রায়তন শিল্প ছড়িয়ে পড়তে পারে সেই ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। গ্রামাঞ্চলের সাধারণ মানুষ যাতে শিল্পায়নের সুযোগ-সুবিধার শরীক হতে পারে এবং শহরগুলোর উপর থেকে মানুষের ভীড় ও চাপ কমে যায় সেটাই এই ব্যবস্থার লক্ষ্য।

কৃষি ও গ্রামের জনগণঃ

আমাদের জনগণের অধিকাংশই গ্রামাঞ্জলের অধিবাসী। সেজন্য কৃষি ও গ্রামের মানুষের অবস্থা উন্নয়নের উপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া না হলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের সমস্ত পরিকল্পনাই অর্থহীন হয়ে পড়বে। একদিকে আমাদের গোটা সমাজের সর্বত্র দারিদ্র ছড়িয়ে পড়েছে, অন্যদিকে গ্রাম ও শহরের জীবন যাত্রার মানের মধ্যে গুরুতর বৈষম্য রয়েছে। এর পিছনে ঐতিহাসিক কারণ থাকলেও নিকট অতীতে সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির জন্য এই বৈষম্য আরো বেড়ে গেছে। ফলে, গরীব চাষির হাত থেকে সম্পদ ধনী পুজিপতিদের হাতে ব্যাপকভাবে পাচার হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ অবিলম্বে গ্রামাঞ্চলের জনগণকে এইরূপ শোষণের হাত থেকে বাঁচাবার অঙ্গিকার করছে। আর এটা করতে হলে কৃষিখাতে সুদূর প্রসারী বিপ্লবের প্রয়োজন এবং এ ধরনের বিপ্লব সাধনের পূর্ব শর্ত হলো ভূমি ব্যবহারে বর্তমান পদ্ধতির আমূল পরিবর্তন সাধন এবং বহুমুখী সমবায়ের মতো নয়া প্রতিষ্ঠান স্থাপন।
আমাদের গ্রামাঞ্চলের জনগণের আরো ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন রয়েছে। সেই সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, অতীতের শোষণের ফলে সৃষ্ট অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের কৃষিকে নতুন জীবন দিতে হলে সরকারকে প্রভূত পরিমানে সার ও উন্নত বীজ থেকে শুরু করে নলকূপ, পাওয়ার পাম্প ও কীটনাশক ঔষধ ইত্যাদি সাহায্য দিতে হবে। আওয়ামী লীগ আমাদের কৃষি ব্যবস্থার বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করছে।
জায়গিরদারী, জমিদারী ও সরদারী প্রথা বিলোপ এবং সর্বোচ্চ পরিমান নির্ধারণ।
জমির ব্যবহারিক পদ্ধতিতে যে সমস্ত পরিবর্তন সাধন করা হবে বলে স্থিও করা হয়েছে তা হলোঃ

ক. পশ্চিম পাকিস্তানে বিদ্যমান জায়গিরদারী, জমিদারী ও সরদারী প্রথার সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন।
খ. জমির প্রকৃত চাষীদের স্বার্থে ভূমি-ব্যবস্থার পুনঃবির্ন্যাস।
গ. জমির সর্বোচ্চ পরিমান নির্ধারণ এবং নির্ধারিত পরিমানের অতিরিক্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ। অঙ্গরাষ্ট্রগুলোর স্থানীয় জনসাধারণের অবস্থা ও প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে আওয়ামী লীগ জমির উপর এই সর্বোচ্চ পরিমান নির্ধারণ করবে।
ঘ. সরকারী খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের কাছে বন্দোবস্ত দেওয়া হবে।

বহুমুখী কৃষি সমবায়ঃ

কৃষি বিপ্লবের আরো একটি পূর্বশর্ত হলো, কৃষি ব্যবস্থার আধুনিকীকরণ। জমি খন্ড বিখন্ড ও উপ বিভক্তির ফলে যেসব অসুবিধার সৃষ্টি হয়েছে তা দূর করা গেলেই এটা সম্ভব হবে। ভূমির একত্রিকরণের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে। তবে সমবায়ের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন চাষীর প্লটগুলোকে গ্রুপ করে তার যৌথ ব্যবহারের ব্যবস্থা দ্বারা আশু সমাধান করা যাবে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে বহুমুখী সমবায় প্রতিষ্ঠায় বিরাট পরিকল্পনা নিয়ে তাকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য প্রতিটি থানায় একটা করে মূল উন্নয়ন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হবে। এই রকম সমবায় প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে কৃষি সেক্টরে বিপুল পরিমান সাহায্য দিয়ে সরকার এইসব সমবায়ে জনগণের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করবে। সেচ, পানি নিস্কাষণ, বাঁধ, গভীর নলকূপ, পাওয়ার পাম্প, উন্নত ধরণের বীজ, সার, কৃষি উপকরণ ও যন্ত্রপাতি, কীটনাশক ঔষধ, ঋণ, আধুনিক কৃষি পদ্ধতি সম্পর্কে শিক্ষাদান-প্রভৃতির আকারে এই সাহায্য দেওয়া হবে।

ভূমি রাজস্বঃ

আমাদের বর্তমান জনসাধারণের উপর ভূমি-রাজস্ব একটি বিরাট বোঝা। এর আশু সমাধান হিসাবে পাকিস্তানের সর্বত্র পঁচিশ বিঘা একর পর্যন্ত জমির খাজনা ও বকেয়া মওকুফ করা হবে। আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হলো বর্তমান ভূমি-রাজস্ব ব্যবস্থার সম্পূর্ণ বিলোপ সাধন। জমি রেকর্ডের ব্যবস্থা সহজ ও উন্নত ধরণের হবে।

পাটঃ

প্রধান অর্থকরী ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী ফসল বলে পাটের উপর বিশেষ নজর দেওয়া প্রয়োজন। পরগাছার উপর মধ্যবর্তী শ্রেণী (middleman) অসাধু ব্যবসায়ী পাট চাষীদের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে পাট-শিল্পপতিরা বিনিময় হারকে (exchange rate) সুকৌশলে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে পাট চাষীদের ক্ষতি করে। আভ্যন্তরীণ বেচাকেনা ও রপ্তানীসহ সম্পূর্ণ পাট ব্যবসাকে জাতীয়করণ করা হবে। জাতীয়করণের মুল লক্ষ্য হলো পরগাছার মতো এইসব দালালদের উচ্ছেদ করে পাট উৎপাদনকারীদের শোষণমুক্ত করা। কাঁচা পাটের বিনিময়ে হারকে পাট উৎপাদনকারীদের স্বার্থের বিরুদ্ধে যেতে দেওয়া হবে না। এইসব ব্যবস্থার দ্বারা বর্তমান মূল্যের চাইতে উচ্চমূল্যে কাঁচা পাটের সর্বনিম্ন মূল্য নিশ্চিত করা যাবে। পাটের মান এবং একর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পাটের নতুন ব্যবহার উদ্ভাবন করার জন্য সরকার পাট গবেষণাকে খুব বেশী অগ্রাধিকার দেবে। অতীতে পাট গবেষণার প্রতি গুরুতর অবহেলা করা হয়েছে। বর্তমানের অ-চিন্তিত ও আংশিক নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি পাট ব্যবসা ও শিল্পের পক্ষে ক্ষতিকর হয়েছে। পাটের মান ও একর প্রতি পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি, পাট উৎপাদনকারীদের সর্বদা সর্বোচ্চ মুল্য দেওয়ার এবং দেশের অর্থনীতিতে পাটের অংশ যাতে সবচেয়ে বেশী হয় সে উদ্দেশ্যে একটা ব্যাপক ‘স্কিম’ নিয়ে তাকে কার্যকর করার জন্য জরুরী ভিত্তিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তুলাঃ

তুলাও একটি অর্থকরী ফসল। এর প্রতি বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ার জন্য পৃথক ব্যবস্থার প্রয়োজন। তুলা ব্যবসা জাতীয়করণ ও তুলা চাষের উন্নয়ন ও গবেষণার উপর অত্যাধিক জোড় দেওয়ার মাধ্যমে আমাদের অর্থনীতিতে এই প্রধান অর্থকরী ফসলের অংশ আরো বাড়ান হবে।

চাঃ

আমাদের চা শিল্পের চরম অদক্ষতার নিদর্শন। প্রতি একরে আমাদের দেশে গড়ে ১২ মন চা উৎপন্ন হয়। অথচ, ঠিক একই রকম অবস্থায় অন্যান্য দেশে একর প্রতি ৩৫ মন চা উৎপাদন হয়। বীজের মান উন্নত করার দিকে প্রায় কোন রকম নজর দেওয়া হয়নি। কার্যকর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা এবং মৃত্তিকা পরীক্ষার ব্যবস্থা, সার ও কীটনাশক ঔষধের অধিকতর ব্যবহারের মাধ্যমে একর প্রতি উৎপাদন দ্রুত বৃদ্ধি করা যেতে পারে। উৎপাদন লক্ষ্যে পৌঁছুতে না পারলে ইজারা বাতিল সহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। চা বোর্ডের ক্ষমতা কার্যকরভাবে প্রয়োগের জন্য চা সম্পর্কে বিশেষ জ্ঞান আছে এমন কর্মচারীদের চা বোর্ডে নিযুক্ত করতে হবে। চায়ের বাজারের বর্তমান গুরুতর স্থিতিহীন অবস্থার অবসান করা দরকার। বর্তমানের ‘মার্কেটিং ইউনিট’ গুলো শৃংখলার সাথে কাজ না করলে ‘টি মার্কেটিং বোর্ড’ স্থাপন করতে হবে।

আখ ও তামাকঃ

আখ ও তামাক-এই দুইটি ফসলের উৎপাদনী সম্ভাবনা প্রচুর। এদের মান উন্নয়ন, উৎপাদন বৃদ্ধি ও উৎপাদনকারীদের জন্য স্থিতিশীল ও উপযুক্ত মূল্য নিশ্চিৎ করার জন্য স্বতন্ত্র বোর্ড প্রতিষ্ঠা করতে হবে। উন্নতমানের বীজ, সার এবং ঋণ হিসেবে প্রভুত পরিমানে সরকারী সাহায্য দেওয়া হবে।

ফল চাষ ও আবাদ এবং ফলের বাগানঃ

বৃহদাকারে ফলের চাষ আমাদের অর্থনীতিকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারে। সমবায় পদ্ধতির মাধ্যমে ফল চাষ উন্নয়নের এবং আবাদের পরিকল্পনা করা হবে। এর ফলে বৈজ্ঞানিক উপায়ে চাষ, মান এবং একর প্রতি উৎপাদন বৃদ্ধি ও বৃহদায়তন শিল্পের সুবিধা পাওয়া যাবে।

বনজ ও বনজ সম্পদঃ

নির্বিচারে বন এলাকা ধ্বংস করার ফলে এই মূল্যবান প্রাকৃতিক সম্পদ দিনের পর দিন নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অতিসত্ত্বর বন জরিপ ও বন সংরক্ষণ প্রণালী নির্ধারণ করতে হবে। নতুন নতুন বন সৃষ্টি করার পরিকল্পনা অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। নির্বিচারে বনজ সম্পদ আহরণের ফলে যে ক্ষতিকর অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে তা এড়াতে হলে এই সম্পদের সদ্ব্যহারের জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

বন্যা নিয়ন্ত্রণঃ

পূর্ব পাকিস্তানের কৃষি ব্যবস্থা পুননির্মাণের যে কোন পরিকল্পনা গ্রহণের ক্ষেত্রে বন্যা নিয়ন্ত্রণের গুরুত্ব সবচেয়ে বেশী। কারণ প্রতি বছর বন্যায় আমাদের অপরিসীম ক্ষতি হয়। অর্থনৈতিক পুর্নবিন্যাসের জন্য বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি ব্যবস্থার একটি ব্যাপক পরিকল্পনা আওয়ামী লীগের কর্মসূচীর মধ্যে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। আওয়ামী লীগের অতি অল্পদিন ক্ষমতায় থাকাকালে ‘ক্রুগ মিশন’ কে বন্যা নিয়ন্ত্রণে একটি ব্যাপক পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য পাকিস্তানে আমন্ত্রন করার মাধ্যমে এটা স্পষ্ট বুঝা যায়। কি ‘ক্রুগ মিশন’ পরিকল্পনা, কি তার পরের কোন পরিকল্পনা, কোনটাই পরবর্তী কোন সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়নি। এই সমস্যা বর্তমানে অত্যন্ত গুরুতর আকার ধারণ করেছে। বন্যা নিয়ন্ত্রনের একটি ব্যাপক পরিকল্পনা বাস্তবায়িত করতে আওয়ামী লীগ ওয়াদাবদ্ধ।

জলাবদ্ধতা ও লবনাক্ততাঃ

ঈশ্চিম পাকিস্তানের কৃষিকে জলাবদ্ধতা এবং লবনাক্ততার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষার ব্যবস্থা ত্বরাম্বিত করা হবে। স্বল্পতম সময়ের মধ্যে জলাবদ্ধতা ও লবনাক্ততা আক্রান্ত জমি পুনরুদ্ধার করা হবে।

বিদ্যুৎ শক্তিঃ

আমাদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ শক্তির প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অত্যুক্তি করার অবকাশ নাই। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক উন্নয়নের গতিকে ত্বরাম্বিত করার কাজে বিদ্যুৎ শক্তির ব্যবহারের অবকাশ অপরিসীম।
পল্লী অঞ্চলে ব্যাপক বিদ্যুতায়নের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে বলে আওয়ামী লীগ প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে। কারণ, এর ফলে কেবল ব্যাপক আর্থিক লাভই হবেনা, অধিকন্তু এর সাহায্যে ক্ষুদ্র শিল্প প্রতিষ্ঠা, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও কৃষি ব্যবস্থার আধুনিক পদ্ধতি শিক্ষাদানের মতো গুরুত্বপূর্ণ লক্ষ্যও অর্জিত হবে এবং আমাদের গ্রামবাসীরা বিংশ শতাব্দীর একটা মৌলিক সুখ স্বাচ্ছন্দও ভোগ করতে পারবে। পল্লী বৈদ্যুতিকরণ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ট্রান্সমিশন ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি অবশ্যই করতে হবে।
সর্বাধিক পরিমাণ বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনের উদ্দ্যেশ্যে বৈদ্যুতিক শক্তি উৎপাদনের প্রত্যেকটি উৎসের সদ্ব্যবহার করা হবে। পূর্ব পাকিস্তানকে আগামী ৫ বৎসরের মধ্যে ন্যূনপক্ষে ২৫০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদন ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। অনুরূপভাবে জনসাধারণের প্রয়োজন পূরণের উদ্দ্যেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন ইউনিটের শক্তি উৎপাদন ক্ষমতাও বাড়ানো হবে। রূপপুর আনবিক শক্তি প্রকল্প ও জামালগঞ্জ কয়লা খনি প্রকল্প অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা হবে।

প্রাকৃতিক সম্পদঃ

বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাকিস্তানের প্রাকৃতিক সম্পদের অনুসন্ধান এবং উন্নয়নের ব্যাপারে ক্ষমাহীন অবহেলা প্রদর্শন করা হয়েছে। এই ব্যাপারে কোন রকম ব্যাপক পানি বা ভূ-তাত্ত্বিক জরিপও চালানো হয়নি। এই ধরণের জরিপের ফলে মূল্যবান খনিজ ও অন্যান্য সম্পদ পাওয়া যেতে পারে। কাজেই এইসব প্রাকৃতিক কার্যকরভাবে ব্যবহারে কর্মসূচি প্রণয়ণের জন্য অবিলম্বে এই ধরণে জরিপের কাজ আরম্ভ করা হবে।

নদী পরিচর্যা ও উন্নয়নঃ
পাকিস্তানের, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানের অসংখ্য নদ-নদী এক বিরাট প্রাকৃতিক সম্পদ। তবে অন্যান্য সম্পদের ন্যায় একমাত্র গবেষণা ও অন্যান্য পরিকল্পনার মাধ্যমে এই নদী সম্পদকে সমাজের প্রভূত কাজে লাগানো সম্ভব। কিন্তু এই ধরণের পরিকল্পনার অভাবে ভূমি ক্ষয়ের মতো সমস্যাগুলো গুরুতর আকার ধারণ করেছে। এ ক্ষেত্রে যে ক্ষমাহীন অবহেলা দেখানো হয়েছে অবিলম্বে উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন নদী-গবেষণা ইন্সটিটিউট স্থাপন করে তার প্রতিকার করা দরকার। এ ইন্সটিটিউট পানি সম্পর্কে মৌলিক গবেষণা এবং নদী ট্রেনিং স্কীম গ্রহণের মাধ্যমে এই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদকে সমাজের প্রয়োজন মিটাবার কাজে লাগাবে।

মৎস্য সম্পদঃ
যে সমাজে শতকরা ৭০ জন লোক প্রোটিন সল্পতায় ভুগে সে সমাজে মৎস সম্পদের অসীম গুরুত্ব বলে শেষ করা যায় না। কাজেই সামদ্রিক মৎস সহ মৎস সম্পদের উন্নয়নের জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা অবশ্যই গ্রহণ করা হবে। এই সেক্টর থেকে থেকে কেবল যে অতিরিক্ত বৈদেশিক মুদ্রাই আয় হবে তা নয়, এ আমাদের লক্ষ্য ক্ষুধার্থ মানুষের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় প্রোটিনও যোগাবে। এই ব্যাপক পরিকল্পনার মধ্যে থাকবে মৎস উন্নয়ন ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা, মৎস বন্দর উন্নয়ন, গভীর সমুদ্রে মৎস্য স্বীকার ও মোটার চালিত আভ্যন্তরীণ মৎস্য স্বীকার, নৌ-বহরের উন্নতি বিধান, মাছ রাখার জন্য শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গুদাম ও বিতরণ ব্যবস্থা এবং বৈজ্ঞানিক মৎস চাষ ও উন্নয়ন।

গবাদি পশু, হাস-মুরগী এবং ডেইরী ফার্মিংঃ
গবাদি পশু উন্নয়ন এবং হাস-মুরগি ও ডেইরী ফার্মিং-এর প্রতিও নিদারুন অবহেলা করা হয়েছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে গবাদি পশু, হাস-মুরগী ও ডেইরী ফার্মিং এর উন্নয়নকল্পে দেশের সকল অঞ্চলে ব্যাপক পরিকল্পনা গৃহীত হবে।

শ্রমিকদের অধিকারঃ
আন্তজাতিক শ্রম সংস্থার ঘোষণা মোতাবেক শ্রমিকদের অধিকারের নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। শ্রমিক ইউনিয়ন গঠনের অধিকার, যৌথ দরকষাকষির অধিকার এবং ধর্মঘটের অধিকার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। শ্রমিকদের এই ধরণের অধিকার খর্ব করার উদ্দেশ্যে প্রণিত সমস্ত আইন বাতিল করা হবে।
সরকার যাতে শ্রমিকদের ন্যায্য স্বার্থ উন্নয়নে গঠনমূলক ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ এবং সেই সঙ্গে শিল্প উৎপাদন উন্নয়ন সুনিশ্চিত করার মাধ্যমে মৌলিক সামাজিক লক্ষ্য অর্জন করতে পারে সেজন্যে সরকারের শ্রম সংক্রান্ত সমগ্র প্রশাসন যন্ত্রের পুনর্বিন্যাস করা হবে।
সরকার শ্রমিক ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা এবং শ্রমিকদের জন্য ট্রেনিং ইন্সটিটিউশান প্রতিষ্ঠাকে উৎসাহিত করবে এবং ট্রেনিং ইন্সটিটিউশানে শ্রমিকদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং তাদের ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য শিক্ষা দেওয়া হবে।
শ্রমিকদের জীবন ধারণের উপযোগী মূল বেতন দেওয়া হবে এবং চাকুরীর নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে। একই কাজের জন্য পুরুষ মহিলা নির্বিশেষে সবাই সমান বেতন পায় তার ব্যবস্থা করা হবে। শ্রমিকদের এবং তাদের পরিবারবর্গকে অবশ্যই নিম্নলিখিত মৌলিক সুবিধার নিশ্চয়তা দেওয়া হবে :

১. বিনা ভাড়ায় বাসোপযোগী গৃহ।
২. বিনা খরচায় চিকিৎসার সুযোগ-সুবিধা।
৩. অসুস্থতার সময়ে পুরা বেতনে ছুটি।
৪. প্রত্যেক পুরা বছরের জন্য পুরা বেতনে এক মাসের ছুটি।
৫. অক্ষমতা ও অবসর গ্রহণের ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা প্রদান।
৬. নুন্যপক্ষে মাধ্যমিক স্কুল পর্যায় পর্যন্ত বিনা খরচে শ্রমিকদের ছেলে-মেয়েদের জন্য শিক্ষার ব্যবস্থা।
৭. মহিলা শ্রমিকদের বেলায় পুরা সুযোগ-সুবিধাসহ মেটারনিটি ছুটি।

উপরোক্ত অধিকার সুনিশ্চিত করা ছাড়াও ন্যায় ও সাম্যপরায়ণ সমাজ গঠনের লক্ষ্য অর্জনের জন্য শিল্প-প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিচালনার সঙ্গে শ্রমিকরা ক্রমেই বেশী করে সংযুক্ত হয়ে উঠবে।
এই একই সামাজিক লক্ষ্য অর্জনের জন্য শ্রমিকরা যে প্রতিষ্ঠানে কাজ করে তার মুনাফায় তাদের একটা অংশ পাওয়ার অধিকার থাকা উচিৎ। এতে উৎপাদন বৃদ্ধির অংশ শ্রমিকরাও পাবে।
সরকারী এবং আধা-সরকারী সংস্থাগুলোর চাকুরীরত শ্রমিকদের জীবন ধারণের উপযোগী বেতন, চাকুরীর নিরাপত্তা এবং অসুস্থতা ও অবসরকালীন সুবিধাসহ কল্যাণমূলক সুবিধার নিশ্চয়তা দিতে হবে।

কর্ম সংস্থানঃ
বেকারত্বই নিকৃষ্টতম সামাজিক অবিচার। প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য কর্মসংস্থানের চূড়ান্ত লক্ষ্য হাসিলের জন্য কর্মসংস্থানের সর্বাধিক সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা সমস্ত অর্থনৈতিক পরিকল্পনার প্রধান উদ্দেশ্য হওয়া উচিৎ। আমাদের সমাজের বিপুল জনসম্পদকে কাজে লাগাবার জন্য জনশক্তির ব্যাপক পরিকল্পনা আবশ্যক। সর্বাধিক কর্মসংস্থানের উদ্দেশ্যে যেসব মৌলিক পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে তার কয়েকটি হলো ঃ
১. সড়ক নির্মাণ, সেচ ও পানি নিস্কাশন কাজ, স্কুলভবন নির্মাণ ও একই ধরনের অন্যান্য কাজের জন্য পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন।
২. শিল্প ও কৃষিতে অধিক উৎপাদন পদ্ধতির (labour intensive techniques) প্রবর্তন।
৩. পল্লী এলাকায় কুটির শিল্পগুলোকে ব্যাপক সাহায্য দান।

শিক্ষাঃ
আমাদের সমাজের মৌলিক প্রয়োজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে নিজেদের সামর্থ অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রত্যেকটি নাগরিকের সর্বাধিক উন্নতি সম্ভব করে তোলাই শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য।
এই প্রতিশ্রুতিকে বাস্তবে পরিণত করার জন্য অনেক বেশী সম্পদ বরাদ্দের প্রয়োজন। মোট জাতীয় উৎপাদনের শতকরা চারভাগ এইখাতে নিয়োজিত করতে হবে। এই অধিক বরাদ্দ থেকে গৃহাদি নির্মাণ বাবদ অপেক্ষাকৃত কম খরচ করে শিক্ষকদের বেতনের স্কেল বাড়ানোর জন্য বেশী অর্থ ব্যয় করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় আমাদের সকল শ্রেণীর জনসাধারণকে সমান সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। বর্তমানে মিশানারী স্কুল, পাবলিক স্কুল এবং ক্যাডেট কলেজ ইত্যাদির মতো কতিপয় উন্নত ধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান স্বল্প সংখ্যক সুবিধাভোগী ব্যক্তির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। প্রস্তাবিত শিক্ষাব্যবস্থা তেমন হবে না। সারাদেশে এই ধরণের শিক্ষাব্যবস্থা চালু করার জন্য এইসব বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে ক্রমান্বয়ে অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মিলিয়ে দেওয়া যাবে।

নিরক্ষরতা দূরীকরণঃ
সমূলে নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য সকল রকম ব্যবস্থা করা হবে। এই উদ্দশ্যে নয়া কৌশল এবং প্রচলিত নিয়ম বহির্ভুত পন্থা অবলম্বনের দরকার হবে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যায়ের ছাত্রদের নিরক্ষরদের শিক্ষাদানের জন্য ‘জাতীয় সার্ভিস প্রোগ্রাম’ কাজে লাগানো এই ধরণের একটি পন্থা।

প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাব্যবস্থাঃ
সকলের জন্য অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক প্রাথমকি শিক্ষার ব্যবস্থা করা হবে। আগামি পাঁচ বৎসরের মধ্যে এই লক্ষ্যে পোঁছা যাবে বলে আশা করা যায়। মাধ্যমিক শিক্ষা সকল শ্রেণীর জনসাধারণের নাগালের মধ্যে আনা হবে।

কারিগরি ও পেশাগত শিতকক্ষাঃ
সমগ্র শিক্ষা ব্যবস্থাকে সমাজের প্রয়োজনের ছাচে ঢালাই করা হবে এবং এই ধরণের প্রয়োজন সম্পর্কে সুষ্ঠু জরিপের পরই কারিগরি ও পেশাগত শিক্ষাদানের জন্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে। পলিটেকনিক ইনষ্টিটিউশন সমস্ত দেশে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।

বিশ্ববিদ্যালয়ঃ
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সর্বোচ্চ মান রক্ষা করা এবং মেধার ভিত্তিতে সকল শ্রেণীর জনসাধারণের জন্য শিক্ষার পথ খুলে দেওয়া হবে। মেধাবী ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা লাভের পথে দারিদ্র যেন বাঁধা হতে না পারে তার ব্যবস্থা করা হবে। সকল ক্ষেত্রে উচ্চশিক্ষার ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে দ্রুততার সাথে সমগ্র পাকিস্তানে মেডিকেল কলেজ এবং কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় সহ অনেকগুলি নয় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হবে।

শিক্ষকতা পেশাঃ
আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজের শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিরা যাতে শিক্ষকতা পেশার প্রতি আকৃষ্ট হন সেই পরিবেশ সৃষ্টির জন্য সব রকম চেষ্টা করা হবে। এজন্য কেবল তাদের বেতনের স্কেল বৃদ্ধি ও বৈষয়িক সুবিধা দিলেই চলবে না; সঙ্গে সঙ্গে কাজ করার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি এবং শিক্ষকদের ন্যায্য মর্যাদা এবং সম্মানও দিতে হবে।

স্বাস্থ্যঃ
সমগ্র সমাজে একটি ব্যাপক স্বাস্থ্যরক্ষা ব্যবস্থা চালু করাই আমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য। এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য অবিলম্বে প্রত্যেক ইউনিয়নে একটা করে মেডিকেল কেন্দ্র এবং প্রত্যেক থানাকেন্দ্রে একটা করে হাসপাতাল স্থাপন করা হবে। এই ধরণের মেডিকেল কেন্দ্র ও হাসপাতালে জরুরী ঔষধ-পত্র পাওয়া যাবে। প্রত্যেকটি নাগরিকের জন্য নুন্যতম চিকিৎসার ব্যবস্থা করার উদ্দেশ্যে মেডিকেল গ্রাজুয়েটদের সাহায্যে পল্লী স্বাস্থ্য কেন্দ্রে জাতীয় সার্ভিস চালু করা হবে। এই সকল কেন্দ্রে নিয়োগের জন্য অধিক সংখ্যক ট্রেনিংপ্রাপ্ত ডাক্তার ছাড়াও মেডিকেল ট্রেনিং প্রাপ্ত কর্মচারীর প্রয়োজন হবে।
স্বাস্থ্য ব্যবস্থা এবং বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের জন্য একটি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে। আগামী পাঁচ বৎসরের মধ্যে কমপক্ষে প্রত্যেক গ্রামে পর্যাপ্ত সংখ্যক নলকূপ স্থাপনের লক্ষ্য থাকবে।
বসন্ত, যক্ষা এবং কলেরার ন্যায় প্রতিরোধযোগ্য রোগের টিকা এবং ইনজেকশন দানকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।

পরিবহণ ও যোগযোগঃ
পরিবহণ ও যোগাযোগ অর্থনীতির অন্যতম কাঠামো হওয়ায় এর উপর নজর দেওয়া জরুরী প্রয়োজন রয়েছে। বর্তমান ব্যবস্থার উন্নতি বিধানকল্পে নিম্ন লিখিত নির্দিষ্ট লক্ষ্য গ্রহণ করা হবেঃ

সড়কঃ
ক. পুর্ব পাকিস্তান এবং পাঞ্জাবের অপেক্ষাকৃত কম উন্নত এলাকা, সিন্ধু, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানে পাকা সড়কের ব্যাপক সম্প্রসারণসহ শহর এবং বাজার কেন্দ্রগুলির সহিত গ্রামাঞ্চলের যোগাযোগ স্থাপনের জন্য বড় রাস্তার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী বহু ছোট রাস্তা নির্মাণ।
খ. ঢাকার সঙ্গে উত্তর বঙ্গের সমস্ত প্রধান শহরের যোগাযোগ সাধন করে ঢাকা-দিনাজপুর হাইওয়ে নির্মাণ।
গ. ঢাকা-চট্টগ্রাম হাইওয়ে প্রশস্তকরণ।

সেতু ও সুড়ঙ্গ –পথঃ
ক. উত্তর বঙ্গের সাথে প্রদেশের অন্যান্য স্থানের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপনের উদ্দেশ্যে যমুনার উপর সেতু নির্মাণকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে।
খ. পাঞ্জাবের ডুড়িয়া খান এবং ডেরাগাজিখানের নিকট সিন্ধু নদীতে এবং সিন্ধুতে সিন্ধু নদীর গুরুত্বপুর্ণ স্থানগুলোয়, কর্ণফুলী, বুড়িগঙ্গা এবং শীতলক্ষা নদীর উপর সেতু নির্মাণ করা হবে।
গ. যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি বিধানকল্পে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এবং বেলুচিস্তানের সুড়ঙ্গ পথ নির্মাণ করতে হবে।

রেলওয়েঃ
রেলওয়ে ভবিষ্যৎ উন্নয়ন স্কীমে পাকিস্তানের সকল রেলওয়েতে নিম্নশ্রেণীতে ভ্রমণকারী যাত্রীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির উপর জোর দেওয়া হবে।

বন্দরঃ
সামদ্রিক এবং আভ্যন্তরীণ নদী বন্দর- উভয় প্রকারের বন্দরের উন্নয়নকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বেলুচিস্তানের বন্দরগুলির উন্নতিবিধান করা হবে। করাচি বন্দরের বর্তমান সুযোগ-সুবিধার উন্নতিবিধান করা হবে। চট্টগ্রাম বন্দরের ক্ষমতা দ্বিগুন করা হবে এবং চালনা বন্দরের ক্ষমতা যথেষ্ট বাড়ানো হবে।

 

বাসস্থানঃ
আশ্রয় মানুষের জীবনের একটি মৌলিক প্রয়োজন। নিম্ন আয়ের লোক এবং পল্লীবাসীদের জন্য বাস্থানের ব্যবস্থা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শ্রমিকদের জন্য মালিকদের দ্বারা বাস্থানের ব্যবস্থার স্কীম ছাড়াও সরকার বাসস্থান উন্নয়নের জন্য নিম্নলিখিত পদক্ষেপ গ্রহণ করবে।

ক. শহরগুলিতে নিম্ন আয়ের লোকদের জন্য আবাসিক উইনিট নির্মাণ।
খ. পল্লী এলাকায় বাসস্থান নির্মানের জন্য পল্লী উন্নয়ন পরিকল্পনায় সদ্ব্যবহার এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে রক্ষা পাওয়ার জন্য পল্লী এলাকায় গৃহ নির্মানের নয়া মডেল প্রবর্তন।

নারী সমাজঃ
আমাদের জনসংখ্যার প্রায় অধেূক নারী। প্রধানতঃ শিক্ষার অভাবে তারা সমাজের প্রতি দায়িত্ব পালনে সামর্থ হচ্ছে না। জীবনের সকল ক্ষেত্রে তাদের সমান সুবিধা ভোগের সুযোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে যত তারাতারি সম্ভব তাদের জন্য শিক্ষার সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো হবে। নারী সমাজকে পূর্ণ নাগরিক অধিকারের গ্যারান্টি দেওয়া যাবে। সমান কাজের জন্য তাদের সমান বেতন দেওয়া হবে। মেধার ভিত্তিতে তাদের জন্য সকল সরকারী চাকুরীর দ্বার মুক্ত থাকবে।

যুব সমাজঃ
কর্মক্ষমতায় পরিপূর্ণ এবং আদর্শবাদী অনুপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত আমাদের যুব সমাজ জাতির এক বিরাট সম্পদ। তাদের আদর্শবাদী অনুপ্রেরণা এবং কর্মক্ষমতাকে জাতি গঠনমূলক কাজের অভিসারী না করতে পারলে জাতীয় জীবনে চরম হতাশার সৃষ্টি হতে পারে। সুতরাং জাতি গঠনমূলক কার্যসূচির সঙ্গে দেশের যুব সমাজকে জড়িত করার অত্যন্ত জরুরী প্রয়োজন রয়েছে। উদাহরণ হিসাবে নিরক্ষরতা দূরীকরণ, সামাজিক উন্নয়ন সংস্থা গঠন এবং সমবায় স্কিমের কথা বলা যেতে পারে। কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের নিয়ে একটা সার্ভিস কোর গঠন করে গ্রাম, কল-কারখানা এবং শহরের বস্তি অঞ্চলে এই ধরণের সেবার জন্য এদের প্রতি আহ্বান জানানো যেতে পারে।

ভাষা ও সংস্কৃতিঃ
পাকিস্তানের দুইটি রাষ্ট্রভাষা (বাংলা ও উর্দু) যাতে জীবনের সকল ক্ষেত্রে ইংরেজীর স্থলাভিষিক্ত হতে পারে তার জন্য আশু ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
পাকিস্তানের সকল এলাকার ভাষা এবং সাহিত্যের উন্নয়নকে উৎসাহিত করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো হবে।

মোহাজেরঃ
মোহাজেরদের স্থায়ী বসতি এবং অর্থনৈতিক পূণর্বাসনের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তারা যাতে অন্যান্য নাগরিকের সঙ্গে সকল ব্যাপারে নিজেদের সমান বলে অনুভব করতে পারে এবং অন্য সকর নাগরিকের সহিত সকল ক্ষেত্রে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যে তাদের ক্রমান্বয়ে স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে একীভূত করে নিঃশেষে মিলিয়ে মিশিয়ে দেওয়া হলো আমাদের লক্ষ্য। যত শীঘ্রই সম্ভব পুনর্বাসনের ব্যাপারগুলো চূড়ান্ত করা হবে।

উপজাতীয় এলাকাঃ
দেশের অন্যান্য নাগরিকের সঙ্গে সকল ব্যাপারে উপজাতীয় এলাকার জনসাধারণ যাতে সমান সুযোগ-সুবিধা ভোগ করতে পারে সেই উদ্দেশ্যে উপজাতীয় এলাকাগুলোকে দেশের বাকী অংশের সঙ্গে সম উন্নয়ন পর্যায়ে আনার জন্য সব কম প্রচেষ্টা চালানো হবে।

বৈদেশিক নীতিঃ
আমাদের রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব এবং জাতীয় স্বাধীনতা সংরক্ষণের প্রতি সর্বাধিক গুরুত্বের ভিত্তিতেই আমাদের বহিঃসীমান্তের নিরাপত্তা রক্ষার প্রশ্নই নয়, আমাদের আভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ প্রতিরোধের প্রশ্নও জড়িত রয়েছে।

স্বাধীন, জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতিঃ
আমাদের জনসাধারণের আশা-আকাঙ্খা এবং রাষ্ট্রের স্বার্থের প্রতি লক্ষ্য রেখে আমরা একটি স্বাধীন, জোট নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির জন্য ওয়াদাবদ্ধ। স্বীকার করতে হবে যে এতদিন যে অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও নীতি অনুসৃত হয়েছে তার সঙ্গে একটি স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির প্রতিশ্রুতি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সাবেক নীতির ফলে বৈদেশিক সাহায্য এবং ঋণের উপর নির্ভরশীলতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং ঋণ ও দেনার বোঝা বেড়ে গেছে। বিদেশের উপর এই ধরণের নির্ভরশীলতা আভ্যন্তরীন এবং আন্তর্জাতিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে আপোষ নীতি গ্রহণে মারাত্মকভাবে বাধ্য করে। ফলে জাতীয় স্বাধীনতাই বিপন্ন হয়ে পরে। অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং বৈদেশিক সাহায্যের ক্ষেত্রে নয়া কলা-কৌশল অবলম্বনের মাধ্যমে এই পরস্পর বিরোধী নীতির অবসান ঘঁটানোই আমাদের লক্ষ্য। এর ফলেই আমরা সত্যিকারভাবে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণে সক্ষম হব।

শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানঃ
“সকলের প্রতি বন্ধুত্ব এবং কারো প্রতি বিদ্বেষ নয়”-এই নীতির অনুসরণে ন্যায় এবং পরস্পরের সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধার ভিত্তিতে আমরা আমাদের প্রতিবেশীদের সহ সকল দেশের সঙ্গে শাস্তিপূর্ণ সহ-অবস্থানে আগ্রহী। এই উদ্দ্যেশ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখার জন্য বিশ্বে বর্তমানে যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব চলছে তার প্রতি আকৃষ্ট হব না এবং আকৃষ্ট হওয়ার মনোবৃত্তিও আমাদের নেই।

বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধানঃ
শান্তিপুর্ণ সহ-অবস্থানের ললক্ষ অনুযায়ী আমরা সকল বিরোধের শান্তিপূর্ণ এবং ন্যায়সঙ্গত মীমাংসার প্রতি সর্বাধিক গুরুত্ব দেব।

কাশ্মীরঃ
জাতিসংঘের প্রস্তাবের ভিত্তিতে কাশ্মীর বিরোধটির মীমাংসার উপর আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছি। মৌলিক আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার আদায়ের জন্য জম্মু ও কাশ্মীরের জনসাধারণের ন্যায্য সংগ্রামের প্রতি আমাদের সমর্থন অব্যাহত থাকবে।

ফারাক্কা বাঁধঃ
পূর্বেকার সরকারগুলোর ক্ষমাহীন অবহেলার ফলেই ফারাক্কা বাঁধ বাস্তবে রূপলাভ করতে সক্ষম হয়েছে এবং পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতির প্রতি মারাত্মক ও স্থায়ী ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধানের জন্য অবিলম্বে পররাষ্ট্রনীতির সকল হাতিয়ারকে কাজে লাগাতে হবে।

সিয়েটো, সেন্টো এবং অন্যান্য সামরিক চুক্তি ত্যাগঃ
সিয়েটো, সেন্টো এবং অন্যান্য সামরিক চুক্তিতে চির আবদ্ধ হয়ে থাকাকে আমরা আমাদের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থি বলে বিশ্বাস করি এবং এই কারণেই আমরা সিয়েটো, সেন্টো এবং অন্যান্য সামরিক চুক্তি থেকে অবিলম্বে পাকিস্তানের বেরিয়ে আসার পক্ষপাতী।

জাতিসংঘের সনদ ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতাঃ
আমরা জাতিসংঘ সনদে সন্নিবিষ্ট নীতিগুলো, বিশেষ করে মানুষের আত্ম-নিয়ন্ত্রণের মৌলিক অধিকার এবং সকল রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব ও সাম্যের ব্যাপারে আমাদের শর্তহীণ সমর্থনের কথা ঘোষণা করছি। বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও মানব কল্যাণের ব্যাপারে আমরা জাতিসংঘ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার সকল কার্যক্রমের প্রতি সমর্থন জানাব।

সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণ বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামঃ
আমরা সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ এবং বর্ণবৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থণ ঘোষণা করছি।

[ শাসনতন্ত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্য -বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণ ]

আরও পড়ুন:

Leave a Comment