শিল্প-সংস্কৃতিতে ডানপন্থি-প্রতিক্রিয়াশীলরা আমাদের কী দিতে পেরেছেন?

শিল্প-সংস্কৃতির প্রতি আকর্ষণ ছিল ছোটবেলা থেকেই। এজন্য শৈশব থেকে এর আনুষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষা না থাকলেও, গান, কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, নাটক, সিনেমা—সবকিছুই গোগ্রাসে গিলেছি। কিছু বুঝেছি, বেশিরভাগই হয়তো বুঝিনি। কিন্তু আজ যখন যাপিত জীবনের সুখস্মৃতি ঘাঁটি, তখন দেখি, সেই সুখের মুহূর্তগুলোর ভিতর আসল আনন্দ রঙ ছড়িয়েছে শিল্প-সংস্কৃতিই। গান, কবিতা কিংবা চলচ্চিত্র—এসব ছাড়া সেই স্মৃতিগুলো এতটা পরিপূর্ণ, এতটা রঙিন হতো না।

অন্যদিকে ভীষণ রক্ষণশীল পরিবারে জন্মের কারণে ছোটবেলা থেকে নানা ডানপন্থি-প্রতিক্রিয়াশীল মানুষের সাথে মেশার সুযোগ হয়েছে। তাদের মধ্যে অদভূত সব বৈপরীত্য দেখেছি। তারা নিজেদের জীবনে শিল্প-সংস্কৃতি তেমন একটা গ্রহণ, আস্বাদন, উপভোগ বা আত্মস্থ করেন না। বেশিরভাগের চোখে শিল্প-সংস্কৃতি সময় নষ্ট, ন্যাকামি বা আঁতলামি ছাড়া আর কিছু নয়। কেউ কেউ উপভোগ করলেও, এগুলোর যারা শ্রষ্ঠা, তাদের পছন্দ করেন না। এসব অপছন্দ মেজরিটি নির্দিধায় প্রকাশ করেন. বাঁকিরা লুকিয়ে রাখার চেস্টা করলেও একসময় প্রকাশ হয়ে যায়। কিন্তু শিল্প-সংস্কৃতির উপর অধিকার ও মালিকানা প্রতিষ্ঠার এক অদ্ভুত আগ্রহ তাঁদের ভেতরে কাজ করে। সেটার জন্য তাঁরা মারামারি করতেও সদা প্রস্তুত।

তারা নজরুল ইসলাম বা মীর মশাররফ হোসেনের মতো জীবনযাপনকারী জিবীত মানুষদের তীব্র ঘৃণার চোখে দেখেন, তাঁদের চিন্তাধারাকে “কাবিলে-গারদানজানী” মনে করেন। অথচ তাদের দুজনকে তাদের লোক বানাতে প্রয়োজনে যুদ্ধে নামেন। আল মাহমুদ জীবনের যখন উঠকৃষ্ট কবিকাল, তখনকার নেই ব্যক্তির মত কাউকে তারা সহ্য করতে পারবেন না। তার সেই ব্যক্তিত্ব বা কবিত্ব যদি থাকতো, তিনি জিবীত অবস্থায় একই রকম অপছন্দের ব্যক্তি থাকতেন। তিনি তার সেই কবীত্বকে হত্যা করে, ডানপস্থি হয়েছিলেণ বলেই জীবদ্দশায় ডানপন্থিদের সম্মান পেয়েছেন।

মোটকথা, সৈয়দ ফররুখ আহমদসহ ডানপন্থিরা যাঁদের নিয়ে পোস্টার বানান এবং “আমাদেরও আছে” ধরনের গর্ব করেন, তাঁদের প্রায় সবাই বড় শিল্পী হয়ে ওঠার আগে পর্যন্ত প্রগতিশীলতার পথেই ছিলেন, প্রগতিশীল শিবিরের লোক ছিলেন। বেশিরভাগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, ডানপস্থায় যাবার পরে উল্লেখযোগ্য কিছু তারা আর উৎপাদন করতে পারেননি।

বাংলাদেশে শামসুর রাহমান, জসীমউদ্দীন, সৈয়দ শামসুল হক, হেলাল হাফিজ, আবুল হাসান, আসাদ চৌধুরী, রফিক আজাদ, মোহাম্মদ রফিক, শহীদ কাদরীসহ আরও যত কবি আছেন, কেউই ডানপন্থী নন। শুধুমাত্র মুসলিম নামের কবিদের কথাই বলছি কারণ বাংলাদেশের ডানপন্থিদের সাথে অন্য ধর্মের কবিদের সম্পর্ক অপ্রসঙ্গীক। অন্যদিকে ডানপন্থি লোকজন কিন্তু বেশুমার লিখেছেন-লিখছেন। তাদের কবিতা পাঠ্যবইয়েও দেয়া হয়েছে (মানে প্রচারের অভাব হয়নি)। কিন্তু কজনের কবি আপনার হিসেবে “রোজমারা’র জীবনে প্রসাঙ্গীক?

কবিতা ছাড়া অন্য সাহিত্য, নাটক, চলচ্চিত্র—যেদিকেই তাকাবেন, ডানপন্থিদের তেমন কোনো অবদান দেখানো সম্ভব নয়। কিন্তু এই অধিকার তারা ছাড়বেন না। তারা মৃত ব্যক্তিদের মাথায় সুবিধামতো টুপি পরিয়ে তাদের দলে টানবেন, মালিকানা দাবি করবেন। ধর্ম ও জাতের বিরোধী লালন-কবিরের মতো কবিয়ালকেও তারা মুসলমান বানানোর চেষ্টা করবেন, আবার সম্প্রদায়ের কবিয়াল বানাতেও চাইবেন।

এবার দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে বের হই। আমাদের মতো মিলেনিয়ালদের কৈশোর-যৌবনের কবি, গীতিকার, সুরকার ও শিল্পী হিসেবে কবির সুমনের প্রভাব সম্ভবত সবচেয়ে বিস্তৃত। তিনি পরবর্তী জীবনে মুসলমান হলেও তাঁর সৃষ্টির সবকিছুই ডানপন্থার বিরোধী।

আবার যেসব গান, কবিতা, সিনেমা (বাংলার বাইরে হিন্দি ও উর্দু) ছোটবেলা থেকে ভালোবেসেছেন, সেগুলো একবার তাকিয়ে দেখুন। দেখবেন সেই প্রিয় কবি, গল্পকার, গীতিকার, সুরকার, গায়ক, বাদক, সিনেমার লেখক (স্ক্রিপ্ট, স্ক্রিনপ্লে, সংলাপ)— এর বড় অংশ এসেছিলেন বামপন্থি দর্শনের বিশেষত দুটি আন্দোলন থেকে: প্রগতিশীল সাহিত্যিক আন্দোলন (Progressive Writers’ Movement (PWM)) এবং ভারতীয় গণনাট্য সমিতি আন্দোলন (Indian People’s Theatre Association (IPTA))। IPTA-র অংশ হিসেবেই বাংলার গণনাট্য সংঘ।

এই প্রগতিশীল আন্দোলনগুলো থেকেই উঠে এসেছেন সলিল চৌধুরী, হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, সুকান্ত ভট্টাচার্য, ভূপেন হাজারিকা, মোহিতলাল মজুমদার, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়—আরও কত নাম! হিন্দি-উর্দু সাহিত্য-সংস্কৃতিতে দেখুন। মুনশি প্রেমচাঁদ, ফয়জ আহমেদ ফয়জ, সাদাত হাসান মান্টো, কৃষণ চন্দর, রাজিন্দর সিং বেদি, ইসমত চুঘতাই, কাইফি আজমিও ওদের থেকেই আসা।

তাই দেখবেন—শুধু এ দেশেই নয়, ভারতেও ডানপন্থিরা শিল্প-সাহিত্যে বিশেষ কিছু দিতে পারেননি। অটল বিহারী বাজপেয়ির মতো ডানপন্থীরা যারা কিছুটা কবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন, তারাও আবার ডানপন্থিদের কাছেই ‘লিবারাল’ বলে সমালোচিত হয়েছেন।

আসল কথা হলো—ডানপন্থায় গেলে শিল্প-সাহিত্য মরে যায়। এর প্রধান কারণ, ডানপন্থার সংস্কার চিন্তা ও প্রকাশের সীমানা নির্ধারণ করে দেয়, আর সেই গণ্ডি স্বভাবতই সংকীর্ণ। সেই সীমারেখার মধ্যে থেকে মহৎ শিল্প সৃষ্টি করা অসম্ভব। তাই তা হয় না।

শিল্প-সাহিত্য কোনো কোম্পানির শেয়ার নয়, যা কিনে নিলেই নিজের হয়ে যাবে। শিল্প-সাহিত্য হলো যাপনের বিষয়। যারা যাপন করবেন, শিল্প-সাহিত্য তাদেরই হবে। তাদের মধ্য থেকেই সৃষ্টি আসবে, তারাই হবেন এর ধারক ও বাহক। আর যা ধারণ করেন না, তার মালিকানা নিয়ে এত টানাটানি কেন করবেন?