একজন সাধারণ মুসলিম যখন নিজে কুরআন পড়তে ও বুঝতে চান, তখন প্রথমেই যে যুক্তিটি তার পথে বাধা হিসেবে দাঁড় করানো হয় তা হলো—
“আপনার ক্বিরাআতই যখন শুদ্ধ নয়, আপনি কুরআন বুঝবেন কীভাবে?”
এই প্রশ্নের আড়ালে ধীরে ধীরে সামনে আনা হয় সহীহ ক্বিরাআতের দীর্ঘ তালিকা—
সঠিক মাখরাজ
তাজবিদ: যেমন মদ্দ, ইখফা, ইদগাম, ক্বলক্বলা ইত্যাদির নিয়ম
নুন সাকিন, মীম সাকিন ও গুন্নাহ্-এর যথাযথ প্রয়োগ
তরতীল ও তাজউইদ-এর চর্চা
খুশূ’ ও আদব
সহীহ সনদওয়ালা কারী-এর অনুসরণ
এরপর বলা হয়—এ সব শর্ত পূরণ না করলে কুরআন বোঝার কোনও অধিকার নেই। অথচ বাস্তবে একজন সাধারণ মুসলিমের পক্ষে কখনোই এতগুলো শর্ত পূরণ করা সম্ভব নয়।
ফলত, প্রশ্নটি জোরালো হয়ে ওঠে—
কুরআন বোঝার জন্য সহীহ ক্বিরাআতের পূর্ণাঙ্গ দক্ষতা কি আদৌ জরুরি?
এ যুগের মুসলিমদের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। বিশেষ করে যারা ইসলাম চর্চা, প্রচার বা প্রসারের সঙ্গে পেশাগতভাবে যুক্ত নন—অর্থাৎ সাধারণ মুসলিম—তারা যখন কুরআন বুঝতে আগ্রহী হন, তখন স্বাভাবিকভাবেই এ সংশয় দেখা দেয়।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো—এই প্রশ্নটি সাধারণ মুসলিমদের কাছ থেকে যতটা না আসে, তারচেয়ে বেশি ধর্মীয় পেশাজীবীরা (ধর্মজীবীরা) উত্থাপন করেন। তাদের সমর্থকরাও একই যুক্তি প্রতিধ্বনির মতো পুনরাবৃত্তি করেন।
ফলে অনেক সাধারণ মুসলিম এই দাবিগুলোর চাপে অসহায় বোধ করেন, কুরআন বোঝার সাহস হারিয়ে ফেলেন।
এই লেখাটি লিখছি মূলত সাধারণ মুসলিমদের সেই সংশয় দূর করতে, তাদের সাহস জোগাতে এবং স্পষ্ট করতে যে—কুরআন বোঝা ও ক্বিরাআতের শুদ্ধতা—এ দুটি আলাদা বিষয়।
ধর্মীয় পেশাজীবীদের দাবী –
ধর্মীয় পেশাজীবীরা (ধর্মজীবীরা) সাধারণত কুরআন বোঝার ক্ষেত্রে কয়েকটি দাবিকে সামনে আনেন। সেগুলো হলো—
১. সহীহ ক্বিরাআতের দাবি
তাদের মতে—
কুরআনের একটি নির্দিষ্ট ক্বিরাআতের (আবৃত্তি) মানদণ্ড রসুলুল্লাহ ﷺ-এর সময় থেকে চালু আছে।
সেই উচ্চারণ ও আবৃত্তি ছাড়া কুরআন পড়া বৈধ নয়।
আর কুরআনকে সঠিকভাবে না পড়লে বোঝার প্রশ্নই আসে না।
এই সহীহ ক্বিরাআত কেবল তারাই জানেন এবং কেবল তারাই তা সঠিকভাবে করতে সক্ষম।
২. অনুবাদকে অগ্রাহ্য করা
তাদের আরেকটি জোরালো দাবি হলো—
কুরআন বোঝার একমাত্র উপায় হলো আরবি ভাষা থেকে সরাসরি বোঝা।
অনুবাদ পড়ে কুরআনের সঠিক অর্থ কখনোই পাওয়া সম্ভব নয়।
তারা বলেন, ধর্মজীবীরাই কুরআনের আরবি ক্বিরাআত থেকে প্রকৃত অর্থ উদ্ঘাটন করেন এবং সাধারণ মানুষকে তা বোঝান।
তাই সাধারণ মুসলিমরা অনুবাদ পড়ে কুরআন বোঝার চেষ্টা করলে তা ব্যর্থ হবে।
সবশেষে এসে তাদের মূল বক্তব্য দাঁড়ায়—
“তোমরা নিজেরা কুরআন বুঝবে না; আমরা যেমনভাবে বোঝাবো, সেটাই নিঃশর্তভাবে মেনে নিতে হবে।”
এবার একে একে প্রশ্নের উত্তরে আগাই – কুরআন বুঝতে সহি ক্বিরাআতের দক্ষতা একটি পূর্ব শর্ত!
ধর্মীয় পেশাজীবীদের যুক্তির সারকথা দাঁড়ায়—
কুরআন বুঝতে হলে সহীহ ক্বিরাআতের দক্ষতা অর্জন করা একটি পূর্বশর্ত।
কিন্তু বাস্তবতা হলো—
একজন সাধারণ মুসলিম পেশাগত দায়িত্ব, পারিবারিক ব্যস্ততা এবং জীবনের নানা টানাপোড়েনের কারণে এই যুগে কুরআনের শুদ্ধ ক্বিরাআতের দক্ষতা নিয়মিত চর্চা করে অর্জন বা ধরে রাখতে প্রায় অসম্ভব।
অথচ আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক মুসলিমের ওপর কুরআন বোঝা ফরজ করেছেন। শুধু বোঝাই নয়, বরং তাফাক্কুর (গভীরভাবে চিন্তা করা) ও তাদাব্বুর (মননশীলভাবে অনুধাবন করা) করারও নির্দেশ দিয়েছেন।
ফলে সাধারণ মুসলিম বাধ্য হয়েই অনুবাদের সাহায্যে কুরআন বোঝার চেষ্টা করেন। কিন্তু এখানেই ধর্মীয় পেশাজীবীরা কঠোর আপত্তি তোলেন। তাদের যুক্তি হলো—
যেহেতু ব্যক্তি শুদ্ধ ক্বিরাআতে কুরআন পড়তে পারেন না, তাই তার জানা বা বোঝা একেবারেই বাতিল।
এমনকি অনেক ক্ষেত্রে এই কারণে সাধারণ মুসলিমরা কটাক্ষ ও ঠাট্টা-মশকরার শিকার হন।
এইরকম একাধিক অভিজ্ঞতাই আমাকে বিষয়টি নিয়ে গভীর অনুসন্ধান করতে বাধ্য করেছে। আমার এই অনুসন্ধান হয়তো অনেক সাধারণ মুসলিমের দ্বিধা দূর করতে এবং তাদের সাহায্য করতে পারে।
তাহলে আসুন দেখা যাক—
ধর্মীয় পেশাজীবীদের এই দাবির আসল ভিত্তি কতটুকু?

একক উচ্চারণ ও আবৃত্তির বাস্তবতা :
প্রশ্ন হচ্ছে – কুরআন কি একই একই সংস্করণে-উচ্চারণে-আবৃত্তিতে নাজিল হয়েছে এবং আমরা আজও সেভাবেই পড়ছি?
১. কুরআনের সাত আহরুফ প্রসঙ্গ
যারা কুরআন সম্পর্কে গভীরভাবে জানেন, তারা অবগত যে কুরআন “সাত আহরুফে” (سبعة أحرف) নাজিল হয়েছে। এ বিষয়ে হাদিসে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। যেমন—
- সহিহ আল-বুখারি (Hadith 2419, Book 44, Hadith 9) এবং
 - মুসনাদ আহমাদ (Hadith 17199, আল-সুয়ুতির মতে সহিহ)
 
এসব বর্ণনায় উল্লেখ আছে যে, কুরআন সাত আহরুফে নাজিল হয়েছে এবং সাহাবারা ভিন্ন ভিন্ন রূপে কিরাআত করতেন, যা রাসূলুল্লাহ ﷺ অনুমোদন করেছিলেন।
“আহরুফ” বলতে কী বোঝানো হয়েছে?
এখানে “আহরুফ” শব্দটির অর্থ নিয়ে ইসলামী স্কলারদের মধ্যে কিছু মতভেদ রয়েছে।
- কেউ বলেন, এগুলো ভিন্ন উচ্চারণ পদ্ধতি বা ধ্বনিগত ভিন্নতা (dialectical variations)।
 - কেউ বলেন, এগুলো শব্দ ব্যবহারের ভিন্ন ধরন বা অভিব্যক্তির ভিন্ন শৈলী।
 - আবার অনেকে একে উপভাষাগত পার্থক্য হিসেবে ব্যাখ্যা করেছেন।
 
তবে মূল কথা হলো—হাদিসের মাধ্যমে স্পষ্ট বোঝা যায় যে, আহরুফগুলোর কারণে কিরাআতে ভিন্নতা শোনা যেত।
কেন এই ভিন্নতা ছিল?
ইসলামী রেওয়ায়ত থেকে ধারণা করা হয়, বিভিন্ন আরব গোত্রের উপভাষাগত ভিন্নতা (dialects) এর কারণে আল্লাহ্ এই সুবিধা দিয়েছিলেন, যাতে প্রত্যেক গোত্র সহজে কুরআন তিলাওয়াত করতে পারে এবং তা তাদের জন্য কষ্টসাধ্য না হয়।
এ থেকে বোঝা যায়—কুরআনের শুরু থেকেই একাধিক শৈলী ও উচ্চারণভেদ বিদ্যমান ছিল। তাই “শুধু একক সংস্করণ ও উচ্চারণ” এর ধারণা ইসলামী ইতিহাস ও হাদিস দ্বারা সমর্থিত নয়। বরং, কুরআনের ঐশ্বর্যই ছিল এর বহুমাত্রিক ভাষাগত বৈচিত্র্য, যা ভিন্ন ভিন্ন আরব গোত্রকে সহজে গ্রহণে সহায়তা করেছিল।
তার মানে নাজিলের পরপরই আমরা সবাই একই রকম ভাবে, একই উচ্চারণে কুরআন পড়ছিলাম না।
২য় পর্ব : ওসমানি মুসহাফ
এরপর কুরআনের প্রচার ও সংরক্ষণের ইতিহাস যদি আমরা দেখি, তবে দেখব—৭টি আহরুফের মধ্যে হজরত আবুবকর (রা:) “কুরায়েশ ডায়লেক্টের” একটি মুসহাফ বা মাসহাফ বা পাণ্ডুলিপি তৈরি করেছিলেন, যেটাকে “মুসহাফে সিদ্দিকী” বলা হতো। তবে সেটি পরবর্তীতে খুব বেশি ব্যবহার হয়েছে বলে জানা যায় না। তাই মুসহাফে সিদ্দিকী কেমন ছিল, তা আজ কোনো আলেমই বলতে পারবেন না।
এখনকার কথা দূরে থাক, “মুসহাফে সিদ্দিকী” তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান বিন আফ্ফান (রা:) এর আমলেও সঠিকভাবে অনুসরণ হয়নি। এর প্রমাণ পাওয়া যায় সেই সময় সাহাবীগণের (রা:) মধ্যে কুরআন পাঠের সঠিক নিয়ম নিয়ে বিভ্রান্তি দেখা দেওয়ার মাধ্যমে। একক উচ্চারণ নিয়ে দ্বিমত বা তৃতীয় মত ওঠার কারণে নতুন করে আরেকটি সঠিক মুসহাফ বা পাণ্ডুলিপি তৈরির প্রয়োজন দেখা দেয়। এর পেছনে অন্যতম কারণ ছিল “একক মুসহাফ” বা মুসহাফে সিদ্দিকীর অনুপস্থিতি।
এই সংকটের কারণে খলিফা উসমান (রা:) ওহি লেখকদের দিয়ে একটি কমিটি গঠন করেন। সেই কমিটির তৈরি একক পাণ্ডুলিপিকে আমরা “উসমানী মুসহাফ” বলি। বাকি সব মুসহাফ পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দেন তিনি। এরপর সেই পাণ্ডুলিপির অনুলিপি বিভিন্ন প্রদেশে কপি করে পাঠানো হয়।
এই ঘটনাগুলো স্পষ্ট প্রমাণ করে যে, আমরা এই পর্যায়ে এসে একইভাবে, একই উচ্চারণে কুরআন পড়ছিলাম না।
৩য় পর্ব : ১০ রকম ক্বিরাআত
এরপর হিজরি তৃতীয় শতকে আবারও দেখা যায়, সেই প্রামাণ্য “উসমানী মুসহাফ” আর হাতে নেই (নেই বলছি কারণ সেটা থকলে উচ্চারণ নিয়ে মতপার্থক্য হবার কথা নয়)। মুসলিম স্কলাররা লক্ষ্য করেন—বিভিন্ন ক্বিরাআতের পার্থক্যের কারণে কোনো কোনো এলাকার মানুষ কুরআনের মূল অর্থ থেকেও সরে যাচ্ছে। এ নিয়ে সংঘর্ষের সূত্রপাত হওয়ায় তারা বিষয়টিকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেন।
এরপর প্রাথমিকভাবে ৭ রকম ক্বিরাআতের ৭ জন ক্বারিকে প্রামাণ্য হিসেবে নির্বাচন করা হয়। (খেয়াল করুন—একটি মুসহাফ থেকে কিছু পার্থক্য হয়ে ৭টি সংস্করণ তৈরি হলো।) এই নির্বাচন করার ক্ষেত্রে মানদণ্ড ছিল—
উসমানী মুসহাফের সাথে সিলসিলাগত সম্পর্ক,
ব্যাকরণগত প্রমাণ্যতা,
এবং গুরু-শিষ্যর ধারাবাহিকতার প্রমাণ।
কিন্তু যেহেতু “উসমানী মুসহাফ” হুবহু পাওয়া যাচ্ছিল না, তাই এই ৭টি সংস্করণ মেনে নিতে হয়। পরবর্তীতে আরও ৩ জন ক্বারি যুক্ত করা হয়। সব মিলিয়ে দাঁড়ায় ১০টি সংস্করণ।
অর্থাৎ, পার্থক্য সামান্য হলেও, তখন আমরা ১০ রকম ভঙ্গিতে কুরআন পড়ছিলাম। আবারও সেই একই সিদ্ধান্তে আসা যায়—এই পর্যায়েও আমরা সবাই একভাবে, একই উচ্চারণে কুরআন পড়ছিলাম না।
৪র্থ পর্ব : ১০ ক্বিরাআতের শত বিস্তার
৭ম শতাব্দীতে নির্বাচিত এই ১০ জন ক্বারির প্রত্যেকেই তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন ক্বিরাআত বা সংস্করণকে প্রামাণ্য হিসেবে পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষা দিয়েছেন। এদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ক্বারি আসিম ইবনে আবি আল-নাজুদ। তাঁরই ছাত্র ছিলেন আবু আমর হাফস ইবনে সুলায়মান ইবনে আল-মুগিরা ইবনে আবি দাউদ আল-আসাদি আল-কুফি, সংক্ষেপে যিনি “হাফস” নামে পরিচিত। রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর পঞ্চম প্রজন্মভুক্ত শিক্ষার্থী এই ইমাম হাফসের ক্বিরাআতের ভিত্তিতেই আজ আমরা—মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্য এশিয়ায়—কুরআন পাঠ করছি।
উক্ত ১০ জন ক্বারির মধ্যে অধিকাংশের ক্বিরাআত বর্তমানে আর প্রচলিত নেই। তবে ৩ জন ক্বারির শিক্ষার্থীদের ক্বিরাআত থেকে তৈরি মুসহাফ আজও প্রচলিত আছে—যেমন লিবিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো, আলজেরিয়া, মৌরিতানিয়া, পশ্চিম আফ্রিকা, সুদান, মধ্য আফ্রিকা, পূর্ব আফ্রিকা ও ইয়েমেন অঞ্চলে।
আহরুফ ও ক্বিরাআতের ভিন্নতার প্রমাণ আমরা আজও পাই। যেমন, “হাফস” আর “ওয়ারশ” কুরআন পাশাপাশি রাখলে দেখা যায়—একই বিষয় ভিন্ন ভিন্ন স্টাইলে বলা হয়েছে। কোথাও ক্রিয়ার কালগত, কোথাও লিঙ্গগত, কোথাও বচনগত—এমনকি ব্যাকরণগত কিছু পার্থক্যও স্পষ্ট।
এপর্যন্ত এসেও আবার একই কথাই বলতে হয়—এই পর্যায়েও আমরা সবাই একভাবে, একই উচ্চারণে কুরআন পড়ছিলাম না।
৫ম পর্ব : ১০ চূড়ান্ত হাফস সংস্করণের জামানা
এখানেই ইতিহাস থেমে যায়নি। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বিভিন্ন দেশ থেকে আনা হাফস কুরআন একত্র করা হয়, তখন তাদের মধ্যে পার্থক্য ইসলামিক স্কলারদের চিন্তায় ফেলে দেয়। এ কারণে আল-আযহার বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন সবগুলো হাফস কুরআন পর্যালোচনা করে ১৯২৪ সালে একটি চূড়ান্ত ও অফিসিয়াল সংস্করণ নির্ধারণ করে।
পরবর্তীতে ১৯৮৫ সালে সৌদি আরব সেই সংস্করণকে গ্রহণ করে এবং কিং ফাহাদ কমপ্লেক্স থেকে ছেপে সারা পৃথিবীতে বিতরণ শুরু করে। আজ আমাদের হাতে যে কুরআন আছে, সেটিই মূলত সেই সংস্করণ।
অতএব স্পষ্ট যে, মাত্র ১০০ বছর আগেও দুইজন হাফস কুরআন পাঠকারী একইভাবে কুরআন পড়ছিলেন না।
এপর্যন্ত এসেও আবার একই কথাই বলতে হয়—এই পর্যায়েও আমরা সবাই একভাবে, একই উচ্চারণে কুরআন পড়ছিলাম না।
এখানে আমাদের যেটা বুঝতে হবে তা হলো – ১০ টি ভিন্ন ক্বিরআত যখন মুসলিম স্কলাররা গ্রহণ করেছেন, তখনই প্রমাণ হয়, ক্বীরআত নয় (অর্থাৎ ছোটখাটো পার্থক্য মুল ইস্যু নয়), কুরআনের বার্তাটাই প্রধান বিষয়। উচ্চারণ বা আবৃত্তি যাই হোক, কুরআনের মুল বার্তাটা প্রচার করাটাই সবচেয়ে জরুরী।
তাই এখানে যে একক ও অভিন্ন ক্বিরআতের যে দাবী করা হয়, সেটা অজ্ঞান প্রসূত।
ক্বিরাআত বনাম লিখিত পাণ্ডুলিপির নির্ভরযোগ্যতা
অস্বীকার করার উপায় নেই যে কুরআনের প্রথম যুগে সংরক্ষণ ও প্রচার হয়েছে মূলত আবৃত্তির মাধ্যমে। ফলে উচ্চারণের ওপরই প্রধান নির্ভরতা ছিল। কিন্তু দেখা গেছে, ডায়লেক্টিকাল পার্থক্যের কারণে ধীরে ধীরে মূল মেসেজ থেকে মানুষ সরে যেতে শুরু করে। আবৃত্তি বা ক্বিরাআতের ওপর ভরসা করার ফলেই একসময় বিতর্কের জন্ম হয়। আর সেই বিতর্ক সমাধান করার জন্য বারবার লিখিত পাণ্ডুলিপি তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো—প্রতিবার প্রামাণ্যতা নিশ্চিত করার জন্য লিখিত আকারে সংরক্ষণ করা হয়েছে এবং শেষ পর্যন্ত লেখাকেই প্রামাণ্য হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। হিজরি তৃতীয় শতকে এসে যখন ক্বিরাআতগুলো লিখিত আকারে মুসহাফে অন্তর্ভুক্ত করা হলো, তখন সেই লেখাই সংরক্ষিত হলো এবং পরবর্তী সময়ে প্রমাণ্যতার জন্য বারবার সেখানে ফিরে যাওয়া হলো। লিখিত আকারে সংরক্ষিত হওয়ার কারণেই এরপর থেকে নতুন কোনো ক্বিরাআতের সৃষ্টি হয়নি।
সারমর্ম: লিখিত সংস্করণই ক্বিরাআতের তুলনায় অনেক বেশি নির্ভরযোগ্য প্রমাণিত হয়েছে।

আজকের দিনে ক্বীরআত নির্ভরতা:
কাগজ সহজলভ্য হয়ে ওঠার পর থেকে মানুষের লিখিত কুরআনের উপর নির্ভরতা বেড়েছে, আর কমেছে আবৃত্তি বা ক্বিরাআতের উপর নির্ভরতা। আবৃত্তির উপর নির্ভরতা কমলে স্বাভাবিকভাবেই উচ্চারণভিত্তিক পার্থক্যের উপর নির্ভরশীলতাও হ্রাস পেয়েছে। এজন্যই দেখা যায়—গত শতকে বহু বড় বড় ইসলামিক আলেম ও গবেষক ছিলেন, যাদের কাছে কভার-টু-কভার কুরআন মুখস্থ ছিল না।
বর্তমান বিশ্বে শিক্ষিত স্কলারগণ লিখিত টেক্সটকে ভিত্তি করে প্রচার, প্রসার ও গবেষণার কাজ পরিচালনা করছেন। ফলে আজকের দিনে নামাজে পাঠ এবং ক্বিরাআত প্রতিযোগিতা ছাড়া ইসলামের প্রচার-প্রসারে ক্বিরাআতের বিশেষ কোনো ব্যবহার নেই বললেই চলে।
আজকের দিনে কুরআন বুঝতে ও গবেষণায় লিখিত টেক্সটই সবচেয়ে প্রামাণ্য, ক্বিরাআত নয়।
কুরআনের আরবি দিয়ে কুরআন বোঝার প্রক্রিয়া:
১ম থাপ:
কুরআন ক্লাসিক্যাল আরবিতে রচিত। আজকের দিনের প্রচলিত আরবিতে নয়। অর্থাৎ অক্ষর, বৈশিষ্ট্যসূচক চিহ্ন বা বিরামচিহ্ন এক হলেও, এবং তা আজকের আরবি জ্ঞান দিয়ে পাঠযোগ্য হলেও, অর্থ বোঝা প্রায় অসম্ভব।
এসব কারণে আরবি ভাষাভাষীদেরও কুরানের আরবি দিয়ে কুরান কে বুঝতে হলে, ক্লাসিক্যাল আরবি আলাদা করে শিখতে হবে। ক্লাসিকাল আরবি ব্যাকরণের পাশাপাশি ও ক্লাসিক্যাল আরবির পুরো লেক্সিকন বা অভিধান নখদর্পণে আনতে হবে।
এছাড়া কুরআনে আরবি ভাষার বাইরে অন্তত ১৩ টি ভাষার শব্দ রয়েছে। সেগুলোর সঠিক অর্থ উদ্ধার করতে ওই ভাষাগুলো জানা দরকার। আর তা না হলে ঘুরে ফিরে আবার অনুবাদ করা অভিধানই ভরসা।
এগুলো জানার পাশাপাশি যেই ভাষায় তিনি অনুবাদ করবেন, সেই ভাষাটির উপরে অনুবাদকের একই রকম দক্ষতা থাকা জরুরী।
তবে উপরে যে যোগ্যতার ফরমায়েশ দিলাম, তা শুধুমাত্র কুরআনের শব্দ ও বাক্য বোঝার জন্যই দরকার। প্রতিটি আয়াতের শুধুমাত্র আক্ষরিক অনুবাদ।
২য় ধাপ:
তবে সেই সব চ্যালেঞ্জ করা ধর্মীয় পেশাজীবীরা, আক্ষরিক অনুবাদে কুরআন বোঝাকে কি মানবেন? এভাবে কুরান বুঝাকে কি তারা যথেষ্ট বোঝা বলে স্বীকার করবেন? তারা কখনোই মানবেন না। তারা কুরানের আয়াত কে বোঝার জন্য Context বা প্রাসঙ্গিকতা টানবেন। সেটি টানলেই প্রথমে চলে আসবে সিরাত। সিরাতের ক্ষেত্রে ইবনে হিশাম এবং ইবনে আব্বাস তো পড়তেই হবে।
সিরাতকে ঠিকমতো Contextualize করতে হলে, হাদিস দরকার। সেজন্য সিরাত এর পাশাপাশি অন্তত দুটি হাদিসের সংগ্রহশালা (বুখারি ও মুসলিম) পড়তে হবে। যদিও অনেকেই মনে করেন কিতাবুস সিত্তাহ পুরোটাই পড়া দরকার। ৩০ হাজার + হাদিস, রিপিট হলেও প্রতিটি হাদিস সনদ ও মতন সহ পড়তে হবে।
হাদিসগুলো বোঝার জন্য হাদিস-শাস্ত্রের পারিভাষিক জ্ঞানের বইগুলো পড়া লাগবে। এছাড়া প্রতিটি হাদিস গ্রন্থ ভালোভাবে বুঝতে প্রতিটি গ্রন্থের অন্তত দুটি করে ব্যাখ্যাকারী গ্রন্থ পড়া দরকার ( যেমন বুখারির জন্য ফাতহুল বারী বা উমদাতুল ক্বারি)।
আপনারা নিশ্চয় জানেন হাদিস গ্রন্থগুলো এবং তার ব্যাখ্যাকারী গ্রন্থগুলোর আকার-প্রকার কত বড়, পড়ে হজম করতে কত বছর দরকার !
৩য় ধাপ:
মনে রাখা দরকার, উপরে উল্লেখিত সব কেতাব যে সময় ধরে রচিত হয়েছে, সেই সময়ে আরবি ভাষা পরিবর্তনের বড় তিনটি যুগ অতিক্রম করেছে। ১০ম খৃষ্টীয় শতককে যদি আমরা সেই যুগের সর্বশেষ ধরি, তবে সেই সময়ে প্রতিশব্দ এবং সমার্থক শব্দের পার্থক্য সহ অন্তত ৬ টি আলাদা আরবি অভিধান চলমান ছিল। সুতরাং এই তিনটি যুগের আরবি, পরিবর্তনগুলো সম্পর্কে গভীর জ্ঞান দরকার।
এখন আপনি নিজে চিন্তা করে বিচার করুন –
যারা কুরআনের আরবি দিয়ে কুরআন বোঝার দাবী করেন, তারা কি আদৌ এর ১০% প্রস্তুতির মধ্যে দিয়ে গেছেন? তাদের দাবীর সাথে বাস্তবতার কি আদৌ কোন সম্পর্ক আছে?
তাই অত্যন্ত বিনীত ভাবে বলতে চাই, যারা আমাদের আশেপাশে সেই দাবী করেন, তারাও প্রচলিত অনুবাদ পড়েই কুরআনের মানে শিখেছেন। কিন্তু আরবি আবৃত্তির পাশাপাশি তারা যখন সেই অনুবাদ থেকে শেখা অর্থ বলেন, সাধারণ মানুষের কাছে মনে হয় তারা আরবি থেকেই অর্থ করছে। আর তারা সেই ভুল বোঝার সুবিধা নিয়ে দাবীটি চালিয়ে যান।
এতক্ষণে নিশ্চয় বুঝতে পারছেন তাদের দাবীর বাস্তবতা আসলে কী?
আরও ভালো বুঝতে পারবেন কুরআনের গ্রহণযোগ্য অনুবাদকারীদের যোগ্যতা সম্পর্কে জেনে।

কুরআনের গ্রহণযোগ্য অনুবাদকারীদের যোগ্যতা:
এবার আসুন একজন গ্রহণযোগ্য অনুবাদক সম্পর্কে জেনে নেই। মির্জা আবুল ফজল কুরানের ইংরেজি অনুবাদ করেছেন। তিনি বংশানুক্রমিক ভাবে হাফেজ ছিলেন। পিএইচডি ছিলেন ১৮ শতকের। আরবি, ইংরেজি এবং সংস্কৃত ভাষার একই রকম পণ্ডিত ছিলেন। ক্লাসিকাল আরবির পাশাপাশি সিরিয়াক, এরামিক জানতেন। কুরানের ডায়লেক্টিকাল পার্থক্য সম্পর্কে অবগত ছিলেন, আলজেরিয়া মরক্কোতে যে ধরনের পার্থক্য পাওয়া যায় তা জানতেন। ভাষা-গত বিবর্তনের বিষয়গুলো জানতেন। বাংলা আর উর্দু যে তিনি জানতেন তা বলাই বাহুল্য। অনুবাদ বহু লোক করেছেন। তবে যাদের অনুবাদ গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তাদের বেশিরভাগের যোগ্যতা এই স্তরেরই।
যোগ্যতার বাটখারায় মেপে সিদ্ধান্ত নিন:
এবার মির্জা আবুল ফজল এর যোগ্যতার পাশাপাশি আপনার পাশের “আরবি থেকে কুরান বোঝা” চ্যালেঞ্জ করা আলেমদের যোগ্যতা রাখুন। পার্থক্যটা আপনার কাছে স্পষ্ট হয়ে যাবে।
আপনি খুব সহজে বুঝতে পারবেন, কার অনুবাদ পড়া উচিৎ, আর কার নিজের অনুবাদ শোনাও উচিৎ নয়।
তাহলে কোথা থেকে কুরান বুঝবো?
উপরে তথ্যগুলো বারবার পড়ুন। সিদ্ধান্ত আপনার নিজেকে নিতে হবে।
তবে আমার মতে কুরআন বোঝার ভালো উপায় হচ্ছে নিজে যে ভাষায় সবচেয়ে বেশি দক্ষ, সেই ভাষার সেরা অনুবাদটি পড়া। সম্ভব হলে একাধিক পড়া।তাতে আপনি সবচেয়ে শিক্ষিত ও গ্রহণযোগ্য আলেমদের চোখ দিয়ে কুরআন কে দেখতে পাবেন।
বিশেষ অনুরোধ:
আমি যেসব তথ্য দিয়েছি তার সবই অনলাইনে উন্মুক্ত তথ্য। লেখাটা সংক্ষিপ্ত করার জন্য সেসব পুনরায় উল্লেখ করছি না। অনলাইনে এসব সম্পর্কে বহু আর্টিকেল আছে, কেউ চাইলে পড়ে নিতে পারবেন। তবে কারও কোন বিষয়ে সন্দেহ হলে বা তথ্য খুঁজে না পেলে কমেন্ট করে জানান, আমি রেফারেন্স যোগ করে দেবো।
সর্বশেষে বলতে চাই আমার জানামতে আমি তথ্য দিলাম, তবে সর্ব বিষয়ে মহান আল্লাহই প্রকৃত বাস্তবতা জানেন। তাই আমার অজানাতে কোন ভুলের জন্য তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করছি।
