১৮৯৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত হয় ধর্ম বিষয়ক এক ঐতিহাসিক সম্মেলন—ওয়ার্ল্ড’স পার্লামেন্ট অব রিলিজিয়নস্। এই আন্তর্জাতিক মঞ্চে ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করে ইতিহাসে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর উদ্বোধনী ভাষণ কেবল ভারতের ভাবধারা নয়, মানবতার সার্বজনীন বাণীকেই বিশ্বমঞ্চে পৌঁছে দিয়েছিল।
ঐতিহাসিক ভাষণের প্রেক্ষাপট
স্বামী বিবেকানন্দ তখন সদ্য ত্রিশোর্ধ্ব। গুরু শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংসের দেখানো পথ ও আদর্শে বলীয়ান হয়ে তিনি পশ্চিমা দুনিয়ায় ভারতীয় দর্শন, বিশেষত বেদান্ত ও হিন্দুধর্ম প্রচারে এগিয়ে এসেছিলেন। শিকাগো সম্মেলনের এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে তিনি বিশ্ববাসীকে দেখালেন—ভারত কোন ভাবধারা ধারণ করে, এবং কেন তা আজকের পৃথিবীতেও প্রাসঙ্গিক।
‘Sisters and Brothers of America…’
স্বামীজির ভাষণের সূচনা হয় এই বিখ্যাত উচ্চারণে—
“Sisters and Brothers of America…”
এই সম্বোধনের মাধ্যমে তিনি শ্রোতাদের অন্তর জয় করে নিয়েছিলেন মুহূর্তেই। ছয় হাজার শ্রোতা একযোগে উঠে দাঁড়িয়ে দীর্ঘক্ষণ করতালি দিয়ে তাঁকে স্বাগত জানায়। এই ভাষণের অন্তর্নিহিত ছিল ভ্রাতৃত্ব, সহনশীলতা, এবং মানবতার প্রতি শ্রদ্ধা।
ভাষণের মূল সুর
১. সাম্প্রদায়িক সহনশীলতা ও ধর্মীয় ঐক্য – স্বামী বিবেকানন্দ বলেন, ভারত সেই দেশ যেখানে প্রাচীনকাল থেকেই বিভিন্ন ধর্ম ও বিশ্বাস একত্রে বাস করেছে। তিনি বৌদ্ধ, জৈন ও ইসলাম ধর্মের সহাবস্থান তুলে ধরেন।
২. হিন্দুধর্মের সার্বজনীনতা – তিনি ব্যাখ্যা করেন, হিন্দুধর্ম কেবলমাত্র একটি সম্প্রদায়ের ধর্ম নয়, এটি এক জীবনদর্শন। তিনি বেদান্তের বাণী তুলে ধরেন—
“As the different streams having their sources in different places all mingle their water in the sea, so, O Lord, the different paths which men take… all lead to Thee.”
৩. সহিষ্ণুতার শিক্ষা – তিনি জানান, ভারত হাজার বছর ধরে শিক্ষা দিয়েছে কীভাবে ‘অপর’ ধর্মকেও শ্রদ্ধা করতে হয়। তাঁর বাণীতে উঠে আসে ঐক্যবদ্ধ মানবজাতির এক শুভ আকাঙ্ক্ষা।
পশ্চিমা বিশ্বে প্রভাব
স্বামী বিবেকানন্দের বক্তৃতা সে সময়কার পাশ্চাত্য শ্রোতাদের কাছে ছিল বিস্ময়কর। একজন ভারতীয় সন্ন্যাসী, যার পোশাক ছিল সাদামাটা, উচ্চারণে ছিল আত্মবিশ্বাস, আর দর্শনে ছিল বিশ্বজনীনতা—তিনি যেন মানবতার পক্ষেই কথা বলেছিলেন। তার বক্তব্য নিউ ইয়র্ক, বোস্টনসহ আমেরিকার বিভিন্ন স্থানে তাঁকে আমন্ত্রণ এনে দেয় এবং তিনি সেসব জায়গায় গিয়ে ভারতীয় দর্শনের প্রচার করেন।
পরবর্তী প্রভাব
শিকাগোর সেই ভাষণই স্বামী বিবেকানন্দকে বিশ্বপরিচিত করে তোলে। ভারতের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শুরুতেও তাঁর এই ভাষণের ভূমিকা ছিল অপরিসীম। স্বাধীনতা-চেতনায় জাগ্রত এক প্রজন্ম তাঁর দর্শনে অনুপ্রাণিত হয়েছিল।
স্বামীজির এই ভাষণ আজও বিশ্বের ইতিহাসে ‘সার্বিক মানবধর্মের’ একটি মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হয়।
স্বামী বিবেকানন্দের ঐতিহাসিক ভাষণ
প্রথম বিশ্ব ধর্ম মহাসভা, শিকাগো
তারিখ: ১১ই সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩
স্থান: বর্তমান শিকাগোর আর্ট ইনস্টিটিউট চত্বরে অনুষ্ঠিত
আমেরিকার বোন ও ভাইয়েরা,
আপনাদের এই আন্তরিক ও উষ্ণ অভ্যর্থনার উত্তরে এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার হৃদয় এক অপার্থিব আনন্দে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই বিশ্বের প্রাচীনতম সন্ন্যাসী সম্প্রদায়ের পক্ষে, আমি কৃতজ্ঞতা জানাই ‘ধর্মসমূহের জননী’ সেই মহান ধর্মের পক্ষ থেকে, এবং আমি কৃতজ্ঞতা জানাই কোটি কোটি হিন্দু—যাঁরা বিভিন্ন শ্রেণি ও সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত—তাঁদের পক্ষ থেকেও।
এই মহামঞ্চে যাঁরা আমাদের, অর্থাৎ প্রাচ্য থেকে আগত প্রতিনিধিদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বলেছেন যে, আমরা বিশ্বব্যাপী সহনশীলতার বাণী বহন করে এনেছি—তাঁদের প্রতিও আমি আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
আমি গর্বিত যে আমি এমন এক ধর্মের অনুসারী, যে ধর্ম মানবজাতিকে সহনশীলতা ও সর্বজনীন গ্রহণযোগ্যতার শিক্ষা দিয়েছে। আমরা কেবল সহনশীলতায় বিশ্বাস করি না, বরং আমরা সমস্ত ধর্মকেই সত্য বলে মেনে নিই।
আমি গর্বিত যে আমি এমন এক জাতির সন্তান, যে জাতি পৃথিবীর সমস্ত ধর্ম ও জাতির নিপীড়িত ও শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। গর্বের সঙ্গে জানাচ্ছি—আমরা আমাদের হৃদয়ে আশ্রয় দিয়েছি ইহুদিদের সেই নিগূঢ়তম অংশকে, যাঁরা তাঁদের পবিত্র মন্দির ধ্বংস হওয়ার সময় দক্ষিণ ভারতে এসে আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন। আমি গর্বিত যে, আমরা আজও সেই মহান জরথুস্ত্রী জাতির অবশিষ্ট জনগোষ্ঠীকে রক্ষা ও লালন করছি।
ভাইয়েরা, আমি আপনাদের সামনে একটি স্তোত্রের কয়েকটি পঙ্ক্তি উদ্ধৃত করতে চাই, যা আমি শৈশব থেকে পাঠ করে আসছি এবং যা প্রতিদিন কোটি কোটি মানুষ উচ্চারণ করেন:
“যেমন নানা নদী, নানা পথে প্রবাহিত হয়ে অবশেষে সমুদ্রে মিশে যায়, তেমনি মানুষও নানা প্রবণতা অনুযায়ী নানা পথ অবলম্বন করেও শেষ পর্যন্ত তোমার কাছেই পৌঁছে যায়।”
এই মহাসভা—যা বিশ্বের ইতিহাসে অন্যতম গৌরবময় ও সম্মানজনক সমাবেশ—নিজেই যেন প্রমাণ করে, গীতায় ঘোষিত সেই চিরন্তন তত্ত্বটি কতটা সত্য:
“যে যে রূপে আমাকে আরাধনা করে, আমি তাকে সেই রূপেই গ্রহণ করি; সকলে নানা পথ অবলম্বন করেও আমাকেই অনুসরণ করে।”
সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি এবং এর ভয়ংকর সন্তান—ধর্মান্ধতা—এই সুন্দর পৃথিবীকে বহুদিন ধরে গ্রাস করে রেখেছে। তারা বারবার এই পৃথিবীকে রক্তাক্ত করেছে, ধ্বংস করেছে সভ্যতাকে, বিলীন করেছে জাতিকে জাতিকে। যদি এই দানবীয় শক্তিগুলোর অস্তিত্ব না থাকত, তবে মানবসমাজ আজ অনেক দূর অগ্রসর হতে পারত।
কিন্তু আজ সেই ঘোর অন্ধকারের অবসানের সময় এসে গেছে। আমি আন্তরিকভাবে আশাবাদী, আজ সকালে এই মহাসভার সম্মানে যে ঘন্টা বাজানো হয়েছে, সেটিই যেন হয়ে ওঠে—সবধরনের ধর্মান্ধতার মৃত্যু-ঘণ্টা, কলম কিংবা তলোয়ার দিয়ে পরিচালিত সকল নিপীড়নের পরিসমাপ্তির সূচনা-ঘণ্টা, এবং এমন সকল অমানবিক অনুভূতির অবসান—যা একে অপরের পথকে বাধা মনে করে, যদিও সবার গন্তব্য এক ও অভিন্ন।