২০১৩ সালের শুরুতে ঢাকার শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ আন্দোলন শুরু হয়, যেখানে মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে দোষীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবি তোলা হচ্ছিল। কিন্তু এই আন্দোলনের ভেতরে থাকা কিছু ব্লগারের বিরুদ্ধে ইসলাম ও মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–কে অবমাননা করার অভিযোগ ওঠে।
এই অভিযোগকে সুসংগঠিতভাবে ছড়িয়ে দেয় তৎকালীন দৈনিক আমার দেশ পত্রিকা, যার সম্পাদক ছিলেন মাহমুদুর রহমান। তিনি ব্লগারদের বিরুদ্ধে বাছাই করা লেখা, বিকৃত উদ্ধৃতি ও উত্তেজনামূলক প্রতিবেদন প্রকাশ করে বিষয়টিকে জাতীয় ইস্যুতে রূপ দেন। এর মাধ্যমে ইসলামপন্থিদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয় এবং সাধারণ জনগণের একাংশও বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে।
এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ রাজপথে নামে। তারা শাহবাগ আন্দোলনকারীদের “নাস্তিক–মুরতাদ” আখ্যা দিয়ে দাবি তোলে যে ইসলাম অবমাননার বিরুদ্ধে কঠোর আইন প্রণয়ন করতে হবে। এভাবেই সংগঠনটি দ্রুত সংগঠিত হয়ে রাজধানীতে লংমার্চের পর একটি বিশাল সমাবেশের মাধ্যমে তাদের ১৩ দফা দাবি ঘোষণা করে।
মতিঝিলে লংমার্চ শেষে আয়োজিত সমাবেশে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ তাদের ১৩ দফা দাবি সরকারকে মেনে নেওয়ার জন্য আল্টিমেটাম দেয়। সংগঠনটির নেতারা দাবি করেন, এসব দাবিকে অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে, অন্যথায় সরকারকে “টেনে হিঁচড়ে নামানো হবে” বলেও হুমকি দেন।
এই সমাবেশের মধ্য দিয়ে হেফাজতে ইসলাম দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার কেন্দ্রে উঠে আসে। তাদের উত্থাপিত দাবিগুলো মূলত ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়কে কেন্দ্র করে, যা জাতীয় রাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সংখ্যালঘু অধিকারসহ বহুমাত্রিক ইস্যুর সঙ্গে সম্পর্কিত।
ঘটনাপ্রবাহ
৬ এপ্রিল ২০১৩ : হেফাজতে ইসলাম ঢাকায় লংমার্চ কর্মসূচি পালন করে। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লাখো মানুষ ঢাকায় সমবেত হয়।
লংমার্চ শেষে রাজধানীর মতিঝিলে সমাবেশে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে ১৩ দফা দাবি উত্থাপন করে।
সরকারকে এই দাবিগুলো বাস্তবায়নের আল্টিমেটাম দিয়ে নেতারা ঘোষণা করেন—দাবি পূরণ না হলে সরকারকে “টেনে হিঁচড়ে নামানো হবে।”
দাবিগুলোর মধ্যে ছিল—সংবিধানে আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা পুনঃস্থাপন, ইসলাম অবমাননার শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড আইন, নারী নীতি ও শিক্ষানীতি বাতিল, কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা, ভাস্কর্য অপসারণ, কওমি মাদ্রাসার স্বাধীনতা রক্ষা ইত্যাদি।
হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবী:
১. সংবিধানে ‘আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ পুনঃস্থাপন এবং কোরআন-সুন্নাহবিরোধী সব আইন বাতিল করা।
২. আল্লাহ্, রাসুল (সা.) ও ইসলাম ধর্মের অবমাননা এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে কুৎসা রোধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে জাতীয় সংসদে আইন পাস।
৩. কথিত শাহবাগি আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী স্বঘোষিত নাস্তিক-মুরতাদ এবং প্রিয় নবী (সা.)-এর শানে জঘন্য কুৎসা রটনাকারী ব্লগার ও ইসলামবিদ্বেষীদের সব অপপ্রচার বন্ধসহ কঠোর শাস্তিদানের ব্যবস্থা করা।
৪. ব্যক্তি ও বাকস্বাধীনতার নামে সব বেহায়াপনা, অনাচার, ব্যভিচার, প্রকাশ্যে নারী-পুরুষের অবাধ বিচরণ, মোমবাতি প্রজ্বালনসহ সব বিজাতীয় সংস্কৃতির অনুপ্রবেশ বন্ধ করা।
৫. ইসলামবিরোধী নারীনীতি, ধর্মহীন শিক্ষানীতি বাতিল করে শিক্ষার প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা।
৬. সরকারিভাবে কাদিয়ানিদের অমুসলিম ঘোষণা এবং তাদের প্রচারণা ও ষড়যন্ত্রমূলক সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
৭. মসজিদের নগর ঢাকাকে মূর্তির নগরে রূপান্তর এবং দেশব্যাপী রাস্তার মোড়ে ও কলেজ-ভার্সিটিতে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপন বন্ধ করা।
৮. জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের সব মসজিদে মুসল্লিদের নির্বিঘ্নে নামাজ আদায়ে বাধাবিপত্তি ও প্রতিবন্ধকতা অপসারণ এবং ওয়াজ-নসিহত ও ধর্মীয় কার্যকলাপে বাধাদান বন্ধ করা।
৯. রেডিও-টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে দাড়ি-টুপি ও ইসলামি কৃষ্টি-কালচার নিয়ে হাসিঠাট্টা এবং নাটক-সিনেমায় নেতিবাচক চরিত্রে ধর্মীয় লেবাস-পোশাক পরিয়ে অভিনয়ের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মের মনে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষমূলক মনোভাব সৃষ্টির অপপ্রয়াস বন্ধ করা।
১০. পার্বত্য চট্টগ্রামসহ দেশব্যাপী ইসলামবিরোধী কর্মকাণ্ডে জড়িত এনজিও এবং খ্রিস্টান মিশনারিগুলোর ধর্মান্তকরণসহ সব অপতৎপরতা বন্ধ করা।
১১. রাসুলপ্রেমিক প্রতিবাদী আলেম-ওলামা, মাদ্রাসার ছাত্র ও তৌহিদি জনতার ওপর হামলা, দমন-পীড়ন, নির্বিচার গুলিবর্ষণ এবং গণহত্যা বন্ধ করা।
১২. সারা দেশের কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষক, ওলামা-মাশায়েখ ও মসজিদের ইমাম-খতিবকে হুমকি-ধমকি, ভয়ভীতি দানসহ তাদের বিরুদ্ধে সব ষড়যন্ত্র বন্ধ করা।
১৩. অবিলম্বে গ্রেপ্তারকৃত সব আলেম-ওলামা, মাদ্রাসাছাত্র ও তৌহিদি জনতাকে মুক্তিদান, দায়ের করা সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার এবং আহত ও নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণসহ দুষ্কৃতকারীদের বিচারের আওতায় এনে কঠোর শাস্তি দিতে হবে।
![hefazat e islam 6027206 960 720 হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবী [ ইসলাম ও মুসলিম ] 2 Hefazat E Islam [ হেফাজত এ ইসলাম]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2021/04/hefazat-e-islam-6027206_960_720-300x199.jpg)
বিতর্ক
হেফাজতের এই দাবিগুলো সমাজে তীব্র বিতর্ক তৈরি করে।
সমর্থকরা এগুলোকে “ধর্ম রক্ষার অপরিহার্য শর্ত” বলে দাবি করে।
প্রগতিশীল মহল এগুলোকে গণতন্ত্রবিরোধী, নারী ও সংখ্যালঘুবিরোধী এবং মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনার পরিপন্থী হিসেবে ব্যাখ্যা করে।
এ বিতর্কের সূত্রপাতেই মাহমুদুর রহমান ও তার আমার দেশ পত্রিকার ভূমিকা ছিল কেন্দ্রীয়। তারা শাহবাগ আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে উত্তেজনা ছড়িয়ে পরিস্থিতিকে ঘোলাটে করে তোলে এবং শেষ পর্যন্ত সেটি হেফাজতের ১৩ দফা দাবির রাজনৈতিক মঞ্চ তৈরির পথ সুগম করে।
আরও পড়ুন:
![হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবী হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবী [ ইসলাম ও মুসলিম ] 1 হেফাজতে ইসলামের ১৩ দফা দাবী](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2024/02/হেফাজতে-ইসলামের-১৩-দফা-দাবী.jpg)