১০ জানুয়ারি (১৯৭২) বিকেল ৪.২৫ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার মতো করে নির্মিত ১০০ ফুট দীর্ঘ মঞ্চে স্থাপিত মাইকের সামনে যখন ভাষণ দিতে ওঠেন, তখন তিনি শিশুর মতো কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন; তার দু’চোখ গড়িয়ে অশ্রু পড়ছিল বারবার।
কান্না ছিল সেদিনের একমাত্র কণ্ঠস্বর। তিনি কাঁদছিলেন। কাঁদছিল লাখো মানুষ। যুগে যুগে অনেক কেঁদেছে বাঙালি, অনেক কান্না বুকের রক্ত হয়ে ঝরেছে। কিন্তু সেদিনের প্রেক্ষাপট ছিল ভিন্ন। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্য অসীম মমতার আবাস যে মহামানবের বুকে, তাঁকে ফিরে পাবার আনন্দে উদ্বেল বাঙালি অঝোরে কেঁদেছে ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি। আর তিনি কেঁদেছিলেন তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে প্রাণাধিক প্রিয় জনতার মাঝে আসতে পেরে।
এই সেই ঐতিহাসিক রমনা রেসকোর্স যেখান থেকে ৭ মার্চ (১৯৭১) বঙ্গবন্ধু মুক্তিসংগ্রাম-স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন, যে ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলার মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আর এখানেই ১০ জানুয়ারি (১৯৭২) বঙ্গবন্ধু আবার মঞ্চে জনতার সামনে দাঁড়ালেন।
![১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস 10 Jan 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahmans Homecoming 4 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ 2 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ, ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস [ 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming Day ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2022/01/১০-জানুয়ারি-বঙ্গবন্ধুর-স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন-দিবস-10-Jan-1972-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahmans-Homecoming-4-300x197.jpg)
১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ
৭ মার্চ মানুষ যেমন ছুটে গিয়েছিল রেসকোর্সের দিকে, ১০ জানুয়ারিও ঢাকাবাসী রওয়ানা হয় রেসকোর্সের দিকে। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময় জনগণের মধ্যে ছিল উত্তেজনা। আর ১০ জানুয়ারি সেই একই উত্তেজনা ছিল কিন্তু এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আনন্দ আর আবেগ। কারণ জাতির পিতা ফিরে এসেছেন।
১০ জানুয়ারি রেসকোর্স ময়দানে ৩৫ মিনিটব্যাপী প্রদত্ত বক্তৃতায় বাংলার প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান দৃপ্ত কণ্ঠে ঘোষণা করেন, “আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। বাংলার একজন লোকও বেঁচে থাকতে এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেবে না। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন কোন শক্তি নেই”।
নয় মাসেরও অধিক সময় পরে স্বদেশে ফিরে এসে দেশবাসীর সামনে বক্তৃতা করতে গিয়ে জনতার প্রিয় নেতার চোখে অশ্রু নেমে আসে।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছে, যাঁরা বর্বর বাহিনীর হাতে নিহত হয়েছে তাদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করে বলেন, “আজ আমার জীবনের সাধ পূর্ণ হয়েছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন। বাংলার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মুক্তিযোদ্ধা ও জনতার প্রতি জানাই সালাম। তোমরা আমার সালাম নাও।
তিনি বলেন, “পশ্চিম পাকিস্তানে আমি ফাঁসিতে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবে।”
তিনি আরও বলেন, “বাংলার মানুষ মুক্ত হাওয়ায় বাস করবে। খেয়ে-পেয়ে সুখে থাকবে এটাই আমার সাধনা।”
কবিগুরুর সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী, রেখেছো বাঙালি করে মানুষ করোনি…।’ কবিতাংশের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, কবিগুরুর আক্ষেপকে আমরা মোচন করেছি। তিনি বলেন, বাঙালি জাতি প্রমাণ করে দিয়েছে যে, তারা প্রাণ দিতে জানে। এমন কাজ তারা এবার করেছে যার নজির ইতিহাসে নেই।”
![১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস 10 Jan 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahmans Homecoming 12 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ 3 ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস [ 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming Day ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2022/01/১০-জানুয়ারি-বঙ্গবন্ধুর-স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন-দিবস-10-Jan-1972-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahmans-Homecoming-12-300x158.jpg)
বঙ্গবন্ধু আরো ঘোষণা করেন, “বাংলাদেশ একটি আদর্শ রাষ্ট্র হবে। আর তার ভিত্তি বিশেষ কোন ধর্মীয় ভিত্তিতে হবে না। রাষ্ট্রের ভিত্তি হবে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা।”
পাকিস্তানি বাহিনী গত দশ মাসে বাংলাদেশকে বিরান করে দিয়েছে। উল্লেখ করে শেখ মুজিব বলেন, “আমি প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, নেতা হিসেবে নয়, আপনাদের ভাই হিসেবে বলছি—যদি দেশবাসী খাবার না পায়, বস্ত্র না পায়, যুবকরা চাকুরী বা কাজ না পায় তাহলে স্বাধীনতা ব্যর্থ হয়ে যাবে পূর্ণ হবে না। তোমরা, আমার ভাইয়েরা, গেরিলা হয়েছিলে দেশমাতার মুক্তির জন্য। তোমরা রক্ত দিয়েছো। তোমাদের রক্ত বৃথা যাবে না।”
বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেছেন, “নিজেরা সবাই রাস্তা তৈরি করতে শুরু করুন, যার যার কাজ করে যান। একজনও ঘুষ খেয়ো না। মনে রেখ আমি সহ্য করবো না।”
তিনি বলেছেন, “সকলে জেনে রাখুন বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র এবং পাকিস্তানের স্থান চতুর্থ। ইন্দোনেশিয়া প্রথম ও ভারত তৃতীয়।”
![১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস 10 Jan 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahmans Homecoming 16 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ 4 ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস [ 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming Day ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2022/01/১০-জানুয়ারি-বঙ্গবন্ধুর-স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন-দিবস-10-Jan-1972-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahmans-Homecoming-16.jpg)
৩০ লক্ষ শহিদ
বঙ্গবন্ধু বলেন যে, বর্বর পাক হানাদার বাহিনী অন্ততপক্ষে ৩০ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। বাংলাদেশ হানাদার বাহিনী যখন স্টিম রোলার চালিয়ে যায়, তখন তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী। ওরা তাঁকে ফাঁসি দিতে চেয়েছিল। ওদের কাছে তখন তিনি একটি প্রার্থনা করেছিলেন যে, তাঁর মৃতদেহ যেন সোনার বাংলায় পাঠানো হয়।
তিনি আরও বলেন, “আমার ফাঁসির হুকুম হয়েছিল। কবর খোঁড়া হয়েছিল। জীবন দেবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম। বলেছিলাম আমি মানুষ, আমি বাঙালি, আমি মুসলমান। মানুষ একবার মরে, দুবার নয়। হাসতে হাসতে মরবো তবু ওদের কাছে ক্ষমা চাইবো না। মরার আগে বলে যাবো আমি বাঙালি, বাংলা আমার ভাষা, জয় বাংলা বলবো, বাংলার মাটি আমার মা। আমি মাথা নত করবো না।”
![১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস 10 Jan 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahmans Homecoming 13 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ 5 ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস [ 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming Day ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2022/01/১০-জানুয়ারি-বঙ্গবন্ধুর-স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন-দিবস-10-Jan-1972-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahmans-Homecoming-13-300x168.jpg)
অন্য ভাষাভাষীদের নিরাপত্তার আশ্বাস
বঙ্গবন্ধু তাঁর বক্তৃতায় দেশবাসীকে বাংলাদেশে বসবাসকারী অন্য ভাষাভাষী লোকদের পূর্ণ নিরাপত্তা প্রদানের জন্য দেশবাসীকে অনু্রোধ করেন। তিনি বলেন, “বিশ্ববাসীকে আমরা দেখাতে চাই বাঙালিরা কেবল স্বাধীনতার জন্যই আত্মত্যাগ করতে পারে তাই নয়, তারা শান্তিতে বসবাস করতে পারে।”
![১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস 10 Jan 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahmans Homecoming 15 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ 6 ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস [ 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming Day ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2022/01/১০-জানুয়ারি-বঙ্গবন্ধুর-স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন-দিবস-10-Jan-1972-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahmans-Homecoming-15-300x171.jpg)
যথাসময়ে বিচার হবে
তিনি অবশ্য উল্লেখ করেন যে, ইয়াহিয়া সরকারের সঙ্গে যারা সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেছে সে সকল দালালদের বিরুদ্ধে যথাসময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এদের বিচার করা হবে। সে ভার সরকারের ওপর ন্যস্ত রাখতে তিনি বলেন। এছাড়া পাক হানাদার বাহিনীর গণহত্যার ব্যাপকতা নিরূপণকল্পে আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থা গঠনের কথা বলেন।
গত ২৫ মার্চের কথা উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু জানান যে, তাকে ছেড়ে চলে আসার সময় তাজউদ্দীন, সৈয়দ নজরুল প্রমুখ নেতা কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। তিনি তাদের আদেশ করেছিলেন যে, তারা যাতে নির্দেশমতো সংগ্রাম চালিয়ে যায়। তিনি এখানেই মরবেন কিন্তু মাথা নত করবেন না। তাঁর সহকর্মীর ওয়াদা পালন করেছেন, সেজন্য তিনি তাদের ধন্যবাদ জানান।
![১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস 10 Jan 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahmans Homecoming 14 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ 7 ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস [ 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming Day ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2022/01/১০-জানুয়ারি-বঙ্গবন্ধুর-স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন-দিবস-10-Jan-1972-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahmans-Homecoming-14.jpg)
ভুট্টোর প্রতি
বঙ্গবন্ধু বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে তাঁর কোনো ক্ষোভ নেই। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের উদ্দেশে বলেন যে, তারা অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করেছে, অসংখ্য বাঙালি মা-বোনের অসম্মান করেছে, তবু তিনি চান তারা যেন ভালো থাকেন।
ভুট্টোর উদ্দেশে তিনি বলেন যে, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র এটি অতি সত্য ঘটনা। পশ্চিম পাকিস্তানও স্বাধীনতা রক্ষা করে শ্রীবৃদ্ধি করুক তিনি তাই চান। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকলে তাদের প্রতি বাংলাদেশ একই নীতি গ্রহণ করবে। এছাড়া ভুট্টো সাহেব বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের সাথে কোনোরকম একটি যোগসূত্র রাখার যে অনুরোধ করেছিলেন সে ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু বলেন, “আপনারা সুখে থাকুন, শান্তিতে থাকুন। আমরাও আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব নিয়ে শান্তিতে থাকতে বদ্ধপরিকর … বাঁধন টুটে গেছে।”
![১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস 10 Jan 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahmans Homecoming 11 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ 8 ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস [ 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming Day ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2022/01/১০-জানুয়ারি-বঙ্গবন্ধুর-স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন-দিবস-10-Jan-1972-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahmans-Homecoming-11-300x211.jpg)
স্বীকৃতি দানের আবেদন
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ভাষণে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি সাহায্যের আবেদন জানাবার সময় বলেছেন, “বিশ্বের সকল মুক্ত রাষ্ট্রকে অনুরোধ করছি বাংলাকে স্বীকৃতি দিন।” তিনি এছাড়া বাংলাদেশকে জাতিসংঘের সদস্যপদ প্রদানের আহ্বান জানিয়েছেন।
সাহায্য চাই
বঙ্গবন্ধু বলেন, “গত দশমাসে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাকে বিরান করেছে। বাংলার লাখো মানুষের আজ খাবার নেই, অসংখ্য লোক গৃহহারা। এদের জন্য মানবতার খাতিরে আমরা সাহায্য চাই।” বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি তিনি সাহায্যের আবেদন জানান।
ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতা
ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে নয়াদিল্লিতে তাঁর আলোচনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, তারা পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন।
তিনি বলেন যে, মিসেস গান্ধীকে তিনি ঘনিষ্ঠভাবে চেনেন। তিনি পণ্ডিত নেহরুর কন্যা ও পণ্ডিত মতিলাল নেহরুর পৌত্রী। রাজনীতি তার প্রতিটি রক্তকণিকার মধ্যে নিহিত। তাঁকে তিনি শ্রদ্ধা করেন। তাঁর মুক্তির জন্য মিসেস গান্ধী বিশ্বের সকল রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে ব্যক্তিগতভাবে চিঠি লিখেছেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমরা মিসেস গান্ধী, ভারত সরকার ও জনগণের কাছে কৃতজ্ঞ।”
তিনি আরও বলেন, বাংলার প্রায় এক কোটি মানুষ প্রাণভয়ে ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের খাবার ও বাসস্থান দিয়ে সাহায্য করেছে ভারত। সেজন্যও তিনি মিসেস গান্ধী ও ভারতবাসীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
![১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস 10 Jan 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahmans Homecoming 10 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ 9 ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস [ 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming Day ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2022/01/১০-জানুয়ারি-বঙ্গবন্ধুর-স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন-দিবস-10-Jan-1972-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahmans-Homecoming-10-300x169.jpg)
ভারতীয় সৈন্য প্রসঙ্গে
বঙ্গবন্ধু বলেন, “আমি যে মুহূর্তে বলব, তখনই সমস্ত ভারতীয় বাহিনীর লোকেরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে যাবে। এখনই আস্তে আস্তে অনেককে ফেরত পাঠানো হচ্ছে।”
এছাড়াও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সমর্থন ও সহযোগিতা দানের জন্য ব্রিটিশ, জার্মান, ফ্রান্স, সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মার্কিন জনগণের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে এক নজর দেখার জন্য এবং তাঁর কথা শোনার জন্য রমনা রেসকোর্সের মাঠ ছিল লোকে লোকারণ্য। কুয়াশা কাটতে না কাটতেই জনস্রোত বয়ে যায় রেসকোর্সের দিকে। দূর-দূরান্ত থেকে অসংখ্য মানুষ জমায়েত হয়েছিল এই প্রিয় নেতাকে দেখার জন্য। সেদিন শেখ মুজিবের জন্য বাংলার জনমানুষের হৃদয়ে কী ভীষণ পরিমাণ আবেগ- অনুভূতি ছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।
১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য রমনা রেসকোর্সের মাঠে এসেছিলেন ৭০ বছর বয়স্ক এক বৃদ্ধা। নাম তার করিমননেছা। মাঠের উত্তর দিকের মেয়েদের গেট দিয়ে প্রবেশ করতে গেলে আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবিকারা করিমননেছাকে প্রবেশ পথে বাধা দেন। তখন এই বৃদ্ধা নিজের কাছে সযত্নে থাকা এক টুকরো রক্তাক্ত কাপড় বের করে কান্নাভেজা অথচ দৃপ্ত কণ্ঠে বলে ওঠেন, “লৌ (রক্ত) আনছি লৌ। আর লৌ লইয়া আইছি, শেখ সাবেরে দিমু। এই দেহেন কত লৌ আনছি।”
করিমননেছার দুটি সন্তান ছিল আরাফাত আলী ও কালাচান। দুই সন্তানই নারায়ণগঞ্জের আদমজী মিলে চাকরি করতেন। বৃদ্ধা জননীর এই দুই সন্তানই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর হাতে শহীদ হন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর গুলিতে দুই পুত্রের বক্ষ বিদীর্ণ হয়ে যখন রক্তস্রোত বয়ে গেল বাংলার শ্যামল মাটির ওপর তখন বৃদ্ধা করিমননেছার মনে হয়েছিল শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণের কথা যেখানে বলা হয়েছিল, “রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব”।
![১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস 10 Jan 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahmans Homecoming 9 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ 10 ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস [ 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming Day ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2022/01/১০-জানুয়ারি-বঙ্গবন্ধুর-স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন-দিবস-10-Jan-1972-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahmans-Homecoming-9-300x169.jpg)
বৃদ্ধা করিমননেছাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল তিনি কেন এত দূর থেকে এসেছেন? জবাবে বৃদ্ধা কান্নায় ভেঙে পড়ে জানিয়েছিলেন, “আমার ছেলে দুইডার মতন আরও কত ছেলে মইরা গেছে। কত মায়েরা বোকের ছেলেগ দিয়া আছকা বোক খালি কইরা রইছে। আমি আইছি যার লাইগা ছেলেগ পাডাইলাম যুদ্ধ করতে তারে এক নজর দেইকা যাইতে। কোন সময় আইব। তারে দেখলে আমার সব দুক শেষ অইব।”
বৃদ্ধা করিমননেছা যখন একথাগুলো বলছিলেন তখন তার দুই চোখের কোণ দিয়ে পানি ঝরছিল অঝোরে। করিমননেছা দুই পুত্রের শোক ভুলে গিয়েছিলেন রমনার মাঠে জনসমুদ্রে জাতির পিতাকে এক নজর দেখতে পেয়ে।
![১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস 10 Jan 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahmans Homecoming 8 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ 11 ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস [ 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming Day ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2022/01/১০-জানুয়ারি-বঙ্গবন্ধুর-স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন-দিবস-10-Jan-1972-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahmans-Homecoming-8-300x225.jpg)
শেখ মুজিবকে দেখার আকুল আশা নিয়ে দুই ভাই-বোন এসেছিলেন রেসকোর্স ময়দানে। আর তাদের একান্ত আপনজন শেখ মুজিবকে অর্ঘ্য দিতে সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন দু’গাছি ফুলের মালা। মালা দুটি ওদের হৃদয় নিংড়ানাে অফুরান ভালোবাসার নৈবেদ্য। শুধু হাতেম আলী আর জয়গুনা খাতুনই নন ঐদিন বাংলার নয়নমণি বঙ্গন্ধুকে হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা দিয়ে অভ্যর্থনা করতে এসেছিলেন লক্ষ লক্ষ হাতেম আলী আর জয়গুনা খাতুনরা।
হাতেম আলী ঐদিন বলেছিলেন, “শেখ সাহেবকে আমরা ভোট দিয়েছি। ভোটের নম্বর দুটিও নিয়ে এসেছি। গত নয় মাস খান সেনাদের অত্যাচারে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছি। কিন্তু যেখানেই গেছি ভোটের কাগজ দুটো যত্ন করে রেখেছি। তিনি এসেছেন। দেশটাতে শান্তি হবে। আমরা সবাই শান্তিতে থাকতে পারব। ছেলেমেয়ে নিয়ে যাতে দু-মুঠো খেতে পারি এটাই আমরা চাই।”
সকাল থেকে তারা খেয়েছেন কিনা জিজ্ঞাসা করলে জয়গুনা খাতুন বলেছিলেন, “শেখ সাহেবকে দেখতে কি আর খাওয়া লাগে। তাঁর বক্তৃতা শুনলে গায়ে বল পাই। তিনি বেঁচে এসেছেন এটাই আমাদের সান্ত্বনা। তার জন্যে আমরা মানত করেছি। ভিক্ষে করে হলেও শিন্নি দেব।”
![১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস 10 Jan 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahmans Homecoming 6 ১০ জানুয়ারির রেসকোর্স ময়দান : উচ্ছ্বাসে উল্লসি ওঠে আকুল আবেগ 12 ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবস [ 10 Jan, 1972 Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman's Homecoming Day ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2022/01/১০-জানুয়ারি-বঙ্গবন্ধুর-স্বদেশ-প্রত্যাবর্তন-দিবস-10-Jan-1972-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahmans-Homecoming-6-300x187.jpg)
গত ৯ মাস আমরা ঘর থেকে বের হতে পারিনি।” বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য লৌহজং থেকে এসেছিলেন সুরেন্দ্র মালয়। পেশায় জেলে। গত এক বছর যাবৎ রােগে ভুগতে থাকলেও বঙ্গবন্ধুর আসার সংবাদ জানাতে পেরে লৌহজং থেকে অসুস্থ শরীর নিয়েই তিনি ঢাকা চলে আসেন বঙ্গবন্ধুকে দেখার জন্য। (সূত্র: দৈনিক বাংলা ও পূর্বদেশ, ১১ জানুয়ারি ১৯৭২)।
রেসকোর্স ময়দান অসংখ্য ইতিহাসের সাক্ষী। এই সেই রেসকোর্স ময়দান যেখানে ১৯৬৯ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি লাভ করেছিলেন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি এই রেসকোর্স ময়দান, যেখানে ভাষণ প্রদানকারী ব্যক্তিটি এখন একটি জাতি, একটি নতুন ভূখণ্ড ও একটি নতুন পতাকার জন্মদাতা।
