বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জুন মাস
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জুন মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, June]
১৯৭২ সালের ৭ জুন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
আমার ভাই ও বোনেরা,
আজ ৭ই জুন। আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, ১৯৬৬ সালের এই দিনে আওয়ামী লীগ ছয় দফা ঘোষণা করেছিল। এই ঘোষণায় সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানেরর শোষক গোষ্ঠী ক্ষেপে গিয়েছিল। কারণ তারা বুঝতে পেরেছিল যে, আমরাও তাদের বুঝতে পেরেছি। তারা জানতে পেরেছিল, বাঙ্গালীদের আর দাবিয়ে রাখা যাবে না। তাই আইয়ুব খান ও মোনেম খান তাঁদের সৈন্য বাহিনী নিয়ে আমার লোকদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। আমি তখন কারাগারে বন্দী হয়ে যাই।
![Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জুন মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, June] 2 বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জুন মাস [ Bangbandhu Sheikh Mujibur Rahman's Speech 1972 ]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/2010/03/Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahman-300x188.jpg)
আপনাদের নিশ্চয়ই আরও মনে আছে, আমাকে যশোরে গ্রেফতার করা হয়, তারপর যশোহর থেকে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। ঢাকা থেকে আমাকে সিলেট নেওয়া হয় এবং সেখানেও আমাকে গ্রেফতার করা হয়। সিলেট থেকে ময়মনসিংহ নেওয়া হয় এবং ময়মনসিংহেও আমাকে গ্রেফতার করা হয়। এমনি করে গ্রেফতারের পালা চলে।
সংগে সংগে ৭ই মে তারিখে আওয়ামী লীগের তাজউদ্দীন, জহুর আহমেদ চৌধুরী, খোন্দকার মুশতাক আহমদ প্রমুখ নেতাও গ্রেফতার হন। পরে আমার সহকর্মী বন্ধু মিজানুর রহমান চৌধুরী, শামসুল হক, মোল্লা জালাউদ্দীন, মনসুর আলী, মরহুম আব্দুল আজিজ (চট্টগ্রাম) মরহুম আমজাদ হোসেন (যিনি পাবনায় মৃত্যুবরণ করেছেন) এবং হাজার হাজার আওয়ামী লীগ পন্থী ছাত্র ও শ্রমিক কর্মীদের গ্রেফতার করা হয়।
শুধু তাই নয়। ৭ই জুন তারিখে তেজগাঁ, ভিক্টোরিয়া পার্ক, নারায়নগঞ্জ, মুক্তাগাছা এবং আরো অনেক জায়গাতে গুলি করে আমার শত শত ভাই বোনকে হত্যা করা হয়। আইয়ুব খান মনে করেছিলেন, গুলি করে বাঙ্গালীদের দাবিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি তা পারেন নাই। সেই দিনই শুরু হয়েছিল বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম। অনেকে হয়ত বুঝতে পারেন নাই। কিন্তু আমরা জানতাম, এ ব্যাপারে কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে। এই জন্যে ধাপে ধাপে আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া হয়।
এরপরে আমি যখন গ্রেফতার হয়ে চলে যাই, আমার সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী সভাপতি হয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গ্রহণ করেন। তারপর তিনিই আওয়ামী লীগের সভাপতি বা সম্পাদক হয়েছেন, তাঁকেই গ্রেফতার করে জেলে দেওয়া হয়েছে।
তারপরেও ষড়যন্ত্র হয়। আওয়ামী লীগকে বিভক্ত করে তার মধ্য থেকে একদলকে নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান সরিয়ে নিয়ে যান। তাতেও আমাদের দাবাতে না পেরে আমার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করা হয়। আপনাদের সব ইতিহাসই মনে আছে। সেদিনও আপনারা শুনেছেন, অনেক দল আইয়ুব খানের টাকা খেয়ে ছয় দফা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে। আপনাদের একথাও জানা আছে যে, ৭ই জুন তারিখে আমাদের বিরুদ্ধে প্রচারপত্র বিলি করা হয়েছিল।
তারপর আসুন ১৯৬৮-৬৯ সালের ঘটনাগুলির কথায়। সে সময়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তোফায়েল আহমদের নেতৃত্বে আন্দোলন শুরু করে। আওয়ামী লীগও আন্দোলনে যোগদান করে এবং তাতে নেতৃত্ব দেয়। তারপর আইয়ুব খান আগরতলা মামলা থেকে আমাকে মুক্তি দিতে বাধ্য হন। সেদিনও আমার দেশের বহু লোককে জীবন দিতে হয়েছে। রক্ত আমাদের অনেক দিতে হয়েছে। বাংলার মানুষকে স্বাধীনতার জন্য যত রক্ত দিতে হয়েছে, কোন দেশ, কোন জাতি তা দেয় নাই।
আমাদের সংগ্রামের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। লোকে বলে, মানুষের স্মৃতিশক্তি নাকি দূর্বল। সে নাকি অল্প দিনেই সব ভূলে যায়। কিন্তু কেমন করে ভূলবে? ২৩-২৪ বছর আওয়ামী লীগকে নিয়ে আমি সংগ্রাম করেছি। এই সময়ের মধ্যে মাত্র ১২-১৩ মাস সোহরাওয়ার্দী সাহেব ক্ষমতায় ছিলেন। সর্বক্ষণই উজানে আমাদের নৌকা বাইতে হয়েছে এবং বার বার গ্রেফতার হতে হয়েছে; রক্ত দিতে হয়েছে। সে ইতিহাস আজও অম্লান রয়েছে।
নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা
তারপর যখন নির্বাচনে আপনারা আমাকে ভোট দিলেন, তখনও একদল লোক নির্বাচন বানচাল করার চেষ্টা করেছিল। আমি বলেছিলাম, দুনিয়াকে দেখিয়ে দিতে হবে, যে বাংলার মানুষ এক, বাংলার মানুষ স্বাধীনতা দিয়েছে। নির্বাচনের মাধ্যমে এসব প্রমাণও হয়ে গেল কিন্তু ষড়যন্ত্র বন্ধ হলো না। ইয়াহিয়া খান সাহেব এসে গদিতে বসলেন। অর্থাৎ এক খান গেলেন আর এক খান এলেন।
ইয়াহিয়া খান এসে শুরু করলেন নির্বাচনের কথা। মিষ্টি কথা, ফিসফিস করা, ছোট ছোট কথা, বড় বড় কথা। আর সঙ্গে সঙ্গে সৈন্য বাড়াতে লাগলেন বাংলার বুকে, আমার উপর আঘাত হানার জন্য। আমরা প্রস্তুত হলাম। আমরাও এখানে দাঁড়িয়ে শপথ নিলাম ৩রা জানুয়ারী তারিখে, যে আদর্শে বাংলার মানুষ আমাদের ভোট দিয়েছে তাতে আপোষ নাই।
আপনারা জানেন ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি মনে করেছিলেন, আমাকে প্রধানমন্ত্রী বললেই আমি গলে গদ গদ হয়ে যাব আর আমার দাবী ছেড়ে আমি তাঁর সঙ্গে হাত মেলাব। কিন্তু তিনি শেখ মুজিবুর রহমানকে জানতেন না। আওয়ামী লীগকেও জানতে না। তাঁর এটাও জানা ছিল না যে, প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য মুজিবুর রহমান রাজনীতি করি নাই।
আমি রাজনীতি করেছি বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাবার জন্য, বাংলার মানুষকে স্বাধীনতা দেবার জন্য, বাংলার মানুষকে শোষণহীন সমাজ গড়ার জন্য। আমি রাজনীতি করেছি পশ্চিম পাকিস্তানেরহাত থেকে বাংলাকে রক্ষা করার জন্য। আমি রাজনীতি করেছি পশ্চিম পাকিস্তানের হাত থেকে বাংলাকে মুক্ত করার জন্য। বাংলার মানুষ যাতে মানুষের মত দুনিয়ায় দাঁড়াতে পারে তার জন্য এবং বাংলার সম্পদ যাতে পশ্চিমারা লুট করে খেতে না পারে তারই জন্য আমি সংগ্রাম করেছিলাম, প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য সংগ্রাম করি নাই।
ভায়েরা আমার,
এরপর অসযোগ আন্দোলন শুরু হয়। এই আন্দোলন এবং তার পরের ঘটনাবলি সম্পর্কে আমি সংক্ষেপে কিছু বলবার চেষ্টা করবো। সে সবের আলোচনায় আপনাদের বেশি সময় আজ আমি নেবো না। কারণ, আরও নেক কথা আপনাদের বলতে হবে। জেল থেকে বের হয়ে এখনে এসে আমি সামান্য কয়েকটি কথা বলেছিলাম। সেদিন আমি বেশি কিছু বলতে পারি নাই। কারণ, মাঝে মাঝে আমার চোখে পানি এসে গেছে। তারপরে ভারতের মহিয়ষী নারী মিসেস গান্ধী যখন এখানে আসেন, তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে আপনাদের সামনে এসেছিলাম এবং কয়েক মিনিট বক্তৃতা করেছিলাম। তিনি অতিথি। তাঁর সামনে অন্য কথা বেশি বলা যায় না।
মুক্তি সংগ্রামের সূচনা
আজ দেশের অবস্থা সম্বন্ধে আপনাদের জানা দরকার। ত্রিশ লক্ষ লোক রক্ত দিয়েছে। ২৫শে মার্চ রাত্রে ইয়াহিয়া বর্বর বাহিনী আমার উপর আক্রমণ চালায়। সেদিন রাত্রে আমার অবস্থা যে কেমন ছিল সেটা কেবল আমিই জানি। আমি জানতাম ঘর থেকে বের হলেই আমাকে গুলি করে মারবে। মৃত্যুর জন্য আমি প্রস্তুত হয়েই ছিলাম। কিন্তু বাংলার মাটিকে আমি ছাড়তে পারি নাই। রাত্রি ১১টার সময় আমার সমস্ত সহকর্মীকে, আওয়ামী লীগের নেতাদের হুকুম দিলাম, বের হয়ে যাও। যেখানে পার, এদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর। খবরদার, স্বাধীনতা না আসা পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেয়ো।
রাত্রে আমি চট্টগ্রামে নির্দেশ পাঠালাম। আগে যাকে ই,পি,আর বলা হতো,তাদের সদর দফতর ছিল চট্টগ্রামে। পিলখানা হেডকোয়ার্টার তখন শত্রুরা দখল করে নিয়েছে। ওদের সাথে আমার যোগাযোগ ছিল। আমি যখন পিলখানার সাথে যোগাযোগ করতে পারলাম না তখন আমি চট্টগ্রামের সাথে যোগাযোগ করে বললাম, আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। তোমরা বাংলার সব জায়গায় ওয়ারলেসে এ খবর দিয়ে দাও। পুলিশ হোক, সেনাবাহিনী হোক, আওয়ামী লীগ হোক, ছাত্র হোক, যে যেখানে আছে, পশ্চিমাদের বাংলা থেকে খতম না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাও। বাংলাদেশ স্বাধীন। তারা আমার কথা মত খবর পৌঁছিয়েছিল।
সে রাত্রে কেবল আমার বাড়িতে নয়, রাজার বাগ, পিলখানা, আওয়ামী লীগের অফিস আর ছাত্রাবাসেও আক্রমণ চলে। বেছে বেছে আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ী জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। রাজারবাগের পুলিশরা ৬ ঘন্টা ৩০৩ রাইফেল দিয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। ঢাকায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের তিন চারটে ব্যাটেলিয়ন ছিল। হঠাৎ আক্রমণ করে তাদের অর্ধেককে মেরে ফেলা হয়।
এমনি করে সমস্ত বাংলাদেশের ছাত্র-যুবক কৃষকদের মেরে ফেলা হয়। আমার সহকর্মীরা পালিয়ে মুজিবনগরে আশ্রয় নেন। সেখানে তাঁরা স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে দিয়ে স্বাধীন সরকার কায়েম করেন। নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হন আর তাজউদ্দীন হন প্রধানমন্ত্রী। মনসুর আলী, কামরুজ্জামান এবং খোন্দকার মুশতাক আহমদকে নিয়ে সরকার গঠিত হয়।
দালালদের সমালোচনা
এখন যাঁরা সমালোচনা করে বক্তৃতা দিচ্ছেন, তখন তাঁদের কাউকে এসব কাজে দেখা যায় নাই। তাঁদের কেউ যুদ্ধে এগিয়ে আসেন নাই। তাঁরা কেবল প্রাণ বাঁচানোর জন্য পালিয়ে বেড়াতেন। অথচ আওয়ামী লীগের নেতারা তখন মুজিবনগরে বসে আবা সকলকে একতাবদ্ধ করে তাঁরা যুদ্ধ শুরু করেন। সারা দুনিয়ায় লোক পাঠিয়ে বাংলাদেশের কথা সবাইকে জানিয়ে দেন।
সে সময়ে বাংলাদেশ থেকে এক কোটি লোক পালিয়ে গিয়ে পশ্চিম বাংলা, মেঘালয়, আসাম আর ত্রিপুরায় আশ্রয় নেয়। তারা স্ত্রী-পুরুষ কন্যার হাত ধরে দেশ ছেড়ে চলে যায়। তখন ঢাকায় রাস্তায় রাস্তায় হাজার হাজার লাশ। সারা বাংলায় রাস্তায় রাস্তায় হাজার লাশ। নদীতে লাশ, ঘরে ঘরে লাশ। মানুষের মা-বোনের আর্তনাদ। চারদিকে হাহাকার, সর্বহারার আর্তনাদ। তবু সেদিন সমালোচকদের কাউকে এগিয়ে আসতে দেখা যায় নাই। তারা বরং ইয়াহিয়া খানের দালালী করেছে।
তারপরের যুদ্ধের ইতিহাস আপনারা জানেন। পাক বাহিনী ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিল। এক কোটি লোক দেশ ত্যাগ করলো। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হল। শ্রমিক আর ছাত্রদের গুলি করে মারা হল। আজ অনেকেই সমালোচনা করে বক্তৃতা করেন আর এমসিএদের এবং আওয়ামী লীগকে গালি দেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের ত্যাগের কথা কারও মুখেই শোনা যায় না। আওয়ামী লীগের এমসিএ আমার সহকর্মী মশিহুর রহমনাকে দুই মাস পর্যন্ত মারতে মারতে হত্যা করা হয়েছে।
আমার আর একজন এম.সিএ আমীন উদ্দীনকে আধামরা করে জীপের পিছনে বেঁধে দিল, গুরিয়ে গুরিয়ে মেরে ফেলা হয়। আমার এক চাচাকে ছয় টুকরো করে রাস্তার মাথায় ঝুলিয়ে রাখা হয়। সৈয়দপুরের এম,সি,এ নজমুল হুদা সরকারকে গুলি করে হত্যা করে দুই ভাগ করে রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছিল। এখন যাঁরা বড় বড় কথা বলেন, তখন তাঁরা কোথায় ছিলেন? সবাই স্বাধীনতা পেয়ে গেছেন। কিন্তু এ কি চোরাকারবারীর স্বাধীনতা, মুনাফাখোরের আর মজুতদারের স্বাধীনতা? রাজাকারের আর আলদবরের স্বাধীনতা? আমি কিছু বলি না। এজন্য তারা ভেবেছে আমি নরম মানুষ। আমি নরম মানুষ নই। আমি তাদের খেলতে দিয়েছিলাম।
আমাকে আপনারা জাতির পিতা আখ্যা দিয়েছেন। আমি প্রধানমন্ত্রী হবার জন্য আসি নাই। আমি সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ভালবাসি। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী আমাকে ভালবাসে। জীবনে কখনও আমি তাদের সাথে বেঈমানী করি নাই। চার বার আমাকে ফাঁসী দেবার চেষ্টা করা হয়েছে। তবু আমি মাথা নত করি নাই। তা সত্ত্বেও কেন এত কথা বলা হয়?
যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি
জেল থেকে বের হয়ে আসার পর আমি বলেছিলাম, আমার কর্তব্য বোধহয় শেষ হয়ে গেছে। আমার দেশ স্বাধীন হয়েছে। আমার পতাকা আজ দুনিয়ার আকাশে উড়ে। আমার দেশ বাংলাদেশ আজ দুনিয়ার মানচিত্রে স্থান পেয়েছে। আজ আমি বলতে পারি, আমি বাঙ্গালী। আজ আমি বলতে পারি, বাঙ্গালী একটি জাতি। আমি আজ বলতে পারি, বাংলার মাটি আমার মাটি। এর বেশি তো আমি চাই নাই। আপনারা আমাকে সব দিয়েছেন। আপনারাতো আমাকে জাতির পিতা বানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীত্ত্বতো আমার জন্য বড় জিনিস নয়। যা কোনদিন কোন মানুষ পায় নি, তা আমি পেয়েছি। আপনারা যা দিয়েছেন, সে হল আপনাদের ভালবাসা। আমাকে আপনারা দোয়া করবেন। আমি যেন আপনাদের ভালবাসা দিয়ে মরতে পারি। এর বেশি কিছুই আমি চাই না।
জেল থেকে বের হয়ে এসে আমি দেখেছিলাম রেলওয়ে ভেঙ্গে গেছে, চালের গুদাম নাই, দোকানে মাল নাই। ব্যাংকের টাকা জ্বালিয়ে দিয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রা লুট করে নিয়েছে। আমি আরও দেখেছিলাম মানুষের কাছের বন্ধুকে। আমার দেশের লোক আমাকে ভালবাসে। তাই আমার সহকর্মীরা বললেন, তোমাকেই তো, সবকিছুর ভার নিতে হবে। তার ফলে আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব নিতে বাধ্য হলাম। বিশেষ করে এই জন্য যে, আমার বাংলার স্বীকৃতি দরকার। আমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে আবেদন জানালাম, তোমাদের অস্ত্র ফেরত দাও। সেই আবেদনে সাড়া দিয়ে আমার বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা দুই লক্ষ অস্ত্র আমার হাতে দিয়েছে। অস্ত্র সমর্পণের এমন নজির দুনিয়ার ইতিহাসে আর দেখা যায় না।
আমাদের গুদামে চাল নাই। পকেটে পয়সা নাই। পোর্ট ভেঙ্গে দিয়েছে। বাস-ট্রাক পুড়িয়ে দিয়েছে। রেলগাড়ি চলে না। রাস্তায় গাড়ী চলতে পারে না। চট্টগ্রাম ও চালনা পোর্টের মুখে সমস্ত জাহাজ ডুবিয়ে রেখে দিয়েছে। এ অবস্থায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে বাঁচাবো কি করে? দস্যুর দল মানুস হত্যা করে খুশি হয় নাই। আমার সম্পদ ধ্বংস করে লুট করে নিয়ে গেছে। অথচ আজ একদল লোক এসবের জন্য ভারতকে দোষ দিয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু এক কোটি লোককে মিসেস গান্ধী খাবার দিয়েছিলেন, কাপড় দিয়েছিলেন, আশ্রয় দিয়েছিলেন। এসব কি তারা দেখে আসে নাই?
খাদ্য ও ত্রাণ
আমার দেশ স্বাধীন দেশ। ভারত হোক, আমেরিকা হোক, রাশিয়া হোক, গ্রেট বৃটেন হোক, কারো এমন শক্তি নাই যে, আমি যতক্ষণ বেঁচে আছি, ততক্ষণ আমার দেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে পারে। কিন্তু বন্ধু রাষ্ট্রকে বন্ধু বলতে লজ্জা করা উচিত নয়। যেদিন আমার সরকার ক্ষমতায় আসে, সেদিন এক ছটাক চাল ছিল না। আমি তাই ভারতের কাছে চাল চাই। ভারত তখন আমাদের সাড়ে সাত লক্ষ টন চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়।
এরই মধ্যে তাদের কাছ থেকে আমি এক কোটি বাষট্টি লক্ষ মন চাল পেয়েছি। এই চাল গরীবদের মধ্যে বিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। আনলোডও চাল দিয়েছে। রাশিয়াও আমাকে সাহায্য করেছে। রাশিয়া আমার বন্দর সাফ করে না দিলে আমি খাবার আনতে পারতাম না। আমার বন্ধু রাষ্ট্র রাশিয়া স্বাধীনতা সংগ্রামেও আমাদের সাহায্য করেছে। কিন্তু এ বন্ধুত্ব নষ্ট করার ক্ষমতা কারও নাই।
বাংলার মানুষকে আমি জানি। আমাকেও বাংলার মানুষ চেনে। বাংলার মানুষকে আমি ভালবাসি। বাংলার মানুষ আমাকে ভালবাসে। আমি তাদের জন্য কোন কাজে হাত দিয়ে কখনও হাল ছাড়ি না। আপনাদের কাছে আমি প্রথম দিন বলেছি, তিন বছর আপনাদের কিছুই দিতে পারবো না। পরে সারা বাংলাদেশেই আমি এই কথা বলেছি। কিন্তু পারবো না বললেও আমি দিয়েছি। রিলিফের জন্য, ঘর-বাড়ি তৈরির করার জন্য এই ছয় মাসে উনত্রিশ কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। টেস্ট রিলিফের জন্য গ্রাম অঞ্চলে দেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। স্কুল-কলেজের জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকা। রিলিফ ক্যাম্পের জন্য দেওয়া হয়েছে ১০ কোটি টাকা।
মোট ৭৫ কোটি টাকা এই ছয় মাসে দেওয়া হয়েছে। রিলিফ, কৃষি ঋণ এবং সমবায় ঋণ দেওয়া হয়েছে ২৬ কোটি টাকা। এছাড়া যত বকেয়া খাজনা ছিল সব মাফ করে দিয়েছি। একদিন এই ময়দানে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মাফ করে দেব। তা আমি দিয়েছি। আমাদের বন্দর ঠিক হয়ে গেছে। এখন বিদেশ থেকে মাল আসতে পারবে, আমার তেল ছিল না, ভারতে তেল দিয়েছে। আমাকে সব জিনিসই অন্যের কাছ থেকে আনতে হচ্ছে। বাংলাদেশ তো কলোনী ছিল, পশ্চিম পাকিস্তানের বাজার ছিল। পশ্চিমমারা সেখানে মাল তৈরী করতো আর বাংলাদেশ সেই মাল বেঁচে পকেটে টাকা নিয়ে উড়ে চলে যেত। আজ জিনিসপত্রের ঘাটতি পড়েছে। সব জিনিসই আমাকে বাইরে থেকে আনতে হবে।
শিল্প জাতীয়করণ ও শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধি
আমার শ্রমিক ভায়েরা, কৃষক ভাইদের জন্য আমি টেস্ট রিলিফ দিচ্ছি, বিনাশর্তে ঋণ দিচ্ছি, খাজনা মাফ করেছি। এই সঙ্গে আমি ব্যাংক জাতীয়করণ করেছি। বড় বড় শিল্প কারখানা আর ইন্সিওরেন্স কোম্পানি জাতীয়করণ করেছি। এসব জাতীয়করণের অর্থ আমাদের বুঝে দেখতে হবে। এগুলি সাড়ে সাত কোটি লোকের সম্পদ। শ্রমিকেরা সারা জীবন শিল্প-কারখানা, ব্যাংক, ইনসিওরেন্স কোম্পানি ইত্যাদি জাতীয়করণের দাবী জানিয়েছেন। এগুলি জাতীয়করণের অর্থ হল শোষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দেওয়া।
আমরা শোষণের চাবিকাঠি ধ্বংস করে দিয়েছি। আপনারা জানেন, পশ্চিমাদের হাতে যে সমস্ত কল-কারখানা ছিল তার সব টাকা তারা উঠিয়ে নিয়ে গেছে। আপনারা শুনে আশ্চর্য হয়ে যাবেন যে, কারখানা চালাতে ও গর্ভনমেন্টের একশ আটান্ন কোটি টাকা দিতে হয়েছে।
যদি কারখানা চালিয়ে উৎপাদন না করতে পারেন, আমি বেতন বাড়াবো কোথা থেকে? আপনারা আমার কাছে চান নাই, আমার কাছে দাবী করার দরকারও নাই। আমি আপনাদের জন্য জীবন ভর দাবী করেছি। আমার কাছে আপনারা কি দাবী করবেন? আপনারা না বললেও আমি ২৫ টাকা বেতন বাড়িয়ে দিয়েছি। তাতেও ৩৫ কোটি টাকা বেতন বাড়াতে হয়েছে। আপনারা যদি উৎপাদন না করেন, আমি টাকা দেব কোথা থেকে? আমি কি তবে বাংলাদেশটা বিক্রি করে দেব?
না বাংলাদেশকে বিক্রি করতে পারবো না। আমাকে সমালোচনা করে বলা হয়েছে, আমি ধর্মঘট কেন বন্ধ করলাম? কিন্তু আমি তো ধর্মঘট বন্ধ করতে চাই নাই। তবে, আমি যদি শ্রমিকদের বেতন দেয়ার জন্য টংগিতে টাকা পাঠাই বা রিলিফের টাকা দিই আর সেখানে সেই টাকা কেড়ে নেওয়া হয় এবং তারপর আবার যদি কেউ বেতন নিতে আসে তাহলে সেটা কি ভালো হয়? শ্রমিকদের কর্তব্য হলো উৎপাদন করা।
ব্যবস্থাপনা ও উৎপাদন
আমি এখানে আজ আর একটা কথা ঘোষনা করেছি। সরকার যেসব কারখানা জাতীয়তকরণ করেছেন, এখন থেকে সেগুলির প্রত্যেকটির ম্যানেজমেন্ট বোর্ডে দুইজন করে সদস্য থাকবে এবং শ্রমিকরা নির্বাচনের মাধ্যমে এই সদস্যদের বোর্ডে পাঠাবেন। এ ছাড়া বোর্ডে সরকারের এবং ব্যাংকের পক্ষ থেকে তিনজন সদস্য থাকবেন এবং এই পাঁচজন বসে কারখানা চালাবেন। যাই আয় হোক না কেন, আমদজী, দাউদ বা আমিনের পকেটে যাবে না। কোথায় যাবে, তা আপনারা জানতে পারবেন। আপনারা হলেন শতকরা একজন বা দেড়জন আর বাংলার কৃষক হলো শতকরা ৮৫ জন। আয়ের একটা অংশ আপনারা নেবেন। আর বাকী অংশ দেশের কৃষকদের।
তাদের টাকা দিয়ে শিল্প-কারখানা চালানো হয়। তাদেরও ভোগ করার অধিকার রয়েছে। শ্রমিক ভায়েরা, দুধ খান, গরু জবাই করে খেয়ে ফেলবেন না। তাতে দেশ চলবে না। আর লাল বাহিনীর ভায়েরা, আপনারা হবেন আদর্শ কর্মী। আপনাদের আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করতে হবে। আর আপনাদের দেখাতে হবে যে, ৮ ঘন্টার জায়গায় লাল বাহিনীর ছেলেরা ১০ ঘন্টা পরিশ্রম করে এবং এই কাজ দেখিয়ে অন্য শ্রমিকদের উৎসাহ দিতে হবে। আপনারা ১০ ঘন্টা না পারেন ৯ ঘন্টা কাজ করেন বা ৮ ঘন্টা করুন। উৎপাদন বাড়ান্ তাহলেই লাল বাহিনী আপনাদের ইজ্জত থাকবে। লাল টুপি মাথায় দিয়ে বেড়ালে লাল বাহিনীর ইজ্জত পাওয়া যাবে না।
সমাজবিরোধী কার্যকলাপ
ভায়েরা আমার, আজ আপনাদের বেতন বাড়ালেই সুবিধা হবে না। সেই জন্য বাংলাদেশে ৪২০০ দোকান খোলা হচ্ছে। প্রত্যেক ইউনিয়নে একটা করে ন্যায্য মূল্য জিনিসপত্র দেওয়ার জন্য শ্রমিক এলাকায়ও এ ধরনের দোকান খোলা হবে। তাতে খরচ হবে ১৯ কোটি টাকা। তবে মজুতদার, চোরাকারবারী আর চোরাচালানীরা হুঁশিয়ার হয়ে যাও। তাদের আমি সোজা কথায় বলে দিচ্ছি, পাঁচ মাস আমি তাদের অনুরোধ করেছি, আবেদন করছি, বুঝিয়েছি, অনেক করে বলেছি, একাজ করো না।
আমার বিশ্বাস ছিলো যে, তারা আমার কথা শুনবে। কিন্তু দেখছি চোরা নাহি শুনে ধর্মের কাহিনী। তাই তাদের হুশিয়ার করে দিয়ে বলতে চাই, যারা শহরে সরকারি বাড়ি, গাড়ী দখলকরে আছ যারা দোকান বা অন্যের জমি দখল করে আছ, যারা মজুদ করছো, জিনিসপত্র বিক্রয় করছো না, জিনিষের দাম বাড়াবার চেষ্টা করছো, তাদের রেহাই নাই।
আমি ভিক্ষা করে দুনিয়ার নানা দেশ থেকে জিনিসপত্র আনছি আমার গরীব দুঃখীদের জন্য। সেই জিনিস যারা লুট করে খাচ্ছো, তাদেরও রক্ষা নাই। আমি ১৫ দিন সময় দিলাম। ১৫ দিনের মধ্যে যদি সরকারী বাড়ি না ছাড়ো, যদি মজুদ করে রাখো এক একটা এলাকায় আমি কারফিউ দেব আর সমস্ত পুলিশ, ম্যাজিস্ট্রেট আর আমার স্বেচ্ছাসেবকরা সেখানে তল্লাশী চালাবেন।
এতদিন আমি কিছু বলি নাই। এখন বলে দিলাম, হুকুম দিয়ে দিলাম। এর পরেও বড় বড় বক্তৃতা করবে আর রাত্রি বেলায় চোরা গাড়ীতে চড়বে, এটা হবে না। আমার লাশ থাকতে নয়। বার বার ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও। আর ঘুঘু খাওয়ার চেষ্টা করো না। আমি পেটের মধ্যে হতে ধান বের করব। চিন্তার কারণ নাই।
এম সি এ দের সমালোচনা
ভায়েরা আমার, আর একটা কথা আমি আপনাদের কাছে বলতে চাই। আওয়ামী লীগ ২৩ বছর এই বাংলাদেশে রাজনীতি করছে। এখন কিছু লোক আওয়ামী লীগের এমসিএ দের নিন্দা করে। কিন্তু ২৩ জন এমসিএ কে বহিস্কার করেছে কোন পার্টি? এমন বহিস্কারের নজির পৃথিবীর আর কোন দেশের ইতিহাসে আছে? যদি কোন এম.সি.এ বা পার্টি সে যে পার্টিরই হোক না কেন, কিংবা কোন শ্রমিক নেতা বা ছাত্র নেতা চুরি করে, তাহলে আমি মাফ করবো না।
এখন এম.সি.এ দের সমালোচনা করার অর্থ কি? যাঁরা সমালোচনা করেন, তাঁরা ভাবেন, আমি নির্বাচনের ব্যবস্থা করবো। তাঁরা যদি এম.সি.এর দোষী সাব্যস্ত করতে পারেন, তাহলে নিজেরা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে জয়লাভ করবেন। কিন্তু সব এম.সি.এ ই কি চোর? কোন এম.সিএ কি যুদ্ধ করেন নাই? তারা কি গুলি খেয়ে মরে নাই? এম.সি.এ দের মধ্যে ভাল মানুষ আছে, খারাপ মানুষও আছে সব দলেই ভালমন্দ মানুষ আছে। যারা খারাপ, তারা সব সময়ই খারাপ।
আমার দলের মধ্যে কেউ যদি চুরি করে, বিশ্বাস লাগতে পারেন, তাকে কেমন করে শায়েস্তা করতে হয়, আমি জানি। তার পরিষদ সদস্যপদ আমি কেড়ে নেব। কিন্তু এম,সি,এ দের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করা খারাপ। তাঁরা গণপরিষদের সদস্য। তাঁরা নির্র্বাচনের মাধ্যমে এসেছেন, তাঁরা শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন। আমি বাংলাদেশে শাসনতন্ত্র দিতে চাই, ইয়াহিয়া খান বা আইয়ুব খানের মতো গভর্নমেন্ট চালাতে চাই না। জনগণকে আমি ভয় করি না। জনগণকে আমি ভালবাসি। সে জন্য শাসনতন্ত্র যত শীঘ্র হয় আমি দেব।
জাতীয় আদর্শ
এখন আমাদের একটা শ্লোগান। আগে ছিল ৬ দফা, এখন বলি ৪ টা স্তম্ভ। আমার বাংলার সভ্যতা, আমার বাঙ্গালী, জাতি এ নিয়ে হল বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ। বাংলার বুকে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ থাকবে। এ হলো আমার এক নম্বর স্তম্ভ।
দ্বিতীয় স্তম্ভ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। এ সমাজতন্ত্র আমি দুনিয়া থেকে ভাড়া করে আনতে চাই না। এ সমাজতন্ত্র হবে বাংলার মাটির সমাজতন্ত্র। এ সমাজন্ত্র বাংলার মানুষের সমাজতন্ত্র, তাঁর অর্থ হলো শোষণহীন সমাজ, সম্পদের সুষম বন্টন। বাংলাদেশে ধনীদের আমি আর ধনসম্পদ বাড়াতে দেব না। বাংলার কৃষক, মজুর, বাংলার বুদ্ধিজীবি, শ্রমিক এদেশে সমাজতন্ত্রের সুবিধা ভোগ করবে।
কিন্তু সমাজতন্ত্রে যেখানে আছে সে দেশে গণতন্ত্র নাই। দুনিয়ায় আমি বাংলার মাটি থেকে দেখাতে চাই যে, গণতন্ত্রের মাধ্যমে আমি সমাজতন্ত্রকে কায়েম করবো। আমি ব্যক্তি স্বাধীনতায় বিশ্বাস করি। আমি জনগণকে ভালবাসি, আমি জনগণকে ভয় পাই না। দরকার হলে আবার ভোটে যাব। গণতন্ত্র বাংলায় অবশ্যই থাকবে।
চতুর্থত ঃ বাংলাদেশ হবে ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্ম নিরপেক্ষ মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমান মুসলমানের ধর্ম পালন করবে। হিন্দু তার ধর্ম পালন করবে। খ্রিষ্টান তার ধর্ম পালন করবে। বৌদ্ধও তার নিজের ধর্ম পালন করবে। এ মাটিতে ধর্মহীনতা নাই, ধর্মনিরপেক্ষতা আছে। এর একটা মানে আছে। এখানে ধর্মের নামে ব্যবসা চলবে না। ধর্মের নামে মানুষকে লুট করে খাওয়া চলবে না। ধর্মের নামে রাজনীতি করে রাজাকার আল বদর পয়দা করা বাংলার বুকে আর চলবে না। সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করতে দেওয়া হবে না। এই হল চার দফা, চার স্তম্ভ।
পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালী
আর একটা কথা বলি। ভুট্টো সাহেব নারাজ হয়ে গেছেন। তিনি আবোল তাবোল বকছেন এবং আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আকুলি বিকুলি করছেন। আমি বলেছি, বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিন। তারপর এসব বিবেচনা করে দেখবো। তিনি এর মধ্যে আমার বিরুদ্ধে বক্তৃতা করছেন। তিনি একটু ভয় পেয়ে গেছেন নাকি?
যারা আমার মা বোনের ওপর অত্যাচার করেছে, যারা পশুর মত আমার জনসাধারণকে হত্যা করেছে, যারা নিরপরাধ কৃষক শ্রমিক ছাত্রকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার করলে নাকি তিনি বড় অসন্তষ্ট হবেন। কিন্তু ভুট্টো সাহেব, শুনে রাখুন। তাদের বিচার বাংলার বুকে অবশ্যই হবে।
ভুট্টো সাহেব আমার চার লক্ষ বাঙ্গালীকে আটক রেখেছেন। তারা নিরপরাধ, কিছুই করে নাই। তবু তিনি দরকষাকী করছেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, আমি আমার বাঙ্গালীদের ইন্শাল্লাহ বাংলার বুকে ফেরত আনবো। তিনি ঠিকাতে পারবেন না।
তবে, একটা অনুরোধ করবো আপনাদের কাছে। যে সমস্ত বাঙ্গালী এখানে আছে, যারা আলবদর, রাজাকার নয়, যারা বাংলার মাটিতে বাঙ্গালী হিসেবে বাস করতে চায়, আমি আগেও বলেছি, এখনও বলি, তাদের বাংলায় থাকবার অধিকার রয়েছে। যারা যেতে চায়, ভূট্টো সাহেব যেন মেহেরবানী করে তাদের নিয়ে যান। আমার আপত্তি নাই। তিনি বলেছেন, তিনি তাদের নেবেন না। কেন নেবেন না? তাদের হাতে তো বন্দুক তাঁরাই দিয়েছিলেন। তাঁদেরতো ব্যবহার করেছিলেন। তাদের দিয়ে বাঙ্গালীদের হত্যা করিয়েছিলেন। এখন কেন নেবেন না?
যারা যেতে চায়, তাদের নিয়ে যান। আমি ছেড়ে দেব। আমার চার লক্ষ লোক ফেরত দিন। ভুট্টো সাহেব যেন একথা মনে না করেন যে, বাংলাদেশে শুধু বিহারী আছে। পশ্চিম পাকিস্তানেরও অনেকে আমার কাছে। ভূট্টো সাহেব আমার লোক ফেরত দিন, আমিও তাদের লোক ফেরত দিচ্ছি। যুদ্ধবন্দীর সঙ্গে জনসাধারণ কোন দিন এক হতে পারে না। এমন নজীর দুনিয়ায় নাই, কোনদিন হয় নাই।
একদল লোক দুনিয়ায় চিৎকার করে বেড়াচ্ছেন যে, বিহারীরা বড় কষ্টে আছে। যখন আমার বোন না খেয়ে মরছিল তখন গুলি করে মারছিল, যখন এদেশের মানুষকে ধরে ধরে কুর্মিটোলায় গুলি করেছিল, যখন জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তখন কেন মেহেরবানী করে তাঁর প্রতিবাদ করেন নাই? এখন কেন তাঁরা কেঁদেকেটে একেবারে অস্থির হয়ে পড়েছেন।
ত্রাণ বিদেশী সাহায্য
আমার বাংলার এক কোটি লোক পশ্চিম বাংলা এবং ভারতের অন্যান্য জায়গা থেকে ছ’মাসে ফিরে এসেছে। তাদের ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের খাবার দিতে হয়। আমার বাংলাদেশের দেড় কোটি লোক এ গ্রাম থেকে ও গ্রামে, ওগ্রাম থেকে এ গ্রামে পালিয়ে বেড়াত। তাদের জন্য কেউ মায়াকান্না কাঁদে নাই। গ্রামে যান। দেখে আসুন, আমার মানুষ না খেয়ে আছে। আমার মানুষের কাপড় নাই। আমার কৃষকের বীজ নাই। আমার মানুষের চাল নাই।
আমি ত পরিস্কার বলেছি, দুনিয়ার সমস্ত দেশ থেকে আমি সাহায্য নিতে রাজী আছি। কিন্তু সে সাহায্য হবে শর্তহীন। শর্ত দিয়ে কারো কাছ থেকে আমি ভিক্ষা আনতে পারবো না। শর্ত ছাড়া যদি কেউ আমাকে সাহায্য করতে চায়, দুনিয়ার যে কোন দেশ থেকে সাহায্য নিতে আমি রাজি আছি। তবে এমন কিছু আনতে চাই না, যা ভবিষ্যতে আমার অসুবিধা হতে পারে। সে জন্য আমি একটু আস্তে আস্তে চলি।
শিল্পের উৎপাদন
শ্রমিক ভায়েরা, আল্লাহর ওয়াস্তে একটা উৎপাদন করো। আল্লাহর ওয়াস্তে মিল খেয়ে ফেলো না। পয়সা থাকবে না। ব্যাংক থেকে ১৫৭ কোটি টাকা তোমাদের আমি দিয়েছি শিল্প প্রতিষ্ঠান চালাবার জন্য। অনেক মিল বন্ধ তবু মাইনে দিয়ে চলছি। অনেক মিলে অর্ধেক কাজ হয়। সেখানেও আমি মাইনে দিয়ে চলছি। আমি তাদের ভালবাসী, এই জন্যই তো আমি বিনা কথায় ২৫ টাকা মাইনে বাড়িয়ে দিয়েছি। তাদের ২/৩ বৎসর কষ্ট করতে হবে। উৎপাদন করতে হবে। ইন্শাল্লাহ, একবার যদি উৎপাদন বেড়ে যায় তাহলে আর কোন কষ্ট হবে না।
শ্রমিকরা সমস্ত মানুষের সংগে সমানভাবে দেশের সম্পদ ভাগ করে খেতে পারবে। কিন্তু চার সের দুধ হলে তার এক সের খাবে। বাকী তিন সের গ্রামের সমস্ত লোককে দেবে। চার সেরই যেন নিজেরা না খায়। তাহলে গ্রামের লোক বাঁচবে না। গ্রামে থাকে কারা? আপনারা আমার বাবা-মা। যারা গ্রামে বাস করে, তারাই কৃষক। তাদের প্রতি আমার কর্তব্য রয়েছে। তাদের আমি ২৫ বিঘা জমি পর্যন্ত খাজনা মাফ করেছি। তাদের আমি ঋণ দিচ্ছি। দরকার হলে আরো দেব। আমি চাই, তারা খাদ্য উৎপাদন করুক। আমি বেশি দিন ভিক্ষা করতে পারবো না। আমার ৩০ লক্ষ টন খাদ্যের দরকার। ১৭ লক্ষ টন আমি পেয়েছি। আরও ১০ লক্ষ টন ইন্শাল্লাহ আমি পাবো। খাদ্য সামগ্রীর অভাব হবে না।
জিনিসপত্রের দাম বেড়ে গিয়েছিল। আবার একটু কমের দিকে আসছে। আমাদের অনেক খবরের কাগজ যেগুলি দাম বাড়তে দেখলে লাফ দিয়ে কেবল বাড়ায়। যখন কমে তখন আর মেহেরবানী করে কিছু লেখে না। তারা যেন দাম কমলে একটু লেখে। আমার তো ছোট চাদরের অবস্থা। মাথায় দিলে পা খালি, পায়ে দিলে বুক খালি। চল আনতে ডাল আসে না, ডাল আনলে নুন আসে না। নুন আনলে তেল আসে না, তেল থাকলে লবণ থাকে না। আনতে হয় চট্টগ্রাম পোর্ট থেকে, চালনা পোর্ট থেকে।
ভায়েরা আমার, আমি জানতে চাই, আপনাদের আমার উপর আস্থা আছে কি নাই? আওয়ামী লীগের উপর আস্থা আছে কি নাই? বাংলাদেশকে গড়বেন কি গড়বেন না? তিন বছর কিছু দিতে পারবো না। দাবী দাওয়া আমার কাছে চলবে না। একদল লোক বলছে, মুজিবুর রহমান লন্ডন যাবে। কিন্তু মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ ছেড়ে কোথাও যাবে না। মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে সুখী করতে চায়। বাংলাকে সোনার বাংলা করেত চায়। লোকে বলে, মুজিবুর রহমান লন্ডন যাবে। মুজিবুর রহমান সব ছেড়ে দিচ্ছে। কিন্তু আমি কেন সব ছাড়বো?
আজ মুনাফাখোর, আড়ৎদার, চোরাকারবারী সাবধান হয়ে যাও। ভবিষ্যতে যদি জিনিসের দাম আর বাড়ে, আমি তোমাদের শেষ করে দেব কারফিউ করে। আর দরকার যদি হয়, আইন পাশ করবো। যদি চোরা কারবারী বা আড়ৎদার আমার কথা না শোনে, তাদের ছাড়বো না। আর যারা অস্ত্র নিয়ে চলে, তারা সোজা পথে না এলে আমি বাধ্য হয়ে আইন পাশ করবো তাদের গুলি করে হত্যা করার জন্য। আর সরকারী কর্মচারী ভাইয়েরা, আপনারা ঘুষ খাবেন না। আমার লোক আছে। আমি সব খবরই পাচ্ছি। ঘুষখোররা নয় নম্বর ধারায় চাকরি যাবে, জেলখানায় যাবে। আর চোর, গুন্ডা, বদমাইশ, ডাকাত, সাবধান হয়ে যাও।
কর্মী ভাইয়েরা, গ্রামে গ্রামে তোমরা পাহারা দাও, যাতে চোর, গুন্ডা, বদমাইশ মানুষের শান্তি শৃঙ্খলা নষ্ট করতে না পারে।
আর যারা শুধু সমালোচনা করে বক্তৃতা করে, তাদের কাছে অনুরোধ করি, গ্রামে গিয়ে একটু কাজ করুন, একটু রিলিফের কাজ করুন। তাতে ফল হবে।
আমি এবার তাহেল চলি। খোদা হাফেজ।
![বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জুন মাস Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech 1972 June বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জুন মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, June] 3 বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জুন মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech 1972, June]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/1972/06/বঙ্গবন্ধুর-ভাষণ-১৯৭২-সালের-জুন-মাস-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahman-Speech-1972-June-1024x536.jpg)
১৯৭২ সালের ২৮ জুন সিলেটের বন্যাদূর্গত এলাকায় বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
ভাইয়েরা ও বোনেরা, জেল থেকে বের হয়ে আসার পরে আপনাদের কাছে আমি আসতে পারি নাই। কেন আসতে পারি নাই, তা আপনারা জানেন। এক মূহুর্তও সময় পাই নাই। দেশের অবস্থা আপনারা ভাল করে জানেন। পাকিস্তানের বর্বর সামরিক বাহিনী আমার বাংলাদেশকে খতম করে দিয়ে গেছে। ত্রিশ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে, লক্ষ লক্ষ ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। লক্ষ বললে ভুল হবে, কোটি কোটি ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে গেছে। এক কোটি লোক দেশের মায়া ত্যাগ করে জীবনের মায়ায় ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল। আর যারা ছিলেন, তারা অনেক কষ্টে দিন যাপন করেছে।
দুই লক্ষ মা-বোনের উপর অত্যাচা করা হয়েছে। রেল লাইন, রাস্তা, লঞ্চ, ট্রাক, বাস, পোর্ট শতকরা পঞ্চাশ ষাট ভাগ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। এত বড় পাষন্ড দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা যায় নাই, যা পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনীরা করেছে আমার দেশে। সেদিন যদি ভারত বর্ষ এবং তার প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী বাংলাদেশকে সহায়তা না করতো চিরদিনের মতো বাংলাদেশের মানুষের কি হতো সে কথা চিন্তা করলে শিহরীয় উঠতে হয়। আমার এক কোটি লোকরে খাবার দিয়েছে। আমার ছেলেকে সাহায্য করেছে। আমার সামরিক বাহিনীর লোকরা, আমার পুলিশ, আমার বিডিআর, আমার ছাত্র, আমার যুবক, আমার বুদ্ধিজীবী, আমার কৃষক, আমার শ্রমিক ভাইয়েরা অস্ত্র তুলে ধরেছিল।
আমি বলে গিয়েছিলাম-সাতই মার্চ তারিখে আমি বলে গিয়েছিলাম, “এবারের সংগ্রাম, স্বাধীনতার সংগ্রাম”। আমি জানতাম জীবনেও মনে হয় আমি আর আপনাদের কাছে ফিরে আসতে পারব না, যখন আমাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। কিন্তু ফিরে এসেছি। আপনারা দোয়া করেছেন। আপনারা রক্ত দিয়েছেন। আজ বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ধ্বংসস্তুপের মতো একটা দেশ পেয়েছি। মানুষের ঘরে খাবার নাই। মানুষের গায়ে কাপড় নাই। স্কুল-কলেজ ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। মালপত্র ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। কি করে আমি এ দেশকে বাঁচাবো?
আমি চিন্তা করলে শিহরীয়া উঠি। তারপরে প্রাকৃতিক দূর্যোগ। আজ আমরা কোন মতে দুনিয়া থেকে ভিক্ষা করে চাল এনেছি। একমাত্র ভারতবর্ষ আমাকে সাড়ে সাত লক্ষ টন খাদ্য দিয়েছেন। আর অন্যান্য দেশ রাশিয়া, আমার বহু রাষ্ট্র ইউএসএ, কানাডা, অষ্ট্রেলিয়া আমাকে খাবার দিয়েছেন, আমি আনছি। আমার পোর্ট নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। আমার জাহাজ নাই। আমাকে বিদেশ থেকে মাল আনতে হবে। এছাড়াও আপনারা জানেন যে, লোকের দুঃখ, আমি লোকের জন্য সংগ্রাম করেছি। এই ২৪ বৎসর এই দেশ পাকিস্তানীদের কলোনী হয়েছিল।
কি দিব আমি আপনাদের। বলেন? কি দেবার পারব? আছে কি? খাজনা? মাপ করে দিয়েছি। ২৫ বিঘা জমির খাজনা? মাপ হয়ে গেছে। গরীব কর্মচারীদের ২৫ টাকা হারে বেতন বাড়ায়া দেয়া হয়েছে। গ্রামে গ্রামে কিছু কিছু খাবার এবং রিলিফ এবং এতিমের টাকা আমি পৌঁছাইয়া দিয়েছি। আপনাদের কিছু দিবার পারি নাই। আমি মিথ্যা কথা বলতে পারি নাই। আমি ধোকা কারো দেই না। ওটা আমার অভ্যাস নাই। আর প্রধানমন্ত্রী বা মন্ত্রী হবার জন্য আমি রাজনীতি করি নাই। আমি রাজনীতি করেছিলাম আমি আমার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির জন্য।
এখন আমার রাজনৈতিক মুক্তি হয়েছে, এখন আমার অর্থনৈতিক মুক্তি প্রয়োজন। এটা না হলে স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে। বাংলার মানুষ যদি পেটভরে ভাত না খায়, যদি বাংলার মানুষ সুখে বাস না করে। বাংলার মানুষ যদি অবিচার-অত্যাচারের হাত থেকে না বাঁচতে পারে-এই স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে। সেজন্য আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, যে যেখানে আছেন, যে যে কাজে আত্মনিয়োগ করেন- আমি দেখে এলাম, সিলেটে গিয়েছিলাম, সুনামগঞ্জে আসলাম, আরো কয়েক জায়গায় যাব, বন্যায় সিলেটের সর্বনাশ হয়ে গেছে।
একেতো আমাদের পাকিস্তানের বর্বরা শেষ করে দিয়ে গেছে। তারপরে আবার বন্যায় যা কিছু ছিল শেষ করে দিয়ে গেছে। কি করব বলেন? তবে এইটুকু আপনাদের বলতে পারি, বাংলাদেশে যা কিছু আছে শুধু গরীবের জন্য। ব্যয় হবে কোন শোষকের পেটে যাবে না-এতটুকু বলতে পারি এবং যা আছে রিলিফের জন্য আপনারা চিন্তা করবেন না।
যেখান থেকে হয় ইন্শাল্লাহ পেটভরে দিবার পারব না, যতদূর পারি কিছু কিছু পৌঁছাবার চেষ্টা করা হবে। তবে কত পারব -আমি তা বলতে পারি না। কারণ আমার ব্যাংকে সেই পয়সা নাই যে আপনাদের কাছে ওয়াদা করতে পারি। কারণ ওয়াদা করে আমি বরখেলাফ করি নাই। ওয়াদা আমি করতে পারি না।তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ রইল আপনাদের একটা কাজ করতে হবে। আমি জানি আপনাদের বাড়ি ঘর নাই। আপানদের খাবার নাই। আপনারা কষ্ট করে এর মধ্যেও আসছেন। আপনাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি।
বন্যা নিয়ন্ত্রণ করতে বড় সময় লাগবে। পয়সা নাই, টাকা নাই, এখন শুধু আমি মানুষকে বাঁচাবার চেষ্টা করতাছি। যেন দু’বেলা ভাত কোন মতে খেতে পায় কিনা? খাজনা মাফ করে দিয়েছি, লবণ কর মাফ করে দিয়েছি, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনাসহ মাফ করে দিয়েছি। টাকা আমি কোথায় পাব? কোত্থেকে আসবে? হ্যাঁ বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পয়সা প্রয়োজন হবে। আপনারা কার্ড….। আমি প্রত্যেকটি গ্রামে গ্রামে টাকা দিয়েছি বিলাইয়া দিচ্ছি। বন্যা নিয়ন্ত্রণের প্ল্যান করা হচ্ছে। আমার বন্ধু ওসমানী সাহেব, জেনারেল ওসমানী এখানে আছেন। আমার ফরেন মিনিষ্টার আব্দুস সামাদ আজাদ সাহেব আছেন। এরা জানে, এরা আমার সহকর্মী। ২৪ ঘন্টা আমার সঙ্গে আছে।
একই হারে প্রত্যেকটা লোকের ১৬ ঘন্টা ১৮ ঘন্টা কার করতে হয়। কারণ কোথা থেকে জোগার করব চিন্তা করতে হয়। বন্যার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে নিশ্চয়ই। না করলে বাংলাদেশ বাঁচবে না। সুষ্ঠ প্ল্যান করে বন্যা নিয়ন্ত্রণে হাত দিতে হবে। সরকারী কর্মচারী, আওয়ামী কর্মচারী, ছাত্র ভাইয়েরা সবাইকে অনুরোধ করছি আপনারা গ্রামে গ্রামে দুঃখী মানুষের পাশে দাঁড়ান। চিন্তা কইরেন না, খাবার কিছু পৌঁছাইয়া যেভাবেই হয় দেয়া হবে।
সুষ্ঠুভাবে যেন বন্টন হয়-সেদিকে খেয়াল রাখবেন। আমি ৪০ লাখ টাকা ঘোষণা করিয়া দিলাম। দরকার হয় আরো দেয়া হবে কিছু দুঃখী মানুষের মুখে যেন হাসি ফুটে, তাই আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ। তাই আরো দরকার হয়, খাবার আপনাকে কম দিয়েছে, দরকার হয় আরো পৌঁছাইয়া দেয়া হবে। কিন্তু দেখেন যেন সুষ্ঠুভাবে বন্টন হয়। যাতে গরীব দুঃখী পায়। সেদিকে খেয়াল রাখবেন।
শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনো। বাবা মারে ইজ্জত করতে শিখো। শিক্ষকের ইজ্জত করতে শিখো। আমার মনে হয় তোমাদের মধ্য থেকে এ জিনিসটা দূর হয়ে গেছে, কোন দিন মানুষ হতে পারবানা। আমার নামের সাথে বিপ্লবী মুজিবুর রহমান বলা হতো কিন্তু আমি বেয়াদব ছিলাম না। যুবকদের ছাত্রদের অনুরোধ করি যে, মেহেরবানী করে স্লোগানটা একটু কম দিয়ে পড়ালেখা কর, আর বাবার পয়সা নষ্ট বেশী কইরনা। আর তোমাদের কাজ হচ্ছে দেশের মধ্যে কারা কারা দূর্ণীতি করে সেদিকে খেয়াল রাখা। দেশের কাজ কর। বড় বড় বক্তৃতা বাদ দাও। যখন কিছু করতে হবে আমি জান আগেও দিচ্ছি ভবিষ্যতের দিব-তোমাদের চিন্তা করতে হবে না।
আর মেহেরবানী করিয়া একটা কথা অনুরোধ করব সকলকে, ভিক্ষা করে দুনিয়া থেকে যা আনি, যাতে গরীব পায়। দূর্ণীতি যেন হয়ে টাকার কুমিড়ে যেন না খেয়ে ফেলে দেয়, সেদিকে আপনাদের খবর রাখতে হবে। গরীবের জন্য কষ্ট করে আনা হয়, মধ্য থেকে চুরি করে যেন না খাওয়া হয়। এবার বেশী সুবিধা হবে না কারণ একটু সময় লাগতাছে আমাদের-কেমন করে বদমাইশ, গুন্ডা, লুইচ্ছা, চোর দমন করতে হয়-বাংলার জনগণকে আমি অনুরোধ করছি যেমন তোমরা সামরিক বাহিনী পাকিস্তানীদের সেই দস্যুদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছিলা, এখন তোমাদের করতে হবে অত্যাচারের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, জুলুমের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে এবং তা যদি করতে হয় তাহলে যাতে ঘুষখোর, বদমাইশ, গুন্ডা, লুইচ্ছা-তাদের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ হতে হবে।
দেশের জনগণকে সংঘবদ্ধ হতে হবে। দেশের জনগণ সংঘবদ্ধ হলে পুলিশ, সরকারি কর্মচারী এবং সকলেই সাহায্য করবে।
আরও দেখুন:
![বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জুন মাস Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech 1972 June বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জুন মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech : 1972, June] 1 বঙ্গবন্ধুর ভাষণ ১৯৭২ সালের জুন মাস [ Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman Speech 1972, June]](https://sufifaruq.com/wp-content/uploads/1972/06/বঙ্গবন্ধুর-ভাষণ-১৯৭২-সালের-জুন-মাস-Bangabandhu-Sheikh-Mujibur-Rahman-Speech-1972-June.jpg)