পারিবারিক সহিংসতা আইন : অনলাইনে আমার নামের আগে ‘আওয়ামী লীগের দালাল’ বিশেষণটা যোগ করেছে অনেকে। এমন বিশেষণ পাওয়ার কারণ, অনলাইনে আমি আওয়ামী লীগ সরকারের নানান সাফল্যের কথা লাউডলি তুলে ধরি। সরকার যে ভাবে একটার পরে একটা উন্নয়ন এবং সংস্কারের কাজ করে যাচ্ছে তাতে বঙ্গবন্ধুর কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার সরকারের কথা না বলে পারি না। এ সরকারের খুরই গুরুত্বপূর্ণ একটা কাজ হল পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০।
বাংলাদেশে যতরকম সহিংসতার ঘটনা ঘটে তার বেশিরভাগই পারিবারিক সহিংসতা এর প্রত্যক্ষ শিকার নারী এবং পরোক্ষ শিকার শিশু ও পরিবারের অন্য সদস্যরা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে শহরাঞ্চলের ৫৩ শতাংশ নারী ও গ্রামাঞ্চলের ৬২ শতাংশ নারী পরিবারে তাদের স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ির আত্মীয়-স্বজন দ্বারা শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার হন। জাস্টিসমেকার্স বাংলাদেশের তথ্য অনুযায়ী ৪৩ শতাংশ নারী পারিবারিক সহিংসতার শিকার। এর মধ্যে ১১ শতাংশ যৌতুকবিষয়ক নির্যাতন। তবে তৃণমূল পর্যায়ের প্রকৃত অবস্থা আরো নাজুক।
পরিবারে শিশু নির্যাতনের হার ক্রমেই বেড়েই চলছে তা সে পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষ যেভাবেই হোক। এটি সর্বজনবিদিত যে পারিবারিক নির্যাতনে শিশুরা মারাত্মকভাবে ক্ষতির সম্মুখীন হয় এবং এর নেতিবাচক প্রভাবে তাদের মধ্যকার ক্ষত দীর্ঘস্থায়ী হয়। এতে একদিকে তারা মৌলিক অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হয়, অন্যদিকে তাদের জীবনের নিরাপত্তা এবং স্বাভাবিক ও সাবলীলভাবে বেড়ে ওঠা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে।
শুধু নিম্নবিত্তই নয়, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত সমাজের চার দেয়ালের মধ্যেও পারিবারিক সহিংসতার শিকার নারীর কান্না আটকা পড়ে যায়। দুঃখজনক হলেও সত্য, এসব নির্যাতনের ঘটনা এখনো ব্যক্তিগত বিষয় বলে বিবেচিত হয়। পারিবারিক সম্পর্ক একটি স্পর্শকাতর বিষয় হওয়ায় এই সব সহিংসতার ঘটনাগুলো বরাবরই আইনের আওতার বাইরে থেকে যায়। মাঝে মাঝে কোন সাহসী প্রতিবাদ করে। তখন, আমাদের মূলধারা গণমাধ্যমের ঘুম ভাঙে। সংবাদ, আলোচনা, পর্যালোচনার করে ইতি টানে এই বিষয়ে সচেতনতার কথা বলে। এবং বিকল্প ধারার গণমাধ্যমও ঠিকি একই কাজ করে যায়। স্ট্যাটাস, ব্লগ আর নানা ধরণের পোস্টে ভরে যায় ফেসবুক-টুইটার-আর ব্লগকম্যুনিটি। আমরা ঝাঁপিয়ে পড়ে লাইক দেই, ছি ছি লিখে কমেন্ট বাড়াই। ব্যাস এইটা করেই শেষ আমাদের সচেতনতা বাড়ানোর কাজ।
আমাদের দেশের প্রচলিত আইনেই কিন্তু এই ধরণের সহিংসতার প্রতিরোধের ও সুরক্ষার ব্যবস্থা রয়েছে। যুগান্তকরী এই আইনটা প্রণয়ন করেছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। নবম জাতীয় সংসদে পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০ পাশ হয়। জননেত্রী শেখ হাসিনার সরকার পারিবারিক সহিংসতার প্রতিকারের রাস্তা খুলে দিলেও সামাজিক ভাবে প্রচারণার এবং সচেতনর অভাবে আইনটি সম্পর্কে অনেকেই জানেন না।
‘পারিবারিক সহিংসতা’ বলতে এ আইনে পারিবারিক সম্পর্কের ভেতর কোনও ব্যক্তি দ্বারা নারী বা শিশুর ওপর শারীরিক নির্যাতন, মানসিক নির্যাতন, যৌন নির্যাতন অথবা আর্থিক ক্ষতিকে বোঝায়। এ ক্ষেত্রে ‘শারীরিক নির্যাতন’ বলতে বোঝাবে এমন কোন কাজকে, যাতে ভিকটিমের জীবন, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা বা শরীরের কোনো অঙ্গের ক্ষতি হয়। এমনকি কাউকে অপরাধমূলক কাজ করতে বাধ্য করাও শারীরিক নির্যাতনের আওতায় পড়বে। ফলে সরাসরি আক্রমণের পাশাপাশি বলপ্রয়োগ করে বা প্ররোচনা দিয়ে অপরাধ সংঘটনকেও ‘শারীরিক নির্যাতন’ হিসেবে গণ্য করা হবে।
মানসিক নির্যাতন হিসেবে দেখা হবে: অপমান, অবজ্ঞা, ভীতি প্রদর্শন করার পাশাপাশি ভিকটিম মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় এমন উক্তিকে। এছাড়া হয়রানি, স্বাভাবিক চলাচল বা ব্যক্তিগত ইচ্ছার ওপর হস্তক্ষেপকেও এই আইনে আওতাভুক্ত করা হয়েছে।
‘যৌন নির্যাতন’ বলতে এ আইনে, যৌন প্রকৃতির এমন আচরণ বুঝাবে যার কারণে ভিকটিমের সম্ভ্রম, সম্মান বা সুনামের ক্ষতি হয়। অর্থাৎ এ ব্যাখ্যায় অনাকাঙ্ক্ষিত যৌন আচরণের ফলে ভিকটিমের আত্মমর্যাদায় আঘাতকে গুরুত্ব দেয়া হয়।
আর সবশেষে ‘আর্থিক ক্ষতি’ বলতে ভিকটিমকে তার সম্পত্তি, নিত্যব্যবহার্য জিনিস, বিয়েতে পাওয়া উপহার ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত করা কিংবা অনুমতি ব্যতীত হস্তান্তর করা বোঝাবে।
পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনে আরো আছে ভিকটিমের নিরাপত্তার বিধান, প্রয়োজনে পরিবার থেকে আলাদা হয়ে নিরাপদ আশ্রয় স্থানে বসবাসের ব্যবস্থা, পুলিশ অথবা সরকারনিয়োজিত প্রয়োগকারী কর্মকর্তা দ্বারা তার প্রয়োজনীয় সেবা, চিকিৎসা, ক্ষতিপূরণ ইত্যাদি সুযোগ-সুবিধা। আবার ভিকটিম যেহেতু পারিবারিক সহিংসতার শিকার, তাই মামলা পরিচালনার মতো সামর্থ্য তার নাও থাকতে পারে। এক্ষেত্রে প্রয়োজনে তিনি যাতে ‘আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০’-এর আওতায় মামলার আর্থিক সহযোগিতা পান সেটিও নিশ্চিত করা হবে।
এছাড়া গোপনীয়তা বজায় রাখার জন্য এ আইনের আওতায় যাবতীয় বিচার কার্যক্রম ‘ক্যামেরা ট্রায়াল’ বা রুদ্ধদ্বার কক্ষে অনুষ্ঠিত হবে। এ আইনের অধীনে আদালত যদি সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে কিংবা ভবিষ্যতে ঘটার সম্ভাবনা আছে এমন কোনো সন্তোষজনক সিদ্ধান্তে পেঁৗছাতে পারেন, তাহলে ভিকটিমের সুরক্ষার জন্য প্রতিপক্ষকে নিবারণমূলক আদেশ দিতে পারেন। এ আদেশ অমান্য করলে প্রতিপক্ষকে অনধিক ৬ (ছয়) মাস কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ (দশ) হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। অপরাধ পুনরাবৃত্তির ক্ষেত্রে তাকে অনধিক ২ (দুই) বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ (এক) লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে। তবে আদালত যথার্থ মনে করলে এই শাস্তি না দিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠানের তত্ত্বাবধানে সমাজকল্যাণমূলক কাজে অংশ নেয়ার নির্দেশ দিতে পারেন। এ আইনের আরেকটি বিশেষ বিধান হল, প্রতিপক্ষের ক্ষতি করার উদ্দেশ্যে মিথ্যা মামলা করলে বাদী পক্ষের এক বছর কারাদণ্ড এবং ৫০,০০০ টাকা জরিমানা হতে পারে।
দুঃখের বিষয়, আমাদের আশেপাশে এমন নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইনের কোনও প্রয়োগ নিয়ে আমাদের কারো কোন মাথা ব্যথা নেই। সরকার এই আইনটি সম্পর্কে সর্বস্তরের জনগণকে জানানোর উদ্যোগ গ্রহণ করলেও আমার-আপনার অসচেতনতার জন্য আইনটি এখনও কাগুজে আইনে পরিণত হয়ে আছে। আর এই কারণে পারিবারিক সম্পর্কের মাঝে কেউ কেই শিকার হচ্ছে নির্যাতনের।
আসুন না আমরা সচেতন হই। নীরবে এই নির্যাতন সহ্য না করে প্রতিরোধ করি। এজন্য আপনাকে প্ল্যাকার্ড নিয়ে পথে নামতে হবে না। ভাঙতে হবে না কোন গাড়ীর কাঁচ। শুধু নিজে এই আইন সম্পর্কে জানুন। এর পরে, জানান আপনার স্বজনদের। যখন আপনার পরিবারের মধ্যে অথবা কাছের কেও যদি এই রকম সহিংসতার শিকার হয় তাকে / তাদের কে জানান যে, তাঁদের জন্য সরকার আইন করে রেখেছে। যিনি এমন সহিংস কর্মকাণ্ড করে তাকে জানান, এই সব অপরাধের জন্য কি ভয়ঙ্কর শাস্তি তার জন্য অপেক্ষা করছে। সমাজের নেতৃত্বস্থানীয়দের সচেতন করুন এই আইন সম্পর্কে, যেন তারা এই বিষয়ে আইনগত ভাবে সহায়তা করতে পারেন। তৃণমূল পর্যায়ের জনপ্রতিনিধিদের (পৌর কাউন্সিলার- ইউপি মেম্বার) সরাসরি প্রশ্ন করুন এই আইন সম্পর্কে কতটুকু জানেন। তাদের উদ্বুদ্ধ করুন পারিবারিক সহিংসতার শিকার অসহায় শিশু-নারীদের সহায়তা করতে। ‘পারিবারিক সহিংসতা (প্রতিরোধ ও সুরক্ষা) আইন ২০১০’ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের লেজিসলেটিভ ও সংসদ বিষয়ক বিভাগের ওয়েবসাইটে গিয়ে। (আইনটির শর্টকাট লিঙ্ক http://goo.gl/GQx40g)। আপনার আমার সচেতনতা পারিবারিক সহিংসতা থেকে রক্ষ করতে পারে অসহায় নারী-শিশুদের। পরিবারের উপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে আমাদের মানব সভ্যতা। এজন্য পরিবারকে বলা হয় কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান। মানুষের সাথে অন্যান্য প্রাণীর পার্থক্য হল ‘পরিবার’। মানুষ পরিবার প্রথা লালন করে, অন্যান্য পশু-প্রাণী তা করে না। কিন্তু কিছু সময় এই মানুষই সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সবচে গুরুত্বপূর্ণ এবং নিরাপদ জায়গা পরিবারের ভেতরেই হিংস্র পশুর থেকে ভয়ঙ্কর ভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে অসহায় নারী এবং শিশুর উপর।আসুন নীরবে দুঃখ বিলাস না করে, এই দুঃখটি নির্মূলের কাজে নামি।
