ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ববাসীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তথ্য জানাতে বিশ্ব সফর করেন

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আধুনিক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, স্যাটেলাইট টিভি বা ডিজিটাল সংবাদ প্রচারের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। ফলে বাংলাদেশের রণাঙ্গনে আসলে কী ঘটছে—তা বহির্বিশ্বে পৌঁছানো ছিল অত্যন্ত কঠিন। কেবলমাত্র অল্প কিছু আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের মাধ্যমে আংশিক তথ্য ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার মানুষের কাছে পৌঁছাত। এই সীমাবদ্ধতাকে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও তাদের মিত্ররা অপপ্রচার চালাতে থাকে। তারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধকে “গৃহযুদ্ধ” বলে প্রচার করে এবং দাবি করে যে, “বাংলার মাটিতে কোনো গণহত্যা বা ধর্ষণ হয়নি, পাকিস্তানি সেনারা কেবল কিছু দুষ্কৃতকারীকে দমন করছে।” এভাবে পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডার কারণে বিশ্বের বহু রাষ্ট্রই প্রকৃত পরিস্থিতি সম্পর্কে অজ্ঞাত রয়ে যায়।

 

ইন্দিরা গান্ধীর উদ্যোগ

এই ভয়াবহ বাস্তবতা অনুধাবন করে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ববাসীর সামনে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। তিনি জানতেন, লাখো মানুষের হত্যা, নারীদের উপর সংঘবদ্ধ ধর্ষণ এবং প্রায় এক কোটি উদ্বাস্তু বাঙালির মানবেতর পরিস্থিতি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে তুলে ধরা জরুরি। তাই তিনি নিজেই বিশ্ব সফরে বের হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যাতে পাকিস্তানি প্রোপাগান্ডাকে মোকাবিলা করা যায় এবং মুক্তিকামী বাঙালিদের পাশে বিশ্ব জনমতকে দাঁড় করানো যায়।

বিশ্ব সফর ও কূটনৈতিক কার্যক্রম

১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর, ইন্দিরা গান্ধী ১৯ দিনের বিশ্ব সফরে বের হন। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানের সাথে বৈঠক করেন। তিনি বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া, ব্রিটেন, ফ্রান্স, জার্মানি এবং যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন।

৪ ও ৫ নভেম্বর, মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন-এর সঙ্গে বৈঠকে তিনি বাংলাদেশের পরিস্থিতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরেন। যদিও নিক্সন মুক্তিযুদ্ধকে “গৃহযুদ্ধ” হিসেবে হালকাভাবে দেখানোর চেষ্টা করেছিলেন, ইন্দিরা গান্ধী এর তীব্র প্রতিবাদ জানান।

৬ নভেম্বর, যুক্তরাষ্ট্রের কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি বিশ্ববাসীর উদ্দেশে বলেন:

“২৫ মার্চ পাকিস্তানি সেনারা পূর্ববাংলায় নারকীয় হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। লক্ষ লক্ষ মানুষ চরম নির্যাতনের শিকার হয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। তাদের নেতা শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানে পাঠানো হয়েছে। এখন পূর্ববাংলার মানুষ স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার, এবং পরিস্থিতি তাদের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।”

৭ নভেম্বর ফ্রান্স সফরের আগে পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান তার সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তাব দেন, কিন্তু তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। এই সিদ্ধান্তই প্রমাণ করে, ইন্দিরা গান্ধী ছিলেন মুক্তিকামী বাঙালিদের অকৃত্রিম বন্ধু ও অবিচল সমর্থক।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া

ইন্দিরা গান্ধীর এই বিশ্ব সফরের ফলেই মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র বিশ্বমঞ্চে পৌঁছায়। ফলে আন্তর্জাতিক গণমত বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত হতে শুরু করে। জাতিসংঘ, বিশ্ব শান্তি সংঘ এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে তার একাধিক বৈঠক মুক্তিযুদ্ধে ভারতের কূটনৈতিক অবস্থানকে দৃঢ় করে। বিশেষত সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থনের কারণে চীন ও যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের পক্ষে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিতে ভয় পায়।

বিশ্ববাসীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তথ্য জানাতে বিশ্ব সফর করেন ইন্দিরা গান্ধী
বিশ্ববাসীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত তথ্য জানাতে বিশ্ব সফর করেন ইন্দিরা গান্ধী

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্ব সফর এক অনন্য অধ্যায়। তার দৃঢ় কূটনৈতিক ভূমিকার কারণেই মুক্তিযুদ্ধ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বৈধতা পায় এবং বিশ্ব জনমত মুক্তিকামী বাঙালিদের পাশে দাঁড়ায়। ফলে পাকিস্তানি সেনাদের পরাজয় নিশ্চিত হয় এবং দীর্ঘ দুই যুগের দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে মুক্তি লাভ করে বাঙালি জাতি।