রাগ মালকোষ । অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ

রাগ মালকোষ উত্তর ভারতের এক অতি প্রাচীন ও জনপ্রিয় রাগ। মাত্র পাঁচটি স্বর ব্যবহৃত হলেও (সা, কোমল গা, শুদ্ধ মা, কোমল ধা এবং কোমল নি) এটি একটি পূর্ণাঙ্গ ও বিশাল মাপের রাগ হিসেবে বিবেচিত। এর বৈশিষ্ট্য হলো—প্রায় প্রতিটি স্বরে দাড়ানো যায় এবং অধিকাংশ স্বর একে অপরের সাথে জোড়া করে ব্যবহার করা সম্ভব। ফলে রাগটির আঙ্গিক ভীষণ বিস্তৃত ও বৈচিত্র্যময়।

এই রাগে ধ্রুপদ, খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা সঙ্গীত থেকে শুরু করে আধুনিক গায়ন-বাদন—সব ধরনের সঙ্গীত পরিবেশিত হয়েছে। শুধু তাই নয়, রাগ মালকোষের গঠনশৈলীকে কেন্দ্র করে একাধিক নতুন রাগের জন্মও হয়েছে, যা তার ঐতিহ্য ও প্রভাবের প্রমাণ বহন করে।

 

রাগ মালকোষ । অসুরের সুরলোকযাত্রা সিরিজ

 

রাগ মালকোষ

 

প্রকৃতি ও স্বরবিন্যাস

  • ঠাট: ভৈরব ঠাট

  • প্রকৃতি: গম্ভীর, ধীরগম্ভীর, গভীর ভাবসম্পন্ন। সাধারণত নিশীথে (রাত্রির গভীর প্রহরে) গাওয়া ও বাজানো হয়।

  • স্বরসমূহ: সা, কোমল গা, শুদ্ধ মা, কোমল ধা, কোমল নি

  • বাদী: মধ্যম (মা)

  • সমবাদী: সা (ষড়জ)

মাত্র পাঁচটি স্বর ব্যবহারের কারণে রাগটির জাতি ঔড়ব–ঔড়ব

আরোহ–অবরোহ

  • আরোহ: নিৃ সা গা মা ধা নি র্সা

  • অবরোহ: র্সা নি ধা মা গা সা (বা র্সা নি ধা মা গা সা)

এখানে নিৃ (নি রি-সা) থেকে সূচনা রাগটির স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য।

পাকড়

রাগটির পাকড় (স্বাতন্ত্র্যসূচক স্বরসমষ্টি) মূলত—
গা মা ধা নি মা গা সা, নি ধা মা গা মা সা
এতে রাগটির আঙ্গিক ও আবহ তৎক্ষণাৎ প্রকাশ পায়।

বিশেষত্ব

  • রাগটির আবেগ গভীর, ধীর এবং ধ্যানমূলক। একে সাধারণত ভক্তি, শ্রদ্ধা এবং অনন্ততার অনুভূতির সাথে যুক্ত করা হয়। গভীর রাতের ধ্যান, ভক্তি ও গম্ভীর আবহ তৈরি করার জন্য এটি অদ্বিতীয়।

  • এর সুরেলা রূপকে অনেক সময় “তন্ত্রকারদের প্রিয় রাগ” বলা হয়, কারণ বাদনে এটি বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করে।

  • রাগ মালকোষের উপর ভিত্তি করে যেমন ঝিঝোটি মালকোষ, চান্দ্রকোষ, হংসকোষ প্রভৃতি রাগের উদ্ভব হয়েছে।

  • রাগ মালকোষ “পেন্টাটনিক” বা পাঁচ স্বরের রাগ হওয়া সত্ত্বেও তার মাধুর্য অসীম।

  • প্রাচীন ভারতীয় সংগীত তত্ত্বে এই রাগকে “প্রকৃতি রাগ” হিসেবে ধরা হয়—অর্থাৎ অন্য রাগের জন্মদাতা।

 

ইতিহাস ও কিংবদন্তি

  • প্রাচীনতা: মালকোষকে অনেকেই “গান্ধারব বিদ্যার মূল রাগ” হিসেবে মনে করেন। এর অস্তিত্ব কয়েক হাজার বছরের পুরোনো।

  • তানসেনের কিংবদন্তি: সম্রাট আকবরের দরবারি গায়ক মিয়ান তানসেন নাকি মালকোষ গেয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে প্রভাব বিস্তার করতে পারতেন—এমন লোককথা প্রচলিত। বলা হয়, তিনি এই রাগ গেয়ে দীপশিখা জ্বালাতে বা বন্য পশুকে শান্ত করতে পারতেন। যদিও এগুলো কল্পকথা, তবে রাগটির শক্তি ও মর্যাদার প্রতীক।

  • উৎপন্ন রাগসমূহ: রাগ মালকোষ থেকে ঝিঝোটি মালকোষ, চান্দ্রকোষ, হংসকোষ প্রভৃতি নতুন রাগের জন্ম হয়েছে।

 

প্রসিদ্ধ বন্দিশ (উদাহরণ)

১. ধ্রুপদ: “চারণ কুম্ভ নাচত গোপালা”

২. খেয়াল: “বলো হে বনবিহারী”

৩. ঠুমরি: “মোরা বালম ন বারসত”

 

আরোহ-আবরোহ এই লিঙ্ক গুলোতে গিয়ে শুনে নিতে পারেন । লিংক ১  ।

 

কাজী নজরুল ইসলামের গানে রাগ মালকোষ:

নজরুলের অনেক গান রাগাশ্রয়ী। নির্দিষ্ট রাগের আশ্রয়ে যে গানগুলোতে সুর করা হয়েছে, সেগুলোর পুরো সুরে রাগের অবয়ব বজায় রাখার চেষ্টা থেকেছে; খুব বেশি রাগভ্রষ্ট হয়নি। তাই নজরুলের গানগুলো কান তৈরিতে বেশি উপযোগী বলে আমার কাছে মনে হয়।

১. ফিরোজা বেগমের : গরজে গম্ভীর গগনে কম্ভু

২. অজয় চক্রবর্তী- শ্মশানে জাগিছে শ্যামা মা

 

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের গানে রাগ মালকোষ:

কবিগুরু তার অনেক কম্পোজিশনে প্রচলিত রাগের আশ্রয় নিলেও অনেক সময় রাগের কাঠামোতে তিনি আটকে থাকতে চাননি। তাঁর সুরের পথ রাগের বাইরে চলে গেছে প্রায়শই। আমার কাঁচা কান যা বলে, তাতে বিশুদ্ধ রাগাশ্রয়ী গান হিসেবে তাঁর গান অনেক ক্ষেত্রেই খুব ভালো উদাহরণ নয়।

১. ট্যাগর কাভার প্রডাকশনের – আনন্দধারা বহিছে ভুবনে (মিশ্র)

পুরো মালকোষে রবীন্দ্রনাথের কোন গান নেই। এই বিষয়ে সমীর সেনগুপ্ত লিখছেন — “আর এইখানেই ভারতীয় সঙ্গীতের ঐতিহ্য থেকে রবীন্দ্রনাথ দূরে সরে যান। ইনি গান রচনা করেছেন, কিন্তু মালকোষে গান রচনা করেন নি। রবিশংকর যখন দু-ঘণ্টা মালকোষ বাজিয়ে ওঠেন, তখন তাঁকে কেউ জিজ্ঞাসা করে না ‘মশাই, এই যে দু-ঘণ্টা মালকোষ বাজালেন, ঠিক কি বলতে চাইলেন বলুন তো?’ সেটা যতোখানি বেয়াদবি হবে, ততখানিই বেয়াদবি হবে রবীন্দ্রনাথের কোন গান, যেটা মালকোষের মত লাগছে, কিন্তু স্বর সবসময় মালকোষের মত চলছে না, বা কোথাও এমন পর্দা লাগছে যেটা মালকোষে লাগে না, সেটা মালকোষ হচ্ছে না বলে প্রতিবাদ করা; কারণ রবীন্দ্রনাথ মালকোষে গান বাঁধেন নি। এবং সেখানেই তিনি রবীন্দ্রনাথ হয়ে উঠেছেন যেখানে তিনি মালকোষ থেকে সরে গেছেন।”

রাগ মালকোষ - Ragmala Painting of Malkauns Raga
Ragmala Painting of Malkauns Raga

আধুনিক গানে রাগ মালকোষ:

১. হৈমন্তি শুক্লার কি গান শোনাবো বলো ওগো সুচরিতা

২. অমিতাভ ঘোষের গান – মধুরাত বয়ে যাবে

৩. শচীন দেববর্মনের – আমি ছিনু একা, বাসর জাগায়ে (কথা: শৈলেন রায়, সুর: হিমাংশু দত্ত)

 

গজলে  রাগ মালকোষ:

১. ওস্তাদ মেহদি হাসান – খাব থা ইয়া খায়াল

২. জগজিৎ সিং ও অনুপ জালোটা – পাগ ঘুংরু বাধে মিরা নাচে

৩. ওসমান মীর – নিন্দ রাতো কো

৪. জসবিন্দার সিং – রাজ এ উলফাত

৫. ফরিদ আহমেদ – দারদে জিগার কি সিনে মে

৬. কবি আসলাম নাভেদের প্রইভেট গজল আড্ডা – দিল কি বাত লাবো পার লা কার আবতাক হাম

 

হিন্দি ফিল্মের গানে রাগ মালকোষ:

১. Mann Tadpat – Mohammad Rafi

২. Aaye Sur Ke Panchhi Aaye (Film – Sur Sangam (1985)), Tal – Tintal, Music Director(s) – Laxmikant, Pyarelal, Singer(s) – Rajan Mishra

৩.

 

মালকোষে গীত:

ওস্তাদ বড় ফাতেহ আলী খান – পেয়ার নেহি হ্যায় সুরসে জিসকো

 

ঠুমরিতে  রাগ মালকোষ:

১. ওস্তাদ গোলাম আলী – আজ মোরি ঘার

 

ভজনে মালকোষ:

১.

 

চেতনা সঙ্গীত:

১. ১. মতুয়া গানের অ্যালবাম- “তোমার অমৃত বানী ” এর- দিয়েছো দিশা তুমি (কথা ও সুর – পবিত্র বিশ্বাস, কণ্ঠ – অন্তরা বিশ্বাস, রাগ – মালকোষ , তাল – আদ্ধা)।

 

মালকোষে জিনান (শিয়া ইসলাইলীদের ভক্তি সঙ্গীত):

১. আবিদা পারভীন – আয়ে আয়ে রহীম রহমান

 

অন্যান্য:

১.

 

যন্ত্রে মালকোষ:

সেতার:

১. ইমদাদখানী ঘরানার শহীদ পারভেজ খানের সেতারে – মালকোষ

 

সাঁনাই:

১. ওস্তাদ বিসমিল্লাহ খানের – মালকোষ

 

সরদ:

১.মাইহার ঘরানার খলিফা ওস্তাদ আলী আকবর খানের সরদে- মালকোষ

২. ওস্তাদ আমজাদ আলী খানের – মালকোষ

 

খেয়াল:

১. রামপুর সহসওয়ান ঘরানার ওস্তাদ রশিদ খানের – মালকোষ

২. আমীর খান সাহেব এর- মালকোষ

৩. পণ্ডিত কুমার গান্ধর্বের কেদার – মালকোষ

৪. ওস্তাদ বড় গোলাম আলী খান সাহেব এর – মালকোষ

৫. ওস্তাদ আমানত আলী ও বড় ফাতেহ আলী খাঁ সাহেবের – মালকোষ

৪. জয়পুর ঘরানার শিল্পী কিশোরী আমনকারের গলায় – মালকোষ

৫. পণ্ডিত মুকুল শিবপুত্রের- মালকোষ

৬. সন্ধ্যা মুখপাধ্যায় এর মালকোষ – এ আয়ে পিয়া মান্দেরওয়া

 

টিউটোরিয়াল:

যেকোনো রাগের স্বরের চলাফেরা বোঝার জন্য ২/৫ টি স্বর-মালিকা বা সারগম-গীত শোনা দরকার। স্বর মল্লিকার পাশাপাশি দু একটি  লক্ষণ গীত (বা ছোট খেয়াল) শুনলে সহজ হতে পারে। লক্ষণ গীত মূলত শেখানো হয় রাগের লক্ষণগুলো সহজে ধরতে। লক্ষণ গীত ছোট খেয়াল প্রায় একই কাজ করে। অনলাইনে অনেক গুলো আছে। একটু খোঁজাখুঁজি করলে পেয়ে যাবেন। স্যাম্পল হিসেবে নিচের দুটো লিংক দেয়া হল।

১. রাগ মালকোষ এর স্বরমল্লিকা

২. এনিসিআরটির টিউটোরিয়াল

৩. পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের “গান শিখি, গান গাই” টিউটোরিয়াল

৪. পন্ডিত জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের “গান শিখি, গান গাই” টিউটোরিয়াল ২

 

রিলেটেড রাগ:

চন্ত্রকোষ

 

মালকোষ সম্পর্কে আরও জানার জন্য:

১. উইকি আর্টিকেল

২. অটোমেটেড ট্রান্সক্রিপশন প্রজেক্ট এর- মালকোষ কেদার

 

রাগ মালকোষ ছাড়াও সিরিজের অন্যান্য আর্টিকেল সূচি: